ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইল অভি। মুখে সব পেয়েছির একটা হাসি। ভীষণ খুশি লাগছে। লুবনা রাগ করেনি, একটুও না। বলছিল কাজটা একদম ঠিক হয়নি। কিন্তু গলা শুনে মোটেই তা মনে হচ্ছিল না। বরং ওর গলায় একটা খুশি খুশি সুর লুকানো ছিল। একটা চাপা উত্তেজনা, এপাশ থেকেও খুব স্পষ্ট অভি বুঝতে পারছিল। বুঝতে পারছিল লুবনার ফর্সা গাল দুটো লালচে হয়ে গেছে, চকচক করছে। আজ লুবনাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল, এত আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল অভি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না। কাছে যাবো না, যাবো না করেও কখন কিভাবে যে অতখানি ঝুঁকে পড়েছিল অভি টেরই পায়নি। লুবনা সরে যায়নি, আবার কাছেও টেনে নেয়নি। শুধু প্রচ্ছন্ন একটা প্রশ্রয় দিয়েছে। ওর এই প্রশ্রয়ের কারণেই অভি এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছে। এমনকি ঠিক হচ্ছে না, এই অনুভূতিটুকুও ওর মধ্যে কাজ করে না।মাত্রই মাস্টার্স শেষ করে বের হয়েছে অভি। বেরুনোর সাথে সাথেই কাজ পেয়ে গেছে একটা প্রোজেক্টে, ছয় মাসের চুক্তি। হয়তো পরে আরো বাড়ানো হবে। এখানে এসেই পরিচয় লুবনার সাথে। ওরা দুজন একটা টিম হিসেবে কাজ করে। লুবনা ওর দু’বছরের বড়। এ কাজে আছে বহদিন ধরে। তাই ওকে হাতে-কলমে শেখানোর দায়িত্বও লুবনার। প্রথম দেখার পর থেকেই অভি লুবনার প্রতি একটা অসম্ভব রকম আকর্ষণ বোধ করে আসছে। লুবনা অনেক সুন্দর দেখতে আর তারচেয়েও বেশি আকর্ষণীয়। ওর চেহারায়, কথায়, হাসিতে, চোখের তারায়, শরীরের প্রতিটা বাঁকে, অঙ্গভঙ্গিতে চুম্বকের মত একটা আকর্ষণ। লুবনার গায়ের রঙ একদম টুকটুকে, গোলাপের মত। যে রঙের জামা পড়ে তাতেই ওকে ভাল লাগে। যেভাবে সাজে তাতেই অভি মুগ্ধ হয়ে যায়, এমনকি না সাজলেও!
অভি হয়তো ভাবে না, কিন্তু ওর মনের অনেক ভিতরে একটা তুলনা এসে যায়। মুনিরা তো এমন না। এত বছর ধরে মুনিরাকে ও দেখে আসছে, মুনিরা কখনো নিজেকে এইভাবে সাজায় না, পরিপাটি হয়ে অভির সামনে আসে না, এইভাবে চোখে চোখে কথা বলতে পারে না, বড্ড আনস্মার্ট মুনিরা, বড্ড সেকেলে.......লুবনার চার বছরের ছোট হলেও মুনিরাকে বুড়ি বুড়ি লাগে। ও কখনো অভিকে এইভাবে আকর্ষণ করেনি। ওর কাছে অভি গেছে আট বছরের অভ্যস্ততায়, কিন্তু মুনিরা সবটুকু দিয়েও ওকে কখনো জাগিয়ে তুলতে পারেনি। যা লুবনা পারে শুধু একটু চোখের তাকানোতে বা মুচকি একটু হাসিতে। অভি ভাবে আর কেমন একটা আবেশে ওর চোখ জড়িয়ে আসে।
প্রায় সারাদিন লুবনার সাথে থাকতে হয় ওকে। একদিন কি কাজে যেন একটু বেশি রাতেই অভি ফোন করেছিল লুবনাকে। ঘুমভাঙা গলায় আধো আধো কথা বলেছিল লুবনা। এত অ™ভুত ছিল ওর গলাটা, অভির গা সিরসির করে উঠেছিল। ওই গলাটা শোনার জন্য অভি এখন কোন না কোন ছুতোয় রোজ রাতে ফোন করে। লুবনা কখনো রাগ করে না। বরং কথা বলে ওর সাথে ঘন্টা পার করে। কত কথা যে বলে ও, কতভাবে যে বলে! মুনিরার সাথে রোজকার একঘেয়ে রুটিন কথার পর লুবনা যেন ওকে কল্পনার একটা জগতে নিয়ে যায়। কথায় কথায় ওদের সম্পর্কটা এখন অনেক গভীর। যদিও মুনিরার কথা কেউ ভোলে না, কিন্তু কেউ তুলেও না ওই প্রসঙ্গ। মুনিরা উহ্য থেকে যায়।
প্রথমদিকে অভির একটু একটু খারাপ লাগতো। মনে হতো ঠিক হচ্ছে না। এভাবে মুনিরাকে এড়িয়ে, ওকে ঠকিয়ে। কিন্তু এখন ও যেন লুবনার মধ্যে ডুবে গেছে। কোন কিছুই ওর আর মনে হয় না। বরং মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যায় মুনিরার ওপর। ওর খুঁতগুলো বেশি বেশি চোখে পড়ে আর তাই নিয়ে হইচই করে। যেটা কখনোই আগে করতোনা।
আজ লুবনা একটা টকটকে লাল জামা পরেছিল। তারসাথে মিলিয়ে লাল টিপ কপালে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। সন্ধ্যায় ফেরার পথে রিকশায় বসে কি কথায় যেন ভীষণ হাসছিল, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে কি যে হল, এক হাতে জড়িয়ে ধরল লুবনাকে আর গালে টুক করে একটা চুমু। কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে থেকে লুবনা আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর আবার স্বাভাবিক। কাজটা করেই অভি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ অস্বস্তি। বাসায় ফিরে, মুনিরার সাথে কথাও বলেছে অভ্যাসমত। কিন্তু সারাক্ষণই অপেক্ষা করেছে কখন রাত হবে, কখন লুবনার সাথে কথা বলবে। না, লুবনা রাগ করেনি। একবার শুধু বলেছে ‘এটা কিন্তু ঠিক না’। তারপরই আবার স্বাভাবিক। আজ কথাগুলো আরো ভাল লাগছিল শুনতে, একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন অভি।
ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে লুবনার কথা। এরই ফাঁকে একবার মুনিরাকে মনে পড়ল। মুনিরাকে ভালবাসে অভি, মুনিরার সাথে এত বছরের অভ্যস্ত জীবন ছাড়া সম্ভব না। আবার লুবনার জন্যও তারমধ্যে অসম্ভব একটা আকর্ষণ। কোনটাই এড়ানো সম্ভব না অভির পক্ষে।
*****
লুবনা হাসছে। এই হাসিটা অভি কোনদিন দেখেনি। ভীষণ নিষ্ঠুর, ক্রুর একটা হাসি লুবনার ঠোঁটে। অভির জন্য ওর করুণা হচ্ছে। বেচারা!
অভিকে দেখে বেচারা শব্দটাই লুবনার মাথায় প্রথম এসেছিল। ভোলা-ভালা, বোকা-সোকা একটা ছেলে, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডির বাইরে পা রেখেছে। বুঝতে শেখার পর থেকেই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল বলে জীবনের অনেকগুলো দিক, হরেক রকম মানুষ ও দেখেনি। মুনিরার কথা ও প্রথম থেকেই বলেছে। আর শুনতে শুনতেই লুবনার মনে হয়েছে এতদিনের সম্পর্ক হলেও কোথাও একটা বড় ফাঁক আছে। ওদের সম্পর্কে একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, নির্ভরতা তৈরি হয়েছে কিন্তু কোন নতুনত্ব নেই। একঘেয়ে হয়ে গেছে। অভির চোখ তাই লুবনাকে দেখে ধাঁধায় পড়ে গেছে। ধীরে ধীরে অভির দৃষ্টির পরিবর্তন দেখেছে লুবনাকে, আর নিজেকে সেভাবেই ওর সামনে তুলে ধরেছে। অভির মুগ্ধ দৃষ্টি, প্রশংসা, তোষামোদ খুব উপভোগ করে লুবনা। ছেলেগুলো যে কি! এত বছরের একটা সম্পর্ককে তুচ্ছ করে, অবহেলা করে অভি কি করে পারে লুবনার সাথে এইসব তোষামোদী করতে। এমন তো না যে অভি বোঝে না এটা অন্যায়। লুবনার ভালই লাগে। ‘তুমি যদি নাচতে চাও, কেন আমি ঢোলে বাড়ি দিবো না?’
আসিফ চলে যাওয়ার পর থেকে লুবনা কোন ছেলেকেই বিশ্বাস করে না। কারো কথাই সত্যি বলে মানতে পারেনা। অভি যখন বলেছিল মুনিরার সাথে ওর এতদিনের সম্পর্ক, ওদের গভীর ভালবাসা, ওদের মধ্যে কখনো কোন সমস্যা বা ভুল বোঝাবুঝি হয় না, ওরা অনেক সুখী তখন অবহেলায় মনে মনে ঠো^ট বাঁকিয়েছিল লুবনা। দেখতে চাইছিল কতটা গভীর অভির ভালবাসা। আস্তে আস্তে জাল বিছিয়েছে যেভাবে অভি চেয়েছে। যাতে অভি পা দিতে চেয়েছে, নিজের অজান্তে।
আর আজকে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল। লুবনার এই হাসিটা অভি খুব পছন্দ করে। মুগ্ধ হয়ে দেখে, আজকেও তাই ঘটল। লুবনা শুধু অনিচ্ছার ভান করে করা স্পর্শটুকু অভিকে দিয়েছে। আর অভি বাধ্য হয়েছে শেষ পথটুকু অতিক্রম করতে। হাহ্ প্রেম! এত বছরের এত ভালবাসা, কই চলে গেল। সেই তো ডুবল। আপনি অন্নেক সুন্দর! অনেক এ্যাট্রাকটিভ! আপনাকে মিস করছি ভীষণ! কত কত এসএমএস। ছেলেগুলো এমন কেন? বিতৃষ্ণায় ঠোঁটের কোণাটা বেঁকে গেল লুবনার।
“সব শালা হারামি!” লুবনার খুব পছন্দের একটা কথা। যখনই েেকান ছেলের ভেতরের চেহারাটা বের হয়ে পড়ে তখনই লুবনা এই কথাটা বিড়বিড় করতে থাকে। অসহ্য লাগে সব।
আসিফের চলে যাওয়াটা লুবনার জন্য একটা ভয়াবহ আঘাত ছিল। আসিফের মধ্যে ছিল প্রচন্ড সন্দেহ। ও প্রতিটা ব্যাপারেই লুবনাকে সন্দেহ করতো। প্রথমদিকে লুবনার ভালই লাগতো। ভাবতো, ও আমার এত কেয়ার করে, সারাক্ষণ আমি কি করলাম, কই গেলাম তাই নিয়ে অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে আসিফের সন্দেহ সব সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। লুবনা আর সহ্য করতে পারেনা। প্রচন্ড ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে, সে জায়গায় জন্ম নেয় ঘৃণা। তারা দূরে সরতে থাকে একজন অন্যজনের থেকে। আর একসময় আসিফ ওকে মিথ্যে সব অপবাদ দিয়ে চলে যায় একা ফেলে। আসিফের অভিযোগগুলো শুনলে লুবনা হতভম্ব হয়ে যেতো। এইসব কখনো সে কল্পনাও করতে পারতো না। অনেক আঘাত পেয়েছিল লুবনা। সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল প্রচুর। সেই দু:সহ সময়টা একা একা নিজের সাথে যুদ্ধ করে পার করেছে। আর একলা পথ চলতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছে অভির মত এইসব মুখোশ পরা ভাল মানুষগুলোর। ঘেন্না করে লুবনা এদের, প্রচন্ড ঘেন্না। “সব শালা হারামি!”
*******
অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছে মুনিরা। ঘুম আসছে না। মনটা ভীষণ খারাপ। অভি আজকাল এত দূরে সরে গেছে! চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই ওর এই পরিবর্তন। এই চাকরিটা নিয়ে ওরা দুজনেই এত খুশি ছিল, অথচ এই চাকরিটাই একটা কাল পর্দার মত ওদের মাঝখানে আড়াল তৈরি করেছে। অভিকে ও বুঝতেই পারে না এখন। কথায় কথায় রেগে যায়, বকাবকি করে, এটা এমন কেন, হল না কেন, তুমি সাজো না কেন, আরেকটু পরিপাটি থাকো না কেন তাই নিয়ে হইচই করে। অভির মধ্যে মুনিরাকে নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ ছিল না। মুনিরা সবসময় সাদামাটা থাকে, খূব একটা সাজে না বা কোন কৃত্রিমতা পছন্দ করেনা। আর অভি তাতেই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আজকাল কি ভীষণ বদলে গেছে!
শুধু অভিযোগ, শুধু অভিযোগ। মুনিরা বুঝে না ওর দোষটা কোথায়? শুধু কষ্ট পায়। আজকে কি যে হল, মুনিরা আম্মার সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে তাই বলছিল। আর অভি কি একটা ধমক লাগাল, ‘রাখো তো তোমার এইসব ফালতু কথা।’ মুনিরা বুঝে না ফালতু কিসে হল। ফোন রেখে দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল একাই। আগে হলে অভি আবার ফোন করতো, স্যরি বলতো, আদর করে দিতো। কিন্তু আজকে অভি ফোনই করল না। মুনিরা বুঝে না কি এমন হল যে অভি এতটা দূরে সরে গেল। শুধু কষ্ট পায়, প্রচন্ড কষ্টে ছটফট করে।
*********
গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো শহর। রাস্তার বাতিগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। শুধু জেগে আছে তিনটি মানুষ। একই শহরের তিনপ্রান্তে নির্ঘুম তিনজোড়া চোখ। সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত, অসহায়।
সাম্প্রতিক.কম এর ১৪ই এপ্রিল সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত
অভি হয়তো ভাবে না, কিন্তু ওর মনের অনেক ভিতরে একটা তুলনা এসে যায়। মুনিরা তো এমন না। এত বছর ধরে মুনিরাকে ও দেখে আসছে, মুনিরা কখনো নিজেকে এইভাবে সাজায় না, পরিপাটি হয়ে অভির সামনে আসে না, এইভাবে চোখে চোখে কথা বলতে পারে না, বড্ড আনস্মার্ট মুনিরা, বড্ড সেকেলে.......লুবনার চার বছরের ছোট হলেও মুনিরাকে বুড়ি বুড়ি লাগে। ও কখনো অভিকে এইভাবে আকর্ষণ করেনি। ওর কাছে অভি গেছে আট বছরের অভ্যস্ততায়, কিন্তু মুনিরা সবটুকু দিয়েও ওকে কখনো জাগিয়ে তুলতে পারেনি। যা লুবনা পারে শুধু একটু চোখের তাকানোতে বা মুচকি একটু হাসিতে। অভি ভাবে আর কেমন একটা আবেশে ওর চোখ জড়িয়ে আসে।
প্রায় সারাদিন লুবনার সাথে থাকতে হয় ওকে। একদিন কি কাজে যেন একটু বেশি রাতেই অভি ফোন করেছিল লুবনাকে। ঘুমভাঙা গলায় আধো আধো কথা বলেছিল লুবনা। এত অ™ভুত ছিল ওর গলাটা, অভির গা সিরসির করে উঠেছিল। ওই গলাটা শোনার জন্য অভি এখন কোন না কোন ছুতোয় রোজ রাতে ফোন করে। লুবনা কখনো রাগ করে না। বরং কথা বলে ওর সাথে ঘন্টা পার করে। কত কথা যে বলে ও, কতভাবে যে বলে! মুনিরার সাথে রোজকার একঘেয়ে রুটিন কথার পর লুবনা যেন ওকে কল্পনার একটা জগতে নিয়ে যায়। কথায় কথায় ওদের সম্পর্কটা এখন অনেক গভীর। যদিও মুনিরার কথা কেউ ভোলে না, কিন্তু কেউ তুলেও না ওই প্রসঙ্গ। মুনিরা উহ্য থেকে যায়।
প্রথমদিকে অভির একটু একটু খারাপ লাগতো। মনে হতো ঠিক হচ্ছে না। এভাবে মুনিরাকে এড়িয়ে, ওকে ঠকিয়ে। কিন্তু এখন ও যেন লুবনার মধ্যে ডুবে গেছে। কোন কিছুই ওর আর মনে হয় না। বরং মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যায় মুনিরার ওপর। ওর খুঁতগুলো বেশি বেশি চোখে পড়ে আর তাই নিয়ে হইচই করে। যেটা কখনোই আগে করতোনা।
আজ লুবনা একটা টকটকে লাল জামা পরেছিল। তারসাথে মিলিয়ে লাল টিপ কপালে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। সন্ধ্যায় ফেরার পথে রিকশায় বসে কি কথায় যেন ভীষণ হাসছিল, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিল। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে কি যে হল, এক হাতে জড়িয়ে ধরল লুবনাকে আর গালে টুক করে একটা চুমু। কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে থেকে লুবনা আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর আবার স্বাভাবিক। কাজটা করেই অভি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ অস্বস্তি। বাসায় ফিরে, মুনিরার সাথে কথাও বলেছে অভ্যাসমত। কিন্তু সারাক্ষণই অপেক্ষা করেছে কখন রাত হবে, কখন লুবনার সাথে কথা বলবে। না, লুবনা রাগ করেনি। একবার শুধু বলেছে ‘এটা কিন্তু ঠিক না’। তারপরই আবার স্বাভাবিক। আজ কথাগুলো আরো ভাল লাগছিল শুনতে, একটা ভাল লাগায় আচ্ছন্ন অভি।
ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে লুবনার কথা। এরই ফাঁকে একবার মুনিরাকে মনে পড়ল। মুনিরাকে ভালবাসে অভি, মুনিরার সাথে এত বছরের অভ্যস্ত জীবন ছাড়া সম্ভব না। আবার লুবনার জন্যও তারমধ্যে অসম্ভব একটা আকর্ষণ। কোনটাই এড়ানো সম্ভব না অভির পক্ষে।
*****
লুবনা হাসছে। এই হাসিটা অভি কোনদিন দেখেনি। ভীষণ নিষ্ঠুর, ক্রুর একটা হাসি লুবনার ঠোঁটে। অভির জন্য ওর করুণা হচ্ছে। বেচারা!
অভিকে দেখে বেচারা শব্দটাই লুবনার মাথায় প্রথম এসেছিল। ভোলা-ভালা, বোকা-সোকা একটা ছেলে, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডির বাইরে পা রেখেছে। বুঝতে শেখার পর থেকেই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল বলে জীবনের অনেকগুলো দিক, হরেক রকম মানুষ ও দেখেনি। মুনিরার কথা ও প্রথম থেকেই বলেছে। আর শুনতে শুনতেই লুবনার মনে হয়েছে এতদিনের সম্পর্ক হলেও কোথাও একটা বড় ফাঁক আছে। ওদের সম্পর্কে একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, নির্ভরতা তৈরি হয়েছে কিন্তু কোন নতুনত্ব নেই। একঘেয়ে হয়ে গেছে। অভির চোখ তাই লুবনাকে দেখে ধাঁধায় পড়ে গেছে। ধীরে ধীরে অভির দৃষ্টির পরিবর্তন দেখেছে লুবনাকে, আর নিজেকে সেভাবেই ওর সামনে তুলে ধরেছে। অভির মুগ্ধ দৃষ্টি, প্রশংসা, তোষামোদ খুব উপভোগ করে লুবনা। ছেলেগুলো যে কি! এত বছরের একটা সম্পর্ককে তুচ্ছ করে, অবহেলা করে অভি কি করে পারে লুবনার সাথে এইসব তোষামোদী করতে। এমন তো না যে অভি বোঝে না এটা অন্যায়। লুবনার ভালই লাগে। ‘তুমি যদি নাচতে চাও, কেন আমি ঢোলে বাড়ি দিবো না?’
আসিফ চলে যাওয়ার পর থেকে লুবনা কোন ছেলেকেই বিশ্বাস করে না। কারো কথাই সত্যি বলে মানতে পারেনা। অভি যখন বলেছিল মুনিরার সাথে ওর এতদিনের সম্পর্ক, ওদের গভীর ভালবাসা, ওদের মধ্যে কখনো কোন সমস্যা বা ভুল বোঝাবুঝি হয় না, ওরা অনেক সুখী তখন অবহেলায় মনে মনে ঠো^ট বাঁকিয়েছিল লুবনা। দেখতে চাইছিল কতটা গভীর অভির ভালবাসা। আস্তে আস্তে জাল বিছিয়েছে যেভাবে অভি চেয়েছে। যাতে অভি পা দিতে চেয়েছে, নিজের অজান্তে।
আর আজকে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল। লুবনার এই হাসিটা অভি খুব পছন্দ করে। মুগ্ধ হয়ে দেখে, আজকেও তাই ঘটল। লুবনা শুধু অনিচ্ছার ভান করে করা স্পর্শটুকু অভিকে দিয়েছে। আর অভি বাধ্য হয়েছে শেষ পথটুকু অতিক্রম করতে। হাহ্ প্রেম! এত বছরের এত ভালবাসা, কই চলে গেল। সেই তো ডুবল। আপনি অন্নেক সুন্দর! অনেক এ্যাট্রাকটিভ! আপনাকে মিস করছি ভীষণ! কত কত এসএমএস। ছেলেগুলো এমন কেন? বিতৃষ্ণায় ঠোঁটের কোণাটা বেঁকে গেল লুবনার।
“সব শালা হারামি!” লুবনার খুব পছন্দের একটা কথা। যখনই েেকান ছেলের ভেতরের চেহারাটা বের হয়ে পড়ে তখনই লুবনা এই কথাটা বিড়বিড় করতে থাকে। অসহ্য লাগে সব।
আসিফের চলে যাওয়াটা লুবনার জন্য একটা ভয়াবহ আঘাত ছিল। আসিফের মধ্যে ছিল প্রচন্ড সন্দেহ। ও প্রতিটা ব্যাপারেই লুবনাকে সন্দেহ করতো। প্রথমদিকে লুবনার ভালই লাগতো। ভাবতো, ও আমার এত কেয়ার করে, সারাক্ষণ আমি কি করলাম, কই গেলাম তাই নিয়ে অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে আসিফের সন্দেহ সব সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। লুবনা আর সহ্য করতে পারেনা। প্রচন্ড ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে, সে জায়গায় জন্ম নেয় ঘৃণা। তারা দূরে সরতে থাকে একজন অন্যজনের থেকে। আর একসময় আসিফ ওকে মিথ্যে সব অপবাদ দিয়ে চলে যায় একা ফেলে। আসিফের অভিযোগগুলো শুনলে লুবনা হতভম্ব হয়ে যেতো। এইসব কখনো সে কল্পনাও করতে পারতো না। অনেক আঘাত পেয়েছিল লুবনা। সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল প্রচুর। সেই দু:সহ সময়টা একা একা নিজের সাথে যুদ্ধ করে পার করেছে। আর একলা পথ চলতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছে অভির মত এইসব মুখোশ পরা ভাল মানুষগুলোর। ঘেন্না করে লুবনা এদের, প্রচন্ড ঘেন্না। “সব শালা হারামি!”
*******
অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছে মুনিরা। ঘুম আসছে না। মনটা ভীষণ খারাপ। অভি আজকাল এত দূরে সরে গেছে! চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই ওর এই পরিবর্তন। এই চাকরিটা নিয়ে ওরা দুজনেই এত খুশি ছিল, অথচ এই চাকরিটাই একটা কাল পর্দার মত ওদের মাঝখানে আড়াল তৈরি করেছে। অভিকে ও বুঝতেই পারে না এখন। কথায় কথায় রেগে যায়, বকাবকি করে, এটা এমন কেন, হল না কেন, তুমি সাজো না কেন, আরেকটু পরিপাটি থাকো না কেন তাই নিয়ে হইচই করে। অভির মধ্যে মুনিরাকে নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ ছিল না। মুনিরা সবসময় সাদামাটা থাকে, খূব একটা সাজে না বা কোন কৃত্রিমতা পছন্দ করেনা। আর অভি তাতেই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আজকাল কি ভীষণ বদলে গেছে!
শুধু অভিযোগ, শুধু অভিযোগ। মুনিরা বুঝে না ওর দোষটা কোথায়? শুধু কষ্ট পায়। আজকে কি যে হল, মুনিরা আম্মার সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে তাই বলছিল। আর অভি কি একটা ধমক লাগাল, ‘রাখো তো তোমার এইসব ফালতু কথা।’ মুনিরা বুঝে না ফালতু কিসে হল। ফোন রেখে দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল একাই। আগে হলে অভি আবার ফোন করতো, স্যরি বলতো, আদর করে দিতো। কিন্তু আজকে অভি ফোনই করল না। মুনিরা বুঝে না কি এমন হল যে অভি এতটা দূরে সরে গেল। শুধু কষ্ট পায়, প্রচন্ড কষ্টে ছটফট করে।
*********
গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো শহর। রাস্তার বাতিগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। শুধু জেগে আছে তিনটি মানুষ। একই শহরের তিনপ্রান্তে নির্ঘুম তিনজোড়া চোখ। সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত, অসহায়।
সাম্প্রতিক.কম এর ১৪ই এপ্রিল সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন