আমি আদিবাসী মেয়ে। বয়স বাইশ। পাহাড় থেকে সমতল ভূমিতে আমি কখনও আসিনি।
পরিবারের দুঃখ-কষ্টের দিকে তাকিয়ে একটা এনজিওতে শিক্ষা কার্যক্রমে চাকরি
নিই। শৈশবে আমার দিনগুলো কেটেছে নাচ-গান আনন্দ-উৎসবে স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে
অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ি মেয়ে তাই পাহাড়কে আমি মনপ্রাণ উজাড় করে প্রেমিক
হিসেবে বুকে স্থান দিয়েছি। পাহাড়ের ঝর্ণায় অবাধ সাঁতার কেটেছি। অরণ্যের ফুল
দিয়ে মালা গেঁথেছি, সেই মালা খোঁপায় বেঁধে 'ছিমুই পাইংখইং তম্রইং ম্রইং
অক্যোয়াইংরোহ থংমা হিয়াহলে' গান গেয়ে আনন্দে নেচেছি। সেই দিনগুলোর কথা
স্মৃতিপটে মনে হলেই চোখ হয়ে যায় অশ্রুনদী, হৃদয় হয়ে যায় ক্ষতবিক্ষত, তখন
সুখ ছিল আদিবাসী গ্রামে। অন্যরকম সুখ। ছোট ছোট গ্রাম ছোট ছোট সুখ। তখন
সমাজে শোষণ-বঞ্চনা ছিল না। শোষণ-বঞ্চনার অর্থই আমরা জানতাম না; কিন্তু আজ
অরণ্য নেই, আদিবাসীদের সে জীবনও নেই। পাহাড় ঠিকই আছে, কিন্তু পাহাড়ের ওপর
আমাদের অধিকার নেই। সব হারিয়ে আজ আমরা অসহায়, বিপন্ন। হঠাৎ সমতল ভূমির
হায়েনারা এসে আমার প্রেমিক পাহাড়কে ছিনতাই করে নিয়ে গেল। আমি খুব কষ্ট করে
আইএ পাস করি। আমার পরিবারের সবাই অশিক্ষিত। আমরা খুবই গরিব। বাবা
ভ্যানচালক। চাকরি নেওয়ার আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল আদিবাসী মেয়েদের
অগ্রাধিকার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে; কিন্তু চাকরি নিয়ে দেখি
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলোর একটাও মানা হচ্ছে না। চাকরিতে কত ট্রেনিং
করেছি, ট্রেইনার কত ভালো ভালো কথা বলেছে; কিন্তু সেগুলো ছিল কথার ফুলঝুরি
মাত্র।
চাকরি নিয়ে আমাদের সংসারের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে; কিন্তু আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত মুখোশধারীরা। অফিসে সুযোগ পেলেই বাঙালি বড়কর্তা, ছোটকর্তা এমনকি আমার সহকর্মীরাও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিত। ওরা মুখে মানবাধিকারের কথা বলত। নারীর ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলত। কিন্তু মনেপ্রাণে ওরা ছিল ওসবের বিরুদ্ধে। একদিন শুনলাম ময়মনসিংগ্যা থেকে একজন বাঙালি মুসলমান আমাদের অফিসে বদলি হয়ে আসছেন। ভয়ে আরও আতঙ্কিত হলাম। যথাসময়ে সে এলো। তার কথাবার্তা চাল-চলনে আমি অবাক হলাম। একদিন অফিসে মিটিং হচ্ছে। বস আমাকে বললেন, তুমি বেলালকে নিয়ে স্টোর রুম থেকে বই নিয়ে এসো। আমি না বললাম। একে একে আরও কয়েক জনের নাম বলল, আমি না উত্তর দিলাম। বস হঠাৎ রাগে বললেন তাহলে ময়মনসিংগ্যা মদনটার সঙ্গে যাবে। আমি হ্যাঁ বললাম। দু'জনে স্টোর রুমে ঢুকলাম। প্রায় এক ঘণ্টা খুঁজে বই পেলাম। কিন্তু বসের সেই ময়মনসিংগ্যা মদনটার কাছ থেকে সেদিন যে ব্যবহার পেয়েছি, মনে হল ও যে দ্বিতীয় ভগবান বৌদ্ধ।
একদিন খবর এলো, আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। বসের কাছে এসে ছুটি চাইলাম। বাবার অসুস্থার কথা বললাম, কিন্তু তিনি ছুটি দেননি। ময়মনসিংগ্যা দাদাটা অসুস্থতার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই বান্দরবান চলে গেল। নিজের টাকা খরচ করে আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলল। আমি বিষয়টি হেড অফিসকে জানালাম। তার কিছুই হলো না। বরং হেড অফিস সেই বসকে প্রমোশন দিল। এবার আরেক নতুন বস এলেন। তার ব্যবহারে মনে হলো জলন্ত আগুন থেকে মুক্ত হয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার দিকে যখন চাইত তখন মনে হতো আমার সারা শরীর গিলে খেতে চায়? আমাকে অনেক উত্ত্যক্ত করতে লাগল। হেড অফিসের নিয়ম আছে মেয়েদের মাসিকের সময় ফিল্ডে কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু সে সময় আমাকে ফিল্ডে কাজ করতে হতো। অফিসে ৫টার পর কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কাজ থাকুক কিংবা না থাকুক ১০টা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন।
ময়মনসিংগ্যা দাদা এসবের প্রতিবাদ করায় একদিন তার চাকরি চলে গেল। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। দাদাকে মোবাইল করলাম দাদা চাকরি ছাড়তে নিষেধ করল। আমার বাবা আবার অসুস্থ হলো। ছুটি চাইলাম। বস আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করল। আমি রিজাইন লেটার লিখে বান্দরবান চলে এলাম। এসে দেখি বাবার লাশ উঠানে, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম ময়মনসিংগ্যা দাদাটা নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে।
চাকরি নিয়ে আমাদের সংসারের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে; কিন্তু আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত মুখোশধারীরা। অফিসে সুযোগ পেলেই বাঙালি বড়কর্তা, ছোটকর্তা এমনকি আমার সহকর্মীরাও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিত। ওরা মুখে মানবাধিকারের কথা বলত। নারীর ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলত। কিন্তু মনেপ্রাণে ওরা ছিল ওসবের বিরুদ্ধে। একদিন শুনলাম ময়মনসিংগ্যা থেকে একজন বাঙালি মুসলমান আমাদের অফিসে বদলি হয়ে আসছেন। ভয়ে আরও আতঙ্কিত হলাম। যথাসময়ে সে এলো। তার কথাবার্তা চাল-চলনে আমি অবাক হলাম। একদিন অফিসে মিটিং হচ্ছে। বস আমাকে বললেন, তুমি বেলালকে নিয়ে স্টোর রুম থেকে বই নিয়ে এসো। আমি না বললাম। একে একে আরও কয়েক জনের নাম বলল, আমি না উত্তর দিলাম। বস হঠাৎ রাগে বললেন তাহলে ময়মনসিংগ্যা মদনটার সঙ্গে যাবে। আমি হ্যাঁ বললাম। দু'জনে স্টোর রুমে ঢুকলাম। প্রায় এক ঘণ্টা খুঁজে বই পেলাম। কিন্তু বসের সেই ময়মনসিংগ্যা মদনটার কাছ থেকে সেদিন যে ব্যবহার পেয়েছি, মনে হল ও যে দ্বিতীয় ভগবান বৌদ্ধ।
একদিন খবর এলো, আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। বসের কাছে এসে ছুটি চাইলাম। বাবার অসুস্থার কথা বললাম, কিন্তু তিনি ছুটি দেননি। ময়মনসিংগ্যা দাদাটা অসুস্থতার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই বান্দরবান চলে গেল। নিজের টাকা খরচ করে আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলল। আমি বিষয়টি হেড অফিসকে জানালাম। তার কিছুই হলো না। বরং হেড অফিস সেই বসকে প্রমোশন দিল। এবার আরেক নতুন বস এলেন। তার ব্যবহারে মনে হলো জলন্ত আগুন থেকে মুক্ত হয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার দিকে যখন চাইত তখন মনে হতো আমার সারা শরীর গিলে খেতে চায়? আমাকে অনেক উত্ত্যক্ত করতে লাগল। হেড অফিসের নিয়ম আছে মেয়েদের মাসিকের সময় ফিল্ডে কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু সে সময় আমাকে ফিল্ডে কাজ করতে হতো। অফিসে ৫টার পর কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কাজ থাকুক কিংবা না থাকুক ১০টা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন।
ময়মনসিংগ্যা দাদা এসবের প্রতিবাদ করায় একদিন তার চাকরি চলে গেল। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। দাদাকে মোবাইল করলাম দাদা চাকরি ছাড়তে নিষেধ করল। আমার বাবা আবার অসুস্থ হলো। ছুটি চাইলাম। বস আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করল। আমি রিজাইন লেটার লিখে বান্দরবান চলে এলাম। এসে দেখি বাবার লাশ উঠানে, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম ময়মনসিংগ্যা দাদাটা নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে।
সুত্র : সমকাল
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন