আধুনিক কবি কালের ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; কিঞ্চিত্ প্রভাবিত। সমকালের বিভিন্ন প্রপঞ্চ আধুনিক মন ও মননকে বিমোহিত করে সত্য; কিন্তু তাতেই শৃঙ্খলিত করে না। বিশেষত কবি ঘটনার ফল নন; ঘটনার দ্রষ্টামাত্র। শব্দের অর্থ কবির হাতে পড়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। মানবমন বস্তুনিরপেক্ষ নয়। ফলে নিষ্প্রাণ বস্তুরাশিও সময়ে প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে ওঠে। সচেতন প্রয়াসেই কবি তার প্রতিবেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বহুরৈখিক রূপ অঙ্কন করেন। আধুনিক কবি সমাজ নয়; ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, মনোবিকার ও তাত্ক্ষণিক অনুভূতির বহুমাত্রিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেন গভীর মনোনিবেশে। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাংলা কবিতা উত্কর্ষে ও প্রাচুর্যে অনন্য।
নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে।
অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা।
আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও?
সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি।
[১নং সনেট]
কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন।
আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন। কামহীন প্রেমকে কবি সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং প্রেমহীন কামকে কবি ঘৃণার্হ করে তুলেছেন শব্দের পর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগের মাধ্যমে।
তার পর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
[১০নং সনেট]
মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তার মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তার দয়িতাকে আলিঙ্গনে আহ্বান করেন। কোনো সংঘ কবির আরাধ্য নয়। কারণ কবিমাত্রই বাঁধনহারা, দৃঢ়চেতা এবং সত্ সাহসী। কবিরা কোনো সংঘের শরণ নেয়ার চেয়ে দরিদ্র বাউলের বাউণ্ডুলেপনাকে শ্রেয় বোধে লালন করেন।
পূর্বপুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাউল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার
এর চেয়ে ভাল নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?
[৬নং সনেট]
শব্দকে একটি শান্ত ও গম্ভীর প্রবহমান নদীর মতো প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে শিল্পীর নান্দনিক ও তাত্পর্যময় ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে কবি নিজের ব্যক্তিত্ব, মনন ও রুচিকে সংক্রমিত করেন তার পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যেও। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। ফলে তার কণ্ঠস্বরটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে—যথার্থ ও অনিবার্য কারণেই।
ছন্দ নির্বাচনে কবি আঠারো মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তকে বেছে নিয়েছেন—বোধ হয় এই ছন্দের প্রবল গাম্ভীর্যময় চারিত্র্যের জন্যই। নিরূপিত ছন্দোপযোগী শব্দ নির্বাচনে আধুনিক কবির স্বাধীনতা সামান্যতম হলেও ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করি। কারণ যথেচ্ছ শব্দ নির্বাচন ও গঠনের সুযোগ নিরূপিত ছন্দে নেই বললেই চলে। এর কারণ বাক্যস্থিত শব্দ সমবায়ের বিন্যাস হতে হয়—অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরম্পরায়। এর ব্যতিক্রমে ছন্দপতন ও বিষয়ের বোধগম্যতায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উলাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো কোন ঝোপে লুকাবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে
আমাদের কলা কেন্দ্রে আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
[১১নং সনেট]
এই অস্তিবাদী জিরাফেরা তাদের ব্যক্তিগত গলা অহরহ বাড়ায়। আজকের অশান্ত বিশ্বের প্রতিটি অশুভ কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে এই অস্তিবাদী জিরাফেরা। এই যে বিষয়ের সঙ্গে ছন্দোপযোগী শব্দ ও পর্ববিন্যাস এবং উপমার যে অভিনবত্ব দেখি, তা অনস্বীকার্যভাবে উজ্জ্বল। বাংলার কৃষকসমাজের উত্থান-পতন যেমন জসীমউদ্দীন এঁকেছেন তার স্বভাব সারল্যে; আবহমান বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল রূপ যেমন এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ তার দীর্ঘ বিষণ্নতার ঘোর রহস্যময় সম্মোহনে; তেমনি আল মাহমুদ এঁকেছেন তার মননশীলতার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অন্বয়সাধনের মাধ্যমে। সোনালি কাবিন বিষয় নির্বাচন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দের প্রয়োগ, পদবিন্যাসের স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে বিশিষ্ট। সুলুক সন্ধানী পাঠকমাত্রই আবিষ্কার করবেন এই সনেটগুচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এক ঘোর রহস্যময় সারল্যের ভাষাচিত্র। স্বাপ্নিক বিরোধ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে নেই সত্য; কিন্তু অন্তহীন রহস্যময় দিগন্তরেখার মোহনীয় উদ্ভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্বোধ্যতা ভর করেনি, সারল্যও নেই; আছে বিমূর্ত আবহের চেতনা।
আধুনিক বাংলা কবিতা অনুভবের জন্য শিক্ষিত পাঠকমন প্রয়োজন। কবিতা শুধু বুদ্ধিপ্রধান বাক্যবন্ধের সমষ্টি নয়; ভাবালুতাসর্বস্ব তরল শব্দ সমবায়ে রচিত বাক্যাবলিও কবিতা নয়। কবিতা যদি মানবজীবনের যাপিত অংশের শৈল্পিক ধারাভাষ্য কিংবা নান্দনিক প্রতিচ্ছবি না হয়, তাহলে পাঠক সেটাকে গ্রহণ করে না। আবার গতানুগতিক বিষয়ের প্রথাগত বুননও কবিকণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। কাব্য-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাত্পর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উেপ্রক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সোনালি কাবিনে ব্যবহৃত শব্দরাজি বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিদিন উচ্চারিত শব্দরাজি থেকে আহরিত। সোনালি কাবিন নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও।
সূত্র : আমার দেশ
নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে।
অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা।
আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও?
সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি।
[১নং সনেট]
কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন।
আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন। কামহীন প্রেমকে কবি সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং প্রেমহীন কামকে কবি ঘৃণার্হ করে তুলেছেন শব্দের পর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগের মাধ্যমে।
তার পর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
[১০নং সনেট]
মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তার মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তার দয়িতাকে আলিঙ্গনে আহ্বান করেন। কোনো সংঘ কবির আরাধ্য নয়। কারণ কবিমাত্রই বাঁধনহারা, দৃঢ়চেতা এবং সত্ সাহসী। কবিরা কোনো সংঘের শরণ নেয়ার চেয়ে দরিদ্র বাউলের বাউণ্ডুলেপনাকে শ্রেয় বোধে লালন করেন।
পূর্বপুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাউল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার
এর চেয়ে ভাল নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?
[৬নং সনেট]
শব্দকে একটি শান্ত ও গম্ভীর প্রবহমান নদীর মতো প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে শিল্পীর নান্দনিক ও তাত্পর্যময় ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে কবি নিজের ব্যক্তিত্ব, মনন ও রুচিকে সংক্রমিত করেন তার পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যেও। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। ফলে তার কণ্ঠস্বরটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে—যথার্থ ও অনিবার্য কারণেই।
ছন্দ নির্বাচনে কবি আঠারো মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তকে বেছে নিয়েছেন—বোধ হয় এই ছন্দের প্রবল গাম্ভীর্যময় চারিত্র্যের জন্যই। নিরূপিত ছন্দোপযোগী শব্দ নির্বাচনে আধুনিক কবির স্বাধীনতা সামান্যতম হলেও ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করি। কারণ যথেচ্ছ শব্দ নির্বাচন ও গঠনের সুযোগ নিরূপিত ছন্দে নেই বললেই চলে। এর কারণ বাক্যস্থিত শব্দ সমবায়ের বিন্যাস হতে হয়—অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরম্পরায়। এর ব্যতিক্রমে ছন্দপতন ও বিষয়ের বোধগম্যতায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উলাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো কোন ঝোপে লুকাবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে
আমাদের কলা কেন্দ্রে আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
[১১নং সনেট]
এই অস্তিবাদী জিরাফেরা তাদের ব্যক্তিগত গলা অহরহ বাড়ায়। আজকের অশান্ত বিশ্বের প্রতিটি অশুভ কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে এই অস্তিবাদী জিরাফেরা। এই যে বিষয়ের সঙ্গে ছন্দোপযোগী শব্দ ও পর্ববিন্যাস এবং উপমার যে অভিনবত্ব দেখি, তা অনস্বীকার্যভাবে উজ্জ্বল। বাংলার কৃষকসমাজের উত্থান-পতন যেমন জসীমউদ্দীন এঁকেছেন তার স্বভাব সারল্যে; আবহমান বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল রূপ যেমন এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ তার দীর্ঘ বিষণ্নতার ঘোর রহস্যময় সম্মোহনে; তেমনি আল মাহমুদ এঁকেছেন তার মননশীলতার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অন্বয়সাধনের মাধ্যমে। সোনালি কাবিন বিষয় নির্বাচন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দের প্রয়োগ, পদবিন্যাসের স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে বিশিষ্ট। সুলুক সন্ধানী পাঠকমাত্রই আবিষ্কার করবেন এই সনেটগুচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এক ঘোর রহস্যময় সারল্যের ভাষাচিত্র। স্বাপ্নিক বিরোধ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে নেই সত্য; কিন্তু অন্তহীন রহস্যময় দিগন্তরেখার মোহনীয় উদ্ভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্বোধ্যতা ভর করেনি, সারল্যও নেই; আছে বিমূর্ত আবহের চেতনা।
আধুনিক বাংলা কবিতা অনুভবের জন্য শিক্ষিত পাঠকমন প্রয়োজন। কবিতা শুধু বুদ্ধিপ্রধান বাক্যবন্ধের সমষ্টি নয়; ভাবালুতাসর্বস্ব তরল শব্দ সমবায়ে রচিত বাক্যাবলিও কবিতা নয়। কবিতা যদি মানবজীবনের যাপিত অংশের শৈল্পিক ধারাভাষ্য কিংবা নান্দনিক প্রতিচ্ছবি না হয়, তাহলে পাঠক সেটাকে গ্রহণ করে না। আবার গতানুগতিক বিষয়ের প্রথাগত বুননও কবিকণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। কাব্য-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাত্পর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উেপ্রক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সোনালি কাবিনে ব্যবহৃত শব্দরাজি বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিদিন উচ্চারিত শব্দরাজি থেকে আহরিত। সোনালি কাবিন নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন