লাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমাকাশ। পরক্ষণেই কালো। সূর্য ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। আকাশটা যেমন গম্ভীর, তেমনি ভারী। দূরের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
সারাদিনের রোদে তাতানো ছোট্ট উঠোন। ঘরের চালে গোলপাতার ছাউনি। পাতাগুলোও রোদের তেজে ঝুরঝুরে মচমচে হয়ে গেছে। চালের কোথাও বা ফাঁকা। আকাশের তারা দেখা যায় সেই ফাঁক দিয়ে। চালের সঙ্গে রো-আটনের বাঁধনগুলোও আলগা হয়ে গেছে।
আবদুলের চারজনের সংসার চলছে এই একটি মাত্র নড়বড়ে ঘরেই।
বারান্দার একপাশে মাটির চুলো। সেখানেই হয় রান্নাবান্না। বৃষ্টি হলে সারা ঘরে বসিয়ে দিতে হয় থালা-বাসন। কাঁসার পাত্রে বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপন জাগায়। বেজে ওঠে টং করে। আবদুলের দুই ছেলে—রফিক ও শফিক শত দুঃখ-যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যেও প্রাণভরে উপভোগ করে সেই নির্মম-মধুর শব্দ।
মায়ের চোখে পানি। সে পানি বেদনার। বাবার চোখে কষ্টের কালি। সে কালি গ্লানির। কিংবা হতে পারে পরাজয়ের।
পরপর দু’টি বছর গেল। ঘর ছাওয়া হয়নি। সেই যে কবে একমাত্র গরুটি বিক্রি করে চালে গোলপাতার ছাউনি দেয়া হয়েছিল, আজ পর্যন্ত আর কোনো গোলপাতা ওঠেনি সেখানে। এমনকি খড়-বিচালিও কিনতে পারেনি আবদুল। সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। ঘর মেরামত করবে কীভাবে!
গত বছর দারুণ অভাব গেছে। সারা বর্ষাকাল কেটেছে অসুখে। বহুকষ্টে বেগম কিছু চালের জোগাড় করলেও রান্নার মতো কাঠ পায়নি। রফিক-শফিকের অভুক্ত হাড্ডিসার দেহ দু’টি কঙ্কাল যেন। ক্ষুধার ইতিহাস ধারণ করে আছে তারা। আবদুল বিছানায় কাতরাচ্ছে। আর সহ্য হয় না বেগমের। জীবনটা ভারি থেকে আরও বেশি ভারি হয়ে ওঠে তার। বাইরে বৃষ্টি তো বৃষ্টি। ঝরছে মুষলধারায়। চালতো কর্জ পাওয়া গেল অনেক চেষ্টার পর, কাঠখড়ি কর্জ দেয় কে? কী করবে, দিশা পায় না বেগম। অগত্যা দা চালায় বারান্দার বাঁশের খুঁটির শরীরে। ঘুণপোকা বাঁশের ভেতরটা শেষ করেছে। আবরণটাই যা সম্বল। ঠিক তাদের সংসারের মতো। এই সংসারের চারটি প্রাণীর মতো। বেগম জোরে কোপ চালায়। বাঁশের শরীর থেকে এক অদ্ভুত গোঙানির শব্দ আছড়ে পড়ে সারা বারান্দায়। কেঁপে ওঠে ঘরের নড়বড়ে চাল। কাঁপে আবদুলের বুকের পাঁজর। করুণ স্বরে বলে,
—আরে করো কি!
বেগমের শান্ত এবং স্থির কণ্ঠ, যা করছি, ভালোই করছি।
—বললেই হলো! চালের খুঁটি কেটে নিলে ঘরটা দাঁড়িয়ে থাকবে কিসের ওপর ভর দিয়ে?
—যেভাবে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ঘরও সেইভাবে দাঁড়াক। না পারলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ুক।
—সম্বল তো কেবল এই ঘরটুকু। তাও যদি ভেঙে পড়ে, তবে দাঁড়াব কোথায়!
বেগম উত্তর দেয় না। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধও করে না। তার অর্থ দাঁড়ায়, আমরা কি দাঁড়িয়ে আছি? এই ঘরের মতো কিংবা এর চেয়েও জরাজীর্ণ। কিংবা কোনো অবস্থার মধ্যেই আমরা পড়ি না।
বেগমের দা চলে দ্রুত বেগে। তার রাগ এবং ক্ষোভ বাঁশ কিংবা দায়ের ওপর নয়, সেটা জীবনের ওপর। বাঁশের শুকনো খুঁটিটা বারান্দার ওপর থেকে কেটে শেষ করল বেগম। তারপর বাঁশের খুঁটির গলা এবং চালের রোর সঙ্গে বাঁধা দড়িটা কেটে ফেলল। খুঁটির অংশটি এখন তার হাতের নাগালে। দায়ের কয়েকটা কোপে সেটা ফালাফালা হয়ে গেল। বেগম চুলার ওপর চাল বসিয়ে দিয়ে কাটা খুঁটি জ্বালিয়ে ভাত রান্না করল। এখন তারা খেতে বসেছে। চারজনের সামনে ভাপ ওঠা নিহত স্বপ্নের কিংবা এক অসম অনিশ্চয়তার খাদ্য। তারা খাচ্ছে। তারা খাচ্ছে এবং আগামীর শূন্যতার প্রান্তর দিয়ে দৌড়ুচ্ছে। কেউ জানে না তাদের কোথায় বিশ্রাম!
বৃষ্টি পড়ছে তখনও, টুপটাপ।
মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস। বাতাসে যতটা কাঁপছে ঘর, তার চেয়েও বেশি কাঁপছে আবদুল। বেগম যেন ঘরের খুঁটি কাটেনি, কেটেছে আবদুলের নির্ভরতার বৃক্ষ।
গেল দু’টি বছর গেছে এভাবেই শঙ্কা এবং উদ্বিগ্নের মধ্য দিয়ে। শীত মৌসুম এলে কুয়াশাসহ শীতের তীব্রতা বেড়ে যায় ঘরে। শীতের সময় তবুও ভালো, ঝড়ে সেটা ভেঙে পড়ার ভয় থাকে না। কিংবা বৃষ্টির পানিতে দেয়াল গলে গলে ধসে পড়ার।
তার যত ভয় কালবৈশাখী এবং বর্ষাকালের জন্য।
এবার কালবৈশাখীটার চরিত্রই অন্যরকম মনে হচ্ছে।
আবদুল খুব ভয়ের মধ্যে আছে।
মেঘে আকাশটা যত ছেয়ে যায়, চারপাশ যত অন্ধকার হয়ে আসে, ততই আবদুলের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।
প্রথমে হালকা গরম একটা ভাপ অনুভব করল আবদুল।
মুহূর্ত মাত্র!
তারপর হঠাত্ করেই শুরু হয়ে গেল ঝড়।
ঝড় তো ঝড়!
কালবৈশাখীর সেকি তাণ্ডব!
উঠোনের নারকেল গাছের শুকনো পাতাগুলো ঝুপঝাপ করে খসে পড়ল।
সুপারি গাছগুলো বেতের কাণ্ডের মতো দোল খাচ্ছে। খেজুরের বাল্লেগুলো মনে হলো কেউ মাথায় চিরুনি দিয়ে ব্যাকব্রাশ করছে। শুকনো পাতায় ভরে গেল উঠোন। ছিঁড়ে পড়ছে আমের বোলসহ কচি ডগা।
মাটির ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে যদিও, তবুও স্থির নেই ঘরের জীর্ণশীর্ণ চাল। শুকনো গোলপাতার অংশবিশেষ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। চালটাও ঝড়ের দোলায় সমানে দুলছে।
এতক্ষণ আবদুল তার দুই ছেলেকে দুইপাশে ধরে শক্তভাবে বসে ছিল বারান্দায়। কিন্তু যেভাবে ঘরের চালটা দুলছে এবং ফুঁসছে, তাতে সে আর বারান্দায় বসতে সাহস পাচ্ছে না।
বেগম তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নির্বিকার। তার কোনো অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নেই। ভেতরে কোনো যন্ত্রণা কিংবা ব্যস্ততাও নেই। কিছুই না পাওয়ার যেমন কষ্ট নেই, তেমনি হারাবার কোনো ভয়ও নেই বেগমের।
ঘরের চালটা এবার ভীষণভাবে দুলে উঠল। এই বুঝি উড়ে যায় সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো!
আবদুল চিত্কার করে উঠল, নামো!
বেগম নামে না। সে অচঞ্চল, অনড়।
আবদুল দুই হাতে দুই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। বেগমকে বলল, তুমিও নামো! বেগমের রুক্ষ কণ্ঠ, নামব! নেমে কোথায় যাব!
—চলো দীনুদের ঘরে যাই।
দীনুদের দু’টি বড় ঘর আছে। ঘর দুটোর বারান্দা অনেক উঁচু। আবদুল ছেলে দু’টিকে নিয়ে দৌড়ানোর সময় আবারও করুণ স্বরে বলল, কি হলো, নামো!
বেগমের দৃঢ় কণ্ঠ, না, আমি যাব না। কোথাও যাব না!
—দেখো, পাগলামো করার সময় এটা নয়। এখন জীবন-মরণ সমস্যা।
—যাই হোক না কেন, আমি যাব না। মরতে হয় এখানেই মরব। তুমি যাচ্ছ যাও।
আবদুল জানে, বেগম একবার না বললে, তাকে হ্যাঁ বলানো আর সম্ভব নয়।
সে বাধ্য হয়ে ছেলেদের আগলে দৌড় দিল দীনুদের বাড়ির দিকে।
ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে ঝড়ের গতি।
এখন চারপাশে ঝুপঝাপ, ঠুশঠাশ। গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে ভেঙে পড়ছে।
চারপাশে কেবল ভাঙনের শব্দ।
সব দিক ধূলায় ধূসর!
দীনুদের উঁচু বারান্দায় উঠে আবদুল আরও শক্তভাবে ধরে রাখল ছেলে দু’টিকে।
বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে তার নিজের ঘরটি। এই তো সামনে, সামান্য দূরে। এই উঠোন আর ক’টি নারিকেল গাছ পেরুলেই।
ঝড়ের শাঁ শাঁ শব্দ।
আবদুল রফিককে বলল, আজান দে তো বাপ। শুনেছি আজান দিলে ঝড়ের গতি কমে। ঝড় নাকি থেমেও যায়।
রফিক বলল, আমি তো আজান দিতে পারিনে আব্বা।
আবদুলের হুঁশ হলো, তাই তো! রফিক তো অনেক ছোট। এটুকু বয়সে আজান শিখবে কেমন করে?
দীনুদের বাড়ির কেউই আজান জানে না। অগত্যা আবদুলই আজান দেয়া শুরু করল, জোরে, আরও জোরে, আরও, আরও।...
আবদুল আর পারে না। তার দম লেগে আসে। সারাদিনের অভুক্ত শরীর। জোরে দম ধরায় তার দেহটা কাঁপছে। মনে হলো বাইরে ঘূর্ণিঝড় নেই, প্রকৃত ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে তার ভেতরে।
আবদুলের তখনও আজান শেষ হয়নি। হঠাত্ দীনুর বউ চিত্কার করে উঠল, সর্বনাশ! রফিকদের ঘরের চাল উড়ে যাচ্ছে, ঐ দেখো!...
রফিক ও শফিক দেখল, তাদের ঘরের চালের বাঁধনহীন গোলপাতা, খড় এবং চাল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝড়ের প্রবল প্রতাবে।
আবদুলের কানেও গেল দুঃসংবাদটি।
তবুও আবদুলের গলায় যতটুকু শক্তি ছিল, সবটুকুই উজাড় করে দিয়ে সে আজান শেষ করল।
আজান শেষ।
এক সময় ঝড়ও শেষ হলো।
শেষ হলো ঝড়ের তুমুল তাণ্ডব।
আবদুলের ঘরের চাল উড়ে গেছে। ঘরটি এখন পশমহীন মুরগির চামড়ার মতো দেখাচ্ছে। উঠোন ভরে গেছে ঝরাপাতা, খড়, গোলপাতার ভাঙা অংশ এবং ঘরের জীর্ণশীর্ণ রোগা-ভাঙা রো-আটনে। সেদিকে তাকিয়ে আবদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেগমের চোখে-মুখে অন্য ধরনের এক ভঙ্গিমা।
সেটা কিসের? কেমন? জানে না কেউ।
সূর্য অস্তে গেছে।
বাইরের ঝড় থেমে গেছে কিছু আগে।
কিন্তু থামেনি বেগমের ভেতরের ঝড়।
রাত যত গভীর হয়, ততই তীব্রতর হয় তার মনের ঝড়। অবশেষে সেটা কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে সকালের জন্য।
নতুন সূর্যের জন্য।
নতুন স্বপ্নের জন্য।
মূলত স্বপ্ন।—
ঝড়ের সাঁকো পেরিয়ে একটি নবতর স্বপ্ন বিনির্মাণের জন্য নতুনভাবে প্রস্তুতি নেয় হার না মানা জাহানারা বেগম।
সূত্র : আমার দেশ
সারাদিনের রোদে তাতানো ছোট্ট উঠোন। ঘরের চালে গোলপাতার ছাউনি। পাতাগুলোও রোদের তেজে ঝুরঝুরে মচমচে হয়ে গেছে। চালের কোথাও বা ফাঁকা। আকাশের তারা দেখা যায় সেই ফাঁক দিয়ে। চালের সঙ্গে রো-আটনের বাঁধনগুলোও আলগা হয়ে গেছে।
আবদুলের চারজনের সংসার চলছে এই একটি মাত্র নড়বড়ে ঘরেই।
বারান্দার একপাশে মাটির চুলো। সেখানেই হয় রান্নাবান্না। বৃষ্টি হলে সারা ঘরে বসিয়ে দিতে হয় থালা-বাসন। কাঁসার পাত্রে বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপন জাগায়। বেজে ওঠে টং করে। আবদুলের দুই ছেলে—রফিক ও শফিক শত দুঃখ-যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যেও প্রাণভরে উপভোগ করে সেই নির্মম-মধুর শব্দ।
মায়ের চোখে পানি। সে পানি বেদনার। বাবার চোখে কষ্টের কালি। সে কালি গ্লানির। কিংবা হতে পারে পরাজয়ের।
পরপর দু’টি বছর গেল। ঘর ছাওয়া হয়নি। সেই যে কবে একমাত্র গরুটি বিক্রি করে চালে গোলপাতার ছাউনি দেয়া হয়েছিল, আজ পর্যন্ত আর কোনো গোলপাতা ওঠেনি সেখানে। এমনকি খড়-বিচালিও কিনতে পারেনি আবদুল। সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। ঘর মেরামত করবে কীভাবে!
গত বছর দারুণ অভাব গেছে। সারা বর্ষাকাল কেটেছে অসুখে। বহুকষ্টে বেগম কিছু চালের জোগাড় করলেও রান্নার মতো কাঠ পায়নি। রফিক-শফিকের অভুক্ত হাড্ডিসার দেহ দু’টি কঙ্কাল যেন। ক্ষুধার ইতিহাস ধারণ করে আছে তারা। আবদুল বিছানায় কাতরাচ্ছে। আর সহ্য হয় না বেগমের। জীবনটা ভারি থেকে আরও বেশি ভারি হয়ে ওঠে তার। বাইরে বৃষ্টি তো বৃষ্টি। ঝরছে মুষলধারায়। চালতো কর্জ পাওয়া গেল অনেক চেষ্টার পর, কাঠখড়ি কর্জ দেয় কে? কী করবে, দিশা পায় না বেগম। অগত্যা দা চালায় বারান্দার বাঁশের খুঁটির শরীরে। ঘুণপোকা বাঁশের ভেতরটা শেষ করেছে। আবরণটাই যা সম্বল। ঠিক তাদের সংসারের মতো। এই সংসারের চারটি প্রাণীর মতো। বেগম জোরে কোপ চালায়। বাঁশের শরীর থেকে এক অদ্ভুত গোঙানির শব্দ আছড়ে পড়ে সারা বারান্দায়। কেঁপে ওঠে ঘরের নড়বড়ে চাল। কাঁপে আবদুলের বুকের পাঁজর। করুণ স্বরে বলে,
—আরে করো কি!
বেগমের শান্ত এবং স্থির কণ্ঠ, যা করছি, ভালোই করছি।
—বললেই হলো! চালের খুঁটি কেটে নিলে ঘরটা দাঁড়িয়ে থাকবে কিসের ওপর ভর দিয়ে?
—যেভাবে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ঘরও সেইভাবে দাঁড়াক। না পারলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ুক।
—সম্বল তো কেবল এই ঘরটুকু। তাও যদি ভেঙে পড়ে, তবে দাঁড়াব কোথায়!
বেগম উত্তর দেয় না। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধও করে না। তার অর্থ দাঁড়ায়, আমরা কি দাঁড়িয়ে আছি? এই ঘরের মতো কিংবা এর চেয়েও জরাজীর্ণ। কিংবা কোনো অবস্থার মধ্যেই আমরা পড়ি না।
বেগমের দা চলে দ্রুত বেগে। তার রাগ এবং ক্ষোভ বাঁশ কিংবা দায়ের ওপর নয়, সেটা জীবনের ওপর। বাঁশের শুকনো খুঁটিটা বারান্দার ওপর থেকে কেটে শেষ করল বেগম। তারপর বাঁশের খুঁটির গলা এবং চালের রোর সঙ্গে বাঁধা দড়িটা কেটে ফেলল। খুঁটির অংশটি এখন তার হাতের নাগালে। দায়ের কয়েকটা কোপে সেটা ফালাফালা হয়ে গেল। বেগম চুলার ওপর চাল বসিয়ে দিয়ে কাটা খুঁটি জ্বালিয়ে ভাত রান্না করল। এখন তারা খেতে বসেছে। চারজনের সামনে ভাপ ওঠা নিহত স্বপ্নের কিংবা এক অসম অনিশ্চয়তার খাদ্য। তারা খাচ্ছে। তারা খাচ্ছে এবং আগামীর শূন্যতার প্রান্তর দিয়ে দৌড়ুচ্ছে। কেউ জানে না তাদের কোথায় বিশ্রাম!
বৃষ্টি পড়ছে তখনও, টুপটাপ।
মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস। বাতাসে যতটা কাঁপছে ঘর, তার চেয়েও বেশি কাঁপছে আবদুল। বেগম যেন ঘরের খুঁটি কাটেনি, কেটেছে আবদুলের নির্ভরতার বৃক্ষ।
গেল দু’টি বছর গেছে এভাবেই শঙ্কা এবং উদ্বিগ্নের মধ্য দিয়ে। শীত মৌসুম এলে কুয়াশাসহ শীতের তীব্রতা বেড়ে যায় ঘরে। শীতের সময় তবুও ভালো, ঝড়ে সেটা ভেঙে পড়ার ভয় থাকে না। কিংবা বৃষ্টির পানিতে দেয়াল গলে গলে ধসে পড়ার।
তার যত ভয় কালবৈশাখী এবং বর্ষাকালের জন্য।
এবার কালবৈশাখীটার চরিত্রই অন্যরকম মনে হচ্ছে।
আবদুল খুব ভয়ের মধ্যে আছে।
মেঘে আকাশটা যত ছেয়ে যায়, চারপাশ যত অন্ধকার হয়ে আসে, ততই আবদুলের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।
প্রথমে হালকা গরম একটা ভাপ অনুভব করল আবদুল।
মুহূর্ত মাত্র!
তারপর হঠাত্ করেই শুরু হয়ে গেল ঝড়।
ঝড় তো ঝড়!
কালবৈশাখীর সেকি তাণ্ডব!
উঠোনের নারকেল গাছের শুকনো পাতাগুলো ঝুপঝাপ করে খসে পড়ল।
সুপারি গাছগুলো বেতের কাণ্ডের মতো দোল খাচ্ছে। খেজুরের বাল্লেগুলো মনে হলো কেউ মাথায় চিরুনি দিয়ে ব্যাকব্রাশ করছে। শুকনো পাতায় ভরে গেল উঠোন। ছিঁড়ে পড়ছে আমের বোলসহ কচি ডগা।
মাটির ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে যদিও, তবুও স্থির নেই ঘরের জীর্ণশীর্ণ চাল। শুকনো গোলপাতার অংশবিশেষ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। চালটাও ঝড়ের দোলায় সমানে দুলছে।
এতক্ষণ আবদুল তার দুই ছেলেকে দুইপাশে ধরে শক্তভাবে বসে ছিল বারান্দায়। কিন্তু যেভাবে ঘরের চালটা দুলছে এবং ফুঁসছে, তাতে সে আর বারান্দায় বসতে সাহস পাচ্ছে না।
বেগম তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নির্বিকার। তার কোনো অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নেই। ভেতরে কোনো যন্ত্রণা কিংবা ব্যস্ততাও নেই। কিছুই না পাওয়ার যেমন কষ্ট নেই, তেমনি হারাবার কোনো ভয়ও নেই বেগমের।
ঘরের চালটা এবার ভীষণভাবে দুলে উঠল। এই বুঝি উড়ে যায় সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো!
আবদুল চিত্কার করে উঠল, নামো!
বেগম নামে না। সে অচঞ্চল, অনড়।
আবদুল দুই হাতে দুই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। বেগমকে বলল, তুমিও নামো! বেগমের রুক্ষ কণ্ঠ, নামব! নেমে কোথায় যাব!
—চলো দীনুদের ঘরে যাই।
দীনুদের দু’টি বড় ঘর আছে। ঘর দুটোর বারান্দা অনেক উঁচু। আবদুল ছেলে দু’টিকে নিয়ে দৌড়ানোর সময় আবারও করুণ স্বরে বলল, কি হলো, নামো!
বেগমের দৃঢ় কণ্ঠ, না, আমি যাব না। কোথাও যাব না!
—দেখো, পাগলামো করার সময় এটা নয়। এখন জীবন-মরণ সমস্যা।
—যাই হোক না কেন, আমি যাব না। মরতে হয় এখানেই মরব। তুমি যাচ্ছ যাও।
আবদুল জানে, বেগম একবার না বললে, তাকে হ্যাঁ বলানো আর সম্ভব নয়।
সে বাধ্য হয়ে ছেলেদের আগলে দৌড় দিল দীনুদের বাড়ির দিকে।
ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে ঝড়ের গতি।
এখন চারপাশে ঝুপঝাপ, ঠুশঠাশ। গাছপালা, ঘরবাড়ি ভেঙে ভেঙে পড়ছে।
চারপাশে কেবল ভাঙনের শব্দ।
সব দিক ধূলায় ধূসর!
দীনুদের উঁচু বারান্দায় উঠে আবদুল আরও শক্তভাবে ধরে রাখল ছেলে দু’টিকে।
বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে তার নিজের ঘরটি। এই তো সামনে, সামান্য দূরে। এই উঠোন আর ক’টি নারিকেল গাছ পেরুলেই।
ঝড়ের শাঁ শাঁ শব্দ।
আবদুল রফিককে বলল, আজান দে তো বাপ। শুনেছি আজান দিলে ঝড়ের গতি কমে। ঝড় নাকি থেমেও যায়।
রফিক বলল, আমি তো আজান দিতে পারিনে আব্বা।
আবদুলের হুঁশ হলো, তাই তো! রফিক তো অনেক ছোট। এটুকু বয়সে আজান শিখবে কেমন করে?
দীনুদের বাড়ির কেউই আজান জানে না। অগত্যা আবদুলই আজান দেয়া শুরু করল, জোরে, আরও জোরে, আরও, আরও।...
আবদুল আর পারে না। তার দম লেগে আসে। সারাদিনের অভুক্ত শরীর। জোরে দম ধরায় তার দেহটা কাঁপছে। মনে হলো বাইরে ঘূর্ণিঝড় নেই, প্রকৃত ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে তার ভেতরে।
আবদুলের তখনও আজান শেষ হয়নি। হঠাত্ দীনুর বউ চিত্কার করে উঠল, সর্বনাশ! রফিকদের ঘরের চাল উড়ে যাচ্ছে, ঐ দেখো!...
রফিক ও শফিক দেখল, তাদের ঘরের চালের বাঁধনহীন গোলপাতা, খড় এবং চাল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝড়ের প্রবল প্রতাবে।
আবদুলের কানেও গেল দুঃসংবাদটি।
তবুও আবদুলের গলায় যতটুকু শক্তি ছিল, সবটুকুই উজাড় করে দিয়ে সে আজান শেষ করল।
আজান শেষ।
এক সময় ঝড়ও শেষ হলো।
শেষ হলো ঝড়ের তুমুল তাণ্ডব।
আবদুলের ঘরের চাল উড়ে গেছে। ঘরটি এখন পশমহীন মুরগির চামড়ার মতো দেখাচ্ছে। উঠোন ভরে গেছে ঝরাপাতা, খড়, গোলপাতার ভাঙা অংশ এবং ঘরের জীর্ণশীর্ণ রোগা-ভাঙা রো-আটনে। সেদিকে তাকিয়ে আবদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেগমের চোখে-মুখে অন্য ধরনের এক ভঙ্গিমা।
সেটা কিসের? কেমন? জানে না কেউ।
সূর্য অস্তে গেছে।
বাইরের ঝড় থেমে গেছে কিছু আগে।
কিন্তু থামেনি বেগমের ভেতরের ঝড়।
রাত যত গভীর হয়, ততই তীব্রতর হয় তার মনের ঝড়। অবশেষে সেটা কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে সকালের জন্য।
নতুন সূর্যের জন্য।
নতুন স্বপ্নের জন্য।
মূলত স্বপ্ন।—
ঝড়ের সাঁকো পেরিয়ে একটি নবতর স্বপ্ন বিনির্মাণের জন্য নতুনভাবে প্রস্তুতি নেয় হার না মানা জাহানারা বেগম।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন