চষবধংব ভড়ত্মরাব সব, ও ধস ংড়ত্ত্ু, ও ষড়াব ুড়ঁ, ঞযধহশ ুড়ঁ—বাক্য চারটি
আওড়াতে আওড়াতে পথ চলে সুহিতা। মনের পাতে খুঁজে পেতে দেখে নেয় বৈরিতার
ফাটল-ধরানো সম্পর্কগুলো। যাপিত সময় প্রবাহে কার সঙ্গে কখন, কেন বিরূপতার
সৃষ্টি হয়েছে—তার একটা নিখুঁত নির্ঘণ্ট তৈরি করতে করতে স্মৃতিসায়রে নামে
সুহিতা। স্মৃতির ঢেউ সরিয়ে যাদের খুঁজে পায় তাদের উদ্দেশে মন্ত্রের মতো
বাক্যগুলো উচ্চারণ করে, যেন বিরাট হাঁ-করা ফাটল মেরামত করছে প্রাণপণে। ফাটল
তো বটেই। সম্পর্কের ভিতগুলো খুব স্পর্শকাতর—সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে
অচিরেই ফাটল ধরে। অনেকগুলো আপন-সম্পর্ক অযত্নে প্রায় ভেঙে পড়েছে। কিছুটা
সুহিতার অভিমান। অভিমানের তীব্রতা ক্রমেই দানবের মতো ফুঁসে উঠতে উঠতে
সম্পর্কের বিন্দুমাত্র সৌহার্দ্যবোধকেও গ্রাস করে। আর এ দানবীয় ক্ষুধার
কাছে সুহিতা নিঃশেষ হতে থাকে।
বিষয়টা ছিল জমি-জমা সংক্রান্ত। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার সময় পারিবারিক বৈঠক বসে। সুহিতা বাড়ির ছোট হিসেবে সামনের অংশটা দাবি করে বসে। প্রস্তাবটা সবাই মেনে নিলেও এতে ভেটো প্রদান করে বড় বুজি। সুহিতা খুব আহত হয়। আদরের বোন হিসেবে কোনো আবদারই তার অগ্রাহ্য করেনি পরিবার, বিশেষত বুজির মতো সহজ-সরল মানুষ তো নয়ই। অথচ এ ব্যাপারটায় বুজির আপত্তি লক্ষ্য করে সুহিতা খুব অবাক হয় এবং অনুমান-নির্ভরতায় উপলব্ধি করে, এই ভেটো প্রদান বুজির নয়, নেপথ্যে ক্রিয়াশীল অন্য কেউ। তো অভিমানের জন্ম এখান থেকেই। কোলে-পিঠে করে যে তাকে মানুষ করেছে তাঁর প্রতি সুহিতার ঋণ যথেষ্ট, কিন্তু মাতৃ-স্নেহের ছায়াটুকুও বিনষ্ট হয়ে গেছে বুজির। জমি-জমার লালসা যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিতগুলোও সমূলে উত্পাটন করে বিশুষ্ক-শ্রীহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে—এই প্রথম উপলব্ধি করল সুহিতা। ক’দিন-ক’রাত ঘুমাতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে। চিরপরিচিত মুখগুলো অচেনা মনে হয়। পৈতৃক বাড়ির সম্মুখ অংশটিতে সে মনে মনে দখল বসায়। সেখানে কেউ উঁকি দেয়ার মতো সামান্য ফাঁক-ফোকরও অবশিষ্ট রাখে না। ক্রমেই সবাইকে তার শত্রু মনে হতে থাকে। আজন্ম ঘনিষ্ঠতায় নির্ভরশীল সম্পর্কগুলো গোষ্ঠীবদ্ধ মেঘের বিচ্ছিন্ন-খণ্ডতায় শিথিল হয়। তার ভাবনা সর্পিল গতিতে, অগ্নস্ফুিলিঙ্গ তোড়ে গতিময় হয়। চোখের পাতায় ঘুম বসে না, এপাশ-ওপাশ করে। মঈন বিরক্ত হয়।
: আহ্- এত নড়াচড়া করছো কেন? ঘুমুতে দাও।
মঈন ঘুমের ডিস্টার্ব সহ্য করতে পারে না। খুব ভোরে ওকে রওনা হতে হয়, সাভারে একটা ট্রেনিং কলেজে কাজ করছে।
ব্যাপারটা মঈনকে বলেনি। ও খুব পজিটিভ মানুষ, অনেকটাই প্রো-অ্যাকটিভ। ব্যাপারটা শুনে হয়তো সুহিতাকেই দোষারোপ করবে। সুহিতার কেন্দ্রীভূত মন ওই অংশটি ছাড়া অন্য কিছুতেই সায় দেয় না। যখন থেকেই নিজস্ব একটা বাড়ির তেষ্টা অনুভব করেছে, তখন থেকেই সে খুঁজে ফিরছে রাস্তার পাশে দক্ষিণমুখী একটি সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ি। বাড়িটির সম্মুখভাগ থাকবে খোলা; সেখানে থাকবে অজস্র ফুল, ফুলের বাগান। দেয়াল ঘেঁষে থাকবে দু’একটা নারকেল-সুপুরি গাছ কিংবা বিশাল গন্ধরাজ, টগর, মাধবীলতা। ফুলের সৌরভ সকাল-সাঁঝে সবাইকে আনমনা করে তুলবে। প্রাত্যহিক বাস্তবতার টানাপড়েন থেকে ক্ষণিকের ছুটি মিলবে। প্রশান্ত মন লাভ-ক্ষতির অংক ভুলে ভালোবাসায় নিমগ্ন হবে। কখনও খোলা ছাদে বসে উপভোগ করবে বিশাল বিশাল বৃক্ষের সগর্ব উত্থানচিত্র কিংবা চাঁদের আলোয় বসাবে চায়ের আসর, সেই সঙ্গে মৃদু স্বরে বাজবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। হিম-কুয়াশায় ভেজা চাঁদ, ভেজা মেঘ দেখে দেখে স্নান করবে হিম-জোছনায়।
রাস্তার ওপারে অনতিদূরে বৃক্ষের চূড়ায় ফুটবে নানা ফুল। শালবৃক্ষের স্নিগ্ধ-আলোয় ধোয়া সাদাটে ফুল, রাধাচূড়ার হলদে রঙ কিংবা সোনালু ফুলের স্বর্গীয় আভা যখন মাতিয়ে তুলবে চারপাশ, দূর থেকে দেখে দেখে অ-জাগতিক আনন্দানুভূতিতে শিউরে উঠবে সুহিতা। তখন মনে এসে ভর করবে কবিতা—‘খুলে দাও দ্বার/নীলাকাশ করো অবারিত:/কৌতূহলী পুষ্পগন্ধ কক্ষে মোর করুক প্রবেশ/প্রথম রৌদ্রের আলো/সর্বদেহে হোক সঞ্চারিত শিরায় শিরায়।’ দক্ষিণমুখী বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বৃক্ষ-ফুলের শ্যামলিমায় অবগাহন করতে করতে কাটবে সুখময় সময়। এমনটি না হলে জীবনের পূর্ণতার অনেকটাই অপূর্ণতার দাবি রাখে। এরকম স্বপ্ন সুহিতার মনের জমিনে নির্ভয়ে-নিরাপদে বসত গড়ে তুলেছে, একে বাস্তুহারা করে বিষাদদৃশ্য নির্মাণে সুহিতা অপারগ। স্বপ্নটার শেকড় এখন এত গভীরে প্রোথিত যে, একে উপড়ে ফেললে ওর পৃথিবী নীরস হয়ে উঠবে। স্বপ্ন-বীজ উপ্ত হয়ে অঙ্কুরোদগমনের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে মঈন। মঈনকেই দায়ী করে সুহিতা। এমনি একটি বাড়ির মালিক উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্য ছিল ওরা। ইচ্ছে করলেই বাড়িটার মালিক ওরা হতে পারত। সবাই-ই জানত বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে মঈন বাড়ি পাবে। মাত্র দু’ভাইয়ের পিতৃহীন সংসারে বড় ভাই সংসারের হাল ধরেছে। ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে মাথায় যখন আকাশ ভেঙে পড়ল, তখন মঈন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের পরীক্ষারত ছাত্র। দূরদর্শী মা ছেলেকে বাবার মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে পরীক্ষা-পর্ব শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে আর বাবার দেখা পেল না। শোক স্তিমিত হয়ে এলে ব্যবসার হাল ধরল। পাশাপাশি চলল চাকরির চেষ্টা। বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে একটা চাকরি জুটলে ধুঁকে চলা ব্যবসাটার পরিসমাপ্তি টেনে দিল। স্বচ্ছ-বেতনের গণ্ডিতে বাঁধা সংসারে প্রয়োজনটুকু স্বীকার করে উদ্বৃত্ত আর তেমন থাকে না। তবুও মিতব্যয়িতার কঠোর শাসনে সঞ্চিত অর্থের আনুকূল্যে ঘরে তোলে সুহিতাকে।
শ্বশুরবাড়ির পরিচ্ছন্ন নিরিবিলি সংসার সুহিতার ভালো লেগে যায়। একতলা বাড়ির সামনে লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দার পিলার জড়িয়ে লতানো মানিপ্ল্যান্ট সজীব-মমতায় বাড়িটাকে জড়িয়ে ধরেছে। বারান্দার সামনে এক চিলতে বাগান। সেই বাগানে তেমন গাছ নেই, মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানে জন্মেছে বুনো ঘাস, ফুল আর পিঁপড়ের বাসা। এলোমেলো অগোছালো জায়গায় সুহিতা সুন্দর বাগান গড়ে তোলে। সামনের গেটে বাগান-বিলাস। শীতের শেষে আগুন রঙা ফুল ফুটে বাড়ি আলো হয়ে থাকে। গেটের পাশে পাকা রাস্তা। মফস্বল এলাকায় ব্যস্ততার আড়ম্বর নেই, রাস্তায় দু’একটা রিকশার টিং টিং শব্দ কিংবা কখন-সখনও হঠাত্ শহর থেকে আসা পাড়া-প্রতিবেশীর গাড়ির আওয়াজ। এছাড়া পুরো সময়ই নিস্তব্ধ-নীরবতায় রাস্তা এবং বাড়িগুলো ধ্যানমগ্ন থাকে। রাস্তার উল্টো পাশে তুলসিদের বাড়ির সুপুরি-নারকেল গাছের গর্ভধারণ, ফলন্ত হওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে দেখতে ঋতু-চক্রের আবর্তন উপলব্ধি করা কিংবা পশ্চিম পাশের মাঠ পেরিয়ে হিন্দু-বাড়ির পারিপাট্য দেখতে দেখতে সময় কাটে সুহিতার। মমতার নিশ্ছিদ্র আবরণ নিঃশব্দে ছায়া ফেলে। লোডশেডিংয়ের সুযোগে মঈনকে নিয়ে খোলা ছাদে অভিসার, ছোট উঠোনে সবার সঙ্গে গল্পচারিতা, জোছনায় বিজন-পথে হাঁটা—এমনি মধুর সময় প্রবাহে স্বপ্নিল একটা জগত গড়ে উঠে ছোট বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। মনের বৈভবে সাজিয়ে শ্রীময় করে অন্তঃপুর। ঝুল ঝেড়ে, টবে জল-ফুল সাজিয়ে নিপুণ শিল্পীর কারুকার্যে নান্দনিক-বিভায় পূর্ণ করে তোলে বাড়ির প্রতিটি কক্ষ। বহুমাত্রিক ছন্দোময় রৈখিকতায়, দ্যুতিময় জীবন-আলোয় ভাসতে থাকে সুহিতা।
একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। মঈনের চাকরির ট্রান্সফার। এভাবে অনেকদিন, অনেক জায়গায়—অবশেষে স্থিত হয় ঢাকায়। ছোট বাসা, ঘিঞ্জি, আলো নেই, বাতাস নেই—মধ্যাহ্নের প্রখর আলোতেও ঘরের ভেতর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলোয় নিষ্প্রাণ উদ্ভাসন। প্রথম প্রথম মনে হতো কারাগার, তারপর খাঁচা আর এখন সুহিতার মনে হয় নাগরিক-অভিশাপ। আশা রূপ একবিন্দু আলো হিরক-বিভার প্রোজ্জ্বল ভূমিকায় প্রোথিত থাকে অন্তরে। সে আলো নির্ভরতা পায় বাড়িকে কেন্দ্র করে। সুহিতা জানে, নাগরিক জীবন প্রবাহে যতই আবাসন-ক্লেশ-গ্লানি থাকুক না কেন, এর থেকে রিলিফ পেয়ে একদিন সে পরিচ্ছন্ন বাড়ির আঙিনাতেই দাঁড়াবে। কিন্তু সে স্বপ্ন মঈন ভেঙে দেয়। মঈন ভেঙেছে না তাকে বাধ্য করা হয়েছে, সে রহস্যাবৃত কাহিনী কেবল সুহিতাই জানে। এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল মঈনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। বৈষয়িক-বিষয়ে পারদর্শী কৌশলী শেলী হস্তগত করে বাড়িটা। মঈনের পেছনে শেলীর ব্যস্ততম সাধনা সফল-পরিণতি পায় যখন এ বিষয়টির ক্ষেত্রে সবাই একতরফাভাবে সায় না দিলেও মঈন সায় দেয়। নিজ পরিবার, নিজ সন্তান, পিতৃভূমি অধিকার—সবকিছু তুচ্ছ করে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মঈন এ কাজটি সমাধা করে। সুহিতার সরলতা, আবেগময়তা শেলীর কৌশলী-ভূমিকার কাছে অকাট-মূর্খতায় পর্যবসিত হয়। মঈন সুহিতার অনুপস্থিতিতে শেলীর স্বার্থে হাত মেলায়। বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল ভাইয়ের স্বার্থে। তবে এক্ষেত্রে ভাই নিস্তেজ ও নীরব। মঈনের ঝোলায় তুলে দেয়া হয় অলস, নিষ্প্রাণ কিছু পতিত জমি। সুহিতার খারাপ লাগলেও মঈনের এতে সুখী-ভাব দেখে আর কোনো মন্তব্য করেনি। যে ছেলে নিজ অধিকার সহজেই ত্যাগ করে, সেখানে পরের মেয়ে হয়ে সুহিতা কী বলবে। তবে সুহিতার দূরদর্শী মন একটা বিষয় অনুমান করে কষ্ট পেল যে, তার সন্তানরা ভবিষ্যতে পিতামহের বাড়িতে আর ঠাঁই পাবে না। বাড়ির কিছুটা অংশ রেখে দিলেও মঈন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিত।
শ্বশুর বাড়ির স্বপ্ন প্রদীপ নিভে যাওয়াতে সুহিতার ভাবনা ঠাঁই পায় বাবার বাড়ির আঙিনায়। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। তিন বোনের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম নয়। সুহিতার পছন্দের জায়গা বেহাত হওয়ার ভাবনায় নিষ্প্রাণ সময় যাপন করে। বুজির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর শীতলতায় পৌঁছেছে, আর সুহিতার আপাদমস্তক ক্রমাগত অগ্নিদাহের উষ্ণ-প্রস্রবণে তোলপাড় হচ্ছে। আহার-নিদ্রা-কর্ম শৃঙ্খলছিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি গড়াগড়ি খাচ্ছে। এদিকে বুজিও তার সিদ্ধান্তে অটল। মনের ক্লান্তি ঘোচে না সুহিতার। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়। একদিন কিছুটা রিলাক্স হওয়ার উদ্দেশ্যে যোগ দেয় এক আলোচনা সভায়। সভাটা অনুষ্ঠিত হয় পাবলিক লাইব্রেরিতে। আলোচনায় মন বসাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। এদিক-ওদিক নজর দিতেই চোখে পড়ে পরিচিত একটি মুখ। সুশান্ত। ঠিক চিনতে পারে সুহিতা। ক্লাসমেট সুশান্ত। ওদের দু’জনের নামের আগে ‘সু’ উপসর্গ থাকায় ক্লাসের বন্ধুরা ‘সু-সু’ বলে প্রায়ই মজা করত। প্রায় বছর পাঁচেক পর দেখা। সুশান্ত পছন্দ করত সুহিতাকে। কলা ভবনের সবুজ চত্বরে স্মৃতিময় হয়ে আছে কত কথা। ক্লাসের দুষ্টুমিটা বেশ উপভোগ করত ওরা। তারপর এক সময় কিছু না জানিয়েই বিদেশ পাড়ি দেয়। সুহিতা সুশান্তকে বন্ধুত্বের সীমায় আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সুশান্তের অনুভূতি সে সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যখন অন্যকিছু দাবি করে, তখন সুহিতা তাকে বাধা দেয়। অনেকটা অভিমানের ধার নিয়েই লাপাত্তা হয় সুশান্ত, আজ এতদিন পর ওকে দেখে খুব ভালো লাগে। সামনের চেয়ার ছেড়ে পেছনে এসে সুহিতার পাশে বসে সুশান্ত। অনেকটা বিস্ময়ভরা গলায় বলে :
: সু, তোমাকে দেখতে পাব এত সহজে ভাবতেই পারিনি।
: আমিও পারিনি, তো, কেমন আছো।
: ভেরি নাইস, তুমি কেমন?
: আমি ভালো আছি, দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে কিছু জানাওনি। কোথায় সেটেল হয়েছো?
: হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে।
: ওখানে কেন?
: বলতে পারো স্বেচ্ছা নির্বাসন।
: নির্বাসন কেন?
: সে তো তুমিই ভালো জানো।
: আমি কিছুই জানি না। বলেই হাসতে থাকে সুহিতা।
তুমি খুব ছেলেমানুষ সুশান্ত, চলো বাইরে কোথাও বসি। এই আলোচনায় তোমার সঙ্গে গল্প হবে না। দু’জন বেরিয়ে এসে লাইব্রেরি-চত্বরের রেস্টুরেন্টে বসে।
: সু, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছো?
: ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?
: তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি।
: বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করেই, তাতে কী?
: আমি তোমার সঙ্গে কেবল বন্ধু হয়ে থাকতে চাইনি।
: সে আমি জানি।
: জানো সু, আমি এখন ভাবি, আমি কী বোকামি করেছি তোমার সঙ্গে।
: বোকামি নয় সুশান্ত, সময়ের দাবি ছিল বলেই প্রত্যাশা রেখেছো।
: আমি যখন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে যাই, আমার মন খুব বিধ্বস্ত ছিল। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো, ওদের একটা মেথড আমাকে ভীষণ বদলে দেয়। আমি দারুণ ইন্সপায়ারড হই।
: কী মেথড?
: ফোর থাউজ্যান্ড ইয়ার’স এগোস মেথড। প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো মেথড। ওরা বিশ্বাস করে যে, কারও মনে কোনো কষ্ট থাকলে তা দূর করা যায় একটি মন্ত্রের মাধ্যমে।
: মন্ত্র? কী আবোল তাবোল বকছো। এই সুপার-সায়েন্সের যুগে মন্ত্র কী কাজে আসবে?
: বিলিভ মি. এটাই মিরাক্কেল। আমি নিজে ট্রাই করে সাকসেস হয়েছি।
: তোমার কষ্ট দূর হয়েছে?
: ডেফিনিটিল, আই অ্যাম সাকসেসফুল।
: কীভাবে বুঝলে?
: তোমাকে দেখে, তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো। আমার এখন আর কোনো কষ্ট নেই।
সুহিতা হাসতে থাকে। সত্যিই ও সুশান্তকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
সুশান্তের উন্মাদনা ওকে ছুঁতে পারেনি। ধর্ম তো একটা বাধা ছিলই, তাছাড়া সুশান্তকে জীবনঙ্গী করার চিন্তাতীত ভাবনায় ছিল সুহিতা।
: শুধু তুমি নও, অন্যদের সম্পর্কেও আমার ট্রিটমেন্ট কার্যকর হয়েছে। সু, তুমি এই মেথড ট্রাই করতে পারো। ধরো তোমারও এমন হতে পারে যে, সম্পর্কের তিক্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে আছো কারও সঙ্গে। এই মন্ত্রটা কয়েকবার জপলেই সাকসেস হবে।
: মন্ত্রটা কী? বিশল্যকরণী মহৌষধটা বলো তো!
: তুমি যাকে কষ্ট দিয়েছো, তাকে স্মরণ করে তার উদ্দেশে বলবে—ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড়.
: মানে?
: এর মানে হলো—চষবধংব ভড়ত্মরবাব সব. ও ধস ংড়ত্ত্ু. ও ষড়াব ুড়ঁ, ঃযধহশ ুড়ঁ. যখনই সময় পাবে, এই মন্ত্রটা বার বার পড়বে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে। এতে তোমার মনের কষ্ট দূর হবে। সেও তোমাকে ক্ষমা করে দেবে।
সুহিতার মনোকষ্ট সম্পর্কের নিবিড়তাকে লাভাসম উত্তপ্ততায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। মন্ত্রটা তার আওড়ানো দরকার।
: হ্যাঁ সুশান্ত বলো, আর কী মেথড জানো?
: সু, প্লিজ ফান করো না।
: রিয়েলি, আমি ফান করছি না। আমি শুনতে চাইছি।
: হ্যাঁ, আরেকটি মেথডও তুমি মানতে পারো, ক্যানাডিয়ান, চধু রঃ ভড়িধত্ফ.
: এক্সপ্লেইন করো।
: এর মনে মানুষকে হেল্প করা, তুমি কারও দ্বারা উপকৃত হয়েছো, পরে তাকে হেল্প করা, সে ব্যক্তি জীবিত নেই। কিন্তু সামনে তুমি অন্য কাউকেও হেল্প করতে পারো।
: সুশান্ত, আমাদের প্রাচ্যে এসব ভূরি ভূরি মেথড আছে। এখন মানুষ মেডিটেশন করছে—এটিই তো যথেষ্ট, আর মেডিটেশন করে মানুষ নিজকে অ্যাকটিভ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পারছে কি? এসব খুব জটিল মনস্তত্ত্ব। বাদ দাও, এতদিন পর দেখা, চলো বাসায় যাবে। মঈনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। দুপুরে ভাত খেয়ে যাবে, কী গো—মাংস চলবে তো?
: অ্যাজ ইউ লাইক।
রাতে বিছানায় শুয়ে সুহিতা ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড় মন্ত্র জপে। কাকে উদ্দেশ করে জপবে? সম্পর্কের তিক্ততায় অনেকে আছে। বড় বুজির কথা মনে হয়। বুজি ওর সঙ্গে কথা বলে না। সুহিতা জন্মের পর ওর মা আঠারো মাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। তখন বড় বুজিই সুহিতাকে লালন-পালন করেছে। এই গল্প কত্তো যে শুনেছে সুহিতা। আজ সেই বুজি মুখ ফিরিয়েছেন। সুশান্তের কানাডিয়ান মেথড মনে হয়। চধু রঃ ভড়িধত্ফ, সুহিতা গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়, বড় বুজির সঙ্গে সম্পর্ক তো মা-মেয়ের মতো। সুহিতাকে বুজি স্নেহ-মমতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুহিতা কি ভুল করছে? চধু রঃ ভড়িধত্ফ বাক্যটি বার বার বলতে থাকে সুহিতা। উদ্ভ্রান্তের মতো সারারাত জেগে থাকে। ভাবনার অতলে ডুবে মুক্তোর খোঁজ পায় সুহিতা।
পরদিন ঘুম ঘুম চোখে ছোটে বুজির বাড়িতে। নামাজ শেষ করে বুজি সবে চায়ের কেটলি চাপিয়েছেন চুলায়। গেটে শব্দ হয়। এত সকালে কে আসবে, বুজি আন্দাজ করতে পারেন না। মালতির মা কাজে আসে রোদ যখন দোরগোড়ায় পৌঁছায়। মালতির মা তো নয়, তাহলে কে? এগিয়ে গিয়ে গেট খোলেন। সুহিতাকে দেখে বুজি চমকে যান। দু’পা পিছিয়ে আসেন। সুহিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ভেতরে ঢুকে গেট আটকে দেয়। তারপর বসে পড়ে বুজির পায়ের কাছে। সুহিতা হু হু করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। বুজিকে জড়িয়ে ধরে। বুজিও সুহিতাকে কোলে তুলে নেন—ঠিক ছেলেবেলার মতো। অবুঝ শিশু যেমন মায়ের কোলে পরম নির্ভরতা খুঁজে পায়, সুহিতাও অনেকদিন পর আপন কোলটি খুঁজে পায়।
বিষয়টা ছিল জমি-জমা সংক্রান্ত। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার সময় পারিবারিক বৈঠক বসে। সুহিতা বাড়ির ছোট হিসেবে সামনের অংশটা দাবি করে বসে। প্রস্তাবটা সবাই মেনে নিলেও এতে ভেটো প্রদান করে বড় বুজি। সুহিতা খুব আহত হয়। আদরের বোন হিসেবে কোনো আবদারই তার অগ্রাহ্য করেনি পরিবার, বিশেষত বুজির মতো সহজ-সরল মানুষ তো নয়ই। অথচ এ ব্যাপারটায় বুজির আপত্তি লক্ষ্য করে সুহিতা খুব অবাক হয় এবং অনুমান-নির্ভরতায় উপলব্ধি করে, এই ভেটো প্রদান বুজির নয়, নেপথ্যে ক্রিয়াশীল অন্য কেউ। তো অভিমানের জন্ম এখান থেকেই। কোলে-পিঠে করে যে তাকে মানুষ করেছে তাঁর প্রতি সুহিতার ঋণ যথেষ্ট, কিন্তু মাতৃ-স্নেহের ছায়াটুকুও বিনষ্ট হয়ে গেছে বুজির। জমি-জমার লালসা যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিতগুলোও সমূলে উত্পাটন করে বিশুষ্ক-শ্রীহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে—এই প্রথম উপলব্ধি করল সুহিতা। ক’দিন-ক’রাত ঘুমাতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে। চিরপরিচিত মুখগুলো অচেনা মনে হয়। পৈতৃক বাড়ির সম্মুখ অংশটিতে সে মনে মনে দখল বসায়। সেখানে কেউ উঁকি দেয়ার মতো সামান্য ফাঁক-ফোকরও অবশিষ্ট রাখে না। ক্রমেই সবাইকে তার শত্রু মনে হতে থাকে। আজন্ম ঘনিষ্ঠতায় নির্ভরশীল সম্পর্কগুলো গোষ্ঠীবদ্ধ মেঘের বিচ্ছিন্ন-খণ্ডতায় শিথিল হয়। তার ভাবনা সর্পিল গতিতে, অগ্নস্ফুিলিঙ্গ তোড়ে গতিময় হয়। চোখের পাতায় ঘুম বসে না, এপাশ-ওপাশ করে। মঈন বিরক্ত হয়।
: আহ্- এত নড়াচড়া করছো কেন? ঘুমুতে দাও।
মঈন ঘুমের ডিস্টার্ব সহ্য করতে পারে না। খুব ভোরে ওকে রওনা হতে হয়, সাভারে একটা ট্রেনিং কলেজে কাজ করছে।
ব্যাপারটা মঈনকে বলেনি। ও খুব পজিটিভ মানুষ, অনেকটাই প্রো-অ্যাকটিভ। ব্যাপারটা শুনে হয়তো সুহিতাকেই দোষারোপ করবে। সুহিতার কেন্দ্রীভূত মন ওই অংশটি ছাড়া অন্য কিছুতেই সায় দেয় না। যখন থেকেই নিজস্ব একটা বাড়ির তেষ্টা অনুভব করেছে, তখন থেকেই সে খুঁজে ফিরছে রাস্তার পাশে দক্ষিণমুখী একটি সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ি। বাড়িটির সম্মুখভাগ থাকবে খোলা; সেখানে থাকবে অজস্র ফুল, ফুলের বাগান। দেয়াল ঘেঁষে থাকবে দু’একটা নারকেল-সুপুরি গাছ কিংবা বিশাল গন্ধরাজ, টগর, মাধবীলতা। ফুলের সৌরভ সকাল-সাঁঝে সবাইকে আনমনা করে তুলবে। প্রাত্যহিক বাস্তবতার টানাপড়েন থেকে ক্ষণিকের ছুটি মিলবে। প্রশান্ত মন লাভ-ক্ষতির অংক ভুলে ভালোবাসায় নিমগ্ন হবে। কখনও খোলা ছাদে বসে উপভোগ করবে বিশাল বিশাল বৃক্ষের সগর্ব উত্থানচিত্র কিংবা চাঁদের আলোয় বসাবে চায়ের আসর, সেই সঙ্গে মৃদু স্বরে বাজবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। হিম-কুয়াশায় ভেজা চাঁদ, ভেজা মেঘ দেখে দেখে স্নান করবে হিম-জোছনায়।
রাস্তার ওপারে অনতিদূরে বৃক্ষের চূড়ায় ফুটবে নানা ফুল। শালবৃক্ষের স্নিগ্ধ-আলোয় ধোয়া সাদাটে ফুল, রাধাচূড়ার হলদে রঙ কিংবা সোনালু ফুলের স্বর্গীয় আভা যখন মাতিয়ে তুলবে চারপাশ, দূর থেকে দেখে দেখে অ-জাগতিক আনন্দানুভূতিতে শিউরে উঠবে সুহিতা। তখন মনে এসে ভর করবে কবিতা—‘খুলে দাও দ্বার/নীলাকাশ করো অবারিত:/কৌতূহলী পুষ্পগন্ধ কক্ষে মোর করুক প্রবেশ/প্রথম রৌদ্রের আলো/সর্বদেহে হোক সঞ্চারিত শিরায় শিরায়।’ দক্ষিণমুখী বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বৃক্ষ-ফুলের শ্যামলিমায় অবগাহন করতে করতে কাটবে সুখময় সময়। এমনটি না হলে জীবনের পূর্ণতার অনেকটাই অপূর্ণতার দাবি রাখে। এরকম স্বপ্ন সুহিতার মনের জমিনে নির্ভয়ে-নিরাপদে বসত গড়ে তুলেছে, একে বাস্তুহারা করে বিষাদদৃশ্য নির্মাণে সুহিতা অপারগ। স্বপ্নটার শেকড় এখন এত গভীরে প্রোথিত যে, একে উপড়ে ফেললে ওর পৃথিবী নীরস হয়ে উঠবে। স্বপ্ন-বীজ উপ্ত হয়ে অঙ্কুরোদগমনের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে মঈন। মঈনকেই দায়ী করে সুহিতা। এমনি একটি বাড়ির মালিক উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্য ছিল ওরা। ইচ্ছে করলেই বাড়িটার মালিক ওরা হতে পারত। সবাই-ই জানত বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে মঈন বাড়ি পাবে। মাত্র দু’ভাইয়ের পিতৃহীন সংসারে বড় ভাই সংসারের হাল ধরেছে। ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে মাথায় যখন আকাশ ভেঙে পড়ল, তখন মঈন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের পরীক্ষারত ছাত্র। দূরদর্শী মা ছেলেকে বাবার মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে পরীক্ষা-পর্ব শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে আর বাবার দেখা পেল না। শোক স্তিমিত হয়ে এলে ব্যবসার হাল ধরল। পাশাপাশি চলল চাকরির চেষ্টা। বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে একটা চাকরি জুটলে ধুঁকে চলা ব্যবসাটার পরিসমাপ্তি টেনে দিল। স্বচ্ছ-বেতনের গণ্ডিতে বাঁধা সংসারে প্রয়োজনটুকু স্বীকার করে উদ্বৃত্ত আর তেমন থাকে না। তবুও মিতব্যয়িতার কঠোর শাসনে সঞ্চিত অর্থের আনুকূল্যে ঘরে তোলে সুহিতাকে।
শ্বশুরবাড়ির পরিচ্ছন্ন নিরিবিলি সংসার সুহিতার ভালো লেগে যায়। একতলা বাড়ির সামনে লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দার পিলার জড়িয়ে লতানো মানিপ্ল্যান্ট সজীব-মমতায় বাড়িটাকে জড়িয়ে ধরেছে। বারান্দার সামনে এক চিলতে বাগান। সেই বাগানে তেমন গাছ নেই, মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানে জন্মেছে বুনো ঘাস, ফুল আর পিঁপড়ের বাসা। এলোমেলো অগোছালো জায়গায় সুহিতা সুন্দর বাগান গড়ে তোলে। সামনের গেটে বাগান-বিলাস। শীতের শেষে আগুন রঙা ফুল ফুটে বাড়ি আলো হয়ে থাকে। গেটের পাশে পাকা রাস্তা। মফস্বল এলাকায় ব্যস্ততার আড়ম্বর নেই, রাস্তায় দু’একটা রিকশার টিং টিং শব্দ কিংবা কখন-সখনও হঠাত্ শহর থেকে আসা পাড়া-প্রতিবেশীর গাড়ির আওয়াজ। এছাড়া পুরো সময়ই নিস্তব্ধ-নীরবতায় রাস্তা এবং বাড়িগুলো ধ্যানমগ্ন থাকে। রাস্তার উল্টো পাশে তুলসিদের বাড়ির সুপুরি-নারকেল গাছের গর্ভধারণ, ফলন্ত হওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে দেখতে ঋতু-চক্রের আবর্তন উপলব্ধি করা কিংবা পশ্চিম পাশের মাঠ পেরিয়ে হিন্দু-বাড়ির পারিপাট্য দেখতে দেখতে সময় কাটে সুহিতার। মমতার নিশ্ছিদ্র আবরণ নিঃশব্দে ছায়া ফেলে। লোডশেডিংয়ের সুযোগে মঈনকে নিয়ে খোলা ছাদে অভিসার, ছোট উঠোনে সবার সঙ্গে গল্পচারিতা, জোছনায় বিজন-পথে হাঁটা—এমনি মধুর সময় প্রবাহে স্বপ্নিল একটা জগত গড়ে উঠে ছোট বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। মনের বৈভবে সাজিয়ে শ্রীময় করে অন্তঃপুর। ঝুল ঝেড়ে, টবে জল-ফুল সাজিয়ে নিপুণ শিল্পীর কারুকার্যে নান্দনিক-বিভায় পূর্ণ করে তোলে বাড়ির প্রতিটি কক্ষ। বহুমাত্রিক ছন্দোময় রৈখিকতায়, দ্যুতিময় জীবন-আলোয় ভাসতে থাকে সুহিতা।
একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। মঈনের চাকরির ট্রান্সফার। এভাবে অনেকদিন, অনেক জায়গায়—অবশেষে স্থিত হয় ঢাকায়। ছোট বাসা, ঘিঞ্জি, আলো নেই, বাতাস নেই—মধ্যাহ্নের প্রখর আলোতেও ঘরের ভেতর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলোয় নিষ্প্রাণ উদ্ভাসন। প্রথম প্রথম মনে হতো কারাগার, তারপর খাঁচা আর এখন সুহিতার মনে হয় নাগরিক-অভিশাপ। আশা রূপ একবিন্দু আলো হিরক-বিভার প্রোজ্জ্বল ভূমিকায় প্রোথিত থাকে অন্তরে। সে আলো নির্ভরতা পায় বাড়িকে কেন্দ্র করে। সুহিতা জানে, নাগরিক জীবন প্রবাহে যতই আবাসন-ক্লেশ-গ্লানি থাকুক না কেন, এর থেকে রিলিফ পেয়ে একদিন সে পরিচ্ছন্ন বাড়ির আঙিনাতেই দাঁড়াবে। কিন্তু সে স্বপ্ন মঈন ভেঙে দেয়। মঈন ভেঙেছে না তাকে বাধ্য করা হয়েছে, সে রহস্যাবৃত কাহিনী কেবল সুহিতাই জানে। এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল মঈনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। বৈষয়িক-বিষয়ে পারদর্শী কৌশলী শেলী হস্তগত করে বাড়িটা। মঈনের পেছনে শেলীর ব্যস্ততম সাধনা সফল-পরিণতি পায় যখন এ বিষয়টির ক্ষেত্রে সবাই একতরফাভাবে সায় না দিলেও মঈন সায় দেয়। নিজ পরিবার, নিজ সন্তান, পিতৃভূমি অধিকার—সবকিছু তুচ্ছ করে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মঈন এ কাজটি সমাধা করে। সুহিতার সরলতা, আবেগময়তা শেলীর কৌশলী-ভূমিকার কাছে অকাট-মূর্খতায় পর্যবসিত হয়। মঈন সুহিতার অনুপস্থিতিতে শেলীর স্বার্থে হাত মেলায়। বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল ভাইয়ের স্বার্থে। তবে এক্ষেত্রে ভাই নিস্তেজ ও নীরব। মঈনের ঝোলায় তুলে দেয়া হয় অলস, নিষ্প্রাণ কিছু পতিত জমি। সুহিতার খারাপ লাগলেও মঈনের এতে সুখী-ভাব দেখে আর কোনো মন্তব্য করেনি। যে ছেলে নিজ অধিকার সহজেই ত্যাগ করে, সেখানে পরের মেয়ে হয়ে সুহিতা কী বলবে। তবে সুহিতার দূরদর্শী মন একটা বিষয় অনুমান করে কষ্ট পেল যে, তার সন্তানরা ভবিষ্যতে পিতামহের বাড়িতে আর ঠাঁই পাবে না। বাড়ির কিছুটা অংশ রেখে দিলেও মঈন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিত।
শ্বশুর বাড়ির স্বপ্ন প্রদীপ নিভে যাওয়াতে সুহিতার ভাবনা ঠাঁই পায় বাবার বাড়ির আঙিনায়। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। তিন বোনের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম নয়। সুহিতার পছন্দের জায়গা বেহাত হওয়ার ভাবনায় নিষ্প্রাণ সময় যাপন করে। বুজির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর শীতলতায় পৌঁছেছে, আর সুহিতার আপাদমস্তক ক্রমাগত অগ্নিদাহের উষ্ণ-প্রস্রবণে তোলপাড় হচ্ছে। আহার-নিদ্রা-কর্ম শৃঙ্খলছিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি গড়াগড়ি খাচ্ছে। এদিকে বুজিও তার সিদ্ধান্তে অটল। মনের ক্লান্তি ঘোচে না সুহিতার। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়। একদিন কিছুটা রিলাক্স হওয়ার উদ্দেশ্যে যোগ দেয় এক আলোচনা সভায়। সভাটা অনুষ্ঠিত হয় পাবলিক লাইব্রেরিতে। আলোচনায় মন বসাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। এদিক-ওদিক নজর দিতেই চোখে পড়ে পরিচিত একটি মুখ। সুশান্ত। ঠিক চিনতে পারে সুহিতা। ক্লাসমেট সুশান্ত। ওদের দু’জনের নামের আগে ‘সু’ উপসর্গ থাকায় ক্লাসের বন্ধুরা ‘সু-সু’ বলে প্রায়ই মজা করত। প্রায় বছর পাঁচেক পর দেখা। সুশান্ত পছন্দ করত সুহিতাকে। কলা ভবনের সবুজ চত্বরে স্মৃতিময় হয়ে আছে কত কথা। ক্লাসের দুষ্টুমিটা বেশ উপভোগ করত ওরা। তারপর এক সময় কিছু না জানিয়েই বিদেশ পাড়ি দেয়। সুহিতা সুশান্তকে বন্ধুত্বের সীমায় আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সুশান্তের অনুভূতি সে সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যখন অন্যকিছু দাবি করে, তখন সুহিতা তাকে বাধা দেয়। অনেকটা অভিমানের ধার নিয়েই লাপাত্তা হয় সুশান্ত, আজ এতদিন পর ওকে দেখে খুব ভালো লাগে। সামনের চেয়ার ছেড়ে পেছনে এসে সুহিতার পাশে বসে সুশান্ত। অনেকটা বিস্ময়ভরা গলায় বলে :
: সু, তোমাকে দেখতে পাব এত সহজে ভাবতেই পারিনি।
: আমিও পারিনি, তো, কেমন আছো।
: ভেরি নাইস, তুমি কেমন?
: আমি ভালো আছি, দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে কিছু জানাওনি। কোথায় সেটেল হয়েছো?
: হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে।
: ওখানে কেন?
: বলতে পারো স্বেচ্ছা নির্বাসন।
: নির্বাসন কেন?
: সে তো তুমিই ভালো জানো।
: আমি কিছুই জানি না। বলেই হাসতে থাকে সুহিতা।
তুমি খুব ছেলেমানুষ সুশান্ত, চলো বাইরে কোথাও বসি। এই আলোচনায় তোমার সঙ্গে গল্প হবে না। দু’জন বেরিয়ে এসে লাইব্রেরি-চত্বরের রেস্টুরেন্টে বসে।
: সু, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছো?
: ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?
: তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি।
: বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করেই, তাতে কী?
: আমি তোমার সঙ্গে কেবল বন্ধু হয়ে থাকতে চাইনি।
: সে আমি জানি।
: জানো সু, আমি এখন ভাবি, আমি কী বোকামি করেছি তোমার সঙ্গে।
: বোকামি নয় সুশান্ত, সময়ের দাবি ছিল বলেই প্রত্যাশা রেখেছো।
: আমি যখন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে যাই, আমার মন খুব বিধ্বস্ত ছিল। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো, ওদের একটা মেথড আমাকে ভীষণ বদলে দেয়। আমি দারুণ ইন্সপায়ারড হই।
: কী মেথড?
: ফোর থাউজ্যান্ড ইয়ার’স এগোস মেথড। প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো মেথড। ওরা বিশ্বাস করে যে, কারও মনে কোনো কষ্ট থাকলে তা দূর করা যায় একটি মন্ত্রের মাধ্যমে।
: মন্ত্র? কী আবোল তাবোল বকছো। এই সুপার-সায়েন্সের যুগে মন্ত্র কী কাজে আসবে?
: বিলিভ মি. এটাই মিরাক্কেল। আমি নিজে ট্রাই করে সাকসেস হয়েছি।
: তোমার কষ্ট দূর হয়েছে?
: ডেফিনিটিল, আই অ্যাম সাকসেসফুল।
: কীভাবে বুঝলে?
: তোমাকে দেখে, তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো। আমার এখন আর কোনো কষ্ট নেই।
সুহিতা হাসতে থাকে। সত্যিই ও সুশান্তকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
সুশান্তের উন্মাদনা ওকে ছুঁতে পারেনি। ধর্ম তো একটা বাধা ছিলই, তাছাড়া সুশান্তকে জীবনঙ্গী করার চিন্তাতীত ভাবনায় ছিল সুহিতা।
: শুধু তুমি নও, অন্যদের সম্পর্কেও আমার ট্রিটমেন্ট কার্যকর হয়েছে। সু, তুমি এই মেথড ট্রাই করতে পারো। ধরো তোমারও এমন হতে পারে যে, সম্পর্কের তিক্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে আছো কারও সঙ্গে। এই মন্ত্রটা কয়েকবার জপলেই সাকসেস হবে।
: মন্ত্রটা কী? বিশল্যকরণী মহৌষধটা বলো তো!
: তুমি যাকে কষ্ট দিয়েছো, তাকে স্মরণ করে তার উদ্দেশে বলবে—ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড়.
: মানে?
: এর মানে হলো—চষবধংব ভড়ত্মরবাব সব. ও ধস ংড়ত্ত্ু. ও ষড়াব ুড়ঁ, ঃযধহশ ুড়ঁ. যখনই সময় পাবে, এই মন্ত্রটা বার বার পড়বে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে। এতে তোমার মনের কষ্ট দূর হবে। সেও তোমাকে ক্ষমা করে দেবে।
সুহিতার মনোকষ্ট সম্পর্কের নিবিড়তাকে লাভাসম উত্তপ্ততায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। মন্ত্রটা তার আওড়ানো দরকার।
: হ্যাঁ সুশান্ত বলো, আর কী মেথড জানো?
: সু, প্লিজ ফান করো না।
: রিয়েলি, আমি ফান করছি না। আমি শুনতে চাইছি।
: হ্যাঁ, আরেকটি মেথডও তুমি মানতে পারো, ক্যানাডিয়ান, চধু রঃ ভড়িধত্ফ.
: এক্সপ্লেইন করো।
: এর মনে মানুষকে হেল্প করা, তুমি কারও দ্বারা উপকৃত হয়েছো, পরে তাকে হেল্প করা, সে ব্যক্তি জীবিত নেই। কিন্তু সামনে তুমি অন্য কাউকেও হেল্প করতে পারো।
: সুশান্ত, আমাদের প্রাচ্যে এসব ভূরি ভূরি মেথড আছে। এখন মানুষ মেডিটেশন করছে—এটিই তো যথেষ্ট, আর মেডিটেশন করে মানুষ নিজকে অ্যাকটিভ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পারছে কি? এসব খুব জটিল মনস্তত্ত্ব। বাদ দাও, এতদিন পর দেখা, চলো বাসায় যাবে। মঈনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। দুপুরে ভাত খেয়ে যাবে, কী গো—মাংস চলবে তো?
: অ্যাজ ইউ লাইক।
রাতে বিছানায় শুয়ে সুহিতা ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড় মন্ত্র জপে। কাকে উদ্দেশ করে জপবে? সম্পর্কের তিক্ততায় অনেকে আছে। বড় বুজির কথা মনে হয়। বুজি ওর সঙ্গে কথা বলে না। সুহিতা জন্মের পর ওর মা আঠারো মাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। তখন বড় বুজিই সুহিতাকে লালন-পালন করেছে। এই গল্প কত্তো যে শুনেছে সুহিতা। আজ সেই বুজি মুখ ফিরিয়েছেন। সুশান্তের কানাডিয়ান মেথড মনে হয়। চধু রঃ ভড়িধত্ফ, সুহিতা গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়, বড় বুজির সঙ্গে সম্পর্ক তো মা-মেয়ের মতো। সুহিতাকে বুজি স্নেহ-মমতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুহিতা কি ভুল করছে? চধু রঃ ভড়িধত্ফ বাক্যটি বার বার বলতে থাকে সুহিতা। উদ্ভ্রান্তের মতো সারারাত জেগে থাকে। ভাবনার অতলে ডুবে মুক্তোর খোঁজ পায় সুহিতা।
পরদিন ঘুম ঘুম চোখে ছোটে বুজির বাড়িতে। নামাজ শেষ করে বুজি সবে চায়ের কেটলি চাপিয়েছেন চুলায়। গেটে শব্দ হয়। এত সকালে কে আসবে, বুজি আন্দাজ করতে পারেন না। মালতির মা কাজে আসে রোদ যখন দোরগোড়ায় পৌঁছায়। মালতির মা তো নয়, তাহলে কে? এগিয়ে গিয়ে গেট খোলেন। সুহিতাকে দেখে বুজি চমকে যান। দু’পা পিছিয়ে আসেন। সুহিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ভেতরে ঢুকে গেট আটকে দেয়। তারপর বসে পড়ে বুজির পায়ের কাছে। সুহিতা হু হু করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। বুজিকে জড়িয়ে ধরে। বুজিও সুহিতাকে কোলে তুলে নেন—ঠিক ছেলেবেলার মতো। অবুঝ শিশু যেমন মায়ের কোলে পরম নির্ভরতা খুঁজে পায়, সুহিতাও অনেকদিন পর আপন কোলটি খুঁজে পায়।
সুত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন