হুমায়ূন আহমেদ গুরুতর অসুস্থ—ন’মাস আগে এ খবর পাওয়ার পর থেকে ১৯শে জুলাই রাত ১১-৩০টার পরে ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগ পর্যন্ত—একবারও আমার মনে হয় নি যে সেরে উঠবেন না তিনি। নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে তাঁর চিকিত্সা চলছে জেনে আরও নিশ্চিত ছিলাম এ ব্যাপারে। কিন্তু সবাইকে শোকস্তব্ধ করে অকালে অকস্মাত্ বিদায় নিলেন তিনি, এই বিমূঢ় স্তব্ধতা সহসা ঘুচবে না কারও।
হুমায়ূন আহমেদকে চিনি ১৯৭০ সাল থেকে। সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ বছর। থাকতাম মুহসিন হলে। সেখানেই দেখেছি তাঁকে। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সখ্য ছিল মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে। আহমদ ছফার সঙ্গে একবার এসেছিলেন আমার ২১১ নম্বর রুমে। তেমন কোনও কথা হয় নি তখন, লেখালেখি নিয়েও না। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কোনও না কোনও অনুরাগী থাকতেন সব সময়, ভেবেছি তাদেরই একজন। স্বাধীনতার পর এক দিন তাঁকে দেখি আহমদ ছফার সঙ্গে। এবার জানা গেল হুমায়ূনের লেখালেখির খবর। ছফা ভাই বললেন, ও দারুণ উপন্যাস লিখেছে একটা। প্রকাশক পাচ্ছি না। শরীফ স্যরের কাছে যাচ্ছি...যদি একটা ভূমিকা লিখে দেন।
পরে উপন্যাস পড়ে আহমদ শরীফ স্যর ভূমিকা লিখে দেন ওই উপন্যাসের। এরপর রাজি হন প্রকাশক। ছাপা হয় ‘নন্দিত নরকে’। প্রকাশের পর-পরই নানাভাবে আলোচিত হয় উপন্যাসটি, পাঠকপ্রিয়ও হয়। ওই সময় লেখক শিবির ও বহুবচন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত আমি। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লেখক শিবির উপন্যাসটিকে পুরস্কৃত করে ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৫ সালে বহুবচন মঞ্চস্থ এর নাট্যরূপ। বহুবচন ১৯৯০ সালে তাঁর ‘দেবী’ নাটকটিও মঞ্চস্থ করে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, কৃষ্ণনগর ও চাকদহ-এও এ নাটকের প্রদর্শনী করেছেন তাঁরা। ‘নন্দিত নরকে’র পর হুমায়ূন লেখেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এ উপন্যাসটিও পাঠকপ্রিয় হয় ‘নন্দিত নরকে’র মতোই।
লেখালেখিতে হুমায়ূনের ছেদ পড়ে যখন তিনি পিএইচডি গবেষণার জন্য যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভারসিটিতে। সেখানে দু’ বছর তিনি পড়াশোনা করেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি নিয়ে, পরে পিএইচডি করেন পলিমার কেমিস্ট্রিতে। ফাঁকে-ফাঁকে অবশ্য কিছু লেখালেখি করেছেন তিনি। মনে আছে, প্রবাস-জীবনের টুকরো-টুকরো নানা কিছু লিখে পাঠাতেন ‘বিচিত্রা’য়, সেগুলো একসঙ্গে ছাপতাম ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে’ শিরোনামের একটি বিভাগে।
দেশে ফিরে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা বলয় ঘিরে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস। ওই বলয়ে প্রধান ছিলেন সালেহ চৌধুরী, আলমগীর রহমান ও হাসান হাফিজ। আলমগীর তাঁর বই প্রকাশনায় (অবসর প্রকাশনীর মাধ্যমে), সালেহ চৌধুরী ও হাসান হাফিজ তাঁকে নিয়ে লেখালেখিতে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা (বিশেষ করে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা’য়)। কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনীর জন্যও লিখেছেন হুমায়ূন। তবে উইলিয়াম পিটার ব্লেটি’র ‘দি এক্সরসিস্ট’ (১৯৭১) অনুবাদ নিয়ে মতান্তর ঘটার পর আর লেখেন নি সেখানে। ওই অনুবাদ সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিস্তর খাটতে হয় আমাকে। দেখে কাজী আনোয়ার হোসেন খুশি হন, অন্যান্য বই সম্পাদনা করে যত সম্মানী পেয়েছি, তার দ্বিগুণ বরাদ্দ করেন সেবার। কিন্তু সেই সম্পাদিত পাণ্ডুলিপি দেখে হুমায়ূন ক্ষুব্ধ হন খুব। এত কাটাকুটি? রাগ আর সামলাতে পারেন না তিনি। তখন তাঁকে শান্ত করতে কোথায় কেন কি পরিবর্তন-পরিমার্জন-পুনর্লিখন করতে হয়েছে তা বোঝাবার চেষ্টা করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জানিয়ে দেন, সম্পাদিত রূপটিই শুধু ছাপতে রাজি আছেন তিনি। কিন্তু মানতে পারেন না হুমায়ূন, রাগে দুঃখে ক্ষেপে গিয়ে চলে যান পাণ্ডুলিপি নিয়ে। পরে অবশ্য ফিরে আসেন, বলেন, খুব রেগে গিয়েছিলাম। মাথা ঠিক ছিল না। আপনি সংশোধিত রূপটিই ছাপুন।
পরে সেই সম্পাদিত রূপেই ছাপা হয় ‘এক্সরসিস্ট’। পরে এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখি নি তাঁর। দেখা হলে কখনও বুঝতে দেন নি সেই রেগে যাওয়ার বিষয়টি। তাঁর এই মেনে নেয়ার ক্ষমতার উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। গত ১৯শে জুলাই ছিল তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। সেদিন সকালে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করি আমরা। রাতে হুমায়ূনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে আবারও ফোনে কথা বলি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তখন কথায়-কথায় ওঠে ‘এক্সরসিস্ট’-এর অনুবাদ ও সম্পাদনার সেই প্রসঙ্গ। বললেন, হুমায়ূন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। ওই বইয়ের ঘটনা তো বটেই, অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যবহারে বুঝেছি তা।
দুঃখ করে বললেন, আমার জন্মদিনের তারিখটা তাঁর মৃত্যুদিনের তারিখ হয়ে গেল!
মনে পড়ে, ওই ঘটনার কয়েক বছর পর হুমায়ূন আমাকে উপহার দেন তাঁর ‘সৌরভ’ নামের উপন্যাসটি, লেখেন ‘সাযযাদ কাদির প্রিয়বরেষু...’। সেদিন ছিল ২০শে জুলাই, ১৯৮৫। কাকতালীয়, কিন্তু কি বিচিত্র!
আসলেই অত্যন্ত সহৃদয় মানুষ ছিলেন হুমায়ূন, মনটা ছিল বড়। এক সময় তাঁর কড়া সমালোচনা করতেন হুমায়ুন আজাদ। তাঁর উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’, টিভি নাটককে বলতেন ‘ওয়ান-টাইমার’। কিন্তু এ নিয়ে কখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান নি হুমায়ূন আহমেদ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দু’জনের অন্তরঙ্গতাই লক্ষ্য করেছি বেশি।
একবার ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগে। সেখান থেকে তিনি নিয়ে যান তাঁর বাসায়। টিভি নাটক নিয়ে কথা হয় অনেকক্ষণ। বলি, তাঁর নাটকে ব্ল্যাক হিউমারের লক্ষণ আছে। এ কথায় উত্সুক হন তিনি। পরে ‘বহুব্রীহি’র পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলেন, ঈদ সংখ্যায় ছাপুন। কোনও সম্মানী দিতে হবে না।
তখন আমি ‘তারকালোকে’র সম্পাদক।
ওই সময় হুমায়ূনের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছিলাম এখানে সেখানে। বইমেলায় তাঁর ভক্ত, টিভির শিল্পী, এমনকি তাঁর ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত ভুল করে বসতো মাঝেমধ্যে। সেদিন এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি করি আমরা। হুমায়ূন স্ত্রীকে ডেকে বলেন, আছে কোনও মিল সাযযাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার? তিনি একবার তাকিয়েই বলেন, না।
পরে দু’জনে হাঁটতে-হাঁটতে আসি এলিফ্যান্ট রোডে। পথে জিজ্ঞেস করেন, আপনার লেখা দেখি না। আর গল্প লেখেন না? আপনাদের লেখা পড়ে-পড়ে আমরা লিখতে শুরু করলাম...
আমার অনূদিত ‘লাভ স্টোরি’ সম্পর্কে বললেন, ওটা পড়ার পর থেকে বেস্টসেলার লিখতে চাইছি। তবে হাতের লেখা নিয়ে সমস্যা। বানান, দাড়ি কমা ড্যাশ...! বাক্য অসমাপ্ত থাকে। আমার দরকার ভাল একজন কমপোজার (ওয়ার্ড প্রসেসর), আর ভাল একজন প্রুফ রিডার।
পরে শুনেছি অমন দু’একজন পেয়েছেন তিনি।
তখন ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’ ও ‘অয়োময়’ টিভি সিরিজ। ওই প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেন প্রযোজক নওয়াজিশ আলি খান ও মুস্তাফিজুর রহমান এবং শিল্পী-কলাকুশলীদের কৃতিত্ব ও অবদানের কথা। বলেন, ওদের ইমপ্রোভাইজেশন দারুণ। একটা সাজেশন থেকে দারুণ কিছু করে ফেলতে পারেন তাঁরা।
তবে হুমায়ূনের ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘নক্ষত্রের রাত’ সিরিয়াল দু’টি বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে আগের সিরিয়াল তিনটির চেয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য অত সাফল্য আসে নি তাঁর। পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের অনুরোধে, ইসকাটনের মহিলা সমিতিতে গিয়ে, তাঁর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবির ছোট্ট একটি দৃশ্যে অভিনয়ের মতো কিছু একটা করতে হয়েছিল আমার। পরে সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছবিটি যখন দেখি, তখন খেয়াল করি সে দৃশ্যটি নেই ছবিতে।
বলেছিলাম, হাঁটতে-হাঁটতে এলিফ্যান্ট রোডে আসার কথা। সেদিন হুমায়ূন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জিগজ্যাগ ভিডিওতে। গিয়ে বলেন, আমাকে কিছু ইংরেজি সিচুয়েশন কমেডি (সিটকম) বেছে দিন তো!
জানালেন সারা রাত ছবি দেখেন তিনি। দেখে-দেখে আইডিয়া পান নানা রকম। হুমায়ূন সেদিন নিয়ে যান ১৮টি ক্যাসেট। দোকানের মালিক জানান, কিছু দিন পর-পর এসে তিনি ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে যান ২০-২২টি করে।
টিভি’র মাধ্যমে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর বইমেলায় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পান হুমায়ূন। এ উদাহরণ কাজে লাগাতে চেয়েছেন অনেকে। এটা হচ্ছে অগস্ট-সেপটেম্বর থেকে টিভিতে একটা সিরিজ শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত চালিয়ে গিয়ে ফেবরুয়ারির বইমেলায় ভিড় সৃষ্টি করার ফরমুলা। এ ফন্দি বা ধান্দা করে অবশ্য কিছুটা সাফল্য পেয়েছেন কেউ-কেউ। অন্যেরা পান নি সেই স্বর্গের সিঁড়ি।
হুমায়ূনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ইসকাটনের এক ডুপ্লেক্স কমপ্লেক্সের চত্বরে, এক শুক্রবার দুপুরে। আমি গিয়েছিলাম সেখানকার বাসিন্দা জামিল আখতার বীনু আপার কাছে। হঠাত্ ঝড়ো বেগে ঝকঝকে নতুন একটি গাড়ি ঢুকে দু’জন নারীকে নামিয়ে দিয়েই আবার বেরিয়ে যায় সাঁত্ করে। ওই দু’জনকে মা ও মেয়ে মনে হয় আমার। আসা ও যাওয়ার দু’বারই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয় গাড়ির অপর আরোহী হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বোধহয় চিনতে পারেন না আমাকে, অথবা চিনলেও হয়তো বুঝে উঠতে পারেন নি—ওই সময় আমি কেন ওখানে থাকবো!
কিছু দিন পর হুমায়ূনের সঙ্গে গুলতেকিনের বিচ্ছেদ এবং শাওনকে বিয়ের খবর আসে পত্রিকায়। তখন বুঝতে পারি, ওই দুই নারীর একজন ছিলেন কিশোরী শাওন।
হুমায়ূনের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে অনেক বিতর্ক। এর আগে, টিভিতে ‘অয়োময়’ সিরিজ চলাকালে, এক বন্ধুর কিশোরী কন্যার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। এসব ঘটনায় আমার মনে পড়েছিল বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার চারলি চ্যাপলিন-এর কথা। ৫৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নিল-এর অষ্টাদশী কন্যা উনা-কে। ভদ্মাদিমির নবোকভ-এর ‘লোলিটা’ উপন্যাসটির কথাও মনে পড়েছে। ওই উপন্যাসের প্রৌঢ় প্রফেসর হামবার্ট হামবার্ট আকৃষ্ট হন ১২ বছরের এক বালিকার প্রতি।
হুমায়ূনের এ ব্যাপারটি নিয়ে চর্চা শেষ হয় নি এখনও। তাঁর মৃত্যুর পরও তা প্রকাশ পেয়েছে দুঃখজনক রূপে। এ নিয়ে অন্তত একটি সাড়াজাগানো উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে জানি। ‘তালাক’ নামের সে উপন্যাসটি লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক মিলান ফারাবী।
প্রশ্ন জাগে, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে কি সাজিয়ে নিতে পারে না কেউ?
অবশ্য ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনের ঘটনা-রটনা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কাটতিতে প্রভাব ফেলে নি কোনও। যারা কট্টর সমালোচক, ঘোরতর নিন্দুক তাদেরও দেখেছি বইমেলায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বই কিনতে। এটা নিঃসন্দেহে এক জাদু-ক্ষমতা।
নব্বই দশকের শেষ দিকে হুমায়ূনের সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্পর্কে আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল পাক্ষিক ‘শৈলী’র পক্ষ থেকে। তাঁর তিনটি বড় সাফল্য নিয়ে তখন আলোচনা করেছিলাম সে লেখায়। প্রথমত, বাংলা বেস্টসেলারে কলকাতার প্রাধান্যকে ছাড়িয়ে তিনি ঢাকার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম। এর আগে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন থেকে আকবর হোসেন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন একমাত্র কাজী আনোয়ার হোসেন। তবে হুমায়ূন অবদান রেখেছেন সামগ্রিক পরিসরে। দ্বিতীয়ত, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানকে স্থায়ী আসন দিয়েছেন তিনি। এর আগের ১৫০ বছরের উপন্যাস পড়ে তেমন করে বোঝা যায় না যে বাঙালিদের ৬০ ভাগ মুসলমান। তৃতীয়ত, উপন্যাসের কাটতি বাড়াতে তিনি সেক্স বা ভায়োলেন্সের আশ্রয় নেন নি কখনও।
এর পর কেটেছে প্রায় দুই দশক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বেস্টসেলার লেখক বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁকে ছাড়িয়ে যান শরত্চন্দ্র। সেকালের জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারের কথা মনে রেখেও বলা যায়, কাটতিতে হুমায়ূন ছাড়িয়ে গিয়েছেন তাঁকেও। হয়তো বাংলা সাহিত্যে সর্বকালের সেরা বেস্টসেলার লেখক তিনিই। অবশ্য গুণ, মান ও শৈলীর বিচার আসছে না এখানে। সে বিচারের জন্য কিছু দিন দেরি করতে হবে আমাদের।
হুমায়ূন সাফল্য দেখিয়েছেন আরও নানা ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ‘দেশ’-এর পূজা সংখ্যায় তিনি করে নিয়েছেন স্থায়ী আসন। বাংলাদেশের কোনও লেখকের জন্য এ এক বিরল প্রতিষ্ঠা। এতে এই আশা জেগেছিল আমাদের, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের বাজারেও হয়তো বেস্টসেলার হবে তাঁর বই। সে হওয়াটা অসম্ভব কিছু ছিল না, কিন্তু তার আগেই আমরা হারালাম তাঁকে। ফলে এই বিশাল সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত হয়ে রইলো আমাদের কাছে। কারণ তাঁর শূন্য স্থান আর পূরণ হবে না সহজে।
হুমায়ূন আহমেদকে চিনি ১৯৭০ সাল থেকে। সেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শেষ বছর। থাকতাম মুহসিন হলে। সেখানেই দেখেছি তাঁকে। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সখ্য ছিল মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে। আহমদ ছফার সঙ্গে একবার এসেছিলেন আমার ২১১ নম্বর রুমে। তেমন কোনও কথা হয় নি তখন, লেখালেখি নিয়েও না। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কোনও না কোনও অনুরাগী থাকতেন সব সময়, ভেবেছি তাদেরই একজন। স্বাধীনতার পর এক দিন তাঁকে দেখি আহমদ ছফার সঙ্গে। এবার জানা গেল হুমায়ূনের লেখালেখির খবর। ছফা ভাই বললেন, ও দারুণ উপন্যাস লিখেছে একটা। প্রকাশক পাচ্ছি না। শরীফ স্যরের কাছে যাচ্ছি...যদি একটা ভূমিকা লিখে দেন।
পরে উপন্যাস পড়ে আহমদ শরীফ স্যর ভূমিকা লিখে দেন ওই উপন্যাসের। এরপর রাজি হন প্রকাশক। ছাপা হয় ‘নন্দিত নরকে’। প্রকাশের পর-পরই নানাভাবে আলোচিত হয় উপন্যাসটি, পাঠকপ্রিয়ও হয়। ওই সময় লেখক শিবির ও বহুবচন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত আমি। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। লেখক শিবির উপন্যাসটিকে পুরস্কৃত করে ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৫ সালে বহুবচন মঞ্চস্থ এর নাট্যরূপ। বহুবচন ১৯৯০ সালে তাঁর ‘দেবী’ নাটকটিও মঞ্চস্থ করে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, কৃষ্ণনগর ও চাকদহ-এও এ নাটকের প্রদর্শনী করেছেন তাঁরা। ‘নন্দিত নরকে’র পর হুমায়ূন লেখেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এ উপন্যাসটিও পাঠকপ্রিয় হয় ‘নন্দিত নরকে’র মতোই।
লেখালেখিতে হুমায়ূনের ছেদ পড়ে যখন তিনি পিএইচডি গবেষণার জন্য যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভারসিটিতে। সেখানে দু’ বছর তিনি পড়াশোনা করেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি নিয়ে, পরে পিএইচডি করেন পলিমার কেমিস্ট্রিতে। ফাঁকে-ফাঁকে অবশ্য কিছু লেখালেখি করেছেন তিনি। মনে আছে, প্রবাস-জীবনের টুকরো-টুকরো নানা কিছু লিখে পাঠাতেন ‘বিচিত্রা’য়, সেগুলো একসঙ্গে ছাপতাম ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে’ শিরোনামের একটি বিভাগে।
দেশে ফিরে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা বলয় ঘিরে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে হুমায়ূনের গল্প-উপন্যাস। ওই বলয়ে প্রধান ছিলেন সালেহ চৌধুরী, আলমগীর রহমান ও হাসান হাফিজ। আলমগীর তাঁর বই প্রকাশনায় (অবসর প্রকাশনীর মাধ্যমে), সালেহ চৌধুরী ও হাসান হাফিজ তাঁকে নিয়ে লেখালেখিতে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা (বিশেষ করে দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা’য়)। কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনীর জন্যও লিখেছেন হুমায়ূন। তবে উইলিয়াম পিটার ব্লেটি’র ‘দি এক্সরসিস্ট’ (১৯৭১) অনুবাদ নিয়ে মতান্তর ঘটার পর আর লেখেন নি সেখানে। ওই অনুবাদ সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিস্তর খাটতে হয় আমাকে। দেখে কাজী আনোয়ার হোসেন খুশি হন, অন্যান্য বই সম্পাদনা করে যত সম্মানী পেয়েছি, তার দ্বিগুণ বরাদ্দ করেন সেবার। কিন্তু সেই সম্পাদিত পাণ্ডুলিপি দেখে হুমায়ূন ক্ষুব্ধ হন খুব। এত কাটাকুটি? রাগ আর সামলাতে পারেন না তিনি। তখন তাঁকে শান্ত করতে কোথায় কেন কি পরিবর্তন-পরিমার্জন-পুনর্লিখন করতে হয়েছে তা বোঝাবার চেষ্টা করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। জানিয়ে দেন, সম্পাদিত রূপটিই শুধু ছাপতে রাজি আছেন তিনি। কিন্তু মানতে পারেন না হুমায়ূন, রাগে দুঃখে ক্ষেপে গিয়ে চলে যান পাণ্ডুলিপি নিয়ে। পরে অবশ্য ফিরে আসেন, বলেন, খুব রেগে গিয়েছিলাম। মাথা ঠিক ছিল না। আপনি সংশোধিত রূপটিই ছাপুন।
পরে সেই সম্পাদিত রূপেই ছাপা হয় ‘এক্সরসিস্ট’। পরে এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখি নি তাঁর। দেখা হলে কখনও বুঝতে দেন নি সেই রেগে যাওয়ার বিষয়টি। তাঁর এই মেনে নেয়ার ক্ষমতার উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। গত ১৯শে জুলাই ছিল তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। সেদিন সকালে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করি আমরা। রাতে হুমায়ূনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে আবারও ফোনে কথা বলি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তখন কথায়-কথায় ওঠে ‘এক্সরসিস্ট’-এর অনুবাদ ও সম্পাদনার সেই প্রসঙ্গ। বললেন, হুমায়ূন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। ওই বইয়ের ঘটনা তো বটেই, অন্যান্য বইয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যবহারে বুঝেছি তা।
দুঃখ করে বললেন, আমার জন্মদিনের তারিখটা তাঁর মৃত্যুদিনের তারিখ হয়ে গেল!
মনে পড়ে, ওই ঘটনার কয়েক বছর পর হুমায়ূন আমাকে উপহার দেন তাঁর ‘সৌরভ’ নামের উপন্যাসটি, লেখেন ‘সাযযাদ কাদির প্রিয়বরেষু...’। সেদিন ছিল ২০শে জুলাই, ১৯৮৫। কাকতালীয়, কিন্তু কি বিচিত্র!
আসলেই অত্যন্ত সহৃদয় মানুষ ছিলেন হুমায়ূন, মনটা ছিল বড়। এক সময় তাঁর কড়া সমালোচনা করতেন হুমায়ুন আজাদ। তাঁর উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’, টিভি নাটককে বলতেন ‘ওয়ান-টাইমার’। কিন্তু এ নিয়ে কখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান নি হুমায়ূন আহমেদ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দু’জনের অন্তরঙ্গতাই লক্ষ্য করেছি বেশি।
একবার ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগে। সেখান থেকে তিনি নিয়ে যান তাঁর বাসায়। টিভি নাটক নিয়ে কথা হয় অনেকক্ষণ। বলি, তাঁর নাটকে ব্ল্যাক হিউমারের লক্ষণ আছে। এ কথায় উত্সুক হন তিনি। পরে ‘বহুব্রীহি’র পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলেন, ঈদ সংখ্যায় ছাপুন। কোনও সম্মানী দিতে হবে না।
তখন আমি ‘তারকালোকে’র সম্পাদক।
ওই সময় হুমায়ূনের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছিলাম এখানে সেখানে। বইমেলায় তাঁর ভক্ত, টিভির শিল্পী, এমনকি তাঁর ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত ভুল করে বসতো মাঝেমধ্যে। সেদিন এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি করি আমরা। হুমায়ূন স্ত্রীকে ডেকে বলেন, আছে কোনও মিল সাযযাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার? তিনি একবার তাকিয়েই বলেন, না।
পরে দু’জনে হাঁটতে-হাঁটতে আসি এলিফ্যান্ট রোডে। পথে জিজ্ঞেস করেন, আপনার লেখা দেখি না। আর গল্প লেখেন না? আপনাদের লেখা পড়ে-পড়ে আমরা লিখতে শুরু করলাম...
আমার অনূদিত ‘লাভ স্টোরি’ সম্পর্কে বললেন, ওটা পড়ার পর থেকে বেস্টসেলার লিখতে চাইছি। তবে হাতের লেখা নিয়ে সমস্যা। বানান, দাড়ি কমা ড্যাশ...! বাক্য অসমাপ্ত থাকে। আমার দরকার ভাল একজন কমপোজার (ওয়ার্ড প্রসেসর), আর ভাল একজন প্রুফ রিডার।
পরে শুনেছি অমন দু’একজন পেয়েছেন তিনি।
তখন ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে তাঁর ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’ ও ‘অয়োময়’ টিভি সিরিজ। ওই প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেন প্রযোজক নওয়াজিশ আলি খান ও মুস্তাফিজুর রহমান এবং শিল্পী-কলাকুশলীদের কৃতিত্ব ও অবদানের কথা। বলেন, ওদের ইমপ্রোভাইজেশন দারুণ। একটা সাজেশন থেকে দারুণ কিছু করে ফেলতে পারেন তাঁরা।
তবে হুমায়ূনের ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘নক্ষত্রের রাত’ সিরিয়াল দু’টি বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে আগের সিরিয়াল তিনটির চেয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য অত সাফল্য আসে নি তাঁর। পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমানের অনুরোধে, ইসকাটনের মহিলা সমিতিতে গিয়ে, তাঁর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবির ছোট্ট একটি দৃশ্যে অভিনয়ের মতো কিছু একটা করতে হয়েছিল আমার। পরে সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছবিটি যখন দেখি, তখন খেয়াল করি সে দৃশ্যটি নেই ছবিতে।
বলেছিলাম, হাঁটতে-হাঁটতে এলিফ্যান্ট রোডে আসার কথা। সেদিন হুমায়ূন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জিগজ্যাগ ভিডিওতে। গিয়ে বলেন, আমাকে কিছু ইংরেজি সিচুয়েশন কমেডি (সিটকম) বেছে দিন তো!
জানালেন সারা রাত ছবি দেখেন তিনি। দেখে-দেখে আইডিয়া পান নানা রকম। হুমায়ূন সেদিন নিয়ে যান ১৮টি ক্যাসেট। দোকানের মালিক জানান, কিছু দিন পর-পর এসে তিনি ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে যান ২০-২২টি করে।
টিভি’র মাধ্যমে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর বইমেলায় বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পান হুমায়ূন। এ উদাহরণ কাজে লাগাতে চেয়েছেন অনেকে। এটা হচ্ছে অগস্ট-সেপটেম্বর থেকে টিভিতে একটা সিরিজ শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত চালিয়ে গিয়ে ফেবরুয়ারির বইমেলায় ভিড় সৃষ্টি করার ফরমুলা। এ ফন্দি বা ধান্দা করে অবশ্য কিছুটা সাফল্য পেয়েছেন কেউ-কেউ। অন্যেরা পান নি সেই স্বর্গের সিঁড়ি।
হুমায়ূনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ইসকাটনের এক ডুপ্লেক্স কমপ্লেক্সের চত্বরে, এক শুক্রবার দুপুরে। আমি গিয়েছিলাম সেখানকার বাসিন্দা জামিল আখতার বীনু আপার কাছে। হঠাত্ ঝড়ো বেগে ঝকঝকে নতুন একটি গাড়ি ঢুকে দু’জন নারীকে নামিয়ে দিয়েই আবার বেরিয়ে যায় সাঁত্ করে। ওই দু’জনকে মা ও মেয়ে মনে হয় আমার। আসা ও যাওয়ার দু’বারই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয় গাড়ির অপর আরোহী হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বোধহয় চিনতে পারেন না আমাকে, অথবা চিনলেও হয়তো বুঝে উঠতে পারেন নি—ওই সময় আমি কেন ওখানে থাকবো!
কিছু দিন পর হুমায়ূনের সঙ্গে গুলতেকিনের বিচ্ছেদ এবং শাওনকে বিয়ের খবর আসে পত্রিকায়। তখন বুঝতে পারি, ওই দুই নারীর একজন ছিলেন কিশোরী শাওন।
হুমায়ূনের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে অনেক বিতর্ক। এর আগে, টিভিতে ‘অয়োময়’ সিরিজ চলাকালে, এক বন্ধুর কিশোরী কন্যার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। এসব ঘটনায় আমার মনে পড়েছিল বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার চারলি চ্যাপলিন-এর কথা। ৫৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নিল-এর অষ্টাদশী কন্যা উনা-কে। ভদ্মাদিমির নবোকভ-এর ‘লোলিটা’ উপন্যাসটির কথাও মনে পড়েছে। ওই উপন্যাসের প্রৌঢ় প্রফেসর হামবার্ট হামবার্ট আকৃষ্ট হন ১২ বছরের এক বালিকার প্রতি।
হুমায়ূনের এ ব্যাপারটি নিয়ে চর্চা শেষ হয় নি এখনও। তাঁর মৃত্যুর পরও তা প্রকাশ পেয়েছে দুঃখজনক রূপে। এ নিয়ে অন্তত একটি সাড়াজাগানো উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে জানি। ‘তালাক’ নামের সে উপন্যাসটি লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক মিলান ফারাবী।
প্রশ্ন জাগে, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে কি সাজিয়ে নিতে পারে না কেউ?
অবশ্য ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনের ঘটনা-রটনা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের কাটতিতে প্রভাব ফেলে নি কোনও। যারা কট্টর সমালোচক, ঘোরতর নিন্দুক তাদেরও দেখেছি বইমেলায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর বই কিনতে। এটা নিঃসন্দেহে এক জাদু-ক্ষমতা।
নব্বই দশকের শেষ দিকে হুমায়ূনের সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্পর্কে আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল পাক্ষিক ‘শৈলী’র পক্ষ থেকে। তাঁর তিনটি বড় সাফল্য নিয়ে তখন আলোচনা করেছিলাম সে লেখায়। প্রথমত, বাংলা বেস্টসেলারে কলকাতার প্রাধান্যকে ছাড়িয়ে তিনি ঢাকার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম। এর আগে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন থেকে আকবর হোসেন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন একমাত্র কাজী আনোয়ার হোসেন। তবে হুমায়ূন অবদান রেখেছেন সামগ্রিক পরিসরে। দ্বিতীয়ত, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানকে স্থায়ী আসন দিয়েছেন তিনি। এর আগের ১৫০ বছরের উপন্যাস পড়ে তেমন করে বোঝা যায় না যে বাঙালিদের ৬০ ভাগ মুসলমান। তৃতীয়ত, উপন্যাসের কাটতি বাড়াতে তিনি সেক্স বা ভায়োলেন্সের আশ্রয় নেন নি কখনও।
এর পর কেটেছে প্রায় দুই দশক। বাংলা সাহিত্যের প্রথম বেস্টসেলার লেখক বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁকে ছাড়িয়ে যান শরত্চন্দ্র। সেকালের জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারের কথা মনে রেখেও বলা যায়, কাটতিতে হুমায়ূন ছাড়িয়ে গিয়েছেন তাঁকেও। হয়তো বাংলা সাহিত্যে সর্বকালের সেরা বেস্টসেলার লেখক তিনিই। অবশ্য গুণ, মান ও শৈলীর বিচার আসছে না এখানে। সে বিচারের জন্য কিছু দিন দেরি করতে হবে আমাদের।
হুমায়ূন সাফল্য দেখিয়েছেন আরও নানা ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ‘দেশ’-এর পূজা সংখ্যায় তিনি করে নিয়েছেন স্থায়ী আসন। বাংলাদেশের কোনও লেখকের জন্য এ এক বিরল প্রতিষ্ঠা। এতে এই আশা জেগেছিল আমাদের, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের বাজারেও হয়তো বেস্টসেলার হবে তাঁর বই। সে হওয়াটা অসম্ভব কিছু ছিল না, কিন্তু তার আগেই আমরা হারালাম তাঁকে। ফলে এই বিশাল সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত হয়ে রইলো আমাদের কাছে। কারণ তাঁর শূন্য স্থান আর পূরণ হবে না সহজে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন