চল্লিশ বছর আগে এক গ্রামের পাশের মাঠে আমরা ক’জন একটা ট্রানজিস্টর রেডিও ঘিরে গোল হয়ে বসে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম। বাংলাদেশে বেঈমান বর্বর নৃশংস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর ঢাকায় আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করার খবর শোনার জন্য। ইতোমধ্যে জানা হয়েছে যে, দখলদার পাকিস্তানিদের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন এবং রমনা রেস কোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ চুক্তি সই হবে।
ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের বঙ্গভাষী দোসররা নয়া পল্টনে আমাদের ছেড়ে আসা বাসায় আমার খোঁজে হানা দিয়েছিল ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে। আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আতিকুস সামাদকেও খুঁজছিল পাকিস্তানিরা। বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী পাড়া-পড়শির মুখে সেইসব খবর পেয়ে আমরা ঢাকা ছেড়েছি সঙ্গে সঙ্গেই। এই শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে বা নৌকা দিয়ে সরু একটা খাল ধরে ধলেশ্বরী তীরে পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁরা বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকের থাকার মতো জায়গা ছিল না। তাঁরা চেয়েছেন ঢাকা থেকে প্রাণ নিয়ে বের হতে। তারপর যে কোনো মুক্ত অঞ্চলে পৌঁছে ‘যেখানে রাত সেখানে কাত’ হয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে। সবারই বিশ্বাস, কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকায় নিজ গৃহে ফেরত আসা যাবে। কারণ, হানাদার পাকিস্তানিরা যে শিগগিরই পরাজিত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ঢাকা ত্যাগ করার তাগিদ ছিল প্রথমত কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানি ও পাকিস্তানপ্রেমী আততায়ীদের লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছিলেন অনেকে। আর দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সেনারা তাদের রাজাকার-আলবদর-আলশামস স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে নিয়ে যদি ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাহলে যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হবে তাতে অনেক বেসামরিক লোকও নিহত হবে। সপরিবারে আমি, আমার ভাই, বিখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হক সাহেবের কন্যা সায়েমা হক ও পুত্র আনিসুল হক (যিনি বর্তমানে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশিষ্ট আইনজীবীতে পরিণত হয়েছেন) এবং আমাদের বন্ধু আজিজুল হক একসঙ্গে চলছিলাম। আমরা যখন ধলেশ্বরী নদীতে নৌকায় উঠছি, তখনও পেছন থেকে কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। তবে ঠিক কোথায় কামানযুদ্ধ, তা নিরূপণ করতে পারিনি। কামানের আওয়াজ বন্ধ হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ পরে। আমাদের গন্তব্য আজিজুল হকের গ্রামের বাড়ি, শেখরনগর।
আমরা শেখরনগর পৌঁছবার পরও যুদ্ধ হতে দেখেছি। পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের তাড়া করে একদল মুক্তিযোদ্ধা শেখরনগরের ওই মাঠ পার হয়ে ছুটছেন, তা দেখেছি। নৃশংস পাকিস্তানিরা পালাবার সময়ও ঘরবাড়িতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করছিল। আবার কাছেই এক নদীতে একটি লঞ্চ লক্ষ্য করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে রকেট নিক্ষেপ করতে দেখেছি। ফলে, যুদ্ধ কখন শেষ হবে সে জন্য ব্যক্তিগত গভীর উত্কণ্ঠা ছিল। ওদিকে ঢাকায় মা-বোন-ভগ্নিপতি-ভাগিনা-ভাগিনীদের এবং পাকিস্তানি জেলখানায় আমার সম্বন্ধী ডা. আনোয়ারুল হককে ছেড়ে এসেছি। তাদের জন্য উদ্বেগ ছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং শত্রুমুক্ত হয়েছে—এমন আকাঙ্ক্ষা তো ছিলই। নিজেরা বাঁচি কী মরি তার চেয়ে বড় কথা, একমাত্র কথা তখন ছিল যে দেশ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হতেই হবে। তাই পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদ শোনার জন্য অধীর অপেক্ষা। অবশেষে সেই পরম সুসংবাদটা শুনলাম। আনন্দে আত্মহারা হলাম। নিঃশ্বাস নিলাম বুকভরে। তারপর মাটির সঙ্গে বুক মিশিয়ে দেশমাতৃকার স্নেহধন্য হলাম।
তবে আমাদের সেই আনন্দ সারা বুক ভরে থাকতে পারে নাই বেশিক্ষণ। দুঃখজনক হলেও অনেক শোকের খবর অপেক্ষা করছিল। ঢাকা ছাড়বার আগেই খবর পেয়েছিলাম, আমার ভ্রাতুষ্পুত্র লে. আশফাকুস সামাদ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছে ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে। তার আগে আমাদের পাড়ার
বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক নিহত হয়েছে। শেখরনগরের আশপাশে আজিজুল হক সাহেবের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে যাবার সময় গোলাগুলিতে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাতুল্য জিল্লুর ভাইয়ের শিশুপুত্র নিহত হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। অনেকেই যাচ্ছিলেন লঞ্চে করে। এরকম একটা লঞ্চ ডুবে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবরও শুনি। আর বিষাদ একেবারে গ্রাস করে ফেলে আমাদের যখন খবর পাই যে, অগ্রজতুল্য সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, এমএ মান্নান ও নিজামুদ্দিন আহমেদ, বন্ধু সাংবাদিক নাজমুল হক ও অনুজতুল্য সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে পাকিস্তানিদের সাহায্যপুষ্ট আলবদররা। ভাগ্যক্রমে বন্ধু এনায়েতুল্লাহ খান ও আমি তাদের থাবা থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলাম। তবে আমাদের কষ্ট বাড়তেই থাকল, যখন আরও খবর পেলাম যে আমার শ্রদ্ধাভাজন অনেক শিক্ষক এবং গুণী চিকিত্সকদেরও হত্যা করেছে তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিসি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান এবং সাংবাদিক শহীদ সাবের তো নিহত হন ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণেই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার পর দিনগুলোতে যতটা না আনন্দিত হয়েছি, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে ততটাই কষ্ট পেয়েছি একের পর এক প্রাণ বিসর্জনের শোকসংবাদ পেয়ে। মোট কথা, বিজয় দিবস ও তার পরের দিনগুলো ছিল হর্ষ ও বিষাদ মেশানো।
আর সে জন্যই তখন দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম ও যেসব চিন্তা এসেছিল, তা এখনও আমার মতো অনেকের কাছেই আজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবাই মিলে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে দেশটাকে সচল করব, সেটা তো ছিল প্রথম চিন্তা ও ইচ্ছা। তারপরই যে আকাঙ্ক্ষা মনে বাসা বেঁধেছিল তা ছিল এই যে, এদেশে সব মানুষ সত্ হবে, দেশটা চলবে ন্যায়-নীতির ওপর, দেশের রাজনীতির ভিত্তি হবে গণতন্ত্র ও বহুমতের সহাবস্থান। যা আছে দেশে, সবই অর্থাত্ দেশের যে সম্পদ তা সবার বেঁচে থাকার ও মঙ্গলের জন্য কাজে লাগানো হবে। বাংলাদেশ অচিরেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে, এদেশের সব নাগরিক একে অপরকে ভালোবাসবে এবং কেউ কারও জন্য অশান্তি সৃষ্টি করবে না। শহীদদের পবিত্র স্মৃতি বুকে ধরে রাখবে সবাই সর্বকাল এবং বহু প্রাণ ও অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা চির-ভাস্বর থাকবে। আমরা হব একটি সুন্দর, গর্বিত, স্বাধীন দেশের নাগরিক।
এসবের অনেক কিছুই এখন অনুপস্থিত। দেশে ধনবৈষম্য একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তবু লোভী লুটেরারা তাদের হীন লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। দুর্নীতি গ্রাস করেছে সারাদেশ। সঙ্গে এসে জুড়ে বসেছে গুম-খুন। মাঝে মাঝে মনে হয় সন্ত্রাসীরা যেন স্বরাজ পেয়েছে এই বাংলাদেশে। ন্যায়-নীতি ও ন্যায়বিচার এখন খুঁজতে হয় শুধু স্বপ্নে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি আর যে-ই মানুন, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেগুলোকে অবজ্ঞাই করছেন। শাসকদের আত্মম্ভরিতা সীমাহীন। চল্লিশ বছর আগে যেসব স্বপ্ন দেখেছিলাম, বর্তমানের রূঢ় বাস্তব সেগুলোর বিপরীত। তবে এও ঠিক যে, একদিনে এই দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নাই। দেশটা ঠিক পথে চলতে না পারার দায় অনেককেই ভাগ করে নিতে হবে। যদিও তারা মনে করতে পারেন আমাদের এই খেদোক্তি ব্যর্থদের নিষম্ফল আস্ফাালন। তবু আমরা আশা ছাড়ব না। আমরা সুদিনের স্বপ্নের কথা শুনিয়েই যাব।
ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের বঙ্গভাষী দোসররা নয়া পল্টনে আমাদের ছেড়ে আসা বাসায় আমার খোঁজে হানা দিয়েছিল ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে। আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আতিকুস সামাদকেও খুঁজছিল পাকিস্তানিরা। বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষী পাড়া-পড়শির মুখে সেইসব খবর পেয়ে আমরা ঢাকা ছেড়েছি সঙ্গে সঙ্গেই। এই শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে বা নৌকা দিয়ে সরু একটা খাল ধরে ধলেশ্বরী তীরে পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁরা বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকের থাকার মতো জায়গা ছিল না। তাঁরা চেয়েছেন ঢাকা থেকে প্রাণ নিয়ে বের হতে। তারপর যে কোনো মুক্ত অঞ্চলে পৌঁছে ‘যেখানে রাত সেখানে কাত’ হয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে। সবারই বিশ্বাস, কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকায় নিজ গৃহে ফেরত আসা যাবে। কারণ, হানাদার পাকিস্তানিরা যে শিগগিরই পরাজিত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ঢাকা ত্যাগ করার তাগিদ ছিল প্রথমত কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানি ও পাকিস্তানপ্রেমী আততায়ীদের লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছিলেন অনেকে। আর দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সেনারা তাদের রাজাকার-আলবদর-আলশামস স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে নিয়ে যদি ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাহলে যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হবে তাতে অনেক বেসামরিক লোকও নিহত হবে। সপরিবারে আমি, আমার ভাই, বিখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হক সাহেবের কন্যা সায়েমা হক ও পুত্র আনিসুল হক (যিনি বর্তমানে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশিষ্ট আইনজীবীতে পরিণত হয়েছেন) এবং আমাদের বন্ধু আজিজুল হক একসঙ্গে চলছিলাম। আমরা যখন ধলেশ্বরী নদীতে নৌকায় উঠছি, তখনও পেছন থেকে কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। তবে ঠিক কোথায় কামানযুদ্ধ, তা নিরূপণ করতে পারিনি। কামানের আওয়াজ বন্ধ হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ পরে। আমাদের গন্তব্য আজিজুল হকের গ্রামের বাড়ি, শেখরনগর।
আমরা শেখরনগর পৌঁছবার পরও যুদ্ধ হতে দেখেছি। পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের তাড়া করে একদল মুক্তিযোদ্ধা শেখরনগরের ওই মাঠ পার হয়ে ছুটছেন, তা দেখেছি। নৃশংস পাকিস্তানিরা পালাবার সময়ও ঘরবাড়িতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করছিল। আবার কাছেই এক নদীতে একটি লঞ্চ লক্ষ্য করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে রকেট নিক্ষেপ করতে দেখেছি। ফলে, যুদ্ধ কখন শেষ হবে সে জন্য ব্যক্তিগত গভীর উত্কণ্ঠা ছিল। ওদিকে ঢাকায় মা-বোন-ভগ্নিপতি-ভাগিনা-ভাগিনীদের এবং পাকিস্তানি জেলখানায় আমার সম্বন্ধী ডা. আনোয়ারুল হককে ছেড়ে এসেছি। তাদের জন্য উদ্বেগ ছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং শত্রুমুক্ত হয়েছে—এমন আকাঙ্ক্ষা তো ছিলই। নিজেরা বাঁচি কী মরি তার চেয়ে বড় কথা, একমাত্র কথা তখন ছিল যে দেশ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হতেই হবে। তাই পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের সংবাদ শোনার জন্য অধীর অপেক্ষা। অবশেষে সেই পরম সুসংবাদটা শুনলাম। আনন্দে আত্মহারা হলাম। নিঃশ্বাস নিলাম বুকভরে। তারপর মাটির সঙ্গে বুক মিশিয়ে দেশমাতৃকার স্নেহধন্য হলাম।
তবে আমাদের সেই আনন্দ সারা বুক ভরে থাকতে পারে নাই বেশিক্ষণ। দুঃখজনক হলেও অনেক শোকের খবর অপেক্ষা করছিল। ঢাকা ছাড়বার আগেই খবর পেয়েছিলাম, আমার ভ্রাতুষ্পুত্র লে. আশফাকুস সামাদ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছে ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে। তার আগে আমাদের পাড়ার
বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক নিহত হয়েছে। শেখরনগরের আশপাশে আজিজুল হক সাহেবের পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে যাবার সময় গোলাগুলিতে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাতুল্য জিল্লুর ভাইয়ের শিশুপুত্র নিহত হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। অনেকেই যাচ্ছিলেন লঞ্চে করে। এরকম একটা লঞ্চ ডুবে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবরও শুনি। আর বিষাদ একেবারে গ্রাস করে ফেলে আমাদের যখন খবর পাই যে, অগ্রজতুল্য সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, এমএ মান্নান ও নিজামুদ্দিন আহমেদ, বন্ধু সাংবাদিক নাজমুল হক ও অনুজতুল্য সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে পাকিস্তানিদের সাহায্যপুষ্ট আলবদররা। ভাগ্যক্রমে বন্ধু এনায়েতুল্লাহ খান ও আমি তাদের থাবা থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলাম। তবে আমাদের কষ্ট বাড়তেই থাকল, যখন আরও খবর পেলাম যে আমার শ্রদ্ধাভাজন অনেক শিক্ষক এবং গুণী চিকিত্সকদেরও হত্যা করেছে তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিসি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান এবং সাংবাদিক শহীদ সাবের তো নিহত হন ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণেই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার পর দিনগুলোতে যতটা না আনন্দিত হয়েছি, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে ততটাই কষ্ট পেয়েছি একের পর এক প্রাণ বিসর্জনের শোকসংবাদ পেয়ে। মোট কথা, বিজয় দিবস ও তার পরের দিনগুলো ছিল হর্ষ ও বিষাদ মেশানো।
আর সে জন্যই তখন দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম ও যেসব চিন্তা এসেছিল, তা এখনও আমার মতো অনেকের কাছেই আজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবাই মিলে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে দেশটাকে সচল করব, সেটা তো ছিল প্রথম চিন্তা ও ইচ্ছা। তারপরই যে আকাঙ্ক্ষা মনে বাসা বেঁধেছিল তা ছিল এই যে, এদেশে সব মানুষ সত্ হবে, দেশটা চলবে ন্যায়-নীতির ওপর, দেশের রাজনীতির ভিত্তি হবে গণতন্ত্র ও বহুমতের সহাবস্থান। যা আছে দেশে, সবই অর্থাত্ দেশের যে সম্পদ তা সবার বেঁচে থাকার ও মঙ্গলের জন্য কাজে লাগানো হবে। বাংলাদেশ অচিরেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে, এদেশের সব নাগরিক একে অপরকে ভালোবাসবে এবং কেউ কারও জন্য অশান্তি সৃষ্টি করবে না। শহীদদের পবিত্র স্মৃতি বুকে ধরে রাখবে সবাই সর্বকাল এবং বহু প্রাণ ও অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা চির-ভাস্বর থাকবে। আমরা হব একটি সুন্দর, গর্বিত, স্বাধীন দেশের নাগরিক।
এসবের অনেক কিছুই এখন অনুপস্থিত। দেশে ধনবৈষম্য একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তবু লোভী লুটেরারা তাদের হীন লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। দুর্নীতি গ্রাস করেছে সারাদেশ। সঙ্গে এসে জুড়ে বসেছে গুম-খুন। মাঝে মাঝে মনে হয় সন্ত্রাসীরা যেন স্বরাজ পেয়েছে এই বাংলাদেশে। ন্যায়-নীতি ও ন্যায়বিচার এখন খুঁজতে হয় শুধু স্বপ্নে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতি আর যে-ই মানুন, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেগুলোকে অবজ্ঞাই করছেন। শাসকদের আত্মম্ভরিতা সীমাহীন। চল্লিশ বছর আগে যেসব স্বপ্ন দেখেছিলাম, বর্তমানের রূঢ় বাস্তব সেগুলোর বিপরীত। তবে এও ঠিক যে, একদিনে এই দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নাই। দেশটা ঠিক পথে চলতে না পারার দায় অনেককেই ভাগ করে নিতে হবে। যদিও তারা মনে করতে পারেন আমাদের এই খেদোক্তি ব্যর্থদের নিষম্ফল আস্ফাালন। তবু আমরা আশা ছাড়ব না। আমরা সুদিনের স্বপ্নের কথা শুনিয়েই যাব।
সুত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন