জীবনানন্দ দাশের কবিতার নায়িকা শঙ্খমালার শিয়রে হিজল কাঠের চিতা জ্বলে। সে আগুনে সব কিছু পুড়ে যাওয়ার পর কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়—‘এ পৃথিবী একবার পায় তাকে পায় না কো আর।’ হুমায়ূন আহমেদের অনন্ত যাত্রার পরও এ কথাটিই ঘুরে ফিরে বারবার প্রাণে বাজছে আমার। হয়তো আমার মতো অনেকেই এ রকমভাবে ভেবেছেন। হয়তো ভাবেননি। কিন্তু কথা তো সত্য, হুমায়ূন আহমেদের মতো শিল্পীরা প্রতিদিন জন্মায় না। যুগে যুগেও জন্মায় না। এমনকি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও না।
বাংলা সাহিত্যের এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কথাসাহিত্যে হুমায়ূনের চেয়ে জনপ্রিয়তা নিয়ে আর কোনো লেখকের আবির্ভাব হয়নি। আবার একথাও ঠিক, জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যা-ই হোক, বাংলা ভাষার সাহিত্যাকাশে প্রথম ‘তারকা’ বা সুপারস্টার নজরুল। নজরুলের আগে-পরে সুপারস্টার শব্দটি আর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়নি— যতদিন না হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটেছে।
নজরুলের সময় মিডিয়ার এত প্রকোপ ছিল না। থাকলে হয়তো আমাদের হাতে প্রত্যক্ষ ভিজ্যুয়াল নজির পৌঁছত। আমাদের নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন স্মৃতিচারণের ওপর। এ রকম এক স্মৃতিচারণ আমরা পেয়েছি চট্টগ্রামের রাউজানের জলিলনগরের আবদুল কুদ্দুচ মাস্টার এবং দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর কাছ থেকে। তাদের বর্ণনামতে, ঘটনার সময় ১৯২৮ সাল। জলিলনগরের হাজীবাড়ীর সামনে আয়োজিত চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন কবি নজরুল। আশপাশের গ্রামগঞ্জে সাড়া পড়ে গেছে। দলে দলে মানুষ ছুটছে সমাবেশস্থলের দিকে। হাজার হাজার মানুষ পাগলের মতো ছুটে এসেছে নজরুলকে একনজর দেখার জন্য। লক্ষাধিক মানুষের সেই চাপ সামলানোর জন্য শেষ পর্যন্ত টিকিটের ব্যবস্থা করা হলো। টিকিটের দাম, ৫০০, ১০০, ৫০, ১০ ও ১ টাকা। তা-ই সই। টিকিট কেটে প্যান্ডেলে ঢুকে কবিকে দেখার জন্য হুলুস্থুল পড়ে গেল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেই প্রথম টিকিট কেটে কবিদর্শনের ব্যবস্থা।
নজরুল দলবল নিয়ে রাস্তায় নামলে অনেক সময় কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম লেগে যেত।
নজরুলের আগে কিংবা পরে অনেকে এসেছেন। কিন্তু নজরুল জাতির অন্তরে যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেখানে আর কেউ যেতে পারেননি। যেতে পারেননি বলেই একজন কবিকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড আমাদের জেনারেশনের দেখা হয়নি। আমাদের সামনে প্রকৃতি সেজন্যই তার সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে পাঠালেন হুমায়ূন আহমেদকে। তা-ও আবার পশ্চিম বাংলার রুক্ষ ধূসরতার মধ্যে নয়; তিনি এলেন বাংলাদেশের সহজ সুন্দর সাবলীল শ্যামল কোমল নদীমাতৃক পাললিক মৃত্তিকায়। যে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হওয়ার উপকরণ জুগিয়েছে, যে বাংলাদেশ নজরুলকে করেছে জাতীয় কবি, দিয়েছে ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হওয়ার প্রেরণা, দিয়েছে অগ্নিবীণা বাজানোর অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য, সেই বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত জীবনের অব্যক্ত কথাকে বাণীময় করার অনন্যসাধারণ শিল্পশক্তি দিয়ে যেন নিজ হাতে গড়ে উপস্থাপন করেছে হুমায়ূন আহমেদকে।
তাঁর আবির্ভাব যেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। অসাধারণ তার মাদকতা এবং চুম্বক শক্তি। তাঁর আগমন যেন দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা বাতাসের মতো পুষ্পল। তিনি ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন প্রো-অ্যাক্টিভ, তেমনি তাঁর সাহিত্যকর্মও সেই পজিটিভনেসের তরজমা। তিনি নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের সাহিত্যের পক্ষে যেন দাঁড়িয়ে গেলেন বটবৃক্ষ হয়ে। ভারতের পশ্চিম বাংলার সাহিত্যকে বিদায় জানিয়ে তিনি যেন উদ্বোধন ঘটালেন ভিন্ন এক বাংলাদেশের—যে বাংলাদেশ স্নিগ্ধ, কোমল, মানবিক, মমতাময়, প্রেমময়, সহজ কিন্তু আন্তরিক। চালটা হালকা, কিন্তু ব্যঞ্জনা বড় গভীর। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যবিত্তের দায়হীন দায়িত্বহীন আনন্দ বিতরণে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁর প্রতিটি কাজের অন্তরেই ছিল মঙ্গলবোধ এবং দেশপ্রেম। তিনি তাঁর নিজের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মকে যে আবিষ্ট করে রেখেছেন, সে তো এই কারণে নয় যে তিনি ভালো গল্প বলতে পারেন; বরং সত্য হলো, তিনি মধ্যবিত্তের ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথা, কান্না-হাসিকে বাঙ্ময় করেছেন অননুকরণীয় মাধুর্যে। তাঁকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন অশিক্ষিত আবেগ দিয়ে নয়; যুক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে, নিরাভরণ সত্যের সহজ-সরল মমতা দিয়ে। একই রকমভাবে বলা যায় আধিপত্যবাদী থাবার নিচ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উদ্ধার করে তাকে দান করে গেছেন প্রাণপ্রাচুর্য ও নিজস্বতা। আর আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠা।
কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষাভঙ্গিকে বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশের জনজীবনের ভাষাকে শিল্পরূপ দিয়ে যে অসামান্য কাজটি তিনি করে গেলেন, তার মূল্যায়ন হতে সময় লাগবে। তিনি নিজের জন্য নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ করে আমাদের আক্কেল-হুঁশ হারিয়ে ফেলা, কেঁচোর মতো ঘিনঘিনে, পরমুখাপেক্ষী লেখক-কবিদের আঁতলামির জ্বালা সয়েছেন বটে; কিন্তু তাদেরও খানিকটা মানুষ করে দিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের লেখক-কবিরা সেজন্য পরবর্তীকালে গর্ববোধ করবেন যে, আমরা হুমায়ূনযুগে বাস করতাম।
হুমায়ূন তাঁর বিষয়বৈচিত্র্যের মতোই বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকেও সম্মান দান করে গেছেন। মধ্যবিত্ত নাগরিক, সাদামাঠা জীবনের কাহিনী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রোপণ করে গেছেন লোকসংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল নানা দিক। তাঁর নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত—সব কিছুই এর প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে আছে। এর মাধ্যমে বিরাজমান হীনম্মন্যতার শিকড় তিনি উপড়ে ফেলেছেন। লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক, ফ্যান্টাসি এবং সায়েন্স ফিকশন—এসবের পরতে পরতে তিনি গেঁথে দিয়েছেন বাংলাদেশকে।
হুমায়ূন আহমদের মিসির আলি, হিমু, শুভ্র, রূপা, বাকের ভাই এজন্যই হয়তো হয়ে উঠেছে আমাদের আত্মার আত্মীয়। বাংলা সাহিত্যে একসঙ্গে এতগুলো সফল এবং জনপ্রিয় চরিত্র নির্মাণের একক কৃতিত্ব আসলেই হুমায়ূনের।
হুমায়ূনের আরেকটি অস্ত্র তাঁর পরিচ্ছন্নতা। জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, হিংসা, ঘৃণা—এসবের বাইরে গিয়ে মানুষকে তিনি বড় করে তুলেছেন সবসময়। একই পরিবারের মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদি—সবাই হুমায়ূনের অনুরক্ত হয়েছেন এ পরিচ্ছন্নতার জোছনায় অবগাহন করে। মানুষকে তিনি সুপারম্যান হিসেবে দেখেননি কখনও, দেখেছেন দোষে-গুণের ভেতরে সন্তরণশীল। এজন্যই শ্রাবণ মেঘের দিনের দাদা, বহুব্রীহির এমদাদ খোন্দকার কিংবা নান্দাইলের ইউনুসের জন্যও চোখে পানি আসে আমাদের। তাঁর মানুষ কেউই সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ নয়, কেউ পরিপূর্ণ মানুষ নয়—সব মিলিয়ে বলা যায় অসাধারণ এক জীবনশিল্পী হুমায়ূন। হুমায়ূনের মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের সাহিত্যের অজর-অমরদের তালিকায় নাম লিখিয়ে গেছেন জীবদ্দশায়ই।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদকে সাহিত্যসম্রাট সামনাসামনি বললে হয়তো তিনি হেসে উঠতেন। কারণ এসব সম্রাট-রাজা, রায় বাহাদুর, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিদের লেখক তো ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মনোনায়ক।
এই মনোনায়কদের ইতিহাসে আমাদের সাহিত্যে প্রথম নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাম্প্রদায়িকতার নোংরামিটুকু বাদ দিলে তিনি অসাধারণ। জনপ্রিয়তার কাতারে প্রথম নাম।
বঙ্কিমের পরে নাম আসে মীর মশাররফ হোসেনের। মীরের বিষাদ-সিন্ধু পাঠ করেননি, এমন মানুষ একসময় এদেশে বিরল ছিল। একটু বিরতি দিয়ে এর পরের নাম শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এরপর জনপ্রিয়তার কাতারে, বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন। একদা এমন ছিল— মেয়েদের বিয়ে হলে এদেশের মায়েরা, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় স্যুটকেসে দু’টি বই দিয়ে দিতেন। এর একটি ছিল মকসুদুল মুমেনীন অন্যটি নজিবর রহমানের আনোয়ারা। আনোয়ারা দীর্ঘদিন বাংলার মুসলমান সংসারজীবনে অবশ্যপাঠ্য হয়ে ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে আমাদের উপন্যাস, জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বলে আমরা মানতাম আকবর হোসেনকে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সাহিত্যের লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়ার সত্ সাহস প্রথম দেখিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যৌবনের বিরাট অংশ দখল করে ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ থ্রিলার সিরিজ। মাসুদ রানা ছিল দুর্ধর্ষ স্পাই। আমরা সে রকম হতে চাইতাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী অপেক্ষায় ছিল এমন একজনের যে, তাদের প্রাণের পাশে আসন পেতে বসে তার সমস্যাজর্জরিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে তাকে নিয়ে যাবে আনন্দের অলকাপুরীতে—তার ভাঙা ঘরের জীর্ণ উঠানের জোছনা দিয়েও যে আলিফ লায়লার রোমান্টিক পৃথিবী নির্মাণ করবে—সেই কাঙ্ক্ষিত প্রতিভার নামই হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম এবং সফলতম প্রতিনিধি। সত্যিই তো, হুমায়ূনের লেখক জীবনের বয়স বাংলাদেশের সমান। সেদিক থেকেও তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের সত্যিকার নায়ক। তাঁর লেখালেখির শুরু এবং শেষ তো খাঁটি বাংলাদেশেই। আবার তিনিই বাংলাদেশের লেখালেখির জগতের প্রথম পেশাদার ও সার্বক্ষণিক লেখক। প্রথম এবং সুপারস্টার। তিনিই তো সেই লেখক, যাঁর বই বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
তিন.
নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের দাফন সব বিবেচনায়ই যথার্থ হয়েছে। সেদিক থেকে হুমায়ূনের ছেলেমেয়ে ও ভাইবোনদের প্রতি সহানুভূতি রেখেও বলব, শাওনের সিদ্ধান্তই সঠিক। এই সঠিকত্ব বুঝতে আরেকটু সময় লাগবে। সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এর গুরুত্ব ও তাত্পর্য অনুধাবন করবে আশা করি।
বাংলা সাহিত্যের শেষ একশ’ বছরে দেখা যায়, মাত্র দু’জন লেখক ব্যাপকভিত্তিক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আগের জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরের জন হুমায়ূন আহমেদ। মাঝে কাজী নজরুলও চেয়েছিলেন বড় ধরনের কিছু একটা করার। কিন্তু তিনি সময় পাননি।
রবীন্দ্রনাথ পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন বোলপুরের আশ্রম। সেখানেই তিনি তাঁর মেধা, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে বাস্তব রূপ দেন স্বপ্নের। গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন। যে শান্তিনিকেতন আজ যেমন কবিতীর্থ-রবিতীর্থ, তেমনি ভারতের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রও বটে। শান্তিনিকেতনের যে কনসেপ্ট, সেই কনসেপ্ট কলকাতার কোলাহলে রূপ দেয়া সম্ভব হতো না। এর জন্য দরকার ছিল কোলাহলবর্জিত, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ পরিবেশ। আজকের শান্তিনিকেতন তাই শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধান পীঠস্থানই শুধু নয়, এর পর্যটন ভ্যালুও অনেক। শান্তিনিকেতনের পরতে পরতে, পাতায় পাতায়, তৃণে-স্থাপত্যে সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ। সেজন্য শান্তিনিকেতনে না গেলে রবীন্দ্রদর্শন ও চর্চা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে।
এ আলোকেই দেখতে অনুরোধ করি নুহাশ পল্লীকে। বাংলাদেশের আর কোনো লেখক হুমায়ূনের মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও হুমায়ূনের মতো এত বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। এমন সুযোগও এদেশের আর লেখকের জীবনে আসেনি। রবীন্দ্রনাথ যেখানে পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন, হুমায়ূন সেখানে নিজে অর্জন করেছেন। নিজস্ব অর্থ, ঘাম, মেধা আর স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছেন নুহাশ পল্লী।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখকই অতিসাধারণ মানের জীবনযাপন করেন। তাদের বেশিরভাগই জনপ্রিয়তা ও বিত্তের বিচারে ফকির। দিন এনে দিন খায়। এদের মধ্যেও স্বপ্নহীন সবাই, তা নয়। কিন্তু মুশকিলটা হলো, হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয়তা ও বিত্তশালী হওয়া তাদের একজীবনে সম্ভব নয়—তারা নুহাশ পল্লীর মতো স্বপ্নভূমি রচনা করবে, কীভাবে?
আবার যাদের সাধ্য ছিল, তাদের মধ্যে বড় কোনো স্বপ্ন নেই। এদের বেশিরভাগই পার্টটাইম লেখক। এরা অর্থ-বিত্তের দৌড়ে ব্যর্থ হয়ে লেখক হিসেবে নাম কামানোর ফিকিরে ঘুরছেন। কেউ সাবেক অতিচতুর আমলা, কেউবা ক্ষুদ্রবুদ্ধির সাংবাদিক। এদের স্বার্থপর জীবনের ক্যানভাসও অতিক্ষুদ্র। সবকিছু দেখেন নিজেদের আত্মার সাইজে। বড় স্বপ্ন বড় কল্পনা ধারণ করার মতো মাথাও এদের নেই। অনেকটা বন্য বরাহের মতো। আত্মপরতার যে কাদাটুকু এরা নাগরিক কোলাহলে পেয়েছেন, সেই কাদা ঘেঁটেই এরা জীবন ধন্য মনে করেন। এদের মাথায় কীভাবে আসবে নাগরিক কোলাহলের বাইরে গভীর নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে মমতার রেণুমাখা একটি নুহাশ পল্লী সৃষ্টির।
চার.
শেক্সপিয়র দর্শনের জন্য যারা স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন গেছেন, তারা দেখে থাকবেন কীভাবে ছোট একটা শহরের পুরোটাই গড়ে উঠেছে শেক্সপিয়রকে নিয়ে। কী নেই সেখানে? আছে শেক্সপিয়রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, আছে সোয়ান থিয়েটার, আছে প্রেক্ষাগৃহ, আছে শপিংমল, আছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পর্যটন অফিস, গাইড, আরও কত কি! সারাবছরই চলছে নানা উত্সব। সেয়ান থিয়েটারে চলছে বিরতিহীন শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটকের বিরতিহীন পরিবেশনা, চলছে আবৃত্তির অনুষ্ঠান। মোট কথা, সে এক এলাহি কাণ্ড। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, কীভাবে শেক্সপিয়রকে নিয়ে মেতে আছে ব্রিটিশরা। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি দেশ-দেশান্তর থেকে প্রতিদিন গাড়ি ভরে ভরে পর্যটক যাচ্ছে স্ট্র্র্র্র্যাটফোর্ডে।
শান্তিনিকেতন যারা দেখেছেন, তারা আমার কথার সারবত্তা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
ভারত বা ব্রিটেনের মতো ইরানও তাদের বিভিন্ন শহরকে অনুপম করে সাজিয়ে রেখেছে বিভিন্ন কবির নামে। এক্ষেত্রে সিরাজনগরীর হাফিজ এভিনিউতে হাফিজ এবং সাদিয়ার শেখ সাদীকে নিয়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলোকে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের ও প্রিয় স্থান নুহাশ পল্লীকে গড়ে তোলার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তার পরিবার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে নুহাশ হয়ে উঠতে পারে ‘হুমায়ূন তীর্থ’; হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যরকম এক স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন; হয়ে উঠতে পারে একটা খাঁটি বাংলাদেশী শান্তিনিকেতন।
একটা চমত্কার মাস্টার প্ল্যানের আওতায় হুমায়ূনের এই প্রিয় নুহাশ পল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে হুমায়ূন আহমেদ মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, উন্মুক্ত থিয়েটার হল, প্রেক্ষাগৃহ, অ্যান্টিক শপ, গবেষণা কেন্দ্র, এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
ঢাকা থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকবে চমত্কার কোচ সার্ভিস। থাকবে পেশাদার গাইড। এই পর্যটকরা গিয়ে দেখবেন সেখানে দিনরাত চলছে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অমাবস্যার রাতে যেখানে মঞ্চস্থ হবে মিসির আলি বিষয়ক নাটক অথবা চলচ্চিত্র। পূর্ণিমার রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় চলবে হিমুকে নিয়ে নানা কাণ্ড। শরতে কিংবা চৈত্রের চন্দ্রিমা রাতে হবে সঙ্গীতের আসর। এভাবে মাসের প্রতিটি দিন কবে কী হবে, তার আগাম রুটিন জানিয়ে দেয়া হবে সবাইকে। সেই মোতাবেক ট্যুরিস্টরা যাবেন নুহাশ পল্লীতে। আবার এমনও হতে পারে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থের প্রতিটি দিন হুমায়ূনের এক একটি বইয়ের নামে অথবা চরিত্রের নামে হবে। যেমন- শঙ্খনীল কারাগার দিবস, মিসির আলি দিবস ইত্যাদি। সেদিনের পল্লী সাজবে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ বা চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে। এতে পর্যটন ভ্যালুও বাড়বে অনেকখানি। ঢাকার কোলাহল থেকে ক্ষণিক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নানা বয়সের নরনারীরা ছুটে যাবে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থে। নির্মল আনন্দের মধ্যে একটি দিন কাটিয়ে তারা ফিরে যাবেন কর্মজীবনে। বিদেশী ট্যুরিস্টরা ঢাকায় এসে বলবেন ‘হুমায়ূন তীর্থ নুহাশ পল্লী, বাংলাদেশ’ এ যাব।
একই সঙ্গে হুমায়ূনকে নিয়ে গবেষণার জন্য জমা হবেন গবেষকরা, গ্রন্থাগারে থাকবে হুমায়ূনের বই এবং হুমায়ূনকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থাদি। বাংলাদেশের সমাজ জীবন ও সংস্কৃতির উপর গ্রন্থরাজি। অর্থাত্ হুমায়ূনকে ঘিরে শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি পজিটিভ চর্চা যদি নুহাশ পল্লীতে শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশ যেমন পাবে ঘুরে দাঁড়ানো ও বেড়ানোর নতুন মাত্রা, তেমনি শান্তি পাবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মাও।
শাওন, শীলা, নোভা, বিপাশা, নুহাশ, নিষাদ, নিনিতরা কি এই লেখাটি পড়বে—আমি জানি না। যদি পড়ে এবং ছিটেফোঁটাও যদি বাস্তাবায়ন হয়, ধন্য মানব নিজেকে। আর এই যে কথাগুলো বললাম, সে আলোকে যদি বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে হুমায়ূনকে দাফন করার জন্য নুহাশ পল্লীই যথার্থ স্থান। এখন স্বাপ্নিক ও স্বপ্ন আমাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে।
বাংলা সাহিত্যের এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কথাসাহিত্যে হুমায়ূনের চেয়ে জনপ্রিয়তা নিয়ে আর কোনো লেখকের আবির্ভাব হয়নি। আবার একথাও ঠিক, জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যা-ই হোক, বাংলা ভাষার সাহিত্যাকাশে প্রথম ‘তারকা’ বা সুপারস্টার নজরুল। নজরুলের আগে-পরে সুপারস্টার শব্দটি আর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়নি— যতদিন না হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটেছে।
নজরুলের সময় মিডিয়ার এত প্রকোপ ছিল না। থাকলে হয়তো আমাদের হাতে প্রত্যক্ষ ভিজ্যুয়াল নজির পৌঁছত। আমাদের নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন স্মৃতিচারণের ওপর। এ রকম এক স্মৃতিচারণ আমরা পেয়েছি চট্টগ্রামের রাউজানের জলিলনগরের আবদুল কুদ্দুচ মাস্টার এবং দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর কাছ থেকে। তাদের বর্ণনামতে, ঘটনার সময় ১৯২৮ সাল। জলিলনগরের হাজীবাড়ীর সামনে আয়োজিত চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন কবি নজরুল। আশপাশের গ্রামগঞ্জে সাড়া পড়ে গেছে। দলে দলে মানুষ ছুটছে সমাবেশস্থলের দিকে। হাজার হাজার মানুষ পাগলের মতো ছুটে এসেছে নজরুলকে একনজর দেখার জন্য। লক্ষাধিক মানুষের সেই চাপ সামলানোর জন্য শেষ পর্যন্ত টিকিটের ব্যবস্থা করা হলো। টিকিটের দাম, ৫০০, ১০০, ৫০, ১০ ও ১ টাকা। তা-ই সই। টিকিট কেটে প্যান্ডেলে ঢুকে কবিকে দেখার জন্য হুলুস্থুল পড়ে গেল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেই প্রথম টিকিট কেটে কবিদর্শনের ব্যবস্থা।
নজরুল দলবল নিয়ে রাস্তায় নামলে অনেক সময় কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম লেগে যেত।
নজরুলের আগে কিংবা পরে অনেকে এসেছেন। কিন্তু নজরুল জাতির অন্তরে যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেখানে আর কেউ যেতে পারেননি। যেতে পারেননি বলেই একজন কবিকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড আমাদের জেনারেশনের দেখা হয়নি। আমাদের সামনে প্রকৃতি সেজন্যই তার সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে পাঠালেন হুমায়ূন আহমেদকে। তা-ও আবার পশ্চিম বাংলার রুক্ষ ধূসরতার মধ্যে নয়; তিনি এলেন বাংলাদেশের সহজ সুন্দর সাবলীল শ্যামল কোমল নদীমাতৃক পাললিক মৃত্তিকায়। যে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হওয়ার উপকরণ জুগিয়েছে, যে বাংলাদেশ নজরুলকে করেছে জাতীয় কবি, দিয়েছে ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হওয়ার প্রেরণা, দিয়েছে অগ্নিবীণা বাজানোর অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য, সেই বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত জীবনের অব্যক্ত কথাকে বাণীময় করার অনন্যসাধারণ শিল্পশক্তি দিয়ে যেন নিজ হাতে গড়ে উপস্থাপন করেছে হুমায়ূন আহমেদকে।
তাঁর আবির্ভাব যেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। অসাধারণ তার মাদকতা এবং চুম্বক শক্তি। তাঁর আগমন যেন দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা বাতাসের মতো পুষ্পল। তিনি ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন প্রো-অ্যাক্টিভ, তেমনি তাঁর সাহিত্যকর্মও সেই পজিটিভনেসের তরজমা। তিনি নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের সাহিত্যের পক্ষে যেন দাঁড়িয়ে গেলেন বটবৃক্ষ হয়ে। ভারতের পশ্চিম বাংলার সাহিত্যকে বিদায় জানিয়ে তিনি যেন উদ্বোধন ঘটালেন ভিন্ন এক বাংলাদেশের—যে বাংলাদেশ স্নিগ্ধ, কোমল, মানবিক, মমতাময়, প্রেমময়, সহজ কিন্তু আন্তরিক। চালটা হালকা, কিন্তু ব্যঞ্জনা বড় গভীর। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যবিত্তের দায়হীন দায়িত্বহীন আনন্দ বিতরণে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁর প্রতিটি কাজের অন্তরেই ছিল মঙ্গলবোধ এবং দেশপ্রেম। তিনি তাঁর নিজের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মকে যে আবিষ্ট করে রেখেছেন, সে তো এই কারণে নয় যে তিনি ভালো গল্প বলতে পারেন; বরং সত্য হলো, তিনি মধ্যবিত্তের ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথা, কান্না-হাসিকে বাঙ্ময় করেছেন অননুকরণীয় মাধুর্যে। তাঁকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন অশিক্ষিত আবেগ দিয়ে নয়; যুক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে, নিরাভরণ সত্যের সহজ-সরল মমতা দিয়ে। একই রকমভাবে বলা যায় আধিপত্যবাদী থাবার নিচ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উদ্ধার করে তাকে দান করে গেছেন প্রাণপ্রাচুর্য ও নিজস্বতা। আর আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠা।
কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষাভঙ্গিকে বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশের জনজীবনের ভাষাকে শিল্পরূপ দিয়ে যে অসামান্য কাজটি তিনি করে গেলেন, তার মূল্যায়ন হতে সময় লাগবে। তিনি নিজের জন্য নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ করে আমাদের আক্কেল-হুঁশ হারিয়ে ফেলা, কেঁচোর মতো ঘিনঘিনে, পরমুখাপেক্ষী লেখক-কবিদের আঁতলামির জ্বালা সয়েছেন বটে; কিন্তু তাদেরও খানিকটা মানুষ করে দিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের লেখক-কবিরা সেজন্য পরবর্তীকালে গর্ববোধ করবেন যে, আমরা হুমায়ূনযুগে বাস করতাম।
হুমায়ূন তাঁর বিষয়বৈচিত্র্যের মতোই বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকেও সম্মান দান করে গেছেন। মধ্যবিত্ত নাগরিক, সাদামাঠা জীবনের কাহিনী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রোপণ করে গেছেন লোকসংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল নানা দিক। তাঁর নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত—সব কিছুই এর প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে আছে। এর মাধ্যমে বিরাজমান হীনম্মন্যতার শিকড় তিনি উপড়ে ফেলেছেন। লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক, ফ্যান্টাসি এবং সায়েন্স ফিকশন—এসবের পরতে পরতে তিনি গেঁথে দিয়েছেন বাংলাদেশকে।
হুমায়ূন আহমদের মিসির আলি, হিমু, শুভ্র, রূপা, বাকের ভাই এজন্যই হয়তো হয়ে উঠেছে আমাদের আত্মার আত্মীয়। বাংলা সাহিত্যে একসঙ্গে এতগুলো সফল এবং জনপ্রিয় চরিত্র নির্মাণের একক কৃতিত্ব আসলেই হুমায়ূনের।
হুমায়ূনের আরেকটি অস্ত্র তাঁর পরিচ্ছন্নতা। জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, হিংসা, ঘৃণা—এসবের বাইরে গিয়ে মানুষকে তিনি বড় করে তুলেছেন সবসময়। একই পরিবারের মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদি—সবাই হুমায়ূনের অনুরক্ত হয়েছেন এ পরিচ্ছন্নতার জোছনায় অবগাহন করে। মানুষকে তিনি সুপারম্যান হিসেবে দেখেননি কখনও, দেখেছেন দোষে-গুণের ভেতরে সন্তরণশীল। এজন্যই শ্রাবণ মেঘের দিনের দাদা, বহুব্রীহির এমদাদ খোন্দকার কিংবা নান্দাইলের ইউনুসের জন্যও চোখে পানি আসে আমাদের। তাঁর মানুষ কেউই সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ নয়, কেউ পরিপূর্ণ মানুষ নয়—সব মিলিয়ে বলা যায় অসাধারণ এক জীবনশিল্পী হুমায়ূন। হুমায়ূনের মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের সাহিত্যের অজর-অমরদের তালিকায় নাম লিখিয়ে গেছেন জীবদ্দশায়ই।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদকে সাহিত্যসম্রাট সামনাসামনি বললে হয়তো তিনি হেসে উঠতেন। কারণ এসব সম্রাট-রাজা, রায় বাহাদুর, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিদের লেখক তো ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মনোনায়ক।
এই মনোনায়কদের ইতিহাসে আমাদের সাহিত্যে প্রথম নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাম্প্রদায়িকতার নোংরামিটুকু বাদ দিলে তিনি অসাধারণ। জনপ্রিয়তার কাতারে প্রথম নাম।
বঙ্কিমের পরে নাম আসে মীর মশাররফ হোসেনের। মীরের বিষাদ-সিন্ধু পাঠ করেননি, এমন মানুষ একসময় এদেশে বিরল ছিল। একটু বিরতি দিয়ে এর পরের নাম শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এরপর জনপ্রিয়তার কাতারে, বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন। একদা এমন ছিল— মেয়েদের বিয়ে হলে এদেশের মায়েরা, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় স্যুটকেসে দু’টি বই দিয়ে দিতেন। এর একটি ছিল মকসুদুল মুমেনীন অন্যটি নজিবর রহমানের আনোয়ারা। আনোয়ারা দীর্ঘদিন বাংলার মুসলমান সংসারজীবনে অবশ্যপাঠ্য হয়ে ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে আমাদের উপন্যাস, জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বলে আমরা মানতাম আকবর হোসেনকে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সাহিত্যের লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়ার সত্ সাহস প্রথম দেখিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যৌবনের বিরাট অংশ দখল করে ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ থ্রিলার সিরিজ। মাসুদ রানা ছিল দুর্ধর্ষ স্পাই। আমরা সে রকম হতে চাইতাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী অপেক্ষায় ছিল এমন একজনের যে, তাদের প্রাণের পাশে আসন পেতে বসে তার সমস্যাজর্জরিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে তাকে নিয়ে যাবে আনন্দের অলকাপুরীতে—তার ভাঙা ঘরের জীর্ণ উঠানের জোছনা দিয়েও যে আলিফ লায়লার রোমান্টিক পৃথিবী নির্মাণ করবে—সেই কাঙ্ক্ষিত প্রতিভার নামই হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম এবং সফলতম প্রতিনিধি। সত্যিই তো, হুমায়ূনের লেখক জীবনের বয়স বাংলাদেশের সমান। সেদিক থেকেও তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের সত্যিকার নায়ক। তাঁর লেখালেখির শুরু এবং শেষ তো খাঁটি বাংলাদেশেই। আবার তিনিই বাংলাদেশের লেখালেখির জগতের প্রথম পেশাদার ও সার্বক্ষণিক লেখক। প্রথম এবং সুপারস্টার। তিনিই তো সেই লেখক, যাঁর বই বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
তিন.
নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের দাফন সব বিবেচনায়ই যথার্থ হয়েছে। সেদিক থেকে হুমায়ূনের ছেলেমেয়ে ও ভাইবোনদের প্রতি সহানুভূতি রেখেও বলব, শাওনের সিদ্ধান্তই সঠিক। এই সঠিকত্ব বুঝতে আরেকটু সময় লাগবে। সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এর গুরুত্ব ও তাত্পর্য অনুধাবন করবে আশা করি।
বাংলা সাহিত্যের শেষ একশ’ বছরে দেখা যায়, মাত্র দু’জন লেখক ব্যাপকভিত্তিক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আগের জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরের জন হুমায়ূন আহমেদ। মাঝে কাজী নজরুলও চেয়েছিলেন বড় ধরনের কিছু একটা করার। কিন্তু তিনি সময় পাননি।
রবীন্দ্রনাথ পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন বোলপুরের আশ্রম। সেখানেই তিনি তাঁর মেধা, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে বাস্তব রূপ দেন স্বপ্নের। গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন। যে শান্তিনিকেতন আজ যেমন কবিতীর্থ-রবিতীর্থ, তেমনি ভারতের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রও বটে। শান্তিনিকেতনের যে কনসেপ্ট, সেই কনসেপ্ট কলকাতার কোলাহলে রূপ দেয়া সম্ভব হতো না। এর জন্য দরকার ছিল কোলাহলবর্জিত, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ পরিবেশ। আজকের শান্তিনিকেতন তাই শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধান পীঠস্থানই শুধু নয়, এর পর্যটন ভ্যালুও অনেক। শান্তিনিকেতনের পরতে পরতে, পাতায় পাতায়, তৃণে-স্থাপত্যে সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ। সেজন্য শান্তিনিকেতনে না গেলে রবীন্দ্রদর্শন ও চর্চা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে।
এ আলোকেই দেখতে অনুরোধ করি নুহাশ পল্লীকে। বাংলাদেশের আর কোনো লেখক হুমায়ূনের মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও হুমায়ূনের মতো এত বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। এমন সুযোগও এদেশের আর লেখকের জীবনে আসেনি। রবীন্দ্রনাথ যেখানে পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন, হুমায়ূন সেখানে নিজে অর্জন করেছেন। নিজস্ব অর্থ, ঘাম, মেধা আর স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছেন নুহাশ পল্লী।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখকই অতিসাধারণ মানের জীবনযাপন করেন। তাদের বেশিরভাগই জনপ্রিয়তা ও বিত্তের বিচারে ফকির। দিন এনে দিন খায়। এদের মধ্যেও স্বপ্নহীন সবাই, তা নয়। কিন্তু মুশকিলটা হলো, হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয়তা ও বিত্তশালী হওয়া তাদের একজীবনে সম্ভব নয়—তারা নুহাশ পল্লীর মতো স্বপ্নভূমি রচনা করবে, কীভাবে?
আবার যাদের সাধ্য ছিল, তাদের মধ্যে বড় কোনো স্বপ্ন নেই। এদের বেশিরভাগই পার্টটাইম লেখক। এরা অর্থ-বিত্তের দৌড়ে ব্যর্থ হয়ে লেখক হিসেবে নাম কামানোর ফিকিরে ঘুরছেন। কেউ সাবেক অতিচতুর আমলা, কেউবা ক্ষুদ্রবুদ্ধির সাংবাদিক। এদের স্বার্থপর জীবনের ক্যানভাসও অতিক্ষুদ্র। সবকিছু দেখেন নিজেদের আত্মার সাইজে। বড় স্বপ্ন বড় কল্পনা ধারণ করার মতো মাথাও এদের নেই। অনেকটা বন্য বরাহের মতো। আত্মপরতার যে কাদাটুকু এরা নাগরিক কোলাহলে পেয়েছেন, সেই কাদা ঘেঁটেই এরা জীবন ধন্য মনে করেন। এদের মাথায় কীভাবে আসবে নাগরিক কোলাহলের বাইরে গভীর নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে মমতার রেণুমাখা একটি নুহাশ পল্লী সৃষ্টির।
চার.
শেক্সপিয়র দর্শনের জন্য যারা স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন গেছেন, তারা দেখে থাকবেন কীভাবে ছোট একটা শহরের পুরোটাই গড়ে উঠেছে শেক্সপিয়রকে নিয়ে। কী নেই সেখানে? আছে শেক্সপিয়রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, আছে সোয়ান থিয়েটার, আছে প্রেক্ষাগৃহ, আছে শপিংমল, আছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পর্যটন অফিস, গাইড, আরও কত কি! সারাবছরই চলছে নানা উত্সব। সেয়ান থিয়েটারে চলছে বিরতিহীন শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটকের বিরতিহীন পরিবেশনা, চলছে আবৃত্তির অনুষ্ঠান। মোট কথা, সে এক এলাহি কাণ্ড। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, কীভাবে শেক্সপিয়রকে নিয়ে মেতে আছে ব্রিটিশরা। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি দেশ-দেশান্তর থেকে প্রতিদিন গাড়ি ভরে ভরে পর্যটক যাচ্ছে স্ট্র্র্র্র্যাটফোর্ডে।
শান্তিনিকেতন যারা দেখেছেন, তারা আমার কথার সারবত্তা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
ভারত বা ব্রিটেনের মতো ইরানও তাদের বিভিন্ন শহরকে অনুপম করে সাজিয়ে রেখেছে বিভিন্ন কবির নামে। এক্ষেত্রে সিরাজনগরীর হাফিজ এভিনিউতে হাফিজ এবং সাদিয়ার শেখ সাদীকে নিয়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলোকে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের ও প্রিয় স্থান নুহাশ পল্লীকে গড়ে তোলার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তার পরিবার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে নুহাশ হয়ে উঠতে পারে ‘হুমায়ূন তীর্থ’; হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যরকম এক স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন; হয়ে উঠতে পারে একটা খাঁটি বাংলাদেশী শান্তিনিকেতন।
একটা চমত্কার মাস্টার প্ল্যানের আওতায় হুমায়ূনের এই প্রিয় নুহাশ পল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে হুমায়ূন আহমেদ মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, উন্মুক্ত থিয়েটার হল, প্রেক্ষাগৃহ, অ্যান্টিক শপ, গবেষণা কেন্দ্র, এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
ঢাকা থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকবে চমত্কার কোচ সার্ভিস। থাকবে পেশাদার গাইড। এই পর্যটকরা গিয়ে দেখবেন সেখানে দিনরাত চলছে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অমাবস্যার রাতে যেখানে মঞ্চস্থ হবে মিসির আলি বিষয়ক নাটক অথবা চলচ্চিত্র। পূর্ণিমার রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় চলবে হিমুকে নিয়ে নানা কাণ্ড। শরতে কিংবা চৈত্রের চন্দ্রিমা রাতে হবে সঙ্গীতের আসর। এভাবে মাসের প্রতিটি দিন কবে কী হবে, তার আগাম রুটিন জানিয়ে দেয়া হবে সবাইকে। সেই মোতাবেক ট্যুরিস্টরা যাবেন নুহাশ পল্লীতে। আবার এমনও হতে পারে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থের প্রতিটি দিন হুমায়ূনের এক একটি বইয়ের নামে অথবা চরিত্রের নামে হবে। যেমন- শঙ্খনীল কারাগার দিবস, মিসির আলি দিবস ইত্যাদি। সেদিনের পল্লী সাজবে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ বা চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে। এতে পর্যটন ভ্যালুও বাড়বে অনেকখানি। ঢাকার কোলাহল থেকে ক্ষণিক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নানা বয়সের নরনারীরা ছুটে যাবে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থে। নির্মল আনন্দের মধ্যে একটি দিন কাটিয়ে তারা ফিরে যাবেন কর্মজীবনে। বিদেশী ট্যুরিস্টরা ঢাকায় এসে বলবেন ‘হুমায়ূন তীর্থ নুহাশ পল্লী, বাংলাদেশ’ এ যাব।
একই সঙ্গে হুমায়ূনকে নিয়ে গবেষণার জন্য জমা হবেন গবেষকরা, গ্রন্থাগারে থাকবে হুমায়ূনের বই এবং হুমায়ূনকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থাদি। বাংলাদেশের সমাজ জীবন ও সংস্কৃতির উপর গ্রন্থরাজি। অর্থাত্ হুমায়ূনকে ঘিরে শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি পজিটিভ চর্চা যদি নুহাশ পল্লীতে শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশ যেমন পাবে ঘুরে দাঁড়ানো ও বেড়ানোর নতুন মাত্রা, তেমনি শান্তি পাবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মাও।
শাওন, শীলা, নোভা, বিপাশা, নুহাশ, নিষাদ, নিনিতরা কি এই লেখাটি পড়বে—আমি জানি না। যদি পড়ে এবং ছিটেফোঁটাও যদি বাস্তাবায়ন হয়, ধন্য মানব নিজেকে। আর এই যে কথাগুলো বললাম, সে আলোকে যদি বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে হুমায়ূনকে দাফন করার জন্য নুহাশ পল্লীই যথার্থ স্থান। এখন স্বাপ্নিক ও স্বপ্ন আমাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন