একজন কবিকে বেঁচে রাখার জন্যে একটি কবিতাই যথেষ্ট; যেমনটিÑ ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ কবিতাটিই যথেষ্ট কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বেঁচে থাকার জন্যে; কবি আল মাহমুদ অত্যন্ত দৃঢ়ভাষায় বলেছিলেন কথাগুলো। যদিও সৈয়দ মুজতবা আলী একটি গ্রন্থের কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’ ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি/ সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি’ কবিতাটি যেমন কাজী নজরুল ইসলামকে চেনার জন্যে শিশুদের কাছে যথেষ্ট তেমনি তাঁর বিদ্রোহী কবিতা তাঁকে সকল মানুষের কাছে বিদ্রোহী কবি বলে পরিচিত করে রেখেছে। একেকজন কবির জন্যে এ রকম একটা দুটো সৃষ্টি তাঁকে জনসম্মুখে অমর করে রাখে। এ রকম অসংখ্য অমর পঙক্তির নির্মাতা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম দুই শক্তিমান কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও গোলাম মোহাম্মদ। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে (মল্লিক ১ মার্চ ১৯৫৬; গোলাম মোহাম্মদ ২৩ এপ্রিল ১৯৫৯) পৃথিবীর মুখ আলোকিত করেছিলেন দুই কবিবন্ধু। দুজনই এসেছেন বাংলাদেশের দণিাঞ্চলের (মল্লিক বাগেরহাট; গোলাম মোহাম্মদ মাগুড়া) ছায়াঢাকা সবুজপল্লীর রাজমুকুট নিয়ে। আবার দুজনই অতি অল্প বয়সে বন্ধুস্বজনকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে (মল্লিক ১২ আগস্ট ২০১০; গোলাম মোহাম্মদ ২২ আগস্ট ২০০২) চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। দুজনের মধ্যে কি অসাধারণ মিল। এ মিল শুধু যাওয়া আসাতেই নয়, এ মিল ছিল আদর্শের, এ মিল ছিল হৃদয়ের; এ বন্ধন ছিল সীসাঢালা প্রাচীরের মতো মজবুত। গান ও কবিতা রচনার েেত্রও দুজনই অসাধারণ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনায় দুজনই ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা পুরুষ। পঙক্তির ভাঁজে ভাঁজে তাঁরা নির্মাণ করেছেন দেশ-জাতি ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার শৈল্পিক চেতনা।
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশ। নিজের দেশ মানে নিজের শরীর, নিজের আত্মা। কবিরা দেশকে ভালোবাসেন তাদের স্বপ্নগত কারণেই। কারণ দেশপ্রেম না থাকলে স্বপ্নরা সফলভাবে ধরা দেয় না। আর স্বপ্ন না থাকলে কবি হওয়া কঠিন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও গোলাম মোহাম্মদ দেশকে ভালোবেসেছেন হৃদয় দিয়ে; মমত্ববোধের রজ্জু দিয়ে স্বদেশকে বেঁধেছেন বিশ্বাসের আবহে। তাইতো আজীবন যৌবনা দেখতে চেয়েছেন তাদের এ প্রিয় জন্মভূমিকে। কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বদেশ কি আগের মতোই যৌবনা আছে? গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু পুকুর ভরা মাছ; এসব এখন যেন কল্পনার ফানুস। পুকুর ডোবার যৌবনা ছবি আঁকতে কোনো কবি যখন বলেন, ‘শিউলি পাড়া নদীকূলের কাশবনে/ বকের সারি ওড়াউড়ি বাঁশবনে/ বরফঝরা দুধের নহর/ কিংবা পাতা ফুলের শহর/ পুকুর ধারে মিষ্টি বিকেল ঘাসবনে;’(ধনচে ফুলের নাও) এ চিত্র যেন কাল্পনিক হয়ে ধরা দেয় তাদের কাছে। কারণ এখন পুকুর নদীর সেই যৌবনা ভাব নেই। নদীগুলো মরা সোঁতা আর পুকুরগুলো এখন ভরাট ভূমি কিংবা বসতবাড়ির ভিটেতে পরিণত হচ্ছে। প্রিয়ভূমির সেই চিত্র আঁকতে গিয়ে ব্যাপকভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন কবি মতিউর রহমান মল্লিক।
তোমার কিশোরকালের
মত এতো পুকুরও তুমি কোথাও পাবে না
এবং তোমার প্রগাঢ় পল্লবের মত এমন
যৌবনও তুমি কোথাও পাবে না
(বিলের দিকে: অনবরত বৃরে গান)
একই বিষয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। নদী নালা খাল বিল আর ধানের দেশ গানের দেশ এখন কি আর সে রকম আছে? কিন্তু কেন থাকলো না? বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় সেগুলো তো আরো বেশি সবুজাভ করা যেতে পারতো। কিন্তু কেন তা পারা যাচ্ছে না। কিন্তু কোন উত্তর আছে কি?
এই মাঠে কি সবুজ সোনার ধান ছিল না,
চাষির তাজা প্রাণ ছিল না?
কোথায় আমার সেই শিহরণ সোনার ধানের শিষ
কে ছড়াল বুকে এমন আগুন ব্যথার বিষ।
(আমার সবুজ মাঠে: রচনা সমগ্র, পৃ. ৮৮)
পানির অপর নাম জীবন। এটা শুধু মানুষ কিংবা অন্য কোন প্রাণির েেত্র নয়, দেশের জন্য, দেশের মাটির জন্যও ধ্রব সত্য। উজানের ঢেউ যেমন কান্নায় ভাসিয়ে নিতো বাংলাদেশের পল্লীগ্রাম তেমনি পল্লীর আঁচলে ছেয়ে দিতো সবুজের সমারোহ। বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশের বৈরি আচরণ এবং ফারাক্কাসহ হাজারো বাঁধের পৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে বাংলাদেশের নদ নদী। তাইতো কবি গোলাম মোহাম্মদের জিজ্ঞাসা-
এই মাঠে কি গহীন গাঙের তীর ছিল না?
ফুল পাখিদের ভিড় ছিল না?
কে কেড়েছে আমার নদীর উছল করা পানি?
আমার সবুজ মাঠ কেন আজ শুষ্ক মরুর কানি?
(আমার সবুজ মাঠে: রচনা সমগ্র, পৃ. ৮৮)
শুধু ফারাক্কায় নয়; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে শহরে বন্দরে, গ্রামে লোকালয়ে, পথে প্রান্তরে এমনকি মাঠে ঘাটে নদী পুকুরে। তাইতো কবি মতিউর রহমান মল্লিকের উৎকণ্ঠাÑ
‘এই অন্ধকার, বিশ্বসিত আকাশের পরপার থেকেও নামতে পারতো
কিন্তু তা না নেমে
এই অন্ধকার একটি কেন্দ্রিকৃত অবস্থান থেকে
লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে
ছড়িয়ে পড়েছে পথ ও প্রান্তরে
ছড়িয়ে পড়েছে পল্বল ও পথপ্রান্তে
ছড়িয়ে পড়েছে নদী, নন্দন ও নান্দনিকতায়’
(এই অন্ধকার: নিষন্ন পাখির নীড়ে)
কবি গোলাম মোহাম্মদ আশঙ্কা করেছেন আরো গভীরতার পরিমাপে। ফারাক্কার সুবাদে এখন যেমন পদ্মার জীবনে পানিশূন্যতা মরুভূমির বালি; সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে চুরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের সোনাঝরা সকাল বিকেল। স্বকীয় জীবনধারায় নেমে এসেছ পশ্চিমাবিশ্বের নষ্টধারা। ঐতিহ্যধারার শেকড় উপড়ানোর সকল আয়োজন সমাপ্ত হতে চলেছে। হয়তো একদিন আমাদের পদ্মা-যমুনাকে ভুলতে হবে। এ আশঙ্কায় তিনি উচ্চারণ করেন-
বাক্সা ঘাসের মতো তরতাজা সকাল বিকেল
পাটশাক তুলে নেয়া মেয়ের আঁচল
চোখের পলকে সব কোথায় উধাও
কোথায় উধাও সুখ ভাটিয়ালী, পুঁথি ও পয়ার
ভুলতে ভুলতে আমি ভুলে যাব পদ্মা মেঘনা নাম।
(ঘাসফুল বেদনা : রচনা সমগ্র, পৃ. ১১০)
এ ধরনের ভয়াবহতার জন্যে যাদেরকে দায়ী করা হচ্ছে শুধু তারাই দায়ী নয়; আমাদের স্বদেশীদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে হাজারো মীরজাফর-জগৎশেঠ। দাঁতাল শুয়োরের মতো তারা আমাদের সভ্যতার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অসহায় সিরাজউদ্দৌলারা আশঙ্কা করছেন আরো কয়েক হাজার পলাশী নাটকের। তাই কবি মতিউর রহমান মল্লিকের উচ্চারণÑ
মীর জাফরের পদভারে দেশ
জর্জরিত
কাইভ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া
সব জড়িত
বাংলাদেশের সর্বনাশের
পেছনে আজও
জগৎ শেঠেরা হয়নিতো শেষ:
তাদের কাজও।
[ঈদ: পুষ্পিত বনের বৃত্তান্ত : নিষণœ পাখির নীড়ে]
শুধু বাংলাদেশ নয়; সারা বিশ্বে মুসলমানরাই যেন অসহায়। মানচিত্রের যেখানেই মুসলিম বসবাসের স্যা সেখানেই ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। বৃটিশ কলোনীগুলো স্বাধীন হলেও প্রত্যেকটা অঞ্চলে একেকটা করে দাবানল জ্বালিয়ে রেখে গেছে তারা। ভারতে কাশ্মির এবং মিয়ানমারে আরাকান যার উজ্বল উদাহরণ। এসব অঞ্চলের মূল অধিবাসী মুসলমান হলেও তারা নিজ ভূমে পরবাসী। বুকের তাজা খুনের উপর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পরাধীনতার কলঙ্কিত ইতিহাস। রোসাঙ্গের ইতিহাসখ্যাত মুসলমানদেরকে এখন সেখানকার বহিরাগত অভিবাসী হিসেবে পরিচিত করানো হচ্ছে। হাজার হাজার মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে নাফ নদীর পানি। রোহিঙ্গা মুসলমান জনপদজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা। ল ল রোহিঙ্গা আজ দেশছাড়া। নারী শিশু বৃদ্ধের অমানবিক জীবন বিশ্বের অসভ্যতার ইতিহাসকে ম্লান করে দিচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা আজ যেন নীরব দর্শক। তাইতো কবি মতিউর রহমান মল্লিকের আপেÑ
রোহিঙ্গাদের বুকের উপরে স্বাধীনতা বিরোধীরা
আরকানীদের মাথার উপরে গৃধ্নের কালো ছায়া
(তবু আকাশে চাঁদ: তোমার ভাষায় তীè ছোরা)
কবি গোলাম মোহাম্মদের কলমেও উঠে এসেছে হৃদয়স্পর্শী পঙক্তিমালাÑ
একদিন যে রোহিঙ্গা রমণী তসবি জপতে জপতে
সন্তান ও স্বামীর সম্মুখে ইফতারের আয়োজন বাড়িয়ে দিতো
আজ তার ইফতার নেই, সেহরি নেই, পলাতক সন্তান, নিখোঁজ স্বামী
অনিশ্চিত উদ্বাস্তু শিবিরে দুঃস্বপ্নের পাহাড় দুচোখে
বিপন্ন মানবতার জন্যে রোজাদার আজ কোন্ প্রার্থনা করবে?
(প্লাবিত প্রার্থনা: রচনা সমগ্র)
দেশপ্রেম ও মানবতাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত বাংলাসাহিত্যের শক্তিমান এ দুই কবির লেখায় উঠে এসেছে এ রকম হাজারো চিত্র। কবিতা, ছড়া এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধেও তাঁরা দেশ ও জাতির জন্য বলিষ্ঠ ভাষায় সাহসী উচ্চারণ করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সফল উত্তরসূরী হিসেবে সঙ্গীতের জগতেও ঢেউ তুলেছেন সফলভাবে। বিশ্বাসী ধারায় তারা এক সফল স্রোত বিনির্মাণেও সফল হয়েছেন পুরোপুরি। গানে গানেও গেয়েছেন মানতাবতার জয়গান। প্রভূপ্রেমকে সম্বল করে তার দেশ জাতি ও মানবতার জন্য লিখে গেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
আমাকে দাও সে ঈমান আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে অসঙ্কোচে
গায় জীবনের গান।
একই ধারায় কবি গোলাম মোহাম্মদও উচ্চারণ করেছেন-
সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে
আমাকেও রাখিও রহমান,
যারা কুরআনের আহ্বানে নির্ভীক
নির্ভয়ে সব করে দান।
(সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে: রচনা সমগ্র ২১৩)
কবি আল মাহমুদ প্রায়ই বলেন, কবিদের কাজ স্বপ্ন দেখানো। তারা জাতিকে স্বপ্ন দেখায়। কাজী নজরুল ইসলামও বলেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’; কবি ফররুখ আহমদ তাই ডাক দিয়েছেন- ‘ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ/ নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ’। পূর্বসূরিদের এমন আহ্বানে সর্বান্তঃকরণে জেগে উঠেছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও কবি গোলাম মোহাম্মদ। তাইতো কবি মতিউর রহমান মল্লিক করুণ কণ্ঠে প্রভুর কাছে দুআ করেছেন গানে গানে- ‘দাও খোদা দাও হেথায় পূর্ণ ইসলামী সমাজ/ রাশেদার যুগ দাও ফিরায়ে, দাও কোরানের রাজ।’ কবি গোলাম মোহাম্মদও গেয়েছেন একই সুরে- ‘খোদা সকল কিছুর বদল হলেও/ তোমার শাসন দাও/ শক্তি নাও মোর সম্পদ নাও/ না হয় আমার জীবন নাও’। আজ দুজনেই প্রভুর কাছে চলে গেছেন। পরিবারের সদস্যদের ছাড়াও হাজারো অনুরাগী রেখে গেছেন; যারা তাদের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তাইতো বলা যায়, শুধু স্বপ্ন বিনির্মাণে নয়; সত্যিকার অর্থেই তারা জাতীয় চেতনার সফল কবিপুরুষ।
লেখক: অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mrakhanda@gmail.com
সূত্র : সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন