নৌকা দুটির বয়স হাজার বছরের উপরে বলে অনুমান করা হয়।
সংগৃহীত নৌকা দুটির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ৫০টি নৌকার কোনো মিল নেই। কেবল ছাতক-সুনামগঞ্জে প্রচলিত জৈন্তাপুরী নৌকার সঙ্গে এর কিছু সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়
রকস মিউজিয়াম। পাহাড় বা পর্বত নয়_ পাথর এবং তার সূত্র ধরে আমাদের সভ্যতার আদিতে পেঁৗছতে হলে আপনাকে আসতে হবে এ জাদুঘরে। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের বিশালায়তন উঠানে গড়ে তোলা হয়েছে এ মিউজিয়াম। সারি করে রাখা হয়েছে নানা আকার, প্রকৃতি ও রঙের অনেক পাথর। যার নামকরণ করা হয়েছে 'রকস মিউজিয়াম'। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ও পরিকল্পনায় এ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক মিউজিয়ামটি গড়ে তুলেছেন। নিজের চেষ্টা আর অর্থে তিনি ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ এ মিউজিয়ামটি গড়ে তোলেন। পরে জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক শামসুজ্জামান খান ও আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হেনরি গাসি এ মিউজিয়ামের 'ফোকলোর ও জাতিতত্ত্ব' বিভাগ উদ্বোধন করেন। যার মেধা, মনন ও একাগ্রতায় এটি গড়ে উঠেছে তিনি শিক্ষাবিদ ড. নাজমুল হক। সাহিত্যের লোক হয়েও প্রত্নতাত্তি্বক এবং ভূ ও খনিজ পদার্থের গবেষক হতে যার আগ্রহ একটুও বাধা হয়ে ওঠেনি। এখন উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এ জাদুঘর।
যেভাবে শুরু
পঞ্চগড় শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে লাঠুয়াপাড়া গ্রামে মহিলা কলেজের কর্মচারী তবিবর রহমানের জমিতে পড়ে থাকা দুটি বিশালায়তনের বেলে ও গ্রানাইট পাথর সংগ্রহের মাধ্যমে নাজমুল হক শুরু করেন এ জাদুঘরের কাজ। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি গড়ে তোলেন দুর্লভ সংগ্রহের একটি জাদুঘর। অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি কোনো সহকর্মীর মোটরসাইকেলে চড়ে চলে যেতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যার নিয়ন্ত্রণে পাথর থাকে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কখনও পাথরের বিনিময়ে কাঠ দিয়ে, কখনও পাথরের পাশে দাতার নাম লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনও স্বল্পমূল্য প্রদান করে তুলে নিয়ে আসেন পাথর। পরে তা গরু-মহিষের গাড়ি অথবা রিকশা-ভ্যানে করে নিয়ে আসতেন কলেজ ক্যাম্পাসে। সহকর্মীরা প্রথমে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন; কিন্তু যেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক এটি দেখতে এসে প্রশংসা করলেন, সেদিনই শুরু হয়েছে মিউজিয়ামের সুদিন। সহকর্মীরাও বাড়িয়েছেন সহযোগিতার হাত। বিশেষত, আমিরুল ইসলাম, তৌহিদুল বারী, নূর ইসলামসহ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা।
মিউজিয়ামে যা আছে
প্রস্তর সংগ্রহে সমৃদ্ধ এ ধরনের জাদুঘর বাংলাদেশে প্রথম তো বটেই, এমনকি উপমহাদেশে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। এই জাদুঘরে সংগৃহীত শিলা বা পাথরের মধ্যে শুধু কোটি বছরের ভূতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিশালায়তন প্রস্তর খণ্ডই নয় বরং হাজার হাজার বছর পুরনো ঐতিহাসিক নৃতাত্তি্বক ও প্রত্নতাত্তি্বক প্রস্তর সংগ্রহও রয়েছে বিপুল পরিমাণে। এছাড়া রয়েছে এ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত কয়েক হাজার বছর বয়সী বিভিন্ন নিদর্শন ও জাতিতাত্তি্বক উপকরণ। মিউজিয়ামটি দুই ভাগে বিভক্ত। কলেজ ক্যাম্পাসের বহিরাঙ্গন এবং কলেজের একটি কক্ষে মিউজিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে। দুটি অংশে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আকৃতির বেলেপাথর, কাদাপাথর, গ্রানাইট, ব্যাসল্ট, সিস্ট, কার্বন, কোয়ার্জাইট, সিলিকন, প্যাট্রিফাইডসহ বিচিত্র নামের পাথর। এগুলোর কোনোটির ওজন এক টন থেকে দুই টন পর্যন্ত। প্রতিটি পাথরের আলাদা আলাদা বিশেষত্ব আছে। যেমন_ ক্লে রকস বা কাদা থেকে রূপান্তরিত পাথরের যে নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। তার বয়স কম করে হলেও ২০ লাখ বছর। বৃক্ষ জমাট বেঁধে রূপান্তরিত পাথরের [প্যাট্রিফাইড] বয়স ২৫ লাখ বছরের কম নয়। ক্লে রকস দুই টন ওজনের আর প্যাট্রিফাইড পাথর অন্তত ১০ মণ ওজন সম্পন্ন। গ্রানাইট পাথরের বড় বড় চাঁই বা ছোট পাহাড় সাধারণত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় কোনো কোনো পাহাড়ে, সুইজারল্যান্ড এবং কানাডায় দেখা যায়। কিন্তু পঞ্চগড়ের মতো একটি সমতলীয় স্থানে এ ধরনের বিশাল পাথর বেশ বিস্মকরও। বিভিন্ন আকারের বেলে ও কোয়ার্জাইট পাথর মিউজিয়ামের একটি বড় সংগ্রহ। কোয়ার্জাইট হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির আদিকালের শিলা। এর বয়স কোটি কোটি বছর। এ ধরনের পাথরও সংগৃহীত আছে এ মিউজিয়ামে। আরও আছে কোয়ার্জাইট পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ যা মেজোলিথিক যুগের [৩৫০০-৪৫০০] আদিবাসীদের তৈরি। এ ছাড়াও এখানে আছে প্রত্নতাত্তি্বক মূল্যসম্পন্ন অনেকগুলো প্রস্তর। অনেকগুলোতে খোদাই করা আছে নকশা, বর্ণ, লিপি, তীর, ধনুক, চোখ ও জ্যামিতিক নকশা। লিপিগুলো দুর্বোধ্য। কোনোটি চাইনিজ, কোনোটি ব্রাক্ষ্মী, খরোষ্ঠি অথবা অশোক লিপি। সংগ্রহের মধ্যে আছে চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো নব্যপ্রস্তর যুগের ডলোরাইট পাথরের হস্তকুঠার। রয়েছে ব্যাসল্ট, সিস্ট ও লাইম স্টোন।
পাথরে জিন আছে
মানুষ কত সৃষ্টিশীল হতে পারে, কতভাবে আমাদের চারপাশকে আলোকিত করতে পারে, আক্ষরিক অর্থেই মৃত্তিকা ভেদ করে আহরণ করতে পারে অফুরন্ত সম্পদ_ তার খবর আমরা ক'জনইবা রাখি। এ রকমই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ড. নাজমুল হক। পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস লেখক ড. নাজমুল হক জানান, কোনো পাথর আনতে গেলে গ্রামের লোকজন জানায়, ওতে জিন আছে। কোনো কোনো পাথরে তখনও পূজা দেওয়া হচ্ছে। কোনো পাথর ৩০-৪০ জন লোকও নাড়াতে পারেনি। কোনো পাথরে রাতের বেলা আলোক রশ্মি দেখা গেছে। পাথর আনার পর রাতেরবেলা স্বপ্ন দেখিয়েছে মালিককে। কেউ হয়েছে অসুস্থ। এক টন, দুই টন ওজনের পাথর গাড়িতে তোলার পর বারবার গড়িয়ে পড়েছে। ভেঙে গেছে গাড়ি, ভ্যান। এতকিছুর পরও দমেননি তিনি। দুই টন ওজনের 'ক্লে রকস'টি দশ ফুট মাটি খুঁড়ে কপিকল দিয়ে টেনে তোলা হয়েছে। ওই পাথরটি ছিল শোয়া অবস্থায়। তার ওপর ছিল আর একটি পাথর, এক টন ওজনের। তিনি জানান, কয়েকটি পাথর কোনো ক্রমেই দিতে চাইছিল না মালিকরা। দু'তিন বার বুঝিয়েও রাজি করা যায়নি। কাজে লাগেনি অধ্যক্ষ পরিচয়। অবশেষে পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় সেগুলো সংগ্রহ সম্ভব হয়। মিউজিয়ামের নিদর্শনগুলো সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোলের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশের খনিজসম্পদ অথবা ভূতত্ত্ব সম্পৃক্ত যে কোনো গবেষণার জন্য অনন্য। নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক যে কোনো বড় ধরনের গবেষণার উপকরণ রয়েছে এখানে। এ বিষয়ে ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষকও এখানে গবেষণা করে গেছেন।
প্রাচীন দুই নৌকা
এ জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ দুটি সুদীর্ঘ নৌকা। নির্মাণ কৌশল ও বয়স এগুলোকে করেছে আকর্ষণীয়। পুরো গাছ খোদাই করে, কোনো জোড়া ছাড়াই তৈরি এ নৌকাগুলো। পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর নিচ থেকে কাঠ সংগ্রহকারী একদল শ্রমিক নদীর তলদেশ খনন করে ৩৩ ফুট দৈর্ঘ্য, ২ ফুট ৩ ইঞ্চি প্রস্থ, ১ ফুট ৯ ইঞ্চি গভীর এবং ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির এই নৌকাটির সন্ধান পায়। অতিপ্রাচীন নৌকাটি যার দুই প্রান্ত মোটামুটি তীক্ষষ্ট এবং মূল অংশটি সামান্য গোলাকৃতি। অপর ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য নৌকাটি পঞ্চগড় সদর থানার অমরখানা গ্রামে চাওয়াই নদীর ৮ ফুট মাটির নিচে পাওয়া যায়। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অনুমান করে দেখা যায়, প্রাপ্ত নৌকা দুটি ডিঙি জাতীয় এবং এর ব্যবহারকারীরা ছিল আদিবাসী কোনো জনগোষ্ঠী। সম্ভবত এরা উত্তরের পাহাড়ি এলাকা থেকে এসেছিলেন। নৌকা দুটির বয়স হাজার বছরের উপরে বলে অনুমান করা হয়।
নাজমুল হক জানান, সংগৃহীত নৌকা দুটির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ৫০টি নৌকার কোনো মিল নেই। কেবল ছাতক-সুনামগঞ্জে প্রচলিত জৈন্তাপুরী নৌকার সঙ্গে এর কিছু সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। এসব নৌকা প্রাচীনকালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা ব্যবহার করত। আফ্রিকার টোগো এবং মাইল দেশের আদিবাসীদের মধ্যে এ গাছের লম্বা অংশ অথবা গুঁড়ি কেটে নৌকায় রূপান্তরিত করে চলাচলের রীতি এখনও প্রচলিত রয়েছে। জাম্বিয়া এবং জায়ারে প্রবাহিত কঙ্গো নদীতে চলাচলকারী আদিবাসীদের নৌকাগুলো পঞ্চগড়ে প্রাপ্ত নৌকার অনুরূপ। এ নৌকা দুটি আফ্রিকায় দুগোট নামে পরিচিত।
অবশেষে স্বতন্ত্র ভবন
দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রত্নতত্ত্ব নির্দশন সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে যাচ্ছিল। প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। অবশেষে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যোগাযোগ উপদেষ্টা গোলাম কাদের ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল পঞ্চগড় সফরে আসেন। মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ড. নাজমুল হকসহ কলেজের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা কামনা করলে দুই উপদেষ্টা মিউজিয়ামের দ্বিতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ঠিকাদার কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ভবন হস্তান্তর করেন। এ মাসের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে নতুন ভবনে উঠছে মিউজিয়াম।
সংগৃহীত নৌকা দুটির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ৫০টি নৌকার কোনো মিল নেই। কেবল ছাতক-সুনামগঞ্জে প্রচলিত জৈন্তাপুরী নৌকার সঙ্গে এর কিছু সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়
রকস মিউজিয়াম। পাহাড় বা পর্বত নয়_ পাথর এবং তার সূত্র ধরে আমাদের সভ্যতার আদিতে পেঁৗছতে হলে আপনাকে আসতে হবে এ জাদুঘরে। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের বিশালায়তন উঠানে গড়ে তোলা হয়েছে এ মিউজিয়াম। সারি করে রাখা হয়েছে নানা আকার, প্রকৃতি ও রঙের অনেক পাথর। যার নামকরণ করা হয়েছে 'রকস মিউজিয়াম'। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ও পরিকল্পনায় এ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক মিউজিয়ামটি গড়ে তুলেছেন। নিজের চেষ্টা আর অর্থে তিনি ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ এ মিউজিয়ামটি গড়ে তোলেন। পরে জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক শামসুজ্জামান খান ও আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হেনরি গাসি এ মিউজিয়ামের 'ফোকলোর ও জাতিতত্ত্ব' বিভাগ উদ্বোধন করেন। যার মেধা, মনন ও একাগ্রতায় এটি গড়ে উঠেছে তিনি শিক্ষাবিদ ড. নাজমুল হক। সাহিত্যের লোক হয়েও প্রত্নতাত্তি্বক এবং ভূ ও খনিজ পদার্থের গবেষক হতে যার আগ্রহ একটুও বাধা হয়ে ওঠেনি। এখন উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এ জাদুঘর।
যেভাবে শুরু
পঞ্চগড় শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে লাঠুয়াপাড়া গ্রামে মহিলা কলেজের কর্মচারী তবিবর রহমানের জমিতে পড়ে থাকা দুটি বিশালায়তনের বেলে ও গ্রানাইট পাথর সংগ্রহের মাধ্যমে নাজমুল হক শুরু করেন এ জাদুঘরের কাজ। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি গড়ে তোলেন দুর্লভ সংগ্রহের একটি জাদুঘর। অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি কোনো সহকর্মীর মোটরসাইকেলে চড়ে চলে যেতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যার নিয়ন্ত্রণে পাথর থাকে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কখনও পাথরের বিনিময়ে কাঠ দিয়ে, কখনও পাথরের পাশে দাতার নাম লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনও স্বল্পমূল্য প্রদান করে তুলে নিয়ে আসেন পাথর। পরে তা গরু-মহিষের গাড়ি অথবা রিকশা-ভ্যানে করে নিয়ে আসতেন কলেজ ক্যাম্পাসে। সহকর্মীরা প্রথমে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন; কিন্তু যেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক এটি দেখতে এসে প্রশংসা করলেন, সেদিনই শুরু হয়েছে মিউজিয়ামের সুদিন। সহকর্মীরাও বাড়িয়েছেন সহযোগিতার হাত। বিশেষত, আমিরুল ইসলাম, তৌহিদুল বারী, নূর ইসলামসহ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা।
মিউজিয়ামে যা আছে
প্রস্তর সংগ্রহে সমৃদ্ধ এ ধরনের জাদুঘর বাংলাদেশে প্রথম তো বটেই, এমনকি উপমহাদেশে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমাদের জানা নেই। এই জাদুঘরে সংগৃহীত শিলা বা পাথরের মধ্যে শুধু কোটি বছরের ভূতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিশালায়তন প্রস্তর খণ্ডই নয় বরং হাজার হাজার বছর পুরনো ঐতিহাসিক নৃতাত্তি্বক ও প্রত্নতাত্তি্বক প্রস্তর সংগ্রহও রয়েছে বিপুল পরিমাণে। এছাড়া রয়েছে এ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত কয়েক হাজার বছর বয়সী বিভিন্ন নিদর্শন ও জাতিতাত্তি্বক উপকরণ। মিউজিয়ামটি দুই ভাগে বিভক্ত। কলেজ ক্যাম্পাসের বহিরাঙ্গন এবং কলেজের একটি কক্ষে মিউজিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে। দুটি অংশে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আকৃতির বেলেপাথর, কাদাপাথর, গ্রানাইট, ব্যাসল্ট, সিস্ট, কার্বন, কোয়ার্জাইট, সিলিকন, প্যাট্রিফাইডসহ বিচিত্র নামের পাথর। এগুলোর কোনোটির ওজন এক টন থেকে দুই টন পর্যন্ত। প্রতিটি পাথরের আলাদা আলাদা বিশেষত্ব আছে। যেমন_ ক্লে রকস বা কাদা থেকে রূপান্তরিত পাথরের যে নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে। তার বয়স কম করে হলেও ২০ লাখ বছর। বৃক্ষ জমাট বেঁধে রূপান্তরিত পাথরের [প্যাট্রিফাইড] বয়স ২৫ লাখ বছরের কম নয়। ক্লে রকস দুই টন ওজনের আর প্যাট্রিফাইড পাথর অন্তত ১০ মণ ওজন সম্পন্ন। গ্রানাইট পাথরের বড় বড় চাঁই বা ছোট পাহাড় সাধারণত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় কোনো কোনো পাহাড়ে, সুইজারল্যান্ড এবং কানাডায় দেখা যায়। কিন্তু পঞ্চগড়ের মতো একটি সমতলীয় স্থানে এ ধরনের বিশাল পাথর বেশ বিস্মকরও। বিভিন্ন আকারের বেলে ও কোয়ার্জাইট পাথর মিউজিয়ামের একটি বড় সংগ্রহ। কোয়ার্জাইট হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির আদিকালের শিলা। এর বয়স কোটি কোটি বছর। এ ধরনের পাথরও সংগৃহীত আছে এ মিউজিয়ামে। আরও আছে কোয়ার্জাইট পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ যা মেজোলিথিক যুগের [৩৫০০-৪৫০০] আদিবাসীদের তৈরি। এ ছাড়াও এখানে আছে প্রত্নতাত্তি্বক মূল্যসম্পন্ন অনেকগুলো প্রস্তর। অনেকগুলোতে খোদাই করা আছে নকশা, বর্ণ, লিপি, তীর, ধনুক, চোখ ও জ্যামিতিক নকশা। লিপিগুলো দুর্বোধ্য। কোনোটি চাইনিজ, কোনোটি ব্রাক্ষ্মী, খরোষ্ঠি অথবা অশোক লিপি। সংগ্রহের মধ্যে আছে চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো নব্যপ্রস্তর যুগের ডলোরাইট পাথরের হস্তকুঠার। রয়েছে ব্যাসল্ট, সিস্ট ও লাইম স্টোন।
পাথরে জিন আছে
মানুষ কত সৃষ্টিশীল হতে পারে, কতভাবে আমাদের চারপাশকে আলোকিত করতে পারে, আক্ষরিক অর্থেই মৃত্তিকা ভেদ করে আহরণ করতে পারে অফুরন্ত সম্পদ_ তার খবর আমরা ক'জনইবা রাখি। এ রকমই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ড. নাজমুল হক। পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস লেখক ড. নাজমুল হক জানান, কোনো পাথর আনতে গেলে গ্রামের লোকজন জানায়, ওতে জিন আছে। কোনো কোনো পাথরে তখনও পূজা দেওয়া হচ্ছে। কোনো পাথর ৩০-৪০ জন লোকও নাড়াতে পারেনি। কোনো পাথরে রাতের বেলা আলোক রশ্মি দেখা গেছে। পাথর আনার পর রাতেরবেলা স্বপ্ন দেখিয়েছে মালিককে। কেউ হয়েছে অসুস্থ। এক টন, দুই টন ওজনের পাথর গাড়িতে তোলার পর বারবার গড়িয়ে পড়েছে। ভেঙে গেছে গাড়ি, ভ্যান। এতকিছুর পরও দমেননি তিনি। দুই টন ওজনের 'ক্লে রকস'টি দশ ফুট মাটি খুঁড়ে কপিকল দিয়ে টেনে তোলা হয়েছে। ওই পাথরটি ছিল শোয়া অবস্থায়। তার ওপর ছিল আর একটি পাথর, এক টন ওজনের। তিনি জানান, কয়েকটি পাথর কোনো ক্রমেই দিতে চাইছিল না মালিকরা। দু'তিন বার বুঝিয়েও রাজি করা যায়নি। কাজে লাগেনি অধ্যক্ষ পরিচয়। অবশেষে পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় সেগুলো সংগ্রহ সম্ভব হয়। মিউজিয়ামের নিদর্শনগুলো সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোলের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশের খনিজসম্পদ অথবা ভূতত্ত্ব সম্পৃক্ত যে কোনো গবেষণার জন্য অনন্য। নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক যে কোনো বড় ধরনের গবেষণার উপকরণ রয়েছে এখানে। এ বিষয়ে ভারতের পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষকও এখানে গবেষণা করে গেছেন।
প্রাচীন দুই নৌকা
এ জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ দুটি সুদীর্ঘ নৌকা। নির্মাণ কৌশল ও বয়স এগুলোকে করেছে আকর্ষণীয়। পুরো গাছ খোদাই করে, কোনো জোড়া ছাড়াই তৈরি এ নৌকাগুলো। পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর নিচ থেকে কাঠ সংগ্রহকারী একদল শ্রমিক নদীর তলদেশ খনন করে ৩৩ ফুট দৈর্ঘ্য, ২ ফুট ৩ ইঞ্চি প্রস্থ, ১ ফুট ৯ ইঞ্চি গভীর এবং ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির এই নৌকাটির সন্ধান পায়। অতিপ্রাচীন নৌকাটি যার দুই প্রান্ত মোটামুটি তীক্ষষ্ট এবং মূল অংশটি সামান্য গোলাকৃতি। অপর ২৫ ফুট দৈর্ঘ্য নৌকাটি পঞ্চগড় সদর থানার অমরখানা গ্রামে চাওয়াই নদীর ৮ ফুট মাটির নিচে পাওয়া যায়। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অনুমান করে দেখা যায়, প্রাপ্ত নৌকা দুটি ডিঙি জাতীয় এবং এর ব্যবহারকারীরা ছিল আদিবাসী কোনো জনগোষ্ঠী। সম্ভবত এরা উত্তরের পাহাড়ি এলাকা থেকে এসেছিলেন। নৌকা দুটির বয়স হাজার বছরের উপরে বলে অনুমান করা হয়।
নাজমুল হক জানান, সংগৃহীত নৌকা দুটির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ৫০টি নৌকার কোনো মিল নেই। কেবল ছাতক-সুনামগঞ্জে প্রচলিত জৈন্তাপুরী নৌকার সঙ্গে এর কিছু সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। এসব নৌকা প্রাচীনকালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা ব্যবহার করত। আফ্রিকার টোগো এবং মাইল দেশের আদিবাসীদের মধ্যে এ গাছের লম্বা অংশ অথবা গুঁড়ি কেটে নৌকায় রূপান্তরিত করে চলাচলের রীতি এখনও প্রচলিত রয়েছে। জাম্বিয়া এবং জায়ারে প্রবাহিত কঙ্গো নদীতে চলাচলকারী আদিবাসীদের নৌকাগুলো পঞ্চগড়ে প্রাপ্ত নৌকার অনুরূপ। এ নৌকা দুটি আফ্রিকায় দুগোট নামে পরিচিত।
অবশেষে স্বতন্ত্র ভবন
দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রত্নতত্ত্ব নির্দশন সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে যাচ্ছিল। প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। অবশেষে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যোগাযোগ উপদেষ্টা গোলাম কাদের ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল পঞ্চগড় সফরে আসেন। মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ড. নাজমুল হকসহ কলেজের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা কামনা করলে দুই উপদেষ্টা মিউজিয়ামের দ্বিতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। চলতি বছরের আগস্ট মাসে ঠিকাদার কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ভবন হস্তান্তর করেন। এ মাসের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে নতুন ভবনে উঠছে মিউজিয়াম।
সূত্র : সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন