এক.
সুন্দর এই পৃথিবী উপকরণ সম্ভারে ভরপুর। সুখ-সমৃদ্ধির কোনো কমতি নেই। সভ্যতার চাকা ঘুরছে অবিরত। চোখ ধাঁধানো নির্মাণ, কারুকার্যময় শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই। সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মহান রাব্বুল আলামীন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব তাঁর অফুরন্ত নেয়ামত। কিন্তু এগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত উপযোগ ও ব্যবহারযোগ্য হয় না, যে পর্যন্ত কোনো কৌশল, কোনো শ্রম বা প্রযুক্তির প্রয়োগ তাতে না ঘটে। ভূমিতে ফসল ফলত না যদি মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাতে ফসল না ফলাত। আল্লাহ তাআলা মাটির নিচে হিরক, পিতল, তামা, লোহা ও জানা-অজানা অসংখ্য রত্ন ভাণ্ডার লুকায়িত রেখেছেন। কিন্তু যদি খনি খননকারীর সুতীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সুনিপুণ কর্মকৌশল তাতে প্রয়োগ না হতো, তবে অলংকারের স্বর্ণালী রূপময়তা দেখে কারো চোখ জুড়াতো না। ডুবুরীরা যদি তার অমিত সাহসে সমুদ্র সেচে হীরা-মুক্তা-রত্ন আহরণ না করত তবে অনুসন্ধিৎসু দল বঞ্চিত হতো। সবকিছুর মূলে রয়েছে একদল শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, ঘাম ঝরানো ক্লেশ, একনিষ্ঠ শ্রম। শ্রমিকের শ্রম না থাকলে কালের চাকা থেমে যেতো, সভ্যতা থমকে দাঁড়াতো, পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলত। এজন্য শ্রমিকদের বলা হয় সভ্যতার কারিগর। শ্রমিকের শ্রমই হচ্ছে সভ্যতার প্রধান নিয়ামক। শ্রমিকদের ওপর একটি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এরা সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত ও নির্যাতিত। প্রায় প্রতিটি দেশেই এদেরকে নিজেদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়। মালিক শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা তাদেরকে বাধ্য করে নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে। এ ধরনের শ্রমিক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ট্রাজেডির নাম ‘মে দিবস’। দুই. আমাদের জীবনে শ্রম একটি অপরিহার্য বিষয়। আল্লাহর এই সৃষ্টিকুলের অফুরন্ত নেয়ামতরাজিকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার পেছনে শ্রমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সভ্যতার চোখ ধাঁধানো অগ্রগতির নেপথ্যে কাজ করছে শ্রম। আমরা দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকি। মানুষ সুউচ্চ মনোরম অট্টালিকায় বাস করে আয়েশ করার পেছনে রয়েছে একদল শ্রমিকের ঘামঝরানো ক্লেশ। কিন্তু তারা এই আরামের বিন্দুমাত্রও উপভোগ করতে পারে না। রাসূল সা. শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষদেরকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কারণ যারা সৃষ্টির কল্যাণের জন্য নিজেদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়, তারা আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী। রাসূল সা. বলেছেন, ‘এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই যা মানুষ স্বহস্তে উপার্জনের মাধ্যমে করে। হযরত দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির করতেন।’ রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহ তাআলা যাকেই নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন তিনিই ছাগল চরিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ আমিও সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম।’ হালাল উপার্জনকে ইসলামের অন্যতম ফরজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লিখিত হাদীসসমূহ থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম শ্রমের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। ইসলাম শ্রমকে যেমন মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে, তেমনি শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ব্যাপারেও ইসলামে রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। পৃথিবীতে যত ধর্ম ও মতবাদ রয়েছে, তার মধ্যে ইসলাম শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমাদের অধীনস্ত ব্যক্তিদেরকে আপন সন্তানদের মতো স্নেহ-সমীহ করো। আর নিজেরা যা খাও তাদেরকেও তাই খাওয়াও।’ অন্যত্র বলেন, তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ শ্রমিকের মজুরী যথাযথ আদায় না আদায় না করার পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ কেয়ামতের দিন আমার মমতাময়ী আশ্রয় থেকে সেই ব্যক্তি বঞ্চিত হবে যে কোনো শ্রমিককে নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেয়ার চুক্তিতে নিয়োগ করে, অতঃপর তার কাছ থেকে পূর্ণ শ্রম ও কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তাকে (পূর্ণ) পারিশ্রমিক দেয় না।’ শ্রমিকের অধিকার আদায়ে ইসলাম নিম্নোক্ত নীতিমালা গ্রহণ করেছে- (ক) শ্রমজীবী মানুষদেরকে রাসূল সা. মালিক-পুঁজিপতিদের ভাই বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাই সমাজে সে ততটুকু পদমর্যাদা ও সম্মান পাবে, যা সমাজের অন্য সদস্যরা পেয়ে থাকে। পেশার কারণে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না। (খ) শ্রমিক যে প্রতিষ্ঠান বা মালিকের কাজ করবে তার ওপর দায়িত্ব হচ্ছে উক্ত শ্রমিকের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা। (গ) কোনো শ্রমিকের ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয়া যাবে না। (ঘ) কাজ শেষ হলে পারিশ্রমিক আদায়ে কোনো ধরনের গড়িমসি করা চলবে না। (ঙ) শ্রমজীবীদের সহায়তার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সহজ কিস্তিতে ঋণ দিতে হবে। (চ) একজন শ্রমিক ইচ্চা করলে মালিকের সঙ্গে মূলধনে শরীক হতে পারবে। উল্লিখিত নীতিমালাসমূহের আলোকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম শ্রমিকের সর্বোচ্চ ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে, যা অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কল্পনাও করা যায় না। তিন. বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে চলছে বিরোধ ও সংঘাত। মালিক শ্রেণী চায় কিভাবে শ্রমিকদেরকে বেশি কাজ করিয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়া যায়। পক্ষান্তরে শ্রমিকেরা চায় ঠিক মতো কাজ না করেই পূর্ণ মজুরী আদায় করে নিতে। উভয় শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মনোভাবের ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দূরত্বের। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত পুঁজিবাদী মতাদর্শে শ্রমিক শ্রেণী গোলামের সমতুল্য। তাদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণের প্রয়োজন নেই। অপরদিকে সমাজতন্ত্র শ্রমিকদেরকে একটি কলের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। তাদের মতে শ্রমিকের দায়িত্ব শুধু কাজ করে যাওয়া। লাভ-ক্ষতি নিয়ে মাথা ঘামানো শ্রমিকের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ইসলাম এ দু’ শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে সুন্দর পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। একদিকে মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষেরা তোমাদের ভাই, সুতরাং তোমরা তাদের সঙ্গে ভাইসুলভ আচরণ কর। অন্যদিকে শ্রমিকদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিক মতো পালন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে উভয়ের মাঝে সুমধুর সম্পর্ক বিরাজ করে। বর্তমান বিশ্বে চলছে মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা আর শ্রমিকদের হঠকারিতা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও প্রাইভেট কোম্পানীগুলোতে চাকরিরত শ্রমিকদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ সুযোগে মালিক শ্রেণী ইচ্ছেমতো খাটাচ্ছে তার অধীনস্ত শ্রমিকদের। তাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বিভিন্ন টালবাহানা করে। কোনো ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা করে না তারা। অপরদিকে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিকদেরকে জিম্মি করে তাদের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত। অধিকার আদায়ের তারা যে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হচ্ছে না। আন্দোলনের নামে দিনের পর দিন কল-কারখানার চাকা বন্ধ রেখে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে। ফলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে তিক্ততা বাড়ছে বৈ কমছে না। বর্তমানে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এটা সর্বজন স্বীকৃত। পুঁজিবাদী বিশ্বে আজ শ্রমিকদের ওপর চলছে অধিকার হরণের খড়গ। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে পর্যন্ত শোষিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষেরা। আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে এদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের মহিলা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। নানান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তারা এ কাজে যোগ দেয়। অথচ তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে অমানবিক আচরণ। দৈনিক বার-চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করেও তাদের বেতন মাত্র এক থেকে দু হাজারের মধ্যে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সামান্য বেতন দিয়ে নাগরিক জীবনে কোনো রকম বেঁচে আছে তারা। অথচ তাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আজ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। চার. প্রতি বছর মে দিবসে শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়। সকল নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম চলছেও অব্যাহতভাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো মতবাদই শ্রমিকের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম নয়। শ্রমিকদের হারানো অধিকার ফিরে পেতে হলে প্রয়োজন ইসলামী শ্রমনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। একমাত্র ইসলামই পারবে তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের সোনালী যুগে মালিক-শ্রমিক পরস্পরে ভাইয়ে পরিণত হয়েছিল। তাদের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল মিষ্টি-মধুর সম্পর্ক। আন্দোলন বা সংগ্রাম করে নয় বরং ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত মালিকরাই প্রাপ্যের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছিল শ্রমিকদেরকে। হযরত আবু যর গিফারী রা. তার গোলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একই পোশাক পরিধান এবং হযরত ওমর রা. তার গোলামের সঙ্গে পালাক্রমে উটের পিটে চড়ে মরুভূমি অতিক্রম সে কথাই প্রমাণ করে। প্রতি বছর মে দিবস আসে, গতানুগতিক ধারায় পালিত হয়। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে এ দিনে মাতামাতি হয় অনেক। কিন্তু দিনটি চলে গেলে হতভাগ্য শ্রমিকদের নিয়ে আর গরজ বোধ করে না কেউই। এভাবে হাজারো মে দিবস অতিবাহিত হলেও আদায় হবে না এ দিবসের প্রকৃত দাবি। তাই শ্রমিকদের অধিকার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সম্মিলিতভাবে ইসলামী শ্রমনীতি অনুসরণ করতে হবে। এতেই রয়েছে মালিক-শ্রকিমক উভয়ের সাফল্যের হাতছানি। zahirbabor@yahoo.com |
|
http://www.sonarbangladesh.com/articles/ZahirUddinBabar |
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন