জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ইন্তেকালে আমি গভীরভাবে শোকাহত। সমগ্র জাতির শোকের সঙ্গে আমার শোক ও অশ্রু মিশে একাকার হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ দক্ষ রূপকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন গভীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। দুর্ভাগ্য আমার, দীর্ঘদিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় এবং আমার দৃষ্টিশক্তি ও চলত্শক্তি প্রায় রহিত হওয়ায় আমি আমার পরম প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের তাঁর শেষ বিদায়ের সময় শোকযাত্রা ও জানাজায় শামিল হতে পারিনি। বাধ্য হয়েই আমাকে গৃহবন্দি অবস্থায় রোগশয্যায় বসে টেলিভিশনের মাধ্যমে তাঁর শেষ যাত্রার দৃশ্যাদি দেখতে এবং শোকাশ্রু বিসর্জন করতে হয়েছে। এদিক থেকে আমি একজন হতভাগ্য ব্যক্তি।
এই শোকবিধুর পরিবেশেও আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ পাঠ করে আমার অভিভূত হওয়ার এবং গ্রন্থটিকে ‘হৃদয় দিয়ে লেখা’ বলে অভিহিত করার কথা। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রতিভার স্পর্শে এবং সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বহু গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনোহরণ করেছেন এবং হৃদয় জয় করেছেন। তিনি হয়েছেন সাহিত্য-শিল্পের একজন অসাধারণ স্রষ্টা; জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর এই জনপ্রিয়তা এবং অভাবনীয় সাফল্যের বিষয়ে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই বোদ্ধা সাহিত্য পাঠক, চলচ্চিত্র দর্শক অনেক কথা বলেছেন। তারা বিভিন্নভাবে হুমায়ূন আহমেদের মূল্যায়ন করেছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও মূল্যায়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে হুমায়ূনের সার্বিক মূল্যায়ন বর্তমানে সম্ভব নয়।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নন্দিত নরকে’র বিষয়ে আমার মূল্যায়নের কথা। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত গ্রন্থটির আলোচনায় আমি শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘নন্দিত নরকে হৃদয় দিয়ে লেখা’। আজ মনে হচ্ছে শুধু নন্দিত নরকেই নয়, তিনি তাঁর সব উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক হৃদয় দিয়েই লিখেছেন। এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর হৃদয়। লেখা যত কঠিন, হৃদয় দিয়ে লেখা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। তিনি হৃদয় দিয়ে লিখেছেন বলেই পাঠক-দর্শক এবং শ্রোতার হৃদয় হরণ করতে পেরেছেন। কথায় বলে, ‘কলম, কাগজ, মন লেখে তিনজন’ কিন্তু শুধু মন দিয়ে লিখলেই হয় না, হৃদয় দিয়েও লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ এ ব্যাপারে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ‘নন্দিত নরকে’ গ্রন্থটির আলোচনায় আমি যা লিখেছিলাম তার কিছু এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘উপন্যাসের আরেকটি আকর্ষণীয় গুণ এখানে যে মনোবিশ্লেষণের নামে, কিংবা আত্ম-অন্তর্মুখীনতার অজুহাতে বর্ণনায় অতিরেক ঘটিয়ে কাহিনীকে বোরিং করে তোলা হয়নি। সহজ, সাবলীল অথচ প্রাণময় ভাষায় তিনি যথার্থ দ্রষ্টা এবং স্রষ্টার মতো নির্লিপ্ত চেতনায় কাহিনী বিন্যাস করে গেছেন। তাঁর রচনায় এবং কাহিনী বিন্যাসে এমন একটি অন্তর্গত আকর্ষণ আছে, যা মনকে কখনও ক্লান্ত করে না, বরং একাধিক পাঠেও অপরিসীম আনন্দ দেয়। এই হৃদয়বান দক্ষ কথাশিল্পীকে আমরা স্বাগত জানাই।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছি এবং কেবলই মনে পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের রচনার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা। তিনি শুধু একজন সৃষ্টিধর্মী লেখকই নন, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে ও নাটকে জনমনের এবং সমগ্র জাতির হৃদয় স্পর্শ করতে হলে কী ধরনের জিনিস রচনায় দেয়া দরকার, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রূপায়ণ ঘটানো অপরিহার্য, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন এবং জাগ্রত সত্তা। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, সাধারণভাবে মানুষ এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশের মানুষ স্বদেশপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী ও সঙ্গীতপ্রেমী এবং পারলৌকিক জীবন ও সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে অভ্যস্ত। তারা যেমন বর্তমান জীবন সম্পর্কে ভাবেন, তেমনি পরকালের জীবন তথা পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে ভাবতেও অভ্যস্ত। এর পরিচয় প্রায়ই আমরা পাই লোকসাহিত্যে, লোকসঙ্গীতে এবং বিশেষ করে মরমী গানে। হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা লক্ষ্য করেছেন, এই অসাধারণ কথাশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার যেমন তাঁর উপন্যাসে নাটকের কাহিনী ও চরিত্রসৃজনের মাধ্যমে পাঠকের মনোহরণ করেছেন, তেমনি তিনি লোকসঙ্গীত, মরমী গান সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছেন অনন্যসাধারণ দক্ষতায়। তাঁর মৃত্যুর পর বিভিন্ন টেলিভিশন মাধ্যমে প্রচারিত নাটক এবং চলচ্চিত্র, যেগুলো আমি রোগশয্যায় বসে দেখেছি, সেগুলোর জীবনবাস্তবতা এবং সৃষ্টিধর্মিতা যেমন আমাকে কাঁদিয়েছে, তেমনি কাঁদিয়েছে সিনেমায়, নাটকে ব্যবহৃত লোকসঙ্গীত বিশেষ করে মরমী সঙ্গীত। আরেকটি কথা অনেকেই বলেছেন, কিন্তু আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অসাধারণ দক্ষতায় এবং সৃষ্টিধর্মী প্রেরণায় মিডিয়াকে বিশেষ করে টেলিভিশনকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটক ও টেলিফিল্ম প্রচারে প্রায় বাধ্য করে অসাধারণ সাফল্যের পরিচিতি দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিধর্মিতা যেমন তাঁকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে, তেমনি তাঁর বিশাল জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ব্যবহারের ক্ষমতা। শুধু শিক্ষিত লোকেরাই নয়, শিক্ষাবঞ্চিত লোকেরাও যে তাঁর সৃষ্টিকর্মে মুগ্ধ হয়েছেন, তার একটা বড় কারণ ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অর্থাত্ টেলিভিশন ও সিনেমার মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী।
শিক্ষার অভাবে অর্থাত্ পড়তে না জানার কারণে যারা তাঁর গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটক পড়তে পারেননি, তারা টেলিভিশনে এবং চলচ্চিত্রে কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং বাস্তবজীবনের রূপায়ণ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ শুধু তাঁর লেখায় দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পাঠকের হৃদয় হরণ করেননি, তিনি তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্ম দিয়ে পাঠকহৃদয় হরণ করেছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক তথ্যে জানলাম, তার গ্রন্থসংখ্যা ৩২২টি, বলাবাহুল্য এর বেশিরভাগই উপন্যাস ও নাটক। এই সংখ্যা থেকে তাঁর সৃষ্টিধর্মিতা এবং লেখার সাবলীল ক্ষমতা ও প্রাণশক্তি সহজেই অনুমেয়। তিনি যে লেখাকে সমগ্র হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছিলেন এবং সেই ধারণক্ষমতাকে রচনার মাধ্যমে উত্সারিত করেছেন, তার পরিচয় এই সংখ্যতত্ত্বেও পাওয়া যায়। ৩২২টি গ্রন্থ রচনা এক অসাধারণ সৃজনক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে।
অনেকে বলেন, যারা বেশি লেখেন, তারা খারাপ লেখেন। এ কথা হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি বেশি লিখলেও একটি মান বজায় রেখেছেন। বেশি লেখা, কম লেখা সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি-প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, অনেকের ধারণা, যারা বেশি লেখেন তারা খারাপ লেখেন, কিন্তু আমি বলতে চাই, আমরা যে প্রতিভা নিয়ে জন্মাই তাতে বেশি লিখি বলেই আমরা সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করি। তিনি প্রশ্ন করেছেন—রবীন্দ্রনাথ কি বেশি লেখেননি? তার রচনাবলি তো ২৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর এই বক্তব্য স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত। বাংলাসাহিত্যে বহু প্রতিভাবান লেখক আছেন, যারা বেশি লিখেছেন এবং সৃষ্টিক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সবাই কি হুমায়ূন আহমেদের মতো তিন শতাধিক বই লিখেছেন? এই প্রশ্নের জবাব সাহিত্য সমালোচকরাই দিতে পারেন।
এসব কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদের পরবর্তী একটি ঘটনা। সেদিন রাতে দিগন্ত টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছিল মিউজিক আওয়ার নামে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান। তাতে লালনসঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। সেই সময় এলো হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ। অনুষ্ঠানটি থামিয়ে দিয়ে এর উপস্থাপক মৃত্যুসংবাদটি প্রচার করলেন। কিন্তু তিনি আবেগে এবং শোকে কথা ভালোভাবে সাজিয়ে বলতে পারছিলেন না। তিনি ফরিদা পারভীনকে একটি সঙ্গীত পরিবেশনের অনুরোধ জানালেন। ফরিদা পারভীন লালনসঙ্গীতের একজন প্রখ্যাত গায়িকা। তিনি শোকাহত কণ্ঠে পরিবেশন করলেন জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত একটি লালনসঙ্গীত। শ্রোতাদের তরফ থেকে অনুরোধ এলো একটি বিশেষ লালনসঙ্গীত পরিবেশনের জন্য। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ফরিদা গাইলেন লালনের সেই বিখ্যাত গান—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ‘কমনে আসে-যায়/ ধরতে পারলে মনও বেড়ি দিতাম পাখির পায়। গানটি শুনে আমিও শোকাহত হয়ে গেলাম। আমার দুই চোখ হয়ে উঠল অশ্রুসিক্ত। বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর ভাবনাই তো আমার নিত্যদিনের ভাবনা। কোন দিন আমার জীবনখাঁচার পাখি উড়াল দিয়ে চলে যাবে, তা কি আমি জানি?
ওই দিনের একটি অনুষ্ঠানে জনৈক অধ্যাপককে (দুঃখের বিষয় তার নামটি আমি শুনতে পাইনি) প্রশ্ন করা হয়েছিল—অনেকেই বলেন, হুমায়ূন আহমেদের রচনা কালজয়ী হবে না। আপনি স্যার কী বলেন? অধ্যাপক মহোদয় একটি চমত্কার উত্তর দিলেন—হুমায়ূন আহমেদ কালজয়ী হবেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন কী করে দেব। এখনও তো হুময়ূনের কাল অতিক্রান্ত হয়নি। আমি তার উত্তরে মুগ্ধ হলাম। তিনি আরও বলেছিলেন, হুমায়ূনের কাল অতিক্রান্ত হলে তবেই বোঝা যাবে, তিনি কালজয়ী কিনা। এখন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অবান্তর।
আমি স্মৃতি থেকে কথাগুলো বললাম। এতে হয়তো সামান্য হেরফের ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক মহোদয়ের মূল কথা ছিল এই। হুমায়ূনের জন্যে টেলিভিশনে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নাটক ও সিনেমার কোনো কোনো শিল্পী বলেছেন, বর্তমানে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘হুমায়ূনের যুগ’ চলছে। কেউ কেউ বলেছেন যেমন রবীন্দ্রযুগ, তেমনি বর্তমান কালটি হুমায়ূনের যুগ।
তাঁর মৃত্যুর পর অগণিত শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোক শোকমিছিলে এবং জানাজায় শরিক হয়েছেন। এর পেছনে তাঁর রচনা ও চলচ্চিত্রের স্বাতন্ত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যই কাজ করেছে। হুমায়ূন আহমেদ যে জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বলা আবশ্যক যে, জনপ্রিয় লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আর জননন্দিত লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে অনেক জনপ্রিয় শিল্পী-সাহিত্যিক আছেন, কিন্তু তারা সবাই জননন্দিত নন। জননন্দিত সেই শিল্পী-সাহিত্যিকই হন, যিনি সর্বস্তরের জনসাধারণের হৃদয় হরণ করেন। নিরক্ষর লোকেরাও যার রচনার দ্বারা মুগ্ধ ও আবিষ্ট হন। এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ম্যাজিক। কথাশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ যেন এই ম্যাজিক করায়ত্ত করেছিলেন। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
শ্রুতিলিখন : আহমদ বাসির
এই শোকবিধুর পরিবেশেও আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ পাঠ করে আমার অভিভূত হওয়ার এবং গ্রন্থটিকে ‘হৃদয় দিয়ে লেখা’ বলে অভিহিত করার কথা। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রতিভার স্পর্শে এবং সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বহু গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনোহরণ করেছেন এবং হৃদয় জয় করেছেন। তিনি হয়েছেন সাহিত্য-শিল্পের একজন অসাধারণ স্রষ্টা; জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর এই জনপ্রিয়তা এবং অভাবনীয় সাফল্যের বিষয়ে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই বোদ্ধা সাহিত্য পাঠক, চলচ্চিত্র দর্শক অনেক কথা বলেছেন। তারা বিভিন্নভাবে হুমায়ূন আহমেদের মূল্যায়ন করেছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও মূল্যায়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে হুমায়ূনের সার্বিক মূল্যায়ন বর্তমানে সম্ভব নয়।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নন্দিত নরকে’র বিষয়ে আমার মূল্যায়নের কথা। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত গ্রন্থটির আলোচনায় আমি শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘নন্দিত নরকে হৃদয় দিয়ে লেখা’। আজ মনে হচ্ছে শুধু নন্দিত নরকেই নয়, তিনি তাঁর সব উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক হৃদয় দিয়েই লিখেছেন। এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর হৃদয়। লেখা যত কঠিন, হৃদয় দিয়ে লেখা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। তিনি হৃদয় দিয়ে লিখেছেন বলেই পাঠক-দর্শক এবং শ্রোতার হৃদয় হরণ করতে পেরেছেন। কথায় বলে, ‘কলম, কাগজ, মন লেখে তিনজন’ কিন্তু শুধু মন দিয়ে লিখলেই হয় না, হৃদয় দিয়েও লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ এ ব্যাপারে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। ‘নন্দিত নরকে’ গ্রন্থটির আলোচনায় আমি যা লিখেছিলাম তার কিছু এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘উপন্যাসের আরেকটি আকর্ষণীয় গুণ এখানে যে মনোবিশ্লেষণের নামে, কিংবা আত্ম-অন্তর্মুখীনতার অজুহাতে বর্ণনায় অতিরেক ঘটিয়ে কাহিনীকে বোরিং করে তোলা হয়নি। সহজ, সাবলীল অথচ প্রাণময় ভাষায় তিনি যথার্থ দ্রষ্টা এবং স্রষ্টার মতো নির্লিপ্ত চেতনায় কাহিনী বিন্যাস করে গেছেন। তাঁর রচনায় এবং কাহিনী বিন্যাসে এমন একটি অন্তর্গত আকর্ষণ আছে, যা মনকে কখনও ক্লান্ত করে না, বরং একাধিক পাঠেও অপরিসীম আনন্দ দেয়। এই হৃদয়বান দক্ষ কথাশিল্পীকে আমরা স্বাগত জানাই।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছি এবং কেবলই মনে পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের রচনার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা। তিনি শুধু একজন সৃষ্টিধর্মী লেখকই নন, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে ও নাটকে জনমনের এবং সমগ্র জাতির হৃদয় স্পর্শ করতে হলে কী ধরনের জিনিস রচনায় দেয়া দরকার, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রূপায়ণ ঘটানো অপরিহার্য, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন এবং জাগ্রত সত্তা। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, সাধারণভাবে মানুষ এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশের মানুষ স্বদেশপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী ও সঙ্গীতপ্রেমী এবং পারলৌকিক জীবন ও সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে অভ্যস্ত। তারা যেমন বর্তমান জীবন সম্পর্কে ভাবেন, তেমনি পরকালের জীবন তথা পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে ভাবতেও অভ্যস্ত। এর পরিচয় প্রায়ই আমরা পাই লোকসাহিত্যে, লোকসঙ্গীতে এবং বিশেষ করে মরমী গানে। হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা লক্ষ্য করেছেন, এই অসাধারণ কথাশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার যেমন তাঁর উপন্যাসে নাটকের কাহিনী ও চরিত্রসৃজনের মাধ্যমে পাঠকের মনোহরণ করেছেন, তেমনি তিনি লোকসঙ্গীত, মরমী গান সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছেন অনন্যসাধারণ দক্ষতায়। তাঁর মৃত্যুর পর বিভিন্ন টেলিভিশন মাধ্যমে প্রচারিত নাটক এবং চলচ্চিত্র, যেগুলো আমি রোগশয্যায় বসে দেখেছি, সেগুলোর জীবনবাস্তবতা এবং সৃষ্টিধর্মিতা যেমন আমাকে কাঁদিয়েছে, তেমনি কাঁদিয়েছে সিনেমায়, নাটকে ব্যবহৃত লোকসঙ্গীত বিশেষ করে মরমী সঙ্গীত। আরেকটি কথা অনেকেই বলেছেন, কিন্তু আমি বিশেষভাবে বলতে চাই যে, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অসাধারণ দক্ষতায় এবং সৃষ্টিধর্মী প্রেরণায় মিডিয়াকে বিশেষ করে টেলিভিশনকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নাটক ও টেলিফিল্ম প্রচারে প্রায় বাধ্য করে অসাধারণ সাফল্যের পরিচিতি দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিধর্মিতা যেমন তাঁকে জনপ্রিয়তা দিয়েছে, তেমনি তাঁর বিশাল জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ব্যবহারের ক্ষমতা। শুধু শিক্ষিত লোকেরাই নয়, শিক্ষাবঞ্চিত লোকেরাও যে তাঁর সৃষ্টিকর্মে মুগ্ধ হয়েছেন, তার একটা বড় কারণ ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অর্থাত্ টেলিভিশন ও সিনেমার মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী।
শিক্ষার অভাবে অর্থাত্ পড়তে না জানার কারণে যারা তাঁর গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটক পড়তে পারেননি, তারা টেলিভিশনে এবং চলচ্চিত্রে কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং বাস্তবজীবনের রূপায়ণ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ শুধু তাঁর লেখায় দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পাঠকের হৃদয় হরণ করেননি, তিনি তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্ম দিয়ে পাঠকহৃদয় হরণ করেছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক তথ্যে জানলাম, তার গ্রন্থসংখ্যা ৩২২টি, বলাবাহুল্য এর বেশিরভাগই উপন্যাস ও নাটক। এই সংখ্যা থেকে তাঁর সৃষ্টিধর্মিতা এবং লেখার সাবলীল ক্ষমতা ও প্রাণশক্তি সহজেই অনুমেয়। তিনি যে লেখাকে সমগ্র হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছিলেন এবং সেই ধারণক্ষমতাকে রচনার মাধ্যমে উত্সারিত করেছেন, তার পরিচয় এই সংখ্যতত্ত্বেও পাওয়া যায়। ৩২২টি গ্রন্থ রচনা এক অসাধারণ সৃজনক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে।
অনেকে বলেন, যারা বেশি লেখেন, তারা খারাপ লেখেন। এ কথা হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি বেশি লিখলেও একটি মান বজায় রেখেছেন। বেশি লেখা, কম লেখা সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি-প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, অনেকের ধারণা, যারা বেশি লেখেন তারা খারাপ লেখেন, কিন্তু আমি বলতে চাই, আমরা যে প্রতিভা নিয়ে জন্মাই তাতে বেশি লিখি বলেই আমরা সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করি। তিনি প্রশ্ন করেছেন—রবীন্দ্রনাথ কি বেশি লেখেননি? তার রচনাবলি তো ২৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর এই বক্তব্য স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত। বাংলাসাহিত্যে বহু প্রতিভাবান লেখক আছেন, যারা বেশি লিখেছেন এবং সৃষ্টিক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু সবাই কি হুমায়ূন আহমেদের মতো তিন শতাধিক বই লিখেছেন? এই প্রশ্নের জবাব সাহিত্য সমালোচকরাই দিতে পারেন।
এসব কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদের পরবর্তী একটি ঘটনা। সেদিন রাতে দিগন্ত টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছিল মিউজিক আওয়ার নামে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান। তাতে লালনসঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। সেই সময় এলো হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ। অনুষ্ঠানটি থামিয়ে দিয়ে এর উপস্থাপক মৃত্যুসংবাদটি প্রচার করলেন। কিন্তু তিনি আবেগে এবং শোকে কথা ভালোভাবে সাজিয়ে বলতে পারছিলেন না। তিনি ফরিদা পারভীনকে একটি সঙ্গীত পরিবেশনের অনুরোধ জানালেন। ফরিদা পারভীন লালনসঙ্গীতের একজন প্রখ্যাত গায়িকা। তিনি শোকাহত কণ্ঠে পরিবেশন করলেন জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত একটি লালনসঙ্গীত। শ্রোতাদের তরফ থেকে অনুরোধ এলো একটি বিশেষ লালনসঙ্গীত পরিবেশনের জন্য। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ফরিদা গাইলেন লালনের সেই বিখ্যাত গান—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ‘কমনে আসে-যায়/ ধরতে পারলে মনও বেড়ি দিতাম পাখির পায়। গানটি শুনে আমিও শোকাহত হয়ে গেলাম। আমার দুই চোখ হয়ে উঠল অশ্রুসিক্ত। বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর ভাবনাই তো আমার নিত্যদিনের ভাবনা। কোন দিন আমার জীবনখাঁচার পাখি উড়াল দিয়ে চলে যাবে, তা কি আমি জানি?
ওই দিনের একটি অনুষ্ঠানে জনৈক অধ্যাপককে (দুঃখের বিষয় তার নামটি আমি শুনতে পাইনি) প্রশ্ন করা হয়েছিল—অনেকেই বলেন, হুমায়ূন আহমেদের রচনা কালজয়ী হবে না। আপনি স্যার কী বলেন? অধ্যাপক মহোদয় একটি চমত্কার উত্তর দিলেন—হুমায়ূন আহমেদ কালজয়ী হবেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন কী করে দেব। এখনও তো হুময়ূনের কাল অতিক্রান্ত হয়নি। আমি তার উত্তরে মুগ্ধ হলাম। তিনি আরও বলেছিলেন, হুমায়ূনের কাল অতিক্রান্ত হলে তবেই বোঝা যাবে, তিনি কালজয়ী কিনা। এখন এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অবান্তর।
আমি স্মৃতি থেকে কথাগুলো বললাম। এতে হয়তো সামান্য হেরফের ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক মহোদয়ের মূল কথা ছিল এই। হুমায়ূনের জন্যে টেলিভিশনে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নাটক ও সিনেমার কোনো কোনো শিল্পী বলেছেন, বর্তমানে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘হুমায়ূনের যুগ’ চলছে। কেউ কেউ বলেছেন যেমন রবীন্দ্রযুগ, তেমনি বর্তমান কালটি হুমায়ূনের যুগ।
তাঁর মৃত্যুর পর অগণিত শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোক শোকমিছিলে এবং জানাজায় শরিক হয়েছেন। এর পেছনে তাঁর রচনা ও চলচ্চিত্রের স্বাতন্ত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যই কাজ করেছে। হুমায়ূন আহমেদ যে জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। বলা আবশ্যক যে, জনপ্রিয় লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আর জননন্দিত লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে অনেক জনপ্রিয় শিল্পী-সাহিত্যিক আছেন, কিন্তু তারা সবাই জননন্দিত নন। জননন্দিত সেই শিল্পী-সাহিত্যিকই হন, যিনি সর্বস্তরের জনসাধারণের হৃদয় হরণ করেন। নিরক্ষর লোকেরাও যার রচনার দ্বারা মুগ্ধ ও আবিষ্ট হন। এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ম্যাজিক। কথাশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ যেন এই ম্যাজিক করায়ত্ত করেছিলেন। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
শ্রুতিলিখন : আহমদ বাসির
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন