অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী মিতু। মেধাবী,বুদ্ধিমতি ও সুশ্রী। ভদ্র ও মার্জিত আচরণের এই মেয়েটির জন্ম গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তিন বোন এক ভাই এর মধ্যে মিতু তৃতীয়। মা-বাবা আর ভাইবোন নিয়ে তাদের সুন্দর সাজানো সংসার। বাবা দীর্ঘদিন থেকে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। মা গৃহিনী। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগে। মেজ বোন কলেজে পড়ছে আর ছোট ভাই সবে মাত্র স্কুলে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের অনেক আদরের ছোট মেয়ে মিতুন সেও বাবা-মাকে খুব ভালবাসে। বিদ্যালয়ের বাঁধা নিয়মের বাহিরেও প্রাইভেট পড়ে সহপাঠিদের সাথে গল্প করে সময় কাটে তার। মাঝে মাঝে মাকেও সহযোগিতা করে সংসারের কাজে। সহপাঠীর মধ্যে প্রিয় হল কানিজ, স্নিগ্ধা নাইস, ফাতেমা, মালেক ও রাহুল। তারা নিজেদের মধ্যে খুব খোলাখুলি কথা বলে। যখন তারা আড্ডায় মগ্ন থাকে তখন মালেক প্রায় তাকিয়ে থাকত মিতুর দিকে। আর মনে মনে ভাবত কি সুন্দর মিতুর হাসি! ওকে আমার কেন এত ভাল লাগে। আমি কি ওকে ভালোবাসি? হয়তো তাই। আমি কি মিতুকে বলবো আমি তোকে ভালবাসি। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি কখনো। সুযোগ পেলেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত মিতুর দিকে। বিষয়টি মিতুর দৃষ্টি এড়ায়নি, দেখতে দেখতে অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তারা নবম শ্রেণীতে উঠল। মিতু এখন নিজেকে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে যে সে বড় হয়েছে এখন আর তাকে যেন তেন ভাবে চলা উচিত নয়। সে মুসলমান ঘরের মেয়ে তাকে সংযত ভাবে শালীন পোশাকে চলতে হবে। প্রতিদিনের মত সকালের নাস্তা সেরে স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে মাকে সালাম দিয়ে স্কুলের পথে চলল। হঠাৎ করে পেছন থেকে মালেক ডাক দিল।
মিতু এই মিতু শোন
হাঁটার গতি থামায়নি মিতু, পেছন ফিরে বলল তাড়াতাড়ি আয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দাঁড়ানা একটু আমিও তো যাব, আমি কি ক্লাস করবনা?
রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল মিতু। কাঁধের ব্যাগটা ডান হাতে চেপে ধরে দৌঁড়ে এল মালেক, দুজনেই পাশপাশি হেঁটে যাচ্ছে। মালেক বলল “কেমন আছিস ভালো তো?”
কোন কথা বলেনা মিতু। মালেক মিতুর দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে “কিরে কথা বলিসনা যে, রাগ করেছিস?”
নারে বোকা রাগ করব কেন?
“তাহলে মুখটা এরকম কালো করে রেখেছিস কেন?
মিতু চুপি চুপি একটি তামাশার হাসি হাসল,মুখটা আরো গম্ভীর করে মালেকের দিকে তাকিয়ে বলল” আমি একটা সমস্যায় পড়েছিলে
উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল মালেক’ কী সমস্যা আমাকে বল
“ক্লাসে ইদানিং আমার খুব খারাপ লাগছে”
কেন?
“তোর মত বানরের মুখ দেখছি বলে” কথাটা বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠল মিতু।
মালেকের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠে। এরই মধ্যে স্কুলে পৌঁছে যায় দুজনে। মালেক আর মিতুকে তার মনের কথাটা বলতে পারেনি।
অবশেষে সে সহপাঠী নাইমকে ধরল মিতুকে বলার জন্য, নাইম বলে নারে আমি পারবোনা। এসব কথা বললে মিতু আমাকে ভুল বুঝবে তুই আমাকে ক্ষমা কর।
সেদিনের মত স্কুল ছুটি হল, যে যার মত বাড়ি ফিরে গেল। মিতু বাড়ি ফিরে শোনে তার মেজ বোন মাইসা সকালে যে কলেজে গেছে এখনো বাড়িতে ফিরেনি। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ করলেও কেউ বলতে পারেনি মাইসার কথা। নিরুপায় বাবা মা ঘরে বসে কাঁদছেন। অবশেষে রাত নয়টার খবর এল তাদের পাশের বাড়ির এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে মাইসা। মায়ের কান্না থামাতে সান্ত্বনা দিচ্ছে মিতু। বাবা পাথরের মূর্তির মত বসে আছেন চেয়ারে। অনেক আশা নিয়ে বিদেশ থেকে এসেছেন মেয়েকে বিয়ে দেবেন বলে। বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে মিতু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই জীবনে যত ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন সে বাবা মাকে কখনো কষ্ট দেবেনা। এভাবে কেটে যায় বছর। এস.এস.সি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করে, ভর্তি হয়ে কলেজে।
একদিন মেজ বোন মাইসা আসে বাড়িতে। তার কোলে ফুটফুটে একটি শিশু। কলেজ থেকে ফিরে মিতু বসার ঘরে দেখতে পেল মাইসা বসে আছে। কিছু না বলে মিতু চলে যায় নিজের রুমে। মাইসা তার বরের অনেক কান্নাকাটি এবং শ্বশুরবাড়ি ও পড়শীদের বোঝানোর পর মাইশাকে মেনে নিল বাবা মা, ফুটফুটে বাচ্চাকে আদর করে সবাই, এ থেকে মিতু ও বাদ যায়নি। কয়েকদিন পর মাইসার বর বিদেশ চলে গেল, মাইসাকে রেখে গেল তার মায়ের নিকট। সবাই তাকে মেনে নিলেও মিতু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বোনকে। তার চোখের সামনে কেবলই ভেসে উঠে মাইসার পালিয়ে যাবার দিনের স্মৃতি। সমাজের কাছে কত ছোট হতে হয়েছে বাবা মাকে। কত কথা শুনতে হয়েছে মিতুকেও। একদিন কলেজে গেলে তার বান্ধবী নাইম ফাতেমা আর রাহুল তাকে ডেকে কমন রুমে নিয়ে যায় এবং মালেকের কথা বলে। নাইম বলে মিতু তোকে একটা কথা বলব জানিনা তুই কিভাবে নিবি। আসলে কথাটা ঠিক আমার না।
কী বলবি অমন করছিস কেন? আসলে মালেক আমাকে ধরেছে ও তোকে অনেকদিন থেকে একটা কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে বলা হয়ে উঠেনি। ও আমি বুঝতে পেরেছি তোরা কি বলতে চাচ্চিস। ওসব হবে না। মালেক আমার বন্ধু ওকে বন্ধুর মত থাকতে বল। একথা বলে সেখান থেকে চলে যায় মিতু। পরের দিন কলেজে আসলে সেই একই দৃশ্য। ফাতেমা নাইস আর রাহুল তাকে বোঝাতে থাকে। তাদের পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছিল মিতু। দরজার পাশে দেখতে পায় মালেক দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’চোখ ঠিক মিতুর চোখে বিদ্ধ। এই দৃশ্য এর আগেও দেখেছে মিতু। পাশ কাটিয়ে চলে এল মিতু কিন্তু মালেকের চোখ দু’টোকে যেন সে এড়াতে পারছেনা। মালেকের দৃষ্টিটা মনে হলে মিতুর ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে।
হে সৃষ্টিকর্তা এ কোন পরিক্ষায় ফেললে আমাকে। তুমি আমার রক্ষা কর। দুদিন কলেজ বন্ধ থাকার পর তৃতীয় দিন কলেজে আসে মিতু। সারাদিন চুপচাপ থাকে। সহপাঠীদের সাথে তেমন কথা বলেনি। বিকেলে বাড়ি ফেরার জন্য কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে গাড়ীর জন্য। সেখানে উপস্থিত হয় মালেক,সেও গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে।
মালেক ভাবে আমি নিজেই তো মিতুকে কথাটা বলতে পারি। এই ভেবে সে ধীরে ধীরে মিতুর কাছে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কলমটা পকেটে থেকে বের করে বলল “নাও এটা তোমার।”
মিতু ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে কলমটা নিল।
হেসে উঠে মিতুকে ধন্যবাদ দিল মালেক। এমন সময় গাড়ি এসে পড়ল। অন্যদের সাথে তারাও গাড়িতে উঠে পড়ে। দুজনেই পাশাপাশি সিটে বসে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেনা। মালেক ঘন ঘন তাকায় মিতুর দিকে। লজ্জায় মিতুর মুখ রাঙ্গা হয়ে উঠে।
পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে মালেক এক গাদা ফুল নিয়ে হাজির হয় মিতুর সামনে। মিতু অবাক হয়ে যায়। তারপর দুজনে হাসতে থাকে। এ হাসি চলল অনেক দিন।
কলেজের প্রথম বর্ষ পরীক্ষার শেষে বাবার বদলির সুবাদে মিজান নামে একটি ছেলে ভর্তি হয় ওদের সাথে। সকলের সাথে তার খুব ভাব। কিন্তু মিতুকে যেন সে অন্য ভাবে দেখে। মালেকের সাথে মিতুর চলাফেরা সে মোটেই সহ্য করতে পারে না। এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বের হলো। তারা ভর্তি হল স্নাতক শ্রেনীতে। একদিন মেয়েদের কমন রুমে আসে মালেক। মিতুকে ডেকে নিয়ে দুজনেই চলে যায় লাইব্রেরীতে। একটি বই নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে মালেক বলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, মিতু, জানিনা তুমি কিভাবে নিবে? মিতু হেসে তাকায় মালেকের দিকে- বারে কী এমন কথা যা বলতে তোমার এত সংশয়?
ভাইয়া আমেরিকা থেকে আমার জন্য ভিসা পাঠিয়েছেন খুব শীঘ্রই আমাকে চলে যেতে হবে। কিন্তু মিতুর মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার চোখের তারা বিষ্ফোরিত হয়ে উঠল। তবুও এক মুহুর্তে নিজেকে সংযত করে নিল। কিন্তু বলল-
সেতো ভাল কথা আমেরিকা যাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
কী বলছ তুমি!
যা সত্যি তাই বলছি। যেতেই যখন হবে যাবে। মুহূর্তে মিতুর দুহাত চেপে ধরল মালেক বলল
চল আমরা বিয়ে করে ফেলি
কিন্তু মিতুর দু’চোখ জলে ভরে গেল।
না মালেক না এটা আমি পারবোনা,কিছুক্ষণ থেমে মিতু বলল
তোমার যখন ভিসা হয়ে গেছে তুমি চলে যাও, সেখানে তোমার পড়ালেখা শেষ হবে। আর আমি এখানে স্নাতকটা শেষ করবো। তারপর আমরা আমাদের কথা অভিভাবকদের জানাবো। তখন দেখবে কেউ না করতে পারবেনা।
মিতু! অস্ফুট শব্দ মালেকের। তারপর কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে রইল।
বৃহস্পতিবার সকালবেলা মালেক মিতুদের বাড়িতে এল মিতুর বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকল মিতুর রুমে। ঢুকে দেখে খাটের এক পাশে বসে আছে মিতু। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মালেক এসে মিতুর সামনের চেয়ারে বসল। মিতুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-আমি তো সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছিনা। তুমি যদি এভাবে কাঁদতে থাক আমি সেখানে গিয়ে কিভাবে থাকব। চল আমাকে একটু এগিয়ে দেবে বলে মিতুর দুচোখ মুছে দেয় মালেক ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। মালেক সামনে এগিয়ে যায়। উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে মালেকের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মিতু। কলেজের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে মিতু। এমন সময় মিজান এসে মিতুর পথ আগলে দাঁড়ায়। মিতু দাঁড়িয়ে পড়ে বলে-কী ব্যাপার পথ আগলে দাঁড়ালি যে?
তোর সাথে কিছু কথা আছে
বল, কী কথা?
চল আমরা কফি খেতে যাই। সেখানেই বলব।
তুই আমাকে ক্যান্টিনে বসে কখনো কিছু খেতে দেখেছিস?
যা বলার এখানেই বল, না হলে পথ ছাড়।
আমি তোকে ভালোবাসি মিতু। আমি যখন প্রথমে কলেজে এসেছি তখনই আমি তোকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম যে মালেক তোকে ভালবাসে, এখন তো মালেক নেই।
মালেক নেই তো কী হয়েছে, মালেকের ভালোবাসা কি চলে গেছে? এমন সব কথা বলিসনা! মিতু পাশ কেটে যেতে চাইল কিন্তু মিজান ফের আগলে দাঁড়াল বলল-মালেক আর কোনদিন ফোন করবোনা দেখিস সে আমেরিকায় গ্রীন কার্ড পাওয়ার জন্য অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক পেতেছে। আমি বিশ্বাস করিনা। কিন্তু তোর সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছে একথা আমি মালেককে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ব। দিন তিনেক পর মালেকের ফোন এল। ফোনটা রিসিভ করে মিতু জিজ্ঞেস করল-
কেমন আছো? ও কথা তোমার মুখে আর শোভা পায়না। এখনতো মিজানের সাথে তোমার কফি খাওয়া হচ্ছে। সিনেমা দেখা হচ্ছে। তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে মিতু? বিশ্বাস করো এসব মিথ্যা। মিজান কী বলেছে তুমি কথাটা আমার কাছ থেকে শোনো।
আমার আর কিছু শোনার নেই মিতু। আমি আবীরের কাছ থেকে সব শুনেছি। আবীর আমাকে ফোন করেছিল। তুমি মিজানের সাথে সিনেমায় গিয়েছিলে।
বিশ্বাস করো এসব মিজানের.....। ফোনটা কেটে দিল মালেক। এরপর যতই ফোন করল মালেককে, সে ফোন আর কখনোই বাজেনি। প্রায় দুবছর পর বাড়ি এসেছে মালেক। হঠাৎ একদিন মিতুর সাথে দেখা হল রাস্তায়। মিতু বোরকা পরে কলেজে যাচ্ছে। মালেক তাকে চিনতে পারলো কিনা জানতে পারেনি মিতু। তার দুচোখে বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ল মনে মনে বলল-কী দোষ ছিল আমার? কেন আমি এত কষ্ট পাচ্ছি? উপরের দিকে তাকিয়ে বলে-ও আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে এ কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দান কর। মিজানের মত অমানুষ ছেলেদের তুমি মানুষ করে দাও। ওরা যেন আর কখনো কোন মেয়ের নামে এ ধরণের মিথ্যা উক্তিনা করে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতু। আর মনে মনে বলে-মালেক- তুমি মিজানের কথা বিশ্বাস করেছ। আমাকে বিশ্বাস করলে না? একবার আমার সামনে এসেও জানতে চাইলেনা। মিজানের কথা সত্য না আমার ভালবাসা সত্য। আমি মৃত্যু পর্যন্ত এ বুকে “ভালবাসার চিতা” জ্বালিয়ে রাখব। তবু তোমার মত স্বল্প বিশ্বাসী ছেলের সাথে জীবন গড়বোনা।
মিতু এই মিতু শোন
হাঁটার গতি থামায়নি মিতু, পেছন ফিরে বলল তাড়াতাড়ি আয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দাঁড়ানা একটু আমিও তো যাব, আমি কি ক্লাস করবনা?
রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল মিতু। কাঁধের ব্যাগটা ডান হাতে চেপে ধরে দৌঁড়ে এল মালেক, দুজনেই পাশপাশি হেঁটে যাচ্ছে। মালেক বলল “কেমন আছিস ভালো তো?”
কোন কথা বলেনা মিতু। মালেক মিতুর দিকে মুখ বাড়িয়ে বলে “কিরে কথা বলিসনা যে, রাগ করেছিস?”
নারে বোকা রাগ করব কেন?
“তাহলে মুখটা এরকম কালো করে রেখেছিস কেন?
মিতু চুপি চুপি একটি তামাশার হাসি হাসল,মুখটা আরো গম্ভীর করে মালেকের দিকে তাকিয়ে বলল” আমি একটা সমস্যায় পড়েছিলে
উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল মালেক’ কী সমস্যা আমাকে বল
“ক্লাসে ইদানিং আমার খুব খারাপ লাগছে”
কেন?
“তোর মত বানরের মুখ দেখছি বলে” কথাটা বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠল মিতু।
মালেকের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠে। এরই মধ্যে স্কুলে পৌঁছে যায় দুজনে। মালেক আর মিতুকে তার মনের কথাটা বলতে পারেনি।
অবশেষে সে সহপাঠী নাইমকে ধরল মিতুকে বলার জন্য, নাইম বলে নারে আমি পারবোনা। এসব কথা বললে মিতু আমাকে ভুল বুঝবে তুই আমাকে ক্ষমা কর।
সেদিনের মত স্কুল ছুটি হল, যে যার মত বাড়ি ফিরে গেল। মিতু বাড়ি ফিরে শোনে তার মেজ বোন মাইসা সকালে যে কলেজে গেছে এখনো বাড়িতে ফিরেনি। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ করলেও কেউ বলতে পারেনি মাইসার কথা। নিরুপায় বাবা মা ঘরে বসে কাঁদছেন। অবশেষে রাত নয়টার খবর এল তাদের পাশের বাড়ির এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে মাইসা। মায়ের কান্না থামাতে সান্ত্বনা দিচ্ছে মিতু। বাবা পাথরের মূর্তির মত বসে আছেন চেয়ারে। অনেক আশা নিয়ে বিদেশ থেকে এসেছেন মেয়েকে বিয়ে দেবেন বলে। বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে মিতু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই জীবনে যত ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন সে বাবা মাকে কখনো কষ্ট দেবেনা। এভাবে কেটে যায় বছর। এস.এস.সি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করে, ভর্তি হয়ে কলেজে।
একদিন মেজ বোন মাইসা আসে বাড়িতে। তার কোলে ফুটফুটে একটি শিশু। কলেজ থেকে ফিরে মিতু বসার ঘরে দেখতে পেল মাইসা বসে আছে। কিছু না বলে মিতু চলে যায় নিজের রুমে। মাইসা তার বরের অনেক কান্নাকাটি এবং শ্বশুরবাড়ি ও পড়শীদের বোঝানোর পর মাইশাকে মেনে নিল বাবা মা, ফুটফুটে বাচ্চাকে আদর করে সবাই, এ থেকে মিতু ও বাদ যায়নি। কয়েকদিন পর মাইসার বর বিদেশ চলে গেল, মাইসাকে রেখে গেল তার মায়ের নিকট। সবাই তাকে মেনে নিলেও মিতু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বোনকে। তার চোখের সামনে কেবলই ভেসে উঠে মাইসার পালিয়ে যাবার দিনের স্মৃতি। সমাজের কাছে কত ছোট হতে হয়েছে বাবা মাকে। কত কথা শুনতে হয়েছে মিতুকেও। একদিন কলেজে গেলে তার বান্ধবী নাইম ফাতেমা আর রাহুল তাকে ডেকে কমন রুমে নিয়ে যায় এবং মালেকের কথা বলে। নাইম বলে মিতু তোকে একটা কথা বলব জানিনা তুই কিভাবে নিবি। আসলে কথাটা ঠিক আমার না।
কী বলবি অমন করছিস কেন? আসলে মালেক আমাকে ধরেছে ও তোকে অনেকদিন থেকে একটা কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে বলা হয়ে উঠেনি। ও আমি বুঝতে পেরেছি তোরা কি বলতে চাচ্চিস। ওসব হবে না। মালেক আমার বন্ধু ওকে বন্ধুর মত থাকতে বল। একথা বলে সেখান থেকে চলে যায় মিতু। পরের দিন কলেজে আসলে সেই একই দৃশ্য। ফাতেমা নাইস আর রাহুল তাকে বোঝাতে থাকে। তাদের পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছিল মিতু। দরজার পাশে দেখতে পায় মালেক দাঁড়িয়ে আছে। তার দু’চোখ ঠিক মিতুর চোখে বিদ্ধ। এই দৃশ্য এর আগেও দেখেছে মিতু। পাশ কাটিয়ে চলে এল মিতু কিন্তু মালেকের চোখ দু’টোকে যেন সে এড়াতে পারছেনা। মালেকের দৃষ্টিটা মনে হলে মিতুর ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠে। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে।
হে সৃষ্টিকর্তা এ কোন পরিক্ষায় ফেললে আমাকে। তুমি আমার রক্ষা কর। দুদিন কলেজ বন্ধ থাকার পর তৃতীয় দিন কলেজে আসে মিতু। সারাদিন চুপচাপ থাকে। সহপাঠীদের সাথে তেমন কথা বলেনি। বিকেলে বাড়ি ফেরার জন্য কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে গাড়ীর জন্য। সেখানে উপস্থিত হয় মালেক,সেও গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে।
মালেক ভাবে আমি নিজেই তো মিতুকে কথাটা বলতে পারি। এই ভেবে সে ধীরে ধীরে মিতুর কাছে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কলমটা পকেটে থেকে বের করে বলল “নাও এটা তোমার।”
মিতু ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে কলমটা নিল।
হেসে উঠে মিতুকে ধন্যবাদ দিল মালেক। এমন সময় গাড়ি এসে পড়ল। অন্যদের সাথে তারাও গাড়িতে উঠে পড়ে। দুজনেই পাশাপাশি সিটে বসে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেনা। মালেক ঘন ঘন তাকায় মিতুর দিকে। লজ্জায় মিতুর মুখ রাঙ্গা হয়ে উঠে।
পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে মালেক এক গাদা ফুল নিয়ে হাজির হয় মিতুর সামনে। মিতু অবাক হয়ে যায়। তারপর দুজনে হাসতে থাকে। এ হাসি চলল অনেক দিন।
কলেজের প্রথম বর্ষ পরীক্ষার শেষে বাবার বদলির সুবাদে মিজান নামে একটি ছেলে ভর্তি হয় ওদের সাথে। সকলের সাথে তার খুব ভাব। কিন্তু মিতুকে যেন সে অন্য ভাবে দেখে। মালেকের সাথে মিতুর চলাফেরা সে মোটেই সহ্য করতে পারে না। এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বের হলো। তারা ভর্তি হল স্নাতক শ্রেনীতে। একদিন মেয়েদের কমন রুমে আসে মালেক। মিতুকে ডেকে নিয়ে দুজনেই চলে যায় লাইব্রেরীতে। একটি বই নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে মালেক বলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, মিতু, জানিনা তুমি কিভাবে নিবে? মিতু হেসে তাকায় মালেকের দিকে- বারে কী এমন কথা যা বলতে তোমার এত সংশয়?
ভাইয়া আমেরিকা থেকে আমার জন্য ভিসা পাঠিয়েছেন খুব শীঘ্রই আমাকে চলে যেতে হবে। কিন্তু মিতুর মাথায় যেন বাজ পড়ল। তার চোখের তারা বিষ্ফোরিত হয়ে উঠল। তবুও এক মুহুর্তে নিজেকে সংযত করে নিল। কিন্তু বলল-
সেতো ভাল কথা আমেরিকা যাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
কী বলছ তুমি!
যা সত্যি তাই বলছি। যেতেই যখন হবে যাবে। মুহূর্তে মিতুর দুহাত চেপে ধরল মালেক বলল
চল আমরা বিয়ে করে ফেলি
কিন্তু মিতুর দু’চোখ জলে ভরে গেল।
না মালেক না এটা আমি পারবোনা,কিছুক্ষণ থেমে মিতু বলল
তোমার যখন ভিসা হয়ে গেছে তুমি চলে যাও, সেখানে তোমার পড়ালেখা শেষ হবে। আর আমি এখানে স্নাতকটা শেষ করবো। তারপর আমরা আমাদের কথা অভিভাবকদের জানাবো। তখন দেখবে কেউ না করতে পারবেনা।
মিতু! অস্ফুট শব্দ মালেকের। তারপর কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে রইল।
বৃহস্পতিবার সকালবেলা মালেক মিতুদের বাড়িতে এল মিতুর বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকল মিতুর রুমে। ঢুকে দেখে খাটের এক পাশে বসে আছে মিতু। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মালেক এসে মিতুর সামনের চেয়ারে বসল। মিতুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-আমি তো সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছিনা। তুমি যদি এভাবে কাঁদতে থাক আমি সেখানে গিয়ে কিভাবে থাকব। চল আমাকে একটু এগিয়ে দেবে বলে মিতুর দুচোখ মুছে দেয় মালেক ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। মালেক সামনে এগিয়ে যায়। উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে মালেকের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মিতু। কলেজের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে মিতু। এমন সময় মিজান এসে মিতুর পথ আগলে দাঁড়ায়। মিতু দাঁড়িয়ে পড়ে বলে-কী ব্যাপার পথ আগলে দাঁড়ালি যে?
তোর সাথে কিছু কথা আছে
বল, কী কথা?
চল আমরা কফি খেতে যাই। সেখানেই বলব।
তুই আমাকে ক্যান্টিনে বসে কখনো কিছু খেতে দেখেছিস?
যা বলার এখানেই বল, না হলে পথ ছাড়।
আমি তোকে ভালোবাসি মিতু। আমি যখন প্রথমে কলেজে এসেছি তখনই আমি তোকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু জানতে পারলাম যে মালেক তোকে ভালবাসে, এখন তো মালেক নেই।
মালেক নেই তো কী হয়েছে, মালেকের ভালোবাসা কি চলে গেছে? এমন সব কথা বলিসনা! মিতু পাশ কেটে যেতে চাইল কিন্তু মিজান ফের আগলে দাঁড়াল বলল-মালেক আর কোনদিন ফোন করবোনা দেখিস সে আমেরিকায় গ্রীন কার্ড পাওয়ার জন্য অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক পেতেছে। আমি বিশ্বাস করিনা। কিন্তু তোর সাথে আমার সম্পর্ক হয়েছে একথা আমি মালেককে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ব। দিন তিনেক পর মালেকের ফোন এল। ফোনটা রিসিভ করে মিতু জিজ্ঞেস করল-
কেমন আছো? ও কথা তোমার মুখে আর শোভা পায়না। এখনতো মিজানের সাথে তোমার কফি খাওয়া হচ্ছে। সিনেমা দেখা হচ্ছে। তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে মিতু? বিশ্বাস করো এসব মিথ্যা। মিজান কী বলেছে তুমি কথাটা আমার কাছ থেকে শোনো।
আমার আর কিছু শোনার নেই মিতু। আমি আবীরের কাছ থেকে সব শুনেছি। আবীর আমাকে ফোন করেছিল। তুমি মিজানের সাথে সিনেমায় গিয়েছিলে।
বিশ্বাস করো এসব মিজানের.....। ফোনটা কেটে দিল মালেক। এরপর যতই ফোন করল মালেককে, সে ফোন আর কখনোই বাজেনি। প্রায় দুবছর পর বাড়ি এসেছে মালেক। হঠাৎ একদিন মিতুর সাথে দেখা হল রাস্তায়। মিতু বোরকা পরে কলেজে যাচ্ছে। মালেক তাকে চিনতে পারলো কিনা জানতে পারেনি মিতু। তার দুচোখে বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ল মনে মনে বলল-কী দোষ ছিল আমার? কেন আমি এত কষ্ট পাচ্ছি? উপরের দিকে তাকিয়ে বলে-ও আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে এ কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দান কর। মিজানের মত অমানুষ ছেলেদের তুমি মানুষ করে দাও। ওরা যেন আর কখনো কোন মেয়ের নামে এ ধরণের মিথ্যা উক্তিনা করে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতু। আর মনে মনে বলে-মালেক- তুমি মিজানের কথা বিশ্বাস করেছ। আমাকে বিশ্বাস করলে না? একবার আমার সামনে এসেও জানতে চাইলেনা। মিজানের কথা সত্য না আমার ভালবাসা সত্য। আমি মৃত্যু পর্যন্ত এ বুকে “ভালবাসার চিতা” জ্বালিয়ে রাখব। তবু তোমার মত স্বল্প বিশ্বাসী ছেলের সাথে জীবন গড়বোনা।
লেখিকা: ছাত্রী, পৌর শহীদ স্মৃতি একাডেমী, লক্ষ্মীপুর।
গল্পটি মাসিক বাংলা আওয়াজে প্রকাশিত
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন