যারা সাহিত্য সম্পর্কে অনুসন্ধিত্সু, তারা রবীন্দ্র প্রতিভা নিয়ে আর আগের
মতো কোলাহলমুখর নয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির
ব্যাপারে কথা বলতে চান। অথচ এই বিষয়গুলো বর্তমান বিশ্বে কারও মনোযোগ আকর্ষণ
করে না। একটা পুরনো বিষয় হিসেবেই এর খানিকটা মূল্যায়ন করে মাত্র। এখন জগতে
আধুনিকতম বিষয় হলো ‘ইসলাম’। কারণ, ইসলাম কারও মুখাপেক্ষী নয়। সে নিজের
গৌরবে গরীয়ান এবং ধর্মের প্রশ্নে এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
জগত ও জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে আমার মনে হয় রবীন্দ্র আকাঙ্ক্ষা খানিকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অবস্থায় ছিল। কিন্তু বিশ্ব, এমনকি ভারতীয় সভ্যতা অনুসন্ধিত্সু এবং আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে আছে। কোনো উপনিষদীয় জ্ঞান এই আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। আমি অবশ্য এখানে ধর্মের প্রসঙ্গ আনতে ইচ্ছুক নই; কিন্তু মর্মের প্রসঙ্গ অবশ্যই উত্থাপিত হতে পারে। মানুষের মন পুরনো, প্রাচীন এবং অতীতে তলিয়ে যাওয়া কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন বা মননশীল সাহিত্যের দিকে আগ্রহহীন নয়। জগত ঘুরছে। একটা কথা আছে না—‘গান্ধীজী যদি মরে যান/ জগত্ হবে না খান খান/ পৃথিবী ঘুরবে’। আমরা অনুভব করছি, পৃথিবী ঘুরেই চলেছে। আর পৃথিবীর গতি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে গেলে সব রহস্যের উত্তর দিতে পারে এমন কোনো ধর্মীয় আদর্শের কাছেই মানব জাতিকে আশ্রয়ের আশায় ভিড় জমাতে হবে।
শোনা যায়, ‘বাবেল’ বলে একটি স্থান থেকে মানুষের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। সেই বিচ্ছেদের কাহিনী হলো ‘বাইবেল’। ‘বাবেল’ থেকে ‘বাইবেল’। যাই হোক, বাবেল থেকেই মানুষের ভাষাও আলাদা হয়ে গেছে। এক গোত্রের ভাষা অন্য গোত্রের ভাষা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। কীভাবে সেটা ঘটেছিল, আজ আর সে কথা মানবজাতির মনে নেই। তবে মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে সিজদায় যাওয়া; এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য এক গোপন ও নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা কাজ করে চলেছে।
এই আকাঙ্ক্ষার পরিণতি কোনো উপনিষদীয় জ্ঞানে আমরা খুঁজে পাই না। এটা খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামের মধ্যে। কারণ, ইসলাম সর্বত্রগামী। ধর্মীয় এবং জাতিগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকার পরও ইসলাম মানবজাতির ঐক্যের নির্দেশনা দিতে পারে। আর এই নির্দেশনার কথা আমরা শুনতে পাই কাজীর কবিতায়—“জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে/ অন্ধকারের এ ভেদ-জ্ঞান/ অ-ভেদ ‘আহাদ’ মন্ত্রে টুটিবে/ সকলে হইবে এক সমান।” সব মানুষকে এক করার এই মন্ত্র রবীন্দ্রনাথ আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির উত্তরসূরি হলেও ভারতীয় মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির দিগন্তে তাঁর বিচরণ খুবই সীমাবদ্ধ।
রবীন্দ্র প্রতিভার এটা এক রহস্যময় ব্যাপার যে, তিনি মূল ভাষায় গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ পাঠ করার তাড়না থেকে আশি বছর বয়সে জর্মন ভাষা শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু তার জমিদারি এস্টেটের অধিকাংশ প্রজার ধর্মীয় গ্রন্থটি অনুধাবন করার চেষ্টা কখনও করেননি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এই গূঢ় রহস্যের কারণেই সর্বত্রগামী হতে পারেননি। যদিও তিনি লিখেছিলেন—‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই দু’চোখ মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া/ একটি ঘাসের শীষের ওপর/ একটি শিশির বিন্দু।’ রবীন্দ্রনাথের পরিবারে ফার্সি সাহিত্য এবং সেই সুবাদে হাদিস শাস্ত্র নিয়েও কিছুটা চর্চা ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। অথচ এর উত্তরাধিকারিত্ব তিনি গ্রহণ করেননি। তার সৃজনে এর প্রভাব থাকলেও মননে ছিল না। যে ভাষায় তিনি আজীবন লিখে গেছেন, সে ভাষার অধিকাংশ মানুষের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা কেন যে তাঁকে ছুঁতে পারেনি, সেটা এক রহস্যময় ব্যাপারই বটে। এ কারণেই একদা আমি আমার একটি কবিতায় লিখেছিলাম—
‘কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে?’
না, আমার কোনো কৌতূহল নেই।
আমার নাম, মাহমুদ। পিতা, আবদুর রব। জাতি মুসলমান। পেশা কৃষিকার্য।
ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যাওয়া সর্বপ্রকাশ আনন্দ ও বিনোদে আমি উত্তরাধিকার খুঁজে নিরাশ।
কেউ আমার জন্যে রেখে যাননি কোনো অমৃত, কোনো আশা ও উদয়।
আমি দেখেছি কেবল অস্তগমনের জন্য প্রতীক্ষারত কিষাণ,
বলদ ও জোয়াল
কর্ষণের ঘাম শুষে নেয়ার জন্য একই সাথে গোধূলির দিকে
ফুরফুরে হাওয়ার প্রতীক্ষা।
আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ।
রুপোর পৈচিবাঁধা কর্মঠ নারীর নগ্ন বাহু।
শাড়ি ও শরীরে মাড়াইয়ের গন্ধ।
ধানভানা গতরে নৃত্যরত দু’টি বুকের আহ্বান।
ঐ দাড়িঅলা সন্তের ছবি আমার ঘরে টাঙিয়েছে আমারই ছেলেমেয়েরা!
আহা, তারা কি করে জানবে ঐ ছবি আমার কাছে
অনাদায়ী খাজনার সর্বশেষ নোটিশের কথাই বারবার মনে পড়িয়ে দ্যায়?
জগত ও জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে আমার মনে হয় রবীন্দ্র আকাঙ্ক্ষা খানিকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অবস্থায় ছিল। কিন্তু বিশ্ব, এমনকি ভারতীয় সভ্যতা অনুসন্ধিত্সু এবং আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে আছে। কোনো উপনিষদীয় জ্ঞান এই আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। আমি অবশ্য এখানে ধর্মের প্রসঙ্গ আনতে ইচ্ছুক নই; কিন্তু মর্মের প্রসঙ্গ অবশ্যই উত্থাপিত হতে পারে। মানুষের মন পুরনো, প্রাচীন এবং অতীতে তলিয়ে যাওয়া কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন বা মননশীল সাহিত্যের দিকে আগ্রহহীন নয়। জগত ঘুরছে। একটা কথা আছে না—‘গান্ধীজী যদি মরে যান/ জগত্ হবে না খান খান/ পৃথিবী ঘুরবে’। আমরা অনুভব করছি, পৃথিবী ঘুরেই চলেছে। আর পৃথিবীর গতি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে গেলে সব রহস্যের উত্তর দিতে পারে এমন কোনো ধর্মীয় আদর্শের কাছেই মানব জাতিকে আশ্রয়ের আশায় ভিড় জমাতে হবে।
শোনা যায়, ‘বাবেল’ বলে একটি স্থান থেকে মানুষের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। সেই বিচ্ছেদের কাহিনী হলো ‘বাইবেল’। ‘বাবেল’ থেকে ‘বাইবেল’। যাই হোক, বাবেল থেকেই মানুষের ভাষাও আলাদা হয়ে গেছে। এক গোত্রের ভাষা অন্য গোত্রের ভাষা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। কীভাবে সেটা ঘটেছিল, আজ আর সে কথা মানবজাতির মনে নেই। তবে মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে সিজদায় যাওয়া; এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য এক গোপন ও নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা কাজ করে চলেছে।
এই আকাঙ্ক্ষার পরিণতি কোনো উপনিষদীয় জ্ঞানে আমরা খুঁজে পাই না। এটা খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামের মধ্যে। কারণ, ইসলাম সর্বত্রগামী। ধর্মীয় এবং জাতিগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকার পরও ইসলাম মানবজাতির ঐক্যের নির্দেশনা দিতে পারে। আর এই নির্দেশনার কথা আমরা শুনতে পাই কাজীর কবিতায়—“জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে/ অন্ধকারের এ ভেদ-জ্ঞান/ অ-ভেদ ‘আহাদ’ মন্ত্রে টুটিবে/ সকলে হইবে এক সমান।” সব মানুষকে এক করার এই মন্ত্র রবীন্দ্রনাথ আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির উত্তরসূরি হলেও ভারতীয় মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির দিগন্তে তাঁর বিচরণ খুবই সীমাবদ্ধ।
রবীন্দ্র প্রতিভার এটা এক রহস্যময় ব্যাপার যে, তিনি মূল ভাষায় গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ পাঠ করার তাড়না থেকে আশি বছর বয়সে জর্মন ভাষা শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু তার জমিদারি এস্টেটের অধিকাংশ প্রজার ধর্মীয় গ্রন্থটি অনুধাবন করার চেষ্টা কখনও করেননি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এই গূঢ় রহস্যের কারণেই সর্বত্রগামী হতে পারেননি। যদিও তিনি লিখেছিলেন—‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই দু’চোখ মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া/ একটি ঘাসের শীষের ওপর/ একটি শিশির বিন্দু।’ রবীন্দ্রনাথের পরিবারে ফার্সি সাহিত্য এবং সেই সুবাদে হাদিস শাস্ত্র নিয়েও কিছুটা চর্চা ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। অথচ এর উত্তরাধিকারিত্ব তিনি গ্রহণ করেননি। তার সৃজনে এর প্রভাব থাকলেও মননে ছিল না। যে ভাষায় তিনি আজীবন লিখে গেছেন, সে ভাষার অধিকাংশ মানুষের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা কেন যে তাঁকে ছুঁতে পারেনি, সেটা এক রহস্যময় ব্যাপারই বটে। এ কারণেই একদা আমি আমার একটি কবিতায় লিখেছিলাম—
‘কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে?’
না, আমার কোনো কৌতূহল নেই।
আমার নাম, মাহমুদ। পিতা, আবদুর রব। জাতি মুসলমান। পেশা কৃষিকার্য।
ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যাওয়া সর্বপ্রকাশ আনন্দ ও বিনোদে আমি উত্তরাধিকার খুঁজে নিরাশ।
কেউ আমার জন্যে রেখে যাননি কোনো অমৃত, কোনো আশা ও উদয়।
আমি দেখেছি কেবল অস্তগমনের জন্য প্রতীক্ষারত কিষাণ,
বলদ ও জোয়াল
কর্ষণের ঘাম শুষে নেয়ার জন্য একই সাথে গোধূলির দিকে
ফুরফুরে হাওয়ার প্রতীক্ষা।
আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ।
রুপোর পৈচিবাঁধা কর্মঠ নারীর নগ্ন বাহু।
শাড়ি ও শরীরে মাড়াইয়ের গন্ধ।
ধানভানা গতরে নৃত্যরত দু’টি বুকের আহ্বান।
ঐ দাড়িঅলা সন্তের ছবি আমার ঘরে টাঙিয়েছে আমারই ছেলেমেয়েরা!
আহা, তারা কি করে জানবে ঐ ছবি আমার কাছে
অনাদায়ী খাজনার সর্বশেষ নোটিশের কথাই বারবার মনে পড়িয়ে দ্যায়?
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন