তারা এসে পড়ল সন্ধ্যার আগে আগে। বিরাট একটা দল। মার্চ-টার্চ কিছু না। এলোমেলোভাবে হেঁটে আসা। সম্ভবত বহুদূর থেকে আসছে। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে একেক জন। ঘামে মুখ ভেজা। ধূলি ধূসরিত খাকি পোশাক।
গ্রামের লোকজন প্রায় সবাই লুকিয়ে পড়ল। শুধু বদি পাগলা হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মহানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, বিষয় কি গো?
পুরো দল থমকে দাঁড়াল মুহূর্তে। বদি পাগলার হাতে একটা লাল গামছা। সে গামছা নিশানের মত উড়িয়ে চেঁচাল, কই যান গো আপনেরা? এমন অদ্ভুত ব্যাপার সে আগে কখনো দেখেনি।
মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস। তিনি সানগ্লাস খুলে ফেলে ইংরেজিতে বললেন, লোকটা কি বলছে? রফিকউদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, লোকটা মনে হচ্ছে পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে পাগল থাকে।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
বুঝলে কি করে এ পাগল?
রফিকউদ্দীন চুপ করে গেল। মেজর সাহেবের খুব পেঁচানো স্বভাব। একটি কথার দশটি অর্থ করেন। বদি পাগলাকে দেখা গেল ছুটতে ছুটতে আসছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। রফিক ধমকে উঠল, ‘এ্যাই, কি চাস তুই?’ বদি পাগলার হাসি আরো বিস্তৃত হল। রফিক কপালের ঘাম মুছল। সরু গলায় বলল, লোকটা স্যার পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে... ।
এই কথা তুমি আগে একবার বলেছ। একই কথা দু’তিনবার বলার প্রয়োজন নেই।
রফিক ঢোঁক গিলল। মেজর সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এ জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। সবাই টায়ার্ড।
মাইল পাঁচেক গেলেই স্যার নবীনগর। খুব বড় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে স্যার নবীনগর চলে যাওয়া ভাল।
কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না স্যার, ভয় পাব কেন?
মেজর সাহেব দলটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বললেন। মৃদু সাড়া জাগল। নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল সবাই। মাথা থেকে ভারী হেলমেট খুলে ফেলতে লাগল। মেজর সাহেব নিচু সুরে বললেন, পাগলটাকে বেঁধে ফেলতে হবে।
তিনি কাঠের একটি বাক্সের ওপর বসে পাইপ ধরালেন। খাকি পোশাক পরা কারো মুখে পাইপ মানায় না। কিন্তু মেজর সাহেব অসম্ভব সুপুরুষ। তাঁর মুখে সবকিছুই মানায়।
পাগলটাকে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হল। তার কোনো আপত্তি দেখা গেল না। বরং কাছাকাছি থাকতে পারার সৌভাগ্যে তাকে আনন্দিত মনে হল। কেউ তার দিকে তেমন নজর দিল না। এরা অসম্ভব ক্লান্ত। এদের দৃষ্টি নিরাসক্ত ও ভাবলেশহীন।
মেজর সাহেব পানির বোতল থেকে কয়েক চুমুক পানি খেলেন। বুটজুতা জোড়া খুলে ফেললেন। তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ফোসকা পড়েছে। রফিক বলল, ডাব খাবেন স্যার? মেজর সাহেব সে কথার জবাব না দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, আগে আমরা কোনো গ্রামে গেলেই ছোটখাটো একটা দল পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে আসত। এখন আর আসে না। এর কারণ কি জান?
জানি না স্যার।
ভয়ে আসে না। এই গ্রামের সব ক’টি লোক এখন জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। ঠিক না?
রফিক জবাব দিল না। বদি পাগলা বলল, এট্টু বোতলের পানি খাইতে মন চায়।
ও কি চায়?
ওয়াটার বটল থেকে পানি খেতে চায় স্যার।
গ্রামের সবাই পালিয়ে গেলেও আজীজ মাস্টার যেতে পারেনি। কারণ সোনাপোতা থেকে তার ছোট বোন এসেছিল। আজ সকাল থেকেই তার প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে। এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে টানাটানি করা যায় না। তবু আজীজ মাস্টার দু’বার বলল, ধরাধরি কইরা নাওডাত তুললে শ্যামগঞ্জ লইয়া যাওন যায়। তার জবাবে আজীজ মাস্টারের মা তার কাপুরুষতা নিয়ে কুিসত একটা গাল দিয়েছেন। পা ভাঙা বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজীজ মাস্টার প্রতিবাদ করেনি। কারণ কথাটি সত্যি। সে বড়ই ভীতু। গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে শোনার পর থেকে তার ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। সে বসে আছে উঠোনে এবং সামান্য শব্দেও দারুণভাবে চমকে উঠছে।
মাস্টার বাড়িতে আছে?
কেডা?
আমরা। খবর হুনছ? বদি পাগলারে বাইন্দা রাখছে আম গাছে।
হুনছি।
নীলগঞ্জের মুরব্বিদের কয়েকজন শংকিত ভঙ্গিতে উঠে এল উঠোনে।
তোমার তো একটু যাওন লাগে মাস্টার।
কই যাওন লাগে?
দবীর মিয়া তার উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি ছাড়া কে যাইব? তুমি ইংরেজি জান। শুদ্ধ ভাষা জান।
মিলিটারির কাছে যাইতে কন?
হ।
আমি গিয়া কি করতাম?
গিয়া কইবা এই গেরামে কোনো অসুবিধা নাই। পাকিস্তানের নিশানটা হাতে লইয়া যাইবা। ভয়ের কিছু নাই।
মাস্টার অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। দবীর মিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, কথা কও না যে?
আমি যাই ক্যামনে? বাড়িতে অত বড় বিপদ। পুতির বাচ্চা অইব।
তোমার তো কিছু করনের নাই মাস্টার। তুমি ডাক্তারও না, কবিরাজও না।
মাস্টার ক্ষীণস্বরে বলল, পাকিস্তানের পতাকা পাইয়াম কই?
ক্যান ইস্কুলের পতাকা কি করলা?
ফালাইয়া দিছি।
ফালাইয়া দিছ? ক্যান?
মাস্টার জবাব দেয় না। দবীর মিয়া রাগী গলায় বলে, আইএ পাশ করলে কি হইব মাস্টার, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি অয় নাই। পতাকাটি তুমি ফালাইলা কোন আক্কেলে? অখন কি আর করবা? যাও খালি হাতে।
আমার ডর লাগে চাচাজী।
ডরের কিছু নাই। এরা বাঘও না, ভল্লুকও না। তুমি গিয়া খাতির-যত্ন কইরা দুইটা কথা কইবা। এক মিনিটের মামলা। কি কও আসমত?
নেয্য কথা।
দেরি কইরো না। আন্ধাইর হওনের আগেই যাও।
একলা?
একলা যাওনই বালা। একলাই যাও। তিনবার কুলহু আল্লাহ কইয়া ডাইন পাওডা আগে ফেলবা। পাঁচবার মনে মনে কইবা ‘ইয়া মুকাদ্দেমু’ ভয়-ডরের কিছুই নাই মাস্টার। আল্লাহর পাক কালাম। এর মরতবাই অন্যরকম।
আজীজ মাস্টার মাথা নিচু করে বসে রইল। তার আবার প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। ঘরের ভেতর থেকে পুতি কুঁ কুঁ করছে। প্রথম পোয়াতি, খুব ভোগাবে।
ভইনটারে এমুন অবস্থায় ফালাইয়া ক্যামনে যাই?
এইটা কি কথা? তুমি ঘরে থাইক্যা করবাটা কি? বেকুবের মত কথা কও খালি। উঠ দেহি।
আজীজ মাস্টার উঠল।
মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মুখের ভাব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বসে আছেন কাঠের একটি বড় বাক্সের ওপর। পা দু’টি ছড়ানো। মেজর সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কি চাও?
আজীজ মাস্টার থতমত খেয়ে গেল। এ বাংলা জানে নাকি? কি আশ্চর্য!
কি চাও তুমি?
জ্বি, কিছু চাই না।
মেজর সাহেব এবার ইংরেজিতে বললেন, কিছু না চাইলে এসেছ কেন?
তামাশা দেখতে? সার্কাস হচ্ছে?
আজীজ মাস্টার ঘামতে শুরু করল। মেজর সাহেবের পরবর্তী সমস্ত কথোপকথন হল ইংরেজিতে। আজীজ মাস্টার বেশিরভাগ জবাবই দিল বাংলায়। তাতে অসুবিধা হল না। মেজর সাহেব বাংলা বুঝতে পারেন।
তুমি কি কর?
আমি এখানকার প্রাইমারি স্কুলের টিচার।
এখানে আবার স্কুলও আছে নাকি?
জ্বি স্যার।
আর কি আছে?
একটা মসজিদ আছে।
শুধু মসজিদ? মন্দির নেই? পূজা হয় যেখানে?
জ্বি না স্যার।
ঠিক করে বল মন্দির আছে কিনা?
নাই স্যার।
মেজর সাহেব পাইপ ধরালেন। ঠাণ্ডা গলায় কাকে যেন পাঞ্জাবি বা অন্য কোনো ভাষায় কি বললেন। সেই লোকটি উঠে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল আজীজ মাস্টারের গালে। আজীজ মাস্টার চিত্ হয়ে পড়ে গেল। আম গাছের সঙ্গে বাঁধা বদি পাগলা দারুণ অবাক হয়ে বলল, ও মাস্টার উঠ উঠ। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মেজর সাহেব বললেন, তোমার নাম কি?
আজীজুর রহমান।
আজীজুর রহমান, তোমাদের এদিকে মুক্তিবাহিনী আছে?
জ্বি না।
সবাই পাকিস্তানি?
জ্বি।
বাহ, খুব ভাল। তুমি নিজেও একজন খাঁটি পাকিস্তানি, ঠিক?
জ্বি স্যার।
সবাই পাকিস্তানি হলে এত ভয় কিসের? আমার তো মনে হয়, এ গ্রামের সবাই ভয়ে পালিয়েছে। মেয়েগুলি লুকিয়ে আছে জঙ্গলে, ঠিক না?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। বমি আসছে। বহু কষ্টে সে বমির বেগ সামলাতে লাগল।
তোমাদের কি ধারণা, আমরা তোমাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাব?
আজীজ মাস্টার চুপ করে রইল।
কি, কথা বলছ না যে? তোমার স্ত্রীও কি জঙ্গলে লুকিয়েছে?
স্যার আমি বিয়ে করিনি।
বিয়ে করনি? বয়স কত তোমার?
চল্লিশ।
চল্লিশ, এখনো বিয়ে করনি? তাহলে চালাও কিভাবে? মাস্টারবেট কর?
আজীজ মাস্টার কপালের ঘাম মুছল। মেজর সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, কথার জবাব দাও। রফিকউদ্দীন ক্ষীণ সুরে বলল, স্যার জানতে চাচ্ছেন আপনি হস্তমৈথুন করেন কিনা? বলে ফেলেন ভাই। স্যার রেগে যাচ্ছেন।
করি না।
বল কি? তোমার যন্ত্রপাতি ঠিক আছে? দেখি, পায়জামা খুলে সবাইকে দেখাও তো।
স্যার কি বললেন?
পায়জামা খুলে তোমার যন্ত্রটা সবাইকে দেখাতে বললাম। ঝটপট কর। দেরি করবে না। আমার হাতে বেশি সময় নেই।
আজীজ মাস্টার অবাক হয়ে তাকাল রফিকের দিকে। রফিকউদ্দীন অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুলে ফেলেন ভাই। ব্যাটা ছেলেদের মধ্যে আবার লজ্জা কি? খুলে ফেলেন, স্যার রাগ করছেন। মেজর সাহেব নিচু গলায় কি একটা বললেন, একজন এসে হ্যাঁচকা টানে আজীজ মাস্টারের পায়জামা নামিয়ে ফেলল। মেজর সাহেব বললেন, জামাটাও খুলে নাও।
আজীজ মাস্টার দু’হাতে তার লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল চারদিকে। একজন কে যেন কাগজের দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল আজীজ মাস্টারের দিকে। মেজর সাহেব বললেন, তুমি পাকিস্তানিদের ভালবাস?
জ্বি স্যার।
ভেরি গুড। আমাকেও নিশ্চয়ই ভালবাস। বাস না? বল, বলে ফেল।
বাসি স্যার।
যে তোমাকে নেংটা করে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে, তাকেও তুমি ভালবাসছ। তুমি তো বিশ্বপ্রেমিক দেখছি।
মেজর সাহেব অনুচ্চ স্বরে কি একটা বলতেই চারদিকে হাসির বান ডেকে গেল। বদি পাগলা চোখ বড় করে বলল, মাস্টার, তোমার কাপড় কই? এ্যাই মাস্টার।
আজীজ মাস্টার ঘোলা চোখে তাকাল তার দিকে। তার বমি বমি ভাবটা কেটে গেছে। শুধু মাথার পিছন দিকটায় তীব্র ও তীক্ষষ্ট একটি যন্ত্রণা। মেজর সাহেব বললেন, আজীজুর রহমান, তুমি ভয়ে মিথ্যা কথা বলছ প্রাণে বাঁচবার জন্যে। সত্যি কথা বল তোমাকে ছেড়ে দেব, তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?
না।
এই তো আসল কথা বেরুচ্ছে। তুমি কি চাও এটা বাংলাদেশ হোক?
জ্বি স্যার।
তুমি তাহলে একজন দেশদ্রোহী। দেশদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আমি সেই ব্যবস্থাই করতে চাই। নাকি তুমি বাঁচতে চাও?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না।
দেরি করবে না। বলে ফেল বাঁচতে চাও কি-না।
রফিকউদ্দীন ভয়-পাওয়া গলায় বলল, বলেন ভাই বাঁচতে চাই। এ রকম করছেন কেন? শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
বদি পাগলা আবার কথা বলে উঠল, ও মাস্টার কাপড় পিন্দ! তুমি নেংটা।
আজীজ মাস্টার নড়ল না। মেজর সাহেব বললেন, কাপড় পর। কাপড় পরে আমার সামনে থেকে বিদেয় হয়ে যাও। ক্লিয়ার আউট।
আজীজ মাস্টার কাপড় পরল না। হঠাত্ একদলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের ডান হাঁটুর কাছে এসে পড়ল। মেজর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। চারদিকে কোনো শব্দ নেই। আজীজ মাস্টার এগিয়ে এসে আরেক দলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের শার্টে এসে পড়ল। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। এবার আমরা রওয়ানা হব।
সৈন্যদল মার্চ করে এগুচ্ছে। মেজর সাহেবের মুখ অসম্ভব বিবর্ণ। পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন নগ্ন মানুষ।
গ্রামের লোকজন প্রায় সবাই লুকিয়ে পড়ল। শুধু বদি পাগলা হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মহানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, বিষয় কি গো?
পুরো দল থমকে দাঁড়াল মুহূর্তে। বদি পাগলার হাতে একটা লাল গামছা। সে গামছা নিশানের মত উড়িয়ে চেঁচাল, কই যান গো আপনেরা? এমন অদ্ভুত ব্যাপার সে আগে কখনো দেখেনি।
মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস। তিনি সানগ্লাস খুলে ফেলে ইংরেজিতে বললেন, লোকটা কি বলছে? রফিকউদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, লোকটা মনে হচ্ছে পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে পাগল থাকে।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
বুঝলে কি করে এ পাগল?
রফিকউদ্দীন চুপ করে গেল। মেজর সাহেবের খুব পেঁচানো স্বভাব। একটি কথার দশটি অর্থ করেন। বদি পাগলাকে দেখা গেল ছুটতে ছুটতে আসছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। রফিক ধমকে উঠল, ‘এ্যাই, কি চাস তুই?’ বদি পাগলার হাসি আরো বিস্তৃত হল। রফিক কপালের ঘাম মুছল। সরু গলায় বলল, লোকটা স্যার পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে... ।
এই কথা তুমি আগে একবার বলেছ। একই কথা দু’তিনবার বলার প্রয়োজন নেই।
রফিক ঢোঁক গিলল। মেজর সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এ জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। সবাই টায়ার্ড।
মাইল পাঁচেক গেলেই স্যার নবীনগর। খুব বড় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে স্যার নবীনগর চলে যাওয়া ভাল।
কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না স্যার, ভয় পাব কেন?
মেজর সাহেব দলটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বললেন। মৃদু সাড়া জাগল। নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল সবাই। মাথা থেকে ভারী হেলমেট খুলে ফেলতে লাগল। মেজর সাহেব নিচু সুরে বললেন, পাগলটাকে বেঁধে ফেলতে হবে।
তিনি কাঠের একটি বাক্সের ওপর বসে পাইপ ধরালেন। খাকি পোশাক পরা কারো মুখে পাইপ মানায় না। কিন্তু মেজর সাহেব অসম্ভব সুপুরুষ। তাঁর মুখে সবকিছুই মানায়।
পাগলটাকে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হল। তার কোনো আপত্তি দেখা গেল না। বরং কাছাকাছি থাকতে পারার সৌভাগ্যে তাকে আনন্দিত মনে হল। কেউ তার দিকে তেমন নজর দিল না। এরা অসম্ভব ক্লান্ত। এদের দৃষ্টি নিরাসক্ত ও ভাবলেশহীন।
মেজর সাহেব পানির বোতল থেকে কয়েক চুমুক পানি খেলেন। বুটজুতা জোড়া খুলে ফেললেন। তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ফোসকা পড়েছে। রফিক বলল, ডাব খাবেন স্যার? মেজর সাহেব সে কথার জবাব না দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, আগে আমরা কোনো গ্রামে গেলেই ছোটখাটো একটা দল পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে আসত। এখন আর আসে না। এর কারণ কি জান?
জানি না স্যার।
ভয়ে আসে না। এই গ্রামের সব ক’টি লোক এখন জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। ঠিক না?
রফিক জবাব দিল না। বদি পাগলা বলল, এট্টু বোতলের পানি খাইতে মন চায়।
ও কি চায়?
ওয়াটার বটল থেকে পানি খেতে চায় স্যার।
গ্রামের সবাই পালিয়ে গেলেও আজীজ মাস্টার যেতে পারেনি। কারণ সোনাপোতা থেকে তার ছোট বোন এসেছিল। আজ সকাল থেকেই তার প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে। এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে টানাটানি করা যায় না। তবু আজীজ মাস্টার দু’বার বলল, ধরাধরি কইরা নাওডাত তুললে শ্যামগঞ্জ লইয়া যাওন যায়। তার জবাবে আজীজ মাস্টারের মা তার কাপুরুষতা নিয়ে কুিসত একটা গাল দিয়েছেন। পা ভাঙা বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজীজ মাস্টার প্রতিবাদ করেনি। কারণ কথাটি সত্যি। সে বড়ই ভীতু। গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে শোনার পর থেকে তার ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। সে বসে আছে উঠোনে এবং সামান্য শব্দেও দারুণভাবে চমকে উঠছে।
মাস্টার বাড়িতে আছে?
কেডা?
আমরা। খবর হুনছ? বদি পাগলারে বাইন্দা রাখছে আম গাছে।
হুনছি।
নীলগঞ্জের মুরব্বিদের কয়েকজন শংকিত ভঙ্গিতে উঠে এল উঠোনে।
তোমার তো একটু যাওন লাগে মাস্টার।
কই যাওন লাগে?
দবীর মিয়া তার উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি ছাড়া কে যাইব? তুমি ইংরেজি জান। শুদ্ধ ভাষা জান।
মিলিটারির কাছে যাইতে কন?
হ।
আমি গিয়া কি করতাম?
গিয়া কইবা এই গেরামে কোনো অসুবিধা নাই। পাকিস্তানের নিশানটা হাতে লইয়া যাইবা। ভয়ের কিছু নাই।
মাস্টার অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। দবীর মিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, কথা কও না যে?
আমি যাই ক্যামনে? বাড়িতে অত বড় বিপদ। পুতির বাচ্চা অইব।
তোমার তো কিছু করনের নাই মাস্টার। তুমি ডাক্তারও না, কবিরাজও না।
মাস্টার ক্ষীণস্বরে বলল, পাকিস্তানের পতাকা পাইয়াম কই?
ক্যান ইস্কুলের পতাকা কি করলা?
ফালাইয়া দিছি।
ফালাইয়া দিছ? ক্যান?
মাস্টার জবাব দেয় না। দবীর মিয়া রাগী গলায় বলে, আইএ পাশ করলে কি হইব মাস্টার, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি অয় নাই। পতাকাটি তুমি ফালাইলা কোন আক্কেলে? অখন কি আর করবা? যাও খালি হাতে।
আমার ডর লাগে চাচাজী।
ডরের কিছু নাই। এরা বাঘও না, ভল্লুকও না। তুমি গিয়া খাতির-যত্ন কইরা দুইটা কথা কইবা। এক মিনিটের মামলা। কি কও আসমত?
নেয্য কথা।
দেরি কইরো না। আন্ধাইর হওনের আগেই যাও।
একলা?
একলা যাওনই বালা। একলাই যাও। তিনবার কুলহু আল্লাহ কইয়া ডাইন পাওডা আগে ফেলবা। পাঁচবার মনে মনে কইবা ‘ইয়া মুকাদ্দেমু’ ভয়-ডরের কিছুই নাই মাস্টার। আল্লাহর পাক কালাম। এর মরতবাই অন্যরকম।
আজীজ মাস্টার মাথা নিচু করে বসে রইল। তার আবার প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। ঘরের ভেতর থেকে পুতি কুঁ কুঁ করছে। প্রথম পোয়াতি, খুব ভোগাবে।
ভইনটারে এমুন অবস্থায় ফালাইয়া ক্যামনে যাই?
এইটা কি কথা? তুমি ঘরে থাইক্যা করবাটা কি? বেকুবের মত কথা কও খালি। উঠ দেহি।
আজীজ মাস্টার উঠল।
মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মুখের ভাব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বসে আছেন কাঠের একটি বড় বাক্সের ওপর। পা দু’টি ছড়ানো। মেজর সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কি চাও?
আজীজ মাস্টার থতমত খেয়ে গেল। এ বাংলা জানে নাকি? কি আশ্চর্য!
কি চাও তুমি?
জ্বি, কিছু চাই না।
মেজর সাহেব এবার ইংরেজিতে বললেন, কিছু না চাইলে এসেছ কেন?
তামাশা দেখতে? সার্কাস হচ্ছে?
আজীজ মাস্টার ঘামতে শুরু করল। মেজর সাহেবের পরবর্তী সমস্ত কথোপকথন হল ইংরেজিতে। আজীজ মাস্টার বেশিরভাগ জবাবই দিল বাংলায়। তাতে অসুবিধা হল না। মেজর সাহেব বাংলা বুঝতে পারেন।
তুমি কি কর?
আমি এখানকার প্রাইমারি স্কুলের টিচার।
এখানে আবার স্কুলও আছে নাকি?
জ্বি স্যার।
আর কি আছে?
একটা মসজিদ আছে।
শুধু মসজিদ? মন্দির নেই? পূজা হয় যেখানে?
জ্বি না স্যার।
ঠিক করে বল মন্দির আছে কিনা?
নাই স্যার।
মেজর সাহেব পাইপ ধরালেন। ঠাণ্ডা গলায় কাকে যেন পাঞ্জাবি বা অন্য কোনো ভাষায় কি বললেন। সেই লোকটি উঠে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল আজীজ মাস্টারের গালে। আজীজ মাস্টার চিত্ হয়ে পড়ে গেল। আম গাছের সঙ্গে বাঁধা বদি পাগলা দারুণ অবাক হয়ে বলল, ও মাস্টার উঠ উঠ। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মেজর সাহেব বললেন, তোমার নাম কি?
আজীজুর রহমান।
আজীজুর রহমান, তোমাদের এদিকে মুক্তিবাহিনী আছে?
জ্বি না।
সবাই পাকিস্তানি?
জ্বি।
বাহ, খুব ভাল। তুমি নিজেও একজন খাঁটি পাকিস্তানি, ঠিক?
জ্বি স্যার।
সবাই পাকিস্তানি হলে এত ভয় কিসের? আমার তো মনে হয়, এ গ্রামের সবাই ভয়ে পালিয়েছে। মেয়েগুলি লুকিয়ে আছে জঙ্গলে, ঠিক না?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। বমি আসছে। বহু কষ্টে সে বমির বেগ সামলাতে লাগল।
তোমাদের কি ধারণা, আমরা তোমাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাব?
আজীজ মাস্টার চুপ করে রইল।
কি, কথা বলছ না যে? তোমার স্ত্রীও কি জঙ্গলে লুকিয়েছে?
স্যার আমি বিয়ে করিনি।
বিয়ে করনি? বয়স কত তোমার?
চল্লিশ।
চল্লিশ, এখনো বিয়ে করনি? তাহলে চালাও কিভাবে? মাস্টারবেট কর?
আজীজ মাস্টার কপালের ঘাম মুছল। মেজর সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, কথার জবাব দাও। রফিকউদ্দীন ক্ষীণ সুরে বলল, স্যার জানতে চাচ্ছেন আপনি হস্তমৈথুন করেন কিনা? বলে ফেলেন ভাই। স্যার রেগে যাচ্ছেন।
করি না।
বল কি? তোমার যন্ত্রপাতি ঠিক আছে? দেখি, পায়জামা খুলে সবাইকে দেখাও তো।
স্যার কি বললেন?
পায়জামা খুলে তোমার যন্ত্রটা সবাইকে দেখাতে বললাম। ঝটপট কর। দেরি করবে না। আমার হাতে বেশি সময় নেই।
আজীজ মাস্টার অবাক হয়ে তাকাল রফিকের দিকে। রফিকউদ্দীন অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুলে ফেলেন ভাই। ব্যাটা ছেলেদের মধ্যে আবার লজ্জা কি? খুলে ফেলেন, স্যার রাগ করছেন। মেজর সাহেব নিচু গলায় কি একটা বললেন, একজন এসে হ্যাঁচকা টানে আজীজ মাস্টারের পায়জামা নামিয়ে ফেলল। মেজর সাহেব বললেন, জামাটাও খুলে নাও।
আজীজ মাস্টার দু’হাতে তার লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল চারদিকে। একজন কে যেন কাগজের দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল আজীজ মাস্টারের দিকে। মেজর সাহেব বললেন, তুমি পাকিস্তানিদের ভালবাস?
জ্বি স্যার।
ভেরি গুড। আমাকেও নিশ্চয়ই ভালবাস। বাস না? বল, বলে ফেল।
বাসি স্যার।
যে তোমাকে নেংটা করে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে, তাকেও তুমি ভালবাসছ। তুমি তো বিশ্বপ্রেমিক দেখছি।
মেজর সাহেব অনুচ্চ স্বরে কি একটা বলতেই চারদিকে হাসির বান ডেকে গেল। বদি পাগলা চোখ বড় করে বলল, মাস্টার, তোমার কাপড় কই? এ্যাই মাস্টার।
আজীজ মাস্টার ঘোলা চোখে তাকাল তার দিকে। তার বমি বমি ভাবটা কেটে গেছে। শুধু মাথার পিছন দিকটায় তীব্র ও তীক্ষষ্ট একটি যন্ত্রণা। মেজর সাহেব বললেন, আজীজুর রহমান, তুমি ভয়ে মিথ্যা কথা বলছ প্রাণে বাঁচবার জন্যে। সত্যি কথা বল তোমাকে ছেড়ে দেব, তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?
না।
এই তো আসল কথা বেরুচ্ছে। তুমি কি চাও এটা বাংলাদেশ হোক?
জ্বি স্যার।
তুমি তাহলে একজন দেশদ্রোহী। দেশদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আমি সেই ব্যবস্থাই করতে চাই। নাকি তুমি বাঁচতে চাও?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না।
দেরি করবে না। বলে ফেল বাঁচতে চাও কি-না।
রফিকউদ্দীন ভয়-পাওয়া গলায় বলল, বলেন ভাই বাঁচতে চাই। এ রকম করছেন কেন? শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
বদি পাগলা আবার কথা বলে উঠল, ও মাস্টার কাপড় পিন্দ! তুমি নেংটা।
আজীজ মাস্টার নড়ল না। মেজর সাহেব বললেন, কাপড় পর। কাপড় পরে আমার সামনে থেকে বিদেয় হয়ে যাও। ক্লিয়ার আউট।
আজীজ মাস্টার কাপড় পরল না। হঠাত্ একদলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের ডান হাঁটুর কাছে এসে পড়ল। মেজর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। চারদিকে কোনো শব্দ নেই। আজীজ মাস্টার এগিয়ে এসে আরেক দলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের শার্টে এসে পড়ল। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। এবার আমরা রওয়ানা হব।
সৈন্যদল মার্চ করে এগুচ্ছে। মেজর সাহেবের মুখ অসম্ভব বিবর্ণ। পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন নগ্ন মানুষ।
সূত্র : আমার দেশ
1 Comment:
কুভ ভাল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন