আকাশের দিকে তাকালেন বাদশা মিয়া। ভেবেছিলেন খোলা আকাশ দেখবেন। কিন্তু এই শহরে খোলা আকাশ দেখার আশা করা ডুমুরের ফুল দেখার মতো। প্রতিনিয়ত এক সারি ইটের মাঝে সিমেন্ট-বালির মিশ্রণ ঢেলে আরেক সারি ইট গেঁথে তৈরি হচ্ছে আকাশচুম্বি অট্টালিকা। সেখানে কোথায় আসমানি আকাশের দর্শন?
কারেন্টের তারের ওপর বসে ছিল কয়েকটা কাক। তাদেরই একটার বুঝি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় হলো তখন। ‘টপ’ করে উষ্ণ পদার্থটুকু এসে পড়ল বাদশা মিয়ার কপালের ঠিক মাঝখানটিতে। চুন বর্ণের ওই পদার্থ তখন বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। ভ্র কুঁচকে ফেললেন বাদশা মিয়া। বাম হাতটা উঠিয়ে নেয়ার আগে একটু অন্যরকম উষ্ণতা অনুভব করলেন এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও। পড়ন্ত বিকেল, কিন্তু গরম কমার নাম নেই।
ভেজা পদার্থটা বাম হাতের আঙুলে লাগিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। মুহূর্তে কুঁচকে ফেললেন কপালের চামড়া। বিশ্রি গন্ধ বের হচ্ছে ওটা থেকে। নাকমুখ এমনিতেই কুঁচকে গেল তার। ইচ্ছা করল গলার সমস্ত জোর কণ্ঠনালীতে এনে মনের সমস্ত ঝাল মিটিয়ে গালাগাল করে ওই হতচ্ছাড়া কালো পাখিগুলোকে। কিন্তু কী মনে হতে তা আর করলেন না। হয়তো ভাবলেন, ওরা তো আর আগেপিছে ভেবে কিছু করেনি। ওরা তো জানে না যে এই সাদা পদার্থটুকু দুর্গন্ধ ছাড়ায় আর মানব জাতির নাক কুঁচকানোর বিষয়ে পরিণত হয়। তাছাড়া ওরা তো অবুঝ জীব। যেখানে বুঝওয়ালা মানুষই নানা সময়ে নানা অকাজ করে যেগুলো তার দ্বারা সম্পন্ন হওয়া শোভা পায় না, জেনে-শুনে-বুঝেই অপরজনকে কষ্ট দেয়- সেখানে কাক নামের ওই সামান্য পাখি মামুলি এ কাজটা করেছে অর্থাৎ কোথাকার কোন্ বাদশা মিয়ার চার আঙুল সমান কপালটাকে ‘ইয়ে’ করে দিয়েছে, এটা নিয়ে ভাববার সময়ই বা কই?
আশেপাশে টিউবওয়েল খুঁজলেন। নাহ্, নেই। কাগজ খুঁজলেন। তাও পেলেন না। পাশের দেয়ালে কিসের যেন পোস্টার সাঁটা আছে। সেখান থেকে কাগজ ছিঁড়ে নিলেন। হাত ও কপাল মুছে ফেললেন। কিন্তু তাতেও মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না। বমি বমি আসছে তার। কাকের ইয়েতে এতো দুর্গন্ধ তা তিনি আগে জানতেন না। আর জানলেও বা কী হতো? না, কিছুই হতো না। তিনি পারতেন না আজকের এই ঘটনাটা এড়াতে। হয়তো পারতেন। কীভাবে? হ্যাঁ পারতের যদি একটা গাজেরো গাড়ি তার থাকত। আর পাজেরো না হলেও অন্তত যদি তারই কলিগ মতিন চৌধুরীর মতো একটা সেকেন্ডহ্যান্ট ট্যাক্সি-কারও থাকত। নাইবা থাকল পাজেরো বা মতিন চৌধুরীর মতো সেকেন্ডহ্যান্ড ট্যাক্সি-কার, বাদশা মিয়া যদি নিদেনপক্ষে একটা রিকশা করে বাড়ি ফিরতে পারতেন তাহলেও এটা এড়াতে পারতেন। সত্যিই কি পারতেন এড়াতে?
বাদশা মিয়া এসব নিয়ে আর ভাবতে চান না। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসে। দুপুরে আজ কেবল দু’টো সিঙারা দিয়ে লাঞ্চ সেরেছেন তিনি। পেটটা তাই একটু কেমন যেন চিনচিন করছে। বাঁ-পাশটায় কী একটা নড়ে নড়ে উঠছে। বাদশা মিয়া আশঙ্কা করছেন এটা এসিডিটির কারণেই হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ বিষয়টা লক্ষ্য করছেন তিনি। তিনি ঘুণাক্ষরেও কখনো ভাবেননি যে তার কোনোদিন এসিডিটি হবে।
বাদশা মিয়া অফিস করে বাড়ি ফিরছিলেন। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। বেতন মিডিয়াম ক্লাসের। তাতে ভালোই চলে যায় তার। কিন্তু জিনিসপত্রের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধিতে এখন আর তিনি পেরে উঠছেন না। ওদিকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও বেড়ে গেছে। ভালো কোনো স্কুল বা কলেজে পড়াতে গেলেই মাস গেলে একগাদা টাকা গুনতে হচ্ছে। বেতনের সিংহভাগটাই এখন ব্যয় হয়ে যায় ছেলেমেয়েদের পেছনে। ইদানীং আরেকটা বিষয় তাকে প্রচণ্ডভাবে পীড়া দিচ্ছে। তিনি অপাত্রে তার শ্রম-অর্থ ঢালছেন নাতো? বড় হয়ে ছেলেমেয়েগুলো তাকে দেখবে তো? যে হারে পারিবারিক বন্ধন এদেশে ভেঙে পড়ছে, তাতে তার এ আশঙ্কাটা কি একেবারেই অমূলক?
বাদশা মিয়া ভাবেন, বর্তমান সমাজের যাবতীয় অসামাজিক কর্মকাণ্ডের মূলে এই পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা। এখন যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, না বললেও সবাই একবাক্যে যে বিষয়টির দিকে অঙুলি নির্দেশ করবে, তা হলো ইভটিজিং। বাদশা মিয়া ভাবেন, কোত্থেকে এলো এই নোংরা জিনিসটা? তাদের সময় তো এটা ছিল না। কিংবা থাকলেও সেটা চোখে পড়ার মতো ছিল না। আসলে ইভটিজিং হচ্ছে সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করার একটা কৌশল মাত্র। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণই দেশের তরুণ সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে ওইসব নোংরামির দিকে। যদি পরিবার থেকেই একজন সন্তানকে ঠিকভাবে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা হতো, তাহলে চিত্রটা কেমন হতো? ঠিক তাদের আদর্শপাড়া গ্রামটার মতো ভাবেন বাদশা মিয়া। আর ভাবেন, এখনও এই অবস্থা থেকে হয়তো উত্তরণ সম্ভব, যদি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
আর কী সব মাথায় ঢুকে চিন্তাটাকে তালগোল পাকিয়ে দিতে লাগল বাদশা মিয়ার। তাই আর ভাবতে চাইল না। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এবং এটাই চান, তার সন্তানরা তাকে নিরাশ করবে না। তাদেরকে তিনি সেভাবেই গড়ে তুলছেন ছোটবেলা থেকেই।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বাদশা মিয়া। নিশ্বাসের সাথে কেমন গরমের হলকা বের হলো বলে মনে হলো। একটু যেন চমকালেন তাতে। নিজের অজান্তেই ডান হাতটা উঠে গেল কপালে। হাতের কব্জির এপিঠ-ওপিঠ দিয়ে শরীরের তাপ অনুভব করার চেষ্টা করলেন। একটু গরম ঠেকল না? হ্যাঁ, গরমই তো! বাদশা মিয়া বুঝলেন তার জ্বর আসছে। গরমের শরীরে ঘাম জমে ঠাণ্ডা লেগে গেছ। নাকের মধ্যে কেমন সুরসুর করে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পর বিকট শব্দে একটা হাঁচি বেরিয়ে এলো। তারপরই নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে লাগল।
জ্বরের সাথে সর্দিও শুরু হয়েছে বাদশা মিয়ার।
বাদশা মিয়ার এখন পকেট খালি। যাকে বলে Hard up now, তাই ভয়ানক দুশ্চিন্তাতে ভুগছেন তিনি।
এই একটু আগে ঘটেছে ঘটনাটা।
বেলা চারটা পর্যন্ত অফিস করে সিএনজি করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছিল।
কয়েক বছর ধরে এক জায়গায় কিছু টাকা জমাচ্ছিলেন তিনি। মাঝে বাদ দিয়েছিলেন, মানে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই ওটার কথা আর মনেও ছিল না। আজই ওরা এসে টাকাটা দিয়ে গেছে। সে কারণেই আজ তার আনন্দ লাগছিল আর দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য সিএনজিতে চড়ে বসেছিলেন তিনি।
বাদশা মিয়ার মনের মধ্যে এখন একসাথে অনেকগুলো অপূরণীয় স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্নগুলো দেখে আসছেন তিনি। সেগুলো ক্রমান্বয়ে ডালপালা বিস্তার করতে করতে ছড়িয়ে গেছে সমস্ত দেহের মধ্যে। সেইসকল ডালপালা তিনি এক এক করে ভরে দেবেন, তবে পাতা বা ফুল-ফল দিয়ে নয়, সুপ্ত আশাগুলোকে বাস্তবে রূপ দান করে। সেটাও অবশ্য এক প্রকার সবুজ পত্রপল্লব আর পুষ্প ও ফলাদি দিয়ে ডাল ভরে দেয়ার মতোই ভাবলেন বাদশা মিয়া।
অথচ...
শহরটা এখন বেশ ব্যস্ত। অথচ তিনি যখন প্রথম এসেছিলেন এই শহরে, তাও আজ থেকে প্রায় পাঁচ-সোয়া পাঁচ বছর হবে, তখন শহরটা এত ব্যস্ত ছিল না। বেশ শান্ত আর ছিমছাম ছিল রাস্তাঘাট, অলিগলি। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা না গেলেও এখনকার মতো অনির্ধষ্ট সময় লাগত না। প্রায় প্রতিটা রাস্তার মোড়েই জ্যাম লেগে থাকে। দেখলে মনে হয় একদল পিঁপড়ে চলেছে একজন সঙ্গীর সন্ধান দেয়া কোনো খাদ্য বয়ে বাসায় আনতে, আগামী দিনের সঞ্চয়ের উদ্দেশে। অথবা ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার দৃশ্যের কথা তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় চলেও আসতে পারে।
এমনই এক জ্যামে পড়েছিলেন বাদশা মিয়া।
খোশ মেজাজে মনে মনে পুরনো দিনের একটা বাংলা গান ভাজছিলেন তিনি। তাই খেয়াল করে পারেননি সিএনজি চালক কখন তার মোবাইলে কথা সেরে নিয়েছে।
সবুজ বাতি জ্বলতেই আবার গাড়িগুলো চলতে শুরু করল। কিছু পথ যেয়ে আবারও সিগন্যাল। অবশ্য এবারেরটা তাড়াতাড়িই ছেড়ে গেল। আর একটু পথ যেতেই ঘটল ঘটনাটা, বাদশা মিয়ার জীবনে এই প্রথম...
সিএনজি ড্রাইভার হঠাৎ একটু স্লো করে ফেলল তার সিএনজি। রাস্তার দু’পাশ থেকে হাজির হল আরও জনা চারেক লোক। এসে ঘিরে ধরল বাদশা মিয়াসহ তার সিএনজিকে। দু’পাশ থেকে দু’জন উঠেও পড়ল।
ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলেন বাদশা মিয়া। বললেন, ‘এ্যা..এ্যা..এ্যাই, কী চাও তোমরা? গাড়িতে উঠে পড়লে যে! এটা তো আমি ভাড়া করেছি।’ আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাকে মাঝপথেই থেমে যেতে হলো, বরং বাধ্য হলেন থেমে যেতে। কেননা, তার কথার জবাবে লোকগুলোর একজন ধারালো চকচকে ছুরির ফলা ও একজন পিস্তলের বাট দেখালো তাকে, অত্যন্ত নরমভাবে, অথচ হিংস্রতার সাথে।
ভীষণভাবে চমকে উঠলেন বাদশা মিয়া। তোতলাতে লাগলেন, ‘এ.. এ.. এ.. এ কী! কারা তোমরা? দে.. দে.. দেখ, আ.. আ..মি কিন্তু এসবের দারুণ ভয় পাই!’
ওদের মধ্যে এবার একজন বলে উঠল, ‘তাইলে কোনো কথা না কইয়া যা আছে সব দিয়া দাও তো চান।’
‘মা.. মা.. মানে?’ ঢোক গিললেন বাদশা মিয়া।
পূর্বের জনই বলল আবার, ‘ন্যাকা! কিছু বুঝবার পারছ না, তাই না? বের কর শালা যা আছে।’ পিস্তলের নল নাচালো সে এবার। আর তাতে ‘কোত্’ করে একটা ঢোক গিললেন বাদশা মিয়া।
‘ঠি.. ঠি.. ঠিক আছে, দিচ্ছি সব। আগে ও.. ওগুলো সরিয়ে নাও..।’ বললেন তিনি।
বাদশা মিয়া এরপর উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাতে চাইলেন, যদি পুলিশ বা এই জাতীয় কাউকে পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি মুখ বাড়াতে যেতেই চাপাকণ্ঠে গর্জে উঠল লোকটা, ‘কোনো চালাকির চেষ্টা কোরো না মিয়া। জলদি কর।’
নিজের কাছে যা ছিল সব বের করে দিলেন বাদশা মিয়া। বরং বলা যায় লোক দু’টো ছিনিয়ে নিল সব।
সব কিছু নেয়া হয়ে গেছে, যখন ভাবল লোকগুলো, তখন একজন বলল, ‘শালা কোনো গ্যান্জাম করবি না। সোজা চইলা যাবি। একবারও পেছন ফিইরা তাকাবি না। যদি তাকাস্, তইলে কলাম...’ হাতের ছোরাটা বিশষ ভঙ্গিতে নাচাল।
বাকিটা আর না বললেও বুঝে নিলেন বাদশা মিয়া। তাই দ্রুত নেমে গেলেন সিএনজি থেকে। তারপর গলিপথটা ধরে হাঁটা ধরলেন। অনেক কষ্টে পেছন ফিরে তাকানো থেকে নিজেকে সামলে রাখলেন।
মনটা তার গুড়িয়ে যাচ্ছে অসহ্য বেদনায়। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন তিনি। কপর্দকশূন্য। সারা দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল। গায়ের বল হারিয়ে ফেলছেন তিনি।
গলিপথটা বাঁক নিতেই আর ধৈর্য ধরতে না পেরে পেছন ফিরে তাকালেন তিনি। না, নেই সিএনজিটা। সেখানেই সেভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।
মনে হল বিশাল আকাশটা তার মাথার উপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। টলছেন তিনি। পা দু’টো অসাড় হয়ে আসতে চাইছে। ঠাল সামলাতে ফুটপাথে বসে পড়লেন। দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলেন মাথা। ওখানকার, কপালের দু’পাশের রগ দু’টো দপ্দপ্ করে লাফাচ্ছে। তলপেটের নিচে চিনচিন করে ব্যথা করে উঠল হঠাৎ। সেইসাথে ঘাড়ের পেছনটাতেও মৃদু চিনচিনে ভাব উপলব্ধি করলেন।
‘উহ্!’ আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। তার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আশা, সমস্ত চাওয়া নিমিষেই গুড়িয়ে গেছে। কতদিন ধরে দেখতে থাকা স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করেই সব আবার শেষ হয়ে গেল।
চোখ জোড়া ঝাঁপসা হয়ে আসতে চাইছে। তবে প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী বাদশা মিয়া অবশেষে উঠে দাঁড়ালেন। এভাবে ভেঙে পড়লে তো আর হবে না। তাকে চলতে হবে। তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা পথ চেয়ে আছে।
বাদশা মিয়া প্রবলভাবে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে সৃষ্টি করেছেন, এতদিন ধরে একান্ত মেহেরবানী করে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেই সৃষ্টিকর্তা তাকে নিরাশ করতে পারেন না এ বিশ্বাসটুকু তার আছে। আজ একটু আগে যে ঘটনাটা তার জীবনে ঘটে গেল, তার পেছনেও নিঃসন্দেহে কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। তাই ভাঙতে ভাঙতে ভাঙলেন না বাদশা মিয়া।
চলতে লাগলেন তিনি। চলাই যে এখন তার সম্বল। আর কিছুদূর হাঁটার পর যখন তিনি উপরের দিকে তাকিয়েছেন মাথার উপরের নীল আকাশটা দেখতে পাবার প্রত্যাশায়, তখনই কাকটা প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিয়েছে।
শীত করছে বাদশা মিয়ার খুব। তারমানে জ্বরের বেগ বাড়ছে। এই একটু আগেও তিনি ঘামছিলেন ছিনতাইকারীদের শিকারে পরিণত হওয়ার সময়। এমনকি যখন সিএনজিতে করে আসছিলেন, তখনও। আর এখন তিনি রীতিমতো কাঁপছেন, প্রচণ্ড শীত তার সমস্ত দেহকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনও বেশ কিছুটা পথ তাকে যেতে হবে। তাই চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
‘আরে বাদশা না? তাইতো, বাদশাই তো। এ্যাই বাদশা?’
থমকে দাঁড়ালেন বাদশা মিয়া। কে তাকে নাম ধরে ডাকে? ‘কে?’ মুখ তুলে তাকালেন তিনি। মুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। অস্ফূটে বলে উঠলেন, ‘আরে রাজা যে!’
রাজা বললেন, ‘হ্যাঁ বন্ধু আমি। তা ীক ব্যাপার? তুমি এই অসময়ে হেঁটে কোথায় যাচ্ছ?’
‘বলব সব, আগে চল কোথাও গিয়ে বসি।’ এক্ষণে মনে বেশ বল পাচ্ছেন বাদশা মিয়া।
তারা দু’জন নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে বসে পড়লেন। তারপর বাদশা মিয়া শুরু করলেন একটু আগে ঘটে যাওয়া তার জীবনের তীক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
রাজা ও বাদশা দু’জন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। একই স্কুল, একই কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন তারা। তারপর রাজা শুরু করেছেন ব্যবসা আর বাদশা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকেছেন। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। মাঝে মাঝে ফোনে আলাপ ছাড়া সরাসরি কথা হয় না বললেই চলে। অনেক দিন পর আজ আবার মিলিত হয়েছেন দু’বন্ধু। কিন্তু একটা বিমর্ষ ভাব বিরাজ করছে। রাজা চাইলেন পরিবেশটা হালকা করতে। কিন্তু বাদশা কিছুতেই হালকা হতে পারছেন না। কিভাবেই বা হবেন?
রাজা বললেন, ‘দোস্ত, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, কাল একবার আমার সাথে দেখা কর। দেখি কী করা যায়।’
‘মানে?’ বাদশা মিয়া কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে রাজার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
‘আরে দোস্ত, বিপদে যদি কাজেই লাগতে না পারলাম তো কিসের বন্ধু, অ্যাঁ?’
‘কিন্তু...’
‘কোনো কিন্তু নয়। এখন বাড়ি যাও। আর শোনো, ভাবিকে কিছু বলার দরকার নেই। পরে আমিই সব বুঝিয়ে বলব। ও.কে?’
‘ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ।’
একটা রিকশা ডেকে তাতে বাদশাকে মিয়াকে উঠিয়ে দিলেন রাজা। তাকে কিছু টাকাও দিয়ে দিলেন।
বাদশা মিয়া রিকশায় করে বাড়ি ফিরে এলেন। হাজার চেষ্টা করেও স্ত্রীর সামনে স্বাভাবিক হতে পারছেন না। তবে তাকে কিছু বুঝতেও দিলেন না। স্ত্রীর কথায় ‘হু-হ্যাঁ’ করে সায় দিয়ে গেলেন শুধু।
বাদশা মিয়া জানেন রাজা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এবং ভালোভাবে। রাজা যে ব্যবসা করেন তার সম্পর্কে একেবারে সবকিছুই না জানলেও যেটুকু জানেন তাতেই তার প্রকৃতি সম্পর্কে অনুমান করে নিতে পারেন। ভাবছেন তার কাছ থেকে সহযোগিতা নেয়া ঠিক হবে না। আবার নিজের অবস্থা সম্পর্কেও ভাবছেন। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তিনি পারছেন না। দারুণ অস্বস্তিতে ছটফট করছেন। ঘুম আসছে না।
স্ত্রী আয়েশা বানু খেয়াল করলেন বিষয়টা। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন?’
‘উঁ! না, কিছু না।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন বাদশা মিয়া।
‘আমার কাছে লুকাচ্ছ কেন? বল না কি হয়েছে তোমার?’ আয়েশা বানুও নাছোড়বান্দা।
বাদশা মিয়া চুপ রইলেন।
আয়েশা বানু বললেন, ‘অফিসে কিছু হয়েছে?’
‘না।’
‘তবে? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’
বাদশা মিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না সব তাকে বলা ঠিক হবে কি না। এ জগতে তার স্ত্রীই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু। পরম হিতৈষী, বিপদে ব্যথার গায়ে সুখের পরশ লেপনকারী।
কাজেই তাকে বোধহয় সব বলা যায়।
মনস্থির করে ফেললেন বাদশা মিয়া। পাশ ফিরলেন।
‘বল কী?(!)’ সব শুনে বললেন আয়েশা বানু।
‘এখন আমি কী করব তুমিই বলে দাও। আমি.. আমি...’ কথা হারিয়ে ফেলেন বাদশা মিয়া।
আয়েশা বানুও কিছু বলতে পারেন না খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন যদি তুমি ভেঙে পড়ো তাহলে ছেলেমেয়েদেরকে সান্ত¡না দেবে কে?’
‘কিন্তু আমি তো ওদেরকে কথা দিয়েছি! এখন কী করব?’
একটু ভাবলেন আয়েশা বানু। তারপর বললেন, ‘সে দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। আমিই ওদেরকে বুঝিয়ে বলব।’
‘কী বুঝিয়ে বলবে তুমি?’
‘ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না।’ বললেন আয়েশা বানু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বাদশা মিয়া। বললেন, ‘যাক, একটা দুঃশ্চিন্তা থেকে আমাকে বাঁচালে। কিন্তু...’
‘আবার কিন্তু কিসের? এখন ঘুমাও। কাল একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু কী ব্যবস্থা করবে তুমি?’
‘আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?’
‘এ কথা কেন বলছ? তুমি ছাড়া কে আমাকে ভালো বোঝে বল? তুমি পাশে আছো বলেই তো আমি এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। আমি নিশ্চিন্ত থেকেছি তোমার উপর ভরসা করে।’
‘যাহ্। তুমি একটু বাড়িয়েই বলছ।’
বাদশা মিয়া একটু হালকা হলেন। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবেন।
রাজার কাছে হাত পাতার ইচ্ছা তারও ছিল না। বাধ্য হয়েই সে কাজ করতে যাচ্ছিলেন তিনি। এক্ষণে মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে ইয়া বড় এক জগদ্দল পাথর নেমে গেছে।
চোখ জোড়া আপনাতেই বুজে এলো তার।
সূত্র : সোনার বাংলাদেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন