এখন বড় একা একা লাগে কমুর। কিছুই ভালো লাগে না আগের মতো। খেলার মাঠ, সঙ্গী-সাথী, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, কানামাছি, গুলতি ছোড়া, পাখি ধরা—কিছুই না। আগে মাঝেমধ্যে দল বেঁধে কর্ণফুলীতে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। সাঁতার কাটত, নৌকা বাইত। নৌকায় করে ওপার যেত, তারপর সরফভাটার নতুন কাঁচা রাস্তা ধরে বৃহৎশঙ্কর হাটের পাশ দিয়ে চলে যেত পুব দিকের নীল পাহাড়ের কাছে। সারা দিন ঘুরে বেড়াত টইটই করে। কিন্তু এখন আর ওসব কিছুই তার মন টানে না।
বিকেলে জাহিদ, হারুন, মতি, মহী, সানুরা খেলতে যায় মাঠে। কমুকে ডাকতে আসে তারা। কিন্তু কমু যায় না। ওদের হইহল্লা আর চিৎকারে তার মাথা ধরে যায়। একটা না একটা ছুতো দেখিয়ে তাই সে গা বাঁচায়। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। তারপর এক সময় আস্তে করে বেরিয়ে যায়।কর্ণফুলীর অপর তীরে চিরিঙ্গার পাহাড়। দিগন্তের কোলে চুপচাপ শুয়ে আছে জন্মকুঁড়ের মতো। এপার থেকে তাকালে ওপারে গাছগাছালির নীলচে আভাস চোখে পড়ে। সে নীলের গায়ে মানুষের পায়ে চলার আঁকাবাঁকা পথ। দূর থেকে মনে হয়, নীল জামায় সাদা ডোরা কিংবা নীল কাঁথায় সাদা সুতোর নকশা।
পড়ন্ত বেলায় সূর্য পশ্চিম আকাশের একদম শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছায়। রংহীন রোদ চকচকে সোনালি হয়ে ওঠে। দিনের শেষে ক্লান্ত পাখিরা ফিরে আসে ঝাঁক বেঁধে। কলরব করতে করতে নিজ নিজ বাসা খুঁজে নেয় চিরিঙ্গা পাহাড়ের উঁচু উঁচু গাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথায়। কর্ণফুলীর সোনালি পানিতে সোনালি পাল উড়িয়ে ভাটির দিকে ভেসে যায় পুব দিক থেকে নীল পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসা নৌকা আর সাম্পানগুলো। নৌকার গলুই অথবা পাছায় বসে থাকে মাঝিরা। আনমনে গান গায় কখনোসখনো।
কমু এসে দাঁড়ায় এখানে। আগে এদিকটায় খুব কমই আসত সে। আসার দরকার হতো না। কিন্তু এখন তার প্রতিদিন আসা চাই। কোনো দিন কোনো কারণে আসতে না পারলে মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কারণে-অকারণে রেগে ওঠে। রাতে পড়তে বসেও আনমনা হয়ে থাকে।
এখানে নিয়মিত আসা শুরু হয় রূপম আসার পর থেকে। জাহিদ-হারুনদের সঙ্গে রূপম মিশতে পারত না। ওর কথা শুনে প্রথম দিনই জাহিদ হাসতে শুরু করেছিল। তার সঙ্গে হারুন-মতিরাও।
রূপম ভীষণ অবাক হয়েছিল তাদের হাসতে দেখে। হাসার কারণ বুঝতে না পেরে ওদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। তারপর চোখমুখ লাল করে বলেছিল, ‘আমি টো হাসির কঠা বলসি না। দেন হোয়াট মেকস য়ু লাফ!’
তার রাগ দেখে জাহিদরা আরও বেশি করে হাসছিল। হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। মতি পেটে হাত চেপে রূপমের দিকে ঝুঁকে বলেছিল, ‘লাফ! কই, আমরা আবার কখন লাফালাম?’
তারপর সে তার ক্লাস সেভেনের ইংরেজি বিদ্যা ফলিয়ে বলেছিল, ‘উই নো জাম্প।’
কাণ্ড দেখে রূপমের কেঁদে ফেলার জোগাড়। কমুর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ওরা অমন করে হাসে কেন? হোয়াই দে ডু সো?’
কমুর খুব খারাপ লাগে। তার মনে হয়েছে, এটা জাহিদদের বাড়াবাড়ি। রূপম তাদের পাড়ারই ছেলে। মার কাছে শুনেছে, রূপমের বয়স যখন দুই বছর, তখন তার বাবা তাদের নিয়ে লন্ডনে চলে যান। রূপম বড় হয়েছে সেখানেই। লেখাপড়াও শিখছে সেখানে। ওর ছোট বোন রিসুও। এগারো বছর পর তার বাবা এবার দেশে ফিরে এসেছেন তাদের নিয়ে। আবার চলে যাবেন মাস খানেক বাদে। মার মুখে সে আরও শুনেছে, রূপমের বাবা এবার একেবারেই চলে যাবেন। তাই জায়গাজমি যা আছে সব বিক্রি করে দেবেন।
সুতরাং রূপম যদি তাদের মতো বাংলায় ভালোভাবে কথা বলতে না পারে, তাতে অমন হাসবার কী আছে? সে তাই ধমক দেয় জাহিদকে, ‘কী হলো, অমন হাসছিস কেন? ওকে পাগল মনে হচ্ছে নাকি তোর?’
কিন্তু তার ধমকে কাজ হলেই তো। জাহিদটা পাজির পা ঝাড়া। শেষে কমু খেপে গিয়ে বলেছে, ‘চল রূপম, আমরা এদের সঙ্গে খেলব না। আমরা দুজনে নদীর পাড়ে বেড়াব।’
বেড়াতে বেড়াতে সেদিন ওরা একদম চিরিঙ্গা পাহাড়ের কাছাকাছি এই জায়গায় এসে পৌঁছেছিল। এর পর থেকে প্রতিদিনই তারা এখানে এসে বসত। বসে বসে রাজ্যের কথা বলত।
রূপম নদী দেখত, গাছপালা দেখত, নদীতে ভেসে যাওয়া নৌকা-সাম্পানের দিকে চেয়ে থাকত। মাঝিরা গান গাইতে গাইতে ভাটির দিকে চলে যেত।
একদিন এক মাঝি গান গেয়ে যাচ্ছিল। গানের সুরটা ছিল চমৎকার। রূপম একমনে গান শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী গান, কো-মু?’
রূপম ‘কমু’ বলতে পারত না। বলত ‘কো-মু’। কমু হাসত। তার হাসিতে রূপম মোটেই রেগে যেত না। সে বুঝতে পারত, কমুর হাসি জাহিদদের হাসির মতো অভদ্র নয়। তাই সে নিজেও হাসত নিজের অপারগতায়।
গানটা রূপমের খুব ভালো লেগেছিল। কমুর কাছে শুনে শুনে তাই সুরসহ মুখস্থ করে ফেলেছিল ওটা। কমুকে সে বলত, ‘জানো কো-মু, আমি এবার লন্ডনে গেলে আমার বন্ধু অ্যান আর লরেলকে ডা-রু-ন একটা সারপ্রাইজ দেব। এই গানটা আমি বেঙ্গলিতেই গেয়ে শোনাব টাডের।’
কমু খুব উৎসাহ পেত ওর কথায়। ব্যাপারটা চিন্তা করে রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করত। মনে মনে দেখতে পেত, রূপমের মুখে বাংলা গান, তা-ও আবার আঞ্চলিক, শুনে তার বন্ধুরা কেমন হাঁ হয়ে রয়েছে। খুব মজা পেয়ে সে-ও হাততালি দিত। ‘ঠিক। দারুণ একটা আইডিয়া! তোমাকে আরও ভালো করে শিখতে হবে তাইলে। ঠিক আছে, তুমি গাও, আমি দেখি ভুলটুল হয় কি না।’
রূপম ভাঙা ভাঙা বাংলায় গাইত, ‘ছোড ছোড রে ঢেউ টুলি, লুসাই পাহাড়ট্টুন নামিয়েরে যার গৈ কর্ণফুলী...’
রূপমকে শুধিয়ে শুধিয়ে লন্ডনের গল্প শুনেছে কমু। ওই দেশে এখানকার মতো গরম নেই। সব সময় ঠান্ডা। বরফ পড়ে খুব। বড় বড় বাড়িঘর সব আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সব পাকা দালানকোঠা। রাস্তায় সারি বেঁধে গাড়ি চলে। মাটির নিচে চলে রেল ঝপাঝপ করে। টিকিট কিনতে গেলে এখানকার মতো ঠেলাঠেলি করতে হয় না। মেশিনে ঠিকমতো পয়সা ফেললে ঠিক ঠিক জিনিস বেরিয়ে আসে, আরও অনেক গল্প।
রূপম চলে গেছে প্রায় এক মাস আগে। তাদের বাড়িঘর কিনে রেখেছে কমুর বাবা। ওরা আর বাংলাদেশে আসবে না।
বিদায় নেওয়ার সময় কমুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে রূপম। চোখ মুছতে মুছতে বলেছে, ‘সি য়ু অ্যাগেইন, কো-মু। অ্যান আর লরেলকে তোমার কথা বলব আমি। টারা খুব খুশি হবে। আর, আই’ল রাইট টু য়ু, সিওর।’
কমুও না কেঁদে পারেনি তখন।
রূপম চলে যাওয়ার পর তার মনে হয়েছে, সে-ও যদি রূপমের সঙ্গে চলে যেতে পারত লন্ডনে! ওখানে নিশ্চয় এখানকার চেয়ে অনেক মজা হয়। আর এই দেশের চেয়ে সে দেশ অনেক উন্নতও নিশ্চয়। রূপম একবার বলেছিল, ঢাকা শহরের চেয়ে লন্ডন শহর নাকি ঢের বেশি বড় আর সুন্দর। কমু এখনো ঢাকা শহরও দেখেনি। সে চট্টগ্রাম শহর দেখেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ঢাকার মতো অত বড় আর সুন্দর নয়। নাজু কাকুর কাছে ঢাকার গল্প শুনেছে সে। রূপমের ভাগ্যে হিংসা হয় ওর। রূপমের বাবার মতো ওর বাবাও যদি...
প্রায় দুই বছর পর হঠাৎ একদিন রূপমের চিঠি পেল কমু। এর মধ্যে রূপম ওর কাছে চিঠি লেখেনি। কমু ওর কথা ভুলেই যাচ্ছিল প্রায়। এমন সময়ে চিঠি পেয়ে সে অবাকই হলো। রূপম লিখেছে,
‘কমু, বাংলাদেশে গিয়ে বাঙালির ছেলে হয়েও বাংলায় কথা বলতে পারিনি বলে জাহিদরা হেসেছিল। সেদিন ওদের ব্যবহারে দুঃখ পেলেও এখন আর দোষ দিচ্ছি না। তবে তোমার ব্যবহারে আমার মন ভরে গিয়েছিল। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিলে।
‘জাহিদের ব্যবহারে দুঃখ পেলেও আমার ভীষণ জেদ চেপে গিয়েছিল বাংলা শেখার জন্য। তাই এখানে এসে একজন বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে আমি আর রিসু বাংলা শিখতে শুরু করি। আব্বু বলতেন, কী লাভ হবে বাংলা শিখে? আমরা তো আর দেশে ফিরে যাচ্ছি না। কিন্তু আমি তা শুনিনি। কমু, আমি ইংল্যান্ডে থেকেও খুব কষ্ট পাই বাংলাদেশের কথা ভেবে। যদিও আমরা এখানকার নাগরিক, কিন্তু আমাদের জন্মভূমি তো বাংলাদেশ। আমার মনে হয় বাংলাদেশে তোমরা ভালোই আছ। যদিও গরিব দেশ, তবু তোমরা নিজের ঘরেই আছ। কেউ তোমাদের বলছে না যে, তোমরা বহিরাগত। তোমরা ভিনদেশি। তোমরা চলে যাও এই দেশ থেকে। গত সপ্তাহে একদল শ্বেতাঙ্গ ছেলে একটা বাঙালি ছেলেকে খুব মেরেছে। তারা আমাদের দেখলে হাসে, আমাদের উপহাস করে। তাই আমি আব্বুকে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। অথচ আমার মনে হয়, কিছুই ঠিক হবে না। যা-ই হোক, আমি বড় হলে হয়তো বাংলাদেশেই চলে আসব। কারণ বাংলাদেশ আমার দেশ। তা আমার নিজের ঘর। ইতি রূপম।’
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন