বিএ পাস করে সেই কবে থেকে ঘরে বসে আছি। চাকরির নামগন্ধ নেই অথচ বাবার রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। কাল মাঝরাত অবধি মদে চুর হয়েছিলাম, সঙ্গে ছিল জাহিদ, আনিস, সঞ্জীব, শিলাব্রতসহ আরও দু-একজন, যাদের আমি চিনি না। চার পেগের পর জাহিদ হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল ওর চলে যাওয়া প্রেমিকার জন্য, যদিও কাঁদার কিছুই ছিল না। কেননা, মেয়েরা এমনি করেই চলে যায়, ছেলেরাও যায়। তারপর আবার আরেকজনের সঙ্গে প্রেম শুরু হয়—প্রেম মানে পার্ক, সিনেমা, নদীর পাড়, লুকিয়ে বন্ধুর বাড়িতে, বাইরে থেকে শেকল দেওয়া ঘরে লদকা-লদকি। এর বাইরে প্রেম বলে কিছু আছে কিনা, জানি না। আনিস বিরহকাতর ওই প্রেমিকের জন্য একটা গান গেয়েছিল—হালকা ধরনের, তবে আন্তরিকতা ছিল, ‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি, তুমি আমার সাধনা...’। তখন পাশের বাড়ি থেকে গান ভেসে আসছিল, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি ডার্লিং তেরে লিয়ে...’ মুন্নির বদনাম কেন হলো জিজ্ঞেস করায় সঞ্জীব আমাকে বলেছিল, একটা গুন্ডার সঙ্গে প্রেম হয়েছিল বলে সবাই ছি ছি করেছিল। শিলাব্রত বুঁদ হয়ে বসেছিল, তারপর উঠে বাড়ি চলে যায়। ভাতটাত খেয়ে প্রি-স্লিপ নকটারনাল অ্যাক্রোবেটিকসে মত্ত হবে, মদ খেলে নাকি ওই ক্রীড়ায় খুব মজা হয়, ঘুমও হয় ভালো...মদ খাওয়ার পয়সা নেই আমার, সময় কাটানোর জন্য মাঝেমধ্যে ওদের আড্ডায় গেলে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্লাসটা এগিয়ে দেয়, তখন মানা করা যায় না। মদ খেয়ে রূপকথার স্বপ্নালোকবাসী হতে পারি না আমি, আমার নিজস্ব স্বপ্ন, ব্যথা, স্মৃতি, অভিমান, সংস্কার, আচ্ছন্নতা কিছুই কাটিয়ে উঠতে পারি না; বাড়ি ফিরতে ফিরতে মধ্যরাত গড়িয়ে যায়, টেবিলে ঢাকা দেওয়া ভাত-ডাল, বেগুন দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল গলাধঃকরণ করতে গিয়ে তীব্র নেশা হওয়ার আন্দাজ পাই। তখন পৃথিবীর সবকিছু চোখের সামনে বনবন করে ঘুরতে থাকে। চৌকিটাতে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। মনে হয় আমি একা। কেউ নেই আমার। দক্ষিণের জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো ঘরে আসে। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার ঘুম আসে না। একটা বই তুলে নিই, যদি পড়তে পড়তে ঘুম আসে—Her favourite line of English prose is a masterpiece : ‘Fuck my pussy, fuck face, till I faint’. when I fart in the bath tab. She kneels naked on the tile floor, leans all the way over, and kisses the bubbles. She sits on my cock while I shit... ছাপানো লাইনগুলো একটা আরেকটার ওপর দিয়ে দৌড়াতে থাকে, কোনো পর্নোগ্রাফি কিংবা ইরোটিকা? হাত থেকে বিছানার ওপর পড়ে যাওয়া বইটা চোখের সামনে মেলে ধরি Portnoy’s complaint, Philip Roth. পর্নোগ্রাফি বা ইরোটিকা কখনো সংগ্রহে রাখি না আমি; কিন্তু ঘুম কেন আসছে না? অথচ ঘুম পাড়িয়ে দিতে কোহলের জুড়ি নেই। কটা বাজে এখন? ঘড়ি নেই আমার। মোবাইল ফোন নেই। চাঁদের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে জানালার ওপারে, ভোর হয়ে আসছে মনে হয়। শরীরে ক্লান্তি ভীষণ। রিকশা না পেয়ে মাইল দুয়েক পথ হেঁটেছি বাড়ি ফিরতে। সন্ধ্যায় টিউশনি করতে গিয়েছিলাম, সেও হেঁটে; আজ পকেটে পয়সাও ছিল না। বাকিতে এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছি; আজ জেগেই কাটল সারারাত, চৈতীর কথা মনে পড়ছিল শুধু, কোনো লাভ নেই, ক্রমাগত প্রেমিক বদল করে চলেছে—প্রথমে আমি, তারপর লিপো, তারপর কমল। আর এখন একজন ইঞ্জিনিয়ার—একেই বিয়ে করবে, সব ঠিকঠাক, ইলোপ করবে লোকটা...আমাদের এই ছোট্ট স্বর্ণকমলপুরের ছেলেমেয়েরা ভীষণ স্মার্ট আজকাল। শরীরটা ভেঙেচুরে ঘুম এসেছিল ভোরে, কিন্তু প্রায় অচেনা এক বাদ্যযন্ত্রের সুরে ঘুমটা গাঢ় হতে পারল না। একটা না-ঘুম না-জাগরণের ভেতর নিয়ে গেল। অনেক দূর থেকে কানে ভেসে এল: মন দোলে...মন দোলে...মন দোলে...এমনি একটা সুরধ্বনি, বীণ বাজছিল দূরে কোথাও। মুখ দিয়ে বাজাতে হয় পেটমোটা একটা ছোট্ট বাঁশি-জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। সাপখেলা দেখানোর সময় সাপুড়েরা সাধারণত বাজায়। যন্ত্রটার আর কোনো নাম আছে কি? অভিধানে বীণার প্রতিশব্দ হিসেবে বীণ কথাটা আছে দেখলাম। বীণ আর বীণায় তো আকাশ-পাথাল তফাৎ; জগ থেকে এক গ্লাস পানি গড়িয়ে খেলাম। গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ। ভাঙা টেবিলটার ওপর বইটই জমে একাকার, একটা গোল আয়না পাওয়া গেল ওখানে—তাকিয়ে দেখি, দুই চোখের কোণে পিচুটি জমে শক্ত হয়ে আছে। খামচে তুলে আনি আঙুল দিয়ে; টিউবটাতে একটুও পেস্ট নেই, ফেনা করে দাঁত না মাজলে দিনটাই মাটি হবে। পেস্ট কেনার জন্য বাবার কাছে টাকা চাইতে হবে, ধুর...বীণের সুর এখন খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এই কাকডাকা ভোরে কে বীণ বাজায়? একটা বাল্যস্মৃতি নেমে আসে, সুরের কি স্মৃতি হয়—হয় বোধ করি। খোঁপাটিতে দোপাটি সাজাও এ রকম একটা গান আছে না? গানটা শুনলে আমার রেবাদির কথা মনে পড়ে—২০ বছর আগে প্রেমিকের বাচ্চা পেটে নিয়ে সুইসাইড করেন; সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনলেই প্রথম আমার সুমিত্রা রায়ের কথা মনে পড়ে—স্কুলে পড়ত আমার সঙ্গে, স্বাধীনতার দুই বছরের মাথায় ওপার বাংলায় চলে যায়, অথচ মন দোলে, মন দোলে, মন দোলে ক্রমাগত আমাকে হাতছানি দিচ্ছে, এমন দুর্লভ কোনো বাদ্য নয় মোৎসার্ট, বেটোভেন, ভিভালদি কিংবা আমাদের ওই ভি. ভালসারা হলেও কথা ছিল, তবে এ শহরে হামেশাই বীণ বাজে না; বাইরে বেরিয়ে আসি আমি। মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা দিয়ে টুংটাং রিকশা চলতে শুরু করেছে। দোকানপাটের ঝাপ উঠছে, ভোরের বাতাস ভালো লাগে আমার। কত দিন আমি সকাল দেখি না, শুধু পড়ে পড়ে ঘুমাই, সারা রাত জেগে থাকি যে; আর ওই যে মোটা মোটা খামে করে এখানে-ওখানে যে দরখাস্তগুলো পাঠাই। ওগুলোর জবাব খুব একটা আসে না। বাবা অবশ্য বলেন, পাঠাতে থাক, একটা না একটা হয়ে যাবে, হাল ছাড়বি না কখনো। একবার-দুবার ডাক পড়েছিল; তবে রিফিউজাল অনিবার্য হয়ে উঠেছিল—অনার্স নেই, বিবিএ-এমবিএ নেই, শুধুই বিএ। এসব ভাবলে ঘুম আসে না। তার পরও সকাল হলে মা ডাকাডাকি করেন নাশতা খাওয়ার জন্য। শুয়েই থাকি, অনেক বেলায় উঠে বাইরে চলে যাই। রেস্তোরাঁয় গিয়ে আড্ডা দিই। কখনো আলুর দম-রুটি কিংবা থাপড়ানো পরোটা আর রসগোল্লার শিরা দিয়ে নাশতা খাই। কোনো দিন কিছুই খাই না, শুধু চা আর সিগারেটের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিই...বীণের আওয়াজ এত কাছ থেকে শুনতে পাই যে, কোথায় বাজছে শনাক্ত করে ফেলি—মাঠটার দিকে এগিয়ে যাই; কিন্তু কেন জানি না। মনে হয় সুরটা ডাকছে আমাকে, পায়ের নিচে ভিজে দূর্বাঘাস আর লতাপাতায় পানি জমেছে, বৃষ্টি হয়েছিল কি রাতে? টের পাইনি কেন? জেগেই তো ছিলাম। স্পঞ্জের স্যান্ডেল ভিজে যাচ্ছে। পায়ের পাতার ঠান্ডা স্পর্শ ছড়িয়ে পড়ছে সারা গায়ে। একটু পরে সূর্য উঠলে কিছুই থাকবে না। হাঁটতে হাঁটতে মাঠটায় চলে আসি—একপাশের গোলবার ভেঙে কাত হয়ে আছে, খেলাধুলা খুব একটা হয় না আজকাল। বিকেলে বাচ্চা ছেলেরা জটলা পাকিয়ে হল্লা করে, বলটল জোগাড় হলে এলোমেলো ফুটবল খেলে। আমাদের সময় ফুটবল ম্যাচ হতো এখানে, শহরের পাড়াগুলোর টিম অংশ নিত—রীতিমতো কাপ-শিল্ড দেওয়া হতো, তবে মারামারি লেগে যেত মাঝেমধ্যে। স্থায়ী হতো না বেশি। মিটমাট হয়ে যেত অল্প কদিনের মধ্যে। ছোট্ট এক চিলতে শহর সবাই সবাইকে চেনে; ওই মাঠটার এক কোনায় বড় একটা জটলা দেখে এগিয়ে যাই—বীণের শব্দ ওখান থেকেই আসছে, সাপের খেলা দেখানো হচ্ছে। এই বিরাট সাপটা আসামের এক জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয়েছে—এ রকম গালগল্প মেরে সাপের খেলা দেখায় এরা। তারপর লোহার তাবিজের ভেতর জংলি গাছের শেকড় ভরে বিক্রি করে। ওই তাবিজ যার কাছে থাকবে, সাপ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না; কিন্তু এখন তো সকাল সাতটাও বাজেনি, এমন একটা অব টাইমে এরা মজমা জমাল কেন? লোকজনও খুব একটা নেই। বাবড়ি চুলঅলা দুজন লোক হাঁটু গেড়ে বসে শরীর বাঁকিয়ে বীণ বাজাচ্ছে। দুই গাল ফুলে ফুলে উঠছে তাদের, বীণ বাজানো সহজ কাজ নয়। স্ট্রাগল ফর অ্যাক্সিসট্যান্স। এই আমি যেমন বছর খানেক ধরে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাচ্ছি ক্রমাগত, একটা চাকরি পাওয়ার আশায়। সকাল-সন্ধ্যা টিউশনি করে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছি সংসারে খরচ করার জন্য; মাথাটা ভারী হয়ে আছে, চোখ দুটো মুদে আসছে, মুখে কাল রাতের বাসি মদের টক টক গন্ধ—কোথায় যেন পড়েছিলাম জীবনে নেশা আর যৌনতার ব্যাপারটা আসে বেঁচে থাকার পর—রুগ্ণ, শীর্ণ, অপুষ্ট মানুষকে আগে বাঁচতে হবে। কেননা বাঁচাই এখন মূল সমস্যা। মূল সমস্যা থেকে চোখ সরিয়ে রাখা শুধু অপরাধই নয়, দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। মানুষ কী করে বাঁচবে? এই মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই ভাবব না আমি, অথচ দুটো পিলে চমকানো ফণা-তোলা গোখরার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, বিশাল দুটো সাপ বীণের সুরে সুরে নাচছে, লকলকে জিভ বের করছে থেকে থেকে, ভয়ে গা সিটিয়ে আসে। ঘেন্না করি এই ভয়ংকর প্রাণীটাকে। ভাবনাটা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা পাই; সেদিন ছোট বোনটার বিয়ে হলো। তার জেনুইন প্রেমিকটি যৌতুক হিসেবে খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণালঙ্কার সবই নিয়ে ছাড়ল। বাবা গ্রামের বেশ কয়েক বিঘা ধানি জমি বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আমি বেকার, বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়েছে। আমাদের বড় সংসার। এসব আমার বোনের প্রেমিকটি একবারও বিবেচনায় আনল না? সে কি সত্যিই ভালোবাসে আমার বোনকে? বোনটাই বা কেমন, কিছুই বলল না তার প্রেমিককে? ভালোবাসা কি তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল, না তার মধ্যে ভালোবাসার কোনো অস্তিত্বই নেই। ফণা নামিয়ে একটা সাপ দ্রুত এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার পা থেকে হাত দেড়েক দূরে আবার ফণা তোলে, ঘাড় বাঁকিয়ে এই বুঝি ছোবল মারবে, একটা ঠান্ডা ভয় শির শির করে আমার মাথায় চড়ে বসে। একলাফে দূরে সরে যাই, সাপুড়েদের একজন দাঁত কেলিয়ে হাসে—‘ডরাইয়েন না স্যার, কামুড় দিব না।’ কিন্তু ভয়টা মনের ভেতর এমনভাবে বাসা বেঁধেছে যে সাপুড়ের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না। সারা শরীর ভয়ে কাঁপছে। ভাবলাম, এখানে আর নয়, পেছনে ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম। পেছন থেকে লোকজন হো হো করে হাসছিল। বলাবলি করছিল, ‘জওয়ান মর্দ মানুষ, কিন্তু কেমুন ভীতুর আন্ডা দ্যাখেন। হা হা হা...।’ তখনো বীণের শব্দ কানে আসছিল আমার। মন দোলে...মন দোলে...মন দোলে...অবিরাম সুর লহরি। তখন রোদ উঠেছে তাতিয়ে, মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তায় উঠে থমকে দাঁড়াই। হাঁপাতে থাকি ক্রমাগত। এখন কোথায় যাব আমি? কোনো বন্ধুর বাড়িতে কি? নাকি কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে আড্ডার ধান্দা করব? তখনই আমার মনে হলো—মানুষ মাত্রই তার নিজের স্নায়ু, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘাম, যন্ত্রণা আর নিজের বৃত্তের মেয়ে মানুষ নিয়ে সদা ব্যস্ত ও বিব্রত। ফলে তারা যে কখন একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিজেরাও জানে না। এখন বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভালো। নাশতা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে আমাকে না পেয়ে মা খুব দুশ্চিন্তা করবেন।
সূত্র : প্রথম আলো
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন