আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মার্দান শহরের অধিবাসী ছিলেন। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনছিলাম আমার দাদা মোহাম্মদ আমিনউদ্দীন খান; তার পিতা মোহাম্মদ মেহের খান এবং তার ভাই মোহাম্মদ লাল খান ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী সিপাহী বিদ্রোহে সরাসরি অংশগ্রহণ করছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের পর তারা দুই ভাই পালাইয়া কলকাতা হইয়া বরিশালে আসেন এবং এখান থেইকা ফরিদপুরের বাহাদুরপুরের পাশে নলগড়া গ্রামে বসবাস করেন। ফারায়জী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর এলাকা বাহাদুরপুর নানা কারণে তখন নিরাপদ ছিল। তাছাড়া ওই এলাকায় ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ও কম ছিল। ব্রিটিশদের এই দেশ থেকে তাড়াবার জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহর বংশধররা ছিলেন সক্রিয়।
আমার জন্মের আগে বাবা মোহাম্মদ মোহসেন উদ্দীন খান বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯২০ সালে বিএ পাস করার পর বরিশালে স্কুল মাস্টারি শুরু করেন। আমার নানা মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন। পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে নারায়ণগঞ্জে বাড়ি-ঘর করেন। আমার মা আঞ্জুমান আরা তার একমাত্র মেয়ে। মায়ের বড় ভাই ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর নানা মাকে শ্বশুর বাড়ি যেতে দেয়নি। আমি নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার বাড়িতে ইংরেজি ১৯২৩ সালের ৩রা এপ্রিল জন্মগ্রহণ করি। আমার নানার ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানির সাথে চুক্তি ছিল। তার ব্যবসা ছিল। নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ড থেইকা তার মালামাল জাহাজে গোয়ালন্দ ঘাটে যাইত। নারায়ণগঞ্জে তার একটা বড় জুতার দোকান ছিল।...
আমার বড় মামা আবুল ফজল মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা গেলে নানা একেবারে ভাইঙ্গা পড়েন। তিনি একমাত্র মেয়ে মাকে বাবার কাছে যাইতে দিতে চাইতেন না। তাছাড়া বাবা সরকারি স্কুল মাস্টার, বদলির চাকরি ছিল। নানা ইদ্রিস মিয়ার সাথে আমার ভালো ভাব ছিল। শিশুকালে নানার হাত ধইরা রোজ সকাল বিকাল ঘুরতে বাইরাইতাম। জিমখানার মাঠে সাহেবরা গলফ খেলত। ব্রিটিশ আমলতো। সাইজা গুইজা নানার সাথে সকাল বিকাল সেই মাঠে যাইতাম। হাতে একটা ছরা বা লাঠি নিতাম। নানার যারা বন্ধু-বান্ধব, তারা আমারে দেইখা কত ঠাট্টা করত। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বেড়াইতাম। নানার যেখানে ব্যবসা, সেই স্টিমার ঘাটেও মাঝে মধ্যে যাইতাম। তারপর যাইতাম নানার সঙ্গে সিনেমায়। আট বছর বয়সে প্রথম সিনেমা দেখি হংস থিয়েটারে নানার সঙ্গে। টারজান দা এ্যাপ ম্যান। সিনেমাটা কয়েকবার দেখছি। সিনেমা হলটা এখনও আছে।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলে সাত বছর বয়সে ভর্তি হই ক্লাস ওয়ানে। বিক্রমপুরের আরব আলী নামে একটা লোক ছিল কাজের, সে স্কুলে নিয়া যাইত ও নিয়া আসত। নানার পূর্বপুরুষরা বিক্রমপুরের, তবে নোয়াখালীর সুধারাম তাদের আদি নিবাস এবং ব্যবসার জন্য নানা নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিলেন। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আমার নানা ১৯২৯ সালে যে দালান তৈরি করছিলেন তার নাম মৌলভী বাড়ি, সেখানেই আমার বিয়া হয়। পুকুর ঘাট অলা বিরাট বাড়ি। ভাগাভাগি হওয়ার পরেও মূল বাড়িটা এখনও জ্যান্ত আছে। জসীম উদ্দীনের কবিতা পড়ছি ক্লাস নাইনে উইঠা। কি কবিতা ছিল? নাইনে থাকতে ম্যাট্রিক সিলেবাসে ছিল রাখাল ছেলে। দুই চার লাইন মনে আছে? রাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি ধরে কোথায় চলে যাও...। আমার মুখস্থ ছিল, এখন মনে নাই। আমি যখন ক্লাস টেনে, তখন মা ফরিদপুরে। বাবা ফরিদপুর জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। আমার ছোট ভাই মিন্টু বাবা-মায়ের সাথে টেপাখোলার বাড়িতে থাকে। স্কুলের ছুটিতে আমি ফরিদপুরে যাই, ওরাও আসে। আদরে আদরে দিনগুলি কাটতেছিল। তখন মনে হইত এইভাবেই বুঝি সারাজীবন কাটতে থাকবে।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতেও বেশ ভালো ছিলাম। সবাই আদর করত। সোনা ভাই সোনা মা (নানী) একটু চোখের আড়াল হইলেই অস্থির হইয়া পড়ত। আমার নানীর বাবা হাজী ইব্রাহীম নারায়ণগঞ্জের প্রথম হাজী। শফিউল্লাহ সাহেবের সাথে আমার খালার আত্মীয়তা ছিল। উনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্সের লেকচারার। তার সঙ্গে কবি সাহেব আসলেন আমাদের বাড়িতে। জসীম উদ্দীন সেই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলার লেকচারার। শফিউল্লাহ সাহেব একদিন আমার নানা ভাইকে বললেন, আপনার বাড়িতে আগামীকাল একজন গুণী মানুষ আনব। যদি অনুমতি দেন। সোনা ভাই বললেন, লোকটি কে? উনি বললেন, ভদ্রলোক একজন কবি। সোনা ভাই খুব খুশি হইছিলেন। তিনি তো নিজেও কবিতার প্রতি দুর্বল ছিলেন। ফার্সি ও বাংলায় খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন আমার নানা। গুণী মানুষ পাইলে আপ্যায়ন করতেন নিজে। তিনি অনুমতি দিলেন। পরের দিন কবি সাহেব আসলেন পাইকপাড়ায় আমার নানার বাড়িতে। সোনা ভাই কবির জন্য সম্মানজনক মেহমানদারীর ব্যবস্থা করলেন।
ঐদিন কবি জসীম উদ্দীনকে ঝাপসা দেখছি। আমার ঘরের সামনে দিয়া তো সোনাভাইয়ের ঘরে যাইতে হয়। আমি ঘরের ভিতর থেইকা জানালা দিয়া দেখলাম—শফিউল্লাহ আর কবি সাহেব ছিলেন লম্বা। এক ঝলক দেখলাম একজন নতুন লম্বা মেহমান আমার ঘরের সামনে দিয়া হাইটা গেলেন। আমি তখন আলাদা রুমে থাকতাম। একপাশে আমার বিছানা আরেক পাশে নানীর বিছানা থাকত।
পনের ষোলদিন পরে শফিউল্লাহ সাহেবকে নিয়ে কবি আবার আসছিল। আমাকে জানানো হয়নি। পড়ার টেবিলে বইসা আছি। কিছুক্ষণ আগে আমার স্কুলের মাস্টার কুমুদরঞ্জন বাবু পড়াইয়া গেলেন। আমি খাতা টাতা গুছাই এদিক ওদিক তাকাই, এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক ওই ঘরের সামনে দিয়া আমার দিকে চাইতে চাইতে বারান্দা পার হইল। আমিও চাইয়া রইলাম। দেখলাম ভদ্রলোক গলায় চাদর প্যাঁচানো, মানে সাহেবি পোশাক না। ধুতি পরা পাঞ্জাবি পরা সাদা চাদর গলায়। চশমা ছিল না। জসীম উদ্দীন তখন মাঝে মধ্যে ধুতি পরতেন। তিনি আমার নানা ভাইয়ের ঘরে গেলেন। সন্ধ্যার একটু আগে। কিছুক্ষণ থাকার পর উনি চইলা গেলেন। যাওয়ার সময় আমি দেখি নাই। তারপরে কতদিন পরে আমাদের বাড়িতে আসছিলেন আমার ঠিক মনে নাই। প্রায় একমাস কি বিশ পঁচিশ দিন হবে। ঐ শফিউল্লাহ সাহেবের সাথেই আবার আসলেন। আসার সাথে সাথেই দেখলাম একটা চঞ্চল অবস্থা। খুব খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমি কিন্তু আগে থেইকা কিছুই জানি না।
আমি কি যেন একটা খাতা নাড়াচাড়া করতেছিলাম। হঠাত্ দেখি সেই ভদ্রলোক টপ কইরা আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে চেয়ারে আমার মাস্টার মশাই বসেন সামনাসামনি, সেই চেয়ারটায় একাই বইসা পড়লেন। আমি একটু অবাকই হইয়া পড়লাম। হঠাত্ কোন জানান না দিয়া আমার ঘরের ভিতরে অচেনা মানুষ! আত্মীয়-স্বজন না। আশ্চর্য ব্যাপার। আমার একটা খাতা টান দিয়া নিয়া বলল, খুকী তুমি এই খাতাটা আমাকে দিবা, আমি তোমাকে একটা কবিতা লেইখা দেই? আমি মাথা ঝুলাইলাম। কিছুক্ষণ বেশ কাটাকুটি কইরা এক পৃষ্ঠায় কবিতা আর এক পৃষ্ঠায় গান লিখলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন খুকী তুমি কবিতা ভালোবাস? আমি একটু ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, না। কথাটা বলার পর আমি একটু হাইসা দিছি। তারপর আর কোন কথা হয় নাই। তখন তো আমি জানি যে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা আমাদের সিলেবাসে আছে। রাখাল ছেলেটা। আমার খাতায় লেখা কবিতাটা ছিল—
আমারে করিও ক্ষমা
সুন্দরী অনুপমা
তোমার শান্ত নিভৃত আলয়ে
হয়তো তোমার খেলার বাসরে
অপরাধ রবে জমা
আমারে করিও ক্ষমা।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। ওটা শুধু মেয়েদের স্কুল ছিল, প্রাইভেট স্কুল। এখনও গেলে দেখি সেই গেইট, সেই ভবন। ও এখন মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের সামনে আরও কিছু সময় ছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, খুকী তুমি কি গান গাইতে পার? আমি বললাম, না। আসলে গান জানতাম।
ভদ্রলোক তো আমারে দেখার পর নানা দিক থেইকা আমার নানা ভাইরে হাত করার জন্য লাইগা গেল। অনেককে দিয়া সুপারিশ করতে লাগল। ওই যে আমারে দেখল, আমার রূপ তার মনে ধইরা নিল, কবি তো!
কবি সাহেব আরেকদিন যখন আসলো, আমাকে গান গাওয়ার জন্য পনের বিশ মিনিটের মত অনুরোধ। আমি আর হারমোনিয়ামে হাত দেই না। আমার নানী ধমক দিল খুব জোরে। নামকরা লোকের সাথে বেয়াদবি করতেছ। গান শিখছ তো মানুষরে শুনানোর জন্যই। শুনাও। তারপর আমি তখন গাইছিলাম নিশীথে যাইও ফুলবনে...। এটা জসীম উদ্দীনের লেখা গান। কিন্তু আমি তখন জানতাম না। আমার গানের মাস্টার শিখাইছিল রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান এবং এই গানও। তারপরও আরও গান গাইতে খুব অনুরোধ করছিল। আমি আর গাই নাই।
কবি সাহেব আমাকে প্রথম দেখার পর তলে তলে অনেক ঘটনা ঘটতেছিল। আমি কিছুই জানি না। আমার মনে হইতে লাগল ভদ্রলোক যে ঘন ঘন এই বাড়িতে আসতেছে ব্যাপারটা কি! তারপরে আমার খালারা হাসি মস্করা কানা-ঘুষা তাতে একটা আলামত পাওয়া গেল। একদিন আমার এক আত্মীয় ঠাস কইরা বইলা ফালাইল, তোমাদের বাড়িতে যে কবি জসীম উদ্দীন আসে তার সাথে তোমার বিয়া ঠিক করতে চায় তোমার নানা। তুমি রাজি আছ কি না? তিনি আমার মাধ্যমে জানতে চান। আমি ছেলেমানুষী ছলে বইলা ফালাইলাম, আমার মত আছে। তারপর দৌড় দিয়া দিদির সামনে থেইকা পালাইয়া গেলাম। আমার আনন্দ হইতে লাগল যে একটা বিয়া হইতে যাইতেছে। হৈচৈ কত মজা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তখন তা বুঝি নাই।
তারপর তো আর কি চাই! নাতিন বিয়ায় রাজি হইয়া গেছে। সোনা মা মনে করছিল রাজি হব না। কবি হিসেবে তাকে তো জানতামই। তখন মনে হয় নাই একটা কালো লম্বা মানুষ, আবার কবি, তার সাথে আমার বিয়া হইতে যাইতেছে। আমার মা অবশ্য বিয়া দিতে চায় নাই। কালো, এ জন্য আমার কোন অসুবিধা ছিল না। তারে দেইখা আমারও পছন্দ হইছিল। বয়সটাও আমার কাছে কোন বাধা মনে হয় নাই। সবচেয়ে পছন্দ হইছিল কি—তিনি হাইসা যখন কথা বলছিলেন একদিন দেখলাম সোনার দুইটা দাঁত চকচক কইরা উঠল। তাঁর সোনার বান্ধানো দাঁত ছিল দুইটা সামনের দিকে। সোনার দাঁত দেখার জন্য তার দিকে বারে বারে চাইছি। সোনার দাঁত পরে ছিল না। প্লাস্টিকের দাঁত লাগাইছিল।
কবি সাহেব যখন বিয়ার প্রস্তাব দিল, তখন প্রথম দিকে আমার নানা-নানী রাজি হয় নাই। ওরা দুই বছর ঘোরাঘুরির পর নানা-নানী নরম হইছে। নানান কারণে তারা রাজি হয় নাই। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, বয়সের এতো তফাত্, অ্যাডজাস্ট হইব কি না। এত আদর আহ্লাদ কইরা অচেনা অজানা এক ছেলের সাথে...। তারপর বাবার কাছে নানা চিঠি দিলেন। বাবা তখন ফরিদপুরে জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। অনেক ছাত্র তার। শহরে নাম-ধাম আছে। বাবা তো সেই চিঠি পাইয়া সাত পৃষ্ঠা চিঠি দিলেন নানার কাছে। বাবা লিখছিলেন, আপনি কি পাগল হইয়া গেলেন। এই লোকটা পাগল। চরে চরে ঘুইরা বেড়ায়। গান গাইয়া বেড়ায়। ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান, মুর্শীদি গান। গানের মজলিসে সারারাত কাইন্দা কাইটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এইরকম ছেলের কাছে বিয়া দিবেন? তার চাইতে আপনি নাতিনরে পদ্মায় ফালাইয়া দেন।
নানা তো চিঠি পাইয়া হতভম্ব হইয়া গেল। একটু রাগও হইল। নানাভাই বলল, ছেলেটাকে আমি প্রায় দুই বছর যাবত্ দেখতাছি। ভালোই তো। সোনাভাই তখন মহসিন হলে যাইতেন এবং পরে কবি সাহেব থাকতেন নিউ মার্কেট এলাকায়, মানে ঠিক উত্তরে ঢাকা কলেজের কাছে হইলদা রঙের একতলা বাড়ি, বাড়িটা নাকি এখনও ঐরকমই আছে। সোনাভাই না বইলা খুব সকালে যাইয়া উঠলেন। দেখার জন্য, আসলে ছেলেটা কেমন। একদিন একটা মজার ঘটনা সেই বাড়িতে হইছিল। আমার সোনাভাই ভোরে যাইয়া কবি সাহেবকে উঠাইয়া বিদায় নিতেছিল। কবি তাকে নাস্তা খাওয়াইয়া খাতির কইরা তারপর রুমে আটকাইছে। কবি সাহেব বলছিলেন, আমার কাছে নাতিন বিয়া দিবেন কি না কথা দিয়া যাইতে হইব। নইলে আইজকা আপনারে ছাড়মু না। নানা ভাইতো মুস্কিলে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত কথা দিয়া ছাড়া পাইতে হইছিল।
আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও বিস্ময়। এত বড় কবির সাথে বিয়া হইতে যাইতেছে, তখন যার কবিতা পাঠ্য বইয়ের অন্তর্গত। খুব একটা অন্যরকম ভাব আমার আসছিল। মানে স্বপ্নের মতো অবস্থা। আমি তখন বিয়ার কথা চিন্তা করতাম না। ছিলাম স্কুলের ছাত্রী। সোনা মা আমারে সাধারণত কারো সাথে মিশতে দিত না। আমি ছিলাম খুব একা। মাঝে মধ্যে ছুটির সময় আমার ছোট ভাই মিন্টু আসতো। ওর সাথে খেলা করতে করতে মনে হইত আমি বুঝি বন্দি অবস্থা থেইকা মুক্তি পাইলাম।
আমার বিয়ার কথাবার্তা চলতেছে। তারিখ-টারিখও ঠিক হইল। ৩ মাস পরে বিয়া হবে ইউনিভার্সিটির গ্রীষ্মের ছুটিতে। নানা ঠিক করলেন ছেলের বাড়ি দেখতে হয় তিনি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে তার এক ভাইগ্না এবং মিলনদাকে পাঠাইলেন। মিলনদা আমার খালাতো ভাই।
ঐ দুই যুবক সব খোঁজ খবর নিয়া আসলেন। কবি সাহেব তিনদিন তাদের এমন আপ্যায়ন করলেন যে, তারা মহা খুশিতে নারায়ণগঞ্জে ফিরা আসলেন। ওদের যখন বাড়িঘর দেইখা পছন্দ হইছেন তখন নানাও খুশি। তিনি বিয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। সোনাভাই আমার বিয়ার ঠিক আগের দিনগুলোতে রাতে কানতেন। এত আদর কইরা নাতিন পালছেন, তারে বিদায় দিতে তার কষ্ট হইতেছিল। তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখ দেখলে বুঝা যাইত অন্তর কানতেছে। বিয়ার জিনিসপত্র কেনাকাটা শুরু হইল। কলকাতা গেল বিয়ার মার্কেটিং করতে। সাথে মিলনদাও গেছিল। তাকে নেয়া হইছিল আধুনিক জিনিসপত্র চিনবার জন্য, কারণ নানাভাই আগের দিনের মানুষ। তারা বহু জিনিসপত্র আনলো—খুব সুন্দর বেনারসী, আকাশী নীল রঙের। আমি মনে মনে ভাবলাম আমারে লাল শাড়ি দিল না কেন। সে সময় শাড়িটার দাম ছিল একশ’ সত্তর টাকা। আর বরের জন্য কলকাতা থেইকা খুব দামি সেলোয়ারের কাপড়, তারপর শেরওয়ানী, টুপি ও পাগড়ি এবং কাপড় আনছিল। কাপড় নিয়া অম্বিকাপুর পাঠানো হইছিল। সেগুলি নারায়ণগঞ্জের ভালো টেইলারিং থেইকা বানানো হইল। কবি সাহেব তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অম্বিকাপুরে।
ঘটনাটা ১৯৩৯ সালের। গায়ে হলুদ যখন হইছিল, তখন আমি ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মাইরা দেখলাম অনেক জিনিসপত্র, ডালা-ডুলা আর সাত-আটটা ঘোড়ার গাড়ি বাড়ির সামনে। প্রত্যেকটা ঘোড়া নানা রঙের ফুল দিয়া সাজানো হইছে। ঐভাবে গায়ে হলুদের জিনিস দিয়া সারা শহর ঘুইরা আইছে সবাই। খুব ফুর্তি হইছিল। গায়ে হলুদেই লোক হইছিল এক হাজারের মতো। আমার মা-বাবা’র বিয়াতে মত ছিল না। তারা ক্ষুব্ধ। তাই বিয়ার কোন অনুষ্ঠানে তারা আসেন নাই। শুধু ফরিদপুর থেইকা অনেক কান্নাকাটি করার পর মিন্টুরে পাঠাইছিল।
হলুদের মালপত্র নিয়া আমাদের ঘাটে যাওয়া হয়, যেখানে ফরিদপুরের স্টিমার আসে। ওই ঘাটে কবিকে সমস্ত কাপড়-চোপড় পরাইয়া আনা হইল নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। বরযাত্রী পঁচিশ ত্রিশজন, এর বেশি হবে না। সাথে ছিল তার বড় ভাই, বোনের জামাই, চাচাতো ভাইরাও ছিল। বিয়াতে গেইট ধরা হইছিল। শালীদের সঙ্গে এক ঘণ্টা যুদ্ধ। খালাতো বোনদের সাথে কথা কাটাকাটি হইল। এক টাকাও দেয় নাই। আমার বোনরা বলছিল, যাইতে দিব না। কবি বলছিল, ঠিক আছে দাঁড়াইয়া থাক। তারপর সময় নষ্ট হইতেছে দেইখা আমার নানা সবাইকে গেইট ছাইড়া দিতে বললেন। বিয়ার তারিখটা ছিল, আমার ইংরেজি মনে নাই, বাংলা মনে আছে— ১০ই আষাঢ়, ১৯৩৯ সাল। মনে হয় পঁচিশ তারিখ ছিল। তখন কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।
বিয়ার দিনের ঘটনা আমি তো সবকিছু নিজে দেখি নাই। পরে শুনছি। আমারে খুব সাজাইছিল। ঢাকা থেইকা ফুল কিনছিল কয়েক মণ। বিয়ার দিনে আমার মন খারাপ ছিল না। যখন আমারে বিদায় দেয়, সবাই কানতেছিল। দেখলাম সোনা মা হাইসা বাঁচে না। কি যেন আমার মনে হইছে। আমি তো চইলা যাইতেছি না। আমার মনে হইতেছিল বেড়াইতে যাইতেছি, আবার বাড়িতে চইলা আসমু। সেই সবকিছু বুঝবার মতো বুদ্ধি হয় নাই আমার তখন।
আমরা পরের দিন নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছিলাম। বিয়ার আসরে নামকরা অনেক লোক আসছিল। আমার স্পষ্ট সবার নাম মনে নাই। অনেক চিঠিপত্র আসছিল কলকাতা থেইকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে শুভেচ্ছা জানাইয়া চিঠি দিছিল। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খুব বড় শিল্পী, তিনি খুব সুন্দর একটা চিঠি এবং তার হাতে আঁকা একটা ছবি পাঠাইছিলেন দুইজনের নামে। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন শুভেচ্ছা জানাইছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটায় ছিল সুন্দর গোলাপী রঙের দুইটা কবুতর একটা ডালে বসা। ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখছিলেন, তিন পৃষ্ঠার এক চিঠি। চিঠিটা এখনও পড়ি। জীবনের যে এত ধাপ তার প্রত্যেকটির বিবরণসহ উপদেশ দিয়ে চিঠিটা লেখা। কে যেন ডাকযোগে কলকাতা থেইকা লাল টকটকা একটা মটকা শাড়ি পাঠাইছিল। যে মৌলভী বিয়া পড়াইতে আসছিল, সে বিয়ার আসরে একটু আপত্তি জানাইছিল। বিয়ার আসরে হুজুর নানা ভাইয়ের কাছে আপত্তি কইরা বলল, আপনার নাতিনরে তো নাচ শিখাইছেন, গান শিখাইছেন, হিন্দু খ্রিস্টানগো মতোন চালচলন শিখাইছেন। এখন ওর কলেমা পড়া লাগব। আমার নানা মহা ক্ষেইপা গিয়া হুজুররে বাদ দিয়া নিজেই দোয়া পড়লেন।
আমি কিন্তু বিয়ার আগে তিনবার কোরআন শরীফ খতম করছি। স্কুলে নাচ, গান, নাটক সবই করছি। কিন্তু সুন্দর জীবনযাপন করছি। ভদ্রভাবে চলার চেষ্টা করছি। বিয়াতে কবি জসীম উদ্দীন কোন যৌতুক নেন নাই। তবে আমার নানাভাই ঘরের প্রায় সমস্ত ফার্নিচার বানাইয়া দিছিল কবিকে।
বিয়ার সময় তিন দিন আলোকসজ্জা করা হইছিল এবং ব্যান্ড পার্টি বাদ্যযন্ত্র বাজাইছে। বাসর ঘর কাঠ গোলাপ, রজনীগন্ধা এবং চামেলী ফুল দিয়া অপরূপ কইরা সাজানো হইছিল। এরোন ফকিরের গল্পটা বলা হইল না। ফরিদপুরের সেই আমলের বিখ্যাত গায়েন এরোন ফকির কবি সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আসছিলেন বিয়াতে। আমি তো ঘোমটা দিয়া বইসা আছি। অনেকেই ঘোমটা উঠাইয়া নতুন বউয়ের মুখ দেইখা যায়। তখন হঠাত্ সামনে তাকাইয়া দেখি দাড়িঅলা এক বয়স্ক লোক। অদ্ভুত পোশাক, সবার চাইতে আলাদা। আমার মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। আমি দেখলাম স্ফটিকের মালা গলায় বাউল গোছের লোক, ফকিরী পোশাক। আমাকে দোয়া-টোয়া করল। এরোন ফকিরের বাড়ি চর ভদ্রাসনে।
বিয়ার আসরে খুব হাসাহাসি ধাক্কাধাক্কি চলছিল। আমার খালাতো ও চাচাতো বোনরা কবি সাহেবকে জব্দ করতে চাইলে তিনি সমানে ওদের সাথে তর্ক করতে লাগল। নতুন জামাইয়ের মতো চুপ থাকে নাই। ওরা তো কবির কাছে হার মাইনা গেল। অনেক রাইত পর্যন্ত বিয়ার অনুষ্ঠান চলল। প্রায় ভোর রাতের দিকে সব অনুষ্ঠান শেষে আমাদেরকে বাসর ঘরে আনা হয়। আমি খুব ক্লান্ত হইয়া পড়লে আমার নানী পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতেছিল। তখন কবি সাহেব বললেন, সোনামা, আপনি চইলা যান। আমি ঘুমাবো। আমি তো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছি। সোনামা চইলা গেলে কবি সাহেব বলেন, আসো আমরা একটু নামাজ পড়ি। আমি মনে মনে বলি ঘুমের মধ্যে কিসের নামাজ-টামাজ। আমি কথা কমু কি, উনি লজ্জা ভাইঙ্গা নিজেই কথা কইতে থাকলেন। তারপর গণকের মতো আমার হাতটা দেখল। তারপর আমি তো ঘুমাইয়া গেছি।
পরের দিন স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেইকা চাঁদপুর হইয়া গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছাই। তখন দুপুর। সেখান থেইকা ট্রেনে অম্বিকাপুর রেল স্টেশন। স্টেশন থেইকা ঘোড়ার গাড়িতে কবি সাহেবের বাড়িতে আসি। আমার জন্য একটা ভিন্ন প্রকৃতি, নতুন পরিবেশ। সবার সহযোগিতায় মানায় নিছিলাম। ফরিদপুরে আসার পরেও আমার মা রাগে ছিলেন। তিনি চাইছিলেন জামাই হবে টুকটুকা রাজপুত্রের মতো, কবি-টবি না। পরে অবশ্য কবি তার ব্যবহার দিয়া সবার মন জয় করছিলেন।
আমি নিজেও এখন জীবন সায়াহ্নে। জীবিত কালেই আমার প্রথম সন্তান হাসু মৃত্যুবরণ করছে। আমার নাতি আসিফের অকাল মৃত্যু, সবই আমাকে দেখতে হইছে। অনেক স্মৃতি আছে লিখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু শরীর বাধা হইয়া দাঁড়ায়। দেশের মানুষ কবিকে এত ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন দেইখা আমার মনটা ভইরা যায়। তখন আমার মনে হয়, উনি মরেন নাই। আমার কবি এখনও জীবিত আছেন। নাসির আলী মামুন সম্পাদিত ‘শতবর্ষে জসীম উদ্দীন’ (প্রকাশক ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
আমার জন্মের আগে বাবা মোহাম্মদ মোহসেন উদ্দীন খান বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯২০ সালে বিএ পাস করার পর বরিশালে স্কুল মাস্টারি শুরু করেন। আমার নানা মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন। পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে নারায়ণগঞ্জে বাড়ি-ঘর করেন। আমার মা আঞ্জুমান আরা তার একমাত্র মেয়ে। মায়ের বড় ভাই ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর নানা মাকে শ্বশুর বাড়ি যেতে দেয়নি। আমি নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার বাড়িতে ইংরেজি ১৯২৩ সালের ৩রা এপ্রিল জন্মগ্রহণ করি। আমার নানার ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানির সাথে চুক্তি ছিল। তার ব্যবসা ছিল। নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ড থেইকা তার মালামাল জাহাজে গোয়ালন্দ ঘাটে যাইত। নারায়ণগঞ্জে তার একটা বড় জুতার দোকান ছিল।...
আমার বড় মামা আবুল ফজল মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা গেলে নানা একেবারে ভাইঙ্গা পড়েন। তিনি একমাত্র মেয়ে মাকে বাবার কাছে যাইতে দিতে চাইতেন না। তাছাড়া বাবা সরকারি স্কুল মাস্টার, বদলির চাকরি ছিল। নানা ইদ্রিস মিয়ার সাথে আমার ভালো ভাব ছিল। শিশুকালে নানার হাত ধইরা রোজ সকাল বিকাল ঘুরতে বাইরাইতাম। জিমখানার মাঠে সাহেবরা গলফ খেলত। ব্রিটিশ আমলতো। সাইজা গুইজা নানার সাথে সকাল বিকাল সেই মাঠে যাইতাম। হাতে একটা ছরা বা লাঠি নিতাম। নানার যারা বন্ধু-বান্ধব, তারা আমারে দেইখা কত ঠাট্টা করত। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বেড়াইতাম। নানার যেখানে ব্যবসা, সেই স্টিমার ঘাটেও মাঝে মধ্যে যাইতাম। তারপর যাইতাম নানার সঙ্গে সিনেমায়। আট বছর বয়সে প্রথম সিনেমা দেখি হংস থিয়েটারে নানার সঙ্গে। টারজান দা এ্যাপ ম্যান। সিনেমাটা কয়েকবার দেখছি। সিনেমা হলটা এখনও আছে।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলে সাত বছর বয়সে ভর্তি হই ক্লাস ওয়ানে। বিক্রমপুরের আরব আলী নামে একটা লোক ছিল কাজের, সে স্কুলে নিয়া যাইত ও নিয়া আসত। নানার পূর্বপুরুষরা বিক্রমপুরের, তবে নোয়াখালীর সুধারাম তাদের আদি নিবাস এবং ব্যবসার জন্য নানা নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিলেন। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আমার নানা ১৯২৯ সালে যে দালান তৈরি করছিলেন তার নাম মৌলভী বাড়ি, সেখানেই আমার বিয়া হয়। পুকুর ঘাট অলা বিরাট বাড়ি। ভাগাভাগি হওয়ার পরেও মূল বাড়িটা এখনও জ্যান্ত আছে। জসীম উদ্দীনের কবিতা পড়ছি ক্লাস নাইনে উইঠা। কি কবিতা ছিল? নাইনে থাকতে ম্যাট্রিক সিলেবাসে ছিল রাখাল ছেলে। দুই চার লাইন মনে আছে? রাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি ধরে কোথায় চলে যাও...। আমার মুখস্থ ছিল, এখন মনে নাই। আমি যখন ক্লাস টেনে, তখন মা ফরিদপুরে। বাবা ফরিদপুর জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। আমার ছোট ভাই মিন্টু বাবা-মায়ের সাথে টেপাখোলার বাড়িতে থাকে। স্কুলের ছুটিতে আমি ফরিদপুরে যাই, ওরাও আসে। আদরে আদরে দিনগুলি কাটতেছিল। তখন মনে হইত এইভাবেই বুঝি সারাজীবন কাটতে থাকবে।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতেও বেশ ভালো ছিলাম। সবাই আদর করত। সোনা ভাই সোনা মা (নানী) একটু চোখের আড়াল হইলেই অস্থির হইয়া পড়ত। আমার নানীর বাবা হাজী ইব্রাহীম নারায়ণগঞ্জের প্রথম হাজী। শফিউল্লাহ সাহেবের সাথে আমার খালার আত্মীয়তা ছিল। উনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্সের লেকচারার। তার সঙ্গে কবি সাহেব আসলেন আমাদের বাড়িতে। জসীম উদ্দীন সেই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলার লেকচারার। শফিউল্লাহ সাহেব একদিন আমার নানা ভাইকে বললেন, আপনার বাড়িতে আগামীকাল একজন গুণী মানুষ আনব। যদি অনুমতি দেন। সোনা ভাই বললেন, লোকটি কে? উনি বললেন, ভদ্রলোক একজন কবি। সোনা ভাই খুব খুশি হইছিলেন। তিনি তো নিজেও কবিতার প্রতি দুর্বল ছিলেন। ফার্সি ও বাংলায় খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন আমার নানা। গুণী মানুষ পাইলে আপ্যায়ন করতেন নিজে। তিনি অনুমতি দিলেন। পরের দিন কবি সাহেব আসলেন পাইকপাড়ায় আমার নানার বাড়িতে। সোনা ভাই কবির জন্য সম্মানজনক মেহমানদারীর ব্যবস্থা করলেন।
ঐদিন কবি জসীম উদ্দীনকে ঝাপসা দেখছি। আমার ঘরের সামনে দিয়া তো সোনাভাইয়ের ঘরে যাইতে হয়। আমি ঘরের ভিতর থেইকা জানালা দিয়া দেখলাম—শফিউল্লাহ আর কবি সাহেব ছিলেন লম্বা। এক ঝলক দেখলাম একজন নতুন লম্বা মেহমান আমার ঘরের সামনে দিয়া হাইটা গেলেন। আমি তখন আলাদা রুমে থাকতাম। একপাশে আমার বিছানা আরেক পাশে নানীর বিছানা থাকত।
পনের ষোলদিন পরে শফিউল্লাহ সাহেবকে নিয়ে কবি আবার আসছিল। আমাকে জানানো হয়নি। পড়ার টেবিলে বইসা আছি। কিছুক্ষণ আগে আমার স্কুলের মাস্টার কুমুদরঞ্জন বাবু পড়াইয়া গেলেন। আমি খাতা টাতা গুছাই এদিক ওদিক তাকাই, এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক ওই ঘরের সামনে দিয়া আমার দিকে চাইতে চাইতে বারান্দা পার হইল। আমিও চাইয়া রইলাম। দেখলাম ভদ্রলোক গলায় চাদর প্যাঁচানো, মানে সাহেবি পোশাক না। ধুতি পরা পাঞ্জাবি পরা সাদা চাদর গলায়। চশমা ছিল না। জসীম উদ্দীন তখন মাঝে মধ্যে ধুতি পরতেন। তিনি আমার নানা ভাইয়ের ঘরে গেলেন। সন্ধ্যার একটু আগে। কিছুক্ষণ থাকার পর উনি চইলা গেলেন। যাওয়ার সময় আমি দেখি নাই। তারপরে কতদিন পরে আমাদের বাড়িতে আসছিলেন আমার ঠিক মনে নাই। প্রায় একমাস কি বিশ পঁচিশ দিন হবে। ঐ শফিউল্লাহ সাহেবের সাথেই আবার আসলেন। আসার সাথে সাথেই দেখলাম একটা চঞ্চল অবস্থা। খুব খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমি কিন্তু আগে থেইকা কিছুই জানি না।
আমি কি যেন একটা খাতা নাড়াচাড়া করতেছিলাম। হঠাত্ দেখি সেই ভদ্রলোক টপ কইরা আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে চেয়ারে আমার মাস্টার মশাই বসেন সামনাসামনি, সেই চেয়ারটায় একাই বইসা পড়লেন। আমি একটু অবাকই হইয়া পড়লাম। হঠাত্ কোন জানান না দিয়া আমার ঘরের ভিতরে অচেনা মানুষ! আত্মীয়-স্বজন না। আশ্চর্য ব্যাপার। আমার একটা খাতা টান দিয়া নিয়া বলল, খুকী তুমি এই খাতাটা আমাকে দিবা, আমি তোমাকে একটা কবিতা লেইখা দেই? আমি মাথা ঝুলাইলাম। কিছুক্ষণ বেশ কাটাকুটি কইরা এক পৃষ্ঠায় কবিতা আর এক পৃষ্ঠায় গান লিখলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন খুকী তুমি কবিতা ভালোবাস? আমি একটু ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, না। কথাটা বলার পর আমি একটু হাইসা দিছি। তারপর আর কোন কথা হয় নাই। তখন তো আমি জানি যে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা আমাদের সিলেবাসে আছে। রাখাল ছেলেটা। আমার খাতায় লেখা কবিতাটা ছিল—
আমারে করিও ক্ষমা
সুন্দরী অনুপমা
তোমার শান্ত নিভৃত আলয়ে
হয়তো তোমার খেলার বাসরে
অপরাধ রবে জমা
আমারে করিও ক্ষমা।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। ওটা শুধু মেয়েদের স্কুল ছিল, প্রাইভেট স্কুল। এখনও গেলে দেখি সেই গেইট, সেই ভবন। ও এখন মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের সামনে আরও কিছু সময় ছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, খুকী তুমি কি গান গাইতে পার? আমি বললাম, না। আসলে গান জানতাম।
ভদ্রলোক তো আমারে দেখার পর নানা দিক থেইকা আমার নানা ভাইরে হাত করার জন্য লাইগা গেল। অনেককে দিয়া সুপারিশ করতে লাগল। ওই যে আমারে দেখল, আমার রূপ তার মনে ধইরা নিল, কবি তো!
কবি সাহেব আরেকদিন যখন আসলো, আমাকে গান গাওয়ার জন্য পনের বিশ মিনিটের মত অনুরোধ। আমি আর হারমোনিয়ামে হাত দেই না। আমার নানী ধমক দিল খুব জোরে। নামকরা লোকের সাথে বেয়াদবি করতেছ। গান শিখছ তো মানুষরে শুনানোর জন্যই। শুনাও। তারপর আমি তখন গাইছিলাম নিশীথে যাইও ফুলবনে...। এটা জসীম উদ্দীনের লেখা গান। কিন্তু আমি তখন জানতাম না। আমার গানের মাস্টার শিখাইছিল রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান এবং এই গানও। তারপরও আরও গান গাইতে খুব অনুরোধ করছিল। আমি আর গাই নাই।
কবি সাহেব আমাকে প্রথম দেখার পর তলে তলে অনেক ঘটনা ঘটতেছিল। আমি কিছুই জানি না। আমার মনে হইতে লাগল ভদ্রলোক যে ঘন ঘন এই বাড়িতে আসতেছে ব্যাপারটা কি! তারপরে আমার খালারা হাসি মস্করা কানা-ঘুষা তাতে একটা আলামত পাওয়া গেল। একদিন আমার এক আত্মীয় ঠাস কইরা বইলা ফালাইল, তোমাদের বাড়িতে যে কবি জসীম উদ্দীন আসে তার সাথে তোমার বিয়া ঠিক করতে চায় তোমার নানা। তুমি রাজি আছ কি না? তিনি আমার মাধ্যমে জানতে চান। আমি ছেলেমানুষী ছলে বইলা ফালাইলাম, আমার মত আছে। তারপর দৌড় দিয়া দিদির সামনে থেইকা পালাইয়া গেলাম। আমার আনন্দ হইতে লাগল যে একটা বিয়া হইতে যাইতেছে। হৈচৈ কত মজা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তখন তা বুঝি নাই।
তারপর তো আর কি চাই! নাতিন বিয়ায় রাজি হইয়া গেছে। সোনা মা মনে করছিল রাজি হব না। কবি হিসেবে তাকে তো জানতামই। তখন মনে হয় নাই একটা কালো লম্বা মানুষ, আবার কবি, তার সাথে আমার বিয়া হইতে যাইতেছে। আমার মা অবশ্য বিয়া দিতে চায় নাই। কালো, এ জন্য আমার কোন অসুবিধা ছিল না। তারে দেইখা আমারও পছন্দ হইছিল। বয়সটাও আমার কাছে কোন বাধা মনে হয় নাই। সবচেয়ে পছন্দ হইছিল কি—তিনি হাইসা যখন কথা বলছিলেন একদিন দেখলাম সোনার দুইটা দাঁত চকচক কইরা উঠল। তাঁর সোনার বান্ধানো দাঁত ছিল দুইটা সামনের দিকে। সোনার দাঁত দেখার জন্য তার দিকে বারে বারে চাইছি। সোনার দাঁত পরে ছিল না। প্লাস্টিকের দাঁত লাগাইছিল।
কবি সাহেব যখন বিয়ার প্রস্তাব দিল, তখন প্রথম দিকে আমার নানা-নানী রাজি হয় নাই। ওরা দুই বছর ঘোরাঘুরির পর নানা-নানী নরম হইছে। নানান কারণে তারা রাজি হয় নাই। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, বয়সের এতো তফাত্, অ্যাডজাস্ট হইব কি না। এত আদর আহ্লাদ কইরা অচেনা অজানা এক ছেলের সাথে...। তারপর বাবার কাছে নানা চিঠি দিলেন। বাবা তখন ফরিদপুরে জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। অনেক ছাত্র তার। শহরে নাম-ধাম আছে। বাবা তো সেই চিঠি পাইয়া সাত পৃষ্ঠা চিঠি দিলেন নানার কাছে। বাবা লিখছিলেন, আপনি কি পাগল হইয়া গেলেন। এই লোকটা পাগল। চরে চরে ঘুইরা বেড়ায়। গান গাইয়া বেড়ায়। ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান, মুর্শীদি গান। গানের মজলিসে সারারাত কাইন্দা কাইটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এইরকম ছেলের কাছে বিয়া দিবেন? তার চাইতে আপনি নাতিনরে পদ্মায় ফালাইয়া দেন।
নানা তো চিঠি পাইয়া হতভম্ব হইয়া গেল। একটু রাগও হইল। নানাভাই বলল, ছেলেটাকে আমি প্রায় দুই বছর যাবত্ দেখতাছি। ভালোই তো। সোনাভাই তখন মহসিন হলে যাইতেন এবং পরে কবি সাহেব থাকতেন নিউ মার্কেট এলাকায়, মানে ঠিক উত্তরে ঢাকা কলেজের কাছে হইলদা রঙের একতলা বাড়ি, বাড়িটা নাকি এখনও ঐরকমই আছে। সোনাভাই না বইলা খুব সকালে যাইয়া উঠলেন। দেখার জন্য, আসলে ছেলেটা কেমন। একদিন একটা মজার ঘটনা সেই বাড়িতে হইছিল। আমার সোনাভাই ভোরে যাইয়া কবি সাহেবকে উঠাইয়া বিদায় নিতেছিল। কবি তাকে নাস্তা খাওয়াইয়া খাতির কইরা তারপর রুমে আটকাইছে। কবি সাহেব বলছিলেন, আমার কাছে নাতিন বিয়া দিবেন কি না কথা দিয়া যাইতে হইব। নইলে আইজকা আপনারে ছাড়মু না। নানা ভাইতো মুস্কিলে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত কথা দিয়া ছাড়া পাইতে হইছিল।
আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও বিস্ময়। এত বড় কবির সাথে বিয়া হইতে যাইতেছে, তখন যার কবিতা পাঠ্য বইয়ের অন্তর্গত। খুব একটা অন্যরকম ভাব আমার আসছিল। মানে স্বপ্নের মতো অবস্থা। আমি তখন বিয়ার কথা চিন্তা করতাম না। ছিলাম স্কুলের ছাত্রী। সোনা মা আমারে সাধারণত কারো সাথে মিশতে দিত না। আমি ছিলাম খুব একা। মাঝে মধ্যে ছুটির সময় আমার ছোট ভাই মিন্টু আসতো। ওর সাথে খেলা করতে করতে মনে হইত আমি বুঝি বন্দি অবস্থা থেইকা মুক্তি পাইলাম।
আমার বিয়ার কথাবার্তা চলতেছে। তারিখ-টারিখও ঠিক হইল। ৩ মাস পরে বিয়া হবে ইউনিভার্সিটির গ্রীষ্মের ছুটিতে। নানা ঠিক করলেন ছেলের বাড়ি দেখতে হয় তিনি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে তার এক ভাইগ্না এবং মিলনদাকে পাঠাইলেন। মিলনদা আমার খালাতো ভাই।
ঐ দুই যুবক সব খোঁজ খবর নিয়া আসলেন। কবি সাহেব তিনদিন তাদের এমন আপ্যায়ন করলেন যে, তারা মহা খুশিতে নারায়ণগঞ্জে ফিরা আসলেন। ওদের যখন বাড়িঘর দেইখা পছন্দ হইছেন তখন নানাও খুশি। তিনি বিয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। সোনাভাই আমার বিয়ার ঠিক আগের দিনগুলোতে রাতে কানতেন। এত আদর কইরা নাতিন পালছেন, তারে বিদায় দিতে তার কষ্ট হইতেছিল। তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখ দেখলে বুঝা যাইত অন্তর কানতেছে। বিয়ার জিনিসপত্র কেনাকাটা শুরু হইল। কলকাতা গেল বিয়ার মার্কেটিং করতে। সাথে মিলনদাও গেছিল। তাকে নেয়া হইছিল আধুনিক জিনিসপত্র চিনবার জন্য, কারণ নানাভাই আগের দিনের মানুষ। তারা বহু জিনিসপত্র আনলো—খুব সুন্দর বেনারসী, আকাশী নীল রঙের। আমি মনে মনে ভাবলাম আমারে লাল শাড়ি দিল না কেন। সে সময় শাড়িটার দাম ছিল একশ’ সত্তর টাকা। আর বরের জন্য কলকাতা থেইকা খুব দামি সেলোয়ারের কাপড়, তারপর শেরওয়ানী, টুপি ও পাগড়ি এবং কাপড় আনছিল। কাপড় নিয়া অম্বিকাপুর পাঠানো হইছিল। সেগুলি নারায়ণগঞ্জের ভালো টেইলারিং থেইকা বানানো হইল। কবি সাহেব তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অম্বিকাপুরে।
ঘটনাটা ১৯৩৯ সালের। গায়ে হলুদ যখন হইছিল, তখন আমি ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মাইরা দেখলাম অনেক জিনিসপত্র, ডালা-ডুলা আর সাত-আটটা ঘোড়ার গাড়ি বাড়ির সামনে। প্রত্যেকটা ঘোড়া নানা রঙের ফুল দিয়া সাজানো হইছে। ঐভাবে গায়ে হলুদের জিনিস দিয়া সারা শহর ঘুইরা আইছে সবাই। খুব ফুর্তি হইছিল। গায়ে হলুদেই লোক হইছিল এক হাজারের মতো। আমার মা-বাবা’র বিয়াতে মত ছিল না। তারা ক্ষুব্ধ। তাই বিয়ার কোন অনুষ্ঠানে তারা আসেন নাই। শুধু ফরিদপুর থেইকা অনেক কান্নাকাটি করার পর মিন্টুরে পাঠাইছিল।
হলুদের মালপত্র নিয়া আমাদের ঘাটে যাওয়া হয়, যেখানে ফরিদপুরের স্টিমার আসে। ওই ঘাটে কবিকে সমস্ত কাপড়-চোপড় পরাইয়া আনা হইল নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। বরযাত্রী পঁচিশ ত্রিশজন, এর বেশি হবে না। সাথে ছিল তার বড় ভাই, বোনের জামাই, চাচাতো ভাইরাও ছিল। বিয়াতে গেইট ধরা হইছিল। শালীদের সঙ্গে এক ঘণ্টা যুদ্ধ। খালাতো বোনদের সাথে কথা কাটাকাটি হইল। এক টাকাও দেয় নাই। আমার বোনরা বলছিল, যাইতে দিব না। কবি বলছিল, ঠিক আছে দাঁড়াইয়া থাক। তারপর সময় নষ্ট হইতেছে দেইখা আমার নানা সবাইকে গেইট ছাইড়া দিতে বললেন। বিয়ার তারিখটা ছিল, আমার ইংরেজি মনে নাই, বাংলা মনে আছে— ১০ই আষাঢ়, ১৯৩৯ সাল। মনে হয় পঁচিশ তারিখ ছিল। তখন কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।
বিয়ার দিনের ঘটনা আমি তো সবকিছু নিজে দেখি নাই। পরে শুনছি। আমারে খুব সাজাইছিল। ঢাকা থেইকা ফুল কিনছিল কয়েক মণ। বিয়ার দিনে আমার মন খারাপ ছিল না। যখন আমারে বিদায় দেয়, সবাই কানতেছিল। দেখলাম সোনা মা হাইসা বাঁচে না। কি যেন আমার মনে হইছে। আমি তো চইলা যাইতেছি না। আমার মনে হইতেছিল বেড়াইতে যাইতেছি, আবার বাড়িতে চইলা আসমু। সেই সবকিছু বুঝবার মতো বুদ্ধি হয় নাই আমার তখন।
আমরা পরের দিন নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছিলাম। বিয়ার আসরে নামকরা অনেক লোক আসছিল। আমার স্পষ্ট সবার নাম মনে নাই। অনেক চিঠিপত্র আসছিল কলকাতা থেইকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে শুভেচ্ছা জানাইয়া চিঠি দিছিল। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খুব বড় শিল্পী, তিনি খুব সুন্দর একটা চিঠি এবং তার হাতে আঁকা একটা ছবি পাঠাইছিলেন দুইজনের নামে। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন শুভেচ্ছা জানাইছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটায় ছিল সুন্দর গোলাপী রঙের দুইটা কবুতর একটা ডালে বসা। ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখছিলেন, তিন পৃষ্ঠার এক চিঠি। চিঠিটা এখনও পড়ি। জীবনের যে এত ধাপ তার প্রত্যেকটির বিবরণসহ উপদেশ দিয়ে চিঠিটা লেখা। কে যেন ডাকযোগে কলকাতা থেইকা লাল টকটকা একটা মটকা শাড়ি পাঠাইছিল। যে মৌলভী বিয়া পড়াইতে আসছিল, সে বিয়ার আসরে একটু আপত্তি জানাইছিল। বিয়ার আসরে হুজুর নানা ভাইয়ের কাছে আপত্তি কইরা বলল, আপনার নাতিনরে তো নাচ শিখাইছেন, গান শিখাইছেন, হিন্দু খ্রিস্টানগো মতোন চালচলন শিখাইছেন। এখন ওর কলেমা পড়া লাগব। আমার নানা মহা ক্ষেইপা গিয়া হুজুররে বাদ দিয়া নিজেই দোয়া পড়লেন।
আমি কিন্তু বিয়ার আগে তিনবার কোরআন শরীফ খতম করছি। স্কুলে নাচ, গান, নাটক সবই করছি। কিন্তু সুন্দর জীবনযাপন করছি। ভদ্রভাবে চলার চেষ্টা করছি। বিয়াতে কবি জসীম উদ্দীন কোন যৌতুক নেন নাই। তবে আমার নানাভাই ঘরের প্রায় সমস্ত ফার্নিচার বানাইয়া দিছিল কবিকে।
বিয়ার সময় তিন দিন আলোকসজ্জা করা হইছিল এবং ব্যান্ড পার্টি বাদ্যযন্ত্র বাজাইছে। বাসর ঘর কাঠ গোলাপ, রজনীগন্ধা এবং চামেলী ফুল দিয়া অপরূপ কইরা সাজানো হইছিল। এরোন ফকিরের গল্পটা বলা হইল না। ফরিদপুরের সেই আমলের বিখ্যাত গায়েন এরোন ফকির কবি সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আসছিলেন বিয়াতে। আমি তো ঘোমটা দিয়া বইসা আছি। অনেকেই ঘোমটা উঠাইয়া নতুন বউয়ের মুখ দেইখা যায়। তখন হঠাত্ সামনে তাকাইয়া দেখি দাড়িঅলা এক বয়স্ক লোক। অদ্ভুত পোশাক, সবার চাইতে আলাদা। আমার মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। আমি দেখলাম স্ফটিকের মালা গলায় বাউল গোছের লোক, ফকিরী পোশাক। আমাকে দোয়া-টোয়া করল। এরোন ফকিরের বাড়ি চর ভদ্রাসনে।
বিয়ার আসরে খুব হাসাহাসি ধাক্কাধাক্কি চলছিল। আমার খালাতো ও চাচাতো বোনরা কবি সাহেবকে জব্দ করতে চাইলে তিনি সমানে ওদের সাথে তর্ক করতে লাগল। নতুন জামাইয়ের মতো চুপ থাকে নাই। ওরা তো কবির কাছে হার মাইনা গেল। অনেক রাইত পর্যন্ত বিয়ার অনুষ্ঠান চলল। প্রায় ভোর রাতের দিকে সব অনুষ্ঠান শেষে আমাদেরকে বাসর ঘরে আনা হয়। আমি খুব ক্লান্ত হইয়া পড়লে আমার নানী পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতেছিল। তখন কবি সাহেব বললেন, সোনামা, আপনি চইলা যান। আমি ঘুমাবো। আমি তো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছি। সোনামা চইলা গেলে কবি সাহেব বলেন, আসো আমরা একটু নামাজ পড়ি। আমি মনে মনে বলি ঘুমের মধ্যে কিসের নামাজ-টামাজ। আমি কথা কমু কি, উনি লজ্জা ভাইঙ্গা নিজেই কথা কইতে থাকলেন। তারপর গণকের মতো আমার হাতটা দেখল। তারপর আমি তো ঘুমাইয়া গেছি।
পরের দিন স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেইকা চাঁদপুর হইয়া গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছাই। তখন দুপুর। সেখান থেইকা ট্রেনে অম্বিকাপুর রেল স্টেশন। স্টেশন থেইকা ঘোড়ার গাড়িতে কবি সাহেবের বাড়িতে আসি। আমার জন্য একটা ভিন্ন প্রকৃতি, নতুন পরিবেশ। সবার সহযোগিতায় মানায় নিছিলাম। ফরিদপুরে আসার পরেও আমার মা রাগে ছিলেন। তিনি চাইছিলেন জামাই হবে টুকটুকা রাজপুত্রের মতো, কবি-টবি না। পরে অবশ্য কবি তার ব্যবহার দিয়া সবার মন জয় করছিলেন।
আমি নিজেও এখন জীবন সায়াহ্নে। জীবিত কালেই আমার প্রথম সন্তান হাসু মৃত্যুবরণ করছে। আমার নাতি আসিফের অকাল মৃত্যু, সবই আমাকে দেখতে হইছে। অনেক স্মৃতি আছে লিখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু শরীর বাধা হইয়া দাঁড়ায়। দেশের মানুষ কবিকে এত ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন দেইখা আমার মনটা ভইরা যায়। তখন আমার মনে হয়, উনি মরেন নাই। আমার কবি এখনও জীবিত আছেন। নাসির আলী মামুন সম্পাদিত ‘শতবর্ষে জসীম উদ্দীন’ (প্রকাশক ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
সৌজন্যঃ দৈনিক আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন