দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত সাহিত্যিকদের নাম গোপন রাখার রীতিটি খুব সতর্কতার সঙ্গে বজায় রেখে চলেছে সুইডিশ একাডেমী। ঘোষণার আগে বিজয়ীর নাম জানার তেমন উপায় নেই, শুধু অনুমান করা ছাড়া। সাহিত্যপ্রেমীদের অনুমান কখনো কখনো মিলে গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে অখ্যাত কারো মাথায় উঠে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারের মুকুটটি। ১৮ সদস্যের কমিটির আনুষ্ঠানিক ভোটের শেষে যে নামটি চূড়ান্তভাবে উঠে আসে, তা সব সময় সাহিত্যরসিকদের মনঃপূত না হলেও অনেক লেখককে নতুন করে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তে দীর্ঘ তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই শেষে পাঁচজনের হ্রস্ব তালিকায় স্থান পাওয়া সাহিত্যিকদের সাহিত্যকৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ চলছে বিজয়ীর নামটি বেছে নেওয়ার জন্য। গত বছর সিরিয়ার কবি আদোনিস (অলি আহমাদ সা'য়িদ), আমেরিকার ফিলিপ রথ ও জয়েস ক্যারোল ওটস, দক্ষিণ কোরিয়ার কো উন এবং আলজেরিয়ার আসিয়া জেবার তালিকার শীর্ষে থেকেও পুরস্কার পাননি। পেয়েছেন পেরুর মারিও বার্গাস য়োসা, যদিও তাঁর লেখনীক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। এ বছরও উলি্লখিত লেখকরাই আলোচনায়। কিন্তু এই তালিকায় আরো অনেকের নাম আছে, যাঁরা স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। আবার এমন অনেককে নিয়ে হৈচৈ চলছে, যাঁদের কেউ এই সম্মান পেয়ে গেলে তা খানিকটা আশ্চর্যজনক হবে বৈকি। হয়তো ভাগ্যদেবী এতক্ষণে কার গলায় স্বপ্নমাল্য পরিধান করা হবে তা নির্ধারণ করে ফেলেছেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির সবচেয়ে সম্মানজনক গ্যেটে পুরস্কার পেয়ে যাওয়ার পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, এ মাসে নোবেল পুরস্কারের সম্মাননাও আদোনিসই (অলি আহমাদ সা'য়িদ) পাবেন। ৮১ বছর বয়সী সিরিয়ার এই কবিকে আরববিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিরিয়ায় জন্মালেও দীর্ঘ সময় লেবাননে অভিবাসীজীবন কাটিয়েছেন তিনি। দামেস্ক, ফ্রান্স ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি কবিতা বিষয়ে পাঠদানকারী আদোনিসের নাম প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, প্রগতি ও আধুনিকতার সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যার আরবি প্রতিশব্দ 'হাদাথা'। একসময় মাহমুদ দারবিশ এই পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ করেছে। আদোনিস আরবি সাহিত্যের জন্য এই সম্মাননা বয়ে আনতে পারেন। কিন্তু তাঁর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন আরেক অশীতিপর কবি সুইডেনের টমাস ট্রান্সট্রুমার। গত বছর তাঁর নাম খুব জোরেশোরে শোনা গেলেও শেষমেশ তাঁর কপালে শিকে ছেঁড়েনি। জানি না ভাগ্যদেবী এঁদের জন্য এতক্ষণে বরমাল্য প্রস্তুত করেছেন কি না। তবে এ বছর তাঁর ভক্তরা সম্ভাবনার দিক দিয়ে তাঁকেই এগিয়ে রাখেন। ১৯৯০ সালে স্ট্রোকের পর শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে এবং কথা জড়িয়ে গেলেও তাঁর লেখনী থামেনি, এখনো লিখে চলেছেন। প্রকাশবাদী ও পরাবাস্তববাদী ধারায় কবিতা চর্চাকারী ট্রান্সট্রুমার একজন পিয়ানোবাদক ও মনস্তত্ত্ববিদ। আলফ্রেড নোবেলের স্বদেশির প্রতি কমিটির সদস্যরা কতখানি সদয় হবেন, তা এতক্ষণে পাঠক হয়তো জেনে গেছেন। আমেরিকার ফিলিপ রথ ও জয়েস ক্যারোল ওটসের নাম ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তার সঙ্গে অনেকে জুড়ে দিয়েছেন টমাস পিঞ্চনের নাম। ৭৮ বছর বয়সী ফিলিপ রথের নামের পাশে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ও পুলিৎজার পুরস্কারের সম্মাননা রয়েছে। আর ৭৩ বছর বয়সী ওটস ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন; এবং তিনি অতিপ্রজ লেখিকা। ৫৬টি উপন্যাস, ৩২টি ছোটগল্পের সংকলন, ৮টি কাব্যগ্রন্থসহ আরো অনেক প্রকাশনা রয়েছে তাঁর। আর পিঞ্চন পুলিৎজারের জন্য মনোনীত হয়েও পুরস্কার পাননি। কারণ জুরিদের কেউ কেউ তাঁর উপন্যাসটিকে অশ্লীল মনে করেছেন। প্রধানত কবি, তবে উপন্যাস, ট্রাভেলগ ও আত্মজীবনী মিলিয়ে ১৪০টির মতো বইয়ের লেখক দক্ষিণ কোরিয়ার কো উন অনেক দিন ধরেই বিশ্বের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক। তাঁর হাত ধরে এশিয়ায় আবার নোবেল ফিরে আসতে পারে। আলজেরিয়ার সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার আসিয়া জেবার (ফাতিমা জোহরা ইমালাইন) তাঁর সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল জিতে নিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
অস্ট্রেলিয়ার লেস মারে এবং জাপানের ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির নাম অনেকের মুখে। মুরাকামি মৌলিক রচনার সঙ্গে খ্যাতি কুড়িয়েছেন অনুবাদক হিসেবে। আমেরিকার উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব রচনায় আমেরিকার সামাজিক বৈশিষ্ট্য আমদানি করেছেন বলে সমালোচকরা মন্তব্য করেছেন। তাঁর সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়া যাচ্ছে না। বাদ যাচ্ছে না পাঁচবারের বুকার বিজয়ী আরেক জাপানি কাজুও ইশিগুরোর নামও। হাঙ্গেরির পিটার নাদাসের সঙ্গে নেপালের কবি রাজেন্দ্র ভাণ্ডারি, ভারতের কবি কে সচ্চিদানন্দন ভারতের আরেক লেখক বিজয়ধন দত্তে বিজ্জি এবং রোমানিয়ার মার্সিয়া কার্তারেস্কুর নাম এসেছে। শেষোক্ত নাম চারটি বিস্ময় সৃষ্টি করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা জমা পড়ার বিষয়টি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে দুই বছর আগেই হাঙ্গেরির হার্তা মুল্যার জিতে নিয়েছেন এই পুরস্কার। এক বছরের ব্যবধানে সেই দেশেরই কোনো লেখকের ভাগ্যে এই পুরস্কারের সম্মাননা জুটবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, যদিও মার্শেল প্রুস্তের সঙ্গে তুলনীয় নাদাসের সম্ভাবনা কম নয়। আর অনেক পুরস্কারের সঙ্গে তাঁর ঝুলিতেও রয়েছে ২০০৩ সালে প্রাপ্ত ফ্রাঞ্জ কাফকা পুরস্কার।
এ বছর মে মাসে ফ্রাঞ্জ কাফকা পুরস্কার জয়ের পর আইরিশ লেখক জন ব্যানভিল সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের একজন হিসেবে বিবেচিত। ফোনে এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর পেঁৗছানোর সময় তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, 'একটু ধরুন, অন্য ফোনটাও বাজছে, সম্ভবত এটা স্টকহোম থেকে এসেছে।' কিন্তু তাঁর সম্ভাবনা ২৫ ভাগের এক ভাগ বলে মনে করছেন ভাষ্যকাররা। যুক্তরাজ্যের সাহিত্যিক এ এস বায়াতের সম্ভাবনা আয়ান ম্যাকইয়ান ও সালমান রুশদীর ওপর। বুকার অব দ্য বুকারস বিজয়ী রুশদী কি পারবেন ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার জিততে? করম্যাক ম্যাকার্থি ও ডন ডেলিলোর সম্ভাবনার কথাও কেউ কেউ বলছেন। বব ডিলানকে নিয়ে তাঁর ভক্তকুল যে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করছেন, তা নিয়ে কেউ কেউ বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি। অ্যালেঙ্ ডোনোহিউ তো বলেই ফেলেছেন, বব এই পুরস্কার পেলে তা হবে অত্যন্ত বেদনার বিষয়।
পর পর দুই বছর লাতিন আমেরিকায় এই পুরস্কার যাবে কি না, সেই সন্দেহ থেকেই মেঙ্েিকার লেখক-কূটনীতিক কার্লোস ফুয়েন্তেসের সম্ভাবনাকে কেউ কেউ শূন্যের কোঠায় বলে ধরে নিয়েছেন। 'স্বৈরতন্ত্রের স্বাভাবিক শত্রু হলেন লেখক'_এই বিশ্বাস থেকে যিনি সাহিত্য রচনা করেন, ৩০টি ভাষায় যাঁর লেখনী অনূদিত হয়ে বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশে সমাদৃত, বুকার বিজয়ী আলবেনিয়ার সেই লেখক ইসমাইল কাদেরের সম্ভাবনাকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কানাডার নারীবাদী লেখিকা ও সমাজকর্মী ৭১ বছর বয়সী মার্গারেট অ্যাটউড রয়েছেন অনেকের পছন্দের তালিকায়। তাঁর লেখনীর অতিপ্রজতা ও বহুমাত্রিকতা তাঁকে নোবেলের জোরালো দাবিদাররূপে দাঁড় করিয়েছে। সোমালিয়ার নূরুদ্দীন ফারাহকেও বাতিল করা যাচ্ছে না। আগেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। কী হবে কেনিয়ার ৭২ বছর বয়সী নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো কিংবা নাইজেরিয়ার ৮১ বছর বয়সী লেখক চিনুয়া আচেবের ক্ষেত্রে? ওলে সোয়িংকার পর আবার কি নাইজেরিয়ার কোনো লেখক এই বিরল সম্মাননার অধিকারী হবেন? এখনো ম্যানবুকার, পুলিৎজার, কাফকা বা গ্যেটে পুরস্কারের মতো নামি পুরস্কার কপালে না জুটলেও মরক্কোর সফল উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যিক তাহের বিন জেলুন এই সম্মাননা পেয়ে গেলে আফ্রিকার জন্য তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই।
আমেরিকার ৮৫ বছর বয়সী লেখক রবার্ট ব্লাইয়ের কথাও কেউ কেউ জোরেশোরে বলছেন একই দেশের নারীবাদী লেখিকা অ্যাড্রিয়েন রিচের সঙ্গে। কবি, শিক্ষাবিদ, সমকামী, রাজনৈতিক কর্মী_এমন অজস্র পরিচয়ে পরিচিত এই নারীর নোবেল জয়ের ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী। ইসরায়েলের লেখক অ্যামোজ ওজ যদি এ বছর পুরস্কারটি জিতে নেন, তাহলে তা অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা হবে না। স্পষ্টবাদী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ৭২ বছর বয়সী এই মানুষটির পক্ষেও সমর্থন রয়েছে অনেকের। মনস্তত্ত্বে স্নাতক পর্তুগিজ লেখক অ্যান্তোনিও লোবো অ্যান্তুনাসকে নিয়ে প্রত্যাশা রয়েছে অনেকের। এই তো সেদিন ওরহান পামুক নোবেল পেলেন। এত দ্রুত কি তা আবার তুরস্কে যাবে? তাই যত ভালো লেখকই হন না কেন, হাসান আলী টোপাসের সম্ভাবনাকে জোরালো বলা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ৫৩ বছর নোবেল পাওয়ার জন্য খুবই কম বয়স। জার্মানির কবি দারস গ্রুবেনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ৪৯ বছর বয়সে নোবেল মেলার কথা নয়। তবে অতিপ্রজ এই কবি নোবেলের যোগ্য দাবিদার। আমেরিকায় অভিবাসী দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক চ্যাং রেই লিয়ের নাম শোনা গেলেও তাঁর ক্ষেত্রেও বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ৪৭ বছর বয়সে কি তিনি জিতে নিতে পারবেন এই পুরস্কার? সার্ব লেখক ডোবরিকা কোসিকের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনো বাধা নয়, বরং তিনিই বোধ হয় সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক। ৯০ বছর বয়সী এই লেখককে নিয়ে কেউ কেউ প্রত্যাশার জাল বুনছেন। আর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চেক প্রজাতন্ত্রের মিলন কুন্ডেরা বোধ হয় যারপরনাই হতাশ।
এ ছাড়া অনেকের নামই বিভিন্নভাবে শোনা গেছে। স্কটল্যান্ডের কবি-নাট্যকার ক্যারোল অ্যান ডাফি, আমেরিকায় অভিবাসী যুগোস্লাভ লেখক চার্লস সিমিক, ফরাসি-ইতালীয় বংশোদ্ভূত পল থোরো, মেঙ্েিকার হোমিরিও অ্যারিজিস, আমেরিকার জিম হ্যারিসন, মার্ক স্ট্র্যান্ড, পিটার মেথিসেন, উইলিয়াম টি ভলম্যান, জোয়ান ডিডিয়ন, লিডিয়া ডেভিস ও মেরি অলিভার, ফ্রান্সের রেনা কাম্যু প্রমুখ নোবেল বিজয়ী হিসেবে আলোচনায় আছেন এবং ছিলেন।
গত বছর কমিটির সম্পাদক পিটার ইংল্যান্ড মন্তব্য করেছিলেন, 'কমিটির সদস্যরা ইউরোপীয় হওয়ায় একজন ইউরোপীয় লেখক বেছে নেওয়াটা তাঁদের জন্য সহজ হয়। এটা একটা সমস্যা, কিন্তু এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।' বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরাও তা কামনা করেন। কারণ, এই সতর্কতা নিরপেক্ষ মূল্যায়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ মাসের যেকোনো বৃহস্পতিবার আমরা পেয়ে যাব ২০১১ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম। সেটা যদি হয় ৬ অক্টোবর, তাহলে এতক্ষণে আপনারা জেনে গেছেন স্বপ্নে পাওয়া সেই মানুষের সমস্ত লেখকজীবনের গল্প। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে নানা রকম জল্পনাকল্পনা।
গত সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির সবচেয়ে সম্মানজনক গ্যেটে পুরস্কার পেয়ে যাওয়ার পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, এ মাসে নোবেল পুরস্কারের সম্মাননাও আদোনিসই (অলি আহমাদ সা'য়িদ) পাবেন। ৮১ বছর বয়সী সিরিয়ার এই কবিকে আরববিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিরিয়ায় জন্মালেও দীর্ঘ সময় লেবাননে অভিবাসীজীবন কাটিয়েছেন তিনি। দামেস্ক, ফ্রান্স ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি কবিতা বিষয়ে পাঠদানকারী আদোনিসের নাম প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, প্রগতি ও আধুনিকতার সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যার আরবি প্রতিশব্দ 'হাদাথা'। একসময় মাহমুদ দারবিশ এই পুরস্কারের যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু সেই সম্ভাবনা নস্যাৎ করেছে। আদোনিস আরবি সাহিত্যের জন্য এই সম্মাননা বয়ে আনতে পারেন। কিন্তু তাঁর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন আরেক অশীতিপর কবি সুইডেনের টমাস ট্রান্সট্রুমার। গত বছর তাঁর নাম খুব জোরেশোরে শোনা গেলেও শেষমেশ তাঁর কপালে শিকে ছেঁড়েনি। জানি না ভাগ্যদেবী এঁদের জন্য এতক্ষণে বরমাল্য প্রস্তুত করেছেন কি না। তবে এ বছর তাঁর ভক্তরা সম্ভাবনার দিক দিয়ে তাঁকেই এগিয়ে রাখেন। ১৯৯০ সালে স্ট্রোকের পর শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে এবং কথা জড়িয়ে গেলেও তাঁর লেখনী থামেনি, এখনো লিখে চলেছেন। প্রকাশবাদী ও পরাবাস্তববাদী ধারায় কবিতা চর্চাকারী ট্রান্সট্রুমার একজন পিয়ানোবাদক ও মনস্তত্ত্ববিদ। আলফ্রেড নোবেলের স্বদেশির প্রতি কমিটির সদস্যরা কতখানি সদয় হবেন, তা এতক্ষণে পাঠক হয়তো জেনে গেছেন। আমেরিকার ফিলিপ রথ ও জয়েস ক্যারোল ওটসের নাম ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তার সঙ্গে অনেকে জুড়ে দিয়েছেন টমাস পিঞ্চনের নাম। ৭৮ বছর বয়সী ফিলিপ রথের নামের পাশে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ও পুলিৎজার পুরস্কারের সম্মাননা রয়েছে। আর ৭৩ বছর বয়সী ওটস ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন; এবং তিনি অতিপ্রজ লেখিকা। ৫৬টি উপন্যাস, ৩২টি ছোটগল্পের সংকলন, ৮টি কাব্যগ্রন্থসহ আরো অনেক প্রকাশনা রয়েছে তাঁর। আর পিঞ্চন পুলিৎজারের জন্য মনোনীত হয়েও পুরস্কার পাননি। কারণ জুরিদের কেউ কেউ তাঁর উপন্যাসটিকে অশ্লীল মনে করেছেন। প্রধানত কবি, তবে উপন্যাস, ট্রাভেলগ ও আত্মজীবনী মিলিয়ে ১৪০টির মতো বইয়ের লেখক দক্ষিণ কোরিয়ার কো উন অনেক দিন ধরেই বিশ্বের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক। তাঁর হাত ধরে এশিয়ায় আবার নোবেল ফিরে আসতে পারে। আলজেরিয়ার সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার আসিয়া জেবার (ফাতিমা জোহরা ইমালাইন) তাঁর সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল জিতে নিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
অস্ট্রেলিয়ার লেস মারে এবং জাপানের ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির নাম অনেকের মুখে। মুরাকামি মৌলিক রচনার সঙ্গে খ্যাতি কুড়িয়েছেন অনুবাদক হিসেবে। আমেরিকার উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব রচনায় আমেরিকার সামাজিক বৈশিষ্ট্য আমদানি করেছেন বলে সমালোচকরা মন্তব্য করেছেন। তাঁর সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়া যাচ্ছে না। বাদ যাচ্ছে না পাঁচবারের বুকার বিজয়ী আরেক জাপানি কাজুও ইশিগুরোর নামও। হাঙ্গেরির পিটার নাদাসের সঙ্গে নেপালের কবি রাজেন্দ্র ভাণ্ডারি, ভারতের কবি কে সচ্চিদানন্দন ভারতের আরেক লেখক বিজয়ধন দত্তে বিজ্জি এবং রোমানিয়ার মার্সিয়া কার্তারেস্কুর নাম এসেছে। শেষোক্ত নাম চারটি বিস্ময় সৃষ্টি করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা জমা পড়ার বিষয়টি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে দুই বছর আগেই হাঙ্গেরির হার্তা মুল্যার জিতে নিয়েছেন এই পুরস্কার। এক বছরের ব্যবধানে সেই দেশেরই কোনো লেখকের ভাগ্যে এই পুরস্কারের সম্মাননা জুটবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, যদিও মার্শেল প্রুস্তের সঙ্গে তুলনীয় নাদাসের সম্ভাবনা কম নয়। আর অনেক পুরস্কারের সঙ্গে তাঁর ঝুলিতেও রয়েছে ২০০৩ সালে প্রাপ্ত ফ্রাঞ্জ কাফকা পুরস্কার।
এ বছর মে মাসে ফ্রাঞ্জ কাফকা পুরস্কার জয়ের পর আইরিশ লেখক জন ব্যানভিল সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ীদের একজন হিসেবে বিবেচিত। ফোনে এই পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর পেঁৗছানোর সময় তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, 'একটু ধরুন, অন্য ফোনটাও বাজছে, সম্ভবত এটা স্টকহোম থেকে এসেছে।' কিন্তু তাঁর সম্ভাবনা ২৫ ভাগের এক ভাগ বলে মনে করছেন ভাষ্যকাররা। যুক্তরাজ্যের সাহিত্যিক এ এস বায়াতের সম্ভাবনা আয়ান ম্যাকইয়ান ও সালমান রুশদীর ওপর। বুকার অব দ্য বুকারস বিজয়ী রুশদী কি পারবেন ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার জিততে? করম্যাক ম্যাকার্থি ও ডন ডেলিলোর সম্ভাবনার কথাও কেউ কেউ বলছেন। বব ডিলানকে নিয়ে তাঁর ভক্তকুল যে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করছেন, তা নিয়ে কেউ কেউ বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি। অ্যালেঙ্ ডোনোহিউ তো বলেই ফেলেছেন, বব এই পুরস্কার পেলে তা হবে অত্যন্ত বেদনার বিষয়।
পর পর দুই বছর লাতিন আমেরিকায় এই পুরস্কার যাবে কি না, সেই সন্দেহ থেকেই মেঙ্েিকার লেখক-কূটনীতিক কার্লোস ফুয়েন্তেসের সম্ভাবনাকে কেউ কেউ শূন্যের কোঠায় বলে ধরে নিয়েছেন। 'স্বৈরতন্ত্রের স্বাভাবিক শত্রু হলেন লেখক'_এই বিশ্বাস থেকে যিনি সাহিত্য রচনা করেন, ৩০টি ভাষায় যাঁর লেখনী অনূদিত হয়ে বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশে সমাদৃত, বুকার বিজয়ী আলবেনিয়ার সেই লেখক ইসমাইল কাদেরের সম্ভাবনাকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কানাডার নারীবাদী লেখিকা ও সমাজকর্মী ৭১ বছর বয়সী মার্গারেট অ্যাটউড রয়েছেন অনেকের পছন্দের তালিকায়। তাঁর লেখনীর অতিপ্রজতা ও বহুমাত্রিকতা তাঁকে নোবেলের জোরালো দাবিদাররূপে দাঁড় করিয়েছে। সোমালিয়ার নূরুদ্দীন ফারাহকেও বাতিল করা যাচ্ছে না। আগেও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। কী হবে কেনিয়ার ৭২ বছর বয়সী নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো কিংবা নাইজেরিয়ার ৮১ বছর বয়সী লেখক চিনুয়া আচেবের ক্ষেত্রে? ওলে সোয়িংকার পর আবার কি নাইজেরিয়ার কোনো লেখক এই বিরল সম্মাননার অধিকারী হবেন? এখনো ম্যানবুকার, পুলিৎজার, কাফকা বা গ্যেটে পুরস্কারের মতো নামি পুরস্কার কপালে না জুটলেও মরক্কোর সফল উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যিক তাহের বিন জেলুন এই সম্মাননা পেয়ে গেলে আফ্রিকার জন্য তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই।
আমেরিকার ৮৫ বছর বয়সী লেখক রবার্ট ব্লাইয়ের কথাও কেউ কেউ জোরেশোরে বলছেন একই দেশের নারীবাদী লেখিকা অ্যাড্রিয়েন রিচের সঙ্গে। কবি, শিক্ষাবিদ, সমকামী, রাজনৈতিক কর্মী_এমন অজস্র পরিচয়ে পরিচিত এই নারীর নোবেল জয়ের ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী। ইসরায়েলের লেখক অ্যামোজ ওজ যদি এ বছর পুরস্কারটি জিতে নেন, তাহলে তা অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা হবে না। স্পষ্টবাদী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ৭২ বছর বয়সী এই মানুষটির পক্ষেও সমর্থন রয়েছে অনেকের। মনস্তত্ত্বে স্নাতক পর্তুগিজ লেখক অ্যান্তোনিও লোবো অ্যান্তুনাসকে নিয়ে প্রত্যাশা রয়েছে অনেকের। এই তো সেদিন ওরহান পামুক নোবেল পেলেন। এত দ্রুত কি তা আবার তুরস্কে যাবে? তাই যত ভালো লেখকই হন না কেন, হাসান আলী টোপাসের সম্ভাবনাকে জোরালো বলা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ৫৩ বছর নোবেল পাওয়ার জন্য খুবই কম বয়স। জার্মানির কবি দারস গ্রুবেনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ৪৯ বছর বয়সে নোবেল মেলার কথা নয়। তবে অতিপ্রজ এই কবি নোবেলের যোগ্য দাবিদার। আমেরিকায় অভিবাসী দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক চ্যাং রেই লিয়ের নাম শোনা গেলেও তাঁর ক্ষেত্রেও বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ৪৭ বছর বয়সে কি তিনি জিতে নিতে পারবেন এই পুরস্কার? সার্ব লেখক ডোবরিকা কোসিকের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনো বাধা নয়, বরং তিনিই বোধ হয় সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক। ৯০ বছর বয়সী এই লেখককে নিয়ে কেউ কেউ প্রত্যাশার জাল বুনছেন। আর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চেক প্রজাতন্ত্রের মিলন কুন্ডেরা বোধ হয় যারপরনাই হতাশ।
এ ছাড়া অনেকের নামই বিভিন্নভাবে শোনা গেছে। স্কটল্যান্ডের কবি-নাট্যকার ক্যারোল অ্যান ডাফি, আমেরিকায় অভিবাসী যুগোস্লাভ লেখক চার্লস সিমিক, ফরাসি-ইতালীয় বংশোদ্ভূত পল থোরো, মেঙ্েিকার হোমিরিও অ্যারিজিস, আমেরিকার জিম হ্যারিসন, মার্ক স্ট্র্যান্ড, পিটার মেথিসেন, উইলিয়াম টি ভলম্যান, জোয়ান ডিডিয়ন, লিডিয়া ডেভিস ও মেরি অলিভার, ফ্রান্সের রেনা কাম্যু প্রমুখ নোবেল বিজয়ী হিসেবে আলোচনায় আছেন এবং ছিলেন।
গত বছর কমিটির সম্পাদক পিটার ইংল্যান্ড মন্তব্য করেছিলেন, 'কমিটির সদস্যরা ইউরোপীয় হওয়ায় একজন ইউরোপীয় লেখক বেছে নেওয়াটা তাঁদের জন্য সহজ হয়। এটা একটা সমস্যা, কিন্তু এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।' বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরাও তা কামনা করেন। কারণ, এই সতর্কতা নিরপেক্ষ মূল্যায়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ মাসের যেকোনো বৃহস্পতিবার আমরা পেয়ে যাব ২০১১ সালের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর নাম। সেটা যদি হয় ৬ অক্টোবর, তাহলে এতক্ষণে আপনারা জেনে গেছেন স্বপ্নে পাওয়া সেই মানুষের সমস্ত লেখকজীবনের গল্প। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে নানা রকম জল্পনাকল্পনা।
সূত্র : কালের কন্ঠ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন