বাতেন সাহেব অফিস থেকে বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রাবিদ বলল, 'বাবা, জরুরি কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে। তুমি জামা-কাপড় খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি কম্পিউটারটা বন্ধ করে আসি।'
কিছু বললেন না বাতেন সাহেব। ছেলের চঞ্চলতা দেখে সামান্য হাসলেন। ঘরে ঢুকে সোফায় বসে জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে স্ত্রীকে বললেন, 'নিতু, তোমার ছেলের কী হয়েছে বলো তো?'
'জানি না তো।'
'ভীষণ অস্থির মনে হচ্ছে আজ ওকে।'
'কই, আমি তো কিছু টের পেলাম না। দাঁড়াও-।' নিতু ঘুরে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বাতেন সাহেবকে দিয়ে বলল, 'রাবিদ আর ওর বন্ধুরা মিলে কী একটা যেন ক্লাব গঠন করেছে। নামও দিয়েছে একটা-আনলাকি থার্টিন!'
'এটা আবার কী ধরনের নাম হলো!'
'ওরা সবাই এবার তের বছরে পড়বে তো, তাই ওই নামটা দিয়েছে। মজা করে দিয়েছে আর কী।' অফিসে যাওয়ার জামা-কাপড় আর জুতো জোড়া হাতে নিয়ে নিতু বলল, 'তুমি চা খাওয়া শেষ করো, আমি একটু রান্নাঘর থেকে আসছি।'
খুব মনোযোগ দিয়ে চা খাচ্ছেন বাতেন সাহেব। ছোটখাটো একটা সমস্যা হয়েছে অফিসে। অবশ্য তার সমস্যা না। তার কলিগ মনোয়ার সাহেবের সমস্যা। খুবই ভালোমানুষ মনোয়ার সাহেব। তার মতো ভালোমানুষ সমস্যায় পড়লে তো সবারই চিন্তা হওয়ার কথা। বাতেন সাহেবও চিন্তা করতে ছিলেন। তার চিন্তা করার একটা ধরন আছে, মাথা যতটা সম্ভব নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করেন তিনি। হাতে চা থাকলে ওরকম মাথা নিচু করে চিন্তা করতে করতেই চা খাওয়ার অভ্যাস তার।
চা শেষ করে কাপটা পাশে রাখতে গিয়েই বাতেন সাহেব দেখলেন, রাবিদ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তিনি খুব আন্তরিক গলায় বললেন, 'কী যেন জরুরি কথা আছে তোমার, বলো।'
বাবার সামনের সোফাটাতে বসল রাবিদ। তারপর বাবার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে বলল, 'বাবা, তুমি বলতে পারবে-মহাশূন্যে যদি কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সে ভেসে বেড়াবে কেন?'
কপাল কুঁচকে ফেললেন বাতেন সাহেব। একটু চিন্তা করে বললেন, 'আমি তো সায়েন্সের ছাত্র ছিলাম না। মহাশূন্যের ব্যাপারটা তাই জানি না।'
'আচ্ছা, সাগরের পানি লবণাক্ত কেন, এটা কি তুমি জানো?'
অসহায় ভঙ্গি করলেন বাতেন সাহেব। খুক খুক করে এমনি এমনি কাশতে লাগলেন তিনি। তাই দেখে রাবিদ একটু হেসে বলল, 'এটাও জানো না তুমি, না?'
কোনো কথা বললেন না বাতেন সাহেব, কেবল মাথা উঁচু-নিচু করলেন তিনি।
রাবিদ বাবার দিকে একটু ঝুঁকে বসল। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, 'বাবা, তুমি কি বলতে পারবে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব শব্দটার ইংরেজি কী?'
বাতেন সাহেব হেসে হেসে বললেন, 'ওই শব্দটার বাংলা অর্থ কি সেটাই তো জানি না।'
'তার মানে কী দাঁড়াল বাবা? সবাই সব কিছু জানবে_ এটা ঠিক না।' রাবিদ বাবার দিকে বিশেষ ভঙ্গিমায় তাকিয়ে বলল, 'আর সবাইকে সব কিছু জানতেই হবে, এটাও ঠিক না। তুমি এসব না জেনেও তো ভালো একটা চাকরি করছ, তাই না?' রাবিদ বাবার পাশের সোফাটায় গিয়ে বসে বলল, 'কাজী নজরুল ইসলাম তো আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের জাতীয় কবি কোন ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, তুমি জানো?'
'খুব বেশি ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি।'
'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ম্যারাডোনা?'
'তিনিও তো খুব বেশি লেখাপড়া করেননি।'
'শচীন টেন্ডুলকারও না।'
'হ্যাঁ, তিনিও তেমন লেখাপড়া করেননি।' বাতেন সাহেব অভিজ্ঞ হেডমাস্টারের মতো বললেন।
রাবিদ একটু সোজা হয়ে বসে বলল, 'তাহলে কী বুঝা গেল-লেখাপড়া না করেও বড় কিছু হওয়া যায়। তাই না বাবা?'
বাতেন সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। হঠাৎ তিনি সোজা হয়ে বসে চঞ্চল গলায় বললেন, 'আজ তো তোমার রেজাল্ট দেওয়ার কথা, রাবিদ। অফিসের ব্যস্ততায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তা তোমার রেজাল্ট কী বলো তো?'
রাবিদও সোজা হয়ে বসল। কী একটা ভেবে উঠে দাঁড়াল সে। একটু ফাঁকে বাতেন সাহেবের সামনের সোফায় গিয়ে বসল আবার। কিছুটা আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলল, 'তুমি তো জানো, আমাদের ক্লাসে এক ডাক্তারের ছেলে আছে, ওর নাম সুজন। সুজন না ফেল করেছে, বাবা।'
'তাই নাকি!'
'হ্যাঁ।' রাবিদ উৎফুল্ল হয়ে বলল, 'ফখরুল আঙ্কেলকে তো তুমি চেনো, উনি তো ইঞ্জিনিয়ার। ওনার ছেলের নাম মিঠুন। আমার সঙ্গে পড়ে। সেও ফেল করেছে, বাবা।'
বাতেন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, 'বলো কী?'
'জি, বাবা।' রাবিদ আগের চেয়ে উৎফুল্লতা নিয়ে বলল, 'লিওনের বাবা হচ্ছেন ভার্সিটির টিচার। কিন্তু কী লজ্জার ব্যাপার জানো বাবা, লিওনও ফেল করেছে। টিচারের ছেলে কখনও ফেল করে! কেমন একটা লাগে না!'
বাতেন সাহেব আরও একটু সোজা হয়ে বসলেন। চোখ দুটো বেশ বড় দেখাচ্ছে তার। নিঃশ্বাস আটকে রাখার মতো তিনি প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, 'তা তুমি পাস করেছ তো?'
'সেটা কীভাবে সম্ভব! ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষকের ছেলেই পাস করতে পারল না, আমি তো সামান্য একজন অফিসারের ছেলে! ওরা ফেল করলে আমার কি পাস করা উচিত, বাবা!' মেঝেতে পড়ে গিয়ে সামনের একটা দাঁত ভেঙে ফেলেছিল রাবিদ। সেই ভাঙা দাঁত বের করে হাসতে থাকে সে।
সূত্র : সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন