পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এখন বাংলাদেশেও ১৪ই ফেব্রুয়ারি “ভ্যালেন্টাইনস্ ডে তথা ভালবাসা দিবস” পালন করা হচ্ছে। তথাকথিত প্রেম পিয়াসী তরুণ তরুণীরা নানা ধরনের অশ্লীলতা বেহায়াপনা ও নোংরামির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশে প্রথম এ দিবসটি আমদানী করে তৎকালীন দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান।
ভ্যালেন্টাইনস্ ডে বা ভালবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য মতামত হল- খ্রিস্টান ধর্মে সবচেয়ে ভালো মানুষ হলো গীর্জার সেইন্ট কিংবা পাদ্রীরা। এ সকল ভালো মানুষদের বিয়ে করা নিষেধ। এমনই একজন ভালো মানুষ ছিলেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন গোপনে এক সুন্দরী নারীর সাথে অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন সেই মেয়েটিকে বিবাহ করেছিলেন। যেহেতু বিয়ে করা বৈধ ছিলো না তাই এই অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়। খ্রিস্ট সমাজের ধর্মযাজকেরা আজো ভ্যালেন্টাইনকে নিকৃষ্ট অপরাধী মনে করেন। তাদের মতে সেইন্ট নিজেকে ভালো রাখতে পারেননি। সাধারণ মানুষরা তার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছে বলে তারা এই দিনটিকে দীর্ঘদিন যাবৎ স্মরণে রেখেছে।
সেইন্ট কিংবা পাদ্রীদের বিয়ে না করার কারণ হলো, তারা নিজেদেরকে তাদের নবী ঈসা আ. ও মরিয়ম আ. এর উত্তরসূরী মনে করেন। অর্থাৎ বিয়ে না করা তাদের নবীর সুন্নাত, সাওয়াবের কাজ এবং ধর্মগুরুদের বিয়ে করা পাপের কাজ মনে করা হয়। এসব কিছু জানার পরও সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন বিয়ে করেছেন। সুতরাং তাকে তো শাস্তি পেতে হবেই।
বিবাহ সম্পর্কে আল্লাহর বিধানঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তাঁর নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে মানসিক শান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রূম-২১)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে একটি দেহ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্য স্বয়ং সেই বস্তু থেকে তেরি করেছেন একটি জোড়া। যেনো তোমরা তার কাছ থেকে শান্তি ও আরাম হাসিল করতে পারো। (সূরা আ’রাফ-১৮)।
সূরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, "তারা হচ্ছে তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক।"
পাঠক লক্ষ করুন, এখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পরস্পরের পোশাক বলা হয়েছে। পোশাক যেমন শরীরের সাথে মিশে থাকে, শরীরকে ঢেকে রাখে, মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং বাহিরের ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে, তেমনি বিবাহিত নারী-পুরুষের অন্তর ও আত্মা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। একে অপরের গোপনীয়তা এবং মান-সম্মান, ইজ্জত, আব্রু রক্ষা করে। এটাই প্রেম-ভালোবাসা ও আন্তরিকতার দাবি।
আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা. ও বিবাহ করাকে উৎসাহ দিয়েছেন। এজন্য মুসলিম সমাজে বিবাহ করা সহজ, এমনকি সাওয়ারের কাজ এবং ব্যভিচার কঠিন অপরাধ। অন্যদিকে খ্রিস্ট সমাজে বিবাহ করা কঠিন কিন্তু ব্যভিচার খুবই সহজলভ্য। বিবাহের মাধ্যমেই একটি সুন্দর-সুখী পরিবার এবং একটি সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে উঠতে পারে। আর ব্যভিচার এমন একটি কাজ যা সমাজ সংসার ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে পারে। রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা যারা বিবাহ করার বয়সে উপনীত হয়েছো, তাদের যদি ভরণ পোষনের সামর্থ্য থাকে তবে যেন তারা বিয়ে করে নেয়।'
ভ্যালেন্টাইনস্ ডে মূলত একটি কঠিন অন্যায়ের প্রতিবাদ দিবস। মানুষের মৌলিক অধিকার বিবাহ করার অপরাধে যদি কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তাহলে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে?
আজ যারা ভ্যালেন্টাইনস্ ডে পালন করছে তাদের বিকৃত মন-মানসিকতা দেখে। এই দিনটি কী ? কোনো উদযাপন করে তারা কিছুই জানে না। এইদিন নিয়ে হৈ চৈ, মাতামাতি করে। কোমলমতি তরুণ-তরুণীরা কিছু না জেনে না বুঝেই পাশ্চাত্যের ধুতরার ফুলকে গন্ধরাজ মনে করে হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছে। এ দিনের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, এটি প্রকাশ্যে ‘নির্লজ্জতার চর্চা’ দিবস। কী নির্লজ্জের মতো যুবক-যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় বিভিন্ন স্পটে অশালীন ভাবে অবস্থান করে। বিনোদন স্পটগুলোতে যেনো নির্লজ্জতার প্রতিযোগিতা চলে। তাদের বেহায়াপনা দেখে শয়তানও লজ্জা পায়। আর কিছুদিন পর তাদের ‘ভালোবাসার ফসল’ গুলো ডাস্টবিনে, ব্রিফকেস ভর্তি, ব্যাগ ভর্তি রাস্তার মোড় সহ বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
অথবা এদেরই ভিড় দেখা যায় হাইকোর্ট, জজকোর্ট আর মানবাধিকার আদালতে। যে মামলা গুলো করা হয় সেগুলোর বাদী বিবাদী একসময় অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। একে অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত ছিলো। বহু ভালোবাসা দিবস রজনীর মধুর স্মৃতি এদের হৃদয়ে রয়েছে। এদের অশ্লীল আর অনৈতিক মেলামেশার বহু সাক্ষীও রয়েছে। আচ্ছা এ কেমন ভালোবাসা ছিল তাদের মাঝে? যারা এক সময় একে অপরের দুষমন হয়ে যায়? সময়ের সাথে ভালোবাসাতো তাদেরই ফুরোয় যারা শুধুমাত্র কিছু সময়ের জন্য একে অন্যকে কাছে পেতে চেয়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটানোর জন্যই কাছে এসেছে।
পাঠকদের প্রতি প্রশ্ন, আচ্ছা, ভালোবাসার জন্য কি কোন দিবস লাগে? কাউকে ভালোবাসার জন্য কি দিন-তারিখ ঠিক করে ভালোবাসতে হবে? ভালোবাসাতো প্রাণের সম্পদ। বাবা-মাকে ভালোবাসা, ভাই-বোনকে ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের গভীর ভালোবাসা থাকতে হবে। বড়দেরকে শ্রদ্ধা এবং ছোটদেরকে আদর স্নেহ করতে হবে। শ্রদ্ধা স্নেহ এসব তো ভালোবাসারই ভিন্ন রূপ, ভিন্ন নাম। ভালোবাসা দিবসের নামে বেহায়াপনা করার শিক্ষা যারা আমাদের দেয় তারা কি সত্যিকারার্থে ভালোবাসতে জানে? ‘ভালোবাসা’ ওদের ভাষায় আছে, চরিত্রে নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ‘আমাদের জন্মই হয়েছে ভালোবাসার মাধ্যমে।’ আমাদের জীবন জুড়েই রয়েছে ভালোবাসা, যার জন্য কোন দিনের প্রয়োজন পড়ে না। অথচ আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে চিত্তবিনোদনের নামে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি পূজা, প্রগতির নামে নগ্নতা, লটারীর নামে জুয়া আর চিন্তার স্বাধীনতার নামে আল্লাহদ্রোহিতার চর্চা, উদারতার নামে ব্যভিচারের প্রসারতা।
রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে তার হাশর হবে সেই জাতির সাথে।’ তবে যারা আজ অন্যদের অপসংস্কৃতি জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন, থার্টিফাস্ট নাইটের মত অপসংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতিতে এনে পালন করছেন তাদের অবস্থা কি হবে সেদিন?
নিরিবিলি বসুন। চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন একবার। আপনি কি করছেন? আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন। আপনিও কি বিভিন্ন বিজাতীয় সংস্কৃতি লালন পালন করছেন না তো? অন্যকে করতে উৎসাহিত করছেন না তো? এখনো সময় আছে, অন্যায় থেকে ফিরুন। অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকুন। বিজাতীয় সংস্কৃতিকে 'না' বলুন। ইসলামী সংস্কৃতিতে প্রবেশ করুন। ইসলামী সংস্কৃতি কোন দিবস নির্ভর সংস্কৃতি নয়। ইসলাম তো আলো বা ‘নূর’। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, ‘তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তার নূরকে বিকশিত করবেন-ই।’
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন