সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনের সংবাদ তত্ক্ষণাত্ ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে জানার পর বেশ কয়েকদিন কয় ঘণ্টা ঘুমিয়েছি জানি না। অনেকটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়েই তিন-চার রাত পার করেছি। ওই দম্পতির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তবু তাদের চেহারা অতি কাছের মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। বারবারই তাদের নিষ্পাপ দুটি মুখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। একই সঙ্গে মনে হচ্ছে তাদের শিশুপত্র মেঘের কথাও। কারণ প্রায় ওই বয়সের আমাদেরও একটি ছেলে রয়েছে। আমাদের অতি আদরের ছেলেকে দিয়ে অনুভব করতে পারছি শিশু মেঘের কথা। সে আমাদের কয়েক ঘণ্টা না দেখলে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে কীভাবে দৌড়ে এসে আমাদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে! মেঘ ওই অনুভূতি নিয়ে এখন থেকে কার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে? এ ক্ষতি অপূরণীয়। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন মাধ্যমে নিহত সাগর ও রুনির বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীর বিভিন্ন মন্তব্য পড়ে জানতে পারলাম, তাদের কোনো শত্রু নেই বা থাকার কথা নয়। অত্যন্ত সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন সর্বদাই হাসিখুশি এ দম্পতি। ফেসবুকেও তাদের প্রোফাইলে বিভিন্ন ছবি দেখে মনে হলো, তাদের একটি সোনার সংসার ছিল। তারপরও দুনিয়ার মায়া ছেড়ে বাধ্য হয়েই লাখ লাখ মানুষকে কাঁদিয়ে অকালে চলে যেতে হলো। কোনো এককালে শুনতাম দীর্ঘ শত্রুতার জের ধরেই কেউ খুন হয়েছে। কিন্তু এখন কাউকে নৃশংসভাবে খুন হতে তেমন কোনো কারণেরই দরকার পড়ে না। কেউ ভালো চললে বা দ্রুত জীবনে সফলতা পেলে আশপাশের অনেকেরই গা জ্বলে। আবার কেউ কেউ নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের ফলে নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে একজন আরেকজনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজ করে বসে।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এভাবে পিলখানার হত্যাযজ্ঞের মতোই একদিন শুনব, আজ সাংবাদিক দম্পতির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে অপমৃত্যুই বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুনিদের শনাক্ত করা হলেও নিরপেক্ষভাবে বিচার হচ্ছে না। ফলে দেশের সর্বত্রই খুন, গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সম্প্রতি খুনের ধরনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা নিঃসন্দেহে অতীতের যে কোনো বর্বর যুগ বা এক পশু অন্য পশুকে হত্যার ঘটনাকেও হার মানাবে। অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে বলে যে রেওয়াজ অতীতে ছিল তা এখন দেশ থেকে প্রায় উঠে গেছে বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা মহামারী আকার ধারণ করেছে। কোনো দেশের সরকারকেই বেডরুমে গিয়ে তার দেশের জনগণকে পাহারা দেয়ার বিধান নেই; কিন্তু দেশের মানুষ আইন না মানলে মানতে বাধ্য করার গুরুদায়িত্ব সরকারের এবং মানুষের মনে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করার দায়িত্বও সরকারের। কোনো এককালে মানুষ গরমের দিনে বাড়ির উঠানে বা ছাদে ঘুমাত। তখন তো কোনোদিন শুনিনি কেউ উঠান বা ছাদ থেকে গায়েব হয়েছে বা খুন হয়েছে। আমার মনে হয় না এ মুহূর্তে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে ওই সব জায়গায় ঘুমানোর কথা। উদাহরণস্বরূপ এসিড নিক্ষেপের কথাও বলা যেতে পারে। বহু বছর আগে দেশে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা সামাজিক জীবনে মহামারি আকার ধারণ করলেও তত্কালীন সরকারের কঠোর পদক্ষেপে এসিড নিক্ষেপকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারপর প্রায় এক যুগের অধিক সময় এসিড নিক্ষেপের ঘটনা শুনিনি।
জানি না গত এক থেকে দুই বছরে দেশে কতজন খুন হয়েছে। যতজন খুন হয়েছে ওই সংখ্যার দ্বিগুণ বা ততোধিক ব্যক্তি এ ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে। খুনিদের অনেকেই হতে পারে আমাদের মতোই সাধারণ পরিবারের সদস্য। তাদেরও বাবা-মা, ভাই-বোন আছে। আছে বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। তাদের ঘরেও থাকতে পারে শিশু মেঘের মতোই এক বা একের অধিক নিষ্পাপ শিশু। কারও বাবা, মা, ভাই বা বোন হতে পারে সমাজের সত্ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। একজনের অসত্ কর্মকাণ্ডের ভার কেন অন্যদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে? মানুষ খুন করার মতো এমন জঘন্য কাজে জড়ানোর আগে এ বিষয়গুলো বারবার ভাবা উচিত। ভাবা উচিত নিজেদের পরিবারের কথা। কারণ একজন খুন হওয়ার ফলে একটি সুন্দর সংসার যেভাবে তছনছ হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই যে বা যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের পরিবারেও নেমে আসতে পারে কালো ছায়া। বরং হত্যাকারীর পরিবারের সদস্যদের ভর্তুকি দিতে হয় দ্বিগুণ। কারণ খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও খুনির পরিবারের সদস্যদের এ ঘানি টানতে হয় সারা জীবন। এ মুহূর্তে আইন তার স্বাভাবিক গতিতে না চললেও এ অব্যবস্থা আজীবন স্থায়ী হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এভাবে একটা স্বাধীন দেশ আজীবন চলতে পারে না। একবার ভাবা উচিত, খুনি যদি কোনো কারণে চিহ্নিত হয় তাহলে তার পরিবারের কেউ শুধু মানসিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের এড়িয়ে চলবে। খুনির শাস্তি কোনো কারণে মৃত্যুদণ্ড না হলেও এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে! একই সঙ্গে ভাবা উচিত খুনি যদি নিজে খুন হতো, তাহলে তার সংসারের কী হাল হতে পারত? তার যদি ফুটফুটে শিশু থাকে, সে কাকে বাবা বলে ডাকবে?
অনেকের মতো আমিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া খুনিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বের করে শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশনাকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আশাবাদী ছিলাম, নিরপেক্ষ তদন্তে খুনিরা ওই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার না হলেও অন্তত শনাক্ত হবে। ৪৮ ঘণ্টার পরও তিনি সবাইকে জোর গলায় বলেছিলেন, শিগগিরই আমরা সুখবর শুনতে পাব। কথা প্রসঙ্গে অনেককে বলেছিলাম, বিলম্বে হলেও এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশে হত্যা ও সন্ত্রাস হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি যদি মন্ত্রিত্ব লাভের পর থেকেই এভাবে ঘটে যাওয়া প্রতিটি খুনের রহস্য উদঘাটনে ও দোষীদের নিরপেক্ষভাবে বা দলমত নির্বিশেষে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব পালনে কঠোর ভূমিকা নিতে বাধ্য করতেন এবং জবাবদিহিতার নজির সৃষ্টি করতেন, মানুষ এ ধরনের নৃশংস হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে বারবার ভাবত। হয়তো সাগর-রুনিসহ অনেকেই প্রাণে বেঁচে যেত। আমাদেরও প্রতিদিন পত্রিকা খুলেই মানুষ হত্যার করুণ সংবাদ হজম করতে হতো না। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কোটি কোটি মানুষকেও সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে আঙুল তুলে বিভিন্ন কটূক্তি ও উপহাস করতে হতো না। জানি না সাংবাদিক দম্পতিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অন্য সব খুনের সঠিক বিচার আদৌ হবে কিনা। কারণ এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় অতীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মতোই সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডও প্রাণ হারাতে বসেছে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো অন্য কোনো ঘটনা প্রাধান্য পাবে এবং এ বিষয়টি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়, আর এটা ক্ষমতাসীনদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের নিরপেক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষীদের আরও যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলোকেও। কেউ বিপদে পড়লে যাতে বিশেষ নম্বরে ফোন করে তত্ক্ষণাত্ আইনের সাহায্য নেয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও ফ্রি নম্বর ০০০ এ ডায়ালের মাধ্যমে ৩ থেকে ৭ মিনিটের ব্যবধানে সমস্যার ধরনের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায়। বিশেষ কারণে ভিকটিম ফোনে ডায়াল করে কথা বলতে না পারলেও পুলিশ ঘটনাস্থল শনাক্ত করে ভিকটিমের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পৃথিবীব্যাপী মোবাইল প্রযুক্তি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের সর্বত্র এর দ্রুত বিস্তার নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, আমাদের দেশেও অসম্ভব বলে কিছুই নেই। নিহত সাগর ও রুনির হত্যা রহস্যে মনে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ নির্যাতনের পর তাদের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে এজাতীয় ব্যবস্থা থাকলে তারাও হয়তো আইনের সাহায্যে নিজেদের বাঁচাতে পারত। অন্তত প্রাণে মারা যেত না। অন্যদিকে, আমি অনুরোধ করব এ লেখার বিষয়বস্তু দেশে থাকা স্বজনরাও তাদের প্রবাসী সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। কারণ ইদানীং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের হাতে নিজ দেশিসহ ভিনদেশি নাগরিক হত্যার প্রবণতা বেশ বেড়ে গেছে। এদের অধিকাংশই শিরশ্ছেদের মতো ভয়ানক সাজায় দণ্ডিত হয়েছে। আবারও বলছি, মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে ভাবা উচিত, সে শুধু প্রতিপক্ষকেই খুন করছে না, হত্যা করছে সে নিজেকে এবং দুই পরিবারের সবাইকে।
লেখক : সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.au
দেখতে দেখতে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এভাবে পিলখানার হত্যাযজ্ঞের মতোই একদিন শুনব, আজ সাংবাদিক দম্পতির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে অপমৃত্যুই বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুনিদের শনাক্ত করা হলেও নিরপেক্ষভাবে বিচার হচ্ছে না। ফলে দেশের সর্বত্রই খুন, গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সম্প্রতি খুনের ধরনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা নিঃসন্দেহে অতীতের যে কোনো বর্বর যুগ বা এক পশু অন্য পশুকে হত্যার ঘটনাকেও হার মানাবে। অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে বলে যে রেওয়াজ অতীতে ছিল তা এখন দেশ থেকে প্রায় উঠে গেছে বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা মহামারী আকার ধারণ করেছে। কোনো দেশের সরকারকেই বেডরুমে গিয়ে তার দেশের জনগণকে পাহারা দেয়ার বিধান নেই; কিন্তু দেশের মানুষ আইন না মানলে মানতে বাধ্য করার গুরুদায়িত্ব সরকারের এবং মানুষের মনে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করার দায়িত্বও সরকারের। কোনো এককালে মানুষ গরমের দিনে বাড়ির উঠানে বা ছাদে ঘুমাত। তখন তো কোনোদিন শুনিনি কেউ উঠান বা ছাদ থেকে গায়েব হয়েছে বা খুন হয়েছে। আমার মনে হয় না এ মুহূর্তে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে ওই সব জায়গায় ঘুমানোর কথা। উদাহরণস্বরূপ এসিড নিক্ষেপের কথাও বলা যেতে পারে। বহু বছর আগে দেশে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা সামাজিক জীবনে মহামারি আকার ধারণ করলেও তত্কালীন সরকারের কঠোর পদক্ষেপে এসিড নিক্ষেপকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারপর প্রায় এক যুগের অধিক সময় এসিড নিক্ষেপের ঘটনা শুনিনি।
জানি না গত এক থেকে দুই বছরে দেশে কতজন খুন হয়েছে। যতজন খুন হয়েছে ওই সংখ্যার দ্বিগুণ বা ততোধিক ব্যক্তি এ ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে। খুনিদের অনেকেই হতে পারে আমাদের মতোই সাধারণ পরিবারের সদস্য। তাদেরও বাবা-মা, ভাই-বোন আছে। আছে বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। তাদের ঘরেও থাকতে পারে শিশু মেঘের মতোই এক বা একের অধিক নিষ্পাপ শিশু। কারও বাবা, মা, ভাই বা বোন হতে পারে সমাজের সত্ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। একজনের অসত্ কর্মকাণ্ডের ভার কেন অন্যদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে? মানুষ খুন করার মতো এমন জঘন্য কাজে জড়ানোর আগে এ বিষয়গুলো বারবার ভাবা উচিত। ভাবা উচিত নিজেদের পরিবারের কথা। কারণ একজন খুন হওয়ার ফলে একটি সুন্দর সংসার যেভাবে তছনছ হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই যে বা যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের পরিবারেও নেমে আসতে পারে কালো ছায়া। বরং হত্যাকারীর পরিবারের সদস্যদের ভর্তুকি দিতে হয় দ্বিগুণ। কারণ খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও খুনির পরিবারের সদস্যদের এ ঘানি টানতে হয় সারা জীবন। এ মুহূর্তে আইন তার স্বাভাবিক গতিতে না চললেও এ অব্যবস্থা আজীবন স্থায়ী হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এভাবে একটা স্বাধীন দেশ আজীবন চলতে পারে না। একবার ভাবা উচিত, খুনি যদি কোনো কারণে চিহ্নিত হয় তাহলে তার পরিবারের কেউ শুধু মানসিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের এড়িয়ে চলবে। খুনির শাস্তি কোনো কারণে মৃত্যুদণ্ড না হলেও এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে! একই সঙ্গে ভাবা উচিত খুনি যদি নিজে খুন হতো, তাহলে তার সংসারের কী হাল হতে পারত? তার যদি ফুটফুটে শিশু থাকে, সে কাকে বাবা বলে ডাকবে?
অনেকের মতো আমিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া খুনিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বের করে শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশনাকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আশাবাদী ছিলাম, নিরপেক্ষ তদন্তে খুনিরা ওই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার না হলেও অন্তত শনাক্ত হবে। ৪৮ ঘণ্টার পরও তিনি সবাইকে জোর গলায় বলেছিলেন, শিগগিরই আমরা সুখবর শুনতে পাব। কথা প্রসঙ্গে অনেককে বলেছিলাম, বিলম্বে হলেও এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশে হত্যা ও সন্ত্রাস হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি যদি মন্ত্রিত্ব লাভের পর থেকেই এভাবে ঘটে যাওয়া প্রতিটি খুনের রহস্য উদঘাটনে ও দোষীদের নিরপেক্ষভাবে বা দলমত নির্বিশেষে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব পালনে কঠোর ভূমিকা নিতে বাধ্য করতেন এবং জবাবদিহিতার নজির সৃষ্টি করতেন, মানুষ এ ধরনের নৃশংস হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে বারবার ভাবত। হয়তো সাগর-রুনিসহ অনেকেই প্রাণে বেঁচে যেত। আমাদেরও প্রতিদিন পত্রিকা খুলেই মানুষ হত্যার করুণ সংবাদ হজম করতে হতো না। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কোটি কোটি মানুষকেও সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে আঙুল তুলে বিভিন্ন কটূক্তি ও উপহাস করতে হতো না। জানি না সাংবাদিক দম্পতিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অন্য সব খুনের সঠিক বিচার আদৌ হবে কিনা। কারণ এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় অতীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মতোই সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডও প্রাণ হারাতে বসেছে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো অন্য কোনো ঘটনা প্রাধান্য পাবে এবং এ বিষয়টি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়, আর এটা ক্ষমতাসীনদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের নিরপেক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষীদের আরও যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলোকেও। কেউ বিপদে পড়লে যাতে বিশেষ নম্বরে ফোন করে তত্ক্ষণাত্ আইনের সাহায্য নেয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও ফ্রি নম্বর ০০০ এ ডায়ালের মাধ্যমে ৩ থেকে ৭ মিনিটের ব্যবধানে সমস্যার ধরনের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায়। বিশেষ কারণে ভিকটিম ফোনে ডায়াল করে কথা বলতে না পারলেও পুলিশ ঘটনাস্থল শনাক্ত করে ভিকটিমের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পৃথিবীব্যাপী মোবাইল প্রযুক্তি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের সর্বত্র এর দ্রুত বিস্তার নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, আমাদের দেশেও অসম্ভব বলে কিছুই নেই। নিহত সাগর ও রুনির হত্যা রহস্যে মনে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ নির্যাতনের পর তাদের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে এজাতীয় ব্যবস্থা থাকলে তারাও হয়তো আইনের সাহায্যে নিজেদের বাঁচাতে পারত। অন্তত প্রাণে মারা যেত না। অন্যদিকে, আমি অনুরোধ করব এ লেখার বিষয়বস্তু দেশে থাকা স্বজনরাও তাদের প্রবাসী সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। কারণ ইদানীং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের হাতে নিজ দেশিসহ ভিনদেশি নাগরিক হত্যার প্রবণতা বেশ বেড়ে গেছে। এদের অধিকাংশই শিরশ্ছেদের মতো ভয়ানক সাজায় দণ্ডিত হয়েছে। আবারও বলছি, মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে ভাবা উচিত, সে শুধু প্রতিপক্ষকেই খুন করছে না, হত্যা করছে সে নিজেকে এবং দুই পরিবারের সবাইকে।
লেখক : সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.au
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন