কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের প্রিয় কবি নজরুল, আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, স্বাধীনতার কবি। তিনি যুগস্রষ্টা কবি। রবীন্দ্রবলয় থেকে বাংলা সাহিত্যের বের হয়ে আসার পর্বে প্রথম প্রাণপুরুষ তিনি। পরবর্তীকালে আমরা জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ ত্রিশের দশকের সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের আধুনিক তথা উত্তর-আধুনিক কবিদের পেয়েছি। তাদের হাত ধরে বাংলা কবিতা আজ তার বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। যুগস্রষ্টা কবি হিসাবে, বিদ্রোহী কবি হিসাবে, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যিক হিসাবে নজরুলের পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান কট্টরপন্থী উভয়ের কাছ থেকে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়াও ছিল স্বভাবগত ছিদ্রান্বেষী ও পরশ্রীকাতর হিন্দু ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠী, যাদের হাত থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও রেহাই পাননি। সম্প্রতি ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত তিতাশ চৌধুরী এসব বিরোধীদের তালিকায় বিশ্বনবী খ্যাত ও ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’র অমর পঙিক্তর কবি গোলাম মোস্তফার নামও দৃষ্টান্তসহ (দ্রষ্টব্য : ‘শনিবারের চিঠি’র নজরুল বিরোধিতার স্বরূপ, যায়যায়দিন, ২৫ মে ২০১২) উল্লেখ করেছেন। এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরোধিতার কাব্যিক জবাব ছিল নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা।
এই আলোচনার প্রথম অংশে নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটির বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরার এবং দ্বিতীয় অংশে বর্তমান কালেও তার কৈফিয়তের বক্তব্য তথা তার কবিতা ও রচনার প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধানের প্রয়াস পাব।
নজরুলের কবিতার সংকলন ‘সঞ্চিতা’য় এই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা স্থান পেয়েছে ‘ফরিয়াদ’ কবিতার পরে। সঞ্চিতায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সর্বহারা’ কাব্যের কবিতা এই ‘আমার কৈফিয়ত’। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলা ১৩৩৩ সালে তথা ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত নজরুলের ‘সর্বহারা’ কাব্যের ১০টি কবিতার মধ্যে আমার কৈফিয়ত ৮ম কবিতা। এই সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে সর্বহারা, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান—এইসব কবিতায় নিপীড়িত সর্বহারাদের জন্য নজরুলের গভীর মমতাময় ভালোবাসার উচ্চারণ যেমন আছে, তেমনি আছে ছাত্রদলের গানের মতো তরুণদের প্রেরণামূলক কবিতা ও কাণ্ডারি হুঁশিয়ারের মতো হিন্দু-মুসলিম মিলনের আহ্বান সংবলিত ঐতিহাসিক অমর দেশপ্রেমের কবিতা। ১৪ অনুচ্ছদের এই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা কবি শুরু করেছেন এই ভাবে :
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবি’।
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
তার তত্কাল অবধি বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর বিভিন্ন বক্তব্য কবি চমত্কার ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। কখনও তার জবাব দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গাত্মক কবিতা তথা সাহিত্যিক শ্লেষাত্মক কবিতার মধ্যে কবিতাটি সম্ভবত অন্যতম শ্রেষ্ঠ হওয়ার যোগ্যতা রাখে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ কবিতাগুলোর পাশাপাশি। যেমন আমরা দেখি :
পড়ে না ক’ বই, বয়ে গেছে ওটা!
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা!
কেহ বলে, মাটি হ’ল মোটা জেলে ব’সে শুধু তাশ খেলে!
কেহ বলে, ‘তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস জেলে!
কবির বিরুদ্ধে সমালোচনা যে শালীনতার সীমা ছেড়ে তার ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক জীবনকেও স্পর্শ করেছিল এবং ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতায় অভ্যস্ত পোষমানা ছাপোষা সংগ্রামবিমুখ আরামপরায়ণ গোষ্ঠী যে কবির বিদ্রোহকে পছন্দ করত না, এখানে তা সুস্পষ্ট।
কবিতায় গজদন্ত মিনারবাসী উচ্চ ভাববাদীর চিরকালের কথা শোনার আগ্রহীদের তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল, কবির ভাষায়, এমন :
কেহ বলে, তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে।
যেমন বেরোয় রবির হতে সে চিরকালের বাণী কই কবি?
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের সম্ভবত নজরুলের কবিতায় বা রচনায় সতত সরাসরি বিদ্রোহের জবাবে উপদেশমূলক মন্তব্য বা উপদেশ আর শনিবারের চিঠি গোষ্ঠীর সমালোচনার কথা কবি বলেছেন কাব্যিক ভাষায় :
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, তুমি হাঁড়িচাচা!
তারপর দেখি কবির চমত্কার রসাত্মক উক্তি :
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, ‘আড়ি চাচা’!
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
কট্টরপন্থী মুসলমান সম্প্রদায়ের আর হিন্দুদের সমালোচনাকে কবি স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এইভাবে :
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর ‘মোল-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবীর নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজি ও।
‘আম পারা’—পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!’
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
এভাবে অনেক অনুপম রসাত্মক ভঙ্গিতে কবি একে একে নন-ভায়োলেন্সের সমর্থক, বিপ্লবী, গোঁড়াপন্থী, স্বরাজী, স্বরাজ-বিরোধী প্রমুখ গোষ্ঠীর তার বিরুদ্ধে সমালোচনাকে তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত অল্প কথায় কবি পুরুষের প্রাধান্যকামী আর নারীবাদী এবং বিদ্যাগর্বীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন এভাবে :
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী।
বিলেত ফিরেনি? প্রবাসী-বন্ধু ক’ন ‘এই তব বিদ্যে, ছি!’
পুরো কবিতাটির মধ্যে ছন্দের চমত্কারিত্ব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একেকটি পঙিক্ততে ইন্টারনাল রিদম বা আন্তঃছন্দ কবিতাটিকে বিশেষ মাধুর্য দান করেছে। জানি না এ পর্যন্ত দেয়া দৃষ্টান্তগুলোতে তা কতটুকু পরস্ফুিট হলো। যে কোনো আগ্রহী পাঠক কবিতাটি নিরিবিলি পাঠে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন আশা রাখি।
কবিতার প্রথম ৬ অনুচ্ছেদে বিভিন্ন সমালোচনা তুলে ধরে তিনি পরের ৮ অনুচ্ছেদে তার জবাব তথা কৈফিয়ত তুলে ধরেছেন হৃদয়ের অনুভব থেকে, আর কাব্যিক যুক্তির মাধ্যমে, কবির পক্ষে যা মানায়। তার কৈফিয়তে কবি রসিকতা করে লেখেন তার হাত উঁচু আর হলো না, যার সরলার্থ তিনি আকাশচারী ভাববাদী দার্শনিক নন। তিনি ঘাড় নিচু করে লেখেন। অর্থাত্ লেখেন তিনি মাটি আর মানুষের কথা। বিদ্রূপ করে লিখেছেন এই তথাকথিত উচ্চভাবের উঁচুদরের লোকেরা তার সমাদর না করলেও রাজ সরকার অর্থাত্ ব্রিটিশ রাজ তার ‘মান’ রেখেছেন। তিনি যা লেখেন তা ‘অমূল্য’ বলে অ-মূল্যে নেন, অর্থাত্ বাজেয়াপ্ত করেন। তার পিছে পিছে ফিরে ‘রাজার প্রহরী’ মানে টিকটিকি বা গোয়েন্দা বা পুলিশ। হৃদয়ের আবেগে কবি হৃদয় থেকে লিখেন মানুষের হৃদয়ের কথা। তার মন রাজনীতির প্রশ্নে শান্তিবাদী ‘রবি-গান্ধীরে’ তথা রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীকে মানে না। শান্তির বাণীর আড়ালে আপসকামী হয় না, আপস করে না অন্যায়, অসত্য, পরাধীনতা, অত্যাচারী আর শোষকের সঙ্গে। বরং যেন শিকারের জন্য অন্যায়, অসত্য আর অশুভ নামের ‘বাঘ’ খুঁজে ফেরে তার মন, তার লেখনী। আপসকামী নীতিহীন রাজনীতির মাধ্যমে যারা তাদের ভাগ্য গড়তে প্রয়াসী, ‘হাফ নেতা’ থেকে ‘ফুল নেতা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তাদের তিনি এই কবিতায় কশাঘাত করেছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিত্য দিনের ক্ষুধা-বঞ্চনা দুঃখ-কষ্টকে উপেক্ষা করে যারা স্বরাজের স্বপ্নে বিভোর, তাদের তিনি এই কবিতায় বিদ্রূপের কশাঘাত করেছেন। এইসব নিঃস্ব অভাবী জনতা প্রচলিত এই রাজনীতির জন্য চাঁদা দেয়, তাদের ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার অন্ন না দিয়েও। আর স্বপ্ন দেখে কোনোদিন স্বরাজ তথা স্বাধীনতা আসবে। তাদের সব দুঃখের অবসান হবে।
কবি বলছেন, আজ এই মুহূর্তে ক্ষুধাতুর শিশু স্বরাজ চায় না, সে চায় দুটো ভাত, একটু নুন। বেলা বয়ে যায়, আর তার পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে। এইসব দুঃখী মানুষের কথাই তার লেখনীতে উঠে আসে। যাদের শোষণের কারণে এই শিশুর অনাহার কবির বিদ্রোহী পঙিক্তমালা তাদের বিরুদ্ধে। দরিদ্র জনতা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনেক বঞ্চনার শিকার হয়েছে। তাদের বঞ্চিত করে সরকারের হাতে, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতে আর রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে কোটি কোটি টাকা এসেছে, কিন্তু স্বরাজ আসেনি। দরিদ্রের দুঃখ ঘোচেনি। তাদের দুঃখের সীমা নেই। তাদের দুঃখে ব্যথাতুর কবির বুকে বিষের জ্বালা, যা তার লেখনীতে, তার পঙিক্তমালায় ঝরে। তাদের দুঃখে বিক্ষুব্ধ কবির ক্ষুব্ধ উচ্চারণ :
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
‘নিঃসঙ্গ শেরপা’র মতো কবির এই নিঃসঙ্গ-সংগ্রামে কবির পঙিক্তমালা আমাদের মন ছুঁয়ে যায় :
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
নিঃস্ব নিপীড়িত জনতার জন্য, গণমানুষের জন্য তার লেখা যাকে কবি বিনয় করে যুগের হুজুগ বলে অভিহিত করেছেন, তার স্থায়িত্ব নিয়ে কবি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার সেইসঙ্গে তার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন :
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
কবির বাঁচা না-বাঁচারেই আশংকা দৈহিক বাঁচা নয়, নিঃসন্দেহে এটা তার কবি হিসাবে, সাহিত্য স্রষ্টা হিসাবে মানুষের মনে বেঁচে থাকার প্রশ্নে।
কবি তার দৃঢ় অঙ্গীকার অনুপম ভঙ্গিতে এভাবে প্রকাশ করেছেন :
প্রার্থনা ক’রো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।
এখন মানবতার কবির, নিপীড়িতের কবির কবিতা তথা রচনাবলীর বর্তমানেও প্রাসঙ্গিকতার কথা। তার আগে এ কথা বলে নেয়া ভালো মাত্র ২৩ বছরে তার কবি ও লেখকজীবনের আকস্মিক অবসান হলেও এক অর্থে তিনি সৌভাগ্যের বরপুত্র। কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশের ২য় বছরে ১৯২২ সালে কবি তার অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছিলেন, যা তাত্ক্ষণিক সাড়া জাগিয়েছিল। তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল। এই কবিতার আবেদন আজ অবধি অম্লান আছে। এই অমর কবিতা রচনা করার অল্পদিন পরই নজরুল বিভিন্ন রচনার জন্য কারাবরণ করেন। কারাগারে বন্দিদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদে কবি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন, যার এক পর্যায়ে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার অনশন ভঙ্গ করার জন্য তাকে টেলিগ্রাম পাঠান : ‘ব্রেক আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচার ডিমান্ডস ইউ।’ কবিগুরু তার বসন্ত নাটক কবি কারাগারে অবস্থানকালে তাকে উত্সর্গ করেন। কবির বয়স তখন পঁচিশও হয়নি। এর কয়েক বছর পরে কোলকাতার আলবার্ট হলে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের পক্ষে থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সংবর্ধনায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ জড়িত ছিলেন। কবির বয়স তখনও মাত্র ত্রিশের কাছাকাছি। ১৯৪২ সালে কবি নীরব হওয়ার পর থেকে কবির জন্মজয়ন্তি বেদনাহত বাঙালি প্রতি বছর উদযাপন করে এসেছে—যা ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজ অবধি চলছে। আমাদের ছোটকাল থেকে সেই পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে বড়দের দেখেছি, তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার নীরবতার জন্য দুঃখ করতে। এই সেদিন কবির জন্মজয়ন্তিতে বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠান ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হলো।
এ তো গেল কবির রচনার বর্তমানেও একরকম প্রাসঙ্গিকতা। এবার আরও গভীরে প্রবেশ করা যাক। ১৯২৬ সালে এই কবিতা ‘আমার কৈফিয়ত’সহ কবির সর্বহারা কাব্য প্রকাশের ২১ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজ বিদায় নিয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পরে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। কবির কবিতায় উল্লিখিত সেই তেত্রিশ কোটি লোক ভারতের ১২০ কোটি, পাকিস্তানের ২০ কোটি আর বাংলাদেশের ১৬ কোটি মিলে জনসংখ্যা এখন আনুমানিক ১৫৬ কোটি দাঁড়িয়েছে। এই ১৫৬ কোটি লোকের মধ্যে ন্যূনপক্ষে ৮০ ভাগ এখনও সুযোগবঞ্চিত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। অন্তত ২০ ভাগ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এখনও এই তিন দেশে এক অর্থে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গ বাকি বিপুল আদমসন্তানের মুখের গ্রাস কেড়ে খায়। গণতন্ত্রের নামে, রাজনীতির নামে এখনও কবির ভাষায় হাফ নেতা ফুল নেতার দৌরাত্ম্য দেখা যায় দেশে দেশে। বিপুল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে এখনও সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠতে দেখি দেশে-বিদেশে আমাদের বেদনাহত চোখের সামনে।
সেদিনের স্বরাজের জায়গা নিয়েছে আজ কোথাও স্বাধীনতা, কোথাও গণতন্ত্র। বঞ্চিতরা স্বপ্ন দেখে রাজনীতির নামে এখনও বিপুল ত্যাগ স্বীকার করছে। কিন্তু তার সুফল চলে যাচ্ছে অন্যদের ঘরে। এই অবস্থায় তাই আজও আমরা মানবতাবাদী নজরুলের কবিতার কাছে ও তার রচনাবলীর কাছে ফিরে যাই। সংক্ষিপ্ত এই বিশ্লেষণে আমরা দেখি, তার কবিতা ও রচনাবলী কোনো যুগের হুজুগ ছিল না। তা চিরকালের বঞ্চিতদের মর্মবেদনা আর তাদের নিরন্তর সংগ্রামের অমর কাব্য হয়ে গেছে, তাদের প্রতীকী পতাকা হয়ে গেছে। বর্তমানেও রয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক। যতদিন পৃথিবীর যেখানে বঞ্চিত মানুষের এই মর্মবেদনা আর সংগ্রাম থাকবে, ততদিন সেখানে কবির পঙিক্তমালা, কবির গদ্য প্রাসঙ্গিক থাকবে। কবির উচ্চারণ এখন দেশ-কাল ছাপিয়ে সব দেশে সব জনতার চিরকালের বাণী হয়ে গেছে। অন্য রকম চিরকালের বাণী তথা আকাশচারী ভাববাদী দর্শন আছে পণ্ডিতের সভায়, আলোচনায় আর সমালোচকদের লেখনীতে, কবির রচনাবলী আছে লক্ষ-কোটি জনতার অন্তরে।
তথ্যপঞ্জি
১. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সঞ্চিতা’, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, এপ্রিল ২০০৩
২. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সর্বহারা’, ঢাকা, নজরুল ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি, ২০১১
৩. তিতাশ চৌধুরী, প্রবন্ধ : শনিবারের চিঠি’র নজরুলবিরোধিতার স্বরূপ, ঢাকা, দৈনিক যায়যায়দিন সাহিত্য সাময়িকী, ২৫ মে, ২০১২
এই আলোচনার প্রথম অংশে নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটির বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরার এবং দ্বিতীয় অংশে বর্তমান কালেও তার কৈফিয়তের বক্তব্য তথা তার কবিতা ও রচনার প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধানের প্রয়াস পাব।
নজরুলের কবিতার সংকলন ‘সঞ্চিতা’য় এই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা স্থান পেয়েছে ‘ফরিয়াদ’ কবিতার পরে। সঞ্চিতায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সর্বহারা’ কাব্যের কবিতা এই ‘আমার কৈফিয়ত’। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলা ১৩৩৩ সালে তথা ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত নজরুলের ‘সর্বহারা’ কাব্যের ১০টি কবিতার মধ্যে আমার কৈফিয়ত ৮ম কবিতা। এই সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে সর্বহারা, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান—এইসব কবিতায় নিপীড়িত সর্বহারাদের জন্য নজরুলের গভীর মমতাময় ভালোবাসার উচ্চারণ যেমন আছে, তেমনি আছে ছাত্রদলের গানের মতো তরুণদের প্রেরণামূলক কবিতা ও কাণ্ডারি হুঁশিয়ারের মতো হিন্দু-মুসলিম মিলনের আহ্বান সংবলিত ঐতিহাসিক অমর দেশপ্রেমের কবিতা। ১৪ অনুচ্ছদের এই ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা কবি শুরু করেছেন এই ভাবে :
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবি’।
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
তার তত্কাল অবধি বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর বিভিন্ন বক্তব্য কবি চমত্কার ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। কখনও তার জবাব দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গাত্মক কবিতা তথা সাহিত্যিক শ্লেষাত্মক কবিতার মধ্যে কবিতাটি সম্ভবত অন্যতম শ্রেষ্ঠ হওয়ার যোগ্যতা রাখে রবীন্দ্রনাথের অনুরূপ কবিতাগুলোর পাশাপাশি। যেমন আমরা দেখি :
পড়ে না ক’ বই, বয়ে গেছে ওটা!
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা!
কেহ বলে, মাটি হ’ল মোটা জেলে ব’সে শুধু তাশ খেলে!
কেহ বলে, ‘তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস জেলে!
কবির বিরুদ্ধে সমালোচনা যে শালীনতার সীমা ছেড়ে তার ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক জীবনকেও স্পর্শ করেছিল এবং ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতায় অভ্যস্ত পোষমানা ছাপোষা সংগ্রামবিমুখ আরামপরায়ণ গোষ্ঠী যে কবির বিদ্রোহকে পছন্দ করত না, এখানে তা সুস্পষ্ট।
কবিতায় গজদন্ত মিনারবাসী উচ্চ ভাববাদীর চিরকালের কথা শোনার আগ্রহীদের তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল, কবির ভাষায়, এমন :
কেহ বলে, তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে।
যেমন বেরোয় রবির হতে সে চিরকালের বাণী কই কবি?
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের সম্ভবত নজরুলের কবিতায় বা রচনায় সতত সরাসরি বিদ্রোহের জবাবে উপদেশমূলক মন্তব্য বা উপদেশ আর শনিবারের চিঠি গোষ্ঠীর সমালোচনার কথা কবি বলেছেন কাব্যিক ভাষায় :
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, তুমি হাঁড়িচাচা!
তারপর দেখি কবির চমত্কার রসাত্মক উক্তি :
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, ‘আড়ি চাচা’!
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
কট্টরপন্থী মুসলমান সম্প্রদায়ের আর হিন্দুদের সমালোচনাকে কবি স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এইভাবে :
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর ‘মোল-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবীর নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজি ও।
‘আম পারা’—পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!’
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
এভাবে অনেক অনুপম রসাত্মক ভঙ্গিতে কবি একে একে নন-ভায়োলেন্সের সমর্থক, বিপ্লবী, গোঁড়াপন্থী, স্বরাজী, স্বরাজ-বিরোধী প্রমুখ গোষ্ঠীর তার বিরুদ্ধে সমালোচনাকে তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত অল্প কথায় কবি পুরুষের প্রাধান্যকামী আর নারীবাদী এবং বিদ্যাগর্বীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন এভাবে :
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী।
বিলেত ফিরেনি? প্রবাসী-বন্ধু ক’ন ‘এই তব বিদ্যে, ছি!’
পুরো কবিতাটির মধ্যে ছন্দের চমত্কারিত্ব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একেকটি পঙিক্ততে ইন্টারনাল রিদম বা আন্তঃছন্দ কবিতাটিকে বিশেষ মাধুর্য দান করেছে। জানি না এ পর্যন্ত দেয়া দৃষ্টান্তগুলোতে তা কতটুকু পরস্ফুিট হলো। যে কোনো আগ্রহী পাঠক কবিতাটি নিরিবিলি পাঠে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন আশা রাখি।
কবিতার প্রথম ৬ অনুচ্ছেদে বিভিন্ন সমালোচনা তুলে ধরে তিনি পরের ৮ অনুচ্ছেদে তার জবাব তথা কৈফিয়ত তুলে ধরেছেন হৃদয়ের অনুভব থেকে, আর কাব্যিক যুক্তির মাধ্যমে, কবির পক্ষে যা মানায়। তার কৈফিয়তে কবি রসিকতা করে লেখেন তার হাত উঁচু আর হলো না, যার সরলার্থ তিনি আকাশচারী ভাববাদী দার্শনিক নন। তিনি ঘাড় নিচু করে লেখেন। অর্থাত্ লেখেন তিনি মাটি আর মানুষের কথা। বিদ্রূপ করে লিখেছেন এই তথাকথিত উচ্চভাবের উঁচুদরের লোকেরা তার সমাদর না করলেও রাজ সরকার অর্থাত্ ব্রিটিশ রাজ তার ‘মান’ রেখেছেন। তিনি যা লেখেন তা ‘অমূল্য’ বলে অ-মূল্যে নেন, অর্থাত্ বাজেয়াপ্ত করেন। তার পিছে পিছে ফিরে ‘রাজার প্রহরী’ মানে টিকটিকি বা গোয়েন্দা বা পুলিশ। হৃদয়ের আবেগে কবি হৃদয় থেকে লিখেন মানুষের হৃদয়ের কথা। তার মন রাজনীতির প্রশ্নে শান্তিবাদী ‘রবি-গান্ধীরে’ তথা রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীকে মানে না। শান্তির বাণীর আড়ালে আপসকামী হয় না, আপস করে না অন্যায়, অসত্য, পরাধীনতা, অত্যাচারী আর শোষকের সঙ্গে। বরং যেন শিকারের জন্য অন্যায়, অসত্য আর অশুভ নামের ‘বাঘ’ খুঁজে ফেরে তার মন, তার লেখনী। আপসকামী নীতিহীন রাজনীতির মাধ্যমে যারা তাদের ভাগ্য গড়তে প্রয়াসী, ‘হাফ নেতা’ থেকে ‘ফুল নেতা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তাদের তিনি এই কবিতায় কশাঘাত করেছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিত্য দিনের ক্ষুধা-বঞ্চনা দুঃখ-কষ্টকে উপেক্ষা করে যারা স্বরাজের স্বপ্নে বিভোর, তাদের তিনি এই কবিতায় বিদ্রূপের কশাঘাত করেছেন। এইসব নিঃস্ব অভাবী জনতা প্রচলিত এই রাজনীতির জন্য চাঁদা দেয়, তাদের ছেলেমেয়েদের ক্ষুধার অন্ন না দিয়েও। আর স্বপ্ন দেখে কোনোদিন স্বরাজ তথা স্বাধীনতা আসবে। তাদের সব দুঃখের অবসান হবে।
কবি বলছেন, আজ এই মুহূর্তে ক্ষুধাতুর শিশু স্বরাজ চায় না, সে চায় দুটো ভাত, একটু নুন। বেলা বয়ে যায়, আর তার পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে। এইসব দুঃখী মানুষের কথাই তার লেখনীতে উঠে আসে। যাদের শোষণের কারণে এই শিশুর অনাহার কবির বিদ্রোহী পঙিক্তমালা তাদের বিরুদ্ধে। দরিদ্র জনতা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনেক বঞ্চনার শিকার হয়েছে। তাদের বঞ্চিত করে সরকারের হাতে, সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতে আর রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে কোটি কোটি টাকা এসেছে, কিন্তু স্বরাজ আসেনি। দরিদ্রের দুঃখ ঘোচেনি। তাদের দুঃখের সীমা নেই। তাদের দুঃখে ব্যথাতুর কবির বুকে বিষের জ্বালা, যা তার লেখনীতে, তার পঙিক্তমালায় ঝরে। তাদের দুঃখে বিক্ষুব্ধ কবির ক্ষুব্ধ উচ্চারণ :
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
‘নিঃসঙ্গ শেরপা’র মতো কবির এই নিঃসঙ্গ-সংগ্রামে কবির পঙিক্তমালা আমাদের মন ছুঁয়ে যায় :
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
নিঃস্ব নিপীড়িত জনতার জন্য, গণমানুষের জন্য তার লেখা যাকে কবি বিনয় করে যুগের হুজুগ বলে অভিহিত করেছেন, তার স্থায়িত্ব নিয়ে কবি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার সেইসঙ্গে তার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন :
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
কবির বাঁচা না-বাঁচারেই আশংকা দৈহিক বাঁচা নয়, নিঃসন্দেহে এটা তার কবি হিসাবে, সাহিত্য স্রষ্টা হিসাবে মানুষের মনে বেঁচে থাকার প্রশ্নে।
কবি তার দৃঢ় অঙ্গীকার অনুপম ভঙ্গিতে এভাবে প্রকাশ করেছেন :
প্রার্থনা ক’রো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।
এখন মানবতার কবির, নিপীড়িতের কবির কবিতা তথা রচনাবলীর বর্তমানেও প্রাসঙ্গিকতার কথা। তার আগে এ কথা বলে নেয়া ভালো মাত্র ২৩ বছরে তার কবি ও লেখকজীবনের আকস্মিক অবসান হলেও এক অর্থে তিনি সৌভাগ্যের বরপুত্র। কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশের ২য় বছরে ১৯২২ সালে কবি তার অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছিলেন, যা তাত্ক্ষণিক সাড়া জাগিয়েছিল। তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল। এই কবিতার আবেদন আজ অবধি অম্লান আছে। এই অমর কবিতা রচনা করার অল্পদিন পরই নজরুল বিভিন্ন রচনার জন্য কারাবরণ করেন। কারাগারে বন্দিদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদে কবি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন, যার এক পর্যায়ে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার অনশন ভঙ্গ করার জন্য তাকে টেলিগ্রাম পাঠান : ‘ব্রেক আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচার ডিমান্ডস ইউ।’ কবিগুরু তার বসন্ত নাটক কবি কারাগারে অবস্থানকালে তাকে উত্সর্গ করেন। কবির বয়স তখন পঁচিশও হয়নি। এর কয়েক বছর পরে কোলকাতার আলবার্ট হলে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের পক্ষে থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই সংবর্ধনায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ জড়িত ছিলেন। কবির বয়স তখনও মাত্র ত্রিশের কাছাকাছি। ১৯৪২ সালে কবি নীরব হওয়ার পর থেকে কবির জন্মজয়ন্তি বেদনাহত বাঙালি প্রতি বছর উদযাপন করে এসেছে—যা ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজ অবধি চলছে। আমাদের ছোটকাল থেকে সেই পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে বড়দের দেখেছি, তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার নীরবতার জন্য দুঃখ করতে। এই সেদিন কবির জন্মজয়ন্তিতে বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠান ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হলো।
এ তো গেল কবির রচনার বর্তমানেও একরকম প্রাসঙ্গিকতা। এবার আরও গভীরে প্রবেশ করা যাক। ১৯২৬ সালে এই কবিতা ‘আমার কৈফিয়ত’সহ কবির সর্বহারা কাব্য প্রকাশের ২১ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজ বিদায় নিয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পরে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। কবির কবিতায় উল্লিখিত সেই তেত্রিশ কোটি লোক ভারতের ১২০ কোটি, পাকিস্তানের ২০ কোটি আর বাংলাদেশের ১৬ কোটি মিলে জনসংখ্যা এখন আনুমানিক ১৫৬ কোটি দাঁড়িয়েছে। এই ১৫৬ কোটি লোকের মধ্যে ন্যূনপক্ষে ৮০ ভাগ এখনও সুযোগবঞ্চিত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। অন্তত ২০ ভাগ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এখনও এই তিন দেশে এক অর্থে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গ বাকি বিপুল আদমসন্তানের মুখের গ্রাস কেড়ে খায়। গণতন্ত্রের নামে, রাজনীতির নামে এখনও কবির ভাষায় হাফ নেতা ফুল নেতার দৌরাত্ম্য দেখা যায় দেশে দেশে। বিপুল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে এখনও সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠতে দেখি দেশে-বিদেশে আমাদের বেদনাহত চোখের সামনে।
সেদিনের স্বরাজের জায়গা নিয়েছে আজ কোথাও স্বাধীনতা, কোথাও গণতন্ত্র। বঞ্চিতরা স্বপ্ন দেখে রাজনীতির নামে এখনও বিপুল ত্যাগ স্বীকার করছে। কিন্তু তার সুফল চলে যাচ্ছে অন্যদের ঘরে। এই অবস্থায় তাই আজও আমরা মানবতাবাদী নজরুলের কবিতার কাছে ও তার রচনাবলীর কাছে ফিরে যাই। সংক্ষিপ্ত এই বিশ্লেষণে আমরা দেখি, তার কবিতা ও রচনাবলী কোনো যুগের হুজুগ ছিল না। তা চিরকালের বঞ্চিতদের মর্মবেদনা আর তাদের নিরন্তর সংগ্রামের অমর কাব্য হয়ে গেছে, তাদের প্রতীকী পতাকা হয়ে গেছে। বর্তমানেও রয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক। যতদিন পৃথিবীর যেখানে বঞ্চিত মানুষের এই মর্মবেদনা আর সংগ্রাম থাকবে, ততদিন সেখানে কবির পঙিক্তমালা, কবির গদ্য প্রাসঙ্গিক থাকবে। কবির উচ্চারণ এখন দেশ-কাল ছাপিয়ে সব দেশে সব জনতার চিরকালের বাণী হয়ে গেছে। অন্য রকম চিরকালের বাণী তথা আকাশচারী ভাববাদী দর্শন আছে পণ্ডিতের সভায়, আলোচনায় আর সমালোচকদের লেখনীতে, কবির রচনাবলী আছে লক্ষ-কোটি জনতার অন্তরে।
তথ্যপঞ্জি
১. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সঞ্চিতা’, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, এপ্রিল ২০০৩
২. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সর্বহারা’, ঢাকা, নজরুল ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি, ২০১১
৩. তিতাশ চৌধুরী, প্রবন্ধ : শনিবারের চিঠি’র নজরুলবিরোধিতার স্বরূপ, ঢাকা, দৈনিক যায়যায়দিন সাহিত্য সাময়িকী, ২৫ মে, ২০১২
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন