এখানে কী করে এলো সে! একেবারে অচেনা জায়গা। এর আগে কোনোদিন এসেছিল বলে মনে পড়ে না তার। তবে রঙগুলো খুব চেনা তার। রঙধনুর সাত রঙ। সাতটা দরোজাই খোলা। প্রত্যেক খোলা দরোজার ভেতর থেকে সাত রকমের আলোর দ্যুতি বেরুচ্ছে। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই।
এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল ছেলেটা; একেবারে সাত দরোজার সামনে। প্রথমেই সে এসে পড়ল বেগুনি দ্যুতি বেরুনো একটা দরোজার সামনে। ভেতরটায় চোখ পড়তেই হিম হয়ে গেল সে। বেগুনি রঙটাকে তার খুব ভয় এমনিতেই। এরপর যা তার চোখে পড়ল তাতে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না তার। ইতিহাসে যেসব ঘৃণিত মানুষের কথা সে পড়েছে তারাই একে একে দেখা দিয়ে গেল তাকে। নাহ্, এ দরোজার সামনে আর দাঁড়ানো যায় না।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল নীল দরোজার সামনে। নীল পর্দাটা উঠতেই চোখে পড়ল_ নীলকণ্ঠধারী এক মহামানবকে। 'জগতের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য আমি নীলবর্ণ বিষাক্ত দ্রব্যকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে রেখেছি, মনে রেখো_ দুঃখ, বিষাদ, বেদনা_ এসবের রঙ নীল। তাই এই দরোজা তোমার নয়, এগিয়ে যাও সামনে।' মন্ত্রমুগ্ধের মতো মহামানবের কথা সে শুনল, মহামানব নয়, তাকে দেবতাই মনে হলো তার। দরোজার সামনে থেকে সরে গেল সে।
এখন সে যে দরোজাটার সামনে দাঁড়াল তার রঙ আসমানি। পর্দাটা দুলছে মায়াবী বাতাসে। একজন লোক নির্বিকার বসে আছেন। তার দৃষ্টি স্থির। ছেলেটা স্পষ্ট দেখল, লোকটার দু'চোখের মণিতে যেন দুটো পৃথিবী ঘুরছে। এক চোখে পৃথিবীর সত্যিকারের রূপ; কখনও আলো কখনও অন্ধকার, মানুষের দুঃখ, বেদনা। আর অন্যটা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, ধূসর; বোঝা যাচ্ছে না কিছুই, তবে এটাই যে পৃথিবীর আরেক রূপ, আরেক চেহারা যাতে মৃত্যু, জরা, ভয়ে ভরা_ এটা বুঝতে কষ্ট হয় না তার। এবার ছেলেটার মনে পড়ল এই লোকটাকেই সে দেখেছে বইয়ের পাতায়। উনি নাকি নীরব, নিভৃতচারী এক মহান কবি_ জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতাও পড়েছে।
সবুজ দরোজার সামনে এসে সে বুঝতে পারল, বয়সটা অনেক অনেক কমে গেছে। দরোজার সামনে সবুজ পর্দাটা অদ্ভুত আভা ছড়িয়ে দুলছে তো দুলছেই; সঙ্গে তার মনটাও। ভেতরে যেন দেবদূতদের মহাসম্মেলন। চোখ তুলে না তাকিয়েও বোঝা যায় এরা যেন একেকজন শিশু। মৃত্যু, দুঃখ, আনন্দ সব জয় করে চিরসবুজ রঙ ধারণ করে বসে আছে। সবুজ দরোজাটাই আপাতত সবচেয়ে প্রিয় মনে হলো তার। সরতে ইচ্ছে হলো না ওখান থেকে। তবু আরও তিনটা দরোজার ভেতরটা দেখতে না পারলে অসমাপ্তই থেকে যাবে। তাই অন্য দরোজার দিকে পা বাড়াল সে।
সামনে তার হলুদ দরোজা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরোজাটা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গেই হলুদ পর্দাটা সরে গেল। উফ্ কী দুর্গন্ধময়!
উষ্ণ বাতাস তাকে যেন ক্ষণিক সময়ের জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে চোখ রাখল সে। দেখল, মৃতপ্রায় গাছ-পালা, জীর্ণ-শীর্ণ-বিবর্ণ অসংখ্য মানুষ। সবারই গায়ের রঙ হলুদ_ সবাই যেন পাণ্ডুর রোগী। অসহ্য ঠেকলো তার কাছে। দ্রুত সামনের দরোজার কাছে এলো সে। দরোজার রঙ কমলা। যারা বসে আছেন কিংবা পায়চারি করছেন তাদের বেশিরভাগই গেরুয়া পোশাকধারী। তাদের সবাইকে ভোরের প্রথম আলোতে স্বর্ণমাখা আলোয় রাঙা করছে স্বয়ং সূর্যদেব। সেই রাঙা আলোয় প্রথম দর্শনে যাকে সে দেখল তাতেই এ জীবনটা সার্থক হলো। জগৎ-জোড়া যার খ্যাতি, যার পায়ের পাতা সবখানে পাতা। আলোকের এই ঝর্ণাধারায় নেয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর একে একে যাদের দেখা গেল_ শ্রী চৈতন্য, লালনসহ অনেক মহামানবকে। আলোময় এ দরোজার সামনে থেকে চলে যেতে মন চাইছে না। তবু যেতে হবে। আর একটাই দরোজা শুধু বাকি।
উষ্ণ হাওয়ার তালে তালে দরোজাটা খুলে গেল। সরে গেল লাল পর্দা। নিজের চোখ জোড়াকে বিশ্বাস করানোই কষ্টকর মনে হলো ছেলেটার। যাকে না চেনা পাপ; ইনিই সেই বঙ্গবন্ধু মুজিব। হাত নেড়ে ছেলেটাকে অভিবাদন জানাতে জানাতে সরে গেলেন। আবেগে পাথর হলো যেন সে। তার উচিত ছিল_ সৈনিকের ভঙ্গিতে তাকে স্যালুট করা, কিন্তু নার্ভাস হলে যা হয়, সে পারেনি। এরপর দীর্ঘ এক মিছিল দেখল_ প্রথম সারিতেই আছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, সুভাষ বোস, ঈশা খাঁ, প্রীতিলতা। মিছিলটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সবাই হাত তুলে ছেলেটাকে অভিবাদন জানাতে জানাতে মিছিলটা সামনের দিকে এগিয়ে এগিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এবার ছেলেটার মুখেও এসে পড়ল আলোর ছটা। আনন্দ-উচ্ছলতায় সেও রেঙে উঠল যেন। ডান হাত নেড়ে নেড়ে সে মিছিলটাকে স্বাগত জানাতে জানাতে হঠাৎ খেয়াল করল তার বাম হাত বজ্রমুষ্টিতে ওপরে উঠে আছে।
সূত্র: সমকাল
এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল ছেলেটা; একেবারে সাত দরোজার সামনে। প্রথমেই সে এসে পড়ল বেগুনি দ্যুতি বেরুনো একটা দরোজার সামনে। ভেতরটায় চোখ পড়তেই হিম হয়ে গেল সে। বেগুনি রঙটাকে তার খুব ভয় এমনিতেই। এরপর যা তার চোখে পড়ল তাতে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না তার। ইতিহাসে যেসব ঘৃণিত মানুষের কথা সে পড়েছে তারাই একে একে দেখা দিয়ে গেল তাকে। নাহ্, এ দরোজার সামনে আর দাঁড়ানো যায় না।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল নীল দরোজার সামনে। নীল পর্দাটা উঠতেই চোখে পড়ল_ নীলকণ্ঠধারী এক মহামানবকে। 'জগতের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য আমি নীলবর্ণ বিষাক্ত দ্রব্যকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে রেখেছি, মনে রেখো_ দুঃখ, বিষাদ, বেদনা_ এসবের রঙ নীল। তাই এই দরোজা তোমার নয়, এগিয়ে যাও সামনে।' মন্ত্রমুগ্ধের মতো মহামানবের কথা সে শুনল, মহামানব নয়, তাকে দেবতাই মনে হলো তার। দরোজার সামনে থেকে সরে গেল সে।
এখন সে যে দরোজাটার সামনে দাঁড়াল তার রঙ আসমানি। পর্দাটা দুলছে মায়াবী বাতাসে। একজন লোক নির্বিকার বসে আছেন। তার দৃষ্টি স্থির। ছেলেটা স্পষ্ট দেখল, লোকটার দু'চোখের মণিতে যেন দুটো পৃথিবী ঘুরছে। এক চোখে পৃথিবীর সত্যিকারের রূপ; কখনও আলো কখনও অন্ধকার, মানুষের দুঃখ, বেদনা। আর অন্যটা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, ধূসর; বোঝা যাচ্ছে না কিছুই, তবে এটাই যে পৃথিবীর আরেক রূপ, আরেক চেহারা যাতে মৃত্যু, জরা, ভয়ে ভরা_ এটা বুঝতে কষ্ট হয় না তার। এবার ছেলেটার মনে পড়ল এই লোকটাকেই সে দেখেছে বইয়ের পাতায়। উনি নাকি নীরব, নিভৃতচারী এক মহান কবি_ জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতাও পড়েছে।
সবুজ দরোজার সামনে এসে সে বুঝতে পারল, বয়সটা অনেক অনেক কমে গেছে। দরোজার সামনে সবুজ পর্দাটা অদ্ভুত আভা ছড়িয়ে দুলছে তো দুলছেই; সঙ্গে তার মনটাও। ভেতরে যেন দেবদূতদের মহাসম্মেলন। চোখ তুলে না তাকিয়েও বোঝা যায় এরা যেন একেকজন শিশু। মৃত্যু, দুঃখ, আনন্দ সব জয় করে চিরসবুজ রঙ ধারণ করে বসে আছে। সবুজ দরোজাটাই আপাতত সবচেয়ে প্রিয় মনে হলো তার। সরতে ইচ্ছে হলো না ওখান থেকে। তবু আরও তিনটা দরোজার ভেতরটা দেখতে না পারলে অসমাপ্তই থেকে যাবে। তাই অন্য দরোজার দিকে পা বাড়াল সে।
সামনে তার হলুদ দরোজা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দরোজাটা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গেই হলুদ পর্দাটা সরে গেল। উফ্ কী দুর্গন্ধময়!
উষ্ণ বাতাস তাকে যেন ক্ষণিক সময়ের জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে চোখ রাখল সে। দেখল, মৃতপ্রায় গাছ-পালা, জীর্ণ-শীর্ণ-বিবর্ণ অসংখ্য মানুষ। সবারই গায়ের রঙ হলুদ_ সবাই যেন পাণ্ডুর রোগী। অসহ্য ঠেকলো তার কাছে। দ্রুত সামনের দরোজার কাছে এলো সে। দরোজার রঙ কমলা। যারা বসে আছেন কিংবা পায়চারি করছেন তাদের বেশিরভাগই গেরুয়া পোশাকধারী। তাদের সবাইকে ভোরের প্রথম আলোতে স্বর্ণমাখা আলোয় রাঙা করছে স্বয়ং সূর্যদেব। সেই রাঙা আলোয় প্রথম দর্শনে যাকে সে দেখল তাতেই এ জীবনটা সার্থক হলো। জগৎ-জোড়া যার খ্যাতি, যার পায়ের পাতা সবখানে পাতা। আলোকের এই ঝর্ণাধারায় নেয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর একে একে যাদের দেখা গেল_ শ্রী চৈতন্য, লালনসহ অনেক মহামানবকে। আলোময় এ দরোজার সামনে থেকে চলে যেতে মন চাইছে না। তবু যেতে হবে। আর একটাই দরোজা শুধু বাকি।
উষ্ণ হাওয়ার তালে তালে দরোজাটা খুলে গেল। সরে গেল লাল পর্দা। নিজের চোখ জোড়াকে বিশ্বাস করানোই কষ্টকর মনে হলো ছেলেটার। যাকে না চেনা পাপ; ইনিই সেই বঙ্গবন্ধু মুজিব। হাত নেড়ে ছেলেটাকে অভিবাদন জানাতে জানাতে সরে গেলেন। আবেগে পাথর হলো যেন সে। তার উচিত ছিল_ সৈনিকের ভঙ্গিতে তাকে স্যালুট করা, কিন্তু নার্ভাস হলে যা হয়, সে পারেনি। এরপর দীর্ঘ এক মিছিল দেখল_ প্রথম সারিতেই আছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, সুভাষ বোস, ঈশা খাঁ, প্রীতিলতা। মিছিলটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সবাই হাত তুলে ছেলেটাকে অভিবাদন জানাতে জানাতে মিছিলটা সামনের দিকে এগিয়ে এগিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এবার ছেলেটার মুখেও এসে পড়ল আলোর ছটা। আনন্দ-উচ্ছলতায় সেও রেঙে উঠল যেন। ডান হাত নেড়ে নেড়ে সে মিছিলটাকে স্বাগত জানাতে জানাতে হঠাৎ খেয়াল করল তার বাম হাত বজ্রমুষ্টিতে ওপরে উঠে আছে।
সূত্র: সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন