লোকটা নাকি জাদুকর। দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো। বড় বড় চুল আর দাড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চুল শুকাতে দেয়। সেই চুল এতো বড় যে, পৃথিবী অব্দি চলে আসে।
পৃথিবী একটা সবুজ গ্রহ। সেটার প্রতি সবার লোভ। সেখানে মানুষের বাস। ওই গ্রহের সবাই ভাবে, পৃথিবীটা দখল করার জন্যই বুঝি বুড়োর এই পাঁয়তারা, ফন্দি-ফিকির। চুলের মায়াজাল ফেলে পৃথিবীকে বশ করতে চায় সে। আবার কেউ কেউ বলে, আগে চুল ফেলে পৃথিবীর প্রতিক্রিয়া পরখ করে নিচ্ছে সে। তেমন প্রতিবাদ না দেখলে আস্তে ধীরে পা ফেলবে। তারপর সারা শরীর। ধীরে ধীরে দখল করে নেওয়ার বুদ্ধি।
পৃথিবীর মানুষজন তো আর বোকা নয়! ধরে ফেললো জাদুকরের বুদ্ধি। ভাবলো, বুড়োকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে লাগিয়ে দিলো বুড়োর চুলে। ধিকিধিকি জ্বলতে লাগলো সেই আগুন। ছড়াতে লাগলো। চুল বেয়ে বেয়ে আগুন পেঁৗছে গেলো বুড়োর মাথা পর্যন্ত।
লক্ষ লক্ষ চুল বেয়ে আগুন যখন মাথায় পেঁৗছালো, তখন বিরাট অগি্নপিণ্ডে পরিণত হলো। কত্তো বিরাট? বোঝানো কষ্টকর। যারা সূর্য দেখেছো, তারাই বুঝবে! সেখানে আগুনের শিখা দাউদাউ জ্বলছে। কিন্তু তবুও পুড়ছে না মুখ। জাদুকরের মুখ বলে কথা!
দিনভর জ্বলে সেই চুল। এতো মিহি চুল_ খালি চোখে ধরা পড়ে না। সবুজ পাতার ফাঁক গলে কেউ তাকালে শুধু চোখে পড়ে সূক্ষ্ম রেখার মতো চুল। অবশ্য তাপ ঠিকই টের পাওয়া যায়। দুপুর হলে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। চুলগুলো ধরে টানাটানি শুরু করে। টানতে টানতে নামিয়ে আনে বুড়োকে নিচে।
কিন্তু জাদুকর বলে কথা! নামানো কি এতো সোজা! বড়শিতে মাছ ধরা পড়লে কতো কসরত করে তুলতে হয়; কত্তো সময় লাগে! তাই নামতে নামতে সন্ধ্যা। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, যাক জাদুকরের হাত থেকে বাঁচা গেলো। তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফেরে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমোতে যায়।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! মানুষ অজ্ঞান হলে যে রকম মাথায় পানি দেওয়া হয়, জাদুকরকেও সে রকম ঢালা হয়। তবে বিন্দু বিন্দু। ফলে অজ্ঞান ভাব কাটে তার। আবার জেগে ওঠে। ভোর বেলা। পুবদিকে। যদিও তাকে টেনে নামানো হয়েছিলো পশ্চিমে। কিন্তু ভেসে ওঠে পূর্বে। কীভাবে, জানো? পৃথিবীর মানুষ তো মারমুখী হয়ে তাকে নামিয়ে আনলো। সে ভয় পেলো খুব। সুড়ঙ্গে লুকালো। তারপর পথ হারিয়ে ফেললো। সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে ভেসে ওঠলো পূর্বে। ভয়ে আর উদ্বেগে চোখমুখ লাল।
আকাশ মাঝে মাঝে কালো চাদরে ঢেকে দেয় বুড়োকে। পৃথিবী তখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে, গুণ্ডা সূর্যটা বুঝি নেই! কিন্তু সূর্য তো জাদুকর। এইসব আড়াল কি তার সহ্য হয়? এক সময় ঠিকই আড়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসে। মেঘের ফাঁকে ফিক করে হাসি দেয়। টিটকিরি মেরে বলে, 'কী, পারলে আমাকে চাপা দিয়ে রাখতে? ছাই দিয়ে কি আগুন চেপে রাখা যায়?'
অবশ্য জাদুকর যে সব সময় জেতে, তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে মেঘের সঙ্গে বেধে যায় ধুন্ধুমার যুদ্ধ। কড়কড় শব্দ করে একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনের হাতের তরবারিতে আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে কিড়মিড় করে। সে কী বিকট শব্দ! দুজনের সংঘর্ষ দেখে বাতাস পর্যন্ত ছুটে পালাতে চায়। গাছপালা ভয়ে তটস্থ। কাঁপতে থাকে। নারকেল গাছ দুহাত জোড় করে মিনতি করে, 'আমায় বাঁচাও। তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।'
বাতাসের বয়েই গেলো এসব উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে!
এ যুদ্ধ কখনও চলে দশ-পনেরো মিনিট। কখনও এক-দুই ঘণ্টা। তারপর সব শুনসান। সন্ধি হয় দুই পক্ষে। শান্ত হয় বাতাস। জাদুকরকে তখন অনেক ঝলমলে, উজ্জ্বল মনে হয়। যেন পুরনো শার্টকে কাপড় কাচার সাবান দিয়ে ঝকঝকে করে ধোয়া হয়েছে। দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঝড় জলের ওয়াশিং মেশিনে গাছের পাতাগুলো ঝকমকে ধোয়া হয়ে যায়। পরদিন পাতাগুলো জাদুকরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে, 'আমাকে একটু উত্তাপ দাও। আলো দাও।'
_কী করবে তুমি উত্তাপ আর আলো দিয়ে?
_রান্না করবো।
_কী রান্না করবে?
_খাবার।
_তোমার নিজের জন্য? সে জন্য তোমার এক-সূর্য আলো দরকার?
_শুধু কি আমার নিজের জন্য?
_তাহলে আর?
_আর রাঁধবো সারা পৃথিবীর জন্য। সব প্রাণীর জন্য।
_বলো কী! সারা পৃথিবীর জন্য রান্না করছো তুমি! তাহলে তো তোমার চুলা অনেক বড়। কোথায় রেখেছো তোমার সেই বিশাল চুলা?
_এই যে আমার শিরায় শিরায়। সব পাতাতে ছড়িয়ে রাখা। সবাই ভাগাভাগি করে নিলে বিশাল কাজও সাধ্যের মধ্যে চলে আসে।
_এতো বড় কাজ করলে তো আমরা হুলস্থূল বাধিয়ে দিতাম। তোমাদের ভাব দেখে তো বোঝাই যায় না।
_কাজটা করি আমরা অন্তর থেকে। ভেতরে ভেতরে। বাহিরে তাই হাঁকডাক নেই। ভালোবেসে কোনো কাজ করলে এ রকমই ঘটে। চুপচাপ। কিন্তু নিখাদ আর নির্ভুল।
জাদুকরের আলো মসৃণ পাতায় পড়ে ঠিকরে যায়। একটু বিষণ্ন হয়। সে ভেবেছিলো, সবার মধ্যে সে-ই সেরা। এখন বুঝলো, তার ধারণা ভুল। ফলাও না করলেও অথবা চকচক না করেও অনেকে অনেক বড় কাজ করছে। করে যাচ্ছে। চুপচাপ, নীরবে-নিভৃতে।
সূত্র : সমকাল
পৃথিবীর মানুষজন তো আর বোকা নয়! ধরে ফেললো জাদুকরের বুদ্ধি। ভাবলো, বুড়োকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে লাগিয়ে দিলো বুড়োর চুলে। ধিকিধিকি জ্বলতে লাগলো সেই আগুন। ছড়াতে লাগলো। চুল বেয়ে বেয়ে আগুন পেঁৗছে গেলো বুড়োর মাথা পর্যন্ত।
লক্ষ লক্ষ চুল বেয়ে আগুন যখন মাথায় পেঁৗছালো, তখন বিরাট অগি্নপিণ্ডে পরিণত হলো। কত্তো বিরাট? বোঝানো কষ্টকর। যারা সূর্য দেখেছো, তারাই বুঝবে! সেখানে আগুনের শিখা দাউদাউ জ্বলছে। কিন্তু তবুও পুড়ছে না মুখ। জাদুকরের মুখ বলে কথা!
দিনভর জ্বলে সেই চুল। এতো মিহি চুল_ খালি চোখে ধরা পড়ে না। সবুজ পাতার ফাঁক গলে কেউ তাকালে শুধু চোখে পড়ে সূক্ষ্ম রেখার মতো চুল। অবশ্য তাপ ঠিকই টের পাওয়া যায়। দুপুর হলে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। চুলগুলো ধরে টানাটানি শুরু করে। টানতে টানতে নামিয়ে আনে বুড়োকে নিচে।
কিন্তু জাদুকর বলে কথা! নামানো কি এতো সোজা! বড়শিতে মাছ ধরা পড়লে কতো কসরত করে তুলতে হয়; কত্তো সময় লাগে! তাই নামতে নামতে সন্ধ্যা। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, যাক জাদুকরের হাত থেকে বাঁচা গেলো। তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফেরে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমোতে যায়।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! মানুষ অজ্ঞান হলে যে রকম মাথায় পানি দেওয়া হয়, জাদুকরকেও সে রকম ঢালা হয়। তবে বিন্দু বিন্দু। ফলে অজ্ঞান ভাব কাটে তার। আবার জেগে ওঠে। ভোর বেলা। পুবদিকে। যদিও তাকে টেনে নামানো হয়েছিলো পশ্চিমে। কিন্তু ভেসে ওঠে পূর্বে। কীভাবে, জানো? পৃথিবীর মানুষ তো মারমুখী হয়ে তাকে নামিয়ে আনলো। সে ভয় পেলো খুব। সুড়ঙ্গে লুকালো। তারপর পথ হারিয়ে ফেললো। সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে ভেসে ওঠলো পূর্বে। ভয়ে আর উদ্বেগে চোখমুখ লাল।
আকাশ মাঝে মাঝে কালো চাদরে ঢেকে দেয় বুড়োকে। পৃথিবী তখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে, গুণ্ডা সূর্যটা বুঝি নেই! কিন্তু সূর্য তো জাদুকর। এইসব আড়াল কি তার সহ্য হয়? এক সময় ঠিকই আড়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসে। মেঘের ফাঁকে ফিক করে হাসি দেয়। টিটকিরি মেরে বলে, 'কী, পারলে আমাকে চাপা দিয়ে রাখতে? ছাই দিয়ে কি আগুন চেপে রাখা যায়?'
অবশ্য জাদুকর যে সব সময় জেতে, তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে মেঘের সঙ্গে বেধে যায় ধুন্ধুমার যুদ্ধ। কড়কড় শব্দ করে একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনের হাতের তরবারিতে আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে কিড়মিড় করে। সে কী বিকট শব্দ! দুজনের সংঘর্ষ দেখে বাতাস পর্যন্ত ছুটে পালাতে চায়। গাছপালা ভয়ে তটস্থ। কাঁপতে থাকে। নারকেল গাছ দুহাত জোড় করে মিনতি করে, 'আমায় বাঁচাও। তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।'
বাতাসের বয়েই গেলো এসব উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে!
এ যুদ্ধ কখনও চলে দশ-পনেরো মিনিট। কখনও এক-দুই ঘণ্টা। তারপর সব শুনসান। সন্ধি হয় দুই পক্ষে। শান্ত হয় বাতাস। জাদুকরকে তখন অনেক ঝলমলে, উজ্জ্বল মনে হয়। যেন পুরনো শার্টকে কাপড় কাচার সাবান দিয়ে ঝকঝকে করে ধোয়া হয়েছে। দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঝড় জলের ওয়াশিং মেশিনে গাছের পাতাগুলো ঝকমকে ধোয়া হয়ে যায়। পরদিন পাতাগুলো জাদুকরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে, 'আমাকে একটু উত্তাপ দাও। আলো দাও।'
_কী করবে তুমি উত্তাপ আর আলো দিয়ে?
_রান্না করবো।
_কী রান্না করবে?
_খাবার।
_তোমার নিজের জন্য? সে জন্য তোমার এক-সূর্য আলো দরকার?
_শুধু কি আমার নিজের জন্য?
_তাহলে আর?
_আর রাঁধবো সারা পৃথিবীর জন্য। সব প্রাণীর জন্য।
_বলো কী! সারা পৃথিবীর জন্য রান্না করছো তুমি! তাহলে তো তোমার চুলা অনেক বড়। কোথায় রেখেছো তোমার সেই বিশাল চুলা?
_এই যে আমার শিরায় শিরায়। সব পাতাতে ছড়িয়ে রাখা। সবাই ভাগাভাগি করে নিলে বিশাল কাজও সাধ্যের মধ্যে চলে আসে।
_এতো বড় কাজ করলে তো আমরা হুলস্থূল বাধিয়ে দিতাম। তোমাদের ভাব দেখে তো বোঝাই যায় না।
_কাজটা করি আমরা অন্তর থেকে। ভেতরে ভেতরে। বাহিরে তাই হাঁকডাক নেই। ভালোবেসে কোনো কাজ করলে এ রকমই ঘটে। চুপচাপ। কিন্তু নিখাদ আর নির্ভুল।
জাদুকরের আলো মসৃণ পাতায় পড়ে ঠিকরে যায়। একটু বিষণ্ন হয়। সে ভেবেছিলো, সবার মধ্যে সে-ই সেরা। এখন বুঝলো, তার ধারণা ভুল। ফলাও না করলেও অথবা চকচক না করেও অনেকে অনেক বড় কাজ করছে। করে যাচ্ছে। চুপচাপ, নীরবে-নিভৃতে।
সূত্র : সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন