আমার মা আমাকে মাঝেমধ্যে ‘পশুরাজ’ বলে ডাকে। আর যখন আমি গাল ফুলিয়ে বলি, ‘আমার কত সুন্দর নাম—রজিন, আর তুমি কিনা আমায় পশুরাজ বলো!’ অবশ্য এটা হলো আমার ছলনা। ‘পশুরাজ’ শুনতে কিন্তু আমার খারাপ লাগে না। সেই এতটুকু বয়স থেকেই আমি কুকুর-বিড়াল ভালোবাসি। একটা কুকুর বা দুটি বিড়াল পোষার শখ অনেক দিন থেকে, কিন্তু সে শখ পূরণ হচ্ছে না। সব সময় মা-বাবার কাছে আবদার, একটা বিড়াল পুষব। আমাদের কম্পিউটারে অনেক বিড়ালের ছবি আছে। কী সুন্দর সে সব বিড়াল—সাদা, কালো, সোনালি; আর কী মায়াবী!
তারপর একদিন হলো কী, জানো? আমি দুটি তুলতুলে-গুলগুলে বিড়ালছানা পেলাম। কিন্তু কীভাবে? আমার বাবা শিক্ষক তো, তাঁর অনেক ছাত্র। সেদিন এক ছাত্রী বাবাকে বলছিল, তাদের বিড়ালের দুটি বাচ্চা হয়েছে। আর আমিও সেখানে ছিলাম। শুরু করলাম ঘ্যানর ঘ্যানর। বিড়ালছানা চাই। তারপর কান্নাকাটি। ফলে কান্নার বিনিময়ে আমিও পেলাম পরদিন ওই দুটি তুলার মতো তুলতুলে বিড়ালছানা; তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
এ দুটি পেয়ে আমার খুশি আর দেখে কে? আমি তাদের কোলে নিই, চুমো দিই, আরও কত কী! তাদের মুখের সামনে ভাত, মাছের কাঁটা দিই। হায়! তারা কিছুই খায় না। বাবা কলেজ থেকে ফিরে এদের দেখে বিচলিত হন; বলেন, এরা তো এখনো মায়ের দুধ ছাড়েনি। আমি বলি, ‘তো কী, আমি ওদের গুঁড়া দুধ খাওয়াব, আদর করব।’
তার পর থেকে চলল আমার বিরতিহীন সেবাযত্ন—তাদের দুধ খাওয়ানো, কাপড়ে জড়িয়ে রাখা, বাইরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দেখো, এত কিছু করছি, তবু তাদের কান্না বন্ধ করতে পারছি কই! একটু মিউ মিউ থামে তো আবার করে, আর এখানে-সেখানে কী যেন খুঁজে ফেরে। মনে হয় যেন ওদের মাকে খুঁজছে। কিন্তু এ বিষয়গুলো আমি কোনো গুরুত্ব দিলাম না। মনে করলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওহ! এর মধ্যে আমার ভাইয়া বাচ্চা দুটির বেশ চমৎকার ও আধুনিক নাম দিয়েছে—ছেলেটি হলো রক এবং মেয়েটি জোলি। কী সুন্দর না? রক ও জোলিকে আদর-ভালোবাসা দিতে দিতে কেটে গেল তিনটি দিন। কিন্তু তাদের ভালোবাসা পেলাম না। তারা সারাক্ষণ মিউ মিউ করে আর তাদের সেই মাকে খুঁজে ফেরে। ওদের এত ভালো খাবার দিচ্ছিলাম, কিন্তু তাতেও তাদের শরীর ভালো হচ্ছিল না।
আমার মা-বাবা বোঝালেন, ‘ও দুটো খুব ছোট। ওদের ফেরত দিয়ে দিই, ওরা ফিরে যাক ওদের মায়ের কাছে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! কান্নাকাটি, ‘দিব না, দিব না’। আরও একটা দিন গেল। আজ মা নানুর বাসায় যাবেন। ওখানে দুই দিন থাকবেন। আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন। কিন্তু আমি তো যাব না রক আর জোলিকে ছেড়ে। মা একটু পর বের হলেন। আমি মেতে রইলাম বিড়াল, টিভি, গেমস নিয়ে। দিন গড়িয়ে এল রাত। মন কেমন করতে লাগল, বুকের পাশটাতে কেমন একটু ব্যথা মায়ের জন্য। বাবা, ভাইয়া, আপু—সবাই আছে। কিন্তু আমার আর ভালো লাগছিল না। মাকে ছাড়া এই প্রথম রাত আমার। চোখ ভেঙে কান্না আসতে চাইছে, কিন্তু লজ্জায় কাঁদতে পারছি না।
ওদিকে রক ও জোলি সমানে তার স্বরে কেঁদে চলেছে এবং আজই প্রথম আমি ওদের কান্নার একটি অর্থ খুঁজে পেলাম। তারাও ওদের মায়ের জন্য কাঁদছে, বুঝতে পারলাম। আমার মা এবং ওদের জন্য সহানুভূতি আমাকে দুর্বল করল। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কান্না বেরিয়ে এল।
সবাই তো আমার এই হঠাৎ কান্না দেখে হতবাক। আমাকে এটা-ওটা বলে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কান্না যেন থামেই না। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, ‘কাল সকালেই রক আর জোলিকে দিয়ে আসব ওদের মায়ের কাছে।’ ওদের দেওয়া হলো। আমার মন খুব খারাপ, কিন্তু খুব আনন্দ হচ্ছে যে ওদের মায়ের কাছে দিতে পেরেছি।
একটু পর মা বাসায় এলেন। আমি তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মা আমাকে আদর করলেন। আমি অনুভব করলাম, কাল রাতের সেই বুকের পাশের ব্যথাটা আর নেই। তোমরাই বলো, পৃথিবীতে মায়ের থেকে আপন, প্রিয় কেউ কি হয়? আর আমি কিনা ‘পশুরাজ’ হয়েও রক আর জোলিকে ওদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা করেছিলাম।
তারপর একদিন হলো কী, জানো? আমি দুটি তুলতুলে-গুলগুলে বিড়ালছানা পেলাম। কিন্তু কীভাবে? আমার বাবা শিক্ষক তো, তাঁর অনেক ছাত্র। সেদিন এক ছাত্রী বাবাকে বলছিল, তাদের বিড়ালের দুটি বাচ্চা হয়েছে। আর আমিও সেখানে ছিলাম। শুরু করলাম ঘ্যানর ঘ্যানর। বিড়ালছানা চাই। তারপর কান্নাকাটি। ফলে কান্নার বিনিময়ে আমিও পেলাম পরদিন ওই দুটি তুলার মতো তুলতুলে বিড়ালছানা; তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে।
এ দুটি পেয়ে আমার খুশি আর দেখে কে? আমি তাদের কোলে নিই, চুমো দিই, আরও কত কী! তাদের মুখের সামনে ভাত, মাছের কাঁটা দিই। হায়! তারা কিছুই খায় না। বাবা কলেজ থেকে ফিরে এদের দেখে বিচলিত হন; বলেন, এরা তো এখনো মায়ের দুধ ছাড়েনি। আমি বলি, ‘তো কী, আমি ওদের গুঁড়া দুধ খাওয়াব, আদর করব।’
তার পর থেকে চলল আমার বিরতিহীন সেবাযত্ন—তাদের দুধ খাওয়ানো, কাপড়ে জড়িয়ে রাখা, বাইরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দেখো, এত কিছু করছি, তবু তাদের কান্না বন্ধ করতে পারছি কই! একটু মিউ মিউ থামে তো আবার করে, আর এখানে-সেখানে কী যেন খুঁজে ফেরে। মনে হয় যেন ওদের মাকে খুঁজছে। কিন্তু এ বিষয়গুলো আমি কোনো গুরুত্ব দিলাম না। মনে করলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওহ! এর মধ্যে আমার ভাইয়া বাচ্চা দুটির বেশ চমৎকার ও আধুনিক নাম দিয়েছে—ছেলেটি হলো রক এবং মেয়েটি জোলি। কী সুন্দর না? রক ও জোলিকে আদর-ভালোবাসা দিতে দিতে কেটে গেল তিনটি দিন। কিন্তু তাদের ভালোবাসা পেলাম না। তারা সারাক্ষণ মিউ মিউ করে আর তাদের সেই মাকে খুঁজে ফেরে। ওদের এত ভালো খাবার দিচ্ছিলাম, কিন্তু তাতেও তাদের শরীর ভালো হচ্ছিল না।
আমার মা-বাবা বোঝালেন, ‘ও দুটো খুব ছোট। ওদের ফেরত দিয়ে দিই, ওরা ফিরে যাক ওদের মায়ের কাছে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! কান্নাকাটি, ‘দিব না, দিব না’। আরও একটা দিন গেল। আজ মা নানুর বাসায় যাবেন। ওখানে দুই দিন থাকবেন। আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন। কিন্তু আমি তো যাব না রক আর জোলিকে ছেড়ে। মা একটু পর বের হলেন। আমি মেতে রইলাম বিড়াল, টিভি, গেমস নিয়ে। দিন গড়িয়ে এল রাত। মন কেমন করতে লাগল, বুকের পাশটাতে কেমন একটু ব্যথা মায়ের জন্য। বাবা, ভাইয়া, আপু—সবাই আছে। কিন্তু আমার আর ভালো লাগছিল না। মাকে ছাড়া এই প্রথম রাত আমার। চোখ ভেঙে কান্না আসতে চাইছে, কিন্তু লজ্জায় কাঁদতে পারছি না।
ওদিকে রক ও জোলি সমানে তার স্বরে কেঁদে চলেছে এবং আজই প্রথম আমি ওদের কান্নার একটি অর্থ খুঁজে পেলাম। তারাও ওদের মায়ের জন্য কাঁদছে, বুঝতে পারলাম। আমার মা এবং ওদের জন্য সহানুভূতি আমাকে দুর্বল করল। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কান্না বেরিয়ে এল।
সবাই তো আমার এই হঠাৎ কান্না দেখে হতবাক। আমাকে এটা-ওটা বলে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কান্না যেন থামেই না। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, ‘কাল সকালেই রক আর জোলিকে দিয়ে আসব ওদের মায়ের কাছে।’ ওদের দেওয়া হলো। আমার মন খুব খারাপ, কিন্তু খুব আনন্দ হচ্ছে যে ওদের মায়ের কাছে দিতে পেরেছি।
একটু পর মা বাসায় এলেন। আমি তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মা আমাকে আদর করলেন। আমি অনুভব করলাম, কাল রাতের সেই বুকের পাশের ব্যথাটা আর নেই। তোমরাই বলো, পৃথিবীতে মায়ের থেকে আপন, প্রিয় কেউ কি হয়? আর আমি কিনা ‘পশুরাজ’ হয়েও রক আর জোলিকে ওদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা করেছিলাম।
সূত্র : প্রথম আলো
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন