আইয়্যামে জাহেলিয়াতের এক চরম সময়ে রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে। তিনি মানবজাতিকে ডাক দিয়েছিলেন অগ্নি, পাথর, মূর্তিপূজা, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও অন্যান্য পাপাচার ছেড়ে এক আল্লাহর পথে আসার জন্য। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই শান্তির পতাকাতলে হাজির হলেন। একত্ববাদে বিশ্বাসী এই জনসমষ্টিই মুসলমান। শান্তির ছায়াতলে ইসলামে দীক্ষিত এই জনসমষ্টির মাধ্যমে নতুন এক সভ্যতার জন্ম হয়, যা পৃথিবীর আশীর্বাদস্বরূপ। এই একত্ববাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তাই ইসলামী সংস্কৃতি। জাহেলিয়াতের যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি দ্বারা গোত্রে গোত্রে হিংসার আগুন জ্বালানো, পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি, প্রতিশোধের স্পৃহা, হানাহানি, কাটাকাটি করতে উদ্বুদ্ধ করত। অপরাধীকে ক্ষমা করা ছিল তখনকার সময়ে কল্পনাতীত। একত্ববাদে বিশ্বাসীদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রোধ সংযত করা অপরাধীদের ক্ষমা করতে শেখায়। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহার সম্প্রীতি শিক্ষা দেয়, জীবনকে সম্মানিত করে তোলে, অনাদর্শকে আদর্শবাদী, অজ্ঞ মূর্খকে নির্ভুল জ্ঞান এবং সাহসহীন মানুষকে সাহসী ও নির্ভীক করে তোলে।
আমরা জানি, মুসলিম শিল্পকলা ও ইসলামী শিল্পকলার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
মুসলিম শিল্পকলা : মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমান শাসক, বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিল্প উত্কর্ষ ও বিকাশ লাভ করে, তা-ই মুসলিম শিল্পকলা।
খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমি, সেলজুক, মামলুক, উসমানীয় খেলাফতের আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষে মোগল আমলে মুসলিম শিল্পকলা ব্যাপক বিকাশ লাভ করে।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে তাদের প্রাসাদে হাম্মাম খানায়, রংমহল, দরবারগৃহ ও হেরেম নৃত্যরত নারী, নারীর শরাব পরিবেশন ও বিভিন্ন প্রাণীর চিত্র, দেয়ালচিত্র ফ্রেস্কো মাধ্যমে মুসলিম শিল্পীরা অঙ্কন করছে।
বাদশা হুমায়ুন ছিলেন সংস্কৃতিমান ও শিল্পরসিক। রাজ্য হারিয়ে পারস্যে কুড়িটি বছর কাটিয়ে দেশে ফেরার সময় তাব্রিজ থেকে মীর সাঈদ আলী ও খাজা আবদুস সামাদ শিরাজী নামক দু’জন খ্যাতিমান শিল্পীকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং এরা স্কুল স্থাপন করে এক শিল্পী তৈরি করে। এদের মাধ্যমে ভারত এবং ইরানি রীতির সংমিশ্রণে ইন্দু-মুসলিম রীতি গড়ে ওঠে। শিল্পীরা রাজদরবারে চিত্র, যুদ্ধচিত্র, রাজাদের প্রতিকৃতি, জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদিকে বিষয়বস্তু করে প্রচুর মিনিয়েচার ছবি অঙ্কন করে। মোগল আমলেই কাগজের ওপর ছবি আঁকা শুরু হয়। কাগজ বানাতে শেখা, ছবি আঁকা থেকে বই লেখা বিশেষভাবে প্রচলিত হয় মোগল আমলেই, তার আগে এ দেশে তালপাতার ওপর লেখা হতো এবং ছোট ছোট ছবিও আঁকা হতো।
বাদশা আকবর শিল্প অনুরাগী ছিলেন। তার সময়ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি চিত্রে শোভিত হয়।
জাহাঙ্গীর নিজেই শিল্পী এবং শিল্প সমালোচক ছিলেন। তার সময়ই ইংরেজ রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো এদেশে আসেন। এই সময় প্রতিকৃতি ও মিনিয়েচার পেইন্টিং করা হয়। ছবিতে আলোছায়া ও পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে সমর্থ হয়। ছবিগুলো খুব বাস্তবধর্মী হয়ে ওঠে। তারা প্রাণীর চিত্র বাস্তবভাবে আঁকতে থাকে, যা বিস্ময়কর। এই সময় স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন তৈরি করা হয়। বিকাশ ঘটে ইসলামী শিল্প ও ক্যালিগ্রাফির। এখানে আমরা ইসলামী শিল্প নিয়েই আলোচনা করব।
ইসলামী শিল্প : ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন’ (আল হাদিস)। যে শিল্পে আল্লাহর মনোনীত ধর্মের অনুশাসনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও তার সৃষ্টির সৌন্দর্য, মহিমা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়, তা-ই ইসলামী শিল্পকলা। এ শিল্প মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়, আহ্বান করে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নির্দেশনা দেয়।
ইসলামের প্রথম যুগেই প্রাণীর চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ করে হাদিস।
এর মধ্যে কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো :
‘হজরত হুজাইফা (রা.) আবু তালহা থেকে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ফেরেস্তারা এমন ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে কুকুর বা ছবি (প্রতিকৃতি) রয়েছে।’
‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে ছবি (প্রতিকৃতি) অঙ্কনকারী লোক।’
‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, আর যে ব্যক্তি ছবি (প্রতিকৃতি) বানালো, তাকে আজাব দেয়া হবে এবং তাকে প্রাণ দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে, অথচ সে তা দিতে পারবে না।’
‘হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, আমরা তোমাদের গির্জায় প্রবেশ করি না এ কারণে যে, সেখানে ছবি রক্ষিত রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস গির্জায় নামাজ পড়তেন, কিন্তু যে গির্জায় ছবি রক্ষিত রয়েছে, সেখানে নামাজ পড়তেন না।’
হজরত মালেক ইবনে আবদুল্লাহর বর্ণনা এই যে, নিষেধ করা হয়েছে সেই ছবি সম্পর্কে, যা প্রকাশ্য স্থানে সংস্থাপন করা হয়। বিছানায় বিছানো ছবির ব্যাপারে কোনো নিষেধ নেই।
তখন শিল্পীরা রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা এখন কী করব? রাসুল (সা.) তাদের নিষ্প্রাণ বস্তু , ফুল, লতা-পাতা আঁকার নির্দেশ দিলেন। মরুভূমিতে খেজুর আর আঙুর গাছ হচ্ছে প্রধান উদ্ভিদ। শিল্পীরা আঙুর, লতা-পাতা দিয়েই ডিজাইন করা শুরু করল। তারা প্রাণিচিত্র আঁকা বর্জন করল। তারা প্রাণিচিত্র বর্জন করে ৪টি উপাদান দিয়ে কাজ শুরু করল :
১. উদ্ভিদীয় পরিকল্পনা বা ফুল-লতা-পাতা।
২. জ্যামিতিক আকার, আকৃতি ও রেখা।
৩. আরবি বর্ণমালা বা ক্যালিগ্রাফি।
৪. বিশুদ্ধ বা অবিমিশ্র রঙের ব্যবহার।
এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত পণ্ডিত শিল্প সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ইসলামী শিল্প পূর্ণ বিকাশ লাভ করে ৮০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।’ এই শতাব্দী যে দীপ্তি এবং ঔজ্জ্বল্য এই আধুনিক সভ্য পৃথিবীর কাছে উপস্থিত করেছে, তা পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার সঙ্গে বিচার করলে অতুলনীয় বিবেচিত হয়। মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে যখন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার আড়ষ্ট সীমা বন্ধন ছিল, একটি দুরন্ত নির্জনতায় পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল তখন ইসলামী সভ্যতা একটি স্বতন্ত্র উন্মুক্ততায় পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। মূলত মুসলমানদের কারণেই পাশ্চাত্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল। অর্থাত্ বর্তমানে যা ইউরোপীয় রেনেসাঁ নামে অভিহিত। ইসলামের সংস্পর্শে না এলে তা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। মুসলমানরা স্পেন বিজয় করার ফলেই ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে নতুন সাড়া পড়েছিল। শিল্প সংস্কৃতির জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।
স্থাপত্য শিল্পে রাসূল (সা.)-এর তৈরি ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘মদিনা মসজিদ’ আজ আধুনিক স্থাপত্যবিদদের কাছে বিস্ময়। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক স্থাপত্যবিদরা গবেষণা করে মদিনা মসজিদকে আধুনিক স্থাপত্যের মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (চলবে)
ইসলামের সঙ্গে যেমন অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য আছে, তেমনি পার্থক্য আছে শিল্প ও সংস্কৃতিরও। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মন্দির সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, যারা ধর্ম প্রচার করেন শুধু তাদের অধিকার রয়েছে সেখানে উপাসনা করার। তাই মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রকোষ্ঠ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে বাইরের আলো-বাতাসের শব্দ প্রবেশ করতে না পারে। পৃথিবীর কর্ম-কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে উপাসনার স্থান হিসেবে নির্জন পাহাড় অজান্তেই বেছে নিয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যেখানে পৃথিবীর কোলাহল স্পর্শ করতে পারেনি।
ইসলামে সম্পূর্ণ ভূখণ্ড আল্লাহর। একজন মুসলমান যে কোনো স্থানে নামাজ আদায় করতে পারেন। ইবাদতের কোনো অন্তরায় নেই। উন্মুক্ততা ইসলামের একটি অংশ। যে কোনো অমুসলিম অতি সহজে কালেমা পড়েই মুসলমান হতে পারেন। মসজিদ নির্মাণ কাঠামোর ও প্রশস্ততায় সহজেই আলো-বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। ভেতরের স্পেসের সঙ্গে বাইরের স্পেসের একটা সঙ্গতি আছে। সহজেই প্রবেশ করা যায়। কোথাও কোনো বাধা নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত। ইসলামের এই উদারতা তার স্থাপত্যে ব্যক্ত হয়েছে।
রাসূল (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপে দুই ধরনের লোক বাস করত। এক দলকে বলা হতো বেদুঈন—এরা নিছক মরুচারী যাযাবর ছিল। আর অন্য দলের লোকরা থাকত শহরে। এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো। দেশে দেশে ব্যবসা করত এরা। ইসলামী শিল্পকলা প্রথম বিস্তার লাভ করে মরুময় অঞ্চলে—তাঁবুতে থাকা মানুষের মধ্যে। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আসবাবপত্র বেশি থাকে না। যাযাবর জীবনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে বেশি জিনিসপত্র নিয়ে চলাফেরা কষ্টকর। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষ প্রধানত তার শিল্পবোধের তৃপ্তি খুঁজছে বয়ন শিল্পের মধ্যে। তাঁবুতে মানুষ গোড়া থেকেই সুন্দর গালিচা বুনতে চেয়েছে। এইসব গালিচা তাঁবুর মধ্যে বিছিয়ে পূরণ করতে চেয়েছে চাদরের অভাব। মরুভূমিতে পানির অভাব থাকায় পানি জোগাড় করে হিসাব করে খরচ করতে না পারলে জীবন চলত না। এই প্রয়োজনে মৃত্পাত্র গড়ার দিকেও তাদের ঝোঁক ছিল। গালিচা, কাপড় ও মৃত্পাত্রের ওপর ফুল, লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এঁকেছে এরা। আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তারা প্রাণীর ছবি অঙ্কন পুরোপুরি বর্জন করেন। আঙুর, লতাপাতা-ফুল দিয়ে নকশা করে মনের সৌন্দর্যবোধকে প্রকাশ করে তৃপ্তি খুঁজেছেন। ইসলামী শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছে মরুচারী যাযাবর জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই। আরবদের আঙুর লতার নকশাকলা বিশেষ জটিল হয়ে ওঠে। ফুল, লতা- পাতা ও জ্যামিতিক আকার আকৃতি দিয়ে করা ইসলামী বিশ্বের বৈশিষ্ট্যসূচক নকশা সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকলা।
ইসলামে মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। তাই কোরআনে উল্লিখিত কোনো ঘটনাবলীকে চিত্রিত অথবা মূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করা হয়নি। খ্রিস্টীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য সম্যকভাবে বুঝতে হলে পড়তে হয় অথবা জানতে হয় ইঞ্জিল কিতাবে (বাইবেল) বর্ণিত ঘটনাবলী। বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পকে বুঝতে হলে জানতে হয় বুদ্ধের জীবনকথা, পড়তে হয় বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী। হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে যে শিল্পকলা গড়ে উঠেছে তাকে যথাযথভাবে বুঝতে পৌরাণিক উপাখ্যান জানতে হয়।
উদ্ভিদীয় পরিকল্পনায় বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ফুল ও লতাপাতা। জ্যামিতিক আকার-আকৃতির মধ্যে বৃত্ত, ঘনক, সরল ও বক্র রেখা বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্ভিদীয় ও জ্যামিতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখা আরবি লিপি দিয়ে যে কোনোভাবে নকশা করা যায়। আরবি অক্ষরের সংখ্যা ২৯টি। এই অক্ষরগুলো আঁকাবাঁকা, খাড়া ও সমান্তরাল। এই অক্ষরগুলো সহজেই ফুল-লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অলঙ্করণের কাজে ব্যবহার করা যায়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে জিবরাঈল (আ) প্রথম বাণী নিয়ে এসেছিলেন—‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক।’ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি (মানুষকে) সৃষ্টি করেছেন; ঘনীভূত রক্তপিণ্ড থেকে। পড় তাঁর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও দয়ালু। যিনি মানুষকে শিখিয়েছেন কলমের ব্যবহার, আর দান করেছেন সেই জ্ঞান যা ছিল মানুষের অজানা।’ (সূরা আলাক : আয়াত ১,২,৩,৪)
রাসুল (সা,) লিখতে পারতেন না, সাহাবীরা আল্লাহর বাণী পাথরের গায়ে, দেয়ালে, গাছের ছালে লিখে রাখতেন। যারা এই আল্লাহর বাণী সুন্দর মনোরম করে লিখতেন, তারাই কাতিব। কাতিবদের মর্যাদা ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। রাসুল (সা.) কাতিবদের ভালোবাসতেন। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। রাসুল (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.) স্বয়ং ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। তিনি কোরআনের আয়াতকে চমত্কার করে লিখে রাখতেন। তিনি বলতেন, ‘সুন্দর হস্তাক্ষর সত্যকে স্বচ্ছ করে তোলে।’ আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। যারা সুন্দরের চর্চা করেন তাদেরকেও পছন্দ করেন।
রাসুল (সা.) ক্যালিগ্রাফি শিল্প এবং শিল্পীদের পছন্দ করতেন ও এই শিল্পের প্রচার প্রসারে কাজ করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বদরের যুদ্ধে যেসব বন্দি মুক্তিপণ দিতে অক্ষম ছিল তাদের প্রত্যেককে দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। এই শিক্ষাদানের মধ্যে ক্যালিগ্রাফিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি মুসলমানদের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার গভীরতা নিরূপণ করা যায়। সে সময়ে শুধু রাসুল (সা.)-এর কাছে নয়, মুসলমান সমাজে সর্বস্তরে ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের কদর ছিল। মুসলিম শাসকরা শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। আব্বাসীয় আমলে রাষ্ট্রনায়করা ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও প্রসারে সহায়তা করেছেন। অক্ষরকে বিশেষভাবে বিন্যাসের মাধ্যমে সুন্দর আকর্ষণীয় রূপ দেয়া এবং ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখেই অতীতে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ৩১ নং আয়াতের আলোকেই বিশ্বাস করা হয়। যেহেতু প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে আদম (আ)-কে অবহিত করা হয়েছে সেহেতু তাঁকে আরবি সম্পর্কেও অবগত করানো হয়েছে। এই বিশ্বাসের আলোকেই বিভিন্ন তথ্যে বলা হয়েছে যে আদম (আ) এরপর তার পুত্র শীষ (আ) আরবি বর্ণ ও বিন্যাসের উত্কর্ষ সাধন করেন। এমনিভাবেই বংশানুক্রমে তাঁরাই আরবি ভাষার বিকাশ সাধন করেছেন। আব্বাসীয় আমলে মুসলিম সভ্যতার যখন স্বর্ণযুগ, তখন আরবি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বলে জানা যায়।
গ্রিক কধষষড়ং এবং এত্ধঢ়যবরহ শব্দ দু’টির মিলিত রূপ ‘ক্যালিগ্রাফিয়া’ থেকে ইংরেজি ‘ক্যালিগ্রাফি’ যার অর্থ ‘সুন্দর লেখা’ হস্তলিখন শিল্প।
পৃথিবীর আরও অনেক ভাষায় ক্যালিগ্রাফি হয়েছে। যেমন- চীন, জাপানে ছবি আঁকা শুরু করতে হয় ক্যালিগ্রাফি দিয়েই। অন্য কোনো দেশের বর্ণমালা এত সুন্দর করে আঁকা সম্ভব হয় না। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে। মানব মুখে প্রথম উচ্চারিত ভাষা আরবি, বেহেশতের ভাষা আরবি পৃথিবীর প্রথম ভাষা আরবি, পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের ভাষা আরবি। আরবি অক্ষর ইসলামী শিল্পকলাকে দিয়েছে বিশিষ্ট রূপ ও শিল্পগত ঐক্য। আরবি লিপিকলা ইসলামে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। চিত্রের স্থান দখল করে রয়েছে আরবি ক্যালিগ্রাফি। সুন্দর লিপিই হচ্ছে শিল্পের মাধ্যমে ইসলামের বাণী প্রচারের উপায়। কোরআনের বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী, যা মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। আল্লাহকে আমরা দেখি না, কিন্তু তাঁর বাণী তিলাওয়াতের সময় আমরা দেখি। কাজেই শিল্পীরা অক্ষরগুলোকে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং তারা এ কাজকে আল্লাহর ইবাদত মনে করেছেন। এ জন্যই ক্যালিগ্রাফি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র। কোরআনের এই ভাষাকে অবলম্বন করে যে লিখন শিল্প মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে উঠেছিল, তা সারা বিশ্বের জন্য অতুলনীয় শিল্প সম্পদ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত সুন্দর হস্তাক্ষরের মাধ্যমে বিশেষভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কাজেই এ ভাষার একটা অলৌকিকতা আছে। তাই যুগ যুগ ধরে কোরআনের বাণীকে সুন্দর লিখন পদ্ধতিতে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সুতরাং এক অর্থে হস্তলিখিত কোরআন অলৌকিকতা ধারণ করে রাখার চেষ্টা করেছে। হস্তলিখিত কোরআনের বাণী হচ্ছে অলৌকিক বাণী শৈল্পিক রূপব্যঞ্জনা। মুসলমানরা একে উচ্চাঙ্গ শিল্পে পরিণত করেছে। এই লিখন পদ্ধতির প্রকৃতি একক নয়, বহুবিধ। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে একটি শৈল্পিক রূপ লক্ষ করা যায়। তা হচ্ছে অক্ষরগুলো লম্বা এবং সমান্তরাল স্বভাবের। এই দুই বৈপরীত্যের মাধ্যমে শিল্পীরা লিপিকর্মে সৌন্দর্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন আল্লাহ শব্দটিতে যে কয়টি অক্ষর আছে, সে কয়টি লম্বা স্বভাবের। এই লম্বা স্বভাবটি সমান্তরাল স্বভাবের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে যে বিচিত্র রূপ-দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে, তা লিপিকর্মে অতুলনীয়। ফুল, লতাপাতা ও জিওমেট্রিক্যাল ফর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে কোনোভাবে এই লিপিকে উপস্থাপন করা যায়, যা অন্য কোনো ভাষার লিপি দ্বারা সম্ভবপর নয়। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি এত ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
মুঘল লিপিকলা : মুঘল সম্রাটরা লিপিকলার মহান পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিপুণ লিপিকারও ছিলেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘খত্তেতবই বাবুরি’ বা বাবুরি লিপি নামে একপ্রকার হস্তলিপি প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক বাদায়ুনীর মতে, তিনি নিজ হাতে বাবুরি লিপিতে এক জিলদ কোরআন শরীফ নকল করে মক্কা শরীফে পাঠান। তাঁর পৌত্র সম্রাট আকবর ছিলেন শিল্পের পরম সমঝদার ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। বহু চিত্রকর ও লিপিকার তার দরবার অলঙ্কৃত করতেন। তাদের তিনি গুণ ও নৈপুণ্যের জন্য অকাতরে পুরস্কৃত করতেন আর সম্মানজনক খেতাব দান করতেন। জায়গীর রূপে ভূ-সম্পত্তি এবং মাঝে মাঝে উচ্চ সরকারি পদও দান করতেন। আকবরের রাজত্বকালে যেসব বিখ্যাত লিপিকারের আবির্ভাব হয়েছিল (তাবকিয়া-ই-খুশ নবীশান বা লিপিকার স্মৃতি নামক পুস্তকে এদের প্রায় সবারই উল্লেখ আছে)। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন, কাশ্মীরবাসী মুহাম্মদ হুমায়ুনের নাম (মৃত্যু ১০২০ হিজরি)। তিনি ‘বরবীন কলম’ বা ‘স্বর্ণ কলমধারী’ নামে পরিচিত। বাদশাহ আকবর তাকে এই সম্মানজনক খেতাবটি দিয়েছিলেন। মনোজ্ঞ লিপিকলায় আইন-ই-আকবরীর মনোরম চিত্রশোভিত এমন একটি চমত্কার পাণ্ডুলিপি উজ্জয়িনীতে ছিল। পরে লন্ডনে নিয়ে রাখা হয়। অন্য লিপি শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মোল্লা মীর আলী ও তার শিষ্য মাওলানা বাকী মাশহাদের মুহাম্মদ আমীন মীর হুসাইনী কুলানকী, মাওলানা আবদুল হাই, মাওলানা দাত্তরী, সুলতান বায়যীদ (আকবর তাকে কাতিবুল মূলক বা রাজ্যের লিপিকার খেতাবে ভূষিত করেছিলেন)। মাওলানা আবদুর রহীম আমবরীন কলম। তিনি প্রসিদ্ধ নামতালীফ লেখক ছিলেন এবং পারস্য কবি নিযামীর খামসা (পঞ্চমী) নকল করেছিলেন। কাশ্মীরের আলী চমন, নূরুল্লাহ কাসিম আরমালান, শিরাজের খাজা আবদুস সামাদ মুয়াফ্ফর আলী, কান্দাহারের মীর মাসুদ (তিনি ফতেহপুর সিক্রির অট্টালিকার শিলালিপিগুলো নিজ হাতে লিখেছেন)। আশরাফ খান নামে পরিচিত মুহাম্মদ আসগর। তিনি নাসতালিফ লিপির বিশেষজ্ঞ এবং হস্তলিপিতে পারদর্শী ছিলেন। অর্থাত্ নসথ লিপির ছয় প্রকার রীতি নাসতালিফ লিপিতে বুত্পত্তিসম্পন্ন ছিলেন। (ওই ছয়টি রীতি সাধারণত ইবনমুকলা দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল বলে কথিত হয়) সেই সময় কয়েকজন প্রসিদ্ধ হিন্দু লিপিকারও ছিলেন। যথা- রাও মনোহর, পণ্ডিত জগনাথ এবং লিপিকলার প্রতি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আকর্ষণ তার কৃতী পিতার চেয়ে কম ছিল না। তার আত্মজীবনী থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ফরাসি ভাষায় সুলেখক ছিলেন। তার পূর্ববর্তীদের মতো তিনিও লিপিকারদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এই লিপিকারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তরবীয়ের মীর আবদুল্লাহ। তিনি মুশকীন কলম (কস্তুরী গন্ধী কলমধারী) নামে পরিচিত। আকবর তাকে এই খেতাব দিয়েছিলেন। তিনি হস্তলিপি রীতিতে পারদর্শী ছিলেন। অন্য লিপিকারদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ শিরিন কলমের পুত্র মুহাম্মদ শরীফ। শিকাসতা লিখনরীতিতে পারদর্শী মিরযা মুহাম্মদ হুমায়ুন। হিরাতের মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক। তিনি মিরযা কামরানের দীওয়ান নকল করেছিলেন এবং সবশেষে তগরারীতি লেখক আহমদ আলী আরশাদ। তিনি ফতেহপুর সিক্রির বিরাট ফটকের পশ্চিম দিকের শিলালিপিগুলো লিখেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথমদিকে তিনি ‘নাসতালীফ’ লিখনরীতির প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে যারা তার অনুসরণ করত তিনি তাদের পুরস্কৃত করতেন। তাযফিয়া-ই খুশনবীশান পুস্তকে লিখিত আছে যে সম্রাট এই অনুকরণকারীদের একশ’ ঘোড়সওয়ারের পরিচালনার পদে নিযুক্ত করতেন। তার সময়ে অনেক অভিজ্ঞ লিপিকার ছিলেন শিরাযের আবদুল হাই ওরফে আমানত খান মীর আবদুল্লাহ মুশকীন রকমের পুত্র তররীযের মীর সালিহ, নমখ লিপিতে পারদর্শী এবং শাহজাদা আওরঙ্গজেবের গৃহশিক্ষক আবদুল বাকী। তিনি তিরিশ পাতায় সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ নকল করে সম্রাটকে উপহার দেয়ায় ‘য়াকুত রকম’ (রত্ন লেখনি ধারক) খেতাব পেয়েছিলেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ঈমান আকিদার দিক দিয়ে প্রকৃত মুসলমান। প্রাণী চিত্রাঙ্কনের যে ধারা চলছিল, তিনি এগুলো বন্ধ করেছিলেন কিন্তু লিপিকলার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এই কলাটি শিখেছিলেন তার গ্রন্থাগারিক ও দরবারী লিপিকার মীর ইযাদের কাছ থেকে সাইদ আলী খান জওহর রকমের (হীরক লেখনী ধারক) কাছে। শাহানশাহ নমখ ও নাসতালীফ উভয় লিপিতেই পারদর্শী ছিলেন। তবু তিনি আর একজন সমসাময়িক লিপিকার ও দরবারী গ্রন্থানিক কমল হিদায়িতুল্লাহ খানের লিপির তারিফ করতেন। সম্রাটের পত্রাবলীতে এর উল্লেখ আছে। এই সময়ে আর একজন জওহর রকম ছিলেন শামছুদ্দীন আলী খান। আওরঙ্গজেবের সময়েও কয়েকজন হিন্দু লিপিকার ছিলেন, যথা পণ্ডিত লক্ষ্মীরাম লাল, সুখরাম মুনশী, মাহবুব রায়ম, মুনশী কমল রায়। মুঘল সাম্র্রাজ্যের অবনতির দিনেও লিপিকলার উন্নতি অব্যাহত থাকে। ফর্রুখ শিয়রের আমলে হাজী নামদার ও মিরযা খাতিম বেগ সুপরিচিত লিপিকার ছিলেন।
দ্বিতীয়ত : আকবরের সময় যে কয়জন লিপিকার খ্যাতিলাভ করেন, তাদের মধ্যে আছেন মীর মোহাম্মদ হুমায়ুন, গুলাম আলী খান, হাফিজ ইব্রাহিম, হাফিজ বরকতুল্লাহ, মীর আবুল হামায, মীর যয়নুল আবেদীন, মীর মাহদী এবং খাজা গুলাম নকশাবন্দ খান। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহও একজন শিল্পী, কবি ও লিপিকার ছিলেন। দিল্লিতে যীনত মহলের এবং হামীম আহসানুল্লাহ খানের হামমামের শিলালিপিতে রক্ষিত আছে। এগুলো তার অপূর্ব নৈপুণ্যের স্বাক্ষর দিল্লির জাদুঘরেও তাঁর লিপির নিদর্শন রক্ষিত আছে। তার সময় নিপুণ লিপিকার ছিলেন মুহাম্মদ জান, মীর ইমাদ আলী ও তার পুত্র মীর জালালুদ্দীন।
মুসলিম কৃষ্টিধারায় লিপিবিদ্যার স্থান অতি উচ্চে। বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় লিপিকলা ছিল পাঠ্যসূচির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। আরব ও পারস্যবাসী লিপিকলার উদ্ভাবন করেন।
লিপিকলার কিছু রূপ ও রীতির নাম—খততই আনিফা, খততই যুলফ, খততই পায়চান, খততই নাখুন, খততই তাওয়াম। এর অধিকাংশই লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনে ও অলঙ্কারের উদ্দেশে ব্যবহৃত হতো।
একদানা চালের ওপর কোরআন শরীফের একটি সম্পূর্ণ আয়াত অঙ্কিত করতে পারা শিল্পের এবং লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট পন্থা ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের পরে বহু বিখ্যাত আলিম ও গুণী কবি লখনৌতে চলে যান। তখন সেখানে সর্বপ্রকার শিল্প, সাহিত্য ও কৃষ্টি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭৯২ খ্রি. দিল্লিতে যে ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপিত হয় এর পাঠ্যসূচির লিপিকলা অন্যতম শিক্ষনীয় বিষয় বলে নির্দিষ্ট হয়েছিল। সাঈদ মুহাম্মদ নামক একজন বিখ্যাত লিপিকারকে এই কলাবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়েছিল।
আধুনিক কালেও আমরা দেখি ইরান, পাকিস্তান, সুদান ও নাইজেরিয়ার এই লিপিশিল্প অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
ইরানের জলিল রাসুলী, সৌদি শিল্পী আহম্মদ মোস্তফা আরবি লিপিকলাগুলোকে ক্যানভাসে চমত্কার অনুজ্জ্বল রঙে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন একান্তই নিজের। তার ছবিটির নাম ‘দি ওয়ারিয়র অব বদর’।
ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী জামিল হামদি আরবি লিপিকে জ্যামিতিক ফর্মে উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব রীতিতে। শিল্পী যুুদা মালাম তার ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে লিপির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। শিল্পী শাকের হাসান তার ফর্মের সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে স্বর্ণ পেয়েছিলেন ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী ‘সাদী আল কাবী’। তার ছবির বিষয়বস্তু ছিল ক্যালিগ্রাফি ‘মরুভূমির শিলালিপি’। গত ১৯৯১ সালে এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীর লিপিশৈলী-১,২,৩,৪ নামে ৪টি ছবি প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকের দৃষ্টি কাড়ে। ক্যানভাসে স্পেচুলা ও কোথাও ব্রাশ দিয়ে মোটা তেল রঙে তাঁর যে ব্রাশিং, তা দর্শকদের মুগ্ধ করে। তার ছবি মনে হয় আরবি লেখা কিন্তু কি লেখা বোঝা দুরূহ অর্থাত্ একটা ইলিউশন তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে জানুয়ারি মাসে রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিক ক্যালিগ্রাফি শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। মিসরের সাইয়েদ ইব্রাহীম মো. সাব্বির আল হিলালী, তিউনিসের মো. ছালেহ আল খুমসি, ইরাকের হাশেম বাগদাদে অংশগ্রহণ করেন। প্রদর্শিত ক্যালিগ্রাফিগুলো চিত্রায়ণ হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। চমত্কার কম্পোজিশন রঙ ও রেখায় বিমূর্ত শিল্পে উন্নীত করা হয়েছে।
এই লিখন পদ্ধতি পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলায় প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রমাণ আমরা পাই বিখ্যাত শিল্পী পল ক্লী’র বিভিন্ন চিত্রকর্মে। তার ‘ডকুমেন্ট’ বা দলিল নামে ছবিটির কতগুলো আরবি বর্ণমালা ছাড়া আর কিছু নয়। রেখাঙ্কনেও আমরা আরবি লিখন পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করি। আরবি ক্যালিগ্রাফি ইউরোপীয় শিল্পেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আরবি না জেনেও ইউরোপীয়রা আরবি লেখার অনুকরণে নকশা করেছে। কাপড়ের বুননে ও নকশায় আরবি লিপিকলার অনুসরণ করার চেষ্ট করা হয়েছে।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল পাবলো পিকাসোর জন্ম স্পেনের আনদানুমিয়া অঞ্চলে। এই অঞ্চল আরবদের অধীন ছিল প্রায় ৭শ’ বছর। এখানকার নকশায় ইসলামী জ্যামিতিক মণ্ডনকলার প্রভাব খুবই স্পষ্ট। পিকাসোর ছবিতেও একসময় জ্যামিতিক নকশার প্রভাব দেখা যায়।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিখ্যাত শিল্পী আঁরি মাতিস তার ছবির অনুপ্রেরণা পান ইরানি গালিচা থেকে। তার ছবির রঙ ও ফর্ম গালিচা থেকে নেয়া। তিনি তার শিল্পে অবিমিশ্র রঙের পাশাপাশি সংস্থাপনের মাধ্যমে রঙের আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পে ইসলামী শিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাব পড়েছে। বিমূর্ত শিল্পের জনক মন্ডিয়ন ক্যালিগ্রাফি শিল্পে মুগ্ধ হয়ে বিমূর্ত শিল্পের জন্ম দিয়েছেন। বিমূর্ত শিল্পের ফিগার নেই, ফর্ম আছে। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফির আদলে ফর্ম ব্যবহার করেছেন তাদের চিত্রকর্মে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর শিল্পের বিমূর্ততার উদ্ভব এখান থেকেই।
পৃথিবীর সব দেশেই আজ ইসলামী শিল্প নিয়ে নিরীক্ষা চলছে, ধর্মগত কারণে নয়, শিল্পের বৈশিষ্ট্যগত কারণে। কাজেই ইসলামী শিল্পধারা একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী শিল্পধারা হিসেবে আজ পরিগণিত। অর্থাত্ কোরআনিক কালচারাল ক্যালিগ্রাফি নিয়ে বাংলাদেশেও ৭০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত অনেক খ্যাতিমান শিল্পী কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে মুর্তজা বশীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, খুরশিদ আলম, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলামসহ আরও অনেকেই। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তেমন বিকাশ ঘটেনি। ৯০’র দশক থেকে বাংলাদেশেও কোরআনিক কালচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় অবশ্য এর সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন শাখায়। দেশের একদল তরুণ এই ধারা পুনর্জাগরণের আন্দোলনে নিয়োজিত। তারা শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে কাজ করতে থাকে। ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র নামক সংগঠন গড়ে ওঠে, যার রয়েছে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের ১৭টি শাখা। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামী কালচার তথা কোরআনিক কালচারকে সমৃদ্ধ করে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করা।
দেশের ক্যালিগ্রাফারদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ’। পবিত্র সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ১০টি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘর গ্যালারিতে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। প্রচুর দর্শক-সমালোচকের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন, মিডিয়াগুলোতে সাড়া পড়ে। এর ফলে সামাজিকভাবেই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, গৃহসজ্জাসহ মসজিদ ডেকোরেশনে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এই শিল্পমাধ্যমটি নিয়ে এখন যারা কাজ করছেন তারা হচ্ছেন—মর্তু বশীর, ড. আবদুস সাত্তার, সৈয়দ এনায়েত হোসেন, বশীরউল্লাহ, রেজাউল করীম, ফরেজ আলী, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, জাহাঙ্গীর হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, শহীদুল এফ বারী, মাহবুব মোর্শেদ, কৃষান মুশাররফ, বশীর মেজবা, আবদুর রহীম, মুবাশ্বির মজুমদার, আমিনুল হক, মুস্তফা মারুফ, আবু দারদা, নিশার জামিল, ফেরদৌস আরা আহমদ ও ফেরদৌসী বেগম। প্রদর্শনীগুলোতে দর্শকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যাও। শিল্পীরা শুধুু দেশে নয়, বিদেশি প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করছে, পুরস্কারও পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশে একটা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
কোরআনিক কালচার এবং ইসলামী শিল্পের এই মাধ্যম ক্যালিগ্রাফি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে শিল্পীরা প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসলামিক কালচারের একটা সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে সংস্কৃতির নামে চলছে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা। চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুসলমানরা হচ্ছে জুলুম নির্যাতনের শিকার। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কোরআনিক কালচারকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়। শিল্প সত্যের জন্য, শিল্প সুন্দরের জন্য। ইসলামী শিল্প বিশেষ করে ‘ক্যালিগ্রাফি’ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সুনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, শুভ চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, মানব চরিত্র উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলাম মানুষকে শুদ্ধ করে এবং শুভ কাজে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে যে শিল্পের সম্পর্ক সে শিল্প কল্যাণকর হবেই। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় উত্সাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশেও ইসলামী কালচার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
তথ্যপঞ্জি
১. Civilization Past and Present.
২. ইন্দো মুসলিম আর্ট—ড. এনামারী সিমেল
৩. শিল্প, সাহিত্য, সাংহমলধতি—মাওলানা আবদুর রহীম
৪. মুসলিম শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৫. ইসলাম ও শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৬. ইসলামী শিল্পকলা—এবনে গোলাম সামাদ
আমরা জানি, মুসলিম শিল্পকলা ও ইসলামী শিল্পকলার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
মুসলিম শিল্পকলা : মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমান শাসক, বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিল্প উত্কর্ষ ও বিকাশ লাভ করে, তা-ই মুসলিম শিল্পকলা।
খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমি, সেলজুক, মামলুক, উসমানীয় খেলাফতের আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষে মোগল আমলে মুসলিম শিল্পকলা ব্যাপক বিকাশ লাভ করে।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে তাদের প্রাসাদে হাম্মাম খানায়, রংমহল, দরবারগৃহ ও হেরেম নৃত্যরত নারী, নারীর শরাব পরিবেশন ও বিভিন্ন প্রাণীর চিত্র, দেয়ালচিত্র ফ্রেস্কো মাধ্যমে মুসলিম শিল্পীরা অঙ্কন করছে।
বাদশা হুমায়ুন ছিলেন সংস্কৃতিমান ও শিল্পরসিক। রাজ্য হারিয়ে পারস্যে কুড়িটি বছর কাটিয়ে দেশে ফেরার সময় তাব্রিজ থেকে মীর সাঈদ আলী ও খাজা আবদুস সামাদ শিরাজী নামক দু’জন খ্যাতিমান শিল্পীকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং এরা স্কুল স্থাপন করে এক শিল্পী তৈরি করে। এদের মাধ্যমে ভারত এবং ইরানি রীতির সংমিশ্রণে ইন্দু-মুসলিম রীতি গড়ে ওঠে। শিল্পীরা রাজদরবারে চিত্র, যুদ্ধচিত্র, রাজাদের প্রতিকৃতি, জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদিকে বিষয়বস্তু করে প্রচুর মিনিয়েচার ছবি অঙ্কন করে। মোগল আমলেই কাগজের ওপর ছবি আঁকা শুরু হয়। কাগজ বানাতে শেখা, ছবি আঁকা থেকে বই লেখা বিশেষভাবে প্রচলিত হয় মোগল আমলেই, তার আগে এ দেশে তালপাতার ওপর লেখা হতো এবং ছোট ছোট ছবিও আঁকা হতো।
বাদশা আকবর শিল্প অনুরাগী ছিলেন। তার সময়ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি চিত্রে শোভিত হয়।
জাহাঙ্গীর নিজেই শিল্পী এবং শিল্প সমালোচক ছিলেন। তার সময়ই ইংরেজ রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো এদেশে আসেন। এই সময় প্রতিকৃতি ও মিনিয়েচার পেইন্টিং করা হয়। ছবিতে আলোছায়া ও পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে সমর্থ হয়। ছবিগুলো খুব বাস্তবধর্মী হয়ে ওঠে। তারা প্রাণীর চিত্র বাস্তবভাবে আঁকতে থাকে, যা বিস্ময়কর। এই সময় স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন তৈরি করা হয়। বিকাশ ঘটে ইসলামী শিল্প ও ক্যালিগ্রাফির। এখানে আমরা ইসলামী শিল্প নিয়েই আলোচনা করব।
ইসলামী শিল্প : ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন’ (আল হাদিস)। যে শিল্পে আল্লাহর মনোনীত ধর্মের অনুশাসনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও তার সৃষ্টির সৌন্দর্য, মহিমা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়, তা-ই ইসলামী শিল্পকলা। এ শিল্প মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়, আহ্বান করে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নির্দেশনা দেয়।
ইসলামের প্রথম যুগেই প্রাণীর চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ করে হাদিস।
এর মধ্যে কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো :
‘হজরত হুজাইফা (রা.) আবু তালহা থেকে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ফেরেস্তারা এমন ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে কুকুর বা ছবি (প্রতিকৃতি) রয়েছে।’
‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে ছবি (প্রতিকৃতি) অঙ্কনকারী লোক।’
‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, আর যে ব্যক্তি ছবি (প্রতিকৃতি) বানালো, তাকে আজাব দেয়া হবে এবং তাকে প্রাণ দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে, অথচ সে তা দিতে পারবে না।’
‘হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, আমরা তোমাদের গির্জায় প্রবেশ করি না এ কারণে যে, সেখানে ছবি রক্ষিত রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস গির্জায় নামাজ পড়তেন, কিন্তু যে গির্জায় ছবি রক্ষিত রয়েছে, সেখানে নামাজ পড়তেন না।’
হজরত মালেক ইবনে আবদুল্লাহর বর্ণনা এই যে, নিষেধ করা হয়েছে সেই ছবি সম্পর্কে, যা প্রকাশ্য স্থানে সংস্থাপন করা হয়। বিছানায় বিছানো ছবির ব্যাপারে কোনো নিষেধ নেই।
তখন শিল্পীরা রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা এখন কী করব? রাসুল (সা.) তাদের নিষ্প্রাণ বস্তু , ফুল, লতা-পাতা আঁকার নির্দেশ দিলেন। মরুভূমিতে খেজুর আর আঙুর গাছ হচ্ছে প্রধান উদ্ভিদ। শিল্পীরা আঙুর, লতা-পাতা দিয়েই ডিজাইন করা শুরু করল। তারা প্রাণিচিত্র আঁকা বর্জন করল। তারা প্রাণিচিত্র বর্জন করে ৪টি উপাদান দিয়ে কাজ শুরু করল :
১. উদ্ভিদীয় পরিকল্পনা বা ফুল-লতা-পাতা।
২. জ্যামিতিক আকার, আকৃতি ও রেখা।
৩. আরবি বর্ণমালা বা ক্যালিগ্রাফি।
৪. বিশুদ্ধ বা অবিমিশ্র রঙের ব্যবহার।
এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত পণ্ডিত শিল্প সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ইসলামী শিল্প পূর্ণ বিকাশ লাভ করে ৮০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।’ এই শতাব্দী যে দীপ্তি এবং ঔজ্জ্বল্য এই আধুনিক সভ্য পৃথিবীর কাছে উপস্থিত করেছে, তা পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার সঙ্গে বিচার করলে অতুলনীয় বিবেচিত হয়। মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে যখন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার আড়ষ্ট সীমা বন্ধন ছিল, একটি দুরন্ত নির্জনতায় পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল তখন ইসলামী সভ্যতা একটি স্বতন্ত্র উন্মুক্ততায় পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। মূলত মুসলমানদের কারণেই পাশ্চাত্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল। অর্থাত্ বর্তমানে যা ইউরোপীয় রেনেসাঁ নামে অভিহিত। ইসলামের সংস্পর্শে না এলে তা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। মুসলমানরা স্পেন বিজয় করার ফলেই ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে নতুন সাড়া পড়েছিল। শিল্প সংস্কৃতির জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।
স্থাপত্য শিল্পে রাসূল (সা.)-এর তৈরি ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘মদিনা মসজিদ’ আজ আধুনিক স্থাপত্যবিদদের কাছে বিস্ময়। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক স্থাপত্যবিদরা গবেষণা করে মদিনা মসজিদকে আধুনিক স্থাপত্যের মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (চলবে)
ইসলামের সঙ্গে যেমন অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য আছে, তেমনি পার্থক্য আছে শিল্প ও সংস্কৃতিরও। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মন্দির সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, যারা ধর্ম প্রচার করেন শুধু তাদের অধিকার রয়েছে সেখানে উপাসনা করার। তাই মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রকোষ্ঠ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে বাইরের আলো-বাতাসের শব্দ প্রবেশ করতে না পারে। পৃথিবীর কর্ম-কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে উপাসনার স্থান হিসেবে নির্জন পাহাড় অজান্তেই বেছে নিয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যেখানে পৃথিবীর কোলাহল স্পর্শ করতে পারেনি।
ইসলামে সম্পূর্ণ ভূখণ্ড আল্লাহর। একজন মুসলমান যে কোনো স্থানে নামাজ আদায় করতে পারেন। ইবাদতের কোনো অন্তরায় নেই। উন্মুক্ততা ইসলামের একটি অংশ। যে কোনো অমুসলিম অতি সহজে কালেমা পড়েই মুসলমান হতে পারেন। মসজিদ নির্মাণ কাঠামোর ও প্রশস্ততায় সহজেই আলো-বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। ভেতরের স্পেসের সঙ্গে বাইরের স্পেসের একটা সঙ্গতি আছে। সহজেই প্রবেশ করা যায়। কোথাও কোনো বাধা নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত। ইসলামের এই উদারতা তার স্থাপত্যে ব্যক্ত হয়েছে।
রাসূল (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপে দুই ধরনের লোক বাস করত। এক দলকে বলা হতো বেদুঈন—এরা নিছক মরুচারী যাযাবর ছিল। আর অন্য দলের লোকরা থাকত শহরে। এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো। দেশে দেশে ব্যবসা করত এরা। ইসলামী শিল্পকলা প্রথম বিস্তার লাভ করে মরুময় অঞ্চলে—তাঁবুতে থাকা মানুষের মধ্যে। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আসবাবপত্র বেশি থাকে না। যাযাবর জীবনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে বেশি জিনিসপত্র নিয়ে চলাফেরা কষ্টকর। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষ প্রধানত তার শিল্পবোধের তৃপ্তি খুঁজছে বয়ন শিল্পের মধ্যে। তাঁবুতে মানুষ গোড়া থেকেই সুন্দর গালিচা বুনতে চেয়েছে। এইসব গালিচা তাঁবুর মধ্যে বিছিয়ে পূরণ করতে চেয়েছে চাদরের অভাব। মরুভূমিতে পানির অভাব থাকায় পানি জোগাড় করে হিসাব করে খরচ করতে না পারলে জীবন চলত না। এই প্রয়োজনে মৃত্পাত্র গড়ার দিকেও তাদের ঝোঁক ছিল। গালিচা, কাপড় ও মৃত্পাত্রের ওপর ফুল, লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এঁকেছে এরা। আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তারা প্রাণীর ছবি অঙ্কন পুরোপুরি বর্জন করেন। আঙুর, লতাপাতা-ফুল দিয়ে নকশা করে মনের সৌন্দর্যবোধকে প্রকাশ করে তৃপ্তি খুঁজেছেন। ইসলামী শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছে মরুচারী যাযাবর জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই। আরবদের আঙুর লতার নকশাকলা বিশেষ জটিল হয়ে ওঠে। ফুল, লতা- পাতা ও জ্যামিতিক আকার আকৃতি দিয়ে করা ইসলামী বিশ্বের বৈশিষ্ট্যসূচক নকশা সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকলা।
ইসলামে মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। তাই কোরআনে উল্লিখিত কোনো ঘটনাবলীকে চিত্রিত অথবা মূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করা হয়নি। খ্রিস্টীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য সম্যকভাবে বুঝতে হলে পড়তে হয় অথবা জানতে হয় ইঞ্জিল কিতাবে (বাইবেল) বর্ণিত ঘটনাবলী। বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পকে বুঝতে হলে জানতে হয় বুদ্ধের জীবনকথা, পড়তে হয় বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী। হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে যে শিল্পকলা গড়ে উঠেছে তাকে যথাযথভাবে বুঝতে পৌরাণিক উপাখ্যান জানতে হয়।
উদ্ভিদীয় পরিকল্পনায় বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ফুল ও লতাপাতা। জ্যামিতিক আকার-আকৃতির মধ্যে বৃত্ত, ঘনক, সরল ও বক্র রেখা বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্ভিদীয় ও জ্যামিতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখা আরবি লিপি দিয়ে যে কোনোভাবে নকশা করা যায়। আরবি অক্ষরের সংখ্যা ২৯টি। এই অক্ষরগুলো আঁকাবাঁকা, খাড়া ও সমান্তরাল। এই অক্ষরগুলো সহজেই ফুল-লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অলঙ্করণের কাজে ব্যবহার করা যায়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে জিবরাঈল (আ) প্রথম বাণী নিয়ে এসেছিলেন—‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক।’ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি (মানুষকে) সৃষ্টি করেছেন; ঘনীভূত রক্তপিণ্ড থেকে। পড় তাঁর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও দয়ালু। যিনি মানুষকে শিখিয়েছেন কলমের ব্যবহার, আর দান করেছেন সেই জ্ঞান যা ছিল মানুষের অজানা।’ (সূরা আলাক : আয়াত ১,২,৩,৪)
রাসুল (সা,) লিখতে পারতেন না, সাহাবীরা আল্লাহর বাণী পাথরের গায়ে, দেয়ালে, গাছের ছালে লিখে রাখতেন। যারা এই আল্লাহর বাণী সুন্দর মনোরম করে লিখতেন, তারাই কাতিব। কাতিবদের মর্যাদা ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। রাসুল (সা.) কাতিবদের ভালোবাসতেন। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। রাসুল (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.) স্বয়ং ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। তিনি কোরআনের আয়াতকে চমত্কার করে লিখে রাখতেন। তিনি বলতেন, ‘সুন্দর হস্তাক্ষর সত্যকে স্বচ্ছ করে তোলে।’ আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। যারা সুন্দরের চর্চা করেন তাদেরকেও পছন্দ করেন।
রাসুল (সা.) ক্যালিগ্রাফি শিল্প এবং শিল্পীদের পছন্দ করতেন ও এই শিল্পের প্রচার প্রসারে কাজ করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বদরের যুদ্ধে যেসব বন্দি মুক্তিপণ দিতে অক্ষম ছিল তাদের প্রত্যেককে দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। এই শিক্ষাদানের মধ্যে ক্যালিগ্রাফিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি মুসলমানদের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার গভীরতা নিরূপণ করা যায়। সে সময়ে শুধু রাসুল (সা.)-এর কাছে নয়, মুসলমান সমাজে সর্বস্তরে ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের কদর ছিল। মুসলিম শাসকরা শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। আব্বাসীয় আমলে রাষ্ট্রনায়করা ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও প্রসারে সহায়তা করেছেন। অক্ষরকে বিশেষভাবে বিন্যাসের মাধ্যমে সুন্দর আকর্ষণীয় রূপ দেয়া এবং ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখেই অতীতে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ৩১ নং আয়াতের আলোকেই বিশ্বাস করা হয়। যেহেতু প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে আদম (আ)-কে অবহিত করা হয়েছে সেহেতু তাঁকে আরবি সম্পর্কেও অবগত করানো হয়েছে। এই বিশ্বাসের আলোকেই বিভিন্ন তথ্যে বলা হয়েছে যে আদম (আ) এরপর তার পুত্র শীষ (আ) আরবি বর্ণ ও বিন্যাসের উত্কর্ষ সাধন করেন। এমনিভাবেই বংশানুক্রমে তাঁরাই আরবি ভাষার বিকাশ সাধন করেছেন। আব্বাসীয় আমলে মুসলিম সভ্যতার যখন স্বর্ণযুগ, তখন আরবি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বলে জানা যায়।
গ্রিক কধষষড়ং এবং এত্ধঢ়যবরহ শব্দ দু’টির মিলিত রূপ ‘ক্যালিগ্রাফিয়া’ থেকে ইংরেজি ‘ক্যালিগ্রাফি’ যার অর্থ ‘সুন্দর লেখা’ হস্তলিখন শিল্প।
পৃথিবীর আরও অনেক ভাষায় ক্যালিগ্রাফি হয়েছে। যেমন- চীন, জাপানে ছবি আঁকা শুরু করতে হয় ক্যালিগ্রাফি দিয়েই। অন্য কোনো দেশের বর্ণমালা এত সুন্দর করে আঁকা সম্ভব হয় না। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে। মানব মুখে প্রথম উচ্চারিত ভাষা আরবি, বেহেশতের ভাষা আরবি পৃথিবীর প্রথম ভাষা আরবি, পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের ভাষা আরবি। আরবি অক্ষর ইসলামী শিল্পকলাকে দিয়েছে বিশিষ্ট রূপ ও শিল্পগত ঐক্য। আরবি লিপিকলা ইসলামে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। চিত্রের স্থান দখল করে রয়েছে আরবি ক্যালিগ্রাফি। সুন্দর লিপিই হচ্ছে শিল্পের মাধ্যমে ইসলামের বাণী প্রচারের উপায়। কোরআনের বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী, যা মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। আল্লাহকে আমরা দেখি না, কিন্তু তাঁর বাণী তিলাওয়াতের সময় আমরা দেখি। কাজেই শিল্পীরা অক্ষরগুলোকে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং তারা এ কাজকে আল্লাহর ইবাদত মনে করেছেন। এ জন্যই ক্যালিগ্রাফি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র। কোরআনের এই ভাষাকে অবলম্বন করে যে লিখন শিল্প মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে উঠেছিল, তা সারা বিশ্বের জন্য অতুলনীয় শিল্প সম্পদ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত সুন্দর হস্তাক্ষরের মাধ্যমে বিশেষভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কাজেই এ ভাষার একটা অলৌকিকতা আছে। তাই যুগ যুগ ধরে কোরআনের বাণীকে সুন্দর লিখন পদ্ধতিতে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সুতরাং এক অর্থে হস্তলিখিত কোরআন অলৌকিকতা ধারণ করে রাখার চেষ্টা করেছে। হস্তলিখিত কোরআনের বাণী হচ্ছে অলৌকিক বাণী শৈল্পিক রূপব্যঞ্জনা। মুসলমানরা একে উচ্চাঙ্গ শিল্পে পরিণত করেছে। এই লিখন পদ্ধতির প্রকৃতি একক নয়, বহুবিধ। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে একটি শৈল্পিক রূপ লক্ষ করা যায়। তা হচ্ছে অক্ষরগুলো লম্বা এবং সমান্তরাল স্বভাবের। এই দুই বৈপরীত্যের মাধ্যমে শিল্পীরা লিপিকর্মে সৌন্দর্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন আল্লাহ শব্দটিতে যে কয়টি অক্ষর আছে, সে কয়টি লম্বা স্বভাবের। এই লম্বা স্বভাবটি সমান্তরাল স্বভাবের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে যে বিচিত্র রূপ-দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে, তা লিপিকর্মে অতুলনীয়। ফুল, লতাপাতা ও জিওমেট্রিক্যাল ফর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে কোনোভাবে এই লিপিকে উপস্থাপন করা যায়, যা অন্য কোনো ভাষার লিপি দ্বারা সম্ভবপর নয়। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি এত ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
মুঘল লিপিকলা : মুঘল সম্রাটরা লিপিকলার মহান পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিপুণ লিপিকারও ছিলেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘খত্তেতবই বাবুরি’ বা বাবুরি লিপি নামে একপ্রকার হস্তলিপি প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক বাদায়ুনীর মতে, তিনি নিজ হাতে বাবুরি লিপিতে এক জিলদ কোরআন শরীফ নকল করে মক্কা শরীফে পাঠান। তাঁর পৌত্র সম্রাট আকবর ছিলেন শিল্পের পরম সমঝদার ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। বহু চিত্রকর ও লিপিকার তার দরবার অলঙ্কৃত করতেন। তাদের তিনি গুণ ও নৈপুণ্যের জন্য অকাতরে পুরস্কৃত করতেন আর সম্মানজনক খেতাব দান করতেন। জায়গীর রূপে ভূ-সম্পত্তি এবং মাঝে মাঝে উচ্চ সরকারি পদও দান করতেন। আকবরের রাজত্বকালে যেসব বিখ্যাত লিপিকারের আবির্ভাব হয়েছিল (তাবকিয়া-ই-খুশ নবীশান বা লিপিকার স্মৃতি নামক পুস্তকে এদের প্রায় সবারই উল্লেখ আছে)। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন, কাশ্মীরবাসী মুহাম্মদ হুমায়ুনের নাম (মৃত্যু ১০২০ হিজরি)। তিনি ‘বরবীন কলম’ বা ‘স্বর্ণ কলমধারী’ নামে পরিচিত। বাদশাহ আকবর তাকে এই সম্মানজনক খেতাবটি দিয়েছিলেন। মনোজ্ঞ লিপিকলায় আইন-ই-আকবরীর মনোরম চিত্রশোভিত এমন একটি চমত্কার পাণ্ডুলিপি উজ্জয়িনীতে ছিল। পরে লন্ডনে নিয়ে রাখা হয়। অন্য লিপি শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মোল্লা মীর আলী ও তার শিষ্য মাওলানা বাকী মাশহাদের মুহাম্মদ আমীন মীর হুসাইনী কুলানকী, মাওলানা আবদুল হাই, মাওলানা দাত্তরী, সুলতান বায়যীদ (আকবর তাকে কাতিবুল মূলক বা রাজ্যের লিপিকার খেতাবে ভূষিত করেছিলেন)। মাওলানা আবদুর রহীম আমবরীন কলম। তিনি প্রসিদ্ধ নামতালীফ লেখক ছিলেন এবং পারস্য কবি নিযামীর খামসা (পঞ্চমী) নকল করেছিলেন। কাশ্মীরের আলী চমন, নূরুল্লাহ কাসিম আরমালান, শিরাজের খাজা আবদুস সামাদ মুয়াফ্ফর আলী, কান্দাহারের মীর মাসুদ (তিনি ফতেহপুর সিক্রির অট্টালিকার শিলালিপিগুলো নিজ হাতে লিখেছেন)। আশরাফ খান নামে পরিচিত মুহাম্মদ আসগর। তিনি নাসতালিফ লিপির বিশেষজ্ঞ এবং হস্তলিপিতে পারদর্শী ছিলেন। অর্থাত্ নসথ লিপির ছয় প্রকার রীতি নাসতালিফ লিপিতে বুত্পত্তিসম্পন্ন ছিলেন। (ওই ছয়টি রীতি সাধারণত ইবনমুকলা দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল বলে কথিত হয়) সেই সময় কয়েকজন প্রসিদ্ধ হিন্দু লিপিকারও ছিলেন। যথা- রাও মনোহর, পণ্ডিত জগনাথ এবং লিপিকলার প্রতি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আকর্ষণ তার কৃতী পিতার চেয়ে কম ছিল না। তার আত্মজীবনী থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ফরাসি ভাষায় সুলেখক ছিলেন। তার পূর্ববর্তীদের মতো তিনিও লিপিকারদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এই লিপিকারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তরবীয়ের মীর আবদুল্লাহ। তিনি মুশকীন কলম (কস্তুরী গন্ধী কলমধারী) নামে পরিচিত। আকবর তাকে এই খেতাব দিয়েছিলেন। তিনি হস্তলিপি রীতিতে পারদর্শী ছিলেন। অন্য লিপিকারদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ শিরিন কলমের পুত্র মুহাম্মদ শরীফ। শিকাসতা লিখনরীতিতে পারদর্শী মিরযা মুহাম্মদ হুমায়ুন। হিরাতের মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক। তিনি মিরযা কামরানের দীওয়ান নকল করেছিলেন এবং সবশেষে তগরারীতি লেখক আহমদ আলী আরশাদ। তিনি ফতেহপুর সিক্রির বিরাট ফটকের পশ্চিম দিকের শিলালিপিগুলো লিখেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথমদিকে তিনি ‘নাসতালীফ’ লিখনরীতির প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে যারা তার অনুসরণ করত তিনি তাদের পুরস্কৃত করতেন। তাযফিয়া-ই খুশনবীশান পুস্তকে লিখিত আছে যে সম্রাট এই অনুকরণকারীদের একশ’ ঘোড়সওয়ারের পরিচালনার পদে নিযুক্ত করতেন। তার সময়ে অনেক অভিজ্ঞ লিপিকার ছিলেন শিরাযের আবদুল হাই ওরফে আমানত খান মীর আবদুল্লাহ মুশকীন রকমের পুত্র তররীযের মীর সালিহ, নমখ লিপিতে পারদর্শী এবং শাহজাদা আওরঙ্গজেবের গৃহশিক্ষক আবদুল বাকী। তিনি তিরিশ পাতায় সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ নকল করে সম্রাটকে উপহার দেয়ায় ‘য়াকুত রকম’ (রত্ন লেখনি ধারক) খেতাব পেয়েছিলেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ঈমান আকিদার দিক দিয়ে প্রকৃত মুসলমান। প্রাণী চিত্রাঙ্কনের যে ধারা চলছিল, তিনি এগুলো বন্ধ করেছিলেন কিন্তু লিপিকলার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এই কলাটি শিখেছিলেন তার গ্রন্থাগারিক ও দরবারী লিপিকার মীর ইযাদের কাছ থেকে সাইদ আলী খান জওহর রকমের (হীরক লেখনী ধারক) কাছে। শাহানশাহ নমখ ও নাসতালীফ উভয় লিপিতেই পারদর্শী ছিলেন। তবু তিনি আর একজন সমসাময়িক লিপিকার ও দরবারী গ্রন্থানিক কমল হিদায়িতুল্লাহ খানের লিপির তারিফ করতেন। সম্রাটের পত্রাবলীতে এর উল্লেখ আছে। এই সময়ে আর একজন জওহর রকম ছিলেন শামছুদ্দীন আলী খান। আওরঙ্গজেবের সময়েও কয়েকজন হিন্দু লিপিকার ছিলেন, যথা পণ্ডিত লক্ষ্মীরাম লাল, সুখরাম মুনশী, মাহবুব রায়ম, মুনশী কমল রায়। মুঘল সাম্র্রাজ্যের অবনতির দিনেও লিপিকলার উন্নতি অব্যাহত থাকে। ফর্রুখ শিয়রের আমলে হাজী নামদার ও মিরযা খাতিম বেগ সুপরিচিত লিপিকার ছিলেন।
দ্বিতীয়ত : আকবরের সময় যে কয়জন লিপিকার খ্যাতিলাভ করেন, তাদের মধ্যে আছেন মীর মোহাম্মদ হুমায়ুন, গুলাম আলী খান, হাফিজ ইব্রাহিম, হাফিজ বরকতুল্লাহ, মীর আবুল হামায, মীর যয়নুল আবেদীন, মীর মাহদী এবং খাজা গুলাম নকশাবন্দ খান। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহও একজন শিল্পী, কবি ও লিপিকার ছিলেন। দিল্লিতে যীনত মহলের এবং হামীম আহসানুল্লাহ খানের হামমামের শিলালিপিতে রক্ষিত আছে। এগুলো তার অপূর্ব নৈপুণ্যের স্বাক্ষর দিল্লির জাদুঘরেও তাঁর লিপির নিদর্শন রক্ষিত আছে। তার সময় নিপুণ লিপিকার ছিলেন মুহাম্মদ জান, মীর ইমাদ আলী ও তার পুত্র মীর জালালুদ্দীন।
মুসলিম কৃষ্টিধারায় লিপিবিদ্যার স্থান অতি উচ্চে। বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় লিপিকলা ছিল পাঠ্যসূচির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। আরব ও পারস্যবাসী লিপিকলার উদ্ভাবন করেন।
লিপিকলার কিছু রূপ ও রীতির নাম—খততই আনিফা, খততই যুলফ, খততই পায়চান, খততই নাখুন, খততই তাওয়াম। এর অধিকাংশই লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনে ও অলঙ্কারের উদ্দেশে ব্যবহৃত হতো।
একদানা চালের ওপর কোরআন শরীফের একটি সম্পূর্ণ আয়াত অঙ্কিত করতে পারা শিল্পের এবং লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট পন্থা ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের পরে বহু বিখ্যাত আলিম ও গুণী কবি লখনৌতে চলে যান। তখন সেখানে সর্বপ্রকার শিল্প, সাহিত্য ও কৃষ্টি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭৯২ খ্রি. দিল্লিতে যে ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপিত হয় এর পাঠ্যসূচির লিপিকলা অন্যতম শিক্ষনীয় বিষয় বলে নির্দিষ্ট হয়েছিল। সাঈদ মুহাম্মদ নামক একজন বিখ্যাত লিপিকারকে এই কলাবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়েছিল।
আধুনিক কালেও আমরা দেখি ইরান, পাকিস্তান, সুদান ও নাইজেরিয়ার এই লিপিশিল্প অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
ইরানের জলিল রাসুলী, সৌদি শিল্পী আহম্মদ মোস্তফা আরবি লিপিকলাগুলোকে ক্যানভাসে চমত্কার অনুজ্জ্বল রঙে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন একান্তই নিজের। তার ছবিটির নাম ‘দি ওয়ারিয়র অব বদর’।
ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী জামিল হামদি আরবি লিপিকে জ্যামিতিক ফর্মে উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব রীতিতে। শিল্পী যুুদা মালাম তার ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে লিপির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। শিল্পী শাকের হাসান তার ফর্মের সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে স্বর্ণ পেয়েছিলেন ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী ‘সাদী আল কাবী’। তার ছবির বিষয়বস্তু ছিল ক্যালিগ্রাফি ‘মরুভূমির শিলালিপি’। গত ১৯৯১ সালে এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীর লিপিশৈলী-১,২,৩,৪ নামে ৪টি ছবি প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকের দৃষ্টি কাড়ে। ক্যানভাসে স্পেচুলা ও কোথাও ব্রাশ দিয়ে মোটা তেল রঙে তাঁর যে ব্রাশিং, তা দর্শকদের মুগ্ধ করে। তার ছবি মনে হয় আরবি লেখা কিন্তু কি লেখা বোঝা দুরূহ অর্থাত্ একটা ইলিউশন তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে জানুয়ারি মাসে রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিক ক্যালিগ্রাফি শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। মিসরের সাইয়েদ ইব্রাহীম মো. সাব্বির আল হিলালী, তিউনিসের মো. ছালেহ আল খুমসি, ইরাকের হাশেম বাগদাদে অংশগ্রহণ করেন। প্রদর্শিত ক্যালিগ্রাফিগুলো চিত্রায়ণ হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। চমত্কার কম্পোজিশন রঙ ও রেখায় বিমূর্ত শিল্পে উন্নীত করা হয়েছে।
এই লিখন পদ্ধতি পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলায় প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রমাণ আমরা পাই বিখ্যাত শিল্পী পল ক্লী’র বিভিন্ন চিত্রকর্মে। তার ‘ডকুমেন্ট’ বা দলিল নামে ছবিটির কতগুলো আরবি বর্ণমালা ছাড়া আর কিছু নয়। রেখাঙ্কনেও আমরা আরবি লিখন পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করি। আরবি ক্যালিগ্রাফি ইউরোপীয় শিল্পেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আরবি না জেনেও ইউরোপীয়রা আরবি লেখার অনুকরণে নকশা করেছে। কাপড়ের বুননে ও নকশায় আরবি লিপিকলার অনুসরণ করার চেষ্ট করা হয়েছে।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল পাবলো পিকাসোর জন্ম স্পেনের আনদানুমিয়া অঞ্চলে। এই অঞ্চল আরবদের অধীন ছিল প্রায় ৭শ’ বছর। এখানকার নকশায় ইসলামী জ্যামিতিক মণ্ডনকলার প্রভাব খুবই স্পষ্ট। পিকাসোর ছবিতেও একসময় জ্যামিতিক নকশার প্রভাব দেখা যায়।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিখ্যাত শিল্পী আঁরি মাতিস তার ছবির অনুপ্রেরণা পান ইরানি গালিচা থেকে। তার ছবির রঙ ও ফর্ম গালিচা থেকে নেয়া। তিনি তার শিল্পে অবিমিশ্র রঙের পাশাপাশি সংস্থাপনের মাধ্যমে রঙের আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পে ইসলামী শিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাব পড়েছে। বিমূর্ত শিল্পের জনক মন্ডিয়ন ক্যালিগ্রাফি শিল্পে মুগ্ধ হয়ে বিমূর্ত শিল্পের জন্ম দিয়েছেন। বিমূর্ত শিল্পের ফিগার নেই, ফর্ম আছে। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফির আদলে ফর্ম ব্যবহার করেছেন তাদের চিত্রকর্মে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর শিল্পের বিমূর্ততার উদ্ভব এখান থেকেই।
পৃথিবীর সব দেশেই আজ ইসলামী শিল্প নিয়ে নিরীক্ষা চলছে, ধর্মগত কারণে নয়, শিল্পের বৈশিষ্ট্যগত কারণে। কাজেই ইসলামী শিল্পধারা একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী শিল্পধারা হিসেবে আজ পরিগণিত। অর্থাত্ কোরআনিক কালচারাল ক্যালিগ্রাফি নিয়ে বাংলাদেশেও ৭০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত অনেক খ্যাতিমান শিল্পী কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে মুর্তজা বশীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, খুরশিদ আলম, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলামসহ আরও অনেকেই। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তেমন বিকাশ ঘটেনি। ৯০’র দশক থেকে বাংলাদেশেও কোরআনিক কালচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় অবশ্য এর সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন শাখায়। দেশের একদল তরুণ এই ধারা পুনর্জাগরণের আন্দোলনে নিয়োজিত। তারা শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে কাজ করতে থাকে। ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র নামক সংগঠন গড়ে ওঠে, যার রয়েছে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের ১৭টি শাখা। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামী কালচার তথা কোরআনিক কালচারকে সমৃদ্ধ করে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করা।
দেশের ক্যালিগ্রাফারদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ’। পবিত্র সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ১০টি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘর গ্যালারিতে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। প্রচুর দর্শক-সমালোচকের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন, মিডিয়াগুলোতে সাড়া পড়ে। এর ফলে সামাজিকভাবেই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, গৃহসজ্জাসহ মসজিদ ডেকোরেশনে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এই শিল্পমাধ্যমটি নিয়ে এখন যারা কাজ করছেন তারা হচ্ছেন—মর্তু বশীর, ড. আবদুস সাত্তার, সৈয়দ এনায়েত হোসেন, বশীরউল্লাহ, রেজাউল করীম, ফরেজ আলী, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, জাহাঙ্গীর হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, শহীদুল এফ বারী, মাহবুব মোর্শেদ, কৃষান মুশাররফ, বশীর মেজবা, আবদুর রহীম, মুবাশ্বির মজুমদার, আমিনুল হক, মুস্তফা মারুফ, আবু দারদা, নিশার জামিল, ফেরদৌস আরা আহমদ ও ফেরদৌসী বেগম। প্রদর্শনীগুলোতে দর্শকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যাও। শিল্পীরা শুধুু দেশে নয়, বিদেশি প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করছে, পুরস্কারও পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশে একটা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
কোরআনিক কালচার এবং ইসলামী শিল্পের এই মাধ্যম ক্যালিগ্রাফি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে শিল্পীরা প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসলামিক কালচারের একটা সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে সংস্কৃতির নামে চলছে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা। চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুসলমানরা হচ্ছে জুলুম নির্যাতনের শিকার। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কোরআনিক কালচারকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়। শিল্প সত্যের জন্য, শিল্প সুন্দরের জন্য। ইসলামী শিল্প বিশেষ করে ‘ক্যালিগ্রাফি’ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সুনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, শুভ চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, মানব চরিত্র উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলাম মানুষকে শুদ্ধ করে এবং শুভ কাজে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে যে শিল্পের সম্পর্ক সে শিল্প কল্যাণকর হবেই। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় উত্সাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশেও ইসলামী কালচার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
তথ্যপঞ্জি
১. Civilization Past and Present.
২. ইন্দো মুসলিম আর্ট—ড. এনামারী সিমেল
৩. শিল্প, সাহিত্য, সাংহমলধতি—মাওলানা আবদুর রহীম
৪. মুসলিম শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৫. ইসলাম ও শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৬. ইসলামী শিল্পকলা—এবনে গোলাম সামাদ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন