রাজার অসুখ। তাবিজ-কবচ, ওঝা-বৈদ্য, ডাক্তার-কবরেজ সব করা হয়েছে কিন্তু রোগ সারে না। সারাদিন চুপচাপ বসে থেকে সময় কাটে নিঃসন্তান রাজার।
একদিন কোতোয়াল এসে রাজাকে বলে- মহামান্য রাজা, লèণ তো ভাল ঠেকছে না, আপনার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বোধ হয়। আপনি বরং চিকিৎসা-টিকিৎসা বাদ দিয়ে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য একমনে ইবাদত-বন্দেগী করুন। বাকি দিনগুলে আরামে কাটুক।
রাজা বললেন, আচ্ছা।
মন্ত্রী এলেন রাজার ঘরে। কুর্ণিশ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, রাজামশাই আপনার অসুস্থতার কথা শুনে রাজ্যটাও কেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুখ চলে যাচ্ছে প্রজাদের মন থেকে। এখন রাজ্যটা শাসন করবে কে? প্রজারা বলছে এভাবে আর কতদিন? এর একটা বিহিত করলে হয় না রাজামশাই? এ ব্যাপারে আপনার সামান্য ইশারা পেলেই...
রাজা বললেন, আচ্ছা।
তারপর এলেন সেনাপতি। তিনি রাজাকে কুর্ণিশ না করেই বললেন, হে দুঃখিত রাজা, আপনি যদি অসুখে-বিসুখে কান্ত হয়ে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন, তাহলে রাজ্যটা চলে কীভাবে? আপনার সুস্থতার জন্য সব চেষ্টাই তো করা হলো। আপনি সুস্থ হবেন এমন কোন লèণ দেখছি না। দিনে দিনে প্রজাদের মনভেঙ্গে যাচ্ছে। রাজ্যে যে-কোন সময় নানা অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যেতে পারে। পরে আশাহত প্রজাদের সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আপনি জীবিত থেকেও মৃত। রাজ্যের কল্যানে নতুন রাজার নাম ঘোষণা করা দরকার। আপনি সম্মতি দিলেই আমরা এগুতে পারি।
রাজা বললেন, আচ্ছা।
ঢোল-কাঁড়ায় বাড়ি পড়ল। তুড়ি-ভেরি, শঙ্খ-শিঙা বেজে উঠল। রাজবাড়িতে শুরু হয়ে গেল রাজাবদলের উৎসব। নতুন রাজার নাম ঘোষণা করা হবে। রাজদরবারে বইছে আনন্দের জোয়ার।
রাজামশাই জানালা ফাঁক করে দেখছেন ওসব। রাজা চিন্তিত মনে পায়চারি করছেন। তার আশেপাশে কেউ নেই। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা।
এরই মধ্যে একটা কান্ড ঘটে গেল। প্রজারা রাজবাড়ির সামনে এসে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল। তাদের কান্নায় রাজবাড়ির আনন্দে টান পড়ল। সবাই প্রচন্ড বিরক্তবোধ করল। কোতোয়াল কয়েকজন সিপাই নিয়ে কান্নারত প্রজাদের সামনে গিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই, কী চাস তোরা? কী হয়েছে তোদের? জানস না এখানে রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন চলছে?
প্রজারা বলল, না, না, না আমাদের প্রিয় রাজাকে কিছুতেই বদল করা চলবে না। বন্ধ করুন উৎসব। নতুন রাজা চাই না আমরা। আমাদের মহান রাজা যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তিনিই থাকবেন আমাদের রাজ্যের রাজা। আমাদের গায়ে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে এই মহান রাজাকে বদল করতে দেব না।
কোতোয়াল রাগে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে গিয়ে মন্ত্রী ও সেনাপতিকে প্রজাদের কথা বলল। তারা রাগে আগুন হয়ে কড়া নির্দেশ দিল কোতোয়ালকে। সে সিপাইদের নিয়ে কান্নারত প্রজাদের ধরে প্রচন্ড মারধর করতে লাগল। তবুও প্রজারা তাদের দাবি ত্যাগ করল না। সেনাপতির নির্দেশে কোতোয়াল তাদের গাছের সাথে বেধে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করে ফেলল। প্রজারা বেহুঁস হয়ে পড়ে রইল।
রাজা জানালার ফাঁক দিয়ে সবই দেখছিলেন। আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি গর্জে উঠলেন এবং দ্রুত নিচে এসে ধমকের সুরে বললেন, কী হচ্ছে এসব, প্রজাদের গায়ের রক্ত ঝরিয়ে রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন চলছে বুঝি?
রাজার অগ্নিমূর্তি দেখে সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল এবং ছেড়ে দিল প্রজাদের। রক্তাক্ত প্রজারা রাজাকে কুর্ণিশ করে বলল, হে মহান রাজা, আমরা আপনাকে অনেক ভালবাসি। আমরা আপনার ন্যায়শাসনের বদলে এই নিষ্ঠুর মানুষের দুঃশাসন চাই না। ওরা রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে। আমরা মনে-প্রাণে আপনার সুস্থতার জন্য দোয়া করছি। আপনি দয়া করে আমাদের ত্যাগ করবেন না রাজামশাই!
রাজা বললেন, আমি অসুস্থ নই। বহুদিনের পুরনো ও বিশ্বস্ত রাজকর্মচারিদের পরীা করার জন্য আমি অসুস্থতার ভান করেছি। আমি যাদের বিশ্বাস করে রাজ্য পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছি-এতদিনে তাদের মধ্যে ভয়ংকর লোভ জেগে উঠেছে। তাদের পরীা হয়ে গেল। সেই সাথে আমার প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস ও ভালবাসার পরীাটাও হয়ে গেল।
রাজা লোভী রাজকর্মচারিদের বন্দী করে তাদের পরিবর্তে প্রজাদের নিয়োগ করলেন। কেউ মন্ত্রী, কেউ সেনাপতি, কেউবা কোতোয়াল-সিপাই পদে অধিষ্ঠিত হলো। রাজা বদলের আনন্দ-আয়োজন-অকৃতজ্ঞ কর্মচারি পরিবর্তনের উৎসবে পরিণত হলো।
সূত্র : অনলাইন
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন