কবি হতে গেলে ইতিহাস সচেতনতার প্রয়োজন হয় না। প্রেম ও প্রকৃতির ওপর কবিতা লিখেও, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা লিখেও কবি হওয়া যায়। কিন্তু কবি যখন কাল-সচেতন, রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন, তখন তাঁকে ইতিহাস-সচেতনও হতে হয়। ক্রমপরিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে আজকের মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে। ফলে পরম্পরাগত সূত্র একটি কালের সঙ্গে অন্য কালের, একটি যুগের সঙ্গে অন্য যুগের, একটি শতাব্দীর সঙ্গে অন্য শতাব্দীর যেমন সম্বন্ধ-সূত্র আছে; তেমনি দেশের সঙ্গে দেশের, জাতির সঙ্গে জাতির, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ আছে।
মানুষের সমাজে কোনো এককালে শতকরা একশ’ ভাগ ফেরেশতা ছিল না। মানুষকে অধিকাংশ সময় শয়তান, দানব ও দৈত্যদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এই দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষের টিকে থাকার ও সভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং তাকে নির্মাণ করার কাহিনী ইতিহাস, মানুষের সম্পূর্ণ পরিবারের জন্য এই ইতিহাস জানার প্রয়োজন। আল কোরআনে মানুষের শিক্ষার জন্য যেসব বিষয় আছে তার মধ্যে ইতিহাসের দৃষ্টান্ত একটি বিষয়। মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য লাভের দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষকে এই জন্যে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে তারা ভুল না করে এবং ভুল করে যেন তারা নিজেদের সর্বনাশ না ডেকে আনে।
বড় ও মহত্ কবিরা ইতিহাসকে নানাভাবে ব্যবহার করেন। কেউ উপমা ও উেপ্রক্ষার প্রয়োজনে, জাতীয় মানসকে উদ্দীপ্ত করার জন্য, নিজের চিন্তাদর্শের ব্যাখ্যার জন্য এবং দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য। কেবল উপমা সৃষ্টির জন্য যখন ইতিহাস ব্যবহৃত হয়, তখন সেটা ইতিহাস সচেতনতা হয় না; ইতিহাস সচেতনতা হয় তখন যখন সমকালের রূপকে চিহ্নিত করার জন্য ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই এ কাজটি অত্যন্ত সার্থকভাবে রূপায়িত করেন।
মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ বীরবাহুর মৃত্যুর তুলনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
পড়িয়াছে বীরবাহু—বীর-চূড়ামণি,
চাপি রিপুচয় বলী, পড়েছিল যথা
হিড়িম্বার স্নেহনীড়ে পালিত গরুড়
ঘটোত্কচ, যবে কর্ণ, কালপৃষ্ঠধারী
এড়িলা একাঘ্নী বাণ রক্ষিতে কৌরবে।
এখানে কাব্যের সৌন্দর্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ঘটনার ব্যাখ্যায় আরেকটি ঘটনার সাদৃশ্যধর্মী তুলনা দেয়া হয়েছে। তার অতিরিক্ত কোনো বক্তব্য এখানে নেই। পাঠককে কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এখানে প্রধাবিত করা হচ্ছে না। সুতরাং ইতিহাস সচেতনতা বলতে যেটা বোঝায়, তার স্বরূপ এখানে অনুপস্থিত। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথের ‘আমরা’ কবিতায় আমরা যখন পড়ি,
আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
এক হাতে মোরা মগেরি রুখেছি মোগলেরে আর হাতে
চাঁদ প্রতাপের হুকুমে হটিতে হয়েছে দিল্লীনাথে।
তখন সেখানে ইতিহাস সচেতনতা দেখলেও কালের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের শিক্ষার ইঙ্গিত দেখি না—এখানে ইতিহাসের স্মরণে উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য লক্ষ করি। সমাজ-চরিত্রের সমালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজের রূপ পরিবর্তনে ইতিহাসকে ব্যবহার করে ইতিহাস সচেতনতার পরিচয়টা নজরুলে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠল। নজরুল যখন লিখলেন,
নব-জীবনের ফোরাত-কূলে গো কাঁদে কারবালা তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া য়ুরোপ-এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা আব্বাস সম পানি আনি প্রাণপণ করি।
যখন জালিম ফেরাউন চাহে মুসা ও সত্যে মারিতে, ভাই,
নীল দরিয়ার মোরা তরঙ্গ, বন্যা আনিয়া তারে ডুবাই।
আজো নমরুদ ইব্রাহীমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই,
আনন্দ-দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুষ্প-মঞ্জুরী।
তখন দেখা গেল একটি অতীত ইতিহাসের দৃষ্টান্তে তিনি সমকালকে ব্যাখ্যা করছেন।
সমকালীন সমাজে নজরুল যে দুর্দশা দেখেছেন নজরুল দেখাচ্ছেন সে দুর্দশা অতীতে ছিল; অতীতের মানুষের সংগ্রাম ও প্রতিরোধ-বিপ্লব তাদের সে দুর্দশা থেকে মুক্ত করেছে। বর্তমানে দানবদলিত পৃথিবীও সেইভাবে সংগ্রামের দ্বারা মুক্ত হবে। নজরুলের বিখ্যাত ‘চল্ চল্ চল্’ সঙ্গীতটির শেষ চারটি স্তবক এমনি,
ঊর্ধ্বে আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ্কাওয়াজ,
খোল্ রে নিঁদ মহল!
কবে সে খোয়ালি বাদশাহী
সেই সে অতীতে আজো চাহি
যাস্ মুসাফির গান গাহি
ফেলিস্ অশ্রুজল।
যাক্ রে তখ্ত-তাউস
জাগ্ রে জাগ্ বেহুঁশ!
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রীক রুশ!
জাগিল তারা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধূলায় তাজমহল!
ইতিহাসে আমরা দেখেছি এক একটা দেশ ও জাতি ক্ষীণ দুর্বল অবস্থা থেকে এক দিন সবল শক্তিমান অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। আবার সম্পন্ন অবস্থা থেকে দরিদ্র অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। আবার দরিদ্র ও বিপন্ন অবস্থা থেকে পরাক্রমশালী জীবনে ফিরে এসেছে। অধঃপতিত ও পশ্চাত্পদ মুসলিম সমাজকে তারই দৃষ্টান্ত দেখাতে নজরুল রোম, গ্রিস, রাশিয়া ও পারস্যের কথা উল্লেখ করলেন এবং জানিয়ে দিলেন যে, ধ্বংসের ভস্মস্তূপ থেকে তারা যদি উঠে আসতে পারে, তাহলে তোমরা উঠে আসতে কেন পারবে না। সুতরাং বাদশাহী হারানোর দুঃখে অশ্রু নিষ্কাশন না করে আবার ঘুম ভেঙে জেগে ওঠো। ইতিহাসের গতিধারা বলে দেয় যে পতনের পর উত্থান আছে। সুতরাং আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদেরও উত্থান হবে এবং নতুন জাগ্রত ও পরাক্রমশালী জাতিতে আমরা আবার পরিণত হবো।
এ কথা সবাই জানে বা এখন জেনেছে যে, নজরুলের কাব্যের ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতা রাজনীতি আশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। কবিতায় রাজনীতির প্রশ্রয় দেয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে এক সময় তাঁর কবিত্ব শক্তির অপচয় হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যদিও পূর্বে রবীন্দ্রনাথ সেটারও প্রয়োজন আছে মনে করে তাঁকে আশীর্বাদও জানিয়েছিলেন।
এ ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে বলে দেয় যে এই সাহসী কাজটা অথবা বলা যায় এই মৌলিক কাজটা নজরুলের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নজরুল বুঝেছিলেন জীবন ও জগতের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মূলে কাজ করছে রাজনীতি। মানুষের খুশির জন্য তাই তার বৃত্তের বাইরে থেকে কোনো সংগ্রাম সম্ভব নয়। সমাজ ব্যাধির মূলে যদি রাজনীতি কারণ হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেই কারণকে করে তুলতে হবে কবিতার বিষয়। ‘নবযুগে’র প্রথম সম্পাদকীয়তে নজরুল লিখেছিলেন,
নরে আর নারায়ণে আজ আর ভেদ নাই। আজ নারায়ণ মানব। তাঁহার
হাতে স্বাধীনতার বাঁশী। সে বাঁশীর সুরে সুরে নিখিল মানবের অণু-
পরমাণু ক্ষিপ্ত হইয়া সাড়া দিয়েছে। আজ রক্ত-প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব
নব প্রভাতী ধরিয়াছে—‘পোহাল পোহাল বিভাবরী/পূর্ব তোরণে শুনি
বাঁশরী! এ সুর নবযুগের। সেই সর্বনাশা বাঁশরীর সুর রুশিয়া শুনিয়াছে,
আয়ারল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে, আরো অনেকে শুনিয়াছে, এবং
সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের হিন্দুস্তান জর্জরিত নিপীড়িত শৃঙ্খলিত
ভারতবর্ষ।’
নজরুলের সমাজ-সচেতন দৃষ্টি বুঝেছিল যে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জাতি যেভাবে সচেতন সংগ্রামের দ্বারা বন্ধনের শিকল কেটে বেরিয়ে আসছে, একই প্রক্রিয়ায় উপমহাদেশের মানুষের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। উপলব্ধিগত এই চেতনা দিয়েই নজরুল তাঁর কবিতার মশাল জ্বালিয়ে তুলেছিলেন।
তাই তিনি সব দুঃশাসন ও দুঃশাসকদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র শ্রেষ্ঠ অবলম্বন ভেবেছিলেন। ইতিহাস থেকেই তিনি জেনেছিলেন। ফেরাউনের হাত থেকে মুসা (আ.), কোরেশদের হাত থেকে মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ করেই নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করেছিলেন, ইতিহাস থেকেই তিনি দেখেছিলেন অন্যায় রোধ করতে রাবণের বিরুদ্ধে রামকে, কংসের বিরুদ্ধে কৃষ্ণকে, কৌরবের বিরুদ্ধে পাণ্ডবকে, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হোসেন (রা.)-কে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
এই যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যযুগের সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রোমীয় ও পারসিদের মুক্তি ঘটেছিল, জারের হাত থেকে মুক্তি ঘটেছিল নির্যাতিত রুশদের, গ্রিসের হাত থেকে মুক্তি ঘটেছিল তুরস্কের। নজরুল ভেবেছিলেন এই যুদ্ধের মাধ্যমেই তাই উপমহাদেশেরও মুক্তি ঘটবে।
নজরুল দেখেছিলেন তাঁর সমকালীন বিশ্বে আজাদী লাভের জন্য বিভিন্ন মুক্তিকামী গোষ্ঠী, দেশ, জাতি বা সম্প্রদায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আদিকাল থেকে মানুষ ও মানবসভ্যতাকে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও মানুষকে ও মানবসভ্যতাকে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে। জীবনের অস্তিত্বের জন্য তাই নজরুল যুদ্ধকে মানব জীবন-দর্শন বলে গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষা ও ইতিহাস সচেতনতাই নজরুলকে এই তাত্ত্বিক বোধে দীক্ষা দিয়েছিল; এবং তিনি তাঁর কাব্যের রক্ত-কণিকায় এই শিক্ষাকে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করেননি।
শাহাবুদ্দীন আহ্মদের ‘বহুরূপে নজরুল’ (বাংলা সাহিত্য পরিষদ, জুলাই ১৯৯৯) থেকে পুনর্মুদ্রিত
মানুষের সমাজে কোনো এককালে শতকরা একশ’ ভাগ ফেরেশতা ছিল না। মানুষকে অধিকাংশ সময় শয়তান, দানব ও দৈত্যদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এই দানবের সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষের টিকে থাকার ও সভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং তাকে নির্মাণ করার কাহিনী ইতিহাস, মানুষের সম্পূর্ণ পরিবারের জন্য এই ইতিহাস জানার প্রয়োজন। আল কোরআনে মানুষের শিক্ষার জন্য যেসব বিষয় আছে তার মধ্যে ইতিহাসের দৃষ্টান্ত একটি বিষয়। মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য লাভের দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষকে এই জন্যে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে তারা ভুল না করে এবং ভুল করে যেন তারা নিজেদের সর্বনাশ না ডেকে আনে।
বড় ও মহত্ কবিরা ইতিহাসকে নানাভাবে ব্যবহার করেন। কেউ উপমা ও উেপ্রক্ষার প্রয়োজনে, জাতীয় মানসকে উদ্দীপ্ত করার জন্য, নিজের চিন্তাদর্শের ব্যাখ্যার জন্য এবং দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য। কেবল উপমা সৃষ্টির জন্য যখন ইতিহাস ব্যবহৃত হয়, তখন সেটা ইতিহাস সচেতনতা হয় না; ইতিহাস সচেতনতা হয় তখন যখন সমকালের রূপকে চিহ্নিত করার জন্য ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই এ কাজটি অত্যন্ত সার্থকভাবে রূপায়িত করেন।
মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ বীরবাহুর মৃত্যুর তুলনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,
পড়িয়াছে বীরবাহু—বীর-চূড়ামণি,
চাপি রিপুচয় বলী, পড়েছিল যথা
হিড়িম্বার স্নেহনীড়ে পালিত গরুড়
ঘটোত্কচ, যবে কর্ণ, কালপৃষ্ঠধারী
এড়িলা একাঘ্নী বাণ রক্ষিতে কৌরবে।
এখানে কাব্যের সৌন্দর্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ঘটনার ব্যাখ্যায় আরেকটি ঘটনার সাদৃশ্যধর্মী তুলনা দেয়া হয়েছে। তার অতিরিক্ত কোনো বক্তব্য এখানে নেই। পাঠককে কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এখানে প্রধাবিত করা হচ্ছে না। সুতরাং ইতিহাস সচেতনতা বলতে যেটা বোঝায়, তার স্বরূপ এখানে অনুপস্থিত। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথের ‘আমরা’ কবিতায় আমরা যখন পড়ি,
আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
এক হাতে মোরা মগেরি রুখেছি মোগলেরে আর হাতে
চাঁদ প্রতাপের হুকুমে হটিতে হয়েছে দিল্লীনাথে।
তখন সেখানে ইতিহাস সচেতনতা দেখলেও কালের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের শিক্ষার ইঙ্গিত দেখি না—এখানে ইতিহাসের স্মরণে উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য লক্ষ করি। সমাজ-চরিত্রের সমালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজের রূপ পরিবর্তনে ইতিহাসকে ব্যবহার করে ইতিহাস সচেতনতার পরিচয়টা নজরুলে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠল। নজরুল যখন লিখলেন,
নব-জীবনের ফোরাত-কূলে গো কাঁদে কারবালা তৃষ্ণাতুর,
ঊর্ধ্বে শোষণ-সূর্য, নিম্নে তপ্ত বালুকা ব্যথা-মরুর।
ঘিরিয়া য়ুরোপ-এজিদের সেনা এপার, ওপার, নিকট, দূর,
এরি মাঝে মোরা আব্বাস সম পানি আনি প্রাণপণ করি।
যখন জালিম ফেরাউন চাহে মুসা ও সত্যে মারিতে, ভাই,
নীল দরিয়ার মোরা তরঙ্গ, বন্যা আনিয়া তারে ডুবাই।
আজো নমরুদ ইব্রাহীমেরে মারিতে চাহিছে সর্বদাই,
আনন্দ-দূত মোরা সে আগুনে ফোটাই পুষ্প-মঞ্জুরী।
তখন দেখা গেল একটি অতীত ইতিহাসের দৃষ্টান্তে তিনি সমকালকে ব্যাখ্যা করছেন।
সমকালীন সমাজে নজরুল যে দুর্দশা দেখেছেন নজরুল দেখাচ্ছেন সে দুর্দশা অতীতে ছিল; অতীতের মানুষের সংগ্রাম ও প্রতিরোধ-বিপ্লব তাদের সে দুর্দশা থেকে মুক্ত করেছে। বর্তমানে দানবদলিত পৃথিবীও সেইভাবে সংগ্রামের দ্বারা মুক্ত হবে। নজরুলের বিখ্যাত ‘চল্ চল্ চল্’ সঙ্গীতটির শেষ চারটি স্তবক এমনি,
ঊর্ধ্বে আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ্কাওয়াজ,
খোল্ রে নিঁদ মহল!
কবে সে খোয়ালি বাদশাহী
সেই সে অতীতে আজো চাহি
যাস্ মুসাফির গান গাহি
ফেলিস্ অশ্রুজল।
যাক্ রে তখ্ত-তাউস
জাগ্ রে জাগ্ বেহুঁশ!
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রীক রুশ!
জাগিল তারা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধূলায় তাজমহল!
ইতিহাসে আমরা দেখেছি এক একটা দেশ ও জাতি ক্ষীণ দুর্বল অবস্থা থেকে এক দিন সবল শক্তিমান অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। আবার সম্পন্ন অবস্থা থেকে দরিদ্র অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। আবার দরিদ্র ও বিপন্ন অবস্থা থেকে পরাক্রমশালী জীবনে ফিরে এসেছে। অধঃপতিত ও পশ্চাত্পদ মুসলিম সমাজকে তারই দৃষ্টান্ত দেখাতে নজরুল রোম, গ্রিস, রাশিয়া ও পারস্যের কথা উল্লেখ করলেন এবং জানিয়ে দিলেন যে, ধ্বংসের ভস্মস্তূপ থেকে তারা যদি উঠে আসতে পারে, তাহলে তোমরা উঠে আসতে কেন পারবে না। সুতরাং বাদশাহী হারানোর দুঃখে অশ্রু নিষ্কাশন না করে আবার ঘুম ভেঙে জেগে ওঠো। ইতিহাসের গতিধারা বলে দেয় যে পতনের পর উত্থান আছে। সুতরাং আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদেরও উত্থান হবে এবং নতুন জাগ্রত ও পরাক্রমশালী জাতিতে আমরা আবার পরিণত হবো।
এ কথা সবাই জানে বা এখন জেনেছে যে, নজরুলের কাব্যের ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতা রাজনীতি আশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। কবিতায় রাজনীতির প্রশ্রয় দেয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে এক সময় তাঁর কবিত্ব শক্তির অপচয় হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যদিও পূর্বে রবীন্দ্রনাথ সেটারও প্রয়োজন আছে মনে করে তাঁকে আশীর্বাদও জানিয়েছিলেন।
এ ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে বলে দেয় যে এই সাহসী কাজটা অথবা বলা যায় এই মৌলিক কাজটা নজরুলের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নজরুল বুঝেছিলেন জীবন ও জগতের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মূলে কাজ করছে রাজনীতি। মানুষের খুশির জন্য তাই তার বৃত্তের বাইরে থেকে কোনো সংগ্রাম সম্ভব নয়। সমাজ ব্যাধির মূলে যদি রাজনীতি কারণ হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেই কারণকে করে তুলতে হবে কবিতার বিষয়। ‘নবযুগে’র প্রথম সম্পাদকীয়তে নজরুল লিখেছিলেন,
নরে আর নারায়ণে আজ আর ভেদ নাই। আজ নারায়ণ মানব। তাঁহার
হাতে স্বাধীনতার বাঁশী। সে বাঁশীর সুরে সুরে নিখিল মানবের অণু-
পরমাণু ক্ষিপ্ত হইয়া সাড়া দিয়েছে। আজ রক্ত-প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব
নব প্রভাতী ধরিয়াছে—‘পোহাল পোহাল বিভাবরী/পূর্ব তোরণে শুনি
বাঁশরী! এ সুর নবযুগের। সেই সর্বনাশা বাঁশরীর সুর রুশিয়া শুনিয়াছে,
আয়ারল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে, আরো অনেকে শুনিয়াছে, এবং
সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের হিন্দুস্তান জর্জরিত নিপীড়িত শৃঙ্খলিত
ভারতবর্ষ।’
নজরুলের সমাজ-সচেতন দৃষ্টি বুঝেছিল যে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জাতি যেভাবে সচেতন সংগ্রামের দ্বারা বন্ধনের শিকল কেটে বেরিয়ে আসছে, একই প্রক্রিয়ায় উপমহাদেশের মানুষের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। উপলব্ধিগত এই চেতনা দিয়েই নজরুল তাঁর কবিতার মশাল জ্বালিয়ে তুলেছিলেন।
তাই তিনি সব দুঃশাসন ও দুঃশাসকদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র শ্রেষ্ঠ অবলম্বন ভেবেছিলেন। ইতিহাস থেকেই তিনি জেনেছিলেন। ফেরাউনের হাত থেকে মুসা (আ.), কোরেশদের হাত থেকে মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ করেই নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করেছিলেন, ইতিহাস থেকেই তিনি দেখেছিলেন অন্যায় রোধ করতে রাবণের বিরুদ্ধে রামকে, কংসের বিরুদ্ধে কৃষ্ণকে, কৌরবের বিরুদ্ধে পাণ্ডবকে, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হোসেন (রা.)-কে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
এই যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যযুগের সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রোমীয় ও পারসিদের মুক্তি ঘটেছিল, জারের হাত থেকে মুক্তি ঘটেছিল নির্যাতিত রুশদের, গ্রিসের হাত থেকে মুক্তি ঘটেছিল তুরস্কের। নজরুল ভেবেছিলেন এই যুদ্ধের মাধ্যমেই তাই উপমহাদেশেরও মুক্তি ঘটবে।
নজরুল দেখেছিলেন তাঁর সমকালীন বিশ্বে আজাদী লাভের জন্য বিভিন্ন মুক্তিকামী গোষ্ঠী, দেশ, জাতি বা সম্প্রদায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আদিকাল থেকে মানুষ ও মানবসভ্যতাকে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও মানুষকে ও মানবসভ্যতাকে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে। জীবনের অস্তিত্বের জন্য তাই নজরুল যুদ্ধকে মানব জীবন-দর্শন বলে গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষা ও ইতিহাস সচেতনতাই নজরুলকে এই তাত্ত্বিক বোধে দীক্ষা দিয়েছিল; এবং তিনি তাঁর কাব্যের রক্ত-কণিকায় এই শিক্ষাকে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করেননি।
শাহাবুদ্দীন আহ্মদের ‘বহুরূপে নজরুল’ (বাংলা সাহিত্য পরিষদ, জুলাই ১৯৯৯) থেকে পুনর্মুদ্রিত
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন