বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তিতে একটি বিষয় সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে এই রাষ্ট্রের চল্লিশ বছরের অস্তিত্বে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি। প্রত্যাশার হিসাব মেলানোটা হয়তো সহজ, কিন্তু প্রাপ্তির হিসাবটা অত্যন্ত জটিল। কেননা, বিগত চার দশকে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, তার মধ্যে প্রধান দু’টি দলের অবস্থান প্রায় বিপরীতমুখী। তারা তাদের মতো করে দেশকে নির্মাণ করতে চেয়েছে এবং এই অবস্থানের মধ্যে ঐকমত্য খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম কেন হয়েছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এ রাষ্ট্রের লক্ষ্য সম্পর্কে সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রত্যাশা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত হয় সেখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমণ্ডলীর (জাতিসংঘ) সদস্য হিসেবে আমাদের ওপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।’ একই ঘোষণায় তত্কালীন নেতারা বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্য সব কার্য করার অঙ্গীকারও করেছেন। অবশ্য সংবিধান সংশোধনের পর সংশোধিত সংবিধানে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে জনগণকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ভিন্ন অন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। এই স্বাধীনতার কথিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার বাইরেও আরও কিছু আকাঙ্ক্ষা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তাদের স্বপ্নের রাজ্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। অথচ এই জনপদের মানুষেরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজ শাসনে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত মুসলমানরা বিত্তবান হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এই সুযোগের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্তরা, বৈষম্যের শিকার হয়ে। তাই তাদের ধারণা ছিল, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা বিত্ত প্রাপ্তির সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবেন। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিত্তের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্তরা।
কিন্তু মধ্যবিত্তের এই বিত্ত সন্ধানের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বাধীনতার পর পর ক্ষমতাসীন দলের আচরণে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে, প্রতিপক্ষ দমনে এবং নির্বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘনে। আইনের শাসনের প্রতি যে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ছিল না, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত লেখার শিরোনাম হয় ‘আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই।’ স্বৈরাচারী মানসিকতা লালনকারী অবস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে দমন করবার জন্য গঠন করতে হয় রক্ষীবাহিনী। ধারণা করা হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক আনুগত্য সম্পর্কে তত্কালীন সরকার নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সেনাবাহিনীর অফিসারদের অনেকের ভেতর ছিল এক ধরনের আদর্শবাদ এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার কারণে সৈনিকদের ভেতরও তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। এ কারণেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োগ করার পর যখন দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তখন এ অভিযান থেকে প্রত্যাহার করতে হয় সেনাবাহিনীকে। আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয় দুর্ভিক্ষ এবং রাজমুকুট মাথায় দিয়ে অতি পরিচিত যুবকের বিয়ে। জীবনের নিরাপত্তার অবসান ঘটে পুলিশি হেফাজতে সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যা এ দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রথম উদাহরণ।
স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে যত ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটার সঙ্গেই সাংবিধানিক প্রস্তাবনার কোনো মিল ছিল না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে জনবিরোধী যত ঘটনা ঘটেছে, তার সূত্রপাত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম বছরগুলোতেই। নির্বাচনে ভোট ডাকাতিরও সূত্রপাত ১৯৭৩ সালে।
এভাবে তালিকা করলে তা অনেক দীর্ঘ হবে। কিন্তু মোটাদাগে বললে স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের যে কয়টি প্রাপ্তি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বিত্তবানদের সংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্নীতির প্রসার এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান। রাজধানী ঢাকার চেহারা হয়তো বিগত দিনগুলোতে অনেক আলো ঝলমল হয়েছে। কিন্তু সে আলো ঝলমল রাজধানী যে দেশের বুকে বিরাজমান সর্বপ্রকার অন্ধকারকে মুছে দিতে পারেনি, এ কথা স্বীকার করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃষক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর তরুণরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মানুষের সপক্ষে যেসব আন্দোলন হয়েছিল, সেখানেও এই শক্তির উপস্থিতি ছিল প্রবল। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য এই শক্তির ওপর নির্ভর করেছে প্রবলভাবে। এই শক্তির একটা প্রধান ক্ষমতা ছিল তাদের সাংগঠনিক অবস্থান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের যে সংগঠন ছিল, তার শক্তি ছিল ব্যাপক। বিভিন্ন সময়ে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যেমন সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও জুগিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতার সফল আন্দোলনের অসংখ্য উদাহরণ আছে। পূর্ব পাকিস্তানে এই সফলতা ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ভরাডুবি ঘটিয়ে দেয়ার সম্ভাবনায় ১৯৫৮ সালে জারি হয়েছিল সামরিক শাসন। অবশ্য সেই সামরিক শাসনের পেছনে মদদ জুগিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সিআইএর এই ভীতির একটা প্রধান কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, কমিউনিস্ট সমর্থিত প্রগতিশীল শক্তির ব্যাপক বিকাশ। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের সংগঠনগুলোর উজ্জ্বল উপস্থিতি মানুষকে সাহস জোগাত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে এ তিনটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে
চরম বিপর্যয়। এসব ক্ষেত্রে প্রাপ্তির হিসাব প্রায় শূন্যের কোটায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর মধ্যবিত্তের মতো ছাত্ররাও হয়ে ওঠে বিত্ত সন্ধানী। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে ঘটে তার প্রতিফলন। পাকিস্তান আমলে যে আদর্শবাদকে নির্ভর করে ছাত্র সংগঠনগুলো পরিচালিত হতো, তা রাতারাতি উবে যায়। ছাত্র সংগঠনের এ বিপর্যয় পুরো দেশের শিক্ষাঙ্গনকে করে তোলে কলুষিত। আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের প্রচেষ্টা পরিণত হয় সমুদ্রের বারি বিন্দুর মতো। ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় রাজনৈতিক দলের লেজুড় এবং তাদের সামনে আদর্শবাদের পথ বন্ধ হয়ে যায়। একই ঘটনা ঘটে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের বেলায়। শ্রমিক সংগঠনগুলোর একাংশের নেতা বাংলাদেশ আমলে অঙ্গীভূত হয়ে যান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে। অন্যরা প্রাথমিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পুনর্গঠিতই হতে পারছিলেন না।
কৃষক সংগঠনগুলো মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন হলেও ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর কৃষক আন্দোলনেও তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতা। শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের সমাজে পুনর্গঠিত না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ অভিজাত এলাকার মানুষদের শ্রমিক ও কৃষক নেতা বনে যাওয়া। বনানীর কৃষক যদি কৃষক সংগঠনের নেতা হয়ে যান, তাহলে আর যাই হোক তাতে সত্যিকারের কৃষকের কোনো সংগঠন গড়ে উঠবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকের সংগঠন বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে সমাজের যে শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে জন অধিকার সংরক্ষণে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত, তা নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলেই স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে এসেছে বিভিন্ন পরিবর্তন। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে মানুষের। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে এটিই বড় ব্যবধান।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম কেন হয়েছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু এ রাষ্ট্রের লক্ষ্য সম্পর্কে সংবিধানের প্রস্তাবনায় প্রত্যাশা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ঘোষিত হয় সেখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমণ্ডলীর (জাতিসংঘ) সদস্য হিসেবে আমাদের ওপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।’ একই ঘোষণায় তত্কালীন নেতারা বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্য সব কার্য করার অঙ্গীকারও করেছেন। অবশ্য সংবিধান সংশোধনের পর সংশোধিত সংবিধানে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে জনগণকে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ভিন্ন অন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। এই স্বাধীনতার কথিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার বাইরেও আরও কিছু আকাঙ্ক্ষা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তাদের স্বপ্নের রাজ্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। অথচ এই জনপদের মানুষেরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজ শাসনে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত মুসলমানরা বিত্তবান হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এই সুযোগের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্তরা, বৈষম্যের শিকার হয়ে। তাই তাদের ধারণা ছিল, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা বিত্ত প্রাপ্তির সুযোগকে কাজে লাগাতে পারবেন। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিত্তের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্তরা।
কিন্তু মধ্যবিত্তের এই বিত্ত সন্ধানের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বাধীনতার পর পর ক্ষমতাসীন দলের আচরণে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা জড়িয়ে পড়েন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনে, প্রতিপক্ষ দমনে এবং নির্বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘনে। আইনের শাসনের প্রতি যে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ছিল না, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত লেখার শিরোনাম হয় ‘আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই।’ স্বৈরাচারী মানসিকতা লালনকারী অবস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে দমন করবার জন্য গঠন করতে হয় রক্ষীবাহিনী। ধারণা করা হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক আনুগত্য সম্পর্কে তত্কালীন সরকার নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সেনাবাহিনীর অফিসারদের অনেকের ভেতর ছিল এক ধরনের আদর্শবাদ এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার কারণে সৈনিকদের ভেতরও তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। এ কারণেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োগ করার পর যখন দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তখন এ অভিযান থেকে প্রত্যাহার করতে হয় সেনাবাহিনীকে। আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয় দুর্ভিক্ষ এবং রাজমুকুট মাথায় দিয়ে অতি পরিচিত যুবকের বিয়ে। জীবনের নিরাপত্তার অবসান ঘটে পুলিশি হেফাজতে সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যা এ দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রথম উদাহরণ।
স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরে রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে যত ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটার সঙ্গেই সাংবিধানিক প্রস্তাবনার কোনো মিল ছিল না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে জনবিরোধী যত ঘটনা ঘটেছে, তার সূত্রপাত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম বছরগুলোতেই। নির্বাচনে ভোট ডাকাতিরও সূত্রপাত ১৯৭৩ সালে।
এভাবে তালিকা করলে তা অনেক দীর্ঘ হবে। কিন্তু মোটাদাগে বললে স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের যে কয়টি প্রাপ্তি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বিত্তবানদের সংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্নীতির প্রসার এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান। রাজধানী ঢাকার চেহারা হয়তো বিগত দিনগুলোতে অনেক আলো ঝলমল হয়েছে। কিন্তু সে আলো ঝলমল রাজধানী যে দেশের বুকে বিরাজমান সর্বপ্রকার অন্ধকারকে মুছে দিতে পারেনি, এ কথা স্বীকার করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃষক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর তরুণরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মানুষের সপক্ষে যেসব আন্দোলন হয়েছিল, সেখানেও এই শক্তির উপস্থিতি ছিল প্রবল। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য এই শক্তির ওপর নির্ভর করেছে প্রবলভাবে। এই শক্তির একটা প্রধান ক্ষমতা ছিল তাদের সাংগঠনিক অবস্থান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের যে সংগঠন ছিল, তার শক্তি ছিল ব্যাপক। বিভিন্ন সময়ে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যেমন সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও জুগিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতার সফল আন্দোলনের অসংখ্য উদাহরণ আছে। পূর্ব পাকিস্তানে এই সফলতা ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ভরাডুবি ঘটিয়ে দেয়ার সম্ভাবনায় ১৯৫৮ সালে জারি হয়েছিল সামরিক শাসন। অবশ্য সেই সামরিক শাসনের পেছনে মদদ জুগিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সিআইএর এই ভীতির একটা প্রধান কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, কমিউনিস্ট সমর্থিত প্রগতিশীল শক্তির ব্যাপক বিকাশ। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের সংগঠনগুলোর উজ্জ্বল উপস্থিতি মানুষকে সাহস জোগাত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে এ তিনটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে
চরম বিপর্যয়। এসব ক্ষেত্রে প্রাপ্তির হিসাব প্রায় শূন্যের কোটায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর মধ্যবিত্তের মতো ছাত্ররাও হয়ে ওঠে বিত্ত সন্ধানী। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে ঘটে তার প্রতিফলন। পাকিস্তান আমলে যে আদর্শবাদকে নির্ভর করে ছাত্র সংগঠনগুলো পরিচালিত হতো, তা রাতারাতি উবে যায়। ছাত্র সংগঠনের এ বিপর্যয় পুরো দেশের শিক্ষাঙ্গনকে করে তোলে কলুষিত। আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের প্রচেষ্টা পরিণত হয় সমুদ্রের বারি বিন্দুর মতো। ছাত্র সংগঠনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় রাজনৈতিক দলের লেজুড় এবং তাদের সামনে আদর্শবাদের পথ বন্ধ হয়ে যায়। একই ঘটনা ঘটে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের বেলায়। শ্রমিক সংগঠনগুলোর একাংশের নেতা বাংলাদেশ আমলে অঙ্গীভূত হয়ে যান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে। অন্যরা প্রাথমিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পুনর্গঠিতই হতে পারছিলেন না।
কৃষক সংগঠনগুলো মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন হলেও ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর কৃষক আন্দোলনেও তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতা। শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের সমাজে পুনর্গঠিত না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ অভিজাত এলাকার মানুষদের শ্রমিক ও কৃষক নেতা বনে যাওয়া। বনানীর কৃষক যদি কৃষক সংগঠনের নেতা হয়ে যান, তাহলে আর যাই হোক তাতে সত্যিকারের কৃষকের কোনো সংগঠন গড়ে উঠবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকের সংগঠন বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে সমাজের যে শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে জন অধিকার সংরক্ষণে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত, তা নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলেই স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে এসেছে বিভিন্ন পরিবর্তন। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে মানুষের। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে এটিই বড় ব্যবধান।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন