বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম আমাদের তরুণদের জন্য একটা কিছু লিখব। বিশেষ করে যেসব তরুণ পড়াশোনা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। কিছুদিন পরেই তো তাদের চাকুরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। অনেকের কাছেই চাকুরি পাওয়া সহজ। কেউ কেউ দুই বছরে চারটে চাকুরিও বদল করেন। আবার অনেকে চাকুরিই পান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনা করে জুতসই চাকরি পাননি, এমন অনেক ভাইকে আমি চিনি। আবার গ্রামের কলেজ থেকে পাশ করে বড় কোম্পানীকে যোগ দিয়েছেন, তিন-চার বছরেই গাড়ি কিনেছেন, ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছেন, এমনও অনেককে দেখছি।
আমাদের দেশে মানুষ বেশি। সেই তুলনায় চাকরি কম। তা ঠিক। তবে যোগ্যতা থাকলে ভালো চাকরি মেলে, এটাও সত্য। অনেক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদ ফাঁকা থাকে, কারণ যোগ্য লোক নেই। দুই বার, তিনবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তবুও লোক মেলে না।
একজন চাকুরিপ্রার্থীকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখাটিতে আমি সেই চেষ্টাটা করেছি। কাজে লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
একজন চাকুরিপ্রার্থীর জন্য একটি সুন্দর ও সঠিক জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) তৈরি করা খুবই দরকারি। অনেকে আছেন, তাড়াহুড়া করে কোনো রকমে একটি জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করে নিয়োগদাতার কাছে পাঠিয়ে দেন। মনে রাখবেন, এ রকম কিছু করলে যোগ্যতা প্রমানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির আগে কিছু বাস্তবতার দিকে খেয়াল রাখা দরকার।
চাকুরিপ্রার্থীদের কেউ কেউ মনে করেন, জীবনবৃত্তান্ত বড় হলে ভালো। তারা পাঁচ বা ছয় পৃষ্ঠা পর্যন্ত জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নিয়োগদাতা আপনার জীবনবৃত্তান্ত দেখার জন্য বড় জোর দুই থেকে তিন মিনিট সময় দেবেন। অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বড় করলে আপনার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতার দিকটি খুঁজে বের করতে তার সময় লাগবে। এতে তিনি বিরক্তও হতে পারেন। তাই জীবনবৃত্তান্ত হতে হবে সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট। সদ্য পাশ করা একজন চাকুরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত দুই পৃষ্ঠার বেশি না হওয়াই ভালো।
বাক্যগঠনগত ভুল, এমনকি একটি বানান, দাড়ি, কমা, ফুলস্টপ-কোনো ধরনের ভুল যেন না হয়। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির পর খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করুন। প্রয়োজনে ভালো ইংরেজি ও বাংলা জানেন, এমন কাউকে দিয়ে দেখিয়ে নিন। আপনার রেজাল্ট যত ভালো হোক না কেন, যতই আপনার অভিজ্ঞতা থাক না কেন, জীবনবৃত্তান্তে ভুল হলে শুরুতেই আপনার ব্যাপারে নিয়োগদাতার নেতিবাচক ধারনা তৈরি হবে। সাক্ষাতকারের জন্য তিনি আপনাকে ডাকতে নাও পারেন।
জীবনবৃত্তান্তে থাকুক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সঠিক প্রতিফলন। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির পর খেয়াল করুন, আপনার সম্পর্কে অতিরিক্ত বা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলা হয়েছে কি না। কম্পিউটারে দক্ষতা এবং ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি বলা ও লেখার বিষয়গুলোতে খেয়াল করুন। যোগ্যতার বাইরে যাবেন না। এতে বরং ক্ষতি হবে। নিজের ওপর ভরসা রাখুন।
জীবনবৃত্তান্ত আকর্ষণীয় হতে হবে। তবে বেশি আকর্ষণীয় করতে গিয়ে রঙ্গিন কালির ব্যবহার না করাই ভালো। নিয়োগকর্তার নজরে বিশেষ কিছু আনতে চাইলে ওই জায়গাটা আন্ডারলাইন করতে পারেন। বোল্ডও করতে পারেন। তবে অনেক নিয়োগকর্তা আন্ডারলাইন বা বোল্ড বিশেষ পছন্দ করেন না। স্বাভাবিক অবস্থাকেই তারা গুরুত্ব দেন।
জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করে রাখলে সুবিধা। পরে শুধু নির্দিষ্ট জায়গা পরিবর্তন করে কাজে লাগানো যায়। খেয়াল রাখবেন, আপনি যে পদের জন্য আবেদন করছেন, চাকরিদাতার শর্ত অনুযায়ী আপনার জীবনবৃত্তান্তটি সেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে কি না। আর খেয়াল রাখবেন রেফারেন্সের বিষয়টি। পারলে এমন ব্যক্তিকে রেফারেন্স হিসেবে দিন, যিনি ওই ক্ষেত্রে (ফিল্ড) পরিচিত। যাকে বা যাদের আপনি রেফারেন্স হিসেবে দিচ্ছেন, তাদের আগেই জানিয়ে রাখবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২.
সাক্ষাৎকার: এরপরে আসে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ। আপনি মেধাবী, আপনার জীবনবৃত্তান্তটাও যথেষ্ট সমীহ করার মত, তবে চাকরির সাক্ষাতকারে তালগোল পাকিয়ে ফেললে কিন্তু সব শেষ। বর্তমানের কঠিন অর্থনীতির সময়ে সম্ভাব্য সবদিক দিয়েই আপনাকে চেষ্টা করতে হবে। জোনাথন লিটম্যান এবং মার্ক হারশনের নতুন বই ‘আই হেট পিপল! কিক লুজ ফ্রম দ্য ওভারবিয়ারিং অ্যান্ড আন্ডারহ্যান্ডেড জার্কস অ্যাট ওয়ার্ক অ্যান্ড গেট হোয়াট ইউ ওয়ান্ট আউট অফ ইউর জব’ -এ সাক্ষাতকারে ভালো করার সরল সমীকরণ দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো, আপনাকে পছন্দের ব্যক্তি হতে হবে, অপছন্দের নয়। এখানে খুবই সাধারণ ১০টি বিষয় আছে, যা আপনার সম্ভাবনাকে নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেবে।
সাক্ষাতকারের সময় অতিরিক্ত হাসাহাসি আপনার আত্ববিশ্বাসের ঘাটতি এবং দুর্বলতাকে তুলে ধরে। তার চেয়ে চিন্তাশীল থাকুন এবং মুখে আনন্দের ভাব বজায় রাখুন। তবে যখন হাসার প্রসঙ্গ উঠবে, তখনই কেবল হাসবেন। আয়না বা কোনো বন্ধুর সামনে পুরো বিষয়টি অনুশীলন করুন।
কখনই মনে করবেন না টুকটাক কথা-বার্তা দিয়েই সাক্ষাতকারটি শেষ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনায় কিভাবে নিয়ে আসা যায়, তা চেষ্টা করুন। তবে কখনই গত রাতে দেখা কোনো নাটক বা সিনেমার অংশ বা আপনার প্রিয় ব্লগের খুঁটিনাটি তথ্য সাক্ষাতকারে জাহির করতে যাবেন না।
ঘেমে গেলেই বিপদ। সাক্ষাতকার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে অথবা কোনো প্রশ্ন না পারলে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হওয়া আপনার ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে না। সাক্ষাতকারের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে বন্ধুদের সামনে অনুশীলন করুন। দেখবেন ভয় কেটে আত্মবিশ্বাস জায়গা করে নিচ্ছে।
শার্টটি যেন ছোট না হয়। বড়ও না হয়। আপনার হওয়া চাকরিটাই বাতিল হয়ে যেতে পারে, এমন বদখত পোশাকে। মানানসই পোশাকের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই।
নিয়োগদাতারা এমন প্রার্থীকে বেছে নিতে চান, যিনি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পগুলো গ্রহণে উৎসাহী হবেন। ইতস্তত করা এবং না বলার মানসিকতাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। আগ্রহের ক্ষেত্র ও কাজগুলোতে সব সময় হ্যাঁ বলুন।
সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা পরিহার করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের খাবার কক্ষ কোথায় বা বৈঠক কক্ষ কোথায়, এসব ছোটখাট প্রশ্ন কখনও জানতে চাইবেন না। এটা আপনার প্রস্তুতির ঘাটতিকে তুলে ধরবে। এই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মীর সংখ্যা কত, প্রতিষ্ঠানের নীতি-এসব রুটিন কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে কর্মীরা হামেশাই মিথ্যা বলেন। মিথ্যা আপনাকে চাকরি দেবে না। সাক্ষাতকারে সামান্য বাড়িয়ে বলাও কিন্তু মিথ্যা। সাক্ষাতকারটি শেষ করার জন্য একটি মিথ্যাই যথেষ্ট। অভিজ্ঞ নিয়োগদাতারা নানা প্রশ্ন করে চাকরিপ্রার্থীর মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে কি তা বের করে ফেলেন। একবার ধরা পড়লে কিন্তু তারা আপনাকে দরজা দেখিয়ে দেবেন। তাই জীবনবৃত্তান্তেও মিথ্যা না, সাক্ষাতকারেও না।
‘ব্যাড কমেডিয়ান’ না হওয়াই ভালো। একটা কৌতুক বলে সাক্ষাতকারের প্রশ্নের জবাব দেওয়া আপনার অভ্যাস হতে পারে। কিন্তু আপনাকে কৌতুকটির উপাদানের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কারণ আপনি তো জানেন না নিয়োগদাতাদের মধ্যে কার সংবেদনশীলতা কেমন, কী তাদের হাসাবে।
সময়ভূক (time-waster) হবেন না। আপনার মেধা দিয়ে ‘টু দ্যা পয়েন্ট’ উত্তর দিন। আশপাশের প্রসঙ্গ জড়িয়ে উত্তর লম্বা করবেন না। এতে তারা আপনাকে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার সময় পাবে না। বিরক্ত হবে।
আপনার পূর্বের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য পরিহার করুন। সেখানে আপনি কিভাবে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছেন, সে অভিজ্ঞতা এই প্রতিষ্ঠানে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা বলুন।
৩.
সাক্ষাতকারের পোশাক: চাকরির জন্য সাক্ষাতকার দিতে যাওয়ার সময় কেমন পোশাক পরবেন, তা অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। হয়তো সাক্ষাতকারের দিন সকালবেলা সঠিক ও মানানসই পোশাকটি খুঁজে পান না। অথবা যে পোশাকটি পরেছেন, আয়নার সামনে গিয়ে দেখলেন ঠিক ভালো লাগছে না, যতটা আপনি প্রত্যাশা করেছিলেন। এ রকম হলে কিন্তু সাক্ষাতকারটি গড়বড় হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, যে পোশাকটি আপনি পরবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটা দুদিন আগেই প্রস্তুত করে রাখা। এবং সাক্ষাতকারের আগের রাতে সেগুলো একবার পরীক্ষা করে দেখা। পারলে বিকল্প আরেকটি সেট পোশাক প্রস্তুত করে রাখুন।
কেমন পোশাক পরবেন? এ প্রশ্নের সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানায় এমন পোশাক। সঠিক পোশাক আপনার ব্যাপারে নিয়োগকর্তার ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। আগে দর্শনধারী, পরে গুনবিচারী- এ কথাটি তো আমাদের সবারই জানা আছে। পোশাকের ব্যাপারে এই সহায়ক টিপসগুলো আপনার উপকারে আসতে পারে।
এমন পোশাক পরুন, যা আরামদায়ক এবং পোশাকে আপনার পেশাদারিত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে, এমন আঁটসাট পোশাক পরবেন না। পরিচ্ছন্ন থাকুন, আপনি নিজে ও আপনার পোশাক। জামাটা যদি কটনের হয়, তাহলে ভালো হয়, যেকোনো ঋতুতে। খোলাখুলি যদি বলি, তবে আপনি পরতে পারেন রক্ষনশীল ধরনের পোশাক, যেমন দুই পিসের সুট, সাদা জামা, এর সঙ্গে টাই। প্যান্টটি যেন হয় সঠিক দৈর্ঘ্যের। প্যান্ট অবশ্যই আপনার গোড়ালি ঢেকে যাবে। তবে কোনোভাবেই যেন আপনার জুতোর হিলের নিচে চলে না যায়।
জুতোটা যেন পরিস্কার হয়। সকালেই একবার পলিশ করে নিন। আর সাক্ষাতকার বোর্ডে ঢোকার আগে আরেকবার দেখে নিন, জুতোয় মাটি-কাদা বা ধুলা লেগে আছে কি না।
চুলের ছাট হোক সাধারণ ও পরিচ্ছন্ন। গোঁফ-দাড়ি লাগসইভাবে ছেটে নিন। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নিয়ে সাক্ষাতকার বোর্ডে যাবেন না, ঠিকমত কামিয়ে নিন। অতিরিক্ত অলঙ্কার পরে, বাড়তি সাজ-সজ্জা করে সাক্ষাতকার দিতে যাবেন না। পারফিউম ব্যবহার করতে পারেন, বেশ হালকা করে।
বেশি জমজমাট পোশাক পরারও দরকার নেই, আবার বেশি ক্যাজুয়াল পোশাকও পরা ঠিক হবে না। স্বাভাবিক, রুচিশীল পোশাক পরুন। স্মরণে রাখবেন, আপনি এখানে সাক্ষাতকার দিতে এসেছেন, কারণ এই কোম্পানীতে কাজ করতে চান। নিজের গুনাগুন, ব্যক্তিত্ব ঢাকা পড়ে এমন পোশাক পরা সঠিক হবে না।
শেষ কথাটি বলি। আপনি যদি ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে চান, আপনাকে ইংরেজিটা ভালো জানতে হবে। অনেকে আছেন, টুকটাক-ভুলভাল, ইয়েস, নো, ভেরি গুড, নো প্রোবলেম, থ্যাংকস, ওয়াও! এসব দিয়েই চালিয়ে নেন। কিন্তু দুই লাইন লিখতে গেলে তিনবার কলম ভাঙে। আপনি কিন্তু ভালো চাকরি পাবেন না। আর এতে আপনার আত্ববিশ্বাসও বাড়বে না। তাই ইংরেজিটা ভালো করে বলা ও লেখার চেষ্টা শুরু করা দরকার গোড়া থেকেই। আপনি যদি প্রতিজ্ঞা করেন, আপনাকে পারতেই হবে, তবেই আপনি পারবেন। (ইয়াহু! জবসের সহায়তা নিয়ে লেখাটি তৈরি করেছেন রহিম রায়হান
আমাদের দেশে মানুষ বেশি। সেই তুলনায় চাকরি কম। তা ঠিক। তবে যোগ্যতা থাকলে ভালো চাকরি মেলে, এটাও সত্য। অনেক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদ ফাঁকা থাকে, কারণ যোগ্য লোক নেই। দুই বার, তিনবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তবুও লোক মেলে না।
একজন চাকুরিপ্রার্থীকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখাটিতে আমি সেই চেষ্টাটা করেছি। কাজে লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
একজন চাকুরিপ্রার্থীর জন্য একটি সুন্দর ও সঠিক জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) তৈরি করা খুবই দরকারি। অনেকে আছেন, তাড়াহুড়া করে কোনো রকমে একটি জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করে নিয়োগদাতার কাছে পাঠিয়ে দেন। মনে রাখবেন, এ রকম কিছু করলে যোগ্যতা প্রমানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির আগে কিছু বাস্তবতার দিকে খেয়াল রাখা দরকার।
চাকুরিপ্রার্থীদের কেউ কেউ মনে করেন, জীবনবৃত্তান্ত বড় হলে ভালো। তারা পাঁচ বা ছয় পৃষ্ঠা পর্যন্ত জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নিয়োগদাতা আপনার জীবনবৃত্তান্ত দেখার জন্য বড় জোর দুই থেকে তিন মিনিট সময় দেবেন। অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বড় করলে আপনার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতার দিকটি খুঁজে বের করতে তার সময় লাগবে। এতে তিনি বিরক্তও হতে পারেন। তাই জীবনবৃত্তান্ত হতে হবে সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট। সদ্য পাশ করা একজন চাকুরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত দুই পৃষ্ঠার বেশি না হওয়াই ভালো।
বাক্যগঠনগত ভুল, এমনকি একটি বানান, দাড়ি, কমা, ফুলস্টপ-কোনো ধরনের ভুল যেন না হয়। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির পর খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করুন। প্রয়োজনে ভালো ইংরেজি ও বাংলা জানেন, এমন কাউকে দিয়ে দেখিয়ে নিন। আপনার রেজাল্ট যত ভালো হোক না কেন, যতই আপনার অভিজ্ঞতা থাক না কেন, জীবনবৃত্তান্তে ভুল হলে শুরুতেই আপনার ব্যাপারে নিয়োগদাতার নেতিবাচক ধারনা তৈরি হবে। সাক্ষাতকারের জন্য তিনি আপনাকে ডাকতে নাও পারেন।
জীবনবৃত্তান্তে থাকুক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সঠিক প্রতিফলন। জীবনবৃত্তান্ত তৈরির পর খেয়াল করুন, আপনার সম্পর্কে অতিরিক্ত বা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলা হয়েছে কি না। কম্পিউটারে দক্ষতা এবং ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি বলা ও লেখার বিষয়গুলোতে খেয়াল করুন। যোগ্যতার বাইরে যাবেন না। এতে বরং ক্ষতি হবে। নিজের ওপর ভরসা রাখুন।
জীবনবৃত্তান্ত আকর্ষণীয় হতে হবে। তবে বেশি আকর্ষণীয় করতে গিয়ে রঙ্গিন কালির ব্যবহার না করাই ভালো। নিয়োগকর্তার নজরে বিশেষ কিছু আনতে চাইলে ওই জায়গাটা আন্ডারলাইন করতে পারেন। বোল্ডও করতে পারেন। তবে অনেক নিয়োগকর্তা আন্ডারলাইন বা বোল্ড বিশেষ পছন্দ করেন না। স্বাভাবিক অবস্থাকেই তারা গুরুত্ব দেন।
জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করে রাখলে সুবিধা। পরে শুধু নির্দিষ্ট জায়গা পরিবর্তন করে কাজে লাগানো যায়। খেয়াল রাখবেন, আপনি যে পদের জন্য আবেদন করছেন, চাকরিদাতার শর্ত অনুযায়ী আপনার জীবনবৃত্তান্তটি সেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে কি না। আর খেয়াল রাখবেন রেফারেন্সের বিষয়টি। পারলে এমন ব্যক্তিকে রেফারেন্স হিসেবে দিন, যিনি ওই ক্ষেত্রে (ফিল্ড) পরিচিত। যাকে বা যাদের আপনি রেফারেন্স হিসেবে দিচ্ছেন, তাদের আগেই জানিয়ে রাখবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২.
সাক্ষাৎকার: এরপরে আসে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ। আপনি মেধাবী, আপনার জীবনবৃত্তান্তটাও যথেষ্ট সমীহ করার মত, তবে চাকরির সাক্ষাতকারে তালগোল পাকিয়ে ফেললে কিন্তু সব শেষ। বর্তমানের কঠিন অর্থনীতির সময়ে সম্ভাব্য সবদিক দিয়েই আপনাকে চেষ্টা করতে হবে। জোনাথন লিটম্যান এবং মার্ক হারশনের নতুন বই ‘আই হেট পিপল! কিক লুজ ফ্রম দ্য ওভারবিয়ারিং অ্যান্ড আন্ডারহ্যান্ডেড জার্কস অ্যাট ওয়ার্ক অ্যান্ড গেট হোয়াট ইউ ওয়ান্ট আউট অফ ইউর জব’ -এ সাক্ষাতকারে ভালো করার সরল সমীকরণ দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো, আপনাকে পছন্দের ব্যক্তি হতে হবে, অপছন্দের নয়। এখানে খুবই সাধারণ ১০টি বিষয় আছে, যা আপনার সম্ভাবনাকে নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেবে।
সাক্ষাতকারের সময় অতিরিক্ত হাসাহাসি আপনার আত্ববিশ্বাসের ঘাটতি এবং দুর্বলতাকে তুলে ধরে। তার চেয়ে চিন্তাশীল থাকুন এবং মুখে আনন্দের ভাব বজায় রাখুন। তবে যখন হাসার প্রসঙ্গ উঠবে, তখনই কেবল হাসবেন। আয়না বা কোনো বন্ধুর সামনে পুরো বিষয়টি অনুশীলন করুন।
কখনই মনে করবেন না টুকটাক কথা-বার্তা দিয়েই সাক্ষাতকারটি শেষ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনায় কিভাবে নিয়ে আসা যায়, তা চেষ্টা করুন। তবে কখনই গত রাতে দেখা কোনো নাটক বা সিনেমার অংশ বা আপনার প্রিয় ব্লগের খুঁটিনাটি তথ্য সাক্ষাতকারে জাহির করতে যাবেন না।
ঘেমে গেলেই বিপদ। সাক্ষাতকার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে অথবা কোনো প্রশ্ন না পারলে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হওয়া আপনার ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে না। সাক্ষাতকারের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে বন্ধুদের সামনে অনুশীলন করুন। দেখবেন ভয় কেটে আত্মবিশ্বাস জায়গা করে নিচ্ছে।
শার্টটি যেন ছোট না হয়। বড়ও না হয়। আপনার হওয়া চাকরিটাই বাতিল হয়ে যেতে পারে, এমন বদখত পোশাকে। মানানসই পোশাকের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই।
নিয়োগদাতারা এমন প্রার্থীকে বেছে নিতে চান, যিনি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্পগুলো গ্রহণে উৎসাহী হবেন। ইতস্তত করা এবং না বলার মানসিকতাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। আগ্রহের ক্ষেত্র ও কাজগুলোতে সব সময় হ্যাঁ বলুন।
সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা পরিহার করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের খাবার কক্ষ কোথায় বা বৈঠক কক্ষ কোথায়, এসব ছোটখাট প্রশ্ন কখনও জানতে চাইবেন না। এটা আপনার প্রস্তুতির ঘাটতিকে তুলে ধরবে। এই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মীর সংখ্যা কত, প্রতিষ্ঠানের নীতি-এসব রুটিন কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে কর্মীরা হামেশাই মিথ্যা বলেন। মিথ্যা আপনাকে চাকরি দেবে না। সাক্ষাতকারে সামান্য বাড়িয়ে বলাও কিন্তু মিথ্যা। সাক্ষাতকারটি শেষ করার জন্য একটি মিথ্যাই যথেষ্ট। অভিজ্ঞ নিয়োগদাতারা নানা প্রশ্ন করে চাকরিপ্রার্থীর মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে কি তা বের করে ফেলেন। একবার ধরা পড়লে কিন্তু তারা আপনাকে দরজা দেখিয়ে দেবেন। তাই জীবনবৃত্তান্তেও মিথ্যা না, সাক্ষাতকারেও না।
‘ব্যাড কমেডিয়ান’ না হওয়াই ভালো। একটা কৌতুক বলে সাক্ষাতকারের প্রশ্নের জবাব দেওয়া আপনার অভ্যাস হতে পারে। কিন্তু আপনাকে কৌতুকটির উপাদানের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কারণ আপনি তো জানেন না নিয়োগদাতাদের মধ্যে কার সংবেদনশীলতা কেমন, কী তাদের হাসাবে।
সময়ভূক (time-waster) হবেন না। আপনার মেধা দিয়ে ‘টু দ্যা পয়েন্ট’ উত্তর দিন। আশপাশের প্রসঙ্গ জড়িয়ে উত্তর লম্বা করবেন না। এতে তারা আপনাকে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার সময় পাবে না। বিরক্ত হবে।
আপনার পূর্বের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য পরিহার করুন। সেখানে আপনি কিভাবে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছেন, সে অভিজ্ঞতা এই প্রতিষ্ঠানে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা বলুন।
৩.
সাক্ষাতকারের পোশাক: চাকরির জন্য সাক্ষাতকার দিতে যাওয়ার সময় কেমন পোশাক পরবেন, তা অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। হয়তো সাক্ষাতকারের দিন সকালবেলা সঠিক ও মানানসই পোশাকটি খুঁজে পান না। অথবা যে পোশাকটি পরেছেন, আয়নার সামনে গিয়ে দেখলেন ঠিক ভালো লাগছে না, যতটা আপনি প্রত্যাশা করেছিলেন। এ রকম হলে কিন্তু সাক্ষাতকারটি গড়বড় হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, যে পোশাকটি আপনি পরবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটা দুদিন আগেই প্রস্তুত করে রাখা। এবং সাক্ষাতকারের আগের রাতে সেগুলো একবার পরীক্ষা করে দেখা। পারলে বিকল্প আরেকটি সেট পোশাক প্রস্তুত করে রাখুন।
কেমন পোশাক পরবেন? এ প্রশ্নের সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানায় এমন পোশাক। সঠিক পোশাক আপনার ব্যাপারে নিয়োগকর্তার ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। আগে দর্শনধারী, পরে গুনবিচারী- এ কথাটি তো আমাদের সবারই জানা আছে। পোশাকের ব্যাপারে এই সহায়ক টিপসগুলো আপনার উপকারে আসতে পারে।
এমন পোশাক পরুন, যা আরামদায়ক এবং পোশাকে আপনার পেশাদারিত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে, এমন আঁটসাট পোশাক পরবেন না। পরিচ্ছন্ন থাকুন, আপনি নিজে ও আপনার পোশাক। জামাটা যদি কটনের হয়, তাহলে ভালো হয়, যেকোনো ঋতুতে। খোলাখুলি যদি বলি, তবে আপনি পরতে পারেন রক্ষনশীল ধরনের পোশাক, যেমন দুই পিসের সুট, সাদা জামা, এর সঙ্গে টাই। প্যান্টটি যেন হয় সঠিক দৈর্ঘ্যের। প্যান্ট অবশ্যই আপনার গোড়ালি ঢেকে যাবে। তবে কোনোভাবেই যেন আপনার জুতোর হিলের নিচে চলে না যায়।
জুতোটা যেন পরিস্কার হয়। সকালেই একবার পলিশ করে নিন। আর সাক্ষাতকার বোর্ডে ঢোকার আগে আরেকবার দেখে নিন, জুতোয় মাটি-কাদা বা ধুলা লেগে আছে কি না।
চুলের ছাট হোক সাধারণ ও পরিচ্ছন্ন। গোঁফ-দাড়ি লাগসইভাবে ছেটে নিন। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নিয়ে সাক্ষাতকার বোর্ডে যাবেন না, ঠিকমত কামিয়ে নিন। অতিরিক্ত অলঙ্কার পরে, বাড়তি সাজ-সজ্জা করে সাক্ষাতকার দিতে যাবেন না। পারফিউম ব্যবহার করতে পারেন, বেশ হালকা করে।
বেশি জমজমাট পোশাক পরারও দরকার নেই, আবার বেশি ক্যাজুয়াল পোশাকও পরা ঠিক হবে না। স্বাভাবিক, রুচিশীল পোশাক পরুন। স্মরণে রাখবেন, আপনি এখানে সাক্ষাতকার দিতে এসেছেন, কারণ এই কোম্পানীতে কাজ করতে চান। নিজের গুনাগুন, ব্যক্তিত্ব ঢাকা পড়ে এমন পোশাক পরা সঠিক হবে না।
শেষ কথাটি বলি। আপনি যদি ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে চান, আপনাকে ইংরেজিটা ভালো জানতে হবে। অনেকে আছেন, টুকটাক-ভুলভাল, ইয়েস, নো, ভেরি গুড, নো প্রোবলেম, থ্যাংকস, ওয়াও! এসব দিয়েই চালিয়ে নেন। কিন্তু দুই লাইন লিখতে গেলে তিনবার কলম ভাঙে। আপনি কিন্তু ভালো চাকরি পাবেন না। আর এতে আপনার আত্ববিশ্বাসও বাড়বে না। তাই ইংরেজিটা ভালো করে বলা ও লেখার চেষ্টা শুরু করা দরকার গোড়া থেকেই। আপনি যদি প্রতিজ্ঞা করেন, আপনাকে পারতেই হবে, তবেই আপনি পারবেন। (ইয়াহু! জবসের সহায়তা নিয়ে লেখাটি তৈরি করেছেন রহিম রায়হান
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন