ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ আধুনিক মহাকবি। সাধারণ অর্থে মহাকাব্যের যিনি রচয়িতা, তিনিই মহাকবি। ব্যাপক অর্থে মহাজীবনকে যিনি কাব্যকর্মে ধারণ করতে পারেন, তিনিই মহাকবি। এই দুই অর্থেই ফররুখ মহাকবি। বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ মহাকাব্য ‘হাতেম তা’য়ী’ রচনা করে তিনি এই মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যদিকে, তিনি তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন একটি সম্পূর্ণ জীবনদর্শন। কাব্য সাধনার বাইরে ফররুখের জীবনসাধনাও এক মহাকাব্যিক মর্যাদায় উদ্ভাসিত। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের পর ফররুখ আহমদই যে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, এ ব্যাপারে এখন আর কারও মধ্যে তেমন সংশয় নেই। মৃত্যুর ৩৬ বছর পরও তিনি নতুনভাবে উদ্ভাসিত হচ্ছেন আমাদের সামনে। আজও প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর অসামান্য, অপ্রকাশিত কবিতা ও রচনা। বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও গবেষক হিসেবে স্বীকৃত, সদ্য পরলোকগত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ফররুখ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত ও নতুন নতুন বিবেচনা হাজির করার প্রাণান্ত সাধনা চালিয়েছেন। ফররুখ আহমদের কাব্য ও জীবনের ঐশ্বর্যই তাঁকে ব্যাপৃত রেখেছিল এই সাধনায়।
১৯৬৬ সালে যখন ফররুখের মহাকাব্য ‘হাতেম তা’য়ী’ প্রকাশ পায়, তখনই সাহিত্যাঙ্গনে এক তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সাহিত্য সমালোচকদের একটি বড় অংশ ‘হাতেম তা’য়ী’কে ফররুখের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে স্বীকৃতি দেন। ‘সাত সাগরের মাঝি’র কবি, ‘সিরাজাম মুনীরা’র কবি, ‘নৌফেল ও হাতেম’-এর কবি, ‘মুহূর্তের কবিতা’র কবি, ফররুখ আহমদের এই মহাকাব্য ওই বিতর্ককে আজও চলমান রেখেছে। কেউ বলছেন ‘সাত সাগরের মাঝি’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি, কেউ বলছেন ‘সিরাজাম মুনীরা’। ‘মুহূর্তের কবিতা’কে কেউ কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সনেট গ্রন্থ হিসেবে, ‘নৌফেল ও হাতেম’ স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ক’টি কাব্যনাটকের তালিকায়। এ থেকেই বোঝা যায়, ফররুখের এসব গ্রন্থের কোনোটি কোনোটির থেকে কম নয়।
ফররুখ যখন ‘হাতেম তা’য়ী’ লিখেছেন, তখন কেউ ভাবতেই পারেনি যে এ যুগেও কেউ মহাকাব্য লিখতে পারে। কেননা, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল কোনো মহাকাব্য রচনা করেননি। ফলে মহাকাব্য রচনা ধারার অবসান হয়েছে বলেই বিশ্বাস ছিল সবার। এ অবস্থায় ফররুখের মতো কবি যখন মহাকাব্য রচনা করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই হতচকিত হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন। এ কাব্যের পক্ষে-বিপক্ষে, ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা কথাই লেখা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু এই আধুনিককালেও মহাকাব্য পাঠের স্বাদ আস্বাদন করতে পাঠককুলের কোনো বেগ পেতে হয়নি। তার প্রমাণ রয়ে গেছে রথী-মহারথী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচকদের কথায়, লেখায় ও মন্তব্যে।
ফররুখ আহমদের জীবন ও কাব্যকর্মের প্রকৃত প্রণোদনা ছিল ইসলাম, আধুনিকতাবাদের চরম বিকাশের যুগে ইসলামের দর্শনকে এত গভীরভাবে আত্মস্থ করা কবির সংখ্যা গোটা পৃথিবীতেই হাতে গোনা। ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল ইকবাল ও নজরুলই তা পেরেছিলেন; যদিও নজরুল কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্যত্র এমন আর কোনো কবির কথা আমাদের জানা নেই। ইসলামের দর্শনকে আত্মস্থ করে ফররুখ তাঁর কবিতাকে কোন উচ্চতায়, কোন গভীরতায় উপস্থাপন করেছেন? বলা যায় সেটা হিমালয়সম উচ্চতা, সমুদ্রসম গভীরতা। সমালোচকরা বলছেন, জেমস এলেবি ফ্লেকার যে ‘স্বর্ণখচিত পথ ধরে সমরখন্দ ভূখ ের উদ্দেশে রওয়ানা করেছেন’ তার সেই অভিযাত্রার তুলনায় ফররুখের সাত-সাগরের মাঝির সমুদ্রযাত্রা অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ। তদুপরি ফ্লেকারের অভিযাত্রা কেবলই রোমাঞ্চকর। কিন্তু ফররুখের অভিযাত্রা আরও দূর, অনন্ত, অন্তহীন পথে এবং সে যাত্রা অনেক বেশি সংহত ও লক্ষ্যাভিসারী এবং সে অভিযাত্রা গভীরতর মানবিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। ফররুখ অতি অনায়াসে ছাড়িয়ে যান বিশ্ববিশ্রুত রোম্যান্টিক কবিদের। ফররুখের ‘ডাহুক’ কবিতার সঙ্গে সমালোচকরা শেলীর ‘স্কাইলার্ক’ কিংবা কীটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’কে মেলাবার বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন তারা। কেননা স্কাইলার্ক কিংবা নাইটিঙ্গেলকে ছাড়িয়ে অতি উচ্চ এক মাত্রা যুক্ত হয়েছে ‘ডাহুক’ কবিতায়। শুধু পশ্চিমা শিল্পচেতনা কিংবা সমাজবাদী শিল্পবোধ দ্বারা ফররুখকে কখনও মাপা যায়নি, যাবেও না।
ফররুখ এমন এক জীবন যাপন করেছেন, যে জীবন অব্যাহত সাধনা ছাড়া যাপন করা যায় না। তাঁর জীবনই বাংলা সাহিত্যের আরেকটি ট্র্যাজিক মহাকাব্যের বিন্যাস। বাংলা সাহিত্যে ফররুখের সবচেয়ে প্রিয় কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলের সঙ্গে ফররুখের জীবনের রয়েছে বিস্তর মিল। মাইকেলের জীবনও এক মহাকাব্যেরই অনুষঙ্গ। মাইকেল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক আধুনিক মহাকবি, আর ফররুখ বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ সার্থক আধুনিক মহাকবি।
ফররুখের কবিতাকে আজ গোটা পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়ার সময়। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অভিশাপে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া মানুষের মানবিক জীবনযাপনের স্বপ্নের ক্যানভাসটি আবার নতুন করে গড়ে তোলার জন্য ফররুখ বিশ্বময় এক অনিবার্য কবিসত্তা।
১৯৬৬ সালে যখন ফররুখের মহাকাব্য ‘হাতেম তা’য়ী’ প্রকাশ পায়, তখনই সাহিত্যাঙ্গনে এক তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সাহিত্য সমালোচকদের একটি বড় অংশ ‘হাতেম তা’য়ী’কে ফররুখের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে স্বীকৃতি দেন। ‘সাত সাগরের মাঝি’র কবি, ‘সিরাজাম মুনীরা’র কবি, ‘নৌফেল ও হাতেম’-এর কবি, ‘মুহূর্তের কবিতা’র কবি, ফররুখ আহমদের এই মহাকাব্য ওই বিতর্ককে আজও চলমান রেখেছে। কেউ বলছেন ‘সাত সাগরের মাঝি’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি, কেউ বলছেন ‘সিরাজাম মুনীরা’। ‘মুহূর্তের কবিতা’কে কেউ কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সনেট গ্রন্থ হিসেবে, ‘নৌফেল ও হাতেম’ স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ক’টি কাব্যনাটকের তালিকায়। এ থেকেই বোঝা যায়, ফররুখের এসব গ্রন্থের কোনোটি কোনোটির থেকে কম নয়।
ফররুখ যখন ‘হাতেম তা’য়ী’ লিখেছেন, তখন কেউ ভাবতেই পারেনি যে এ যুগেও কেউ মহাকাব্য লিখতে পারে। কেননা, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল কোনো মহাকাব্য রচনা করেননি। ফলে মহাকাব্য রচনা ধারার অবসান হয়েছে বলেই বিশ্বাস ছিল সবার। এ অবস্থায় ফররুখের মতো কবি যখন মহাকাব্য রচনা করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই হতচকিত হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন। এ কাব্যের পক্ষে-বিপক্ষে, ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা কথাই লেখা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু এই আধুনিককালেও মহাকাব্য পাঠের স্বাদ আস্বাদন করতে পাঠককুলের কোনো বেগ পেতে হয়নি। তার প্রমাণ রয়ে গেছে রথী-মহারথী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচকদের কথায়, লেখায় ও মন্তব্যে।
ফররুখ আহমদের জীবন ও কাব্যকর্মের প্রকৃত প্রণোদনা ছিল ইসলাম, আধুনিকতাবাদের চরম বিকাশের যুগে ইসলামের দর্শনকে এত গভীরভাবে আত্মস্থ করা কবির সংখ্যা গোটা পৃথিবীতেই হাতে গোনা। ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল ইকবাল ও নজরুলই তা পেরেছিলেন; যদিও নজরুল কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্যত্র এমন আর কোনো কবির কথা আমাদের জানা নেই। ইসলামের দর্শনকে আত্মস্থ করে ফররুখ তাঁর কবিতাকে কোন উচ্চতায়, কোন গভীরতায় উপস্থাপন করেছেন? বলা যায় সেটা হিমালয়সম উচ্চতা, সমুদ্রসম গভীরতা। সমালোচকরা বলছেন, জেমস এলেবি ফ্লেকার যে ‘স্বর্ণখচিত পথ ধরে সমরখন্দ ভূখ ের উদ্দেশে রওয়ানা করেছেন’ তার সেই অভিযাত্রার তুলনায় ফররুখের সাত-সাগরের মাঝির সমুদ্রযাত্রা অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ। তদুপরি ফ্লেকারের অভিযাত্রা কেবলই রোমাঞ্চকর। কিন্তু ফররুখের অভিযাত্রা আরও দূর, অনন্ত, অন্তহীন পথে এবং সে যাত্রা অনেক বেশি সংহত ও লক্ষ্যাভিসারী এবং সে অভিযাত্রা গভীরতর মানবিক উদ্দেশ্যপূর্ণ। ফররুখ অতি অনায়াসে ছাড়িয়ে যান বিশ্ববিশ্রুত রোম্যান্টিক কবিদের। ফররুখের ‘ডাহুক’ কবিতার সঙ্গে সমালোচকরা শেলীর ‘স্কাইলার্ক’ কিংবা কীটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’কে মেলাবার বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন তারা। কেননা স্কাইলার্ক কিংবা নাইটিঙ্গেলকে ছাড়িয়ে অতি উচ্চ এক মাত্রা যুক্ত হয়েছে ‘ডাহুক’ কবিতায়। শুধু পশ্চিমা শিল্পচেতনা কিংবা সমাজবাদী শিল্পবোধ দ্বারা ফররুখকে কখনও মাপা যায়নি, যাবেও না।
ফররুখ এমন এক জীবন যাপন করেছেন, যে জীবন অব্যাহত সাধনা ছাড়া যাপন করা যায় না। তাঁর জীবনই বাংলা সাহিত্যের আরেকটি ট্র্যাজিক মহাকাব্যের বিন্যাস। বাংলা সাহিত্যে ফররুখের সবচেয়ে প্রিয় কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলের সঙ্গে ফররুখের জীবনের রয়েছে বিস্তর মিল। মাইকেলের জীবনও এক মহাকাব্যেরই অনুষঙ্গ। মাইকেল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক আধুনিক মহাকবি, আর ফররুখ বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ সার্থক আধুনিক মহাকবি।
ফররুখের কবিতাকে আজ গোটা পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়ার সময়। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অভিশাপে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া মানুষের মানবিক জীবনযাপনের স্বপ্নের ক্যানভাসটি আবার নতুন করে গড়ে তোলার জন্য ফররুখ বিশ্বময় এক অনিবার্য কবিসত্তা।
1 Comment:
আসসালামুয়ালাইকুম , ভাই সিরাজাম মুনীরা আরও অন্যান্য কাব্য গ্রন্থ গুলোর ডাউনলোড লিঙ্ক থাকলে একটু দেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন