এক ছিল রাজা। তাঁর ছিল ডজন খানেক উপদেষ্টা।
রাজার উপদেষ্টাগণ রাজাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, রাজ্যে হু হু করে লোকসংখ্যা বাড়ছে। লোকজন ফসলী জমিতে বাড়িঘর করছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যে খাদ্যসংকট ও নানা সমস্যা দেখা দেবে। ফসলী জমিতে বাড়িঘর করা নিষিদ্ধ করে একটি আইন জারি করে দিলে কেমন হয় রাজামশাই?
বিকল্প ব্যবস্থা না করে ফসলী জমিতে বাড়িঘর করা নিষিদ্ধ করা হলে রাজ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। এমন একটা বুদ্ধি বের করো যাতে সমস্যার সমাধান হবে আবার রাজ্যে সৃষ্টি হবে না কোন অসন্তোষ। প্রত্যেকে দেবে একটি করে প্রস্তাব। তিন দিনের মধ্যে এর উত্তম সমাধান না দিতে পারলে গর্দান যাবে তোমাদের-বললেন রাজা। উপদেষ্টাগণ পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়। তাঁরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বেরিয়ে গেলেন রাজদরবার থেকে। চিন্তা করতে করতে চলে গেল দুই দিন। এখনও কোন সমাধান বের করতে পারলেন না। সময় যতই কমে আসছে, উপদেষ্টাগণ ততই ছটফট করতে লাগলেন। রাজার সমস্যার সমাধান বের না করতে পারলেও তাঁরা নিজেদের রার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছেন। তা হলো, কেউ ব্যর্থ উপদেষ্টা হয়ে রাজার সামনে গিয়ে গর্দান দেবে না; যে যেদিকে পারে সেদিকে পালিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে একমত হলো সবাই।
রাজাকে সমস্যার সমাধান জানানোর আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। উপদেষ্টাগণ কোন উপায় বের করতে না পেরে পালাবার আয়োজন করছেন। এমন সময় জলখাবার নিয়ে ঘরে এলো এক দাসী। সে উপদেষ্টাদের দুরবস্থা দেখে বলল, আমি আপনাদের সমস্যার কথা জানি আবার এর সমাধানও জানি। ওরা সমস্বরে বলল, কী বলতে চাস, বল, আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা।
দাসী বলল, আমার কথাটা শুনলে পরে আপনাদের কারোর পালাতেও হবে না; মরতেও হবে না। বরং আপনারা পাবেন রাজার অনুগ্রহ।
একজন বলল, তাড়াতাড়ি বল, সময় নেই আমাদের হাতে।
দাসী বলল, এ রাজ্যে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য ডোবা-নালা। অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি করা যায় এই ডোবা-নালাগুলো ভরাট করে। এতে প্রজাদের সমস্যার যেমন সমাধান হয় তেমনি প্রজাদের মধ্যে অসন্তুষ সৃষ্টি হওয়ারও কোনো কারণ থাকে না।
দাসীর প্রস্তাবটা শুনে উপদেষ্টারা আনন্দে লাফালাফি করতে লাগল। তাঁরা পালাবার পরিবর্তে দাসীর প্রস্তাবটা নিজেদের প্রস্তাব বানিয়ে বুক ফুলিয়ে রাজদরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
রাজা বললেন, সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তোমাদের প্রস্তাব পেশ করো।
প্রস্তাব তো মোটে একটা। আগে যে বলতে পারবে জয় হবে তার। উপদেষ্টাদের মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আমি আগে বলি, এটা আমার বুদ্ধিতে নেওয়া প্রস্তাব, আরেকজন খিচকিমেরে বলল, আরে রাখো তো, কে বলেছে এটা তোমার নেওয়া প্রস্তাব? এটা তো আমার প্রস্তাব। তোমরা সরে যাও, বলতে দাও আমাকে। আরেক জন বলল, আমিই দাসীকে প্রস্তাব করার অনুমতি দিয়েছিলাম, এটা আমার... এ কথা শুনে পেছন থেকে দুজন তার মুখ চেপে ধরে বলল, হায়! হায়! বলে কি! বলে কি! এই পাঁজিটা তো আমাদের শূলে চড়াবে দেখছি! একটা হ্যাঁচকা টানে সবার পেছনের নিয়ে গেল তাকে। কার কথা কে শোনে। একজন রাজার দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রস্তাবটা বলার চেষ্টা করতেই আরেক উপদেষ্টা পেছন থেকে উড়ে এসে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে বলল, চুপ চুপ, মিথ্যাবাদী কোথাকার, চুপ। মহারাজের অনুগ্রহ পাওয়ার ও গর্দান বাঁচানোর অধিকার আমারও আছে। আমার প্রস্তাব আমাকে বলতে দাও। কেউ থামে না-কেউ দমে না। শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি।
রাজা উপদেষ্টাদের কাণ্ড দেখে বিরক্ত হয়ে কোতোয়ালকে আদেশ করলেন, প্রত্যেককে বন্দী করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে নিয়ে রাখা হোক। যেই কথা সেই কাজ। কান্ত-শ্রান্ত উপদেষ্টাগণ আলাদা কুঠুরিতে বসে একা একা বিড়বিড় করতে লাগল।
রাজা গেলেন প্রথম কুঠুরির সামনে। বললেন, তোমার প্রস্তাবটা বলো।
প্রথমেই প্রস্তাবটা শোনানোর সুযোগ পেয়ে উপদেষ্টা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করল। এই সুযোগে উত্তম প্রস্তাব গ্রহণে তার কী ভূমিকা ছিল তা পেশ করার লোভ সামলাতে পারলো না। সে জ্ঞানীর মতো বলল, এই সামান্য সমস্যার সমাধানের লে আমাদের বিস্তর সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, তবে এতো সময় দেওয়ার আদৌ প্রয়োজন ছিল না রাজামশাই। আপনি নির্দেশ দেওয়ার পর পরই রাজদরবার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় এ কঠিন সমস্যার একটা সহজ সমাধান বের করে ফেলেছিলাম আমি। সমাধানের কথা আপনাকে সাথে সাথেই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা আমাকে বলতে দিল না। তারা বলল, সমস্যা সমাধানের জন্যে সময় আছে তিনদিন।
রাজা বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললেন, প্রস্তাবটা কী তাই বলো।
উপদেষ্টা আবেগে অভিমানে বলতে লাগল, মহারাজ, প্রস্তাবটা শোনার পূর্বে এর আগের কাহিনি শোনা জরুরি। আমার প্রস্তাবটা এতোই যুৎসই ও মঙ্গলজনক যে এটা অন্যসব উপদেষ্টার পছন্দ হয়ে যায় এবং তারা এ প্রস্তাবটাকে ছিনিয়ে নিয়ে যার যার প্রস্তাব আকারে আপনার বরাবরে পেশ করার জন্যে নানা কূট-কৌশল শুরু করে দেয়। আমার প্রস্তাবটা আমার কাছে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজা বিরক্ত হয়ে তার কথা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। তিনি গেলেন পরের কুঠুরিতে। এ কুঠুরির উপদেষ্টাও সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব বলার আগে অন্যদের চেয়ে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কথা বলতে শুরু করল। রাজা চলে গেলেন পরেরটাতে। এভাবে রাজা এগার উপদেষ্টার কুঠুরি পার হলেন কিন্তু কারও কাছে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাবটি শুনতে পারেন নি। সবাই আগে নিজের সাফল্যের কথা বলতে ব্যস্ত।
শেষের কুঠরিতে মিনমিনে ধরনের এক উপদেষ্টা বসে আছে। সে রাজাকে দেখে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলল। রাজা ধমক দিয়ে বললেন, এত কান্না কীসের? অন্য উপদেষ্টারা সমস্যা সমাধানের কথা না বলে শুধু নিজেদের নানান ভূমিকার কথা বলতে ব্যস্ত। এবার তুমি শুধু তোমার প্রস্তাবটা পেশ করো। উপদেষ্টা হতাশ হয়ে বিস্ময়ে বলল, তারা তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে বলে ফেলেছে আর আপনি তা শুনেও ফেলেছেন মহারাজ! তাহলে এবার আমারটা শুনুনÑ
মহারাজ আমার বুদ্ধিতেই দাসী এত মূল্যবান পরামর্শটা দিয়েছে, অন্য কারো কথায় নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে কার কতটুকু ভূমিকা আর কৃতিত্ব তা আপনার বিচার মহারাজ।
রাজা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন দরবারে।
রাজার নির্দেশে সকল উপদেষ্টাকে কুঠুরি থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো এবং সকল দাসীকেও ডাকা হলো।
রাজা বললেন, আমার উপদেষ্টাদের উপদেশ দিয়েছে কে?
দাসীরা ভয়ে মুখ খুলছে না। সবাই মাথানত করে দাঁড়িয়ে রইল।
এক দাসী সভয়ে বলল, মহারাজ, আমরা হলাম দাসী। সারাদিন আপনাদের সেবাকাজে ব্যস্ত থাকি। তবে মাঝেমধ্যে ওই কালোদাসীকে দেখতাম উপদেষ্টাদের উপদেশ দিতে।
রাজা কালোদাসীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি করে বলো, তুমি কি তাঁদের পরামর্শ দিয়েছ?
কালোদাসীর প্রাণ যায় যায়। সে বারকয়েক ঢোক গিলে কোনোমতে বলল, এ আমার কাজ নয় মহারাজ। আমি শুধু উপদেষ্টাদের জীবন বাঁচানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম।
রাজা অবাক হয়ে বললেন, জীবন বাঁচানোর জন্যে মানে?
দাসী ভয়ে ভয়ে বলল, মহারাজ, আপনি উপদেষ্টাদের কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরামর্শ চেয়েছিলেন, তা ছিল তাদের জ্ঞানের অতীত। তাঁরা সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুভয়ে পালিয়ে দেশান্তরী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁদের এ বিপদ দেখে আমি এ সমস্যার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব দিয়েছি মাত্র। আমার প্রস্তাবটি তাদের খুব পছন্দ হয়ে যায়। কার আগে কে এ প্রস্তাবটি নিজের প্রস্তাব আকারে আপনার কাছে পেশ করে রাজার অনুগ্রহ লাভ করবে, এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে এত হাঙ্গামা।
রাজা দাসীকে বললেন, কী ছিল তোমার সেই প্রস্তাব, নির্ভয়ে বলো?
দাসী তার প্রস্তাবটি পেশ করল। প্রস্তাবটি শুনে সত্যি সত্যি মহা খুশি হয়ে গেলেন রাজা!
আর বিলম্ব না করে রাজা কালোদাসীকে উপদেষ্টা পদে আর বারো উপদেষ্টাকে রাজবাড়ির দাস পদে নিয়োগের আদেশ জারি করে দিলেন।
রাজার উপদেষ্টাগণ রাজাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, রাজ্যে হু হু করে লোকসংখ্যা বাড়ছে। লোকজন ফসলী জমিতে বাড়িঘর করছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যে খাদ্যসংকট ও নানা সমস্যা দেখা দেবে। ফসলী জমিতে বাড়িঘর করা নিষিদ্ধ করে একটি আইন জারি করে দিলে কেমন হয় রাজামশাই?
বিকল্প ব্যবস্থা না করে ফসলী জমিতে বাড়িঘর করা নিষিদ্ধ করা হলে রাজ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। এমন একটা বুদ্ধি বের করো যাতে সমস্যার সমাধান হবে আবার রাজ্যে সৃষ্টি হবে না কোন অসন্তোষ। প্রত্যেকে দেবে একটি করে প্রস্তাব। তিন দিনের মধ্যে এর উত্তম সমাধান না দিতে পারলে গর্দান যাবে তোমাদের-বললেন রাজা। উপদেষ্টাগণ পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়। তাঁরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বেরিয়ে গেলেন রাজদরবার থেকে। চিন্তা করতে করতে চলে গেল দুই দিন। এখনও কোন সমাধান বের করতে পারলেন না। সময় যতই কমে আসছে, উপদেষ্টাগণ ততই ছটফট করতে লাগলেন। রাজার সমস্যার সমাধান বের না করতে পারলেও তাঁরা নিজেদের রার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছেন। তা হলো, কেউ ব্যর্থ উপদেষ্টা হয়ে রাজার সামনে গিয়ে গর্দান দেবে না; যে যেদিকে পারে সেদিকে পালিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে একমত হলো সবাই।
রাজাকে সমস্যার সমাধান জানানোর আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। উপদেষ্টাগণ কোন উপায় বের করতে না পেরে পালাবার আয়োজন করছেন। এমন সময় জলখাবার নিয়ে ঘরে এলো এক দাসী। সে উপদেষ্টাদের দুরবস্থা দেখে বলল, আমি আপনাদের সমস্যার কথা জানি আবার এর সমাধানও জানি। ওরা সমস্বরে বলল, কী বলতে চাস, বল, আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা।
দাসী বলল, আমার কথাটা শুনলে পরে আপনাদের কারোর পালাতেও হবে না; মরতেও হবে না। বরং আপনারা পাবেন রাজার অনুগ্রহ।
একজন বলল, তাড়াতাড়ি বল, সময় নেই আমাদের হাতে।
দাসী বলল, এ রাজ্যে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য ডোবা-নালা। অসংখ্য বাড়িঘর তৈরি করা যায় এই ডোবা-নালাগুলো ভরাট করে। এতে প্রজাদের সমস্যার যেমন সমাধান হয় তেমনি প্রজাদের মধ্যে অসন্তুষ সৃষ্টি হওয়ারও কোনো কারণ থাকে না।
দাসীর প্রস্তাবটা শুনে উপদেষ্টারা আনন্দে লাফালাফি করতে লাগল। তাঁরা পালাবার পরিবর্তে দাসীর প্রস্তাবটা নিজেদের প্রস্তাব বানিয়ে বুক ফুলিয়ে রাজদরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
রাজা বললেন, সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তোমাদের প্রস্তাব পেশ করো।
প্রস্তাব তো মোটে একটা। আগে যে বলতে পারবে জয় হবে তার। উপদেষ্টাদের মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আমি আগে বলি, এটা আমার বুদ্ধিতে নেওয়া প্রস্তাব, আরেকজন খিচকিমেরে বলল, আরে রাখো তো, কে বলেছে এটা তোমার নেওয়া প্রস্তাব? এটা তো আমার প্রস্তাব। তোমরা সরে যাও, বলতে দাও আমাকে। আরেক জন বলল, আমিই দাসীকে প্রস্তাব করার অনুমতি দিয়েছিলাম, এটা আমার... এ কথা শুনে পেছন থেকে দুজন তার মুখ চেপে ধরে বলল, হায়! হায়! বলে কি! বলে কি! এই পাঁজিটা তো আমাদের শূলে চড়াবে দেখছি! একটা হ্যাঁচকা টানে সবার পেছনের নিয়ে গেল তাকে। কার কথা কে শোনে। একজন রাজার দিকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রস্তাবটা বলার চেষ্টা করতেই আরেক উপদেষ্টা পেছন থেকে উড়ে এসে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে বলল, চুপ চুপ, মিথ্যাবাদী কোথাকার, চুপ। মহারাজের অনুগ্রহ পাওয়ার ও গর্দান বাঁচানোর অধিকার আমারও আছে। আমার প্রস্তাব আমাকে বলতে দাও। কেউ থামে না-কেউ দমে না। শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি।
রাজা উপদেষ্টাদের কাণ্ড দেখে বিরক্ত হয়ে কোতোয়ালকে আদেশ করলেন, প্রত্যেককে বন্দী করে আলাদা আলাদা কুঠুরিতে নিয়ে রাখা হোক। যেই কথা সেই কাজ। কান্ত-শ্রান্ত উপদেষ্টাগণ আলাদা কুঠুরিতে বসে একা একা বিড়বিড় করতে লাগল।
রাজা গেলেন প্রথম কুঠুরির সামনে। বললেন, তোমার প্রস্তাবটা বলো।
প্রথমেই প্রস্তাবটা শোনানোর সুযোগ পেয়ে উপদেষ্টা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করল। এই সুযোগে উত্তম প্রস্তাব গ্রহণে তার কী ভূমিকা ছিল তা পেশ করার লোভ সামলাতে পারলো না। সে জ্ঞানীর মতো বলল, এই সামান্য সমস্যার সমাধানের লে আমাদের বিস্তর সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, তবে এতো সময় দেওয়ার আদৌ প্রয়োজন ছিল না রাজামশাই। আপনি নির্দেশ দেওয়ার পর পরই রাজদরবার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় এ কঠিন সমস্যার একটা সহজ সমাধান বের করে ফেলেছিলাম আমি। সমাধানের কথা আপনাকে সাথে সাথেই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা আমাকে বলতে দিল না। তারা বলল, সমস্যা সমাধানের জন্যে সময় আছে তিনদিন।
রাজা বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললেন, প্রস্তাবটা কী তাই বলো।
উপদেষ্টা আবেগে অভিমানে বলতে লাগল, মহারাজ, প্রস্তাবটা শোনার পূর্বে এর আগের কাহিনি শোনা জরুরি। আমার প্রস্তাবটা এতোই যুৎসই ও মঙ্গলজনক যে এটা অন্যসব উপদেষ্টার পছন্দ হয়ে যায় এবং তারা এ প্রস্তাবটাকে ছিনিয়ে নিয়ে যার যার প্রস্তাব আকারে আপনার বরাবরে পেশ করার জন্যে নানা কূট-কৌশল শুরু করে দেয়। আমার প্রস্তাবটা আমার কাছে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজা বিরক্ত হয়ে তার কথা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। তিনি গেলেন পরের কুঠুরিতে। এ কুঠুরির উপদেষ্টাও সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব বলার আগে অন্যদের চেয়ে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কথা বলতে শুরু করল। রাজা চলে গেলেন পরেরটাতে। এভাবে রাজা এগার উপদেষ্টার কুঠুরি পার হলেন কিন্তু কারও কাছে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাবটি শুনতে পারেন নি। সবাই আগে নিজের সাফল্যের কথা বলতে ব্যস্ত।
শেষের কুঠরিতে মিনমিনে ধরনের এক উপদেষ্টা বসে আছে। সে রাজাকে দেখে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলল। রাজা ধমক দিয়ে বললেন, এত কান্না কীসের? অন্য উপদেষ্টারা সমস্যা সমাধানের কথা না বলে শুধু নিজেদের নানান ভূমিকার কথা বলতে ব্যস্ত। এবার তুমি শুধু তোমার প্রস্তাবটা পেশ করো। উপদেষ্টা হতাশ হয়ে বিস্ময়ে বলল, তারা তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে বলে ফেলেছে আর আপনি তা শুনেও ফেলেছেন মহারাজ! তাহলে এবার আমারটা শুনুনÑ
মহারাজ আমার বুদ্ধিতেই দাসী এত মূল্যবান পরামর্শটা দিয়েছে, অন্য কারো কথায় নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে কার কতটুকু ভূমিকা আর কৃতিত্ব তা আপনার বিচার মহারাজ।
রাজা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন দরবারে।
রাজার নির্দেশে সকল উপদেষ্টাকে কুঠুরি থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো এবং সকল দাসীকেও ডাকা হলো।
রাজা বললেন, আমার উপদেষ্টাদের উপদেশ দিয়েছে কে?
দাসীরা ভয়ে মুখ খুলছে না। সবাই মাথানত করে দাঁড়িয়ে রইল।
এক দাসী সভয়ে বলল, মহারাজ, আমরা হলাম দাসী। সারাদিন আপনাদের সেবাকাজে ব্যস্ত থাকি। তবে মাঝেমধ্যে ওই কালোদাসীকে দেখতাম উপদেষ্টাদের উপদেশ দিতে।
রাজা কালোদাসীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি করে বলো, তুমি কি তাঁদের পরামর্শ দিয়েছ?
কালোদাসীর প্রাণ যায় যায়। সে বারকয়েক ঢোক গিলে কোনোমতে বলল, এ আমার কাজ নয় মহারাজ। আমি শুধু উপদেষ্টাদের জীবন বাঁচানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম।
রাজা অবাক হয়ে বললেন, জীবন বাঁচানোর জন্যে মানে?
দাসী ভয়ে ভয়ে বলল, মহারাজ, আপনি উপদেষ্টাদের কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য যে পরামর্শ চেয়েছিলেন, তা ছিল তাদের জ্ঞানের অতীত। তাঁরা সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুভয়ে পালিয়ে দেশান্তরী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁদের এ বিপদ দেখে আমি এ সমস্যার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব দিয়েছি মাত্র। আমার প্রস্তাবটি তাদের খুব পছন্দ হয়ে যায়। কার আগে কে এ প্রস্তাবটি নিজের প্রস্তাব আকারে আপনার কাছে পেশ করে রাজার অনুগ্রহ লাভ করবে, এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে এত হাঙ্গামা।
রাজা দাসীকে বললেন, কী ছিল তোমার সেই প্রস্তাব, নির্ভয়ে বলো?
দাসী তার প্রস্তাবটি পেশ করল। প্রস্তাবটি শুনে সত্যি সত্যি মহা খুশি হয়ে গেলেন রাজা!
আর বিলম্ব না করে রাজা কালোদাসীকে উপদেষ্টা পদে আর বারো উপদেষ্টাকে রাজবাড়ির দাস পদে নিয়োগের আদেশ জারি করে দিলেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন