কোরবানির জন্য গরু-ছাগল কেনাকাটার কাজটা খুবই আনন্দের। এই যেমন ধরুন, যখন আমি ছোট, তখন আব্বা আমাকে নিয়ে নদীর ধারে চলে যেতেন। সেখানেই অস্থায়ী হাট হতো। নৌকা থেকে গরু নামত, আর সেখান থেকে গরু দেখে কেনাবেচা হতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা একবার ১২৫ টাকায় গরু কিনলেন। আজ থেকে ৪৫ বছর আগের কথা বলছি। এখন এই গরুর দাম হবে হয়তো লাখ দুয়েক টাকা। সেই গরু নিয়ে যখন মহল্লায় ঢুকলাম, তখন তো পুরো মহল্লাজুড়ে মানুষ চলে এলেন। আজ এই চিত্র ভিন্ন। আর ঢাকা শহরে তো এখন এটি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন ব্যবসায়ীরা। তার পরও আমাদের হাটে যেতে হয়। সাত বছর হলো আমি আর কোরবানির পশু কেনার জন্য হাটে যাই না। শেষ অভিজ্ঞতাটি মোটেও সুখকর ছিল না। শুটিং করতে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে। বাড়ির লোকজনকে বললাম বিকেলে গাবতলী হাটে যেতে। শুটিং শেষ করে বিকেলের মধ্যেই আমি সেখানে পৌঁছাব।
এখন তো তুরাগ নদ শুকিয়ে গেছে প্রায়। তখন নদটি অনেক প্রশস্ত ছিল। ট্রাকে করে যেমন গরুর পাল আসত, তেমনি নৌকায় করে গরু নামত। বিকেলে যেই না গরুর হাটে গেলাম, মনে হলো আমি যেন নিজেই কোরবানির পশু। গরু দেখতে যেমন মানুষের ভিড়, তেমনি আমাকেও দেখতে শুরু করল মানুষ। আর জটলা দেখে বাইরের মানুষও এসে যোগ দিল সেই জটলায়। হয়তো ভিড়ের কারণে কেউ দেখতেই পারছে না। চিৎকার করে একজন আর একজনকে বলছে, ‘মনে হয় কোনো গরু মইরা আছে।’ মনে মনে বললাম, আসলেই আমি মইরা গেলাম এখানে আইসা। সবার উদ্দেশে সালাম দিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি আপনাদের মতোই একটি গরু কিনতে এসেছি।’ সবাই আমার কথা শুনে হাসে। একজন বলছেন, ‘আরে, আপনার নিজে আসতে হয় নাকি! সিনেমায় দেখি আপনার কত চ্যালাপ্যালা থাকে, হেরাই তো লইতে পারে।’ আর একজন বলছেন, ‘এই ভাই, আপনি, আপনি জানেন আপনি, কতটা খারাপ মানুষ? আপনিও আসছেন এইখানে। যান তো, এখান থেকে চলে যান।’আমি হাসব নাকি কাঁদব বুঝতে পারছি না। এবার পেছন থেকে আর একজন বলছেন, ‘যে খারাপ মানুষ আপনি, কেউ আপনার কাছে গরু বিক্রি করবে না। মানুষের ওপর কত অত্যাচার করেছেন!
আমি নিরুত্তর। বললাম, ‘ভাই, ভুল বুঝবেন না। আমাকে যেতে দিন। একটা গরু কিনেই চলে যেতে হবে।’ বলে কিছুটা চোখ রাঙিয়ে মানুষের ভিড় ঠেলেই হাটের ভেতর গেলাম। দেখলাম, একটা গরু বিক্রি হয়েছে। যিনি গরুটি কিনেছেন, তিনি গরু নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি বললাম, গরুটা ভালো। গরু ব্যবসায়ী হঠাৎ করেই বিক্রীত গরু বিক্রি করবে না বলে জানিয়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বললেন, ‘নেন, বেশি দাম না, মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।’ মেজাজটা ঠিক রাখতে হলো। বললাম, ‘তোমার গরুটি যদি মাত্র এক টাকায় দাও, তবুও আমি নেব না। কারণ ওটা আর একজন কিনেছেন, তুমি তাকেই দাও।’
আসলে ওরা মনে করে, আমরা কোটিপতি। সিনেমায় আমাদের শানশওকত দেখতে দেখতে ওদের এই ধারণা হয়েছে। ফলে আমাদের মতো লোক দেখলেই ওরা দামটা বাড়িয়ে দেয়।
অন্য একটা গরু দেখলাম। একটু আগেই যে গরুটির দাম চাওয়া হয়েছিল মাত্র ৪০ হাজার টাকা, সেখানে আমাকে দেখেই বলা হলো, ‘দাম তো ৮০ হাজার কিন্তু আপনার সম্মানে আমরা মাত্র ৭০ হাজার টাকায় গরু দিয়ে দিচ্ছি।’ আমি আর হাটে থাকলাম না। আমার বাসার লোকজনকে বললাম, রাত হোক, তখন আসা যাবে। বলে হাট থেকে অনেকটা যুদ্ধ করে বেরোতে লাগলাম। হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম, একজন বলছে, ‘বলছিলাম না, এই লোকের কাছে কেউ গরু বিক্রি করবে না। যে খারাপ মানুষ! বাপ রে বাপ!’ আমি আর না হেসে পারলাম না। রাত নয়টার পর আমি আমার লোকদের গরুর হাটে পাঠালাম। ওরা গরুর দরদাম করল। এরপর একজন এসে আমাকে খবর দিল। আমি গিয়ে যখন টাকা দিলাম, তখন গরু ব্যবসায়ী বলছেন, ‘আমি তো আপনার কাছে গরু বিক্রি করিনি।’ আমি বললাম, ‘ওরা আমারই লোক।’ গরু ব্যবসায়ী ভীষণ বিরক্ত। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমিও মানুষ। অন্যদের কাছে যে দামে বিক্রি করছেন, আমার কাছে সেই দামে গরু বিক্রি করলে সমস্যা কোথায়?’ গরু ব্যবসায়ী এবার বোধহয় একটু লজ্জাই পেলেন।
আমি এবার গরু নিয়ে রওনা হলাম। গরুটা ছিল একটু বেশি তাগড়া। বোধহয় পেছন থেকে কেউ গুঁতো দিয়েছিল, গরু তো ওমনি দিল দৌড়। এসে লাগল সোজা আমার পিঠে। আর একটু হলে তো আমাকে পায়ের নিচে পিষে ফেলত। আমি কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে গরুর গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। গরু শান্ত হলো। এরপর রশি ধরে ওকে রাস্তায় তুললাম।
এরপর আর কোরবানির সময় গরুর হাটে যাইনি। এখন ছেলেরা যায়, ওরাই নিয়ে আসে। আর চোখের সামনে গরুর হাটে যাওয়ার স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে।
[অনুলিখিত]
সূত্র : প্রথম আলো
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন