গাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই জানালা দিয়ে দোতলার বর্ণময় বারান্দাটার দিকে তাকিয়েছিলাম। আগের চেয়ে একটু মলিন বটে। তবে মনকাড়ার মতো যথেষ্ট সুন্দর সুন্দর উপাদান এখনও আছে। সেখানেই অপেক্ষা করছে আমার জন্য মা, ভাই ও আরিফা। পথের পাঁচালির কোনো দৃশ্যের মতোই বাঙ্ময় সেই দৃশ্য। প্রত্যেকটা মানুষ যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যার যার আলাদা সত্তা, কতশত ঘটনা, স্মৃতি-অনুভূতি ছড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে। শুধু আমার বড় বোন ও বাবার অভাবটা পূর্ণাঙ্গভাবে আঘাত করল আমায়।
প্রথম দিন নীলা আপু সামনে আসেনি। সে দুঃখটা যন্ত্রণা দেয়। চেয়ে পরের দিন যখন আপু দৌড়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে রাগতস্বরে বলতে লাগল, জানিস আমার বড় ননাস মুখ ভেংচি কেটে বলছিল, ‘ন্যাকা, কেউ যেন আর বিদেশ-বিভুঁই যায় না? আহ্লাদ দিয়েই বোনের মাথাটা খেয়েছ। যাও এখন সামলাও। এমনিতেই তো আইবুড়োর খাতায় নাম লিখিয়েছে। দেখো কেউ বিয়ে-থা করে কিনা। যাও-যাও জলদি যাও। নাহলে আবার চোখের জলের নদী বয়ে যাবে যে।’ কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে আপুর হাত থেকে আমার হাত সরে গিয়েছিল, বুঝতেই পারিনি। অন্যরা যে যাই বলুক, কিছু যায়-আসে না। মনে হচ্ছিল আপু তার নিজস্ব সুর মিলিয়েছিল কথাটা পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য। আমি কি এই আপুকে রেখে গিয়েছিলাম? চোখের জল মুছতে মুছতে অবচেতনে বারান্দায় পৌঁছে ইজিচেয়ারটায় বসে চোখের জল মুছেছিলাম— তবে ওড়না দিয়ে নয়, শার্টের কলারেই মুছেছিলাম; যদি কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে।
আমি কি পাগল হয়ে গেছি? কোনো কথার ধার অন্তত আমায় কাটতে পারেনি, তবে কেন আজ...
তাছাড়া আমার ড্রেসআপ নিয়েও কেউ কোনোদিন কিছু বলেনি। অথচ আপু কেমন করে বিদঘুটে স্টাইলে বলল, ‘এতটা বদলে গেলি কেমন করে? নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এমনকি সংসারের আত্মসম্মানটাকেও জলাঞ্জলি দিলি? সবকিছু ভুলে গেলি কী করে? যা জামা-কাপড় বদলে নে। বাইরের কেউ দেখলে আর রক্ষে নেই।’ মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলেও মনে হলো, এত সামান্য কথায় বর্তমান পরিস্থিতির আনন্দটা মাটি করার কোনো অর্থই হয় না। চেয়ার থেকে উঠতেই দেখি উনি পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছে, ‘কী ব্যাপার! তুই এখানে একা একা বসে কী করছিস?’
‘না কিছু না। অনেকদিন পর নিজের বাড়ির বারান্দাটা অনেক আপন আপন মনে হলো। যদিও এর সঙ্গে বৃত্তের মতো সম্পর্ক এবং পুরনো কিছু স্মৃতিও জড়িত।’
‘কী বলছিস? রাখ তো তোর আঁতেল মার্কা কথাবার্তা। তা তুই কি কিছু ভাবছিস?’
‘মানে! কোন ভাবনার কথা বলছ?’
‘স্রোতের শেওলা হয়ে আর কত ভাসবে? তীরে তরী ভেড়ানোর সময় কি হয়নি?’ বাবারও তো বয়েস হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে...।
কথাগুলো বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে সবার সামনে নিয়ে একেবারে আসামির মতো দাঁড় করিয়েছিল। স্বীকারোক্তি না দিলে জামিন দেয়া হবে না। আমিও কম কিসে?
বেয়াদবি না করে মিছরির ছুরির মতো মুচকি হাসির ফোয়ারা নিয়েই বললাম...।
আপু! তোমাদের ছেড়ে এত জলদি আমি যাব না, কিন্তু দেখো অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরেছি। কই! আমায় নিয়ে হইহুল্লোড় করবে, তা কিনা তুমি আমায় কত কিছু বলেই যাচ্ছ। এতকিছু ভাবতে পারব না। আগে আমার ক্যারিয়ার।
ইস! কোনো ক্যারিয়ার-ট্যারিয়ার দেখতে পারব না। চারদিক থেকে নানান লোক নানান কথা বলছে। তাছাড়া...
তাছাড়া আবার কী? বল, থামলে কেন?
বয়স অনেক হয়েছে। বিয়ে-থা করতে হবে না?
এখন কোনোমতেই বিয়ে করব না। মাত্র ব্যারিস্টারি কমপ্লিট করে এলাম। এখন নিজেই একটা কিছু করার চেষ্টা করব। আমার অনেক স্বপ্ন। তারপর দেখা যাবে— বলে দৌড়ে গিয়ে সোফায় পা দুটো উঠিয়ে বসে পড়লাম। বললাম, দেখো আপু, তোমাকে কিন্তু না করছি আমার...।
তুই এসব কী বলছিস? সঠিক সময় অনেক আগেই পার হয়েছে। তাছাড়া পরে তোমার যোগ্য পাত্র পাবে না, বলে দিচ্ছি।
‘আচ্ছা আপু...’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে আমার হাত দুটো আপুর কাঁধে রেখে বললাম, ‘তোমরা যা ভাবছ, তা ঠিক নয়। মানে...’
থামলি কেন? বল, বল।
তুইও যেন কেমন হয়ে গেছিস! সবকিছু কেমন যেন গুমোট-গুমোট ভাব।
না কিছু না। ও তুমি বুঝবে না।
সেদিনই মনে মনে গুমরে উঠেছিল বিদ্রোহ। কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। আমরা তো একই মায়ের সন্তান। এত পার্থক্য! কতদিন পরে ফিরে এসেছি! আপু বদলেছে, এটুকু জানতাম। তবে মমতায় ফাঙ্গাস ধরেছে। চিন্তাশক্তির এত অধঃপতন; হিসাব মেলাতে পারছি না, নাকি অন্যের সুখ হজম করার মনমানসিকতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। বাবা-মার স্বভাব-চরিত্রের যেটুকু চিত্র দেখেছি বা জেনেছি, তার সঙ্গে নীলা আপুর কোনো রকম সাদৃশ্য খুঁজে পাইনি। তবে কীভাবে, আমার সঙ্গে বোনের চেয়েও বেশি, বন্ধুত্ব ছিল কোনো এককালে। তা কি আপুর একটুও মনে নেই। অথচ চরম দুর্দিনে আপুর পাশে ঢাল হয়ে আমিই থাকতাম। উনার ব্যবহারে নিজের ভেতর ভূকম্পন টের পাচ্ছি। এই বুঝি ধৈর্যের সব চুল্লিতে ফাটল ধরবে। হাজার হলেও সে আমার বড় বোন। এই বলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি। মা সেই কখন থেকে রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অনেকদিন ধরে তার রান্না থেকে আমিও বঞ্চিত। আপুকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে...।
কী ব্যাপার, সেই কখন একবার তোমার চেহারাটা দেখিয়ে অধৈর্যের নদীতে আমাকে একা ফেলে চলে এলে, একটু খবরও নিলে না...মা, কাজটি একটুও ঠিক হয়নি কিন্তু!
কেন রে, এত পাকা পাকা কথা বলছিস কেন?
পরিস্থিতি কিছুই আঁচ করতে না দিয়েই আবারও বললাম।
তুমি কি তোমার মেয়ের দিকে ঠিক করে একবার তাকিয়ে দেখেছ? কই একবার তো জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আছি?
কেন? আমি তো দেখেছি তোর মুখটা কেমন শুকনো শুকনো হয়ে আছে।
তাই তো তোর জন্যে একটু কর্নস্যুপ বানাচ্ছিলাম। এই হয়ে এলো। যা না একটু আমার ঘরে গিয়ে বোস। তোর জন্যে তো আমি ঘরে এসি ছেড়ে রেখেছি। লক্ষ্মী সোনা আমার ঘরে যা। বাবার সঙ্গে বসে একটু গল্প কর। তোর কথা বারবার জিজ্ঞেস করছিল। আমি বলেছি, তুই ঘুমিয়ে আছিস।
সময় পেলে তো যাব! বিড়বিড় করে বললাম। মা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বলল, কিছু বললি?
না, মা।
পাগল মেয়ে। বাবার সঙ্গে এখনও তোর দূরত্ব যায়নি। মা না, বাবার কাছে যা। তুই যাওয়ার পর থেকেই সে যেন কেমন হয়ে গেছে রে।
বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি, নিজের ঘরেই, আপাতত নিঃসঙ্গ। বাঁ দিকের পাঁজরার কাছটায় চুলকানি উঠেছে বলেই ডান হাত বাড়িয়ে একটু চুলকে নিতে নিতে দরজার ঘট্ শব্দটা শুনেই তাকালেন। দেখলেন আমাকে। বললেন, ‘কিরে ভেতরে আয়! বস্, আমার কাছে এসে বস্।’ জ্বী বাবা—বলে এগিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। বাবার প্রতিটি অনুভূতির সঙ্গেই আমি পরিচিত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যৌবনের শক্তির ক্ষয় হতে হতে আজ যে অবস্থান, তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তা স্পষ্টই বোঝা গেল। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। যে দৃঢ় মনোবল, তাকে বটগাছের মতোই মনে হলো। ডান হাতটা দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন, তুমি আমার মেয়ে, একটু দমকা বাতাস এলেই নুয়ে পড়বে না। সময় এবং অবস্থানের সঙ্গে মোকাবিলা করতে শেখো। এটাই আমার আদেশ বল, আর উপদেশ বল, তা-ই; বুঝলে?
‘কেন বাবা? আমি কী করেছি? তুমি এমনভাবে কথা বলছ কেন? তুমি কি কোনো কারণে...’ কথাটি শেষ না করতেই মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলেন, ‘না, তোমার তো অনেক চওড়া দীর্ঘপথ। পথে পিছলালে চলবে না। তাই বলছিলাম কি, কারও কোনো কথায় কর্ণপাত না করে বরং যা শুরু করার কথা তার জন্য তৈরি হয়ে নাও।’
‘জ্বী বাবা। আমি তৈরি হয়েই এসেছি। এখন জীবনের প্রথম পর্ব। এই সময়টাকে ট্যাক্স না দিয়ে চললে পরে আমাকে কেউ-ই সাহায্য তো দূরের কথা, সহযোগিতাই করবে না। তা অন্তত এই দু’দিনেই বুঝে গেছি। তুমি ভেবো না, বাবা। সময়মত সব সামলে নেব। আমি তো তোমারই মেয়ে।’
‘সকালের নাশতা করেছিস? তোর মাকে একটু ডেকে দিবি? জ্বী, বলেই বিছানা ছাড়লাম। দরজা খুলতেই দেখি মা, হাতে স্যুপের পেয়ালা। আয় বাবার কাছে বসেই খেয়ে নে তো!’
আমি আমার নিকট-অতীত হাতড়ে দেখলাম। বর্তমানের সঙ্গে যা জুড়ে আছে তা একটা অদৃশ্য দূরত্ব। সে দূরত্ব আমাকে অহরহ স্পর্শ করছে। কাছে না থাকলেই তো নতুন করে চেষ্টা করতে হয় কাছে যাওয়ার। কিন্তু যদি কেউ সেই প্রবেশপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন? এক অজানা প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে বাবা-মায়ের ঘরটা ত্যাগ করলাম।
আজ প্রথম বারের জন্য ছোট ভাইটার জন্য আমার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল। কেননা যেই রিয়াদকে রেখে গিয়েছিলাম সে আজ তা নয়—এক ভয়ঙ্কর ফেরোসাস প্রাণী। শুধু বুদ্ধিবৃত্তির জন্যই একটু আলাদা। তবে কোথায় সেই বুদ্ধি, কোথায় সেই বাবার আদর্শ। একসময় ও বন্ধুদের ব্যাপারে কী অদ্ভুত পরামর্শ দিত। এখন কী হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছি না। ওর মেন্টাল হেলথ ঠিক আছে তো? নাকি, অসহায় হয়ে পড়েছে? জীবনের লক্ষ্যই হারিয়ে ফেলেছে। না হলে কেউ এভাবে জীবনটাকে তছনছ করে ফেলে? এবার নিয়ে চারবারের মতো ‘ও’ লেভেলে অ্যাটেন্ড করবে। এও কি সম্ভব! কারা ওর বন্ধু, খোঁজ নিতে হবে। মায়ের রুম থেকে বের হওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, আরিফা নামের মেয়েটি কি নিখুঁত হাতে ডাইনিং টেবিলের সবকিছু ঠিকঠাক করছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম আর বললাম, ভেরি গুড। মুচকি হাসির ঝলকে ডাইনিং রুমটা বেশ আলোকিতই মনে হলো। ওকে দু-একটা নির্দেশ দিয়ে ঢুকে পড়লাম রিয়াদের রুমে। দেখি কার সঙ্গে যেন মোবাইল ফোনে কথা বলছে। ধরন দেখে ভালো মনে হলো না। আমাকে দেখেও না দেখার ভান ওর বরাবরই। তবুও ভনিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত একসাইটেড হয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিস?’
‘তাতে তোমার লাভ? এ সময় আমার ঘরে কী মনে করে? বাইরে থেকেও ভদ্রতাটুকু শিখলে না, আপু।’
‘ছোট ভাইয়ের রুমে ঢুকতে বুঝি পারমিশনের প্রয়োজন?’
বল কী আপু! প্রত্যেকের প্রাইভেসি আছে। তাতে তুমি কোনোমতে হস্তক্ষেপ করতে পার না।
‘সরি, ভুল হয়ে গেছে। তা তোর পড়াশোনার খবরটবর কী? এ তুই কী করছিস?’
এত অমনোযোগী! কথার মাঝখানেই অদ্ভুত রিংটোনে রিয়াদের ফোনটা বেজে উঠল। দৌড়ে এসে ফোন ধরেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দোস্ত, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি। তুই রাস্তার মোড়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। ঠিক আছে আল্লাহ হাফেজ— বলেই, তরতর করে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। আর বলছে, ‘আপু, তোর সঙ্গে পরে কথা হবে। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আসি। কিছু মনে করিস না। চষবধংব আপু।’ ‘ঠিক আছে, আমিও বললাম। আরও বললাম, ‘দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাব। জলদি চলে আসিস।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, আপু। ইউ আর আ সুইটি পাই।’
সবাই কেমন অদ্ভুত ব্যাপারে ব্যস্ত, যার কোনো ভিত্তি নেই। একাকিত্ব থেকে বিদায় নেয়ার জন্যই আমি বিলেতে পড়তে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দেশে ফিরে এসে দেখব, শুধু কাজের জন্যই সবাই ব্যস্ত। কিন্তু না...। কোথায় কী যেন একটা গ্যাপ সবার মধ্যে।
আবার সেজন্যেই ফিরে এলাম। মনে হলো ফ্যামিলিটা আলাদা ব্যাপার, এখন মনে হচ্ছে কেন দেশে ফিরে এলাম? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। শুধু মনে হচ্ছে ম্যানচেস্টারে ফিরে গেলেই ভালো হবে। ফিরে যাওয়ার পথ এখনও খোলা আছে। তাছাড়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভীষণ ভয়াবহ। ইচ্ছে করলেই কি কোনো ব্যাপারে সাকসেস সম্ভব!
রিয়াদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাথাটাই ধরে গেল। ওর ঘর থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। জানালাগুলো বন্ধ থাকায় ঘরে আবছা অন্ধকার। তার মধ্যেও শোকে ভেঙেচুরে যাওয়া মায়ের মুখটা দেখতে পেলাম। আর টের পেলাম আমার হাতের ওপ টপটপ করে গরম জলের ফোঁটা পড়ছে। সান্ত্বনা দিয়ে মাকে বললাম, ‘আপুর সামনে এখনও অনেক জীবন পড়ে আছে, মা।’
কীভাবে কাটবে বল, সেই জীবনটা? এই অকালেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে... না, তা হতে পারে না। বলেই আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম...‘ইচ্ছে হলে দু-একটা বুদ্ধিমতির মতো কথা বলে, তবে... মা বলল।
‘তবে কী মা, বলো না, থামলে কেন? চুপ করে থাকলে সমস্যার শিকড় আরও গভীর হবে। তা বুঝতে পারছ?’
‘আমার মনে হয় তুই-ই একটা বিহিত করতে পারবি ওর। দেখ না একটু চেষ্টা করে। তোর তো এখন ঢের বুদ্ধি। মা, বড় পাস দিয়েছিস, আমাদের গর্ব তুই।’ এই বলে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিল। ‘হ্যাঁ মা, তাই-ই দেখব। তুমি ভেবো না। তোমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আচ্ছা মা, বাবা কি একটুও হাঁটাচলা করে না?’ ‘না, অনেক চেষ্টা করেছি। কোনো কথাই শোনে না আমার।’
যত দুঃসাধ্যই হোক। আপুর মুখোমুখি হতে হবে। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের বিশেষ প্রয়োজন। ‘দুর্ভাগ্য’ মানুষকে বহু কিছু অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখায়। শুধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এই নতুন অবস্থাটা অবজার্ভ করলাম। মনে পড়ে গেল আপুর বিয়ের দিনের কথা। দৃশ্যের পাতা উল্টাতে লাগলাম। সারা শরীর-মন ছম ছম করছে। আপুর এই অবস্থার জন্য পরিবারের কেউ-ই দায়ী নয়। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিল। হঠাত্, বলা নেই কওয়া নেই, আবিদ ভাই দেশান্তরিত হলো। তারপর সুন্দর একটা বিদেশি নীল খামের ভেতর ডিভোর্স লেটার পৌঁছে গেল। আর ছোট্ট একটা চিরকুট, তাতে লেখা, ‘আমায় ক্ষমা করে দিও। এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না।’ ঘরের আনাচে-কানাচে যতটুকু অন্ধকার ছিল তার মধ্যে নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করলাম আর ভাবলাম ফিরে যাওয়া কোনোমতেই আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়। এই দুর্বল মুহূর্তকে আরও আঘাত করা হবে। কিন্তু মন দিয়ে হয়তো বা মনকে নূতন করে স্পর্শ করা যাবে। হয়তো নিজের পদক্ষেপকে আরও জোরালো করতে হবে। ভাবতে ভাবতে জানালার সবুজ পর্দা সরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এটাই প্রকৃত জীবন। আরও অপেক্ষা করব নীলা আপুর জন্য। আর মনে মনে বললাম, বিবাহিত জীবন যদি যথার্থ হতো, তবে আমার জীবনও কি ওই একই পথে প্রবাহিত হতো না? মনের মধ্যে ভাসতে থাকল একটাই ভাবনা। একই বাড়িতে, একই ছাদের নিচে বসবাস। আদর্শ বাবা-মায়ের অভিভাবকত্বে বড় হওয়া তিনটি জীবন, কী করে তিন দিকে চলে যাওয়া সম্ভব হলো?
সূত্র : আমার দেশ
প্রথম দিন নীলা আপু সামনে আসেনি। সে দুঃখটা যন্ত্রণা দেয়। চেয়ে পরের দিন যখন আপু দৌড়ে এসে আমার হাত দুটো ধরে রাগতস্বরে বলতে লাগল, জানিস আমার বড় ননাস মুখ ভেংচি কেটে বলছিল, ‘ন্যাকা, কেউ যেন আর বিদেশ-বিভুঁই যায় না? আহ্লাদ দিয়েই বোনের মাথাটা খেয়েছ। যাও এখন সামলাও। এমনিতেই তো আইবুড়োর খাতায় নাম লিখিয়েছে। দেখো কেউ বিয়ে-থা করে কিনা। যাও-যাও জলদি যাও। নাহলে আবার চোখের জলের নদী বয়ে যাবে যে।’ কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে আপুর হাত থেকে আমার হাত সরে গিয়েছিল, বুঝতেই পারিনি। অন্যরা যে যাই বলুক, কিছু যায়-আসে না। মনে হচ্ছিল আপু তার নিজস্ব সুর মিলিয়েছিল কথাটা পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য। আমি কি এই আপুকে রেখে গিয়েছিলাম? চোখের জল মুছতে মুছতে অবচেতনে বারান্দায় পৌঁছে ইজিচেয়ারটায় বসে চোখের জল মুছেছিলাম— তবে ওড়না দিয়ে নয়, শার্টের কলারেই মুছেছিলাম; যদি কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে।
আমি কি পাগল হয়ে গেছি? কোনো কথার ধার অন্তত আমায় কাটতে পারেনি, তবে কেন আজ...
তাছাড়া আমার ড্রেসআপ নিয়েও কেউ কোনোদিন কিছু বলেনি। অথচ আপু কেমন করে বিদঘুটে স্টাইলে বলল, ‘এতটা বদলে গেলি কেমন করে? নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এমনকি সংসারের আত্মসম্মানটাকেও জলাঞ্জলি দিলি? সবকিছু ভুলে গেলি কী করে? যা জামা-কাপড় বদলে নে। বাইরের কেউ দেখলে আর রক্ষে নেই।’ মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলেও মনে হলো, এত সামান্য কথায় বর্তমান পরিস্থিতির আনন্দটা মাটি করার কোনো অর্থই হয় না। চেয়ার থেকে উঠতেই দেখি উনি পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছে, ‘কী ব্যাপার! তুই এখানে একা একা বসে কী করছিস?’
‘না কিছু না। অনেকদিন পর নিজের বাড়ির বারান্দাটা অনেক আপন আপন মনে হলো। যদিও এর সঙ্গে বৃত্তের মতো সম্পর্ক এবং পুরনো কিছু স্মৃতিও জড়িত।’
‘কী বলছিস? রাখ তো তোর আঁতেল মার্কা কথাবার্তা। তা তুই কি কিছু ভাবছিস?’
‘মানে! কোন ভাবনার কথা বলছ?’
‘স্রোতের শেওলা হয়ে আর কত ভাসবে? তীরে তরী ভেড়ানোর সময় কি হয়নি?’ বাবারও তো বয়েস হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে...।
কথাগুলো বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে সবার সামনে নিয়ে একেবারে আসামির মতো দাঁড় করিয়েছিল। স্বীকারোক্তি না দিলে জামিন দেয়া হবে না। আমিও কম কিসে?
বেয়াদবি না করে মিছরির ছুরির মতো মুচকি হাসির ফোয়ারা নিয়েই বললাম...।
আপু! তোমাদের ছেড়ে এত জলদি আমি যাব না, কিন্তু দেখো অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরেছি। কই! আমায় নিয়ে হইহুল্লোড় করবে, তা কিনা তুমি আমায় কত কিছু বলেই যাচ্ছ। এতকিছু ভাবতে পারব না। আগে আমার ক্যারিয়ার।
ইস! কোনো ক্যারিয়ার-ট্যারিয়ার দেখতে পারব না। চারদিক থেকে নানান লোক নানান কথা বলছে। তাছাড়া...
তাছাড়া আবার কী? বল, থামলে কেন?
বয়স অনেক হয়েছে। বিয়ে-থা করতে হবে না?
এখন কোনোমতেই বিয়ে করব না। মাত্র ব্যারিস্টারি কমপ্লিট করে এলাম। এখন নিজেই একটা কিছু করার চেষ্টা করব। আমার অনেক স্বপ্ন। তারপর দেখা যাবে— বলে দৌড়ে গিয়ে সোফায় পা দুটো উঠিয়ে বসে পড়লাম। বললাম, দেখো আপু, তোমাকে কিন্তু না করছি আমার...।
তুই এসব কী বলছিস? সঠিক সময় অনেক আগেই পার হয়েছে। তাছাড়া পরে তোমার যোগ্য পাত্র পাবে না, বলে দিচ্ছি।
‘আচ্ছা আপু...’ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে আমার হাত দুটো আপুর কাঁধে রেখে বললাম, ‘তোমরা যা ভাবছ, তা ঠিক নয়। মানে...’
থামলি কেন? বল, বল।
তুইও যেন কেমন হয়ে গেছিস! সবকিছু কেমন যেন গুমোট-গুমোট ভাব।
না কিছু না। ও তুমি বুঝবে না।
সেদিনই মনে মনে গুমরে উঠেছিল বিদ্রোহ। কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। আমরা তো একই মায়ের সন্তান। এত পার্থক্য! কতদিন পরে ফিরে এসেছি! আপু বদলেছে, এটুকু জানতাম। তবে মমতায় ফাঙ্গাস ধরেছে। চিন্তাশক্তির এত অধঃপতন; হিসাব মেলাতে পারছি না, নাকি অন্যের সুখ হজম করার মনমানসিকতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। বাবা-মার স্বভাব-চরিত্রের যেটুকু চিত্র দেখেছি বা জেনেছি, তার সঙ্গে নীলা আপুর কোনো রকম সাদৃশ্য খুঁজে পাইনি। তবে কীভাবে, আমার সঙ্গে বোনের চেয়েও বেশি, বন্ধুত্ব ছিল কোনো এককালে। তা কি আপুর একটুও মনে নেই। অথচ চরম দুর্দিনে আপুর পাশে ঢাল হয়ে আমিই থাকতাম। উনার ব্যবহারে নিজের ভেতর ভূকম্পন টের পাচ্ছি। এই বুঝি ধৈর্যের সব চুল্লিতে ফাটল ধরবে। হাজার হলেও সে আমার বড় বোন। এই বলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি। মা সেই কখন থেকে রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অনেকদিন ধরে তার রান্না থেকে আমিও বঞ্চিত। আপুকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে...।
কী ব্যাপার, সেই কখন একবার তোমার চেহারাটা দেখিয়ে অধৈর্যের নদীতে আমাকে একা ফেলে চলে এলে, একটু খবরও নিলে না...মা, কাজটি একটুও ঠিক হয়নি কিন্তু!
কেন রে, এত পাকা পাকা কথা বলছিস কেন?
পরিস্থিতি কিছুই আঁচ করতে না দিয়েই আবারও বললাম।
তুমি কি তোমার মেয়ের দিকে ঠিক করে একবার তাকিয়ে দেখেছ? কই একবার তো জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আছি?
কেন? আমি তো দেখেছি তোর মুখটা কেমন শুকনো শুকনো হয়ে আছে।
তাই তো তোর জন্যে একটু কর্নস্যুপ বানাচ্ছিলাম। এই হয়ে এলো। যা না একটু আমার ঘরে গিয়ে বোস। তোর জন্যে তো আমি ঘরে এসি ছেড়ে রেখেছি। লক্ষ্মী সোনা আমার ঘরে যা। বাবার সঙ্গে বসে একটু গল্প কর। তোর কথা বারবার জিজ্ঞেস করছিল। আমি বলেছি, তুই ঘুমিয়ে আছিস।
সময় পেলে তো যাব! বিড়বিড় করে বললাম। মা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বলল, কিছু বললি?
না, মা।
পাগল মেয়ে। বাবার সঙ্গে এখনও তোর দূরত্ব যায়নি। মা না, বাবার কাছে যা। তুই যাওয়ার পর থেকেই সে যেন কেমন হয়ে গেছে রে।
বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি, নিজের ঘরেই, আপাতত নিঃসঙ্গ। বাঁ দিকের পাঁজরার কাছটায় চুলকানি উঠেছে বলেই ডান হাত বাড়িয়ে একটু চুলকে নিতে নিতে দরজার ঘট্ শব্দটা শুনেই তাকালেন। দেখলেন আমাকে। বললেন, ‘কিরে ভেতরে আয়! বস্, আমার কাছে এসে বস্।’ জ্বী বাবা—বলে এগিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। বাবার প্রতিটি অনুভূতির সঙ্গেই আমি পরিচিত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যৌবনের শক্তির ক্ষয় হতে হতে আজ যে অবস্থান, তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তা স্পষ্টই বোঝা গেল। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। যে দৃঢ় মনোবল, তাকে বটগাছের মতোই মনে হলো। ডান হাতটা দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন, তুমি আমার মেয়ে, একটু দমকা বাতাস এলেই নুয়ে পড়বে না। সময় এবং অবস্থানের সঙ্গে মোকাবিলা করতে শেখো। এটাই আমার আদেশ বল, আর উপদেশ বল, তা-ই; বুঝলে?
‘কেন বাবা? আমি কী করেছি? তুমি এমনভাবে কথা বলছ কেন? তুমি কি কোনো কারণে...’ কথাটি শেষ না করতেই মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলেন, ‘না, তোমার তো অনেক চওড়া দীর্ঘপথ। পথে পিছলালে চলবে না। তাই বলছিলাম কি, কারও কোনো কথায় কর্ণপাত না করে বরং যা শুরু করার কথা তার জন্য তৈরি হয়ে নাও।’
‘জ্বী বাবা। আমি তৈরি হয়েই এসেছি। এখন জীবনের প্রথম পর্ব। এই সময়টাকে ট্যাক্স না দিয়ে চললে পরে আমাকে কেউ-ই সাহায্য তো দূরের কথা, সহযোগিতাই করবে না। তা অন্তত এই দু’দিনেই বুঝে গেছি। তুমি ভেবো না, বাবা। সময়মত সব সামলে নেব। আমি তো তোমারই মেয়ে।’
‘সকালের নাশতা করেছিস? তোর মাকে একটু ডেকে দিবি? জ্বী, বলেই বিছানা ছাড়লাম। দরজা খুলতেই দেখি মা, হাতে স্যুপের পেয়ালা। আয় বাবার কাছে বসেই খেয়ে নে তো!’
আমি আমার নিকট-অতীত হাতড়ে দেখলাম। বর্তমানের সঙ্গে যা জুড়ে আছে তা একটা অদৃশ্য দূরত্ব। সে দূরত্ব আমাকে অহরহ স্পর্শ করছে। কাছে না থাকলেই তো নতুন করে চেষ্টা করতে হয় কাছে যাওয়ার। কিন্তু যদি কেউ সেই প্রবেশপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন? এক অজানা প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে বাবা-মায়ের ঘরটা ত্যাগ করলাম।
আজ প্রথম বারের জন্য ছোট ভাইটার জন্য আমার মন সহানুভূতিতে ভরে উঠল। কেননা যেই রিয়াদকে রেখে গিয়েছিলাম সে আজ তা নয়—এক ভয়ঙ্কর ফেরোসাস প্রাণী। শুধু বুদ্ধিবৃত্তির জন্যই একটু আলাদা। তবে কোথায় সেই বুদ্ধি, কোথায় সেই বাবার আদর্শ। একসময় ও বন্ধুদের ব্যাপারে কী অদ্ভুত পরামর্শ দিত। এখন কী হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছি না। ওর মেন্টাল হেলথ ঠিক আছে তো? নাকি, অসহায় হয়ে পড়েছে? জীবনের লক্ষ্যই হারিয়ে ফেলেছে। না হলে কেউ এভাবে জীবনটাকে তছনছ করে ফেলে? এবার নিয়ে চারবারের মতো ‘ও’ লেভেলে অ্যাটেন্ড করবে। এও কি সম্ভব! কারা ওর বন্ধু, খোঁজ নিতে হবে। মায়ের রুম থেকে বের হওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, আরিফা নামের মেয়েটি কি নিখুঁত হাতে ডাইনিং টেবিলের সবকিছু ঠিকঠাক করছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম আর বললাম, ভেরি গুড। মুচকি হাসির ঝলকে ডাইনিং রুমটা বেশ আলোকিতই মনে হলো। ওকে দু-একটা নির্দেশ দিয়ে ঢুকে পড়লাম রিয়াদের রুমে। দেখি কার সঙ্গে যেন মোবাইল ফোনে কথা বলছে। ধরন দেখে ভালো মনে হলো না। আমাকে দেখেও না দেখার ভান ওর বরাবরই। তবুও ভনিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত একসাইটেড হয়ে কার সঙ্গে কথা বলছিস?’
‘তাতে তোমার লাভ? এ সময় আমার ঘরে কী মনে করে? বাইরে থেকেও ভদ্রতাটুকু শিখলে না, আপু।’
‘ছোট ভাইয়ের রুমে ঢুকতে বুঝি পারমিশনের প্রয়োজন?’
বল কী আপু! প্রত্যেকের প্রাইভেসি আছে। তাতে তুমি কোনোমতে হস্তক্ষেপ করতে পার না।
‘সরি, ভুল হয়ে গেছে। তা তোর পড়াশোনার খবরটবর কী? এ তুই কী করছিস?’
এত অমনোযোগী! কথার মাঝখানেই অদ্ভুত রিংটোনে রিয়াদের ফোনটা বেজে উঠল। দৌড়ে এসে ফোন ধরেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দোস্ত, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি। তুই রাস্তার মোড়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। ঠিক আছে আল্লাহ হাফেজ— বলেই, তরতর করে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। আর বলছে, ‘আপু, তোর সঙ্গে পরে কথা হবে। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আসি। কিছু মনে করিস না। চষবধংব আপু।’ ‘ঠিক আছে, আমিও বললাম। আরও বললাম, ‘দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাব। জলদি চলে আসিস।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, আপু। ইউ আর আ সুইটি পাই।’
সবাই কেমন অদ্ভুত ব্যাপারে ব্যস্ত, যার কোনো ভিত্তি নেই। একাকিত্ব থেকে বিদায় নেয়ার জন্যই আমি বিলেতে পড়তে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দেশে ফিরে এসে দেখব, শুধু কাজের জন্যই সবাই ব্যস্ত। কিন্তু না...। কোথায় কী যেন একটা গ্যাপ সবার মধ্যে।
আবার সেজন্যেই ফিরে এলাম। মনে হলো ফ্যামিলিটা আলাদা ব্যাপার, এখন মনে হচ্ছে কেন দেশে ফিরে এলাম? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। শুধু মনে হচ্ছে ম্যানচেস্টারে ফিরে গেলেই ভালো হবে। ফিরে যাওয়ার পথ এখনও খোলা আছে। তাছাড়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভীষণ ভয়াবহ। ইচ্ছে করলেই কি কোনো ব্যাপারে সাকসেস সম্ভব!
রিয়াদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাথাটাই ধরে গেল। ওর ঘর থেকে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। জানালাগুলো বন্ধ থাকায় ঘরে আবছা অন্ধকার। তার মধ্যেও শোকে ভেঙেচুরে যাওয়া মায়ের মুখটা দেখতে পেলাম। আর টের পেলাম আমার হাতের ওপ টপটপ করে গরম জলের ফোঁটা পড়ছে। সান্ত্বনা দিয়ে মাকে বললাম, ‘আপুর সামনে এখনও অনেক জীবন পড়ে আছে, মা।’
কীভাবে কাটবে বল, সেই জীবনটা? এই অকালেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে... না, তা হতে পারে না। বলেই আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম...‘ইচ্ছে হলে দু-একটা বুদ্ধিমতির মতো কথা বলে, তবে... মা বলল।
‘তবে কী মা, বলো না, থামলে কেন? চুপ করে থাকলে সমস্যার শিকড় আরও গভীর হবে। তা বুঝতে পারছ?’
‘আমার মনে হয় তুই-ই একটা বিহিত করতে পারবি ওর। দেখ না একটু চেষ্টা করে। তোর তো এখন ঢের বুদ্ধি। মা, বড় পাস দিয়েছিস, আমাদের গর্ব তুই।’ এই বলে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিল। ‘হ্যাঁ মা, তাই-ই দেখব। তুমি ভেবো না। তোমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আচ্ছা মা, বাবা কি একটুও হাঁটাচলা করে না?’ ‘না, অনেক চেষ্টা করেছি। কোনো কথাই শোনে না আমার।’
যত দুঃসাধ্যই হোক। আপুর মুখোমুখি হতে হবে। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের বিশেষ প্রয়োজন। ‘দুর্ভাগ্য’ মানুষকে বহু কিছু অন্যরকমভাবে ভাবতে শেখায়। শুধু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এই নতুন অবস্থাটা অবজার্ভ করলাম। মনে পড়ে গেল আপুর বিয়ের দিনের কথা। দৃশ্যের পাতা উল্টাতে লাগলাম। সারা শরীর-মন ছম ছম করছে। আপুর এই অবস্থার জন্য পরিবারের কেউ-ই দায়ী নয়। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিল। হঠাত্, বলা নেই কওয়া নেই, আবিদ ভাই দেশান্তরিত হলো। তারপর সুন্দর একটা বিদেশি নীল খামের ভেতর ডিভোর্স লেটার পৌঁছে গেল। আর ছোট্ট একটা চিরকুট, তাতে লেখা, ‘আমায় ক্ষমা করে দিও। এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না।’ ঘরের আনাচে-কানাচে যতটুকু অন্ধকার ছিল তার মধ্যে নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করলাম আর ভাবলাম ফিরে যাওয়া কোনোমতেই আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়। এই দুর্বল মুহূর্তকে আরও আঘাত করা হবে। কিন্তু মন দিয়ে হয়তো বা মনকে নূতন করে স্পর্শ করা যাবে। হয়তো নিজের পদক্ষেপকে আরও জোরালো করতে হবে। ভাবতে ভাবতে জানালার সবুজ পর্দা সরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এটাই প্রকৃত জীবন। আরও অপেক্ষা করব নীলা আপুর জন্য। আর মনে মনে বললাম, বিবাহিত জীবন যদি যথার্থ হতো, তবে আমার জীবনও কি ওই একই পথে প্রবাহিত হতো না? মনের মধ্যে ভাসতে থাকল একটাই ভাবনা। একই বাড়িতে, একই ছাদের নিচে বসবাস। আদর্শ বাবা-মায়ের অভিভাবকত্বে বড় হওয়া তিনটি জীবন, কী করে তিন দিকে চলে যাওয়া সম্ভব হলো?
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন