আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মৃত্যুদিন ৩০ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৩ সালের এই দিনে তিনি ১০টা ৪৭ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। লিখতে বসেছিলেন ‘চট্টগ্রামের অজানা কাহিনী’। লিখতে বসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাংলাদেশেই শুধু নয়, ভারত উপমহাদেশের জ্ঞানসাধকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর নাম ড. সুনীতি কুমার, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নামের সঙ্গে কৃতী গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। গবেষকরা বলেন, মৃত্যুর পরে ড. দীনেশচন্দ্রের ডান হাতের আঙুলে কালির দাগ পাওয়া গেছে। আর সাহিত্যবিশারদ লিখতে বসে মৃত্যুর নীরবতায় শয়ন করেন। তার হাতেও কালির দাগ ছিল।
আজীবন দরিদ্র ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সামান্য কেরানিগিরি করতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তত্কালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে ম্যাট্রিক পাস অবশ্য কম কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণেই আর অগ্রসর হতে পারেননি একাডেমিক শিক্ষায়। তার পরও স্বীয় সাধনার বলে, নিষ্ঠার জোরে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক মনীষীদের কাতারে তাঁর নাম স্থান পেয়েছে।
তিনি যে কাজটি করে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তা ছিল নিদারুণ কষ্টসাধ্য, এমনকি ব্যয়সাপেক্ষও। এর সঙ্গে প্রতিভা ও মেধার প্রশ্নও জড়িত ছিল, আর ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর গাঢ় ভালোবাসা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি, যাকে বলে পুঁথি, তার আবিষ্কারক। নিজ খরচে, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে পল্লীগ্রামে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করে করে অবহেলায় পড়ে থাকা পুঁথি উদ্ধার করেছেন। সেখানেই ক্ষান্ত হননি, পুঁথির হস্তলিপি পর্বে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, তার সম্পাদনা করেছেন, তার পর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় তা পাঠাতেন। সসম্মানে ছাপা হতো।
একথা ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো বিদগ্ধ পত্রিকা সম্পাদকের ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় সাহিত্যবিশারদের প্রবন্ধ ছাপা হতো।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। তাই দেখি যে, তিনি পুঁথি অনুসন্ধানে নেমে জাত-পাত মানেননি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল কবিদের পুঁথি উদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন।
মানতেই হবে, সাহিত্যবিশারদের আগে যারা পুঁথি উদ্ধারে নেমেছিলেন তারা খণ্ডিত মনোভাবে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যবিশারদ প্রথম পূর্ণাঙ্গ, আদর্শবান পুঁথির আবিষ্কারক।
এ কারণে একটি পুঁথি আবিষ্কার করে, তা সুসম্পাদনা করে, টীকাটিপ্পনীসহ সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকায় পাঠানো মাত্র ছাপা হতো। শুধু তাই নয়, উভয় সম্প্রদায়ের মনীষীদের প্রশংসা পেতেন। তাঁর লেখা পাওয়ার জন্য তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
এ কথা পরিষ্কার বলা দরকার, সাহিত্যবিশারদ কেবল পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন না, সৃজনশীল, চিন্তাশীল লেখকও ছিলেন। অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ, পরিচিত, অপরিচিত সবগুলো পত্রিকায়। তাঁর লেখা যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল। তাঁর মানস আধুনিক, অগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট। বাঙালির সেক্যুলার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি একজন পথিকৃত্।
সাহিত্যবিশারদকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ব্যোমকেশ মুস্তফী এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ এমদাদ আলী প্রমুখ।
তিনি ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মানিত সদস্য। একসময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতিও হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে ভালোবেসে একটি চাকরি দিয়েছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভালোবেসে তাঁকে প্রবেশিকা ও এফএ পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বিএ ক্লাসের বাংলা বিষয়ের পরীক্ষার খাতা দেখতেন।
সাহিত্যবিশারদ প্রায় সব পত্রিকা পড়তেন, তা সংগ্রহ করতেন, তাতে লিখতেন। তিনি পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন। সম্পাদনা করেছেন ‘নবনূর’, ‘কোহিনূর’, ‘সওগাত,’ ‘পূজারী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকা।
তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময় তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।
তিনি যখন কলেজে পড়েন, তখন নলিনী কান্ত সেন ‘আলো’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সাহিত্যবিশারদ এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এ পত্রিকায় তিনি ‘আলাওল গ্রন্থাবলীর কালনির্ণয়’ নামে একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধ পড়ে একজন বিদ্বান মন্তব্য করেন, ‘কালে এই বালক যশস্বী লেখক হইতে পারিবে।’ (আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪, পৃ. ১২৮)।
হ্যাঁ, যশস্বী হয়েছিলেন। বিদ্বত্সমাজ তাকে সাহিত্যবিশারদ উপাধি দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাগর উপাধিও পেয়েছিলেন। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর বলতে যেমন ঈশ্বরচন্দ্রকে বোঝায়, তেমনি সাহিত্যবিশারদ বলতে আবদুল করিমকেই বোঝায়। আমরা কিন্তু মাইকেল, বিদ্যাসাগর, সাহিত্যবিশারদ বলতেই ভালোবাসি।
একজন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন কলকাতা থেকে দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা তাঁর হাতে আসে। এই পত্রিকা পড়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সংগ্রহে অনুপ্রাণিত হন।
চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়ে, গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে পুঁথি পাঠ শুনে, পূর্বপুরুষের সংগৃহীত পুঁথি পাঠ করে সাহিত্যবিশারদ মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত প্রথম বই ‘রাধিকার মান ভঙ্গ’। এই বইয়ের ভূমিকা লেখেন ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেন, “শ্রী আবদুল করিম চট্টগ্রামের একটি বাঙ্গালা বিদ্যালয়ের পণ্ডিত। তাহার অবস্থা ভাল নহে। তথাপি তিনি সাহিত্যসেবায় অকাতরে পরিশ্রম করিয়া থাকেন। বাঙ্গালা সহিত্যের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহায়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন—সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন ‘জার্মান এডিটর’ এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।” (ঐ-পৃ. ১৬)
‘ইসলামাবাদ’ সাহিত্যবিশারদের একটি মৌলিক গ্রন্থ। চট্টগ্রামকেই তিনি ইসলামাবাদ বলেছেন। কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগে আউলিয়া, পীর, বুজর্গানেরা চট্টগ্রামে এসে, সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। উল্লিখিত গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন তিনি, “আমাদের এই দেশ ধর্মজগতে একটা পরম শ্লাঘ্য স্থান অধিকার করিবার দাবি করিয়া আছে। পৃথিবীর চারিটি মহাধর্ম শক্তি আসিয়া এখানে সম্মিলিত হইয়াছে। ইহা হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ—এই তিন মহাজাতিরই একটা পরম পবিত্র তীর্থরূপে পরিগণিত।... হিন্দুর হিন্দুত্ব ও মুসলমানের মুসলমানত্ব একমাত্র এই দেশেই আজও সম্পূর্ণ বজায় আছে। এক গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিয়া এক পুকুরের জল খাইয়া আমরা হিন্দু-মুসলমান দুইটি জাতি স্মরণাতীত কাল হইতেই স্ব-স্ব ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া পরম প্রীতিতে চলিয়া আসিতেছি, জাতি-ধর্ম লইয়া এ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনোদিন একটা টুঁ শব্দ পর্যন্তও হয় নাই, ইহা আমাদের চট্টগ্রামের একটা বিশিষ্ট গুণ।” (ঐ-পৃ. ২০)
তার অসাম্প্রদায়িক-উদার মানসের পরিচয় এ উদ্ধৃতিতে বিদ্যমান।
১৯৩৯ সালে সাহিত্য বিশারদ কলকাতা বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে বলেন, “সাহিত্যে জাতি-ধর্মের গণ্ডী আমি কখনও স্বীকার করি নাই, এখনও স্বীকার করি না, কিন্তু ইহার বৈচিত্র্য স্বীকার করি। সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে জাতিরই হউক, ইহা সাহিত্য পদবাচ্য হইলেই সর্বজনীন হইয়া থাকে। ...মুসলমানের সাহিত্য সর্বজনীন সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যের বিচিত্র ভঙ্গীর একদিক মাত্র। হিন্দুর সাহিত্যও তদ্রূপ একদিক। এই জন্যই আধুনিক বঙ্গের সাহিত্যিক জাগরণকে আমি ভীতির চক্ষে দেখি না, বরং প্রীতির নয়নেই নিরীক্ষণ করিয়া থাকি। কারণ অখণ্ড বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা সুগভীর এবং পরিচয় প্রাচীন।” (ঐ-পৃ. ৩৩)
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কি কেবল মধ্যযুগের পুঁথিই মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছিলেন? অবশ্য পুঁথিগুলো অজানা অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে না আনলে বাংলা সাহিত্য থাকত আধখানা চাঁদের মতো অসম্পূর্ণ। কিন্তু তিনি মূলত পুরো বাঙালি জাতির মননের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেছেন। আবিষ্কৃত উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলোতে যেহেতু ইংরেজের কূটপ্রভাব স্পর্শ করেনি, সেহেতু সেসবে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার সজীবতা, হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা।
জীবনসায়াহ্নে মানুষ হয় প্রতিক্রিয়াশীল। সাহিত্যবিশারদ হয়েছিলেন প্রগতিশীল। তাঁর সায়াহ্নকালীন অভিভাষণগুলো বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতাবিরোধী খরদীপ্ত উচ্চারণে বলিষ্ঠ। এজন্যই তিনি মনীষী, মহাপুরুষ।
সাম্প্রদায়িক চিন্তা তো অনাধুনিক চিন্তা। আর অনাধুনিক চিন্তা দিয়ে সাহিত্য বিশারদ এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষী হওয়া যায় না।
আজীবন দরিদ্র ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সামান্য কেরানিগিরি করতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তত্কালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে ম্যাট্রিক পাস অবশ্য কম কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণেই আর অগ্রসর হতে পারেননি একাডেমিক শিক্ষায়। তার পরও স্বীয় সাধনার বলে, নিষ্ঠার জোরে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক মনীষীদের কাতারে তাঁর নাম স্থান পেয়েছে।
তিনি যে কাজটি করে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তা ছিল নিদারুণ কষ্টসাধ্য, এমনকি ব্যয়সাপেক্ষও। এর সঙ্গে প্রতিভা ও মেধার প্রশ্নও জড়িত ছিল, আর ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর গাঢ় ভালোবাসা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি, যাকে বলে পুঁথি, তার আবিষ্কারক। নিজ খরচে, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে পল্লীগ্রামে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করে করে অবহেলায় পড়ে থাকা পুঁথি উদ্ধার করেছেন। সেখানেই ক্ষান্ত হননি, পুঁথির হস্তলিপি পর্বে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, তার সম্পাদনা করেছেন, তার পর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় তা পাঠাতেন। সসম্মানে ছাপা হতো।
একথা ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো বিদগ্ধ পত্রিকা সম্পাদকের ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় সাহিত্যবিশারদের প্রবন্ধ ছাপা হতো।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। তাই দেখি যে, তিনি পুঁথি অনুসন্ধানে নেমে জাত-পাত মানেননি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল কবিদের পুঁথি উদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন।
মানতেই হবে, সাহিত্যবিশারদের আগে যারা পুঁথি উদ্ধারে নেমেছিলেন তারা খণ্ডিত মনোভাবে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যবিশারদ প্রথম পূর্ণাঙ্গ, আদর্শবান পুঁথির আবিষ্কারক।
এ কারণে একটি পুঁথি আবিষ্কার করে, তা সুসম্পাদনা করে, টীকাটিপ্পনীসহ সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকায় পাঠানো মাত্র ছাপা হতো। শুধু তাই নয়, উভয় সম্প্রদায়ের মনীষীদের প্রশংসা পেতেন। তাঁর লেখা পাওয়ার জন্য তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
এ কথা পরিষ্কার বলা দরকার, সাহিত্যবিশারদ কেবল পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন না, সৃজনশীল, চিন্তাশীল লেখকও ছিলেন। অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ, পরিচিত, অপরিচিত সবগুলো পত্রিকায়। তাঁর লেখা যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল। তাঁর মানস আধুনিক, অগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট। বাঙালির সেক্যুলার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি একজন পথিকৃত্।
সাহিত্যবিশারদকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ব্যোমকেশ মুস্তফী এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ এমদাদ আলী প্রমুখ।
তিনি ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মানিত সদস্য। একসময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতিও হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে ভালোবেসে একটি চাকরি দিয়েছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভালোবেসে তাঁকে প্রবেশিকা ও এফএ পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বিএ ক্লাসের বাংলা বিষয়ের পরীক্ষার খাতা দেখতেন।
সাহিত্যবিশারদ প্রায় সব পত্রিকা পড়তেন, তা সংগ্রহ করতেন, তাতে লিখতেন। তিনি পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন। সম্পাদনা করেছেন ‘নবনূর’, ‘কোহিনূর’, ‘সওগাত,’ ‘পূজারী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকা।
তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময় তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।
তিনি যখন কলেজে পড়েন, তখন নলিনী কান্ত সেন ‘আলো’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সাহিত্যবিশারদ এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এ পত্রিকায় তিনি ‘আলাওল গ্রন্থাবলীর কালনির্ণয়’ নামে একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধ পড়ে একজন বিদ্বান মন্তব্য করেন, ‘কালে এই বালক যশস্বী লেখক হইতে পারিবে।’ (আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪, পৃ. ১২৮)।
হ্যাঁ, যশস্বী হয়েছিলেন। বিদ্বত্সমাজ তাকে সাহিত্যবিশারদ উপাধি দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাগর উপাধিও পেয়েছিলেন। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর বলতে যেমন ঈশ্বরচন্দ্রকে বোঝায়, তেমনি সাহিত্যবিশারদ বলতে আবদুল করিমকেই বোঝায়। আমরা কিন্তু মাইকেল, বিদ্যাসাগর, সাহিত্যবিশারদ বলতেই ভালোবাসি।
একজন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন কলকাতা থেকে দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা তাঁর হাতে আসে। এই পত্রিকা পড়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সংগ্রহে অনুপ্রাণিত হন।
চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়ে, গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে পুঁথি পাঠ শুনে, পূর্বপুরুষের সংগৃহীত পুঁথি পাঠ করে সাহিত্যবিশারদ মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত প্রথম বই ‘রাধিকার মান ভঙ্গ’। এই বইয়ের ভূমিকা লেখেন ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেন, “শ্রী আবদুল করিম চট্টগ্রামের একটি বাঙ্গালা বিদ্যালয়ের পণ্ডিত। তাহার অবস্থা ভাল নহে। তথাপি তিনি সাহিত্যসেবায় অকাতরে পরিশ্রম করিয়া থাকেন। বাঙ্গালা সহিত্যের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহায়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন—সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন ‘জার্মান এডিটর’ এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।” (ঐ-পৃ. ১৬)
‘ইসলামাবাদ’ সাহিত্যবিশারদের একটি মৌলিক গ্রন্থ। চট্টগ্রামকেই তিনি ইসলামাবাদ বলেছেন। কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগে আউলিয়া, পীর, বুজর্গানেরা চট্টগ্রামে এসে, সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। উল্লিখিত গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন তিনি, “আমাদের এই দেশ ধর্মজগতে একটা পরম শ্লাঘ্য স্থান অধিকার করিবার দাবি করিয়া আছে। পৃথিবীর চারিটি মহাধর্ম শক্তি আসিয়া এখানে সম্মিলিত হইয়াছে। ইহা হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ—এই তিন মহাজাতিরই একটা পরম পবিত্র তীর্থরূপে পরিগণিত।... হিন্দুর হিন্দুত্ব ও মুসলমানের মুসলমানত্ব একমাত্র এই দেশেই আজও সম্পূর্ণ বজায় আছে। এক গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিয়া এক পুকুরের জল খাইয়া আমরা হিন্দু-মুসলমান দুইটি জাতি স্মরণাতীত কাল হইতেই স্ব-স্ব ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া পরম প্রীতিতে চলিয়া আসিতেছি, জাতি-ধর্ম লইয়া এ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনোদিন একটা টুঁ শব্দ পর্যন্তও হয় নাই, ইহা আমাদের চট্টগ্রামের একটা বিশিষ্ট গুণ।” (ঐ-পৃ. ২০)
তার অসাম্প্রদায়িক-উদার মানসের পরিচয় এ উদ্ধৃতিতে বিদ্যমান।
১৯৩৯ সালে সাহিত্য বিশারদ কলকাতা বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে বলেন, “সাহিত্যে জাতি-ধর্মের গণ্ডী আমি কখনও স্বীকার করি নাই, এখনও স্বীকার করি না, কিন্তু ইহার বৈচিত্র্য স্বীকার করি। সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে জাতিরই হউক, ইহা সাহিত্য পদবাচ্য হইলেই সর্বজনীন হইয়া থাকে। ...মুসলমানের সাহিত্য সর্বজনীন সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যের বিচিত্র ভঙ্গীর একদিক মাত্র। হিন্দুর সাহিত্যও তদ্রূপ একদিক। এই জন্যই আধুনিক বঙ্গের সাহিত্যিক জাগরণকে আমি ভীতির চক্ষে দেখি না, বরং প্রীতির নয়নেই নিরীক্ষণ করিয়া থাকি। কারণ অখণ্ড বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা সুগভীর এবং পরিচয় প্রাচীন।” (ঐ-পৃ. ৩৩)
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কি কেবল মধ্যযুগের পুঁথিই মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছিলেন? অবশ্য পুঁথিগুলো অজানা অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে না আনলে বাংলা সাহিত্য থাকত আধখানা চাঁদের মতো অসম্পূর্ণ। কিন্তু তিনি মূলত পুরো বাঙালি জাতির মননের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেছেন। আবিষ্কৃত উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলোতে যেহেতু ইংরেজের কূটপ্রভাব স্পর্শ করেনি, সেহেতু সেসবে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার সজীবতা, হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা।
জীবনসায়াহ্নে মানুষ হয় প্রতিক্রিয়াশীল। সাহিত্যবিশারদ হয়েছিলেন প্রগতিশীল। তাঁর সায়াহ্নকালীন অভিভাষণগুলো বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতাবিরোধী খরদীপ্ত উচ্চারণে বলিষ্ঠ। এজন্যই তিনি মনীষী, মহাপুরুষ।
সাম্প্রদায়িক চিন্তা তো অনাধুনিক চিন্তা। আর অনাধুনিক চিন্তা দিয়ে সাহিত্য বিশারদ এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষী হওয়া যায় না।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন