ছেলেটি থাকে দূর দ্বীপাঞ্চলের এক মফস্বল শহরে। সে স্বপ্ন দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তখনও সে কলেজের গণ্ডি পেরোয়নি। কিন্তু স্বপ্নটা তার আগে থেকেই। মামা মফিজুর রহমান অর্থনীতির বহু গ্রন্থের লেখক। জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি খ্যাতনামা। ছেলেটির মনে স্বপ্নটাও তখন থেকেই অঙ্কুরিত। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছর আগে সে ঢাকায় এসে একবার মানিক মামার রুমে গিয়েছিল ইকবাল হলে [স্বাধীনতার পর জহুরুল হক হল]। কী সুন্দর শান বাঁধানো ঘাটের বিশাল পুকুর হলের পেছনে। যেন দিঘি! বাতাসে তিরতির করছে টলটলে জল। বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসের ছাত্র মানিক মামা। ছায়াঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস কেমন নির্জন। এখানে-ওখানে স্বল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর দেখা মেলে। চারদিকে অথই সবুজ। পাখপাখালির কূজন। মানিক মামার কাছে এসেই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তীব্র পিপাসা জাগল। অথচ ছেলেটি তখনও স্কুলের ছাত্র। আর মফিজ মামা প্রেরণা হলেন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর।
মামা বললেন, ভালো রেজাল্ট করতে পারবি তো? যদি আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে অনার্স পড়। না হলে পিটিআই পাস করে স্কুলে শিক্ষকতায় ঢুকে যা এক্ষুণি। বাবা-মায়ের উপকার হবে। না হলে শুধু শুধু গরিবের অর্থের অপচয়। ছেলেটি কথা দেয় ভালো রেজাল্ট করবে। আগে তো ঢাকায় যাবে_ চিন্তাই করত না কেউ। সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী বলে কথা। সবাই স্বপ্ন দেখে ঢাকায় যাওয়ার। কেউ কেউ চিকিৎসাসহ নানা কাজে ঢাকামুখী হতে শুরু করেছে। যে আলীনগর গ্রামে দু'তিনজন মাত্র '৪৭ থেকে '৭১ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, পড়েছেন, সেই গ্রামের ছেলেটির মতো আরও দু'চারজন সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানীতে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেয় ওই অঞ্চলের। ছেলেটির বন্ধু রফিক ওদের বাড়িতে লজিং থেকেই আইএ পাস করেছে। সে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। প্রেরণা আরও বেড়ে যায় তার টানে। অভিভাবকরা প্রায় কেউ রাজি নন। অত দূরে, ব্যয়বহুল শহরে পড়তে যাবে এইটুকুন ছেলে! কিন্তু না, কোনো বাধাই বাধা নয় ইচ্ছার তীব্রতার কাছে। একদিন একটি ছোট্ট লঞ্চে উঠে পড়ল সে। হাতে ফুল-পাতা আঁকা রঙিন টিনের সুটকেস। আজকালকার মতো এত বিশালাকার লঞ্চ তখনও দ্বীপাঞ্চল থেকে ঢাকামুখো যাত্রা শুরু করেনি। দু'চারটি বড় লঞ্চ-স্টিমার যাতায়াত করত ঢাকা-বরিশাল-খুলনায়। অথচ পদ্মা-মেঘনা তখন কী ভয়াবহ উত্তাল! আজকালকার মতো নদী দখল ছিল না তখন। নদী ছিল বিশাল আর তার বুকে অধিকাংশ বাহন ছিল বিপজ্জনক একতলা, দেড়তলা লঞ্চ। দোতলা যে দু'চারটি, তাও কাঠবডির। প্রবল ঝাঁকুনি আর বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে দুলতে দুলতে প্রাণ হাতে নিয়ে যেন সদরঘাটে অনেক যাত্রীর সঙ্গে নামল ছেলেটি। এরপর দু'চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে সে দেখল রাজধানী শহর ঢাকা। একটা ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে হঠাৎ এত বড় শহরে! কৌতূহলী চোখে দেখতে দেখতে হেঁটে সদরঘাট পার হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক। পার্কের পুব পাশে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট লক্কড়ঝক্কড় পুরনো বাস। বলা হতো মুড়ির টিন। সেই মুড়ির টিনের একটিতে চেপে উত্তর যাত্রাবাড়ীর পথে যাত্রা। বাস যাবে আরও বহু দূরে, ডেমরা। ভিড় নেই। ভাড়া মাত্র চার আনা। ভাড়া দিয়ে নেমে বন্ধু রফিকের ঠিকানার সন্ধান। কাজলা, দনিয়া-কুতুবখালী তখন একেবারে গণ্ডগ্রাম। সেই দনিয়া পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এরপর রফিকের সাক্ষাৎ। কমার্সের ছেলে। পড়তে চায় ম্যানেজমেন্ট অথবা অর্থনীতিতে। সব ঠিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া বাংলাই পড়তে হলো ছেলেটিকে। সাহিত্যের নেশা তো আগে থেকেই ছিল, সেটা আরও বাড়ল প্রিয় বন্ধু সহপাঠী মোহাম্মদ সাদিকের নিবিড় সানি্নধ্যে। সে এসেছে সুদূর সুনামগঞ্জ থেকে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পেঁৗছতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়ায় তখন। সেই দূর পল্লীর ছেলেটি এমন সুন্দর কবিতা লেখে আর নজরুল, রবীন্দ্র, শরৎ সাহিত্যসহ পাঠ্যবহির্ভূত এত বই পড়েছে! ফাল্গুনীর 'চিতাবহ্নিমান' থেকে মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি' কী করে সে মেলায়। দুই সহপাঠী হরিহর আত্মা। দনিয়া গ্রামে মাতবর বাড়ি লজিং মাস্টার রফিক থেকে শুরু করে মোহাম্মদ সাদিকসহ আরও কত বন্ধু তার। কিন্তু সাহিত্যের বন্ধু সাদিকই।
গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশেই চুচিন চৌ রেস্তোরাঁ। তার মধ্যবর্তী স্থানে ভারতীয় তথ্যকেন্দ্র। বাংলা সাহিত্যসহ সব বিষয়ে অসংখ্য বইয়ের এক বিশাল ভাণ্ডার। সেখানে ছেলেটি রোজ পড়তে আসে। ক্লাসের পরে যেটুকু অবসর, এখানেই কাটায়। ১৬/১ লারমিনি স্ট্রিট থেকে আসে বন্ধু সাদিকও। পাঠ্যবহির্ভূত কত যে গল্প-উপন্যাসের জগতে ভ্রমণ, কত বিচিত্র প্রবন্ধ! রবীন্দ্রনাথ যে এত বড় চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক সেটাও জানা হতো না এখানে না এলে। এই লাইব্রেরিতে বহু ছাত্রছাত্রী রোজ পড়ছেন। পড়ছেন বয়স্ক পাঠকরাও। সেই ৩-৪টি বছরের পাঠ্যবহির্ভূত বাড়তি পড়া কীভাবে একটি যুবকের জীবনে অন্য আলো ফেলতে পারে, সে অভিজ্ঞতা কেবল তাদেরই আছে, যারা ওই নেশার জগতে ঢুকেছিলেন।
রাজধানী ঢাকায় আসার যে বিবরণ একটি স্বপ্নবাজ তরুণের তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে বলা হলো, সেই যাত্রায় লঞ্চ, মুড়ির টিন বাস কিংবা সেদিনের স্বল্প যানবাহন আর স্বল্প ভিড়ের এই নগরী, ফুটবলে উত্তাল স্টেডিয়ামের শহর ঢাকার গল্প শুধু এক যুবকের নয়, তার বয়সী আরও অনেকেরই তো একই গল্প। আজ ঢাকায় প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস। তীব্র যানজট আর বিপন্ন পরিবেশে বসে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকার চেহারা-চিত্র কল্পনাও করা যাবে না। গুলিস্তানে তখনও রেললাইন। ফুলবাড়িয়া থেকে তখনও মালটানা ট্রেন ছেড়ে যায়। যদিও কমলাপুর স্টেশন তখন চালু। নীলক্ষেত বাবুপুরা বস্তির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে বহুদূর চলে যাওয়া যেত। এতটা কুঁড়েমি বা আলসেমিও তখনও ছোঁয়নি নগরবাসীকে। হাঁটার একটা পরিবেশ এবং অভ্যাসও ছিল অনেকের মধ্যেই। এখন হাঁটার পরিবেশও নেই, অভ্যাসও নেই।
একটি তরুণকে কেন্দ্র করে সেই যে ঢাকার দিনরাত্রি, তার সঙ্গে জাড়িয়ে আছেন কত রথী-মহারথী! স্বনামখ্যাত কথাশিল্পী শওকত আলী আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তারুণ্যখচিত যাপিতজীবনের প্রত্যক্ষদর্শী আমরা তখন! আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রাহাত খান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তখন আমাদের স্বপ্নপুরুষ। স্বপ্নে উঁকি দেয় 'স্বপ্নস্বর্গ'। দুই সহপাঠীর একজন হয়ে যায় রঞ্জু আর একজন মেহবুব। স্বর্গের দেবী 'রানী' কিন্তু ঘিরে রাখে স্বপ্নজগৎ। দু'জন গোপনে ল্যান্ডফোনে গল্প বোনে একই কেন্দ্রে। চিঠি লেখে একই ঠিকানায়। কী তুখোড় তৃষ্ণা না দেখা সেই তরুণীর জন্য! উত্তর যাত্রাবাড়ীর 'বড়দি' কিংবা ৪৪ নং ধলপুরে যেতে যেতে হঠাৎ বন্ধু হানিফের অপূর্ব সুন্দরী ছাত্রীটির জন্য মন কেমন করা দিনরাত্রি কি এই ঢাকার বিবর্তনের মতোই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে? না অবচেতনে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে স্মৃতির মধ্যে!
এই শহর বিশেষ করে টিএসসি, রোকেয়া হলের সামনের চত্বরে মধ্য সত্তরে 'রাখাল'-এর আড্ডায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, ইসহাক খান, আহমদ আজিজ, সোহেল অমিতাভ, রেজা সেলিম, তুষার দাশসহ আরও কত তরুণ কবি আসতেন। আমাদের সেভাবে যাওয়া হতো না ওখানে। কিন্তু শরীফ মিয়ার চত্বরে, লাইব্রেরির পেছনে, জগন্নাথের কেন্টিনে কত কেন্দ্রে যে ছড়িয়ে পড়েছিল সৃজনশীলতার আগুন! তারপর একদিন ছেলেটা ছিটকে যায় আরও দূরে সাংবাদিকতার অঙ্গনে। সাদিকসহ কোনো কোনো বন্ধু বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে। জীবনের পথ ছড়িয়ে যায় সাপ্তাহিক গণমুক্তি থেকে বিটিভি আর ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান অঙ্গনে। কী অবিশ্বাস্য বাস্তব! সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, মোহাম্মদ মোদাব্বের, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, আবদুল আহাদ, সমর দাসের মতো বিখ্যাতদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ বেতারের 'যুবকণ্ঠের' জন্য। কোন দূর পল্লীর ছেলেটি নাগরিক হয়ে বিখ্যাতজনদের সানি্নধ্যে বেড়ে ওঠে ক্রমশ। দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীবের ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে চাকরি করা_ কী অবিশ্বাস্য সত্য! এভাবে যুবক বাড়তে থাকে বয়সের পথে, সাহিত্যের পথে, সাংবাদিকতার পথে আর ঢাকা শহর বাড়তে থাকে মেট্রোপলিটন সিটির দিকে, তারপর কসমোপলিটন দুঃসহ যানজটে আক্রান্ত আর আকাশ ঢেকে দেওয়া বহুতল ভবনে শ্বাসরুদ্ধকর এক বিশাল নগরীর দিকে। সেই নগরী নিঃশব্দে যেন আর্তনাদ করে চলে_ শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা...
মামা বললেন, ভালো রেজাল্ট করতে পারবি তো? যদি আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে অনার্স পড়। না হলে পিটিআই পাস করে স্কুলে শিক্ষকতায় ঢুকে যা এক্ষুণি। বাবা-মায়ের উপকার হবে। না হলে শুধু শুধু গরিবের অর্থের অপচয়। ছেলেটি কথা দেয় ভালো রেজাল্ট করবে। আগে তো ঢাকায় যাবে_ চিন্তাই করত না কেউ। সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী বলে কথা। সবাই স্বপ্ন দেখে ঢাকায় যাওয়ার। কেউ কেউ চিকিৎসাসহ নানা কাজে ঢাকামুখী হতে শুরু করেছে। যে আলীনগর গ্রামে দু'তিনজন মাত্র '৪৭ থেকে '৭১ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, পড়েছেন, সেই গ্রামের ছেলেটির মতো আরও দু'চারজন সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানীতে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেয় ওই অঞ্চলের। ছেলেটির বন্ধু রফিক ওদের বাড়িতে লজিং থেকেই আইএ পাস করেছে। সে ঢাকায় ভর্তি হয়েছে। প্রেরণা আরও বেড়ে যায় তার টানে। অভিভাবকরা প্রায় কেউ রাজি নন। অত দূরে, ব্যয়বহুল শহরে পড়তে যাবে এইটুকুন ছেলে! কিন্তু না, কোনো বাধাই বাধা নয় ইচ্ছার তীব্রতার কাছে। একদিন একটি ছোট্ট লঞ্চে উঠে পড়ল সে। হাতে ফুল-পাতা আঁকা রঙিন টিনের সুটকেস। আজকালকার মতো এত বিশালাকার লঞ্চ তখনও দ্বীপাঞ্চল থেকে ঢাকামুখো যাত্রা শুরু করেনি। দু'চারটি বড় লঞ্চ-স্টিমার যাতায়াত করত ঢাকা-বরিশাল-খুলনায়। অথচ পদ্মা-মেঘনা তখন কী ভয়াবহ উত্তাল! আজকালকার মতো নদী দখল ছিল না তখন। নদী ছিল বিশাল আর তার বুকে অধিকাংশ বাহন ছিল বিপজ্জনক একতলা, দেড়তলা লঞ্চ। দোতলা যে দু'চারটি, তাও কাঠবডির। প্রবল ঝাঁকুনি আর বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে দুলতে দুলতে প্রাণ হাতে নিয়ে যেন সদরঘাটে অনেক যাত্রীর সঙ্গে নামল ছেলেটি। এরপর দু'চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে সে দেখল রাজধানী শহর ঢাকা। একটা ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে হঠাৎ এত বড় শহরে! কৌতূহলী চোখে দেখতে দেখতে হেঁটে সদরঘাট পার হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক। পার্কের পুব পাশে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট লক্কড়ঝক্কড় পুরনো বাস। বলা হতো মুড়ির টিন। সেই মুড়ির টিনের একটিতে চেপে উত্তর যাত্রাবাড়ীর পথে যাত্রা। বাস যাবে আরও বহু দূরে, ডেমরা। ভিড় নেই। ভাড়া মাত্র চার আনা। ভাড়া দিয়ে নেমে বন্ধু রফিকের ঠিকানার সন্ধান। কাজলা, দনিয়া-কুতুবখালী তখন একেবারে গণ্ডগ্রাম। সেই দনিয়া পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এরপর রফিকের সাক্ষাৎ। কমার্সের ছেলে। পড়তে চায় ম্যানেজমেন্ট অথবা অর্থনীতিতে। সব ঠিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া বাংলাই পড়তে হলো ছেলেটিকে। সাহিত্যের নেশা তো আগে থেকেই ছিল, সেটা আরও বাড়ল প্রিয় বন্ধু সহপাঠী মোহাম্মদ সাদিকের নিবিড় সানি্নধ্যে। সে এসেছে সুদূর সুনামগঞ্জ থেকে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পেঁৗছতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়ায় তখন। সেই দূর পল্লীর ছেলেটি এমন সুন্দর কবিতা লেখে আর নজরুল, রবীন্দ্র, শরৎ সাহিত্যসহ পাঠ্যবহির্ভূত এত বই পড়েছে! ফাল্গুনীর 'চিতাবহ্নিমান' থেকে মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি' কী করে সে মেলায়। দুই সহপাঠী হরিহর আত্মা। দনিয়া গ্রামে মাতবর বাড়ি লজিং মাস্টার রফিক থেকে শুরু করে মোহাম্মদ সাদিকসহ আরও কত বন্ধু তার। কিন্তু সাহিত্যের বন্ধু সাদিকই।
গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশেই চুচিন চৌ রেস্তোরাঁ। তার মধ্যবর্তী স্থানে ভারতীয় তথ্যকেন্দ্র। বাংলা সাহিত্যসহ সব বিষয়ে অসংখ্য বইয়ের এক বিশাল ভাণ্ডার। সেখানে ছেলেটি রোজ পড়তে আসে। ক্লাসের পরে যেটুকু অবসর, এখানেই কাটায়। ১৬/১ লারমিনি স্ট্রিট থেকে আসে বন্ধু সাদিকও। পাঠ্যবহির্ভূত কত যে গল্প-উপন্যাসের জগতে ভ্রমণ, কত বিচিত্র প্রবন্ধ! রবীন্দ্রনাথ যে এত বড় চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক সেটাও জানা হতো না এখানে না এলে। এই লাইব্রেরিতে বহু ছাত্রছাত্রী রোজ পড়ছেন। পড়ছেন বয়স্ক পাঠকরাও। সেই ৩-৪টি বছরের পাঠ্যবহির্ভূত বাড়তি পড়া কীভাবে একটি যুবকের জীবনে অন্য আলো ফেলতে পারে, সে অভিজ্ঞতা কেবল তাদেরই আছে, যারা ওই নেশার জগতে ঢুকেছিলেন।
রাজধানী ঢাকায় আসার যে বিবরণ একটি স্বপ্নবাজ তরুণের তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে বলা হলো, সেই যাত্রায় লঞ্চ, মুড়ির টিন বাস কিংবা সেদিনের স্বল্প যানবাহন আর স্বল্প ভিড়ের এই নগরী, ফুটবলে উত্তাল স্টেডিয়ামের শহর ঢাকার গল্প শুধু এক যুবকের নয়, তার বয়সী আরও অনেকেরই তো একই গল্প। আজ ঢাকায় প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস। তীব্র যানজট আর বিপন্ন পরিবেশে বসে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকার চেহারা-চিত্র কল্পনাও করা যাবে না। গুলিস্তানে তখনও রেললাইন। ফুলবাড়িয়া থেকে তখনও মালটানা ট্রেন ছেড়ে যায়। যদিও কমলাপুর স্টেশন তখন চালু। নীলক্ষেত বাবুপুরা বস্তির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে বহুদূর চলে যাওয়া যেত। এতটা কুঁড়েমি বা আলসেমিও তখনও ছোঁয়নি নগরবাসীকে। হাঁটার একটা পরিবেশ এবং অভ্যাসও ছিল অনেকের মধ্যেই। এখন হাঁটার পরিবেশও নেই, অভ্যাসও নেই।
একটি তরুণকে কেন্দ্র করে সেই যে ঢাকার দিনরাত্রি, তার সঙ্গে জাড়িয়ে আছেন কত রথী-মহারথী! স্বনামখ্যাত কথাশিল্পী শওকত আলী আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তারুণ্যখচিত যাপিতজীবনের প্রত্যক্ষদর্শী আমরা তখন! আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রাহাত খান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তখন আমাদের স্বপ্নপুরুষ। স্বপ্নে উঁকি দেয় 'স্বপ্নস্বর্গ'। দুই সহপাঠীর একজন হয়ে যায় রঞ্জু আর একজন মেহবুব। স্বর্গের দেবী 'রানী' কিন্তু ঘিরে রাখে স্বপ্নজগৎ। দু'জন গোপনে ল্যান্ডফোনে গল্প বোনে একই কেন্দ্রে। চিঠি লেখে একই ঠিকানায়। কী তুখোড় তৃষ্ণা না দেখা সেই তরুণীর জন্য! উত্তর যাত্রাবাড়ীর 'বড়দি' কিংবা ৪৪ নং ধলপুরে যেতে যেতে হঠাৎ বন্ধু হানিফের অপূর্ব সুন্দরী ছাত্রীটির জন্য মন কেমন করা দিনরাত্রি কি এই ঢাকার বিবর্তনের মতোই জীবন থেকে হারিয়ে গেছে? না অবচেতনে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে স্মৃতির মধ্যে!
এই শহর বিশেষ করে টিএসসি, রোকেয়া হলের সামনের চত্বরে মধ্য সত্তরে 'রাখাল'-এর আড্ডায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, ইসহাক খান, আহমদ আজিজ, সোহেল অমিতাভ, রেজা সেলিম, তুষার দাশসহ আরও কত তরুণ কবি আসতেন। আমাদের সেভাবে যাওয়া হতো না ওখানে। কিন্তু শরীফ মিয়ার চত্বরে, লাইব্রেরির পেছনে, জগন্নাথের কেন্টিনে কত কেন্দ্রে যে ছড়িয়ে পড়েছিল সৃজনশীলতার আগুন! তারপর একদিন ছেলেটা ছিটকে যায় আরও দূরে সাংবাদিকতার অঙ্গনে। সাদিকসহ কোনো কোনো বন্ধু বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে। জীবনের পথ ছড়িয়ে যায় সাপ্তাহিক গণমুক্তি থেকে বিটিভি আর ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান অঙ্গনে। কী অবিশ্বাস্য বাস্তব! সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, মোহাম্মদ মোদাব্বের, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, আবদুল আহাদ, সমর দাসের মতো বিখ্যাতদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ বেতারের 'যুবকণ্ঠের' জন্য। কোন দূর পল্লীর ছেলেটি নাগরিক হয়ে বিখ্যাতজনদের সানি্নধ্যে বেড়ে ওঠে ক্রমশ। দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীবের ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে চাকরি করা_ কী অবিশ্বাস্য সত্য! এভাবে যুবক বাড়তে থাকে বয়সের পথে, সাহিত্যের পথে, সাংবাদিকতার পথে আর ঢাকা শহর বাড়তে থাকে মেট্রোপলিটন সিটির দিকে, তারপর কসমোপলিটন দুঃসহ যানজটে আক্রান্ত আর আকাশ ঢেকে দেওয়া বহুতল ভবনে শ্বাসরুদ্ধকর এক বিশাল নগরীর দিকে। সেই নগরী নিঃশব্দে যেন আর্তনাদ করে চলে_ শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা...
সূত্র : সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন