ছোটমামা, আজ কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের গল্প বলতে হবে- বীথি ও আল আমিনের আবদার শুনে হাসলেন ছোটমামা আবু আবদুল্লাহ। একটু অবাকও হলেন। যে সময়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা পাঠ্যবই, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না, সে সময়ে ওরা দেশ নিয়ে ভাবছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাচ্ছে। ছোটমামা থাকেন ঢাকার চকবাজারে। তিনি কেবলমাত্র বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। কোথাও বেড়াতে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গল্প শোনার জন্য চেপে ধরলে বাধ্য হয়ে তিনি শুনাতে থাকেন নতুন যুগের নতুন সেনাপতিদের গল্প। ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে বোনদের বাড়িতে বেড়াতে যান। ছোট বোনের সন্তান দু’টি। বড় মেয়ে বীথি আর ছোট ছেলে আল আমিন। দু’জনই খুব মেধাবী। তারা নিজ নিজ ক্লাসে শ্রেষ্ঠ। তাদের স্বপ্ন মুক্তিযোদ্ধারা যেমনি এই দেশকে নিজেদের রক্ত, শ্রম ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করেছিলেন তেমনি তারাও এই দেশকে একটি সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলবে। মার্চ মাস। স্বাধীনতা ঘোষণার মাস। পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল সবগুলোতে মহান স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বীথি ও আল আমিন মাঝে মাঝে চ্যানেল খুলে একটু আধটু দেখে। এ মাসে ছোটমামা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসায় স্বাধীনতাযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য চেপে ধরেছে। তাদের চাপাচাপিতে স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক গল্প তুলে ধরলেন মামা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করত ব্রিটিশরা। তাদের থেকে স্বাধীন হয় ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। পাকিস্তানের দু’টি অংশ, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এ দেশের ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করে। আর এরই প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে আপামর জনসাধারণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতাযুদ্ধ স্থায়ী হয়। অবশেষে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক একটি ভুখন্ডের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, নারী-পুরুষ তথা আপামর জনসাধারণ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে আল আমিন বলল, ‘আচ্ছা মামা, মুক্তিযুদ্ধ আর হবে না?’ মামা প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও শেষ হয়নি। আমাদের অনেক অর্জন থাকলেও সকল স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখনও অনেকে প্রতিদিন দুইবেলা আহার পায় না। এখনও সবাই পড়ালেখা করার সুযোগ পায় না। অনেকে ফুটপাথে ঘুমায়, এখনও সকল মানুষের মুখে হাসি ফোটেনি। বীথি বলে উঠল, ‘মামা, আমরা ছোট, আমরা কিভাবে যুদ্ধ করব?’ মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের দেশ গঠনের যুদ্ধে সবাই ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা যদি আমাদের টিফিনের টাকা থেকে টাকা বাঁচিয়ে অল্প অল্প করে জমিয়ে ক্লাসের যে ছাত্রটির টিফিন কেনার সামর্থ্য নেই, তাকে একদিন টিফিন করাই। নানা কারণে যে ছেলেটি স্কুলে যেতে পারে না, তাকে লেখাপড়া করালে এক সময় আমাদের স্বপ্ন সার্থক হবে।’ বীথি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ক্লাসের কয়েক বন্ধু মিলে প্রতিদিন একজনকে টিফিন করাতে পারি।’ মামা আরও বলতে লাগলেন, ‘আমাদের দেশের বাজারে দেশীয় পণ্যের পাশাপাশি বিদেশী পণ্যও আছে। বিদেশী পণ্যের পরিবর্তে আমাদের দেশীয় পণ্য ব্যবহার করলে দেশের অর্থনীতির উপকারে আসবে। হয়তো আমাদের দেশীয় পণ্য একটু কম উন্নত হতে পারে, কিন্তু আমরা সবাই ব্যবহার করলে চাহিদা বাড়বে, দেশীয় উৎপাদকরা উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করবেন।’ আল আমিন বলল, মামা, ‘আমাদের বেশি ব্যবহারের কারণে কখনও কি এমন হয়েছে?’ মামা উত্তর দিলেন, ‘হবে না কেন? আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে আমাদের দেশের ওষুধের বাজার বিদেশী ওষুধের দখলে ছিল। এখন কিন্তু অল্প কিছু ওষুধ ছাড়া বাকি সকল ওষুধ আমরা উৎপাদন করি। অনেক ওষুধ বিদেশেও রফতানি হয়। ইলেকট্রনিকস পণ্যও দেশে উৎপাদিত হয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।’ মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে দেখে বীথি ও আল আমিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারা দু’জন কানে কানে কী যেন বলল, তারপর এক সাথে দু’জনে মামাকে বলল, ‘ছোটমামা, আমরাও আজ থেকে দেশ গড়ার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন