এক.
প্রমথ চৌধুরী যাকে বলে গেছেন বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা, সেই ঝামেলায় নজরুল একটা যুঁত্সই জবাব দিয়েছিলেন তার অতি আলোচিত প্রবন্ধ ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’-এ।
আজকের এই পাপ তাপ বিদগ্ধ ব্যথিত সময়ে যখন আমাদের সবারই কমবেশি সময় কাটে কারও না কারও নির্মিত গালির গালিচায়, যখন অন্ধ এবং উদ্দেশ্যবাজরাই বেশি চোখে দেখে, সেই সময় সেই ঐতিহাসিক রচনাটির শেষ তিনটি স্তবক উদ্ধৃত না করে পারছি না—‘একদিন কথা-শিল্পী সুরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম যে শরত্চন্দ্র তার বই-এর সমস্ত আয় দিয়ে পথের কুকুরদের জন্য একটি মঠ তৈরি করে যাবেন। খেতে না পেরে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় যে-সব হন্যে কুকুর, তারা আহার ও বাসস্থান পাবে ঐ মঠে—ফ্রি অব চার্জ। শরত্ চন্দ্র নাকি জানতে পেরেছেন, ঐ সমস্ত পথের কুকুর পূর্বজন্মে সাহিত্যিক ছিল, মরে কুকুর হয়েছে। শুনলাম ঐ মর্মে নাকি উইলও হয়ে গেছে।
ওই গল্প শুনে আমি বারংবার শরত্চন্দ্রের উদ্দেশে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিলাম, শরত্-দা সত্যিই একজন মহাপুরুষ। সত্যিই আমরা সাহিত্যিকরা কুকুরের জাত। কুকুরের মতোই আমরা না খেয়ে এবং কামড়া-কামড়ি করে মরি। তার সত্যিকার অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি আছে, তিনি সাহিত্যিকদের অবতার রূপ দেখতে পেয়েছেন।
আজ তাই একটিমাত্র প্রার্থনা, যদি পরজন্ম থাকেই, তবে আর যেন এদেশে কবি হয়ে না জন্মাই। যদি আসি, বরং শরত্চন্দ্রের মঠের কুকুর হয়েই আসি যেন। নিশ্চিন্তে দু’মুঠো খেয়ে বাঁচব।’
নজরুল এই লেখাটি লেখেন ১৯২৭ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে ৮৫ বছর। অর্থাত্ সাড়ে আট দশক।
মোটামুটি ৩১০২৫টি দিন। অর্থাত্ ৩১০২৫টি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত। অজয় আর গোমতি দিয়ে গড়িয়ে গেছে কত পানি। দূষণে দূষণে বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। দখলে দখলে শীর্ণকায় হয়ে কোনো রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে-ঠেকিয়ে রেখেছে গোরস্তান যাত্রা।
এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাংলাদেশের লেখক-কবিদের পচন। অবশ্য পচন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবনের সর্বত্রই। তবে আমার আজকের বিষয় শুধু লেখক। বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন লেখক-কবিদের সান্নিধ্যও এখন অসহ্য লাগে। তারা জাতে ওঠার জন্য বেহুঁশ। খ্যাতি ও প্রতিপত্তির জন্য উন্মাদ। নার্সিসাসের বিবর্তিত প্রজন্ম এই লেখককুলের কোনো দেশ-কাল নেই। দেশ ও জাতি নেই। নেই কোনো অঙ্গীকার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পায়ের ওপর এরা অষ্টপ্রহর সেজদায় পড়ে থাকে। তাদেরই প্রেসক্রিপশন মোতাবেক উদযাপন করে এদের ঘৃণিত লেখক জীবন। বিভেদ, হানাহানি এবং ঘৃণা সঞ্চার করে এই দুঃখী দেশটাকে আরও রক্তাক্ত করাই এদের ধর্ম। আজন্ম হীনম্মন্যতার রোগী দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশি সারমেয়দের পেছনে গুষ্ঠিসুদ্ধ ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই খুঁজে বেড়ায় পরিত্রাণ। কলমের চেয়েও প্রখর এদের চোয়াল। অলিম্পিক গেমসে চোয়ালবাজির ওপর কোনো প্রতিযোগিতা থাকলে বাংলাদেশের এই অশিক্ষিত ভণ্ডগুলো নিশ্চয়ই সোনার মেডেল নিয়ে বাড়ি ফিরতো। চ্যাটাং চ্যাটাং বোলচাল ঝেড়ে দেশকে, দেশের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলাকেই এরা মনে করে আধুনিকতা। ন্যাকামো আর পাকামোই এদের জীবন।
জাতির শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত এসব লেখককুল যে পরজন্মে শরত্চন্দ্রের মঠের হন্যে কুকুর হয়ে জন্মাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই এদেশের মানুষের। ফলে এই নোংরা পাপী জীবনযাপনকারীদের নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। মাথাব্যথাও নেই। এরা কী করে না করে, কী বলে না বলে—সে সব কিছুকে থোরাই কেয়ার করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
দুই.
তবুও ড. গোলাম মুরশিদ বলে কথা। সকালের পত্রিকা খুলে যখন দেখলাম তিনি বাংলা একাডেমীর সেমিনার হলে ‘নজরুল ইসলাম : একটি আদর্শ জীবনীর খোঁজে’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দেবেন, তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যত কাজই থাক, আমি তার বক্তৃতা শুনতে যাব। দিনটি ছিল ২৭ আগস্ট ২০১২ নজরুলের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। সময় বিকাল ৪টা।
সকালে নজরুলের মাজার জিয়ারত করার পরই খোঁজ নিলাম আমার দেশ-এর সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক হাসান শান্তনুর। তাকে না পেয়ে ফোন করলাম তরুণ কবি আহমদ বাসিরকে। পেলাম। বিকাল ৪টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট স্থানে।
একে একে মঞ্চে আসন নিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও ড. গোলাম মুরশিদ। শামসুজ্জামান খানের স্বাগত ভাষণ দেয়ার পরই শুরু হলো ড. গোলাম মুরশিদের একক বক্তৃতা।
গোলাম মুরশিদ সাহেব তার বক্তৃতার প্রথম অংশে বললেন জীবনী কী, কীভাবে জীবনী লিখতে হয়, কী কী বিষয় জীবনীর মধ্যে থাকতে হয় ইত্যাদি। এর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনী ও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলোর ওপর।
তিনি প্রভাত বাবুর রবীন্দ্র জীবনী বিষয়ে শহীদ মুনীর চৌধুরীর উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বললেন, এটাই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবনী। কিন্তু তার এই আলোচনায় তিনি শেখ আবদুর রহিম, মীর মশাররফ হোসেন, মওলানা আকরম খাঁ কিংবা ড. রফিকুল ইসলামের লেখা জীবনীগুলোর নামও উল্লেখ করলেন না। আবার ব্রজেন বাবুর জীবনী গ্রন্থমালা নিয়ে কথা বললেও খোদ বাংলা একাডেমী প্রণীত জীবনী সিরিজ গ্রন্থমালার নামগন্ধও নিলেন না।
ফলে তার বক্তৃতার এই অংশ শুনে মনে হচ্ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপকের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ যেন শুনছি। যার সঙ্গে অন্তত বাংলাদেশের সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
যা হোক, এবার তার বক্তৃতার দ্বিতীয় অংশ প্রসঙ্গে আসি। নজরুলের একটা আদর্শ জীবনীর খোঁজ করতে গিয়ে তিনি বললেন, নজরুলের জীবনীর নামে এদেশে যা কিছু লেখা হয়েছে, সবই নজরুলকে অতিমানব বানানোর জন্য রচিত। এক হাজার-দেড় হাজার পৃষ্ঠার নজরুল জীবনী লিখে যারা বাহ্বা নিয়েছেন, তারা আসলে জীবনীর নাম করে একত্রিত করেছেন ভূরি ভূরি স্তুতি বাক্য। এসব লেখালেখির উদ্দেশ্য ‘বীর পূজা’। এসব বইয়ের কোথাও সত্যিকারের নজরুল নেই। তার জীবনের অন্ধকার দিকের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এদেশে নজরুল চর্চা হয়েছে খণ্ডিতভাবে। নজরুলের জীবন স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহ নজরুলকে ‘ভালুকায়’ (হবে ত্রিশাল) নিয়ে এসেছিলেন আধা চাকর হিসেবে। নজরুল রেলের গার্ড সাহেবের বাবুর্চি ছিলেন না, ছিলেন চাকর। নজরুল সেনাবাহিনীতে যান ব্রিটিশের অনুগত সৈনিক হিসেবে। ফিরে এসে কমরেড মুজফফর আহমদের সাহচর্যে ব্রিটিশবিরোধী হন। নজরুলের বিপ্লব আসলে এক ধরনের বিপ্লব-বিলাসিতা। নজরুল মুসলমান ছিলেন, পরে ধীরে ধীরে ‘মানুষ’ হন। শেষ দিকে আবারও মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে দু’একবার কথা বলেছেন তিনি।
নজরুলের প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রমীলা বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে যান। বিয়ের সময় তিনি ৫ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলেন। বিয়ের ৪ মাস পরে তিনি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন।—নজরুলের ছেলেরা নজরুল সম্পর্কে কিছু জানতো না। এই প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি লেখালেখি করেছেন, কিন্তু ছাপার সময় বাংলাদেশের সম্পাদকরা এই জায়গাগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছে।
আরও অনেক কথা বলেছেন ড. গোলাম মুরশিদ। সেসব মনেও নেই। যেটুকু উল্লেখ করতে পারলাম তাও যে হুবহু পারলাম, তাও নয়। কারণ তার শারীরিক ভাষা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব, কথা বলার ভঙ্গি তো উদ্ধৃত করা যায় না। গেলেও অন্তত আমার সে ক্ষমতা নেই। তবে এটুকু মনে আছে, নজরুল থেকে যে দু’একটি উদ্ধৃতি তিনি দিয়েছিলেন, তার বেশিরভাগই ছিল ভুলে ভরা। অনেক স্থানে বিভিন্ন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের নামও তিনি উল্টোপাল্টা বলছিলেন।
সব মিলিয়ে আমি বলতে পারি, ‘আশার ছলনে ভুলি’র লেখককে দেখে ও তার কথা শুনে আমি হতাশ হয়েছি। কারণ, সবচেয়ে বেশি যে কথাটা আমার মনে হয়েছে তা হলো, জীবনী লেখার ব্যাকরণ নিয়ে তার বলাটা হয়তো ঠিক আছে; কিন্তু নজরুলের জীবন সম্পর্কে, তার অবদান সম্পর্কে খুব কম জেনে, যতটুকু জেনেছেন তার চেয়েও কম বুঝে—তিনি দেড় ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করে সবাইকে চমত্কৃত করার চেষ্টা করেছিলেন। নজরুল সম্পর্কে তার পড়াশোনার পরিধির মধ্যে ফুটে উঠেছিল নিদারুণ দৈন্যদশা। দৈন্যদশায় যে তিনি আক্রান্ত, সেটুকু বোঝার মতো সচেতনতা সেদিন তার মধ্যে দেখিনি। কারণ তার বক্তৃতার মধ্যে এমন একটি তথ্য বা শব্দও ছিল না, যা আগে শুনিনি বা পড়িনি। তাছাড়া তার অনেক কথার রেফারেন্স ছিল না, ছিল না কোনো সনদ। বিশেষ করে নজরুলের প্রিয়তমা স্ত্রী সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা আমার কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। কোনো নজরুল গবেষক নয়, তথ্য দিয়ে নয়, তিনি এক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রভাবিত হয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো গল্প বানানেওয়ালার দ্বারা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দুই কানকাটা ব্যক্তির মতো সড়কের মাঝ দিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু একজন গোলাম মুরশিদের জন্য সেই অলীক গল্পের দ্বারা পরিচালিত হওয়া মানায় না। তিনি হয়তো আসানসোল দরিরামপুরে নজরুলের ছাত্র কাজী তালেবুর রহমানের লেখা পড়েননি। পড়লে তাকে দারোগার অর্ধ চাকর বানাতেন না।
ঢাকায় প্রথমবার এসে ঐতিহাসিক পল্টন মাঠ দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম। কারণ আমার গ্রামের খেলার মাঠও ছিল এর চাইতে অনেক বড়। তেমনি রবাহুত হয়ে ড. গোলাম মুরশিদের বক্তৃতা শুনেও আমি মর্মাহত হয়েছি।
আমার এ লেখা ড. গোলাম মুরশিদ পড়বেন কি না জানি না। তবু তাকে অনুরোধ করি, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা মাইকেল মধুসূদন নিয়ে বড় কাজ করে নিজেকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই উচ্চতা ধরে রাখার জন্যই তার উচিত হবে নজরুলের জীবন ও অবদান নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করা। আমার এই অনুরোধ হয়তো তার কাছে বিষের মতো লাগবে—হয়তো তার পছন্দ হবে না। তবুও সত্যের স্বার্থে, নজরুলের যথার্থ চর্চার স্বার্থে বলব, যদি তার মতো মানুষ আর একটু মন দিয়ে, সত্যিকারের দরদ দিয়ে নজরুল পড়েন, তাহলে নিজের ভুলগুলো তিনি শুধরে নিতে পারবেন। আর আমরাও উপহার পাব ভিন্ন মাত্রার এক নজরুলকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে পলাশী ট্র্যাজেডি, মীর কাসিমের লড়াই, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওহাবি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ, ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় আরও অসংখ্য আত্মত্যাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত রেনেসাঁ, জমিদার, মহাজন, বাবু, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, সাম্যবাদী চিন্তাধারার বিকাশ, পাকিস্তান আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের পাতাগুলো আরও একবার উল্টে দেখতে বলবো। তাহলে নজরুলকে বুঝতে তার আরও সহজ হবে।
আর একটা কথা, যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের নজরুল চর্চাকারীদের কটাক্ষ করছেন, সেই অবস্থানটি নির্মাণের জন্য জীবনপাত করে গেছেন কবি আবদুল কাদির, খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, কবি তালিম হোসেন, ড. রফিকুল ইসলাম, শাহাবুদ্দীন আহমদ, কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ্, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ, কবি আতাউর রহমান, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশ, করুণাময় গোস্বামী, এসএম আহসানের মতো বহু মহাপ্রাণ মানুষ। তারা যদি নজরুল চর্চার সূত্রপাত না করতেন, যদি একনিষ্ঠভাবে নজরুল চর্চা চালিয়ে না যেতেন, তারা সবাই যদি কলকাতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তাহলে নজরুলের অবস্থা হতো যতীন বাগচী, কালিদাস রায়, সত্যেন দত্তের মতো। একথা নিশ্চয় ড. মুরশিদ স্বীকার করবেন। সে জন্যই কলকাতার চামচ দিয়ে চিনি খাওয়ার খাসলত বাদ দিতে হবে।
যাদের নাম উল্লেখ করলাম এবং যাদের করলাম না—তাদের মতো শত শত হাজার হাজার লাখ লাখ নজরুল অনুরাগীর হাতেই সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলনের, মহান মুক্তিযুদ্ধের। সৃষ্টি হয় আজকের বাংলাদেশের। তথ্য ও তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সব কাজই হয়তো সব সময় মানসম্মত হয়নি—হয়নি ড. গোলাম মুরশিদের মনমত। তাই বলে এই অসীম আত্মত্যাগ, এই পরিশ্রম, এই প্রেম মিথ্যা হয়ে যায় না।
ড. মুরশিদ হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন, এই পূর্বসূরিরা যেখানে কাজ শেষ করেছেন, সেখান থেকেই তো শুরু করতে যাচ্ছেন তিনি। তার মতো অন্যেরাও। এই যাত্রা শুরুর শুভ মুহূর্তে গালাগাল কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নিজের ‘বীরগিরি’ প্রদর্শন কোনো কাজের কথা নয়।
বরং কাজটা ভালোভাবে সমাপ্ত করে আমাদের ‘বাহ্বা’ নিন। আর কে না জানে, মানব সভ্যতা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, একটা দীর্ঘ ধারাবাহিক তার ফল। সাহিত্য-সংস্কৃতিও তেমনই। সেই ধারাবাহিকতাকে সম্মান জানাতে পারার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ পাণ্ডিত্য ও বিচক্ষণতা। বিনয় মানুষকে বড় করে, অকারণ ঔদ্ধত্য নয়।
তিন.
বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জীবনী ছাপাতে অস্বীকার করায় ১৯৯২ সালে আমি গড়ে তুলি আন্দোলন। আমাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘেরাও করি বাংলা একাডেমী। তারিখটা ছিল ১৩ আগস্ট ১৯৯২। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেয়। পরবর্তীকালে দেখি, আমি বাদ। জীবনী লেখার দায়িত্ব পেয়েছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও কবি-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের অনুরোধে মেনে নেই বাংলা একাডেমীর সিদ্ধান্ত। কারণ সৈয়দ আবুল মকসুদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।
মকসুদ ভাই ইদানীং গবেষণা বোধ করি ছেড়েই দিয়েছেন। কলাম লিখে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। শরীরে ধরেছেন গান্ধীজীর পোশাক। তো খান আবদুল গাফ্ফার খান যদি হন সীমান্ত গান্ধী, তাহলে মকসুদ ভাইয়ের ভবিষ্যত্ নাম হতে পারে ‘বাংলা গান্ধী’ বা ‘বাংলাদেশী গান্ধী’।
যাই হোক। সেই মকসুদ ভাইকে এবার নজরুলের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন এক টিভি চ্যানেলে চট্টগ্রামের এক শ্রোতা প্রশ্ন করেন, চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বহু যত্নে প্রতিষ্ঠিত নজরুল স্কয়ারে অনেক সংগঠন অনুষ্ঠানাদি করে থাকে। কিন্তু তারা দাওয়াত পত্রে ‘নজরুল স্কয়ার’ নামটি ব্যবহার করে না। এটা কি নজরুলের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়?
উত্তরে সৈয়দ আবুল মকসুদ যা বলেন, তার সারাংশ হলো—নজরুল হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু ডিসি হিল একটা ঐতিহাসিক নাম। ইতিহাসের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।
তাছাড়া বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রদল, যুবদলের ক্যাডাররা গায়ের জোরে নজরুল স্কয়ার প্রতিষ্ঠা করে। সেজন্য আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তারা নজরুল স্কয়ার নাম ব্যবহার করতে পারি না।
এবার একটু পেছনে ফিরতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি টিলার বাঁ পাশে ছিল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের বাংলো। তার টিলার একেবারে উপরে ছিল চট্টগ্রাম ডাকবাংলো। সেই থেকে ডিসি হিল। ঐতিহাসিকত্ব বলতে এটুকুই।
নজরুল তার অনুজপ্রতিম হবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে ও আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো বেড়াতে আসেন চট্টগ্রামে। সেবার চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে কবিকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম ডাকবাংলোতে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে শহরে। সরগরম হয়ে ওঠে ডাকবাংলো। পরদিন অবশ্য হবিবুল্লাহ বাহারের আবদার ও অনুরোধে ডাকবাংলো ত্যাগ করে হবিবুল্লাহ বাহারের নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের তামাকুমণ্ডির ‘আজিজ মঞ্জিলে’ ওঠেন।
কবির প্রথমবার চট্টগ্রাম সফরের প্রথম বাসস্থান এরশাদ আমলে ভেঙে ফেলে গড়ে তোলা হয় বিভাগীয় কমিশনারের বাসা।
আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য যখন ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ নামে প্রামাণ্য ম্যাগাজিন ‘কথামালা’ করি, তখন প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে চলে আসে বিষয়টি। এর আগে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করি এ নিয়ে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. হাসান মোহাম্মদ, সাংবাদিক আহমেদ করিম, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামীসহ সর্বস্তরের মানুষ। তারা আমার সঙ্গে আওয়াজ তোলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজধানী। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই মহানগরে জাতীয় কবির প্রথম বাসস্থানটি সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু এতদিনে ডাকবাংলো তো উধাও হয়ে গেছে। এর কিছুদিন পর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই টিলার পাদদেশে একটা সংস্কৃতি পরিমণ্ডল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কাজও শুরু করে। বিষয়টি আমার গোচরে এলে আমি কথা বলি তত্কালীন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী কবি আলমগীর কবিরের সঙ্গে। বিভিন্ন তথ্য ও ডকুমেন্ট তুলে দেই তার হাতে। তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেন চউকের সঙ্গে। নজরুল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। তিনি কনভিন্স হয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) এই নির্মাণাধীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ‘নজরুল স্কয়ার’ নাম দেয়ার নির্দেশ দেন। চউক সানন্দে পালন করে এই নির্দেশ। তারপর ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল ৮ একর জমির ওপর ২ কোটি টাকা খরচ করে গড়ে তোলা নজরুল স্কয়ার উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। এই নজরুল স্কয়ারে আছে ওয়াকওয়ে, গ্যালারি, উন্মুক্ত মঞ্চ, প্লাটফর্ম, সীমানা প্রাচীর, মেইন গেট, গ্রিন স্পট, সিট বেঞ্চ। সব মিলিয়ে বলা যায়, খুবই চমত্কার একটি স্থাপনা, যা এখন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিপ্রেমিকদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে।
এই ইতিহাস সৈয়দ আবুল মকসুদের জানার কথা নয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণের তাত্পর্য ও গুরুত্বও তার বোঝার কথা নয়। কারণ তিনি ‘নব্য গান্ধী’ সেজেছেন। আর নজরুল আগাগোড়া ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু এক মহান কবি। সেজন্যই তার হাতে নির্মিত হয়েছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাটাতন।
ডিসি হিলের তথাকথিত ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে তিনি অটল। কিন্তু নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি কৃপণ। ডিসির বাড়ি নিয়ে তার মাথা ব্যথা। কিন্তু জাতীয় কবির সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে তিনি উদাসীন।
যুবদল-ছাত্রদলের ক্যাডাররা বিএনপি আমলে এটা গায়ের জোরে করেছে বলে যে মিথ্যা তথ্য তিনি দিয়েছেন, তা
তার অজ্ঞতাকেই প্রকট করেছে। এখানে ছাত্রদল ও
যুবদলের ক্যাডারদের করা তো দূরের কথা, তারা হয়তো বিষয়টি জানতোই না। তারপরও নিজের অসূয়া মানসিকতার কারণে তিনি বিদ্বেষ ও অজ্ঞতাবশত তাদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছেন। তারপরও তর্কের খাতিরে বলি, যদি ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডাররা গায়ের জোরে ‘নজরুল স্কয়ার’ করেও থাকতো, তাতে দোষের কী হতো? নাকি তার মতো বুদ্ধিবাগীসরা প্রত্যাশা করেন, আমাদের তরুণরা সব সময় নিজ নিজ দলের পক্ষে ঠ্যাঙারের ভূমিকা নিয়েই পড়ে থাকুক? ভারত থেকে পাঠানো ফেনসিডিল খেয়ে অকালে ঝরে যাক জীবন থেকে? চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে করেই শেষ করুক পরমায়ু?
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ করেছে যে তারুণ্য, তাদের বংশধররা নজরুল স্কয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এসে কি অপরাধ করতো?
চট্টগ্রামবাসীর মনে নজরুল স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে যদি তারা সচেষ্ট হতো, তাহলে তো তাদের প্রশংসা পাওয়ারই কথা। কিন্তু তা না করে সৈয়দ মকসুদের মতো দায়িত্ববান নাগরিকরা যদি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ভারতের অন্ধ দালালদের মতো গালমন্দ করেন—তখন তো প্রশ্ন উঠতেই পারে? তাছাড়া তিনি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের শাসকদলের মূর্খ পাণ্ডাদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে টেনে এনে বাহাদুরি ফলানোর চেষ্টা করেছেন। তাহলে কি বুঝতে হবে, নজরুল বা নজরুলভক্ত বাংলাদেশের মানুষ সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী? শুধু সৈয়দ মকসুদ বা তাদের মতো নজরুল-বিদ্বেষীরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোকানদার?
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলেছিল ‘ভণ্ড’, মূর্খ। আমরা সেই সব শব্দ ব্যবহার করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, নজরুলের বিরোধিতাকারীরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এই আত্মঘাতী চক্রই আজকাল বেশি বেশি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে।
এদের মোকাবিলা করা শুধু নজরুলের জন্য নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থেই আজ জরুরি।
চার.
রাষ্ট্রের টাকায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবির নামাঙ্কিত দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ ক্যাম্পাসে এবার কবির ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিলেবাস থেকে কেটে নজরুলকে ২৬ নম্বরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ২৬ নম্বরেরও আবার বিকল্প রাখা আছে।
অর্থাত্ নজরুলকে না পড়েও একজন শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করতে পারেন।
অথচ দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল নজরুলের ওপর ১০০ নম্বরের পূর্ণপত্র প্রতিষ্ঠার।
সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
প্রমথ চৌধুরী যাকে বলে গেছেন বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা, সেই ঝামেলায় নজরুল একটা যুঁত্সই জবাব দিয়েছিলেন তার অতি আলোচিত প্রবন্ধ ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’-এ।
আজকের এই পাপ তাপ বিদগ্ধ ব্যথিত সময়ে যখন আমাদের সবারই কমবেশি সময় কাটে কারও না কারও নির্মিত গালির গালিচায়, যখন অন্ধ এবং উদ্দেশ্যবাজরাই বেশি চোখে দেখে, সেই সময় সেই ঐতিহাসিক রচনাটির শেষ তিনটি স্তবক উদ্ধৃত না করে পারছি না—‘একদিন কথা-শিল্পী সুরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম যে শরত্চন্দ্র তার বই-এর সমস্ত আয় দিয়ে পথের কুকুরদের জন্য একটি মঠ তৈরি করে যাবেন। খেতে না পেরে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় যে-সব হন্যে কুকুর, তারা আহার ও বাসস্থান পাবে ঐ মঠে—ফ্রি অব চার্জ। শরত্ চন্দ্র নাকি জানতে পেরেছেন, ঐ সমস্ত পথের কুকুর পূর্বজন্মে সাহিত্যিক ছিল, মরে কুকুর হয়েছে। শুনলাম ঐ মর্মে নাকি উইলও হয়ে গেছে।
ওই গল্প শুনে আমি বারংবার শরত্চন্দ্রের উদ্দেশে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিলাম, শরত্-দা সত্যিই একজন মহাপুরুষ। সত্যিই আমরা সাহিত্যিকরা কুকুরের জাত। কুকুরের মতোই আমরা না খেয়ে এবং কামড়া-কামড়ি করে মরি। তার সত্যিকার অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি আছে, তিনি সাহিত্যিকদের অবতার রূপ দেখতে পেয়েছেন।
আজ তাই একটিমাত্র প্রার্থনা, যদি পরজন্ম থাকেই, তবে আর যেন এদেশে কবি হয়ে না জন্মাই। যদি আসি, বরং শরত্চন্দ্রের মঠের কুকুর হয়েই আসি যেন। নিশ্চিন্তে দু’মুঠো খেয়ে বাঁচব।’
নজরুল এই লেখাটি লেখেন ১৯২৭ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে ৮৫ বছর। অর্থাত্ সাড়ে আট দশক।
মোটামুটি ৩১০২৫টি দিন। অর্থাত্ ৩১০২৫টি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত। অজয় আর গোমতি দিয়ে গড়িয়ে গেছে কত পানি। দূষণে দূষণে বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। দখলে দখলে শীর্ণকায় হয়ে কোনো রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে-ঠেকিয়ে রেখেছে গোরস্তান যাত্রা।
এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাংলাদেশের লেখক-কবিদের পচন। অবশ্য পচন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবনের সর্বত্রই। তবে আমার আজকের বিষয় শুধু লেখক। বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন লেখক-কবিদের সান্নিধ্যও এখন অসহ্য লাগে। তারা জাতে ওঠার জন্য বেহুঁশ। খ্যাতি ও প্রতিপত্তির জন্য উন্মাদ। নার্সিসাসের বিবর্তিত প্রজন্ম এই লেখককুলের কোনো দেশ-কাল নেই। দেশ ও জাতি নেই। নেই কোনো অঙ্গীকার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পায়ের ওপর এরা অষ্টপ্রহর সেজদায় পড়ে থাকে। তাদেরই প্রেসক্রিপশন মোতাবেক উদযাপন করে এদের ঘৃণিত লেখক জীবন। বিভেদ, হানাহানি এবং ঘৃণা সঞ্চার করে এই দুঃখী দেশটাকে আরও রক্তাক্ত করাই এদের ধর্ম। আজন্ম হীনম্মন্যতার রোগী দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশি সারমেয়দের পেছনে গুষ্ঠিসুদ্ধ ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই খুঁজে বেড়ায় পরিত্রাণ। কলমের চেয়েও প্রখর এদের চোয়াল। অলিম্পিক গেমসে চোয়ালবাজির ওপর কোনো প্রতিযোগিতা থাকলে বাংলাদেশের এই অশিক্ষিত ভণ্ডগুলো নিশ্চয়ই সোনার মেডেল নিয়ে বাড়ি ফিরতো। চ্যাটাং চ্যাটাং বোলচাল ঝেড়ে দেশকে, দেশের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলাকেই এরা মনে করে আধুনিকতা। ন্যাকামো আর পাকামোই এদের জীবন।
জাতির শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত এসব লেখককুল যে পরজন্মে শরত্চন্দ্রের মঠের হন্যে কুকুর হয়ে জন্মাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই এদেশের মানুষের। ফলে এই নোংরা পাপী জীবনযাপনকারীদের নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। মাথাব্যথাও নেই। এরা কী করে না করে, কী বলে না বলে—সে সব কিছুকে থোরাই কেয়ার করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
দুই.
তবুও ড. গোলাম মুরশিদ বলে কথা। সকালের পত্রিকা খুলে যখন দেখলাম তিনি বাংলা একাডেমীর সেমিনার হলে ‘নজরুল ইসলাম : একটি আদর্শ জীবনীর খোঁজে’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দেবেন, তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যত কাজই থাক, আমি তার বক্তৃতা শুনতে যাব। দিনটি ছিল ২৭ আগস্ট ২০১২ নজরুলের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। সময় বিকাল ৪টা।
সকালে নজরুলের মাজার জিয়ারত করার পরই খোঁজ নিলাম আমার দেশ-এর সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক হাসান শান্তনুর। তাকে না পেয়ে ফোন করলাম তরুণ কবি আহমদ বাসিরকে। পেলাম। বিকাল ৪টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট স্থানে।
একে একে মঞ্চে আসন নিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও ড. গোলাম মুরশিদ। শামসুজ্জামান খানের স্বাগত ভাষণ দেয়ার পরই শুরু হলো ড. গোলাম মুরশিদের একক বক্তৃতা।
গোলাম মুরশিদ সাহেব তার বক্তৃতার প্রথম অংশে বললেন জীবনী কী, কীভাবে জীবনী লিখতে হয়, কী কী বিষয় জীবনীর মধ্যে থাকতে হয় ইত্যাদি। এর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনী ও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলোর ওপর।
তিনি প্রভাত বাবুর রবীন্দ্র জীবনী বিষয়ে শহীদ মুনীর চৌধুরীর উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বললেন, এটাই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ জীবনী। কিন্তু তার এই আলোচনায় তিনি শেখ আবদুর রহিম, মীর মশাররফ হোসেন, মওলানা আকরম খাঁ কিংবা ড. রফিকুল ইসলামের লেখা জীবনীগুলোর নামও উল্লেখ করলেন না। আবার ব্রজেন বাবুর জীবনী গ্রন্থমালা নিয়ে কথা বললেও খোদ বাংলা একাডেমী প্রণীত জীবনী সিরিজ গ্রন্থমালার নামগন্ধও নিলেন না।
ফলে তার বক্তৃতার এই অংশ শুনে মনে হচ্ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপকের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ যেন শুনছি। যার সঙ্গে অন্তত বাংলাদেশের সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
যা হোক, এবার তার বক্তৃতার দ্বিতীয় অংশ প্রসঙ্গে আসি। নজরুলের একটা আদর্শ জীবনীর খোঁজ করতে গিয়ে তিনি বললেন, নজরুলের জীবনীর নামে এদেশে যা কিছু লেখা হয়েছে, সবই নজরুলকে অতিমানব বানানোর জন্য রচিত। এক হাজার-দেড় হাজার পৃষ্ঠার নজরুল জীবনী লিখে যারা বাহ্বা নিয়েছেন, তারা আসলে জীবনীর নাম করে একত্রিত করেছেন ভূরি ভূরি স্তুতি বাক্য। এসব লেখালেখির উদ্দেশ্য ‘বীর পূজা’। এসব বইয়ের কোথাও সত্যিকারের নজরুল নেই। তার জীবনের অন্ধকার দিকের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। এদেশে নজরুল চর্চা হয়েছে খণ্ডিতভাবে। নজরুলের জীবন স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহ নজরুলকে ‘ভালুকায়’ (হবে ত্রিশাল) নিয়ে এসেছিলেন আধা চাকর হিসেবে। নজরুল রেলের গার্ড সাহেবের বাবুর্চি ছিলেন না, ছিলেন চাকর। নজরুল সেনাবাহিনীতে যান ব্রিটিশের অনুগত সৈনিক হিসেবে। ফিরে এসে কমরেড মুজফফর আহমদের সাহচর্যে ব্রিটিশবিরোধী হন। নজরুলের বিপ্লব আসলে এক ধরনের বিপ্লব-বিলাসিতা। নজরুল মুসলমান ছিলেন, পরে ধীরে ধীরে ‘মানুষ’ হন। শেষ দিকে আবারও মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে দু’একবার কথা বলেছেন তিনি।
নজরুলের প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রমীলা বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে যান। বিয়ের সময় তিনি ৫ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলেন। বিয়ের ৪ মাস পরে তিনি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন।—নজরুলের ছেলেরা নজরুল সম্পর্কে কিছু জানতো না। এই প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি লেখালেখি করেছেন, কিন্তু ছাপার সময় বাংলাদেশের সম্পাদকরা এই জায়গাগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছে।
আরও অনেক কথা বলেছেন ড. গোলাম মুরশিদ। সেসব মনেও নেই। যেটুকু উল্লেখ করতে পারলাম তাও যে হুবহু পারলাম, তাও নয়। কারণ তার শারীরিক ভাষা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব, কথা বলার ভঙ্গি তো উদ্ধৃত করা যায় না। গেলেও অন্তত আমার সে ক্ষমতা নেই। তবে এটুকু মনে আছে, নজরুল থেকে যে দু’একটি উদ্ধৃতি তিনি দিয়েছিলেন, তার বেশিরভাগই ছিল ভুলে ভরা। অনেক স্থানে বিভিন্ন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের নামও তিনি উল্টোপাল্টা বলছিলেন।
সব মিলিয়ে আমি বলতে পারি, ‘আশার ছলনে ভুলি’র লেখককে দেখে ও তার কথা শুনে আমি হতাশ হয়েছি। কারণ, সবচেয়ে বেশি যে কথাটা আমার মনে হয়েছে তা হলো, জীবনী লেখার ব্যাকরণ নিয়ে তার বলাটা হয়তো ঠিক আছে; কিন্তু নজরুলের জীবন সম্পর্কে, তার অবদান সম্পর্কে খুব কম জেনে, যতটুকু জেনেছেন তার চেয়েও কম বুঝে—তিনি দেড় ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করে সবাইকে চমত্কৃত করার চেষ্টা করেছিলেন। নজরুল সম্পর্কে তার পড়াশোনার পরিধির মধ্যে ফুটে উঠেছিল নিদারুণ দৈন্যদশা। দৈন্যদশায় যে তিনি আক্রান্ত, সেটুকু বোঝার মতো সচেতনতা সেদিন তার মধ্যে দেখিনি। কারণ তার বক্তৃতার মধ্যে এমন একটি তথ্য বা শব্দও ছিল না, যা আগে শুনিনি বা পড়িনি। তাছাড়া তার অনেক কথার রেফারেন্স ছিল না, ছিল না কোনো সনদ। বিশেষ করে নজরুলের প্রিয়তমা স্ত্রী সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা আমার কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। কোনো নজরুল গবেষক নয়, তথ্য দিয়ে নয়, তিনি এক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রভাবিত হয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো গল্প বানানেওয়ালার দ্বারা। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দুই কানকাটা ব্যক্তির মতো সড়কের মাঝ দিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু একজন গোলাম মুরশিদের জন্য সেই অলীক গল্পের দ্বারা পরিচালিত হওয়া মানায় না। তিনি হয়তো আসানসোল দরিরামপুরে নজরুলের ছাত্র কাজী তালেবুর রহমানের লেখা পড়েননি। পড়লে তাকে দারোগার অর্ধ চাকর বানাতেন না।
ঢাকায় প্রথমবার এসে ঐতিহাসিক পল্টন মাঠ দেখে আমি হতাশ হয়েছিলাম। কারণ আমার গ্রামের খেলার মাঠও ছিল এর চাইতে অনেক বড়। তেমনি রবাহুত হয়ে ড. গোলাম মুরশিদের বক্তৃতা শুনেও আমি মর্মাহত হয়েছি।
আমার এ লেখা ড. গোলাম মুরশিদ পড়বেন কি না জানি না। তবু তাকে অনুরোধ করি, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি কিংবা মাইকেল মধুসূদন নিয়ে বড় কাজ করে নিজেকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই উচ্চতা ধরে রাখার জন্যই তার উচিত হবে নজরুলের জীবন ও অবদান নিয়ে গভীরভাবে পড়াশোনা করা। আমার এই অনুরোধ হয়তো তার কাছে বিষের মতো লাগবে—হয়তো তার পছন্দ হবে না। তবুও সত্যের স্বার্থে, নজরুলের যথার্থ চর্চার স্বার্থে বলব, যদি তার মতো মানুষ আর একটু মন দিয়ে, সত্যিকারের দরদ দিয়ে নজরুল পড়েন, তাহলে নিজের ভুলগুলো তিনি শুধরে নিতে পারবেন। আর আমরাও উপহার পাব ভিন্ন মাত্রার এক নজরুলকে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে পলাশী ট্র্যাজেডি, মীর কাসিমের লড়াই, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওহাবি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ, ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় আরও অসংখ্য আত্মত্যাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত রেনেসাঁ, জমিদার, মহাজন, বাবু, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, সাম্যবাদী চিন্তাধারার বিকাশ, পাকিস্তান আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের পাতাগুলো আরও একবার উল্টে দেখতে বলবো। তাহলে নজরুলকে বুঝতে তার আরও সহজ হবে।
আর একটা কথা, যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে তিনি বাংলাদেশের নজরুল চর্চাকারীদের কটাক্ষ করছেন, সেই অবস্থানটি নির্মাণের জন্য জীবনপাত করে গেছেন কবি আবদুল কাদির, খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, কবি তালিম হোসেন, ড. রফিকুল ইসলাম, শাহাবুদ্দীন আহমদ, কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ্, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ, কবি আতাউর রহমান, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশ, করুণাময় গোস্বামী, এসএম আহসানের মতো বহু মহাপ্রাণ মানুষ। তারা যদি নজরুল চর্চার সূত্রপাত না করতেন, যদি একনিষ্ঠভাবে নজরুল চর্চা চালিয়ে না যেতেন, তারা সবাই যদি কলকাতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তাহলে নজরুলের অবস্থা হতো যতীন বাগচী, কালিদাস রায়, সত্যেন দত্তের মতো। একথা নিশ্চয় ড. মুরশিদ স্বীকার করবেন। সে জন্যই কলকাতার চামচ দিয়ে চিনি খাওয়ার খাসলত বাদ দিতে হবে।
যাদের নাম উল্লেখ করলাম এবং যাদের করলাম না—তাদের মতো শত শত হাজার হাজার লাখ লাখ নজরুল অনুরাগীর হাতেই সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলনের, মহান মুক্তিযুদ্ধের। সৃষ্টি হয় আজকের বাংলাদেশের। তথ্য ও তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সব কাজই হয়তো সব সময় মানসম্মত হয়নি—হয়নি ড. গোলাম মুরশিদের মনমত। তাই বলে এই অসীম আত্মত্যাগ, এই পরিশ্রম, এই প্রেম মিথ্যা হয়ে যায় না।
ড. মুরশিদ হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন, এই পূর্বসূরিরা যেখানে কাজ শেষ করেছেন, সেখান থেকেই তো শুরু করতে যাচ্ছেন তিনি। তার মতো অন্যেরাও। এই যাত্রা শুরুর শুভ মুহূর্তে গালাগাল কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নিজের ‘বীরগিরি’ প্রদর্শন কোনো কাজের কথা নয়।
বরং কাজটা ভালোভাবে সমাপ্ত করে আমাদের ‘বাহ্বা’ নিন। আর কে না জানে, মানব সভ্যতা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, একটা দীর্ঘ ধারাবাহিক তার ফল। সাহিত্য-সংস্কৃতিও তেমনই। সেই ধারাবাহিকতাকে সম্মান জানাতে পারার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ পাণ্ডিত্য ও বিচক্ষণতা। বিনয় মানুষকে বড় করে, অকারণ ঔদ্ধত্য নয়।
তিন.
বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জীবনী ছাপাতে অস্বীকার করায় ১৯৯২ সালে আমি গড়ে তুলি আন্দোলন। আমাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘেরাও করি বাংলা একাডেমী। তারিখটা ছিল ১৩ আগস্ট ১৯৯২। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেয়। পরবর্তীকালে দেখি, আমি বাদ। জীবনী লেখার দায়িত্ব পেয়েছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও কবি-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের অনুরোধে মেনে নেই বাংলা একাডেমীর সিদ্ধান্ত। কারণ সৈয়দ আবুল মকসুদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।
মকসুদ ভাই ইদানীং গবেষণা বোধ করি ছেড়েই দিয়েছেন। কলাম লিখে পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। শরীরে ধরেছেন গান্ধীজীর পোশাক। তো খান আবদুল গাফ্ফার খান যদি হন সীমান্ত গান্ধী, তাহলে মকসুদ ভাইয়ের ভবিষ্যত্ নাম হতে পারে ‘বাংলা গান্ধী’ বা ‘বাংলাদেশী গান্ধী’।
যাই হোক। সেই মকসুদ ভাইকে এবার নজরুলের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন এক টিভি চ্যানেলে চট্টগ্রামের এক শ্রোতা প্রশ্ন করেন, চট্টগ্রামের ডিসি হিলে বহু যত্নে প্রতিষ্ঠিত নজরুল স্কয়ারে অনেক সংগঠন অনুষ্ঠানাদি করে থাকে। কিন্তু তারা দাওয়াত পত্রে ‘নজরুল স্কয়ার’ নামটি ব্যবহার করে না। এটা কি নজরুলের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়?
উত্তরে সৈয়দ আবুল মকসুদ যা বলেন, তার সারাংশ হলো—নজরুল হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু ডিসি হিল একটা ঐতিহাসিক নাম। ইতিহাসের প্রতি আমাদের সম্মান দেখাতে হবে।
তাছাড়া বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রদল, যুবদলের ক্যাডাররা গায়ের জোরে নজরুল স্কয়ার প্রতিষ্ঠা করে। সেজন্য আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তারা নজরুল স্কয়ার নাম ব্যবহার করতে পারি না।
এবার একটু পেছনে ফিরতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি টিলার বাঁ পাশে ছিল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের বাংলো। তার টিলার একেবারে উপরে ছিল চট্টগ্রাম ডাকবাংলো। সেই থেকে ডিসি হিল। ঐতিহাসিকত্ব বলতে এটুকুই।
নজরুল তার অনুজপ্রতিম হবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে ও আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো বেড়াতে আসেন চট্টগ্রামে। সেবার চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে কবিকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম ডাকবাংলোতে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে শহরে। সরগরম হয়ে ওঠে ডাকবাংলো। পরদিন অবশ্য হবিবুল্লাহ বাহারের আবদার ও অনুরোধে ডাকবাংলো ত্যাগ করে হবিবুল্লাহ বাহারের নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের তামাকুমণ্ডির ‘আজিজ মঞ্জিলে’ ওঠেন।
কবির প্রথমবার চট্টগ্রাম সফরের প্রথম বাসস্থান এরশাদ আমলে ভেঙে ফেলে গড়ে তোলা হয় বিভাগীয় কমিশনারের বাসা।
আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য যখন ‘চট্টগ্রামে নজরুল’ নামে প্রামাণ্য ম্যাগাজিন ‘কথামালা’ করি, তখন প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে জনসমক্ষে চলে আসে বিষয়টি। এর আগে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করি এ নিয়ে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. হাসান মোহাম্মদ, সাংবাদিক আহমেদ করিম, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামীসহ সর্বস্তরের মানুষ। তারা আমার সঙ্গে আওয়াজ তোলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজধানী। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই মহানগরে জাতীয় কবির প্রথম বাসস্থানটি সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু এতদিনে ডাকবাংলো তো উধাও হয়ে গেছে। এর কিছুদিন পর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই টিলার পাদদেশে একটা সংস্কৃতি পরিমণ্ডল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কাজও শুরু করে। বিষয়টি আমার গোচরে এলে আমি কথা বলি তত্কালীন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী কবি আলমগীর কবিরের সঙ্গে। বিভিন্ন তথ্য ও ডকুমেন্ট তুলে দেই তার হাতে। তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেন চউকের সঙ্গে। নজরুল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। তিনি কনভিন্স হয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (চউক) এই নির্মাণাধীন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ‘নজরুল স্কয়ার’ নাম দেয়ার নির্দেশ দেন। চউক সানন্দে পালন করে এই নির্দেশ। তারপর ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল ৮ একর জমির ওপর ২ কোটি টাকা খরচ করে গড়ে তোলা নজরুল স্কয়ার উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। এই নজরুল স্কয়ারে আছে ওয়াকওয়ে, গ্যালারি, উন্মুক্ত মঞ্চ, প্লাটফর্ম, সীমানা প্রাচীর, মেইন গেট, গ্রিন স্পট, সিট বেঞ্চ। সব মিলিয়ে বলা যায়, খুবই চমত্কার একটি স্থাপনা, যা এখন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিপ্রেমিকদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে।
এই ইতিহাস সৈয়দ আবুল মকসুদের জানার কথা নয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণের তাত্পর্য ও গুরুত্বও তার বোঝার কথা নয়। কারণ তিনি ‘নব্য গান্ধী’ সেজেছেন। আর নজরুল আগাগোড়া ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু এক মহান কবি। সেজন্যই তার হাতে নির্মিত হয়েছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাটাতন।
ডিসি হিলের তথাকথিত ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে তিনি অটল। কিন্তু নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি কৃপণ। ডিসির বাড়ি নিয়ে তার মাথা ব্যথা। কিন্তু জাতীয় কবির সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে তিনি উদাসীন।
যুবদল-ছাত্রদলের ক্যাডাররা বিএনপি আমলে এটা গায়ের জোরে করেছে বলে যে মিথ্যা তথ্য তিনি দিয়েছেন, তা
তার অজ্ঞতাকেই প্রকট করেছে। এখানে ছাত্রদল ও
যুবদলের ক্যাডারদের করা তো দূরের কথা, তারা হয়তো বিষয়টি জানতোই না। তারপরও নিজের অসূয়া মানসিকতার কারণে তিনি বিদ্বেষ ও অজ্ঞতাবশত তাদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছেন। তারপরও তর্কের খাতিরে বলি, যদি ছাত্রদল-যুবদলের ক্যাডাররা গায়ের জোরে ‘নজরুল স্কয়ার’ করেও থাকতো, তাতে দোষের কী হতো? নাকি তার মতো বুদ্ধিবাগীসরা প্রত্যাশা করেন, আমাদের তরুণরা সব সময় নিজ নিজ দলের পক্ষে ঠ্যাঙারের ভূমিকা নিয়েই পড়ে থাকুক? ভারত থেকে পাঠানো ফেনসিডিল খেয়ে অকালে ঝরে যাক জীবন থেকে? চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে করেই শেষ করুক পরমায়ু?
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ করেছে যে তারুণ্য, তাদের বংশধররা নজরুল স্কয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে এসে কি অপরাধ করতো?
চট্টগ্রামবাসীর মনে নজরুল স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে যদি তারা সচেষ্ট হতো, তাহলে তো তাদের প্রশংসা পাওয়ারই কথা। কিন্তু তা না করে সৈয়দ মকসুদের মতো দায়িত্ববান নাগরিকরা যদি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ভারতের অন্ধ দালালদের মতো গালমন্দ করেন—তখন তো প্রশ্ন উঠতেই পারে? তাছাড়া তিনি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের শাসকদলের মূর্খ পাণ্ডাদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে টেনে এনে বাহাদুরি ফলানোর চেষ্টা করেছেন। তাহলে কি বুঝতে হবে, নজরুল বা নজরুলভক্ত বাংলাদেশের মানুষ সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী? শুধু সৈয়দ মকসুদ বা তাদের মতো নজরুল-বিদ্বেষীরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোকানদার?
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলেছিল ‘ভণ্ড’, মূর্খ। আমরা সেই সব শব্দ ব্যবহার করতে চাই না। শুধু বলতে চাই, নজরুলের বিরোধিতাকারীরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এই আত্মঘাতী চক্রই আজকাল বেশি বেশি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে।
এদের মোকাবিলা করা শুধু নজরুলের জন্য নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থেই আজ জরুরি।
চার.
রাষ্ট্রের টাকায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবির নামাঙ্কিত দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ ক্যাম্পাসে এবার কবির ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিলেবাস থেকে কেটে নজরুলকে ২৬ নম্বরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ২৬ নম্বরেরও আবার বিকল্প রাখা আছে।
অর্থাত্ নজরুলকে না পড়েও একজন শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স পাস করতে পারেন।
অথচ দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল নজরুলের ওপর ১০০ নম্বরের পূর্ণপত্র প্রতিষ্ঠার।
সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন