নজরুল ইসলাম বলেছেন : আমার গানগুলো আহত পাখির মতো তোমার পায়ে, হে প্রিয়তম, লুটিয়ে পড়ে। সুরের পাখায় এ গানগুলো যখন আকাশে উড়ছিল, তখন তোমার নয়নের দৃষ্টি তীক্ষষ্ট তীর হয়ে তাকে বিদ্ধ করল এবং সে তোমার দৃষ্টির বাণবিদ্ধ অবস্থায় ভূতলে পতিত হলো। তার মৃত্যু-আহত কণ্ঠে তখন গানের বন্যা জাগল এবং মৃত্যুর বিষাদের মধ্যে অমৃতের স্বাদ জাগল। নজরুল ইসলামের এই অসাধারণ গানটি বাংলা সঙ্গীত জগতে এমন একটি তাত্পর্য বহন করছে, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন গান অতীতেও কেউ লেখেননি, বর্তমানেও কেউ লিখছেন না। রবীন্দ্রনাথ ‘গানের পাখি’র কথা বলেছেন। আবার লিখেছেন : ‘বনে যদি ফুটলো কুসুম, নেই কেন সেই পাখি?’ একটি কবিতায় গানের সুরের ব্যঞ্জনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন—‘পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান। তার বেশি করে না সে দান। আমারে দিয়েছ স্বর, তার বেশি করি আমি দান। আমি গাই গান।’ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে একটি তত্ত্বগত মূর্ছনা আছে, কোনো কোনো গানে রবীন্দ্রনাথ মানবের চিত্তবোধ বোঝাতে পাখির কথা বলেছেন। গবেষকরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ ‘পাখি’ পেয়েছিলেন লালন শাহের গান থেকে। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের সূত্রপাতে আমরা সহ-নায়ক বিনয়কে দেখি। একদিন প্রত্যুষে সে তার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তখন একজন বাউল গান গেয়ে যাচ্ছিল, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কমনে আসে যায়।’ এতে রবীন্দ্রনাথের বোধের রাজ্যে লালনের তত্ত্বচিন্তার আগমন দেখি।
নজরুল ইসলাম তাঁর প্রেমের কবিতায় শুধু প্রেমের বেদনাকেই আমাদের অনুভবের মধ্যে আনতে চেয়েছেন। তাঁর প্রেমচিন্তা যথার্থই পার্থিব যুবক-যুবতীর প্রেমচিন্তা, যেখানে সবুজ পাতার শিহরণ আছে, বাতাসের স্পর্শে আশ্বস্ততা আছে, পাখির কলকণ্ঠ আছে, পুষ্পের সৌরভ আছে এবং নদীর স্বচ্ছ প্রবাহ আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমকে কখনও অলৌকিক করেননি, তাঁর কাছে প্রেম হচ্ছে মানুষের যৌবন-উন্মাদনার একটি অস্তিত্ব। এ অস্তিত্ব এমন উদ্বেল, এমন ব্যাকুল, এমন আহত অস্থির এবং বেদনাসিক্ত যে, তাকে কেউ কোনো দিন কোনো মুহূর্তে অস্বীকার করতে পারে না। মানুষ প্রেম নিয়ে স্বপ্ন রচনা করে, দীর্ঘ রাত্রির জাগরণের কথা বলে এবং কল্পনার দয়িতাকে বিস্ময়কর রূপে বর্ণনা করতে চায়। নজরুল ইসলাম প্রেমের জন্য এভাবেই বিচিত্র কল্পলোক নির্মাণ করেছেন। একটি গানে বলছেন : ‘হে প্রিয়, তুমি আছ কোথায় এবং কতদূরে আছ, আমি জানি না। তোমার আমার প্রাণ বিরহ-ব্যথায় আতুর হয়। এখন আমার মনে হয় তুমি স্বপ্নের রমণী ছিলে, তুমি আমার স্বপ্নে এসে আবার হারিয়ে গেছ ঘুমের দেশে। তড়িিশখা যেমন ক্ষণিক হেসে আবার হারিয়ে যায়, তুমিও তেমনি আমার হৃদয় অন্ধকার করে কোথায় যেন হারিয়ে গেছ। আমি তো একদিন নিজেকে নিয়ে একাকী সন্তুষ্ট ছিলাম, তুমি কেন সেখানে আমার জীবন নিয়ে মরণ খেলা খেলতে এলে? যখন তুমি এলে তখন মনে হয়েছিল ঊষার সরোবরে তুমি স্নান করে এসেছ এবং তোমার আগমনে প্রেমের অরুণ উদিত হয়েছে। আমি তো একাকী অচেতন ছিলাম, তোমার আবির্ভাব সোনার স্পর্শের মতো আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল, কিন্তু সত্যিই যখন জাগলাম, তখন দেখলাম তোমার আগমনের মূর্ছনাটি আছে, কিন্তু তুমি নেই। এখন মনে হচ্ছে বিপুল বারিধির একূলে আমি এবং ওকূলে তুমি, মাঝখানে বিপুল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পারাপারের কোনো উপায় নেই এবং ওকূলে তুমি, মাঝখানে বিপুল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পারাপারের কোনো উপায় নেই এবং আমি ব্যথাতুর ক্রন্দনে লুটিয়ে পড়ছি।’
সমগ্র বাংলা কাব্যে প্রেমের এই অসাধারণ কল্পনা অতীতে কখনও ছিল না। এর প্রথম সূচনা করলেন নজরুল ইসলাম। গানের শব্দবিন্যাস এবং সুরের বিস্তারে এমন একটি সহজতা এবং স্বাভাবিকতা আছে যে সহজতা এবং স্বাভাবিকতা আমরা প্রকৃতির মধ্যে পাই। একটি নিকুঞ্জে যেমন ফুল ফোটে এবং তার মদির সুবাস বাতাসে বহন করে। নজরুল ইসলামের গানগুলোও তেমনি সহজ, সুস্পষ্ট এবং স্বাভাবিক। অন্য একটি গানে নজরুল ইসলাম বলছেন : যখন বিদায় নিতেই হবে জানলাম, তখন দিগন্তে সন্ধ্যা নামল মনে হলো এবং আমার নয়নে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। হে প্রিয়, তুমি আমার যাত্রাপথ তোমার অশ্রু দিয়ে পিচ্ছিল করো না। আমি স্রোতের ফুলের মতো ভেসে এসেছিলাম, তুমি কেন ভুল করে সেই ভেসে আসা ফুলকে খোঁপায় পরলে? আবার খোঁপা থেকে খুলে তাকে ফেলে দিলে স্রোতে? পৃথিবীতে মানুষের যে প্রেম তা কুসুমের মতো, প্রস্ফুটিত হয়েই তা শুকিয়ে যায়। এ ফুল দিয়ে যে মালা গাঁথতে চায় তার চোখে চিরকাল অশ্রু ঝরে। এখানে কেউ কারও চিত্তদাহ বুঝতে চান না। যাকে আমি একান্তভাবে চাই, সে অবহেলাভরে চলে যায়। আবার যাকে পেয়েছি বলে ভাবি, সে আপন হয় না। এখানে ভালোবাসার হৃদয় নেই। তুমি বুঝতে পারবে না, মিলনের মালা কেন অভিমানে ম্লান হলো। আমি দূরে উড়ে যেতে চাই। যেখানে তুমি নেই। সেখানেই আমি তোমার জন্য গান রচনা করব।
নজরুল ইসলাম প্রেমকে একটি বিশ্বাস এবং বিস্ময়কর অনুভূতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কেউ কখনও প্রশ্ন করবে না নজরুল ইসলামের এই কাল্পনিক রূপসজ্জা কতটা আন্তরিক। যেভাবে তিনি সুরের বিন্যাস ঘটিয়েছেন, তার মধ্যে আন্তরিকতার একটি অলৌকিক মূর্ছনা ধরা পড়েছে। তিনি কোন দেশের মানুষ সেটি জানার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু আমরা জানতে পারি যে তিনি একটি মমতার ইচ্ছার মানুষ। মানুষের জীবনে মমতা এবং ইচ্ছার কোনো সময়কাল নেই, কোনো দেশকাল নেই; কিন্তু তার আন্তরিক অভিপ্রায়ের একটি চিরকালীনতা আছে। আমরা এখানে শ্রেণীর প্রশ্ন তুলি না, সমাজের প্রশ্ন তুলি না, ধর্মের প্রশ্নও তুলি না। আমরা চিরকালের বিরহের কথা তুলি এবং স্বপ্নের একটি বিলাসের কথা তুলি, যে স্বপ্ন কিন্তু সব মানুষের মধ্যে আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের ক্ষেত্রে অসহায় আতুরতার কথা বলেছেন, বিভ্রমের কথা বলেছেন এবং শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। মানুষ কখনও নিজের অস্তিত্বকে হারাতে পারে না, পৃথিবীতেও অস্তিত্বই তার একটি বিরাট বন্ধন, কিন্তু প্রেমিক তার অস্তিত্বকে হারাতে চায়। সে আকাশের নীলে হারিয়ে যেতে চায়, সাগরের গভীরে হারিয়ে যেতে চায়, পুষ্পের পরাগে হারিয়ে যেতে চায় এবং একটি মহাশূন্যে বিলীন হতে চায়। বৌদ্ধ সাধনায় শূন্যতার কথা আছে। সাধকরা শূন্যতার কথা বলেছেন, অতি শূন্যের কথা বলেছেন এবং মহাশূন্যের কথা বলেছেন। বাস্তব পৃথিবী অতিক্রম করার জন্য এভাবে শূন্যতার সাধনা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ বাস্তব প্রপঞ্চের মধ্যে আবদ্ধ। সাধক যেমন এই প্রপঞ্চ ভাঙতে চান, প্রেমিকও তেমনি এই প্রপঞ্চ অগ্রাহ্য করতে চান। নজরুল ইসলাম এভাবে বাস্তবকে অস্বীকার করে একটি কল্পলোকের আচ্ছন্নতা নির্মাণ করেছেন, যা তাঁর গানকে, গানের বাণী ও সুরকে একটি নিগূঢ় তন্ময়তা এবং আচ্ছন্নতা এনে দিয়েছে।
এক সময় আইরিশ কবি উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস ১৮৯০-এর দশকে প্রেমের একটি বিস্ময়কর স্বপ্নলোক নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই স্বপ্নলোকের মধ্যে মানবচিত্তের গভীর অনুভূতিকে প্রবহমান করেছিলেন। একটি গানে তিনি লিখেছিলেন : ‘যদি আমার কাছে ঊর্ধ্ব আকাশের সুচিত্রিত চন্দ্রাতপ থাকত যেখানে তারকারাজি, চন্দ্রের এবং সূর্যের আলো শোভা পায় এবং সে আলোর কারণে চন্দ্রাতপটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাহলে আমি সে চন্দ্রাতপটি তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিতাম, কিন্তু আমি তো দরিদ্র কবি আমার কোনো মহার্ঘ সম্পদ নেই, আমার শুধু আছে স্বপ্ন, আমি তাই আমার স্বপ্নকে তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিলাম। তুমি ধীর পদসঞ্চারে আমার স্বপ্নের উপর দিয়ে হেঁটে যাও। ধীরে কেননা তুমি স্বপ্নের উপর দিয়ে হাঁটছো।’
এই অনিন্দ্যসুন্দর কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের একটি চিরকালীন সম্পদ হয়ে রয়েছে। নজরুল ইসলামের প্রেমের গানগুলোকে ইয়েটসের সে সময়কার কবিতা ও গানগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস অসাধারণ প্রেমের কবিতা লিখে গেছেন, আমরা জানি। একই সঙ্গে সেগুলো কবিতা এবং গান। সে গানগুলোতে কুসুম সুবাস আছে, পদতলে তৃণগুল্ম আছে এবং অপরিচিত পাখিদের কাকলি আছে। এক সময় রবীন্দ্রনাথ বার্নসের গানের অনুকরণে অনেক গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলার মধ্যে আমরাও গানগুলো পাব। কল্পনারও যে একটা সত্যতা এবং সফলতা আছে, বার্নসের গানগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। নজরুল ইসলামের গানেও আমরা এভাবে কল্পনার সফলতা এবং সত্যতা আবিষ্কার করি। একটি গানে বার্নস বলেছেন : আমি স্বপ্নে দেখলাম যে যেখানে ফুলগুলো সবেমাত্র পাপড়ি খুলছে, সেখানে আমি শুয়ে আছি, প্রত্যুষে সূর্যের আলো চতুর্দিকে তখন ছড়িয়েছে এবং আমি একটি আনন্দের অনুভূতির মধ্যে নিজেকে পাচ্ছি। যেসব পাখিকে আমি জানি না সেসব পাখির কলকাকলি শুনছি এবং যেখানে স্বচ্ছ কাচের মতো পানি প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে তার পাশেই আমি শুয়ে আছি। এখানে কল্পনার যে মধুরতা তাকে কে অস্বীকার করবে? নজরুল ইসলামের গানের মধ্যে কল্পনার এই মধুরতা আমাদের মুগ্ধ করে। একটি গানে নজরুল ইসলাম বলছেন : আমার নয়নে তোমার নয়ন রেখে, হে প্রিয়তমা, তুমি কোন অমৃত পান করতে চাও। আমার নয়নে উষ্ণ আঁখিজল আছে, সেখানে মধুর কোনো সুধা নেই। আমাকে ভেঙেচুরে তুমি কোনো মানস-প্রতিমা নির্মাণ করতে চাও জানি না, আমাকে নিয়ে তোমার কেন এই আরতি? প্রেমের দেবতা তো পাষাণ, তাকে কি জাগ্রত করা যায়? আমার দেহভৃঙ্গারে যদি সুরা থাকে, তবে প্রেমাষ্পদ তুমি তা পান করো।
এখানে আমরা প্রেমের যে একটি কল্পনা পেলাম সে কল্পনাকে অস্বীকার করতে পারি না, কেননা তার একটা নিজস্ব যুক্তি আছে, বিনম্র সহনশীলতা আছে এবং একটি মধুর অভিবাদন আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের গান লিখেছেন তাঁর সর্বস্ব দিয়ে এবং গান রচনার তন্ময় মুহূর্তে তিনি চতুর্দিকের সংসারের কথা ভাবেননি। সংসারের একটি সত্য আছে, একটি বাস্তবতা আছে, কিন্তু তার পরিবর্তন হয়। সংসারের বাস্তবতা চিরকাল একরকম থাকে না, কিন্তু প্রেমের স্বপ্নকল্পনার মহার্ঘতায় চিরকাল বেঁচে থাকে। নজরুল ইসলামের গানও চিরকাল বেঁচে থাকার গান। সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মানবচিত্তের ইচ্ছার আরতিতে কল্পনা চিরকাল মুক্ত থাকে—যেমন বার্নসের গান বেঁচে আছে, যেমন ইয়েটসের কবিতা এখনও আধুনিক, তেমনি নজরুল ইসলামের প্রেমের গানগুলো চিরকাল আধুনিক।
আমি সুর-সাকী কাব্যগীতি থেকে নজরুল ইসলামের কয়েকটি গানের ব্যাখ্যা উপস্থিত করে এখানে বোঝাতে চেয়েছি যে প্রেমিক নজরুল ইসলাম একটি অখণ্ড সত্তা, যেখানে মধুর অভিপ্রায় আছে, বিরহের কাতরতা আছে এবং দূরে বহুদূরে উড়ে যাওয়ার বাসনা আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের গানের মধ্য দিয়ে সবসময় একজন প্রেমিককে নির্মাণ করেছেন যে কখনও হারিয়ে যাওয়ার নয়। একটি চিরায়ত আনন্দ-ব্যঞ্জনায় তাঁর গানে প্রেমের যে ইচ্ছাগুলো ফুটে উঠেছে তা কখনও হারিয়ে যাওয়ার নয়। হ
* আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীন (প্রকাশক : নজরুল ইনস্টিটিউট, জানুয়ারি ২০০৩) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত
নজরুল ইসলাম তাঁর প্রেমের কবিতায় শুধু প্রেমের বেদনাকেই আমাদের অনুভবের মধ্যে আনতে চেয়েছেন। তাঁর প্রেমচিন্তা যথার্থই পার্থিব যুবক-যুবতীর প্রেমচিন্তা, যেখানে সবুজ পাতার শিহরণ আছে, বাতাসের স্পর্শে আশ্বস্ততা আছে, পাখির কলকণ্ঠ আছে, পুষ্পের সৌরভ আছে এবং নদীর স্বচ্ছ প্রবাহ আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমকে কখনও অলৌকিক করেননি, তাঁর কাছে প্রেম হচ্ছে মানুষের যৌবন-উন্মাদনার একটি অস্তিত্ব। এ অস্তিত্ব এমন উদ্বেল, এমন ব্যাকুল, এমন আহত অস্থির এবং বেদনাসিক্ত যে, তাকে কেউ কোনো দিন কোনো মুহূর্তে অস্বীকার করতে পারে না। মানুষ প্রেম নিয়ে স্বপ্ন রচনা করে, দীর্ঘ রাত্রির জাগরণের কথা বলে এবং কল্পনার দয়িতাকে বিস্ময়কর রূপে বর্ণনা করতে চায়। নজরুল ইসলাম প্রেমের জন্য এভাবেই বিচিত্র কল্পলোক নির্মাণ করেছেন। একটি গানে বলছেন : ‘হে প্রিয়, তুমি আছ কোথায় এবং কতদূরে আছ, আমি জানি না। তোমার আমার প্রাণ বিরহ-ব্যথায় আতুর হয়। এখন আমার মনে হয় তুমি স্বপ্নের রমণী ছিলে, তুমি আমার স্বপ্নে এসে আবার হারিয়ে গেছ ঘুমের দেশে। তড়িিশখা যেমন ক্ষণিক হেসে আবার হারিয়ে যায়, তুমিও তেমনি আমার হৃদয় অন্ধকার করে কোথায় যেন হারিয়ে গেছ। আমি তো একদিন নিজেকে নিয়ে একাকী সন্তুষ্ট ছিলাম, তুমি কেন সেখানে আমার জীবন নিয়ে মরণ খেলা খেলতে এলে? যখন তুমি এলে তখন মনে হয়েছিল ঊষার সরোবরে তুমি স্নান করে এসেছ এবং তোমার আগমনে প্রেমের অরুণ উদিত হয়েছে। আমি তো একাকী অচেতন ছিলাম, তোমার আবির্ভাব সোনার স্পর্শের মতো আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল, কিন্তু সত্যিই যখন জাগলাম, তখন দেখলাম তোমার আগমনের মূর্ছনাটি আছে, কিন্তু তুমি নেই। এখন মনে হচ্ছে বিপুল বারিধির একূলে আমি এবং ওকূলে তুমি, মাঝখানে বিপুল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পারাপারের কোনো উপায় নেই এবং ওকূলে তুমি, মাঝখানে বিপুল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পারাপারের কোনো উপায় নেই এবং আমি ব্যথাতুর ক্রন্দনে লুটিয়ে পড়ছি।’
সমগ্র বাংলা কাব্যে প্রেমের এই অসাধারণ কল্পনা অতীতে কখনও ছিল না। এর প্রথম সূচনা করলেন নজরুল ইসলাম। গানের শব্দবিন্যাস এবং সুরের বিস্তারে এমন একটি সহজতা এবং স্বাভাবিকতা আছে যে সহজতা এবং স্বাভাবিকতা আমরা প্রকৃতির মধ্যে পাই। একটি নিকুঞ্জে যেমন ফুল ফোটে এবং তার মদির সুবাস বাতাসে বহন করে। নজরুল ইসলামের গানগুলোও তেমনি সহজ, সুস্পষ্ট এবং স্বাভাবিক। অন্য একটি গানে নজরুল ইসলাম বলছেন : যখন বিদায় নিতেই হবে জানলাম, তখন দিগন্তে সন্ধ্যা নামল মনে হলো এবং আমার নয়নে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। হে প্রিয়, তুমি আমার যাত্রাপথ তোমার অশ্রু দিয়ে পিচ্ছিল করো না। আমি স্রোতের ফুলের মতো ভেসে এসেছিলাম, তুমি কেন ভুল করে সেই ভেসে আসা ফুলকে খোঁপায় পরলে? আবার খোঁপা থেকে খুলে তাকে ফেলে দিলে স্রোতে? পৃথিবীতে মানুষের যে প্রেম তা কুসুমের মতো, প্রস্ফুটিত হয়েই তা শুকিয়ে যায়। এ ফুল দিয়ে যে মালা গাঁথতে চায় তার চোখে চিরকাল অশ্রু ঝরে। এখানে কেউ কারও চিত্তদাহ বুঝতে চান না। যাকে আমি একান্তভাবে চাই, সে অবহেলাভরে চলে যায়। আবার যাকে পেয়েছি বলে ভাবি, সে আপন হয় না। এখানে ভালোবাসার হৃদয় নেই। তুমি বুঝতে পারবে না, মিলনের মালা কেন অভিমানে ম্লান হলো। আমি দূরে উড়ে যেতে চাই। যেখানে তুমি নেই। সেখানেই আমি তোমার জন্য গান রচনা করব।
নজরুল ইসলাম প্রেমকে একটি বিশ্বাস এবং বিস্ময়কর অনুভূতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কেউ কখনও প্রশ্ন করবে না নজরুল ইসলামের এই কাল্পনিক রূপসজ্জা কতটা আন্তরিক। যেভাবে তিনি সুরের বিন্যাস ঘটিয়েছেন, তার মধ্যে আন্তরিকতার একটি অলৌকিক মূর্ছনা ধরা পড়েছে। তিনি কোন দেশের মানুষ সেটি জানার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু আমরা জানতে পারি যে তিনি একটি মমতার ইচ্ছার মানুষ। মানুষের জীবনে মমতা এবং ইচ্ছার কোনো সময়কাল নেই, কোনো দেশকাল নেই; কিন্তু তার আন্তরিক অভিপ্রায়ের একটি চিরকালীনতা আছে। আমরা এখানে শ্রেণীর প্রশ্ন তুলি না, সমাজের প্রশ্ন তুলি না, ধর্মের প্রশ্নও তুলি না। আমরা চিরকালের বিরহের কথা তুলি এবং স্বপ্নের একটি বিলাসের কথা তুলি, যে স্বপ্ন কিন্তু সব মানুষের মধ্যে আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের ক্ষেত্রে অসহায় আতুরতার কথা বলেছেন, বিভ্রমের কথা বলেছেন এবং শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। মানুষ কখনও নিজের অস্তিত্বকে হারাতে পারে না, পৃথিবীতেও অস্তিত্বই তার একটি বিরাট বন্ধন, কিন্তু প্রেমিক তার অস্তিত্বকে হারাতে চায়। সে আকাশের নীলে হারিয়ে যেতে চায়, সাগরের গভীরে হারিয়ে যেতে চায়, পুষ্পের পরাগে হারিয়ে যেতে চায় এবং একটি মহাশূন্যে বিলীন হতে চায়। বৌদ্ধ সাধনায় শূন্যতার কথা আছে। সাধকরা শূন্যতার কথা বলেছেন, অতি শূন্যের কথা বলেছেন এবং মহাশূন্যের কথা বলেছেন। বাস্তব পৃথিবী অতিক্রম করার জন্য এভাবে শূন্যতার সাধনা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ বাস্তব প্রপঞ্চের মধ্যে আবদ্ধ। সাধক যেমন এই প্রপঞ্চ ভাঙতে চান, প্রেমিকও তেমনি এই প্রপঞ্চ অগ্রাহ্য করতে চান। নজরুল ইসলাম এভাবে বাস্তবকে অস্বীকার করে একটি কল্পলোকের আচ্ছন্নতা নির্মাণ করেছেন, যা তাঁর গানকে, গানের বাণী ও সুরকে একটি নিগূঢ় তন্ময়তা এবং আচ্ছন্নতা এনে দিয়েছে।
এক সময় আইরিশ কবি উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস ১৮৯০-এর দশকে প্রেমের একটি বিস্ময়কর স্বপ্নলোক নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই স্বপ্নলোকের মধ্যে মানবচিত্তের গভীর অনুভূতিকে প্রবহমান করেছিলেন। একটি গানে তিনি লিখেছিলেন : ‘যদি আমার কাছে ঊর্ধ্ব আকাশের সুচিত্রিত চন্দ্রাতপ থাকত যেখানে তারকারাজি, চন্দ্রের এবং সূর্যের আলো শোভা পায় এবং সে আলোর কারণে চন্দ্রাতপটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাহলে আমি সে চন্দ্রাতপটি তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিতাম, কিন্তু আমি তো দরিদ্র কবি আমার কোনো মহার্ঘ সম্পদ নেই, আমার শুধু আছে স্বপ্ন, আমি তাই আমার স্বপ্নকে তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিলাম। তুমি ধীর পদসঞ্চারে আমার স্বপ্নের উপর দিয়ে হেঁটে যাও। ধীরে কেননা তুমি স্বপ্নের উপর দিয়ে হাঁটছো।’
এই অনিন্দ্যসুন্দর কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের একটি চিরকালীন সম্পদ হয়ে রয়েছে। নজরুল ইসলামের প্রেমের গানগুলোকে ইয়েটসের সে সময়কার কবিতা ও গানগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস অসাধারণ প্রেমের কবিতা লিখে গেছেন, আমরা জানি। একই সঙ্গে সেগুলো কবিতা এবং গান। সে গানগুলোতে কুসুম সুবাস আছে, পদতলে তৃণগুল্ম আছে এবং অপরিচিত পাখিদের কাকলি আছে। এক সময় রবীন্দ্রনাথ বার্নসের গানের অনুকরণে অনেক গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলার মধ্যে আমরাও গানগুলো পাব। কল্পনারও যে একটা সত্যতা এবং সফলতা আছে, বার্নসের গানগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। নজরুল ইসলামের গানেও আমরা এভাবে কল্পনার সফলতা এবং সত্যতা আবিষ্কার করি। একটি গানে বার্নস বলেছেন : আমি স্বপ্নে দেখলাম যে যেখানে ফুলগুলো সবেমাত্র পাপড়ি খুলছে, সেখানে আমি শুয়ে আছি, প্রত্যুষে সূর্যের আলো চতুর্দিকে তখন ছড়িয়েছে এবং আমি একটি আনন্দের অনুভূতির মধ্যে নিজেকে পাচ্ছি। যেসব পাখিকে আমি জানি না সেসব পাখির কলকাকলি শুনছি এবং যেখানে স্বচ্ছ কাচের মতো পানি প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে তার পাশেই আমি শুয়ে আছি। এখানে কল্পনার যে মধুরতা তাকে কে অস্বীকার করবে? নজরুল ইসলামের গানের মধ্যে কল্পনার এই মধুরতা আমাদের মুগ্ধ করে। একটি গানে নজরুল ইসলাম বলছেন : আমার নয়নে তোমার নয়ন রেখে, হে প্রিয়তমা, তুমি কোন অমৃত পান করতে চাও। আমার নয়নে উষ্ণ আঁখিজল আছে, সেখানে মধুর কোনো সুধা নেই। আমাকে ভেঙেচুরে তুমি কোনো মানস-প্রতিমা নির্মাণ করতে চাও জানি না, আমাকে নিয়ে তোমার কেন এই আরতি? প্রেমের দেবতা তো পাষাণ, তাকে কি জাগ্রত করা যায়? আমার দেহভৃঙ্গারে যদি সুরা থাকে, তবে প্রেমাষ্পদ তুমি তা পান করো।
এখানে আমরা প্রেমের যে একটি কল্পনা পেলাম সে কল্পনাকে অস্বীকার করতে পারি না, কেননা তার একটা নিজস্ব যুক্তি আছে, বিনম্র সহনশীলতা আছে এবং একটি মধুর অভিবাদন আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের গান লিখেছেন তাঁর সর্বস্ব দিয়ে এবং গান রচনার তন্ময় মুহূর্তে তিনি চতুর্দিকের সংসারের কথা ভাবেননি। সংসারের একটি সত্য আছে, একটি বাস্তবতা আছে, কিন্তু তার পরিবর্তন হয়। সংসারের বাস্তবতা চিরকাল একরকম থাকে না, কিন্তু প্রেমের স্বপ্নকল্পনার মহার্ঘতায় চিরকাল বেঁচে থাকে। নজরুল ইসলামের গানও চিরকাল বেঁচে থাকার গান। সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মানবচিত্তের ইচ্ছার আরতিতে কল্পনা চিরকাল মুক্ত থাকে—যেমন বার্নসের গান বেঁচে আছে, যেমন ইয়েটসের কবিতা এখনও আধুনিক, তেমনি নজরুল ইসলামের প্রেমের গানগুলো চিরকাল আধুনিক।
আমি সুর-সাকী কাব্যগীতি থেকে নজরুল ইসলামের কয়েকটি গানের ব্যাখ্যা উপস্থিত করে এখানে বোঝাতে চেয়েছি যে প্রেমিক নজরুল ইসলাম একটি অখণ্ড সত্তা, যেখানে মধুর অভিপ্রায় আছে, বিরহের কাতরতা আছে এবং দূরে বহুদূরে উড়ে যাওয়ার বাসনা আছে। নজরুল ইসলাম প্রেমের গানের মধ্য দিয়ে সবসময় একজন প্রেমিককে নির্মাণ করেছেন যে কখনও হারিয়ে যাওয়ার নয়। একটি চিরায়ত আনন্দ-ব্যঞ্জনায় তাঁর গানে প্রেমের যে ইচ্ছাগুলো ফুটে উঠেছে তা কখনও হারিয়ে যাওয়ার নয়। হ
* আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীন (প্রকাশক : নজরুল ইনস্টিটিউট, জানুয়ারি ২০০৩) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন