# ৭৭-এ পা দিচ্ছেন, কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান?
— স্বাধীন, সার্বভৌম, শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুখী বাংলাদেশ।
# আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মধ্যে ফারাকটা কতখানি?
— বেশ ফারাক আছে। কারণ কবি যে কল্পনা করে, আমরা একটু বেশি আশা করি, সে রকম তো আর হয় না, আমরা যা আশা করি। তবু পায়ের নিচের মাটিটা তো বাংলাদেশ। তাই না? এক ভালোবাসার টান।
# একটা রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন আমরা জানি। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন।
— স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা প্রকাশ্যে ছিলাম না, কিন্তু আশপাশে ছিলাম, তাদের সঙ্গেই।
# এবং তারও আগে থেকেই বাংলাদেশের সত্তা যখন গঠিত হচ্ছিল, আপনার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এসেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এসেছে, ভাষা আন্দোলন এসেছে। বাংলাদেশের মাটিকে, এদেশের জলকে, হাওয়াকে, লোকজ জীবনকে তুলে এনেছেন—এসবের পেছনে আপনার কী দর্শনটা কাজ করেছিল?
— বাংলার মাটি! একটা কথা আছে না—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক...’ এই।
# কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী?
— সন্দেহ নেই, এ দু’জনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব নেই, কারণ কবিরা যেখানে শুতে যায় সেই জায়গাটার একদিকে নারী, আরেক দিকে বই থাকে। এই দুটোকে সরিয়ে কবিকে বিশ্রাম নিতে হয়। আশা করি কথাটা বুঝেছ।
# আপনি তো একজন ঘোরতর আস্তিক মানুষ। এই বিশ্বাস, এই রহস্যময়তা আপনার বিপুল রচনাসম্ভারে নানা মাত্রিকতায়, নানা অবয়বে প্রতিফলিত। এই মরমিয়াবাদ সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন।
— আমি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মানুষ কী করে? বিশ্বাসী মানুষ সবসময় একটা কাজ করে। সেটা কী করে? সে সেজদা করে অদৃশ্যের দিকে এবং সে প্রার্থনা করে, অ্যান্ড হি প্রেজ, প্রার্থনা করতে থাকে। এটা আমার একটা ধারণা। ধারণা কী? এটা সত্য।
# আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে?
— আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন মনে হলো—আচ্ছা, আমিও তো এরকম লিখতে পারি। লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল।
# সেটা তো বিস্ময়কর!
— আমার কাছেও বিস্ময়কর!
# এখনও?
— এখনও লাগে।
# আপনার জীবনে এমন কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে কী, যেটা এখনও পূর্ণ হয়নি?
— এটা তো তুমি একটা খুব জটিল প্রশ্ন করলে। আমি তো পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। কিছু পাই, কিছু পাই না। এই হাতড়ে বেড়াই। এটা হলো জীবন।
# ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার যে বাঁকবদলগুলো হয়েছে, তার পেছনে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমার জীবনই একটা আশ্চর্য জীবন। কত ঘাটে ভিড়তে হয়েছে। কত কিছু দেখলাম, জানলাম। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে, দেশে যা কিছু ঘটেছে। আমি তো এদেশ থেকে পালিয়ে যাইনি। আমি দেশে থেকে দেশের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি, মুভ করেছি এবং আরেকটা কী ব্যাপার—কেঁদেছি। আই ওয়েপ্ট।
# নানা ধরনের লেখা আপনি লেখেন। কথাশিল্প, কলাম, কবিতা, আত্মজৈবনিক—কোন শাখায় লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেন?
— আসলে ওই অতীত নিয়ে লিখতে ভালোই লাগে। কিন্তু অতীত বেশিদিন দেখা যায় না। আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানটা যে এতই বাস্তব এবং এতই রূঢ় যে, এর মধ্যে বসবাস করতে হলে সাহস, শক্তি এবং কাব্যগুণ লাগে। সেটা মনে হয় আমারও কম-বিস্তর আছে।
# কেউ কেউ বলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা’।
— এটা কেউ কেউ নয়, আমিই বলেছি প্রথম।
# এ কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে?
— বাংলা ভাষাই বাংলাদেশের আত্মা। এই ভাষার সঙ্গে অন্য কিছুকে বাংলাদেশ মিশ্রিত করে না। এক দিগ্বিজয়ী ভাষা। শব্দের তরঙ্গ বাংলাদেশেই বইছে। বাংলাদেশ ছাড়া এটা আর কোথাও সম্ভবপর হয়নি। কলকাতা গেলে তুমি দেখবে, সব হিন্দি আর ইংরেজি।
# সেখানে বাংলা ভাষা মরে যাচ্ছে, ওরা টিকিয়ে রাখতে পারছে না।
— না, পারছে না।
# গদ্য কিংবা কবিতা লেখার পরবর্তী যে অনুভব কিংবা সাফল্যের শিহরণ—দুয়ের মধ্যে মৌল কোনো পার্থক্য আছে কি?
— আমি সব সময় ভাবি যে, আমার খাপে তো দুইটা তরবারি আছে—একটা গদ্যের, একটা পদ্যের। যখন যেটা আমার প্রয়োজন, সেটা ব্যবহার করেছি।
# তরুণ কবিদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি?
— কথা হলো যে, উপদেশ দেয়া আমার জন্য ঠিক না। তরুণরা ইচ্ছানুযায়ী চলবে—এটাই আমরা চাই। তবে একটা কথা বলব। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান না হলে কিছুই হয় না। বলা হয় না, জ্ঞানবৃক্ষের ফল না খেলে সে তো কিছুই জানে না? জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার যে খেয়েছে, তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে স্বর্গ ছেড়ে। স্বর্গ থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে, সে পৃথিবীতেই চলে আসবে। পৃথিবীতে এসে নিজের পরিশ্রমের অন্ন নিজে খাবে।
# দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা প্রকৃত সাহিত্যচর্চায় কতটা অবদান রাখতে পারছে?
— আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যের জন্য সাহায্যকারী হয়েছে। অন্য দেশে এটা হয়নি, আমাদের দেশে হয়েছে।
# মানসম্পন্ন সাহিত্য কাগজের অভাবের কারণে হয়েছে?
— তাই, তাই তো দেখতে হবে। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। লিটলম্যাগ আছে।
# বাংলা কবিতার ভবিষ্যত্ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
— এটা বলা উচিত না। কারণ, আধুনিক বাংলা কবিতা হলো আধুনিক জাতীয় জীবনের একটা দৃষ্টান্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা এতই পরিপকস্ফ এবং এতই ডালপালা মেলে দিয়েছে, যদিও গদ্যকে আমরা আধুনিক বলি, এটা অন্য কোনো সাহিত্যে ঘটেনি যে, কবিতাই বিজয়ী হয়েছে।
# সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর কারণটা কী?
— আশ্চর্য কথা—বাংলাদেশে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। দল বেঁধে কেউ কবিতা
(৭-এর পৃষ্ঠার পর)
পড়ত নাকি? কোনো সময় পড়েনি। দলবদ্ধভাবে কাব্যচর্চা করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। কেউ কেউ করেছে—এরাই তো বাঁচিয়ে রাখে সব।
# আমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা বিশ্বমানের বিচারে কোন অবস্থায় আছে?
— আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় জগতের সাহিত্যের সমকক্ষ। আমাদের কবিতা যদি ব্যাপক অনুবাদ হয় তাহলে বোঝা যাবে, কী আশ্চর্য কাজ হয়েছে বাংলা ভাষায়!
# স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কিন্তু সেভাবে আসেনি।
— না, অনুবাদ করার মতো লোক আসেনি। এটা ঠিকই কথা।
# বাংলা একাডেমীর একটা ভূমিকা, দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে ছিল না?
— কার কার ভূমিকা বা দায়িত্ব ছিল এটা বলে কোনো লাভ নেই। এটা ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। একজন লোক যদি থাকে, তাহলে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়।
# কেউ যদি বলে, আপনার ইদানীং কালের লেখায় আগেকার সেই লাবণ্য ও মাধুর্য কিছুটা গরহাজির—এ অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— আমার পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব নেই। তবে কী কারণে বলে, তা কিন্তু উল্লেখ করা হয় না। তারা ভ্রান্ত কিনা, নাকি আমি ভুল করছি সেটা বোঝার মতো ব্যাখ্যা হয়নি এখনও।
# বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন কাব্যধারা কিংবা প্রবণতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী?
— আমি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সম্পর্কে কম জানি। আমার পড়া হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম আমার। কে লিখছে, কী লিখছে এটা আমি জানি না, তখন একটা আন্দাজি মন্তব্য আমি করতে পারি না। তবে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কাব্যের শক্তি এবং ঐশ্বর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে এর যে লোকজ গ্রাউন্ড, সেটা অনেক উর্বর বলে আমি মনে করি।
# আপনার মায়াবি কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— হয়তোবা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেয়া, কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম।
# বলা হয়, আমাদের কবিতাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি। এই ক্ষতির জন্য কে বা কারা দায়ী?
— কেউ দায়ী নয়। ভালো ট্রান্সলেটরের অভাব— যে একই সঙ্গে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী হবে। তাদের আবির্ভাব হয়নি। এটা একটা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে।
# একজন খাঁটি কবি হওয়ার ক্ষেত্রে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কতটা জরুরি?
— আমি আস্তিকতাকে খুব মূল্য দিই। কারণ, বিশ্বাস হলো একটা হাতল। এটা ধরতে হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। বিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই।
# মহাকালের বিচারে আপনার কবিতা কতটা টিকে থাকবে বলে আপনার ধারণা?
— আমি তো ভবিষ্যত্ বক্তা নই। যে কারণে বলতে পারব না। মহাকালের বিচারে টিকে থাকে না অনেক কিছুই। তুমি চর্যাপদ দেখ, চর্যাচর্যাবিনিশ্চয়। এটা কীভাবে আছে?
‘শাশুড়ী নিদ গাএ বউড়ি জাগত্র
কানেট চোরে নিল কাগই মাগত্র’
# প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলী আকবর খান একবার বলেছিলেন যে, নিবিড় সঙ্গীত সাধনার এক পর্যায়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। কবিতা রচনার কোনো পর্যায়ে এমন ধরনের কোনো ঐশী বোধ কি কখনও আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে?
— তিনি তো বলেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে; কিন্তু আমি যে জিনিস চর্চা করি এটার নাম হলো আধুনিক কবিতা। কবিতার মধ্যেও সঙ্গীত আছে। আমি লিরিকটা পছন্দ করি। আমি একটু লিরিক্যাল লোক এবং লিরিক হলো সবকিছু পাওয়ার একটা পথ। এটাই অনুসন্ধান করতে হবে।
# বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে আপনি প্রায়ই বলতেন, চিত্রকল্পই কবিতা। ত্রিশের দশকের খ্যাতিমান এক কবি বলে গেছেন, উপমাই কবিতা। এ ব্যাপারে বিশদ বলবেন কি?
— আমি কেন যে চিত্রকল্পকেই কবিতা বলেছিলাম, সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে। আমার কবিতায় তো আমি এটা ত্যাগ করিনি। চিত্রকল্প তো প্রায় কবিতারই সমার্থক। কবিতায় একটা চিত্রকল্প লাগে।
# আমরা জানি, কবিতা পড়তে গিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে উপমা, চিত্রকল্প, উেপ্রক্ষা, প্রতীকের দক্ষ শৈল্পিক প্রয়োগের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ছন্দের ব্যাপারটিও জরুরি, তাই নয় কি?
— সবচেয়ে বড় কথা হলো ছন্দ। একজন কবিকে জানতে হয়—মিলটা কীভাবে সংঘটিত হয়। অনুপ্রাস জানতে হবে। এটা জানলেই তার মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এটা না জানলে কিন্তু অনেক অসুবিধা।
# দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় আপনার সৃজিত কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়েছে সমকাল, বাংলাদেশের লোকজীবন, দেশ, সমাজ, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, অহং, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সফল সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নে এসবের প্রতিফলন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো কেন জরুরি বলবেন কি?
— তুমি নিজেই তো বললে জরুরি। জরুরি এজন্য যে, একটাকে বাদ দিলে খুঁত থেকে যায়। এই খুঁত ভরাট করার আর কে আছে, কিছু তো নেই। কবিতার জায়গাটা কবিতা দিয়েই ভরাট করা দরকার, অন্য কিছু দিয়ে হয় না।
# উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
— এটা হলো—দার্শনিকরা যেটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, সেটা ঘাড়ে তুলে নেয়া।
# উত্তর আধুনিকতা বলতে পশ্চিমে আধুনিকতা-পরবর্তী কালটাকে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতে বা বাংলাদেশে এটাকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া বোঝাচ্ছে—এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছাড়া ঘটেনি। কবিতা কিন্তু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি আছে সেখানে সবসময় প্রাচীন ঐতিহ্য আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে তো থাকা যায় না। মানুষকে সামনের দিকে এগোতে হয়। পুরনো ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু কবিতা হয়ে উঠতে হলে আধুনিকতা দরকার।
# এবার একটু ম্যাজিক রিয়েলিজম সম্পর্কে আলাপ করতে চাই। রিয়েলিজম ও ড্রিমের মধ্যে সেতু তৈরি করাকেই আমরা ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে বুঝি। এ নিয়ে লাতিন ও ক্যারিবিয়ান কথাশিল্পীরাই বেশি কাজ করে থাকেন। পরে এই জাদুবাস্তবতার ধারণা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। আপনার কবিতায়ও আমরা এর লক্ষণ দেখছি। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতার বইতে এই বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
— এটার মধ্যে যা বক্তব্য সেটা ঠিক খোলাসা করা যায় না। তবে এটুকু বলতে পারি—সবগুলো জটিলতার জট খুলে যায় যখন মিল বোঝে কবি—ছন্দের দোলায় যখন পৌঁছে। ছন্দ, গন্ধ এবং স্পর্শের যে আনন্দ; এটা একজন কবিকে সামনে ঠেলে দেয়। ভবিষ্যতের দিকে দারুণভাবে ঠেলে দেয়। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়।
# আপনার কাব্য-সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—সেটাই কবিতা যা প্রথম পাঠে ভালো লাগে। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
— তিনি কী বলেছিলেন সেটা আমি বলতে পারব না। তবে প্রথম পাঠে অনেক কিছুই ভালো লাগে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত কথা হলো? প্রথম পাঠে অনেক অকবিতাও ভালো লাগে, তাই না? প্রথম পাঠে আমার ভালো লাগে গদ্য। কারণ গদ্য আধুনিক। এটা তো বলা যায় না—আমার প্রথম পাঠে যেটা ভালো লাগে সেটাই কবিতা। এর সঙ্গে ঠিক আমি একমত হতে পারি না।
# আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—একটা কবিতা প্রথম পাঠে ভালো লাগল, কিন্তু আপনি যখন কয়েকবার পাঠ করলেন তখন মনে হলো—না, ভালো লাগার আসলে কারণ নেই।
— হ্যাঁ, কোনো কারণ নেই দেখা যাচ্ছে।
# আনন্দ ও বেদনা—কবিতার কাছে আপনি কোনটা বেশি পেয়েছেন?
— আমার মনে হয়, আনন্দ-বেদনা—এই দুইটাই সমভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।
# একজন লেখকের বিকাশের জন্য সংঘ বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
— কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। কিন্তু দল বেঁধে কাব্য হয় না।
# এই যে জাতীয় কবিতা পরিষদ হয়েছে, কেউ বলেন এটা এখন খুব স্তিমিত হয়ে আছে—এগুলো কি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকার করেছে?
— কবিতার যে কোনো সংগঠন বা কবিতার জন্য যারা কাজ করে, তারা কিছু না কিছু কাজ তো করেই—এটুকু শুধু বলতে পারি।
# মৃত্যুচিন্তা কি আপনাকে কখনও আচ্ছন্ন করে? এ অনুভূতিটা কেমন?
— যেহেতু আমি জন্মেছি, মৃত্যু হবেই। এটা যখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তখন মৃত্যুর ভয়টা হয়তো ঈষত্ কমে আছে—কিন্তু মৃত্যুর যে ভয়, বিস্ময়, মৃত্যুর যে একটা স্বাদ আছে এটা আমি কখনও গ্রহণ করিনি। এটা একবারই মানুষ গ্রহণ করে, যখন সে মরে যায়। ফিরে এসে আর কিছু বলতেও পারে না।
# বিশ্ব সমাজে সমাজতন্ত্র যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা আপনাকে ব্যথিত করে কি?
— সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে সমাজতন্ত্রের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। কারণ, পুঁজিবাদ এত প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রীরা মুখ খুলতে পারছে না। পুঁজিবাদ যতই বৃহদাকার ধারণ করুক—পুঁজিরও একটা পরিসমাপ্তি আছে।
# আপনার রাজনৈতিক চিন্তায় আমরা ব্যাপক পরিবর্তন দেখি। বামধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় আপনি আস্থাশীল হয়েছেন সময়ের পরিক্রমায়। এই পরিবর্তনের অনিবার্যতা কী ছিল? আপনার সাহিত্যচিন্তা ও লেখালেখিতে এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাম ঘরানা, যতই বলে না কেন, মানুষের বিশেষ করে কবির স্বাধীনতা হরণ করে।
# বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত লেখালেখিকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
— এ কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু আমি তো লিখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি—আয়-রোজগার যাই বলো, এই লেখা থেকেই।
# আপনি তো অন্যান্য চাকরিও করেছেন। সেগুলো যদি করতে না হতো...
— সেটা করেছি, কিন্তু লেখালেখি থেকেই আমাকে আয়-রোজগার বেশি করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলি—যেটা ঘটে না, সেটা ঘটবে না বলেই ঘটে না। এটা সত্য।
# কবিরা সত্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বর্তমান কবিদের কবিতায় তার কেমন প্রতিফলন আছে?
— সব কবি সত্যদ্রষ্টা কিনা জানি না। তবে আমি বলি—কবিরা দ্রষ্টা। সে দেখে।
# আপনি এক সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বৃত্তি কতটা উপকারী কিংবা অপকারী বলে আপনার মনে হয়েছে?
— এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। আমি সাংবাদিকতা করেছি। কেন করেছি? আমার পেটের জন্য করেছি। বেঁচে থাকার জন্য করেছি। সেটাও প্রয়োজন ছিল।
# কবিতার কাছে আপনার ঋণ কতখানি?
— যা কিছু নিয়েছি, কাব্যের কাছ থেকেই নিয়েছি। তবে দিয়েছিও, শোধ করার চেষ্টাও আমি করেছি।
# কেউ কেউ বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শক্তিমান লেখক আর আসছেন না। আপনি কি এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত?
— আমি ঠিক একমত নই। তবে সব সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত লেখক যারা, তারা বেশ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে আসেন, প্রতিদিন তো আর আসেন না।
# আপনার প্রথম প্রেমের অনুভূতি, রোমাঞ্চ—নারী প্রেম অর্থে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
— আমারও এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ সময় যেটা, যেটাকে আমরা যৌবন বলি, তার প্রারম্ভে। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই, বলা উচিতও নয়।
# কবিদের মধ্যে ক্ষুদ্র দলাদলির ব্যাপারটি কি আপনাকে পীড়িত করে? একজন খাঁটি কবি দলভুক্ত না হলে ন্যূনতম স্বীকৃতিও পান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন আপনি?
— এটা আমি ঠিক মানি না, কারণ কবিতা একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। কবিতা নীরবে লিখতে হয় এবং কবি একা, কবি নীরব সব সময়।
# কিন্তু দল না করলে পুরস্কার পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কার নিয়েও এটা হয়ে থাকে।
— এগুলো বাস্তবতা। এগুলো আমি অস্বীকার করে চলে এসেছি।
# ইদানীংকালে আপনার দিনগুলো কেমন করে কাটছে?
— আমি তো চোখে-টোখে দেখি না। দৃষ্টি তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটামুটি বসে থাকি। পড়তে খুব ইচ্ছা করে। আমার পড়ে শোনানোর লোকও আছে। নাতি-নাতনিরা আছে। তারা জরুরি বিষয় যেটা সেটা পড়ে শোনায়। পত্রিকা শোনায়। আমি মাঝে মাঝে গান শুনতে ভালোবাসি।
# আপনার প্রিয় শিল্পী কে? প্রিয় গান সম্পর্কে বলুন।
— আমি তো এদেশের শ্রেষ্ঠ যারা গায়ক-গায়িকা, তাদের সবারই গান শুনি।
# আপনি তো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেনও। শিল্পকলা একাডেমী থেকে আপনার বইও হয়েছে।
— আছে। আব্বাসউদ্দীনকে নিয়েও আমি একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি।
# আপনার প্রিয় গান কোনটা—রবীন্দ্র, নজরুল?
— ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার প্রিয়। এছাড়া আমার একটা স্বতন্ত্র পড়াশোনা ছিল পশ্চিমা মিউজিকের ওপর। এটা খুবই আমার কাছে লেগেছিল। আমি এদেশীয় সঙ্গীত বুঝতে পেরেছি। যাকে বলে পশ্চিমা সঙ্গীত, সেটারও ধ্বনি তরঙ্গ আমি অনুভব করতে পারি। এর ওপর আমার কিছু বক্তৃতাও ছিল। আমি মাঝে মাঝে এ সম্পর্কে বলতাম। আমি প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি—যদি আমি কবি না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই সঙ্গীতজ্ঞ হতাম।
# দেশে এবং বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা?
— অনেক নামই তাহলে বলতে হয়। আমাদের দেশে আমার প্রিয় লেখক কাকে বলব—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন, রবীন্দ্রনাথ...
# রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আপনার অনেক লেখা আছে— গদ্য, পদ্য...
— আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশাল ভাণ্ডার। সেখান থেকে অনেক কিছু নেয়ার আছে। আর নজরুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারণ হলো—তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একটিমাত্র কবিতা তার আছে—‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির’—যার সমতুল্য কাব্য বাংলা ভাষায় আর নেই।
# জীবনানন্দ দাশকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
— জীবনানন্দ তো নির্জনতার কবি। তাঁর একটা কবিতায় আছে—উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে—এটাই জীবনানন্দ সম্পর্কে আমি বলি।
# সাম্প্রতিককালে কী লিখছেন?
— কলাম-টলাম তো লিখছি। দু’একটা কবিতা হয়তো লিখছি। আরও কিছু লিখতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমার তো বয়স হয়ে গেছে আসলে আশি। এ বয়সে মানুষ আর লেখে না, ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমি তো এখনও ছাড়িনি।
# বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, এটা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? দেশটা কি সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হবে?
— আমি অবশ্য আমাদের জনগণকে অধিক মূল্য দান করি। আমি শুধু বলব যে, আমাদের জনগণ নির্বোধ নয়। তারা সবই বুঝতে পারে।
# আপনার প্রিয় সুগন্ধি কী? আপনি তো সুগন্ধি ভালোবাসেন। আপনার গল্পও আছে—সৌরভের কাছে পরাজিত।
— আতর আমার প্রিয় সুগন্ধি। সবচেয়ে ভালো লাগে গোলাপি আতর। অসাধারণ। মানুষ আসল গোলাপি আতর পায় না। কিন্তু আসল গোলাপি আতর এক ধরনের পানির মধ্যে ভেসে ওঠা তেলের মতো। খুবই মধুর। একদিন লাগালে দু’তিন দিন থাকে।
# আপনার সংগ্রহে আছে?
— ছিল, এখন আর নেই।
# আপনার প্রিয় খাবার কী?
— আমার প্রিয় খাবার সাধারণত কোর্মা-পোলাও। এখনও এটা আমি ভালোবাসি, খেতেও পারি।
# আপনি একটা কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না কারণ সাম্রাজ্যবাদের পরাক্রম বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে আরব বিশ্বে ইসলামী গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— এটা আমি একবার বলেছিলাম কিন্তু। একটা বিষয় আসছে, পৃথিবীতে যেটা সম্পূর্ণ নতুন এবং তার কোনো কামান-বন্দুক নেই। সে অস্ত্রশূন্য হাতে একটি পুস্তক নিয়ে আসছে—তার নাম হচ্ছে ইসলাম। এর হাতে হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এটা পুঁজিবাদের সঙ্গেও মিলে না, সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও না। এটা হলো আধুনিক জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এটা ব্যবসাকে হালাল করে, সুদকে হারাম করে দেয়। যে সমাজে সুদ আছে সে সমাজে সুখ নেই। সুদের সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদ তো হারাম করে দিয়েছে। আমার মতে যারা সুদ খায়—আমাদের বইপত্রে আছে যে, যারা সুদ খায় তারা উঠে দাঁড়াতে পারে না।
# লেখালেখির ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে?
— এক সময় তো আমার স্ত্রীই ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। এখন এই যে নিঃসঙ্গ আমি, এই ক্ষতি তো আর পূরণ হবে না, হয়ও না।
# এক সময় তো কবি হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন কেন লিখছেন—এটা কি কোনো দায়বোধ?
— আমরা তো কোথাও পৌঁছতে চাই। ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, সেটা আমি এখন বলছি না। তবে একটা কথা হচ্ছে—ইসলাম আসছে। ভবিষ্যত্ হলো ইসলামের হাতে।
# এখন যদি আপনার হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, আপনার প্রথম কাজ কী হবে?
— প্রথম কথা হলো—এ দায়িত্ব আমি নিতে চাই না।
# আপনি চান না, কিন্তু যদি কোনোভাবে এমনটা হয়?
— তাহলে তো প্রথমে জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এটাই আমি করব।
# আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্য।
‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই’— এ কথা কবি আল মাহমুদের। যদিও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সাংবাদিক হিসেবে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা, তথাপি তাঁর কবি পরিচয়ই তাকে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করেছে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর সমৃদ্ধিসাধনে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অগুনতি পাঠকের কাছ থেকে। হাজার বছরের বাংলা কাব্যধারায় অবগাহন করে আল মাহমুদ বাংলাভাষী পাঠককে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনডজন কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় তিনি বাঁকের পর বাঁক বদল করে ক্রমাগত ছুটেছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর অতৃপ্ত কবিপ্রাণ এখনও ধাবমান।
বয়স আশির কাছাকাছি হলেও প্রাণে তার তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। কবিতায় তিনি ধারণ করেছেন এই বাংলাদেশের আত্মা। ‘আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ’ তিনি দেখেছেন। গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে জারিত লোকজজীবনের অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, বিশেষ মহিমা। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, বরুদগন্ধী মানুষের দেশ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, পুরুষ সুন্দর, যে পারো ভুলিয়ে দাও, কবি ও কোলাহল, আগুনের মেয়ে, চেহারার চতুরঙ্গ তার আলোচিত উপন্যাস।
ছোট্টগল্প লিখেও চমকে দিয়েছেন তিনি পাঠকদের। পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন ইত্যাদি তার ছোট্টগল্প গ্রন্থ। যেভাবে বেড়ে উঠি, বিচূর্ণ আয়নার কবির মুখ—তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বেশ ক’টি গ্রন্থ। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম বিষয়ক এবং আত্মগত অসংখ্য প্রবন্ধ ও কলাম।
গত ১১ জুলাই ছিল এই মহান কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় কবির বাসায় হাজির হয়েছিলাম আমরা। মগবাজারের আয়শা-গোমতী ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন তিনি একটি পত্রিকার প্রতিনিধিকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন। আমাদের ডাকলেন তাঁর শোয়ার ঘরে। কবিকে মনে হলো বেশ চঞ্চল ও উত্ফুল্ল। সাক্ষাত্কার দিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার এই সাক্ষাত্কারটি এখানে পত্রস্থ হলো।
— স্বাধীন, সার্বভৌম, শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুখী বাংলাদেশ।
# আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মধ্যে ফারাকটা কতখানি?
— বেশ ফারাক আছে। কারণ কবি যে কল্পনা করে, আমরা একটু বেশি আশা করি, সে রকম তো আর হয় না, আমরা যা আশা করি। তবু পায়ের নিচের মাটিটা তো বাংলাদেশ। তাই না? এক ভালোবাসার টান।
# একটা রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন আমরা জানি। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন।
— স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা প্রকাশ্যে ছিলাম না, কিন্তু আশপাশে ছিলাম, তাদের সঙ্গেই।
# এবং তারও আগে থেকেই বাংলাদেশের সত্তা যখন গঠিত হচ্ছিল, আপনার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এসেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এসেছে, ভাষা আন্দোলন এসেছে। বাংলাদেশের মাটিকে, এদেশের জলকে, হাওয়াকে, লোকজ জীবনকে তুলে এনেছেন—এসবের পেছনে আপনার কী দর্শনটা কাজ করেছিল?
— বাংলার মাটি! একটা কথা আছে না—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক...’ এই।
# কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী?
— সন্দেহ নেই, এ দু’জনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব নেই, কারণ কবিরা যেখানে শুতে যায় সেই জায়গাটার একদিকে নারী, আরেক দিকে বই থাকে। এই দুটোকে সরিয়ে কবিকে বিশ্রাম নিতে হয়। আশা করি কথাটা বুঝেছ।
# আপনি তো একজন ঘোরতর আস্তিক মানুষ। এই বিশ্বাস, এই রহস্যময়তা আপনার বিপুল রচনাসম্ভারে নানা মাত্রিকতায়, নানা অবয়বে প্রতিফলিত। এই মরমিয়াবাদ সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন।
— আমি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মানুষ কী করে? বিশ্বাসী মানুষ সবসময় একটা কাজ করে। সেটা কী করে? সে সেজদা করে অদৃশ্যের দিকে এবং সে প্রার্থনা করে, অ্যান্ড হি প্রেজ, প্রার্থনা করতে থাকে। এটা আমার একটা ধারণা। ধারণা কী? এটা সত্য।
# আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে?
— আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন মনে হলো—আচ্ছা, আমিও তো এরকম লিখতে পারি। লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল।
# সেটা তো বিস্ময়কর!
— আমার কাছেও বিস্ময়কর!
# এখনও?
— এখনও লাগে।
# আপনার জীবনে এমন কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে কী, যেটা এখনও পূর্ণ হয়নি?
— এটা তো তুমি একটা খুব জটিল প্রশ্ন করলে। আমি তো পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। কিছু পাই, কিছু পাই না। এই হাতড়ে বেড়াই। এটা হলো জীবন।
# ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার যে বাঁকবদলগুলো হয়েছে, তার পেছনে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমার জীবনই একটা আশ্চর্য জীবন। কত ঘাটে ভিড়তে হয়েছে। কত কিছু দেখলাম, জানলাম। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে, দেশে যা কিছু ঘটেছে। আমি তো এদেশ থেকে পালিয়ে যাইনি। আমি দেশে থেকে দেশের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি, মুভ করেছি এবং আরেকটা কী ব্যাপার—কেঁদেছি। আই ওয়েপ্ট।
# নানা ধরনের লেখা আপনি লেখেন। কথাশিল্প, কলাম, কবিতা, আত্মজৈবনিক—কোন শাখায় লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেন?
— আসলে ওই অতীত নিয়ে লিখতে ভালোই লাগে। কিন্তু অতীত বেশিদিন দেখা যায় না। আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানটা যে এতই বাস্তব এবং এতই রূঢ় যে, এর মধ্যে বসবাস করতে হলে সাহস, শক্তি এবং কাব্যগুণ লাগে। সেটা মনে হয় আমারও কম-বিস্তর আছে।
# কেউ কেউ বলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা’।
— এটা কেউ কেউ নয়, আমিই বলেছি প্রথম।
# এ কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে?
— বাংলা ভাষাই বাংলাদেশের আত্মা। এই ভাষার সঙ্গে অন্য কিছুকে বাংলাদেশ মিশ্রিত করে না। এক দিগ্বিজয়ী ভাষা। শব্দের তরঙ্গ বাংলাদেশেই বইছে। বাংলাদেশ ছাড়া এটা আর কোথাও সম্ভবপর হয়নি। কলকাতা গেলে তুমি দেখবে, সব হিন্দি আর ইংরেজি।
# সেখানে বাংলা ভাষা মরে যাচ্ছে, ওরা টিকিয়ে রাখতে পারছে না।
— না, পারছে না।
# গদ্য কিংবা কবিতা লেখার পরবর্তী যে অনুভব কিংবা সাফল্যের শিহরণ—দুয়ের মধ্যে মৌল কোনো পার্থক্য আছে কি?
— আমি সব সময় ভাবি যে, আমার খাপে তো দুইটা তরবারি আছে—একটা গদ্যের, একটা পদ্যের। যখন যেটা আমার প্রয়োজন, সেটা ব্যবহার করেছি।
# তরুণ কবিদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি?
— কথা হলো যে, উপদেশ দেয়া আমার জন্য ঠিক না। তরুণরা ইচ্ছানুযায়ী চলবে—এটাই আমরা চাই। তবে একটা কথা বলব। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান না হলে কিছুই হয় না। বলা হয় না, জ্ঞানবৃক্ষের ফল না খেলে সে তো কিছুই জানে না? জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার যে খেয়েছে, তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে স্বর্গ ছেড়ে। স্বর্গ থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে, সে পৃথিবীতেই চলে আসবে। পৃথিবীতে এসে নিজের পরিশ্রমের অন্ন নিজে খাবে।
# দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা প্রকৃত সাহিত্যচর্চায় কতটা অবদান রাখতে পারছে?
— আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যের জন্য সাহায্যকারী হয়েছে। অন্য দেশে এটা হয়নি, আমাদের দেশে হয়েছে।
# মানসম্পন্ন সাহিত্য কাগজের অভাবের কারণে হয়েছে?
— তাই, তাই তো দেখতে হবে। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। লিটলম্যাগ আছে।
# বাংলা কবিতার ভবিষ্যত্ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
— এটা বলা উচিত না। কারণ, আধুনিক বাংলা কবিতা হলো আধুনিক জাতীয় জীবনের একটা দৃষ্টান্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা এতই পরিপকস্ফ এবং এতই ডালপালা মেলে দিয়েছে, যদিও গদ্যকে আমরা আধুনিক বলি, এটা অন্য কোনো সাহিত্যে ঘটেনি যে, কবিতাই বিজয়ী হয়েছে।
# সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর কারণটা কী?
— আশ্চর্য কথা—বাংলাদেশে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। দল বেঁধে কেউ কবিতা
(৭-এর পৃষ্ঠার পর)
পড়ত নাকি? কোনো সময় পড়েনি। দলবদ্ধভাবে কাব্যচর্চা করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। কেউ কেউ করেছে—এরাই তো বাঁচিয়ে রাখে সব।
# আমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা বিশ্বমানের বিচারে কোন অবস্থায় আছে?
— আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় জগতের সাহিত্যের সমকক্ষ। আমাদের কবিতা যদি ব্যাপক অনুবাদ হয় তাহলে বোঝা যাবে, কী আশ্চর্য কাজ হয়েছে বাংলা ভাষায়!
# স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কিন্তু সেভাবে আসেনি।
— না, অনুবাদ করার মতো লোক আসেনি। এটা ঠিকই কথা।
# বাংলা একাডেমীর একটা ভূমিকা, দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে ছিল না?
— কার কার ভূমিকা বা দায়িত্ব ছিল এটা বলে কোনো লাভ নেই। এটা ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। একজন লোক যদি থাকে, তাহলে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়।
# কেউ যদি বলে, আপনার ইদানীং কালের লেখায় আগেকার সেই লাবণ্য ও মাধুর্য কিছুটা গরহাজির—এ অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— আমার পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব নেই। তবে কী কারণে বলে, তা কিন্তু উল্লেখ করা হয় না। তারা ভ্রান্ত কিনা, নাকি আমি ভুল করছি সেটা বোঝার মতো ব্যাখ্যা হয়নি এখনও।
# বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন কাব্যধারা কিংবা প্রবণতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী?
— আমি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সম্পর্কে কম জানি। আমার পড়া হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম আমার। কে লিখছে, কী লিখছে এটা আমি জানি না, তখন একটা আন্দাজি মন্তব্য আমি করতে পারি না। তবে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কাব্যের শক্তি এবং ঐশ্বর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে এর যে লোকজ গ্রাউন্ড, সেটা অনেক উর্বর বলে আমি মনে করি।
# আপনার মায়াবি কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— হয়তোবা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেয়া, কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম।
# বলা হয়, আমাদের কবিতাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি। এই ক্ষতির জন্য কে বা কারা দায়ী?
— কেউ দায়ী নয়। ভালো ট্রান্সলেটরের অভাব— যে একই সঙ্গে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী হবে। তাদের আবির্ভাব হয়নি। এটা একটা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে।
# একজন খাঁটি কবি হওয়ার ক্ষেত্রে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কতটা জরুরি?
— আমি আস্তিকতাকে খুব মূল্য দিই। কারণ, বিশ্বাস হলো একটা হাতল। এটা ধরতে হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। বিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই।
# মহাকালের বিচারে আপনার কবিতা কতটা টিকে থাকবে বলে আপনার ধারণা?
— আমি তো ভবিষ্যত্ বক্তা নই। যে কারণে বলতে পারব না। মহাকালের বিচারে টিকে থাকে না অনেক কিছুই। তুমি চর্যাপদ দেখ, চর্যাচর্যাবিনিশ্চয়। এটা কীভাবে আছে?
‘শাশুড়ী নিদ গাএ বউড়ি জাগত্র
কানেট চোরে নিল কাগই মাগত্র’
# প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলী আকবর খান একবার বলেছিলেন যে, নিবিড় সঙ্গীত সাধনার এক পর্যায়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। কবিতা রচনার কোনো পর্যায়ে এমন ধরনের কোনো ঐশী বোধ কি কখনও আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে?
— তিনি তো বলেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে; কিন্তু আমি যে জিনিস চর্চা করি এটার নাম হলো আধুনিক কবিতা। কবিতার মধ্যেও সঙ্গীত আছে। আমি লিরিকটা পছন্দ করি। আমি একটু লিরিক্যাল লোক এবং লিরিক হলো সবকিছু পাওয়ার একটা পথ। এটাই অনুসন্ধান করতে হবে।
# বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে আপনি প্রায়ই বলতেন, চিত্রকল্পই কবিতা। ত্রিশের দশকের খ্যাতিমান এক কবি বলে গেছেন, উপমাই কবিতা। এ ব্যাপারে বিশদ বলবেন কি?
— আমি কেন যে চিত্রকল্পকেই কবিতা বলেছিলাম, সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে। আমার কবিতায় তো আমি এটা ত্যাগ করিনি। চিত্রকল্প তো প্রায় কবিতারই সমার্থক। কবিতায় একটা চিত্রকল্প লাগে।
# আমরা জানি, কবিতা পড়তে গিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে উপমা, চিত্রকল্প, উেপ্রক্ষা, প্রতীকের দক্ষ শৈল্পিক প্রয়োগের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ছন্দের ব্যাপারটিও জরুরি, তাই নয় কি?
— সবচেয়ে বড় কথা হলো ছন্দ। একজন কবিকে জানতে হয়—মিলটা কীভাবে সংঘটিত হয়। অনুপ্রাস জানতে হবে। এটা জানলেই তার মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এটা না জানলে কিন্তু অনেক অসুবিধা।
# দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় আপনার সৃজিত কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়েছে সমকাল, বাংলাদেশের লোকজীবন, দেশ, সমাজ, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, অহং, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সফল সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নে এসবের প্রতিফলন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো কেন জরুরি বলবেন কি?
— তুমি নিজেই তো বললে জরুরি। জরুরি এজন্য যে, একটাকে বাদ দিলে খুঁত থেকে যায়। এই খুঁত ভরাট করার আর কে আছে, কিছু তো নেই। কবিতার জায়গাটা কবিতা দিয়েই ভরাট করা দরকার, অন্য কিছু দিয়ে হয় না।
# উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
— এটা হলো—দার্শনিকরা যেটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, সেটা ঘাড়ে তুলে নেয়া।
# উত্তর আধুনিকতা বলতে পশ্চিমে আধুনিকতা-পরবর্তী কালটাকে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতে বা বাংলাদেশে এটাকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া বোঝাচ্ছে—এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছাড়া ঘটেনি। কবিতা কিন্তু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি আছে সেখানে সবসময় প্রাচীন ঐতিহ্য আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে তো থাকা যায় না। মানুষকে সামনের দিকে এগোতে হয়। পুরনো ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু কবিতা হয়ে উঠতে হলে আধুনিকতা দরকার।
# এবার একটু ম্যাজিক রিয়েলিজম সম্পর্কে আলাপ করতে চাই। রিয়েলিজম ও ড্রিমের মধ্যে সেতু তৈরি করাকেই আমরা ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে বুঝি। এ নিয়ে লাতিন ও ক্যারিবিয়ান কথাশিল্পীরাই বেশি কাজ করে থাকেন। পরে এই জাদুবাস্তবতার ধারণা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। আপনার কবিতায়ও আমরা এর লক্ষণ দেখছি। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতার বইতে এই বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
— এটার মধ্যে যা বক্তব্য সেটা ঠিক খোলাসা করা যায় না। তবে এটুকু বলতে পারি—সবগুলো জটিলতার জট খুলে যায় যখন মিল বোঝে কবি—ছন্দের দোলায় যখন পৌঁছে। ছন্দ, গন্ধ এবং স্পর্শের যে আনন্দ; এটা একজন কবিকে সামনে ঠেলে দেয়। ভবিষ্যতের দিকে দারুণভাবে ঠেলে দেয়। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়।
# আপনার কাব্য-সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—সেটাই কবিতা যা প্রথম পাঠে ভালো লাগে। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
— তিনি কী বলেছিলেন সেটা আমি বলতে পারব না। তবে প্রথম পাঠে অনেক কিছুই ভালো লাগে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত কথা হলো? প্রথম পাঠে অনেক অকবিতাও ভালো লাগে, তাই না? প্রথম পাঠে আমার ভালো লাগে গদ্য। কারণ গদ্য আধুনিক। এটা তো বলা যায় না—আমার প্রথম পাঠে যেটা ভালো লাগে সেটাই কবিতা। এর সঙ্গে ঠিক আমি একমত হতে পারি না।
# আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—একটা কবিতা প্রথম পাঠে ভালো লাগল, কিন্তু আপনি যখন কয়েকবার পাঠ করলেন তখন মনে হলো—না, ভালো লাগার আসলে কারণ নেই।
— হ্যাঁ, কোনো কারণ নেই দেখা যাচ্ছে।
# আনন্দ ও বেদনা—কবিতার কাছে আপনি কোনটা বেশি পেয়েছেন?
— আমার মনে হয়, আনন্দ-বেদনা—এই দুইটাই সমভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।
# একজন লেখকের বিকাশের জন্য সংঘ বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
— কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। কিন্তু দল বেঁধে কাব্য হয় না।
# এই যে জাতীয় কবিতা পরিষদ হয়েছে, কেউ বলেন এটা এখন খুব স্তিমিত হয়ে আছে—এগুলো কি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকার করেছে?
— কবিতার যে কোনো সংগঠন বা কবিতার জন্য যারা কাজ করে, তারা কিছু না কিছু কাজ তো করেই—এটুকু শুধু বলতে পারি।
# মৃত্যুচিন্তা কি আপনাকে কখনও আচ্ছন্ন করে? এ অনুভূতিটা কেমন?
— যেহেতু আমি জন্মেছি, মৃত্যু হবেই। এটা যখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তখন মৃত্যুর ভয়টা হয়তো ঈষত্ কমে আছে—কিন্তু মৃত্যুর যে ভয়, বিস্ময়, মৃত্যুর যে একটা স্বাদ আছে এটা আমি কখনও গ্রহণ করিনি। এটা একবারই মানুষ গ্রহণ করে, যখন সে মরে যায়। ফিরে এসে আর কিছু বলতেও পারে না।
# বিশ্ব সমাজে সমাজতন্ত্র যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা আপনাকে ব্যথিত করে কি?
— সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে সমাজতন্ত্রের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। কারণ, পুঁজিবাদ এত প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রীরা মুখ খুলতে পারছে না। পুঁজিবাদ যতই বৃহদাকার ধারণ করুক—পুঁজিরও একটা পরিসমাপ্তি আছে।
# আপনার রাজনৈতিক চিন্তায় আমরা ব্যাপক পরিবর্তন দেখি। বামধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় আপনি আস্থাশীল হয়েছেন সময়ের পরিক্রমায়। এই পরিবর্তনের অনিবার্যতা কী ছিল? আপনার সাহিত্যচিন্তা ও লেখালেখিতে এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাম ঘরানা, যতই বলে না কেন, মানুষের বিশেষ করে কবির স্বাধীনতা হরণ করে।
# বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত লেখালেখিকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
— এ কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু আমি তো লিখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি—আয়-রোজগার যাই বলো, এই লেখা থেকেই।
# আপনি তো অন্যান্য চাকরিও করেছেন। সেগুলো যদি করতে না হতো...
— সেটা করেছি, কিন্তু লেখালেখি থেকেই আমাকে আয়-রোজগার বেশি করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলি—যেটা ঘটে না, সেটা ঘটবে না বলেই ঘটে না। এটা সত্য।
# কবিরা সত্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বর্তমান কবিদের কবিতায় তার কেমন প্রতিফলন আছে?
— সব কবি সত্যদ্রষ্টা কিনা জানি না। তবে আমি বলি—কবিরা দ্রষ্টা। সে দেখে।
# আপনি এক সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বৃত্তি কতটা উপকারী কিংবা অপকারী বলে আপনার মনে হয়েছে?
— এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। আমি সাংবাদিকতা করেছি। কেন করেছি? আমার পেটের জন্য করেছি। বেঁচে থাকার জন্য করেছি। সেটাও প্রয়োজন ছিল।
# কবিতার কাছে আপনার ঋণ কতখানি?
— যা কিছু নিয়েছি, কাব্যের কাছ থেকেই নিয়েছি। তবে দিয়েছিও, শোধ করার চেষ্টাও আমি করেছি।
# কেউ কেউ বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শক্তিমান লেখক আর আসছেন না। আপনি কি এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত?
— আমি ঠিক একমত নই। তবে সব সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত লেখক যারা, তারা বেশ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে আসেন, প্রতিদিন তো আর আসেন না।
# আপনার প্রথম প্রেমের অনুভূতি, রোমাঞ্চ—নারী প্রেম অর্থে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
— আমারও এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ সময় যেটা, যেটাকে আমরা যৌবন বলি, তার প্রারম্ভে। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই, বলা উচিতও নয়।
# কবিদের মধ্যে ক্ষুদ্র দলাদলির ব্যাপারটি কি আপনাকে পীড়িত করে? একজন খাঁটি কবি দলভুক্ত না হলে ন্যূনতম স্বীকৃতিও পান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন আপনি?
— এটা আমি ঠিক মানি না, কারণ কবিতা একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। কবিতা নীরবে লিখতে হয় এবং কবি একা, কবি নীরব সব সময়।
# কিন্তু দল না করলে পুরস্কার পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কার নিয়েও এটা হয়ে থাকে।
— এগুলো বাস্তবতা। এগুলো আমি অস্বীকার করে চলে এসেছি।
# ইদানীংকালে আপনার দিনগুলো কেমন করে কাটছে?
— আমি তো চোখে-টোখে দেখি না। দৃষ্টি তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটামুটি বসে থাকি। পড়তে খুব ইচ্ছা করে। আমার পড়ে শোনানোর লোকও আছে। নাতি-নাতনিরা আছে। তারা জরুরি বিষয় যেটা সেটা পড়ে শোনায়। পত্রিকা শোনায়। আমি মাঝে মাঝে গান শুনতে ভালোবাসি।
# আপনার প্রিয় শিল্পী কে? প্রিয় গান সম্পর্কে বলুন।
— আমি তো এদেশের শ্রেষ্ঠ যারা গায়ক-গায়িকা, তাদের সবারই গান শুনি।
# আপনি তো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেনও। শিল্পকলা একাডেমী থেকে আপনার বইও হয়েছে।
— আছে। আব্বাসউদ্দীনকে নিয়েও আমি একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি।
# আপনার প্রিয় গান কোনটা—রবীন্দ্র, নজরুল?
— ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার প্রিয়। এছাড়া আমার একটা স্বতন্ত্র পড়াশোনা ছিল পশ্চিমা মিউজিকের ওপর। এটা খুবই আমার কাছে লেগেছিল। আমি এদেশীয় সঙ্গীত বুঝতে পেরেছি। যাকে বলে পশ্চিমা সঙ্গীত, সেটারও ধ্বনি তরঙ্গ আমি অনুভব করতে পারি। এর ওপর আমার কিছু বক্তৃতাও ছিল। আমি মাঝে মাঝে এ সম্পর্কে বলতাম। আমি প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি—যদি আমি কবি না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই সঙ্গীতজ্ঞ হতাম।
# দেশে এবং বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা?
— অনেক নামই তাহলে বলতে হয়। আমাদের দেশে আমার প্রিয় লেখক কাকে বলব—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন, রবীন্দ্রনাথ...
# রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আপনার অনেক লেখা আছে— গদ্য, পদ্য...
— আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশাল ভাণ্ডার। সেখান থেকে অনেক কিছু নেয়ার আছে। আর নজরুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারণ হলো—তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একটিমাত্র কবিতা তার আছে—‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির’—যার সমতুল্য কাব্য বাংলা ভাষায় আর নেই।
# জীবনানন্দ দাশকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
— জীবনানন্দ তো নির্জনতার কবি। তাঁর একটা কবিতায় আছে—উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে—এটাই জীবনানন্দ সম্পর্কে আমি বলি।
# সাম্প্রতিককালে কী লিখছেন?
— কলাম-টলাম তো লিখছি। দু’একটা কবিতা হয়তো লিখছি। আরও কিছু লিখতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমার তো বয়স হয়ে গেছে আসলে আশি। এ বয়সে মানুষ আর লেখে না, ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমি তো এখনও ছাড়িনি।
# বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, এটা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? দেশটা কি সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হবে?
— আমি অবশ্য আমাদের জনগণকে অধিক মূল্য দান করি। আমি শুধু বলব যে, আমাদের জনগণ নির্বোধ নয়। তারা সবই বুঝতে পারে।
# আপনার প্রিয় সুগন্ধি কী? আপনি তো সুগন্ধি ভালোবাসেন। আপনার গল্পও আছে—সৌরভের কাছে পরাজিত।
— আতর আমার প্রিয় সুগন্ধি। সবচেয়ে ভালো লাগে গোলাপি আতর। অসাধারণ। মানুষ আসল গোলাপি আতর পায় না। কিন্তু আসল গোলাপি আতর এক ধরনের পানির মধ্যে ভেসে ওঠা তেলের মতো। খুবই মধুর। একদিন লাগালে দু’তিন দিন থাকে।
# আপনার সংগ্রহে আছে?
— ছিল, এখন আর নেই।
# আপনার প্রিয় খাবার কী?
— আমার প্রিয় খাবার সাধারণত কোর্মা-পোলাও। এখনও এটা আমি ভালোবাসি, খেতেও পারি।
# আপনি একটা কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না কারণ সাম্রাজ্যবাদের পরাক্রম বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে আরব বিশ্বে ইসলামী গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— এটা আমি একবার বলেছিলাম কিন্তু। একটা বিষয় আসছে, পৃথিবীতে যেটা সম্পূর্ণ নতুন এবং তার কোনো কামান-বন্দুক নেই। সে অস্ত্রশূন্য হাতে একটি পুস্তক নিয়ে আসছে—তার নাম হচ্ছে ইসলাম। এর হাতে হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এটা পুঁজিবাদের সঙ্গেও মিলে না, সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও না। এটা হলো আধুনিক জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এটা ব্যবসাকে হালাল করে, সুদকে হারাম করে দেয়। যে সমাজে সুদ আছে সে সমাজে সুখ নেই। সুদের সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদ তো হারাম করে দিয়েছে। আমার মতে যারা সুদ খায়—আমাদের বইপত্রে আছে যে, যারা সুদ খায় তারা উঠে দাঁড়াতে পারে না।
# লেখালেখির ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে?
— এক সময় তো আমার স্ত্রীই ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। এখন এই যে নিঃসঙ্গ আমি, এই ক্ষতি তো আর পূরণ হবে না, হয়ও না।
# এক সময় তো কবি হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন কেন লিখছেন—এটা কি কোনো দায়বোধ?
— আমরা তো কোথাও পৌঁছতে চাই। ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, সেটা আমি এখন বলছি না। তবে একটা কথা হচ্ছে—ইসলাম আসছে। ভবিষ্যত্ হলো ইসলামের হাতে।
# এখন যদি আপনার হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, আপনার প্রথম কাজ কী হবে?
— প্রথম কথা হলো—এ দায়িত্ব আমি নিতে চাই না।
# আপনি চান না, কিন্তু যদি কোনোভাবে এমনটা হয়?
— তাহলে তো প্রথমে জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এটাই আমি করব।
# আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্য।
‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই’— এ কথা কবি আল মাহমুদের। যদিও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সাংবাদিক হিসেবে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা, তথাপি তাঁর কবি পরিচয়ই তাকে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করেছে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর সমৃদ্ধিসাধনে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অগুনতি পাঠকের কাছ থেকে। হাজার বছরের বাংলা কাব্যধারায় অবগাহন করে আল মাহমুদ বাংলাভাষী পাঠককে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনডজন কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় তিনি বাঁকের পর বাঁক বদল করে ক্রমাগত ছুটেছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর অতৃপ্ত কবিপ্রাণ এখনও ধাবমান।
বয়স আশির কাছাকাছি হলেও প্রাণে তার তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। কবিতায় তিনি ধারণ করেছেন এই বাংলাদেশের আত্মা। ‘আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ’ তিনি দেখেছেন। গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে জারিত লোকজজীবনের অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, বিশেষ মহিমা। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, বরুদগন্ধী মানুষের দেশ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, পুরুষ সুন্দর, যে পারো ভুলিয়ে দাও, কবি ও কোলাহল, আগুনের মেয়ে, চেহারার চতুরঙ্গ তার আলোচিত উপন্যাস।
ছোট্টগল্প লিখেও চমকে দিয়েছেন তিনি পাঠকদের। পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন ইত্যাদি তার ছোট্টগল্প গ্রন্থ। যেভাবে বেড়ে উঠি, বিচূর্ণ আয়নার কবির মুখ—তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বেশ ক’টি গ্রন্থ। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম বিষয়ক এবং আত্মগত অসংখ্য প্রবন্ধ ও কলাম।
গত ১১ জুলাই ছিল এই মহান কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় কবির বাসায় হাজির হয়েছিলাম আমরা। মগবাজারের আয়শা-গোমতী ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন তিনি একটি পত্রিকার প্রতিনিধিকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন। আমাদের ডাকলেন তাঁর শোয়ার ঘরে। কবিকে মনে হলো বেশ চঞ্চল ও উত্ফুল্ল। সাক্ষাত্কার দিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার এই সাক্ষাত্কারটি এখানে পত্রস্থ হলো।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : হাসান হাফিজ / আহমদ বাসির
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন