তুতুলের কী যে ইচ্ছে করে, তুতুল সে কথা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে না। কাউকে সে বলতেও পারে না। কিন্তু মনের মধ্যে সারাক্ষণ অনেক সুন্দর ইচ্ছে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে ওর মনটাকে কেমন উতাল করে তোলে। চঞ্চল মন হাওয়ায় ভেসে ঘুরে ফেরে সারা গ্রাম। বিকালে মিষ্টি রোদ গড়িয়ে পড়ে মাঠ-ঘাট-প্রান্তরে। ফুরফুরে বাতাসে তালে তালে নড়েচড়ে গাছের পাতা। তুতুল ঘর ছেড়ে দৌড়ে যায় খোলা মাঠে। মাঠের পশ্চিমে সারি সারি দেবদারু গাছ। গাছের লম্বা ছায়া তুলির আঁচড়ের মতো দেখায় সবুজ মাঠের বুকে। তুতুলের চোখে বড় মায়াবী হয়ে ওঠে সেই ছায়া। উজ্জ্বল অথচ নরম সেই আলো-ছায়ার মধ্যে পাখির ডানার মতো দু’হাত প্রসারিত করে ডানে-বাঁয়ে হেলে তুতুল দৌড়াতে থাকে আপন মনে।
দেখতে দেখতে দূর গাঁয়ের সবুজ বেষ্টনীর আড়ালে চলে যায় সূর্য। মিষ্টি আবীর ছড়িয়ে পড়ে বন-বীথিকার মাথায় মাথায়। চোখের সামনে ম্লান হয়ে যায় দেবদারুর ছায়া। পাখিরা ফিরে আসে আপন নীড়ে। ডালে ডালে পাতার অন্ধকারে পাখিদের কল-কাকলিতে মুখর হয় চারপাশ। তুতুলের মন হারিয়ে যায় অজানা স্বপ্নের দেশে।
তুতুল ভাবে, আমি যদি পাখি হতে পারতাম! তা হলে ডানা মেলে উড়ে যেতাম মন যেখানে যেতে চাইতো। সীমাহীন আকাশে ঘুরতাম দল বেঁধে। কেউ মানা করতো না। বাধাও দিতো না কেউ। চলে যেতাম এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে। যেমন দূর দেশ থেকে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কতো পাখিরা আসে এই দেশে। ওদের কোনো যানবাহনের প্রয়োজন হয় না। দেশের সীমানা ডিঙ্গাতে পাসপোর্টেরও দরকার পড়ে না। আমিও মনের সুখে উড়ে উড়ে ক্লান্ত ডানায় দূরের কোনো গাছের ডালে বিশ্রাম নিতাম। ঘুমিয়ে পড়তাম ঘন পাতায় ছাওয়া মগডালে। পাখিরা পরিবেশ এবং মানুষের কতো না উপকার করে।
কখনো ভাবে, দুরন্ত বাতাস হয়ে সবুজ ফসল ভরা মাঠের উপর দিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে পাহাড়, বন, নদী-নালা আর গাঁয়ের ছোট ছোট ঘরবাড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হারিয়ে যাই দূরে-বহুদূরে। অসীম শূন্যে ঘুরে ঘুরে আবার ফিরে আসি এই সবুজ বাংলায়। রবি ঠাকুরের মনেও কি এমন সাধ জেগেছিলো? কবিই তো বলেছেন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’।
তুতুল কখনো এমনও ভাবে যে, আমি যদি একটা গাছ হতে পারতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো। আম গাছ, কাঁঠাল গাছ অথবা বিশাল একটা বট বৃক্ষ। গাছ কি শুধুই দাঁড়িয়ে থাকে? না, গাছের তো অনেক কাজ। শিকড় দ্বারা মাটি থেকে রস টেনে পৌঁছে দিতে হয় কাণ্ডে, ডালে, পাতায়, ফুলে ও ফলে। ছোট ছোট ডালপালা যেনো তার শত শত হাত। পাতাগুলো যেনো তার হাজার হাজার আঙুল। মিষ্টি রোদ মেখে ওরা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবার ঝিরঝির হাওয়ায় খুশিতে কেমন লুকোচুরি খেলায় মাতে। সূর্যের আলো থেকে সংগ্রহ করে খাদ্য। কতো পাখি গাছের ডালে নেচে নেচে গান গায়। দিবসে ক্লান্ত ডানায় বিশ্রাম নেয়, রাতে ঘুম যায় পাতার ফাঁকে। আবার গাছের ডালেই বাসা বেঁধে বংশ বিস্তার করে। গাছ ফুল ফোটায়, ফুল থেকে ফল হয়। মানুষ এবং পশু-পাখিরা সেই ফল খেয়ে তৃপ্ত হয়। ক্লান্ত পথিক একটু জিরিয়ে নেয় গাছের ছায়ায়। গাঁয়ের ছেলে-মেয়েরা সারাদিন কত খেলা খেলে গাছতলায়। গরমের সময় গাঁয়ের কতো মানুষ গাছতলায় বসে ফুরফুরে বাতাসে গা জুড়ায়। তার চেয়েও বড় কথা, গাছ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন তৈরি করে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে সেই অক্সিজেন টেনে বুক ভরি। আর ছেড়ে দিই কার্বন ডাই-অক্সাইড। যা গাছপালা-তরুলতা জীবন বাঁচাতে গ্রহণ করে থাকে।
তুতুলের ভাবনা এখানেই শেষ নয়। সে আরো অনেক কিছু হতে চায়। নদী হয়ে গাছ-পালা ঘেরা হাজার গাঁয়ের কোল ঘেঁষে কুল কুল রবে বয়ে যেতে চায়। ওর যা যা ভালো লাগে সেসব আরো বেশি বেশি জানার জন্য তুতুল ক্লাসের বই ছাড়াও লাইব্রেরি থেকে পছন্দের বই এনে পড়ে। ও ভাবে, আমাদের এই দেশটা কতো সুন্দর। প্রতিটি ধূলিকণা, গাছপালা, বন, নদী-নালা সবখানেই যেনো মায়ার পরশ মাখা। এদেশের দিনটাও সুন্দর, রাতটাও সুন্দর। আকাশটা যেনো আবার ফুলে সাজানো বিশাল একটা সামিয়ানা। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকে মিষ্টি আলো। অনেক রাতে তুতুলের ঘুম ভেঙে গেলেও জানালা পথে চেয়ে থাকে বাইরে। নিশাচর পাখির ডাক শুনতে ভালো লাগে ওর। তখন কোনো ডোবা বা জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ডাহুকের ডাক।
দেখতে দেখতে আরেকটু বড় হয় তুতুল। প্রাইমারি ছেড়ে পা রাখে হাই স্কুলে। শিক্ষকদের মুখে শুনতে পায় কতো অজানা কথা। একদিন ক্লাসে শিক্ষক বললেন, তোমরা বড় হয়ে কে কী হতে চাও, তা নিয়ে একটা রচনা লেখো।
ক্লাসের সব ছেলে-মেয়েই লিখলো। কেউ লিখলো আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো। কেউ লিখলো আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো। তুতুল কী লিখবে? ওর মনে তো অন্য কথা, অন্য ভাবনা। শেষে ও লিখলো, আমি গাছ হতে চাই, আমি নদী হতে চাই...। কিন্তু কেমন করে হবো, তা আমি জানি না।
শিক্ষক তুতুলের খাতা দেখে একটু অবাক হলেন। তবে তখনই তুতুলকে কিছু বললেন না। সবার খাতা দেখার পর শিক্ষক তুতুলের দিকে তাকালেন। এর মধ্যেই তুতুল অন্যান্য ছেলেমেয়ের ইচ্ছার কথা জেনে ওর মনটা কেমন যেনো হয়ে গেলো। ও ভাবলো, তাই তো, বড় হয়ে মানুষ পাইলট, শিক্ষক, সাংবাদিক আরো কতো কিছু হতে চায়। কিন্তু আমার কেনো গাছ হতে ইচ্ছে করে! বাতাস হতে ইচ্ছে করে, নদী হতে ইচ্ছে করে!
শিক্ষক তুতুলকে বললেন, তুতুল, তোমার গাছ হতে ইচ্ছে করে কেনো? শিক্ষকের প্রশ্ন শুনে তুতুল একটু চমকে উঠলো। তথাপি শিক্ষকের মিষ্টি ব্যবহারে তুতুলের ভয়-ভাবনা অনেকটা কেটে গেছে তখন। তবু সে ভয়ে ভয়েই বলতে চেষ্টা করলো কেনো সে গাছ, পাখি, বাতাস আর নদী হতে চায়।
শিক্ষক বললেন, তুমি যা যা হতে চাও তার সবই ভালো। তবে একটা মানুষ কি কখনো একটা গাছ অথবা একটা নদী হতে পারে? পারে না। গাছ অনাদর-অবহেলায় বড় হয়। বড় হওয়ার পর গাছটি নিঃস্বার্থভাবে মানুষ আর পশু-পাখিদের কত না উপকার করে চলে। গাছটি একদিন মারা যায়। মরা গাছটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যক্ষও মানুষের উপকারে আসে। তেমনি পাখি, নদী ও বাতাসও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা মানুষরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চাই না। আমরা কোনো একটি গাছ লাগাতে চাই না। লাগালেও সেটাকে যত্ন করি না। পাখিরা আমাদের কতো উপকার করে। অথচ আমরা প্রতিদিনই কেউ না কেউ পাখি শিকার করছি। প্রকৃতির এই সুন্দর পাখিদের খাঁচায় বন্দি করে রাখছি। ওদের জীবনের কথা না ভেবে কতো কষ্ট দিচ্ছি। আবার নদীর কথা বলতে গেলে কতো কথা বলতে হয়। নদী কেমন বিশ্রামহীন বয়ে চলেছে। দু-কূলের মানুষ, মাঠ-ঘাট, গাছপালা নদী থেকে কতো উপকৃত হচ্ছে। নদীতে জন্মে কতো ধরনের মাছ। অথচ সেই নদীর কথা কেউ ভাবি না। নদী ভরাট করে রুদ্ধ করছি তার স্রোত। নদীর পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত করছি পানি। অথচ সবাই জানি, ‘পানির আরেক নাম জীবন’। তেমনি কল-কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাতাস হচ্ছে দূষিত। কেউ ভাবি না যে, এই দূষিত বাতাসে আমাদের শরীরের কতো ক্ষতি হচ্ছে। নির্মল বাতাস ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না।
শিক্ষকের কথা শুনে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা তো একেবারে চুপ। এসব কথা ওরা যে এর আগে কিছু কিছু শোনেনি তা কিন্তু নয়। তবে এমন সুন্দর করে কেউ ওদের বলেনি। শুধু তাই নয়, ওরা এ কথাও ভাবতে লাগলো যে, তবে কি আমাদের ইচ্ছার চেয়ে তুতুলের এমন উদ্ভট ইচ্ছাটাই বড়ো হলো? কী জানি! কিন্তু মানুষ তো কখনো গাছ, নদী, বাতাস অথবা পাখি হতে পারে না।
শিক্ষক তুতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন—তুতুল, তোমার ইচ্ছাগুলো অতি উত্তম। গাছ, পাখি, নদী ও বাতাস এরা সবাই সৃষ্টি থেকে এই পৃথিবীর কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। হয়তো তোমার মনও সেরূপ এই বাংলার মানুষকে, সমাজকে এবং প্রকৃতিকে সুন্দর করে দেখতে চায়। তুমিও দেশ ও মানুষের কল্যাণে কিছু করতে চাও। এসব ভাবনা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু তুমি কিছুই বুঝতে পারছো না।
আমি আশা করছি, তুমি বড় হয়ে দেশ, মানুষ এবং প্রকৃতির কল্যাণে তোমার জীবনটাকে উত্সর্গ করবে। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
দেখতে দেখতে দূর গাঁয়ের সবুজ বেষ্টনীর আড়ালে চলে যায় সূর্য। মিষ্টি আবীর ছড়িয়ে পড়ে বন-বীথিকার মাথায় মাথায়। চোখের সামনে ম্লান হয়ে যায় দেবদারুর ছায়া। পাখিরা ফিরে আসে আপন নীড়ে। ডালে ডালে পাতার অন্ধকারে পাখিদের কল-কাকলিতে মুখর হয় চারপাশ। তুতুলের মন হারিয়ে যায় অজানা স্বপ্নের দেশে।
তুতুল ভাবে, আমি যদি পাখি হতে পারতাম! তা হলে ডানা মেলে উড়ে যেতাম মন যেখানে যেতে চাইতো। সীমাহীন আকাশে ঘুরতাম দল বেঁধে। কেউ মানা করতো না। বাধাও দিতো না কেউ। চলে যেতাম এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে। যেমন দূর দেশ থেকে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কতো পাখিরা আসে এই দেশে। ওদের কোনো যানবাহনের প্রয়োজন হয় না। দেশের সীমানা ডিঙ্গাতে পাসপোর্টেরও দরকার পড়ে না। আমিও মনের সুখে উড়ে উড়ে ক্লান্ত ডানায় দূরের কোনো গাছের ডালে বিশ্রাম নিতাম। ঘুমিয়ে পড়তাম ঘন পাতায় ছাওয়া মগডালে। পাখিরা পরিবেশ এবং মানুষের কতো না উপকার করে।
কখনো ভাবে, দুরন্ত বাতাস হয়ে সবুজ ফসল ভরা মাঠের উপর দিয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে পাহাড়, বন, নদী-নালা আর গাঁয়ের ছোট ছোট ঘরবাড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হারিয়ে যাই দূরে-বহুদূরে। অসীম শূন্যে ঘুরে ঘুরে আবার ফিরে আসি এই সবুজ বাংলায়। রবি ঠাকুরের মনেও কি এমন সাধ জেগেছিলো? কবিই তো বলেছেন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’।
তুতুল কখনো এমনও ভাবে যে, আমি যদি একটা গাছ হতে পারতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো। আম গাছ, কাঁঠাল গাছ অথবা বিশাল একটা বট বৃক্ষ। গাছ কি শুধুই দাঁড়িয়ে থাকে? না, গাছের তো অনেক কাজ। শিকড় দ্বারা মাটি থেকে রস টেনে পৌঁছে দিতে হয় কাণ্ডে, ডালে, পাতায়, ফুলে ও ফলে। ছোট ছোট ডালপালা যেনো তার শত শত হাত। পাতাগুলো যেনো তার হাজার হাজার আঙুল। মিষ্টি রোদ মেখে ওরা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবার ঝিরঝির হাওয়ায় খুশিতে কেমন লুকোচুরি খেলায় মাতে। সূর্যের আলো থেকে সংগ্রহ করে খাদ্য। কতো পাখি গাছের ডালে নেচে নেচে গান গায়। দিবসে ক্লান্ত ডানায় বিশ্রাম নেয়, রাতে ঘুম যায় পাতার ফাঁকে। আবার গাছের ডালেই বাসা বেঁধে বংশ বিস্তার করে। গাছ ফুল ফোটায়, ফুল থেকে ফল হয়। মানুষ এবং পশু-পাখিরা সেই ফল খেয়ে তৃপ্ত হয়। ক্লান্ত পথিক একটু জিরিয়ে নেয় গাছের ছায়ায়। গাঁয়ের ছেলে-মেয়েরা সারাদিন কত খেলা খেলে গাছতলায়। গরমের সময় গাঁয়ের কতো মানুষ গাছতলায় বসে ফুরফুরে বাতাসে গা জুড়ায়। তার চেয়েও বড় কথা, গাছ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন তৈরি করে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে সেই অক্সিজেন টেনে বুক ভরি। আর ছেড়ে দিই কার্বন ডাই-অক্সাইড। যা গাছপালা-তরুলতা জীবন বাঁচাতে গ্রহণ করে থাকে।
তুতুলের ভাবনা এখানেই শেষ নয়। সে আরো অনেক কিছু হতে চায়। নদী হয়ে গাছ-পালা ঘেরা হাজার গাঁয়ের কোল ঘেঁষে কুল কুল রবে বয়ে যেতে চায়। ওর যা যা ভালো লাগে সেসব আরো বেশি বেশি জানার জন্য তুতুল ক্লাসের বই ছাড়াও লাইব্রেরি থেকে পছন্দের বই এনে পড়ে। ও ভাবে, আমাদের এই দেশটা কতো সুন্দর। প্রতিটি ধূলিকণা, গাছপালা, বন, নদী-নালা সবখানেই যেনো মায়ার পরশ মাখা। এদেশের দিনটাও সুন্দর, রাতটাও সুন্দর। আকাশটা যেনো আবার ফুলে সাজানো বিশাল একটা সামিয়ানা। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকে মিষ্টি আলো। অনেক রাতে তুতুলের ঘুম ভেঙে গেলেও জানালা পথে চেয়ে থাকে বাইরে। নিশাচর পাখির ডাক শুনতে ভালো লাগে ওর। তখন কোনো ডোবা বা জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ডাহুকের ডাক।
দেখতে দেখতে আরেকটু বড় হয় তুতুল। প্রাইমারি ছেড়ে পা রাখে হাই স্কুলে। শিক্ষকদের মুখে শুনতে পায় কতো অজানা কথা। একদিন ক্লাসে শিক্ষক বললেন, তোমরা বড় হয়ে কে কী হতে চাও, তা নিয়ে একটা রচনা লেখো।
ক্লাসের সব ছেলে-মেয়েই লিখলো। কেউ লিখলো আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো। কেউ লিখলো আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো। তুতুল কী লিখবে? ওর মনে তো অন্য কথা, অন্য ভাবনা। শেষে ও লিখলো, আমি গাছ হতে চাই, আমি নদী হতে চাই...। কিন্তু কেমন করে হবো, তা আমি জানি না।
শিক্ষক তুতুলের খাতা দেখে একটু অবাক হলেন। তবে তখনই তুতুলকে কিছু বললেন না। সবার খাতা দেখার পর শিক্ষক তুতুলের দিকে তাকালেন। এর মধ্যেই তুতুল অন্যান্য ছেলেমেয়ের ইচ্ছার কথা জেনে ওর মনটা কেমন যেনো হয়ে গেলো। ও ভাবলো, তাই তো, বড় হয়ে মানুষ পাইলট, শিক্ষক, সাংবাদিক আরো কতো কিছু হতে চায়। কিন্তু আমার কেনো গাছ হতে ইচ্ছে করে! বাতাস হতে ইচ্ছে করে, নদী হতে ইচ্ছে করে!
শিক্ষক তুতুলকে বললেন, তুতুল, তোমার গাছ হতে ইচ্ছে করে কেনো? শিক্ষকের প্রশ্ন শুনে তুতুল একটু চমকে উঠলো। তথাপি শিক্ষকের মিষ্টি ব্যবহারে তুতুলের ভয়-ভাবনা অনেকটা কেটে গেছে তখন। তবু সে ভয়ে ভয়েই বলতে চেষ্টা করলো কেনো সে গাছ, পাখি, বাতাস আর নদী হতে চায়।
শিক্ষক বললেন, তুমি যা যা হতে চাও তার সবই ভালো। তবে একটা মানুষ কি কখনো একটা গাছ অথবা একটা নদী হতে পারে? পারে না। গাছ অনাদর-অবহেলায় বড় হয়। বড় হওয়ার পর গাছটি নিঃস্বার্থভাবে মানুষ আর পশু-পাখিদের কত না উপকার করে চলে। গাছটি একদিন মারা যায়। মরা গাছটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যক্ষও মানুষের উপকারে আসে। তেমনি পাখি, নদী ও বাতাসও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা মানুষরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চাই না। আমরা কোনো একটি গাছ লাগাতে চাই না। লাগালেও সেটাকে যত্ন করি না। পাখিরা আমাদের কতো উপকার করে। অথচ আমরা প্রতিদিনই কেউ না কেউ পাখি শিকার করছি। প্রকৃতির এই সুন্দর পাখিদের খাঁচায় বন্দি করে রাখছি। ওদের জীবনের কথা না ভেবে কতো কষ্ট দিচ্ছি। আবার নদীর কথা বলতে গেলে কতো কথা বলতে হয়। নদী কেমন বিশ্রামহীন বয়ে চলেছে। দু-কূলের মানুষ, মাঠ-ঘাট, গাছপালা নদী থেকে কতো উপকৃত হচ্ছে। নদীতে জন্মে কতো ধরনের মাছ। অথচ সেই নদীর কথা কেউ ভাবি না। নদী ভরাট করে রুদ্ধ করছি তার স্রোত। নদীর পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত করছি পানি। অথচ সবাই জানি, ‘পানির আরেক নাম জীবন’। তেমনি কল-কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাতাস হচ্ছে দূষিত। কেউ ভাবি না যে, এই দূষিত বাতাসে আমাদের শরীরের কতো ক্ষতি হচ্ছে। নির্মল বাতাস ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না।
শিক্ষকের কথা শুনে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা তো একেবারে চুপ। এসব কথা ওরা যে এর আগে কিছু কিছু শোনেনি তা কিন্তু নয়। তবে এমন সুন্দর করে কেউ ওদের বলেনি। শুধু তাই নয়, ওরা এ কথাও ভাবতে লাগলো যে, তবে কি আমাদের ইচ্ছার চেয়ে তুতুলের এমন উদ্ভট ইচ্ছাটাই বড়ো হলো? কী জানি! কিন্তু মানুষ তো কখনো গাছ, নদী, বাতাস অথবা পাখি হতে পারে না।
শিক্ষক তুতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন—তুতুল, তোমার ইচ্ছাগুলো অতি উত্তম। গাছ, পাখি, নদী ও বাতাস এরা সবাই সৃষ্টি থেকে এই পৃথিবীর কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। হয়তো তোমার মনও সেরূপ এই বাংলার মানুষকে, সমাজকে এবং প্রকৃতিকে সুন্দর করে দেখতে চায়। তুমিও দেশ ও মানুষের কল্যাণে কিছু করতে চাও। এসব ভাবনা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু তুমি কিছুই বুঝতে পারছো না।
আমি আশা করছি, তুমি বড় হয়ে দেশ, মানুষ এবং প্রকৃতির কল্যাণে তোমার জীবনটাকে উত্সর্গ করবে। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন