এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে
এতোটুকু তারে ঘরে এনেছিনু পরীর মতোন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলো বলে কেঁদে ভাসাইতো বুক
সেই ডালিম গাছের রক্তিম ফুলগুলো পাপড়ি ছড়ায় আজও সবুজ দূর্বাদলের ওপর শান্তিতে নিদ্রারত কবির কবরে। আমার অতি প্রিয়জন কবি জসীম উদ্দীন, যাঁকে আমি ডাকি চাচা বলে। আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর, ভাইয়ের, অতি নিকট আত্মীয়ের।
সিলেটে হজরত শাহজালাল রাহমতুল্লাহ আলাইহির দরগায় টিলার সবুজ ঘাসে শুয়ে আছেন আমার আব্বা, খেজুর গাছ থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে কমলা রঙের খেজুর, ঝরে পড়ে তার পাতা। কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, ছবিতেও দেখিনি তাঁকে। দরগার সম্মান রক্ষার্থে মহিলারা কবরের পাশে যেতে পারেন না। সাদা প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন দূর থেকে দেখি আব্বার কবর, মোনাজাতের হাত তুলি, তখন অম্বিকাপুরের ডালিম গাছের নিচের কবরগুলোর ছবি মনে ভেসে ওঠে।
উনিশশ’ তেষট্টি সালে বিয়ে হয়ে এসেছি পুরানা পল্টনে ‘হিরামন মঞ্জিলে’, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমার নবীন সঙ্গী আব্বাসীর সঙ্গে ঘুরতে বেরুতাম কখনও শান্তিনগর, কখনও কমলাপুর, কখনও নয়াপল্টন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীম উদ্দীন, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী কলিম শরাফী, কবি মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, কবি গোলাম মোস্তফা—এঁদের বাড়িগুলোতে আমাদের নিত্য আনাগোনা। গোসল নাস্তা পর্ব শেষে একটি রিকশাতে চড়ে দু’জনে দশ মিনিটেই পৌঁছে যেতাম গন্তব্যে। এই গুণীজনেরা যেন সোনার মানুষ। এত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করতাম, বাড়িতে ফেরার তাগিদ থাকত না।
সবচেয়ে বেশি যাওয়া হতো কমলাপুরে জসীম উদ্দীন ও মমতাজ জসীম উদ্দীনের বাড়িতে। আমাদের দু’জনারই অতি প্রিয় এই চাচা ও চাচি, কবিতা ও সুখাদ্য, আকর্ষণ তো কম নয়। কী যে আনন্দের খনিতে অবগাহন! অতি সহজ সরল পরিবেশ, একতলা বাড়ির চারপাশে সুপুরি নারকেল কলা আম জাম কাঁঠালের গাছ ছায়া বিস্তার করে আছে, এক পাশে বেলী চামেলী গন্ধরাজ কামিনী মাধবীলতা জুঁইয়ের সুগন্ধি ঝাড়।
কবি জসীম উদ্দীন চাচা ও চাচি মমতাজ (যাঁকে আদর করে ডাকেন মণিমালা) স্নেহের চাদর বিছিয়ে ডেকে নিতেন কাছে। শীতের সকালে রোদ্দুরে পাটি পেতে বসে চাচি পরিবেশন করতেন নকশি পিঠা, মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, ঘন দুধের ক্ষীর। কত যে সুস্বাদু খাদ্য তাঁর ভাণ্ডারে, রাঁধতে ভীষণ ভালোবাসতেন, আরও ভালোবাসতেন লোকজনকে ডেকে খাওয়াতে। কবি চাচা তাঁর নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন মৃদু স্বরে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। অনেক সময় আমরাই প্রথম শ্রোতা অথবা প্রথম পাঠক।
কবিতাপ্রীতি তো আমার জন্মসূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার। যখন শৈশবে পিতাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে এসেছি মনু নদীর তীরে মৌলভীবাজার শহরে, যেখানে প্রকৃতি ও সাহিত্য এক হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। হুরু মামু সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট বোন সৈয়দা হিফজুন্নেসা খানম গৌর বর্ণের রূপসী মহিলা আমার আম্মা। সবসময়ই সাদা রঙের শাড়িতে তাঁকে দেখেছি, রঙের কোনো ছিটেফোঁটা নেই, তবু কী অপরূপ, বিধাতা যেন তাঁর সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন আমার মায়ের চেহারায় ও চরিত্রে।
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়
মায়ামমতায় জড়াজড়ি করি মোর গৃহখানি রহিয়াছে ভরি
মায়ের আদরে ভাইয়ের স্নেহে বোনের মায়ার ছায়
যাবে তুমি ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাব তবে লইয়া ঘাটের তরী
মায়ের মুখে শুনতাম কবিতাগুলো বিছানায় ঘুমুতে যাওয়ার ক্ষণে। আরও কত কবিতা, যেন স্বপ্নের জগতে চলে যাওয়া।
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই
মামার বাড়ি পুণ্যিপুকুর
গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল
আম কাঁঠালের বনের ধারে
মামা বাড়ির ঘর
আকাশ হতে জ্যোত্স্না কুসুম
ঝরে মাথার পর
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর-রঙে নাওয়া;
সেই ঘরেতে এক্লা বসে ডাকছে আমার মা—
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে আবার কোথা ধাও,
পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।
ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,
সরষে ফুলের পাপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু’খান পা,
বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা’।
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই।
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।
‘নীল নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ, কলার পাতা দোলায় চাপা শিশির ধোয়ায় পা’—এমন শ্যামলিমা ভরা গাঁ পৃথিবীর আর কোনো দেশে বোধ করি অবস্থান করে না। বাংলাদেশ এই হাজার হাজার গ্রামের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিবিম্ব। মনে বড় সাধ জাগে এমন শ্যামল উদ্ভিদ লতাপাতা গুল্মময় গ্রামে ঘুরে বেড়াতে। আমার জন্মভূমিতে অনায়াসেই খুঁজে পাই কবির সেই ভালোবাসার গ্রাম। আমার অন্তরে তারা স্থায়ী ছবি এঁকে নেয় তাঁদের মাধুরিমায়।
যখন বড় হয়ে নিজে নিজে পড়তে শিখলাম ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’—কী বিস্ময় কী বিস্ময়। এত সহজ ছন্দে সহজ বাক্যে কবি সৃষ্টি করলেন অসাধারণ কাব্য।
আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো কবির অপূর্ব সৃষ্টি।
নদীর কূল নাই কিনার নাই রে
আমি কোন্ কূল হতে কোন্ কূলে যাব কাহারে শুধাই রে \
ও পারে মেঘের ঘটা
কণক বিজলি ছটা
মাঝে নদী বহে শাঁই শাঁই রে।
আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাই রে \
বিষম নদীর পানি
ঢেউ করে হানাহানি
ভাঙ্গা এ তরণী তবু বাই রে।
আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর যদি দেখা পাই রে \
আমার গহীন গাঙ্গের নাইয়া
তুমি অপর বেলায় নাও বায়া যাও রে
ও দরদী কার বা পানে চাইয়া \
ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়
পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায় রে
ওরে আবছা মেঘে হাতছানি দেয়
কে জানি মোর সয়া-রে \
ঐ না গাঙ্গের আগের বাঁকে
আমার বন্ধুর দ্যাশ
কলাবনের বাউরি বাতাস দোলায় মাথার ক্যাশ;
কইও খবর তাহার লাইগা
কাইন্দা মরে এই অভাইগা রে
ও তার ব্যথার দেওয়া থাইক্যা থাইক্যা
ঝরে নয়ন বায়া রে \
জসীম উদ্দীন ও আব্বাসউদ্দীন যেন এক বৃন্তের দু’টি কুসুম। তাঁদের সেই অমর সৃষ্টি আজও স্পন্দিত হয় বাংলার লোকে-লোকান্তরে।
জসীম উদ্দীনের বাড়ির আবহে গ্রামবাংলার ছবি কী সুন্দর মমতায় চিত্রিত। বাঁশ ঝাড় কলাগাছ লাউয়ের মাচার ঐশ্বর্য, গোয়াল ঘরে গরু, আরও আছে হাঁস মুরগি ছাগল কবুতর। পাখিদের কিচিরমিচির তার সঙ্গে যুক্ত হয় কাকের কা-কা রব। কবি নিজ হাতে গাছপালার যত্ন করতেন। গাছের গোড়ায় পানি দেয়া, মাটি দেয়া, শুকনো ডাল কেটে ফেলা, পোকামাকড় সাফ করা সব নিজ হাতে করতেন। ফুল ও পাখি দুটোই ছিল তাঁর প্রিয়। কবিপত্নী শরত্কালের ভোরে উঠে প্রথমে শিউলি ফুল কুড়াতেন, তারপর সংসারের নানা কাজ। একবার কবি বাজার থেকে পঞ্চাশটি মাটির কলসী কিনে আনলেন, কবিপত্নী অবাক হয়ে দেখছেন, কবি বললেন, বাড়িতে অনেক গাছ আছে পাখিদের বাসার খোঁজে যাতে ঘুরাঘুরি করতে না হয়, তাই কলসীগুলো কিনে এনেছি। এগুলো রশি দিয়ে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেব। কলসীগুলোর গলার কাছে ফুটো করে আম গাছ জাম গাছ বেল গাছ কাঁঠাল গাছ চালতা গাছ সব গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। বাগানের দক্ষিণ কোণে ঝড়ে ভাঙা একটি সফেদা গাছ ও বকফুল গাছ ছিল। এই দুই গাছে নারকেল পাতা খড়বিচালী ঝুলিয়ে দেয়া হলো শালিক ও বুলবুলির জন্য, তারা বাসা বাঁধল সেখানে। আস্তে আস্তে কলসীগুলোতেও নীড় বাঁধল পাখিরা, যেন এক পক্ষীসাম্রাজ্য।
যে কবি এত ভালোবাসেন ফুল পাখি লতাপাতা, তিনি নিজ হাতে পাখিদের জন্য খৈ মুড়ি গুড় মেখে গাছের তলায় ছড়িয়ে দিতেন আর ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে বসত কবির পাশে, তিনি উজাড় করে স্নেহ বিলিয়েছেন তাদের, যেমন তাঁর নয়নের মণি কন্যা হাসনা ও আসমা, পুত্র হাসু, বাসু, রাসু—তেমনি তাঁর স্নেহের পরশ পেয়েছে কত না শিশু।
আমাদের শিক্ষা জীবনে নতুন করে পেয়েছি কবি জসীম উদ্দীনকে, তাঁর কবিতা পাঠ্যবইতে ছিল, ছিল অনার্স ক্লাসে। তখন থেকেই শ্যামল বরণ মায়াবী চেহারা কোমল হৃদয় কবিকে আপন ভাবতে শিখেছি। আমার মতো ক্লাসের সব শিক্ষার্থীর মনেই ছিল তাঁর জন্য গভীর মমতা। এত সহজে যে কবিতা মনের তারে তারে সেতারের সুর জাগিয়ে তোলে, তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরব। কবিদের শ্রেণীভাগ করা যায় না, কাব্যের যে ক্ষেত্রেই তাদের সৃজন হোক না কেন, তাঁদের একমাত্র পরিচয় তাঁরা কবি। গীতিকবি, পল্লীকবি, মহাকাব্য কবি, বিদ্রোহী কবি, বিশ্বকবি যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাঁরা হলেন সর্বজনীন, প্রত্যেকেই নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার দীপ্তিতে ভাস্বর। রূপ রস বর্ণ গন্ধহীন বিবর্ণ পৃথিবীকে অপরূপ করে তোলাই তাঁদের কাজ। কবি জসীম উদদ্ীনের কাছে জাতির ঋণ সবসময়ই থাকবে, আমরা তাঁরই কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে নিবেদন করব আমাদের নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নৈবেদ্য।
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে
এতোটুকু তারে ঘরে এনেছিনু পরীর মতোন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলো বলে কেঁদে ভাসাইতো বুক
সেই ডালিম গাছের রক্তিম ফুলগুলো পাপড়ি ছড়ায় আজও সবুজ দূর্বাদলের ওপর শান্তিতে নিদ্রারত কবির কবরে। আমার অতি প্রিয়জন কবি জসীম উদ্দীন, যাঁকে আমি ডাকি চাচা বলে। আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর, ভাইয়ের, অতি নিকট আত্মীয়ের।
সিলেটে হজরত শাহজালাল রাহমতুল্লাহ আলাইহির দরগায় টিলার সবুজ ঘাসে শুয়ে আছেন আমার আব্বা, খেজুর গাছ থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে কমলা রঙের খেজুর, ঝরে পড়ে তার পাতা। কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, ছবিতেও দেখিনি তাঁকে। দরগার সম্মান রক্ষার্থে মহিলারা কবরের পাশে যেতে পারেন না। সাদা প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন দূর থেকে দেখি আব্বার কবর, মোনাজাতের হাত তুলি, তখন অম্বিকাপুরের ডালিম গাছের নিচের কবরগুলোর ছবি মনে ভেসে ওঠে।
উনিশশ’ তেষট্টি সালে বিয়ে হয়ে এসেছি পুরানা পল্টনে ‘হিরামন মঞ্জিলে’, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমার নবীন সঙ্গী আব্বাসীর সঙ্গে ঘুরতে বেরুতাম কখনও শান্তিনগর, কখনও কমলাপুর, কখনও নয়াপল্টন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীম উদ্দীন, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী কলিম শরাফী, কবি মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, কবি গোলাম মোস্তফা—এঁদের বাড়িগুলোতে আমাদের নিত্য আনাগোনা। গোসল নাস্তা পর্ব শেষে একটি রিকশাতে চড়ে দু’জনে দশ মিনিটেই পৌঁছে যেতাম গন্তব্যে। এই গুণীজনেরা যেন সোনার মানুষ। এত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করতাম, বাড়িতে ফেরার তাগিদ থাকত না।
সবচেয়ে বেশি যাওয়া হতো কমলাপুরে জসীম উদ্দীন ও মমতাজ জসীম উদ্দীনের বাড়িতে। আমাদের দু’জনারই অতি প্রিয় এই চাচা ও চাচি, কবিতা ও সুখাদ্য, আকর্ষণ তো কম নয়। কী যে আনন্দের খনিতে অবগাহন! অতি সহজ সরল পরিবেশ, একতলা বাড়ির চারপাশে সুপুরি নারকেল কলা আম জাম কাঁঠালের গাছ ছায়া বিস্তার করে আছে, এক পাশে বেলী চামেলী গন্ধরাজ কামিনী মাধবীলতা জুঁইয়ের সুগন্ধি ঝাড়।
কবি জসীম উদ্দীন চাচা ও চাচি মমতাজ (যাঁকে আদর করে ডাকেন মণিমালা) স্নেহের চাদর বিছিয়ে ডেকে নিতেন কাছে। শীতের সকালে রোদ্দুরে পাটি পেতে বসে চাচি পরিবেশন করতেন নকশি পিঠা, মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, ঘন দুধের ক্ষীর। কত যে সুস্বাদু খাদ্য তাঁর ভাণ্ডারে, রাঁধতে ভীষণ ভালোবাসতেন, আরও ভালোবাসতেন লোকজনকে ডেকে খাওয়াতে। কবি চাচা তাঁর নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন মৃদু স্বরে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। অনেক সময় আমরাই প্রথম শ্রোতা অথবা প্রথম পাঠক।
কবিতাপ্রীতি তো আমার জন্মসূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার। যখন শৈশবে পিতাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে এসেছি মনু নদীর তীরে মৌলভীবাজার শহরে, যেখানে প্রকৃতি ও সাহিত্য এক হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। হুরু মামু সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট বোন সৈয়দা হিফজুন্নেসা খানম গৌর বর্ণের রূপসী মহিলা আমার আম্মা। সবসময়ই সাদা রঙের শাড়িতে তাঁকে দেখেছি, রঙের কোনো ছিটেফোঁটা নেই, তবু কী অপরূপ, বিধাতা যেন তাঁর সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন আমার মায়ের চেহারায় ও চরিত্রে।
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়
মায়ামমতায় জড়াজড়ি করি মোর গৃহখানি রহিয়াছে ভরি
মায়ের আদরে ভাইয়ের স্নেহে বোনের মায়ার ছায়
যাবে তুমি ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাব তবে লইয়া ঘাটের তরী
মায়ের মুখে শুনতাম কবিতাগুলো বিছানায় ঘুমুতে যাওয়ার ক্ষণে। আরও কত কবিতা, যেন স্বপ্নের জগতে চলে যাওয়া।
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই
মামার বাড়ি পুণ্যিপুকুর
গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল
আম কাঁঠালের বনের ধারে
মামা বাড়ির ঘর
আকাশ হতে জ্যোত্স্না কুসুম
ঝরে মাথার পর
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর-রঙে নাওয়া;
সেই ঘরেতে এক্লা বসে ডাকছে আমার মা—
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।
রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে আবার কোথা ধাও,
পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।
ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,
সরষে ফুলের পাপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু’খান পা,
বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা’।
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই।
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।
‘নীল নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ, কলার পাতা দোলায় চাপা শিশির ধোয়ায় পা’—এমন শ্যামলিমা ভরা গাঁ পৃথিবীর আর কোনো দেশে বোধ করি অবস্থান করে না। বাংলাদেশ এই হাজার হাজার গ্রামের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিবিম্ব। মনে বড় সাধ জাগে এমন শ্যামল উদ্ভিদ লতাপাতা গুল্মময় গ্রামে ঘুরে বেড়াতে। আমার জন্মভূমিতে অনায়াসেই খুঁজে পাই কবির সেই ভালোবাসার গ্রাম। আমার অন্তরে তারা স্থায়ী ছবি এঁকে নেয় তাঁদের মাধুরিমায়।
যখন বড় হয়ে নিজে নিজে পড়তে শিখলাম ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’—কী বিস্ময় কী বিস্ময়। এত সহজ ছন্দে সহজ বাক্যে কবি সৃষ্টি করলেন অসাধারণ কাব্য।
আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো কবির অপূর্ব সৃষ্টি।
নদীর কূল নাই কিনার নাই রে
আমি কোন্ কূল হতে কোন্ কূলে যাব কাহারে শুধাই রে \
ও পারে মেঘের ঘটা
কণক বিজলি ছটা
মাঝে নদী বহে শাঁই শাঁই রে।
আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাই রে \
বিষম নদীর পানি
ঢেউ করে হানাহানি
ভাঙ্গা এ তরণী তবু বাই রে।
আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর যদি দেখা পাই রে \
আমার গহীন গাঙ্গের নাইয়া
তুমি অপর বেলায় নাও বায়া যাও রে
ও দরদী কার বা পানে চাইয়া \
ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়
পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায় রে
ওরে আবছা মেঘে হাতছানি দেয়
কে জানি মোর সয়া-রে \
ঐ না গাঙ্গের আগের বাঁকে
আমার বন্ধুর দ্যাশ
কলাবনের বাউরি বাতাস দোলায় মাথার ক্যাশ;
কইও খবর তাহার লাইগা
কাইন্দা মরে এই অভাইগা রে
ও তার ব্যথার দেওয়া থাইক্যা থাইক্যা
ঝরে নয়ন বায়া রে \
জসীম উদ্দীন ও আব্বাসউদ্দীন যেন এক বৃন্তের দু’টি কুসুম। তাঁদের সেই অমর সৃষ্টি আজও স্পন্দিত হয় বাংলার লোকে-লোকান্তরে।
জসীম উদ্দীনের বাড়ির আবহে গ্রামবাংলার ছবি কী সুন্দর মমতায় চিত্রিত। বাঁশ ঝাড় কলাগাছ লাউয়ের মাচার ঐশ্বর্য, গোয়াল ঘরে গরু, আরও আছে হাঁস মুরগি ছাগল কবুতর। পাখিদের কিচিরমিচির তার সঙ্গে যুক্ত হয় কাকের কা-কা রব। কবি নিজ হাতে গাছপালার যত্ন করতেন। গাছের গোড়ায় পানি দেয়া, মাটি দেয়া, শুকনো ডাল কেটে ফেলা, পোকামাকড় সাফ করা সব নিজ হাতে করতেন। ফুল ও পাখি দুটোই ছিল তাঁর প্রিয়। কবিপত্নী শরত্কালের ভোরে উঠে প্রথমে শিউলি ফুল কুড়াতেন, তারপর সংসারের নানা কাজ। একবার কবি বাজার থেকে পঞ্চাশটি মাটির কলসী কিনে আনলেন, কবিপত্নী অবাক হয়ে দেখছেন, কবি বললেন, বাড়িতে অনেক গাছ আছে পাখিদের বাসার খোঁজে যাতে ঘুরাঘুরি করতে না হয়, তাই কলসীগুলো কিনে এনেছি। এগুলো রশি দিয়ে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেব। কলসীগুলোর গলার কাছে ফুটো করে আম গাছ জাম গাছ বেল গাছ কাঁঠাল গাছ চালতা গাছ সব গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। বাগানের দক্ষিণ কোণে ঝড়ে ভাঙা একটি সফেদা গাছ ও বকফুল গাছ ছিল। এই দুই গাছে নারকেল পাতা খড়বিচালী ঝুলিয়ে দেয়া হলো শালিক ও বুলবুলির জন্য, তারা বাসা বাঁধল সেখানে। আস্তে আস্তে কলসীগুলোতেও নীড় বাঁধল পাখিরা, যেন এক পক্ষীসাম্রাজ্য।
যে কবি এত ভালোবাসেন ফুল পাখি লতাপাতা, তিনি নিজ হাতে পাখিদের জন্য খৈ মুড়ি গুড় মেখে গাছের তলায় ছড়িয়ে দিতেন আর ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে বসত কবির পাশে, তিনি উজাড় করে স্নেহ বিলিয়েছেন তাদের, যেমন তাঁর নয়নের মণি কন্যা হাসনা ও আসমা, পুত্র হাসু, বাসু, রাসু—তেমনি তাঁর স্নেহের পরশ পেয়েছে কত না শিশু।
আমাদের শিক্ষা জীবনে নতুন করে পেয়েছি কবি জসীম উদ্দীনকে, তাঁর কবিতা পাঠ্যবইতে ছিল, ছিল অনার্স ক্লাসে। তখন থেকেই শ্যামল বরণ মায়াবী চেহারা কোমল হৃদয় কবিকে আপন ভাবতে শিখেছি। আমার মতো ক্লাসের সব শিক্ষার্থীর মনেই ছিল তাঁর জন্য গভীর মমতা। এত সহজে যে কবিতা মনের তারে তারে সেতারের সুর জাগিয়ে তোলে, তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরব। কবিদের শ্রেণীভাগ করা যায় না, কাব্যের যে ক্ষেত্রেই তাদের সৃজন হোক না কেন, তাঁদের একমাত্র পরিচয় তাঁরা কবি। গীতিকবি, পল্লীকবি, মহাকাব্য কবি, বিদ্রোহী কবি, বিশ্বকবি যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাঁরা হলেন সর্বজনীন, প্রত্যেকেই নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার দীপ্তিতে ভাস্বর। রূপ রস বর্ণ গন্ধহীন বিবর্ণ পৃথিবীকে অপরূপ করে তোলাই তাঁদের কাজ। কবি জসীম উদদ্ীনের কাছে জাতির ঋণ সবসময়ই থাকবে, আমরা তাঁরই কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে নিবেদন করব আমাদের নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নৈবেদ্য।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন