অবিবাহিত মেয়েদের দিয়ে সেকালে অনেক পুণ্য কর্ম করানো হতো, যেমন কোনো কিছুর চুরি হলে বা হারিয়ে গেলে কাঁঠাল বা কলাপাতায় বাড়ির বা সন্দেহজনক লোকদের নাম লিখে নিয়ে লোটা ভরে পানি নিয়ে দুটি কুমারী মেয়েকে ধরতে দিয়ে বসানো হতো। কোরআন শরীফ থেকে সুরা ইয়াসিন বা সুরা রহমান কিংবা আয়তাল কুরশী পড়া হতো। সঙ্গে সঙ্গে নাম লেখা পাতা একটি করে সেই লোটার মধ্যে ফেলা হতো। যে নামের পাতাটি লোটায় পড়লে লোটাটি ঘুরে উঠত, তাকেই ধরা হতো। আর এটি সত্যিই আশ্চর্যজনক রূপে চোর ধরিয়ে দিত। এখন কি আর সে প্রথা কেউ মানবে, না সে প্রথা কেউ অবলম্বন করবে? কেউ পালিয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে জমিদার বাড়ির বড় হাফিজ সাহেব কলা পাতায় একটি দোওয়া লিখে দিতেন। তিনদিনের মধ্যে সে নিজেই ফিরে আসত কিংবা দূরে চলে গেলে চিঠি দিয়ে বা লোকমুখে সে নিজেই খবর দিত, কোথায় আছে এবং কেন চলে গিয়েছে। এসব অলৌকিক কাহিনী আজ আর কেউ বিশ্বাস করবে কি? বৃষ্টি না হলে সবাই খালি মাথায় খালি পায়ে খোলা মাঠে নামাজ পড়তেন। মেয়েরা ভিজা কাপড়ে ভিজাচুলে দোওয়া-দরুদ পড়তেন। বৃষ্টি সত্যিই হতো। আর খুব বেশি বৃষ্টি হলে ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে একটা বড় মজার খেলা করতো। রাতে মেঘের ফাঁকে ২/১টি তারা দেখা গেলে সুর করে তারা বাঁধতো দল, কাটতো ছড়া। সে ছড়াটি হলো- একতারা, দুইতারা, তারারা কয় ভাই?/ তারারা সাত ভাই/ বেঁধে ফেল্লাম বড় ভাই/ চন্দ্র গেলে সূর্যের বাড়ি বসতে দিল চৌকি সিঁড়ি
বসবেনা আর পিঁড়িতে/ মানুষ মরে ভাতে, গরু মরে ঘাসে/ কালেকের রৌদ্রে যেন বসুমতী ফাটে।/
শৈশবের দিনগুলো ছিলো স্বপ্নঘেরা রঙিন । একালের মতো কচি বয়স হতেই স্কুল পড়া আর সময় মেনে চলার দিন ছিল না বলে শিশুমনের কল্পনার বিকাশ হতো নানা দিক দিয়ে। জীবন ছিল জীবন্ত, আনন্দও যেন অফুরন্ত ছিল, খেলাধুলা,খাওয়া, পরা, গ্রাম্য পরিবেশ, ফুলঝরা, পাখিডাকা, ভোরে ফুলের গন্ধে, পাখির গানে, রোদে বৃষ্টিতে ফুল ফল কুড়ানো, নদী-পুকুরে সাঁতার কাটা। শরীর স্বাস্থ্য মন অন্তর যেন পরিপূর্ণতা লাভ করত। আকাশ মাটির সাথে মিতালি হতো। পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কোলে চলছিল আদরের ফুলফোটা। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, এসবের শুরু থেকে যে অভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ সেই সময়ের সবার মনের ছাপ রেখেছে সুগভীর করে। স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই, এই বাণী তখনকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতো। প্রতিনিয়ত মানুষ সেই সংগ্রাম করে চলছে, একতাবদ্ধ গণজাগরণ চিরকাল জয়ে পতাকা উড্ডীন করেছে।
এমন একটা সময়ের গল্প। গল্পের প্রথম পর্বে দেখা যায়, বিশাল প্রাচীরের ভেতর বিশাল প্রাসাদ। ফুল-ফল আর নানারকম গাছগাছিলেতে শোভান্বিত শ্যামল ভেতর বাড়িতে দুই পুকুর একটি গোসলের, অন্যটি রান্না করা, কাপড় ধোয়ার কাজের। অন্দরের পুকুরের সঙ্গে প্রাচীরের তলা দিয়ে গেট করা, খাল থেকে নদীতে যাওয়ার পথ। জোয়ারের পানি নববর্ষায় উচ্ছ্বসিত হয়ে গেটের তলা দিয়ে পুকুরে আসত আর আসত অসংখ্য মাছ। বেগম-বিবিরা সেই মাছ ধরতেন অবসরের আনন্দে। অন্দর বাড়িতে পুরুষের প্রবেশ ছিল না, তাই বিবিরা সবাই সাঁতার কেটে, নৌকা বেয়ে আনন্দ-উৎসব করার সুযোগ পেতেন। গরমের দিনে দুপুরে থাকার জন্য ঠান্ডা আটচালা বাংলোর সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে বৃহৎ পুকুরের মধ্যে। দুই ধারে মেহেদি গাছের বেড়ার মধ্যে অজস্র ফুলের গাছ। রঙ্গন গাছের কুঞ্জ বেয়ে লতিয়ে উঠেছে লতা-বেলি, জুঁইয়ের ঝাড়, কামিনী, শেফালি, জবা, সূর্যমুখী। শিউলি বোঁটার রঙে কাপড় রাঙ্গিয়ে পরার জন্য প্রচুর ফুল সংগ্রহ করে বোঁটা শুকিয়ে রাখা হতো। এসব কাজে ছেলেমেয়ে, বউ-ঝিদের উৎসাহ ছিল প্রচুর। ভোর-সকালে ফুল কুড়ানোর পাল্লা দেওয়া হতো, কে কত ফুল কুড়াতে পারে। বাইরে থেকে মালিরাও ফুল পাঠাত অন্দরমহলে। ফুল বাছানিয়ারা তা থেকেও বোঁটা সংগ্রহ করত। আম, জাম, লিচু, আতা, বাতাবি, সফেদা, লেবু, তুঁত, পেয়ারা, তাল, খেজুর, কলা, কামরাঙ্গা, করমচা, চালতা, আমরুল, আঁশফল, সুপারি গাছ প্রাচীরের পাশে বহু বিস্তৃত সীমানার মধ্যে থাকায় তাজা-টাটকা ফল পেতে পরিবারের অভাব হতো না। বাড়িতে অন্দরমহলে বিস্কুট, রুটি, কেকও তৈরি হতো। কিন্তু আমার বড় মামার বিস্কুট, রুটি, কেক, চিনি, নুন, চা, গোলমরিচ গুঁড়া আসত কলকাতার আর্মি নেভি স্টোরস থেকে। এই যে বিশাল প্রাসাদের কথা বলছি, এই প্রাসাদের চারপাশে দারওয়ানরা বাড়ি পাহারা দিত। বাচ্চারাও সেকালে মসজিদে যেতাম আর মসজিদের জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে দেখা যেত ঠিক বিছানায়ই শুয়ে আছে। আর এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হতো- ফেরেশ্তারা বাচ্চাদের সবাইকে ঘরে এনে শুইয়ে দিয়ে গেছেন।
তখন মসজিদে গিয়ে সুর মিলিয়ে জোরে 'কায়েদা বোগ্দাদি' পড়তে হতো। তিন-চারজন মেয়েও যেতো এই কায়দা বোগদাদি পড়ার জন্য। প্রাসাদের মালিকের আদরের বড় নাতি যখন আরবি-ফারসি পড়তে শিখলেন, তখন ছোটরা জের-জবর- পেশ-তশ্দিদ শিখছে। তারা সুর করে পড়তেন- করিমা বেবখ্শা য়ে বর হালেমা/ কে হাস্তম আলীরে কমন্দে হাওয়া/ নেগাহ্দার মারা-জারায়ে খাতা/ খাতা দর্ গোজারো সওয়াবেন্নামা...
গল্পের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে ছন্দিত আনন্দিত কল্লোলে। আর এভাবেই শুভদিনটি চলে আসে। বাংলা আষাঢ় মাসের কোন একটি দিন, ইংরেজি সাল গণণায় দেখা যায়- ১৯৯১ সালের ২০ জুন। এই দিনটিতেই একটি শিশুর জন্ম হয়। আনন্দ-কলরবে শিশুটির জন্মণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। যেই প্রাসাদের কথা শুরুতেই বলেছি, সেই প্রাসাদটি সারাদেশে পরিচিত। বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ নওয়াব পরিবারের অনেক খ্যাতি তখন। শিশুটির মাতামহ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন শিশুটির মা। ত্রিপুরা জেলার শিলাউড় গ্রামের সৈয়দ আবদুল বারী বিএল ছিলেন তাঁর বাবা। তারা এক ভাই এক বোন। মাটিকে বাদ দিয়ে ফুলগাছের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই আমার মাকে বাদ দিয়ে তারও তেমন কোনো কথা নেই। শিশুটি জন্ম নেওয়ার আগেই মায়ের মুখে 'হাতেম তাইয়ের কেচ্ছা' শুনে শিশুটির নানি আম্মা তাঁর নাম রেখেছিলেন হাসনা বানু। শিশুটির নানা প্রথম বয়সে সদর আলা থেকে জজগিরি পর্যন্ত সারা করে শেষ বয়সে সাধক-'দরবেশ' নাম অর্জন করেছিলে। আলোকিত আগামী গড়ার অনন্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার রঙিন ভূবন নিয়ে যখন তিনি জন্ম নিলেন, নিজের হাতে সেই শিশুটির মুখে মধু দিয়ে তিনি নবাগত শিশুর নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। কিন্তু তাঁর ডাক নাম হাসনা বানুটাই আমাদের পরিবারে প্রচলিত। সেই শিশু হাসনা বানু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন; সুখ স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নে আসে একটা আতঙ্কিত ভাব; সুখ স্বপ্নের মধুর আবেশে মন ভরে থাকে। তারও শৈশবের সুখ স্বপ্ন মধুময়। অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মধ্যে, শিতি পরিবারের আওতায়, ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছে । তাদের পরিবারটি ছিল সুবৃহৎ। মা, মামা-খালা আম্মারা মিলে ছয় ভাই, ছয় বোন। শিশুটির আম্মা বোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। শিশুটির শৈশব-কৈশোর ছিল পরিবারের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ।
গল্পের তৃতীয় পর্বের রঙধনু দূর করেছে কষ্টের কালোমেঘ। আর ঠিক তখন কিছুই বোঝবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি হয়নি শিশুটির। কিন্তু কি জানি কেন তার ভীষণ কান্না পেত। আর তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় এক বোনঝি চোখ মুছিয়ে বলতেন, শুধু শুধু কাঁদতে নেই। সিপারের আমপারা পর্যন্ত মসজিদে তাদের পড়া; তারপর কোরআনের সবক আম্মার কাছ থেকেই নিতে হয়েছে, কেননা তখন তারা বড় হয়ে গিয়েছিলেন। তবে জুবিলি স্কুলে প্যারীলাল মাস্টার মশায়ের কাছে তিনিও দু-এক সবক পড়েছেন। তবে তা পুরুষের পোষাকের মাধ্যমে অর্থাৎ পায়জামা-কুর্তা আবার আচকান-পায়জামা পরে গিয়ে । বাল্য-শিা পর্যন্ত তার বিদ্যা হওয়ার পর ভাইয়ারা সব চলে গেলেন কেউ বরিশাল, কেউ ঢাকা আর আমার ভাইয়া গেলেন কলকাতায়। খালা-আম্মা তাকে নিয়ে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মামাত বোনেরা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। শূন্য বিরাট ভবনে পীমাতার পতলে রইলেন শুধু হাসনা বানু একা। আর রইল দাই-খেলাই বাঁদী খানসামা-পেয়াদাদের দল। তখন তার বয়স সাত বছর। আর এই বয়সে নিরালা নিঝুমপুরীতে পাহারা দেওয়ার পেয়াদাদের বেহালার মূর্ছনা অনেক রাত পর্যন্ত তার কানে বাজত। শিশুজীবনের সবচেয়ে প্রকৃত শিক-সাথী ছিলেন তার 'জামাই', অর্থাৎ পুতুল মেয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমি 'শাশুড়ি' হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হাসনা বানুর আম্মার দুধভাই, ভাইয়ারা সবাই তাকে ডাকত মামা। হাসনা ডাকতেন জামাই। সেই জামাইয়ের কোলে বসে বসে শুনতেন পুঁথি পড়া। শুনতেন গান। দেখতেন বেহালার তানে তানে ওস্তাদ বেহালাদারের ভাবোদ্বেল মুখ, কখনও হোসেনের বীরত্বে উচ্ছ্বসিত, কখনও সখিনার ব্যথায় ব্যথিত। আবার পালাগানও হতো। ভালো ভালো পালা সোনাভানের পালা ইত্যাদিথ বানিয়ে ওরা অভিনয় করত। তখন তো আর অভিনয় কী তিনি জানতেন না। তবে তার কাছে মনে হয়েছে শিল্প-সাহিত্য মানুষের অন্তরের সম্পদ। আল্লাহ্ তা সবাইকে দান করেছেন। সবার অন্তরে এ স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ এ নিয়ে বিশ্বজোড়া নাম করে, কেউ বা কোথায় ঢেউয়ে ভেসে তলিয়ে যায় সাধনা-সুযোগ-সুবিধা ও শিার অভাবে তার আর পাত্তা থাকে না। শীতের দিনে খেজুর গাছের রস নামিয়ে নারিকেল, চাউল দিয়ে পেয়াদারা যে শিরনি রাঁধত, হাসনাও জামাইয়ের কোলে বসে তা খেতেন। অনেক রাতে জামাইয়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে নিয়ে গিয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন। সেইত জীবন-সেই স্বপ্ন সুর ব্যথা, আর তার সঙ্গে শুরু দুঃখ-অভাব-অনটনের। ব্যথার যে কত রূপ তা কি এখনও জানার সূত্র তৈরী হচ্ছে। হারিয়ে পাওয়া-পেয়ে হারানো। চাওয়া-পাওয়া-দেওয়া এ সবই তো ব্যথা-বিজড়িত সুখ-দুঃখ অশ্রুজল সিক্ত, স্মৃতির সুরভিতে সুরভিত। কখনও কোনো দূরান্ত থেকেও এরা ভেসে এসেছে।
গল্পের চতুর্থ পর্ব বয়ে চলেছে কবিতার রাস্তা ধরে- সুফিয়া কামালের কবিতা। আমরা যেই শিশুটির কথা, যেই হাসনা বানুর কথা এতক্ষণ পর্যন্ত বলছি, শুনছি। সেই হাসনা বানু বাংলাদেশের শিশু-কিশোর নারীদের অতি পরিচিত মানুষ। অতি পরিচিত কবি। অনন্য নারী মহিয়ষী। তিনি তার চেতনায় আদর্শে রেখেছিলেন স্বাধীনতা আর স্বাধীকারের স্বাদ। আর তাই শৈশবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও পিছপা হননি। বরং সেই স্বামীর হাত ধরেই নিয়েছে কবিতার নতুন সোপান। আর এভাবেই তিনি একসময় লিখেছেন, সাঁঝের মায়া। যেখানে জীবনের কথা, দেশের কথা, মানুষের কথা তিনি তুলে ধরেছেন পরম মমতায়- অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে
সুন্দর দণি হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/ দণিা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/ বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/ দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।/ সুমধুর মোহে ধীরে ধীরে ধীরে/ প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলাশেষে দিবসের তীরে/
ডুবিল যে শান্ত মহিমায়,/ তাহারি সে অস্তরাগে বসন্তের সন্ধ্যাকাশ ছায়।/ ওগো কান্ত দিবাকর! তব অস্ত-উৎসবের রাগে/ হেথা মর্তে বনানীর পল্লবে পল্লবে দোলা লাগে...
পঞ্চম পর্বে এসে স্বপ্নজ জীবনের ডানা মেলে বলা যায়, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা 'হেনা' সুফিয়া কামাল-এর মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে। গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি মোহগ্রস্থ হন জমিদার বাড়ির নাতনি হাসনা বানু আমাদের আলোকিত সময়ের সাহসমানুষ সুফিয়া কামাল। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাঁকে উৎসাহিত করে। আর তাই এগিয়ে যান জীবনের একটাই লক্ষ্য নিয়ে আর তা হলো মানুষের মঙ্গল। এরপর যখন তার বিয়ে হয় তখন, সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বি.এম.কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফ.এ. পাশ করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাাৎ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ তিনি লাভ করেন আমাদের সুফিয়া কামাল। যা তাঁকে সাহিত্য চর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর উত্সাহ উদ্দীপনা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন; এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত 'তরুণ' পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন সে সময়ের তরুণ মেধাবী ছাত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন। 'তরুণ' পত্রিকার জন্যে লেখা চাই। নেহাল হোসেনের মনে হলো তার নববধু সুফিয়ার কাঁচা হাতের কিছু লেখা আছে। তিনি সুফিয়ার ২/৩ টি লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক একটি গল্প ও একটি কবিতা মনোনীত করে প্রথমে গল্পটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। 'তরুণ' পত্রিকার প্রথম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় মিসেস এস.এন. হোসেন নামে সুফিয়া কামাল-এর প্রথম লেখা 'সৈনিক বধূ' প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার প্রথম লেখা প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দু মুসলমান সকলে অত্যন্ত প্রশংসা করে আরও লেখার জন্য তাঁকে উত্সাহিত করেন। এ সময় বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা গীতিকবি কামিনী রায় আসেন বরিশালে। একজন মুসলমান মেয়ে গল্প ও কবিতা লিখছেন এ কথা শুনে তিনি নিজে সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে উত্সাহিত করেন। অতঃপর আমরা পেলাম প্রত্যয়ী একজন মানুষকে। যিনি জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন দেশ, মাটি, মানুষ আর শিশু-কিশোর-নারীদেরকে। তার ভালোবাসার বহমান ¯্রােতেই আমরা পেয়েছি সাহসআলো, সাহসকাব্য আর চেতনায় স্বাধীনতা...
বসবেনা আর পিঁড়িতে/ মানুষ মরে ভাতে, গরু মরে ঘাসে/ কালেকের রৌদ্রে যেন বসুমতী ফাটে।/
শৈশবের দিনগুলো ছিলো স্বপ্নঘেরা রঙিন । একালের মতো কচি বয়স হতেই স্কুল পড়া আর সময় মেনে চলার দিন ছিল না বলে শিশুমনের কল্পনার বিকাশ হতো নানা দিক দিয়ে। জীবন ছিল জীবন্ত, আনন্দও যেন অফুরন্ত ছিল, খেলাধুলা,খাওয়া, পরা, গ্রাম্য পরিবেশ, ফুলঝরা, পাখিডাকা, ভোরে ফুলের গন্ধে, পাখির গানে, রোদে বৃষ্টিতে ফুল ফল কুড়ানো, নদী-পুকুরে সাঁতার কাটা। শরীর স্বাস্থ্য মন অন্তর যেন পরিপূর্ণতা লাভ করত। আকাশ মাটির সাথে মিতালি হতো। পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কোলে চলছিল আদরের ফুলফোটা। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, এসবের শুরু থেকে যে অভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ সেই সময়ের সবার মনের ছাপ রেখেছে সুগভীর করে। স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই, এই বাণী তখনকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতো। প্রতিনিয়ত মানুষ সেই সংগ্রাম করে চলছে, একতাবদ্ধ গণজাগরণ চিরকাল জয়ে পতাকা উড্ডীন করেছে।
এমন একটা সময়ের গল্প। গল্পের প্রথম পর্বে দেখা যায়, বিশাল প্রাচীরের ভেতর বিশাল প্রাসাদ। ফুল-ফল আর নানারকম গাছগাছিলেতে শোভান্বিত শ্যামল ভেতর বাড়িতে দুই পুকুর একটি গোসলের, অন্যটি রান্না করা, কাপড় ধোয়ার কাজের। অন্দরের পুকুরের সঙ্গে প্রাচীরের তলা দিয়ে গেট করা, খাল থেকে নদীতে যাওয়ার পথ। জোয়ারের পানি নববর্ষায় উচ্ছ্বসিত হয়ে গেটের তলা দিয়ে পুকুরে আসত আর আসত অসংখ্য মাছ। বেগম-বিবিরা সেই মাছ ধরতেন অবসরের আনন্দে। অন্দর বাড়িতে পুরুষের প্রবেশ ছিল না, তাই বিবিরা সবাই সাঁতার কেটে, নৌকা বেয়ে আনন্দ-উৎসব করার সুযোগ পেতেন। গরমের দিনে দুপুরে থাকার জন্য ঠান্ডা আটচালা বাংলোর সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে বৃহৎ পুকুরের মধ্যে। দুই ধারে মেহেদি গাছের বেড়ার মধ্যে অজস্র ফুলের গাছ। রঙ্গন গাছের কুঞ্জ বেয়ে লতিয়ে উঠেছে লতা-বেলি, জুঁইয়ের ঝাড়, কামিনী, শেফালি, জবা, সূর্যমুখী। শিউলি বোঁটার রঙে কাপড় রাঙ্গিয়ে পরার জন্য প্রচুর ফুল সংগ্রহ করে বোঁটা শুকিয়ে রাখা হতো। এসব কাজে ছেলেমেয়ে, বউ-ঝিদের উৎসাহ ছিল প্রচুর। ভোর-সকালে ফুল কুড়ানোর পাল্লা দেওয়া হতো, কে কত ফুল কুড়াতে পারে। বাইরে থেকে মালিরাও ফুল পাঠাত অন্দরমহলে। ফুল বাছানিয়ারা তা থেকেও বোঁটা সংগ্রহ করত। আম, জাম, লিচু, আতা, বাতাবি, সফেদা, লেবু, তুঁত, পেয়ারা, তাল, খেজুর, কলা, কামরাঙ্গা, করমচা, চালতা, আমরুল, আঁশফল, সুপারি গাছ প্রাচীরের পাশে বহু বিস্তৃত সীমানার মধ্যে থাকায় তাজা-টাটকা ফল পেতে পরিবারের অভাব হতো না। বাড়িতে অন্দরমহলে বিস্কুট, রুটি, কেকও তৈরি হতো। কিন্তু আমার বড় মামার বিস্কুট, রুটি, কেক, চিনি, নুন, চা, গোলমরিচ গুঁড়া আসত কলকাতার আর্মি নেভি স্টোরস থেকে। এই যে বিশাল প্রাসাদের কথা বলছি, এই প্রাসাদের চারপাশে দারওয়ানরা বাড়ি পাহারা দিত। বাচ্চারাও সেকালে মসজিদে যেতাম আর মসজিদের জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে দেখা যেত ঠিক বিছানায়ই শুয়ে আছে। আর এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হতো- ফেরেশ্তারা বাচ্চাদের সবাইকে ঘরে এনে শুইয়ে দিয়ে গেছেন।
তখন মসজিদে গিয়ে সুর মিলিয়ে জোরে 'কায়েদা বোগ্দাদি' পড়তে হতো। তিন-চারজন মেয়েও যেতো এই কায়দা বোগদাদি পড়ার জন্য। প্রাসাদের মালিকের আদরের বড় নাতি যখন আরবি-ফারসি পড়তে শিখলেন, তখন ছোটরা জের-জবর- পেশ-তশ্দিদ শিখছে। তারা সুর করে পড়তেন- করিমা বেবখ্শা য়ে বর হালেমা/ কে হাস্তম আলীরে কমন্দে হাওয়া/ নেগাহ্দার মারা-জারায়ে খাতা/ খাতা দর্ গোজারো সওয়াবেন্নামা...
গল্পের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে ছন্দিত আনন্দিত কল্লোলে। আর এভাবেই শুভদিনটি চলে আসে। বাংলা আষাঢ় মাসের কোন একটি দিন, ইংরেজি সাল গণণায় দেখা যায়- ১৯৯১ সালের ২০ জুন। এই দিনটিতেই একটি শিশুর জন্ম হয়। আনন্দ-কলরবে শিশুটির জন্মণ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। যেই প্রাসাদের কথা শুরুতেই বলেছি, সেই প্রাসাদটি সারাদেশে পরিচিত। বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ নওয়াব পরিবারের অনেক খ্যাতি তখন। শিশুটির মাতামহ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন শিশুটির মা। ত্রিপুরা জেলার শিলাউড় গ্রামের সৈয়দ আবদুল বারী বিএল ছিলেন তাঁর বাবা। তারা এক ভাই এক বোন। মাটিকে বাদ দিয়ে ফুলগাছের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই আমার মাকে বাদ দিয়ে তারও তেমন কোনো কথা নেই। শিশুটি জন্ম নেওয়ার আগেই মায়ের মুখে 'হাতেম তাইয়ের কেচ্ছা' শুনে শিশুটির নানি আম্মা তাঁর নাম রেখেছিলেন হাসনা বানু। শিশুটির নানা প্রথম বয়সে সদর আলা থেকে জজগিরি পর্যন্ত সারা করে শেষ বয়সে সাধক-'দরবেশ' নাম অর্জন করেছিলে। আলোকিত আগামী গড়ার অনন্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার রঙিন ভূবন নিয়ে যখন তিনি জন্ম নিলেন, নিজের হাতে সেই শিশুটির মুখে মধু দিয়ে তিনি নবাগত শিশুর নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। কিন্তু তাঁর ডাক নাম হাসনা বানুটাই আমাদের পরিবারে প্রচলিত। সেই শিশু হাসনা বানু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন; সুখ স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নে আসে একটা আতঙ্কিত ভাব; সুখ স্বপ্নের মধুর আবেশে মন ভরে থাকে। তারও শৈশবের সুখ স্বপ্ন মধুময়। অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মধ্যে, শিতি পরিবারের আওতায়, ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছে । তাদের পরিবারটি ছিল সুবৃহৎ। মা, মামা-খালা আম্মারা মিলে ছয় ভাই, ছয় বোন। শিশুটির আম্মা বোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। শিশুটির শৈশব-কৈশোর ছিল পরিবারের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ।
গল্পের তৃতীয় পর্বের রঙধনু দূর করেছে কষ্টের কালোমেঘ। আর ঠিক তখন কিছুই বোঝবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি হয়নি শিশুটির। কিন্তু কি জানি কেন তার ভীষণ কান্না পেত। আর তার চেয়ে বয়সে কিছু বড় এক বোনঝি চোখ মুছিয়ে বলতেন, শুধু শুধু কাঁদতে নেই। সিপারের আমপারা পর্যন্ত মসজিদে তাদের পড়া; তারপর কোরআনের সবক আম্মার কাছ থেকেই নিতে হয়েছে, কেননা তখন তারা বড় হয়ে গিয়েছিলেন। তবে জুবিলি স্কুলে প্যারীলাল মাস্টার মশায়ের কাছে তিনিও দু-এক সবক পড়েছেন। তবে তা পুরুষের পোষাকের মাধ্যমে অর্থাৎ পায়জামা-কুর্তা আবার আচকান-পায়জামা পরে গিয়ে । বাল্য-শিা পর্যন্ত তার বিদ্যা হওয়ার পর ভাইয়ারা সব চলে গেলেন কেউ বরিশাল, কেউ ঢাকা আর আমার ভাইয়া গেলেন কলকাতায়। খালা-আম্মা তাকে নিয়ে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মামাত বোনেরা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। শূন্য বিরাট ভবনে পীমাতার পতলে রইলেন শুধু হাসনা বানু একা। আর রইল দাই-খেলাই বাঁদী খানসামা-পেয়াদাদের দল। তখন তার বয়স সাত বছর। আর এই বয়সে নিরালা নিঝুমপুরীতে পাহারা দেওয়ার পেয়াদাদের বেহালার মূর্ছনা অনেক রাত পর্যন্ত তার কানে বাজত। শিশুজীবনের সবচেয়ে প্রকৃত শিক-সাথী ছিলেন তার 'জামাই', অর্থাৎ পুতুল মেয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমি 'শাশুড়ি' হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হাসনা বানুর আম্মার দুধভাই, ভাইয়ারা সবাই তাকে ডাকত মামা। হাসনা ডাকতেন জামাই। সেই জামাইয়ের কোলে বসে বসে শুনতেন পুঁথি পড়া। শুনতেন গান। দেখতেন বেহালার তানে তানে ওস্তাদ বেহালাদারের ভাবোদ্বেল মুখ, কখনও হোসেনের বীরত্বে উচ্ছ্বসিত, কখনও সখিনার ব্যথায় ব্যথিত। আবার পালাগানও হতো। ভালো ভালো পালা সোনাভানের পালা ইত্যাদিথ বানিয়ে ওরা অভিনয় করত। তখন তো আর অভিনয় কী তিনি জানতেন না। তবে তার কাছে মনে হয়েছে শিল্প-সাহিত্য মানুষের অন্তরের সম্পদ। আল্লাহ্ তা সবাইকে দান করেছেন। সবার অন্তরে এ স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ এ নিয়ে বিশ্বজোড়া নাম করে, কেউ বা কোথায় ঢেউয়ে ভেসে তলিয়ে যায় সাধনা-সুযোগ-সুবিধা ও শিার অভাবে তার আর পাত্তা থাকে না। শীতের দিনে খেজুর গাছের রস নামিয়ে নারিকেল, চাউল দিয়ে পেয়াদারা যে শিরনি রাঁধত, হাসনাও জামাইয়ের কোলে বসে তা খেতেন। অনেক রাতে জামাইয়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে নিয়ে গিয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেন। সেইত জীবন-সেই স্বপ্ন সুর ব্যথা, আর তার সঙ্গে শুরু দুঃখ-অভাব-অনটনের। ব্যথার যে কত রূপ তা কি এখনও জানার সূত্র তৈরী হচ্ছে। হারিয়ে পাওয়া-পেয়ে হারানো। চাওয়া-পাওয়া-দেওয়া এ সবই তো ব্যথা-বিজড়িত সুখ-দুঃখ অশ্রুজল সিক্ত, স্মৃতির সুরভিতে সুরভিত। কখনও কোনো দূরান্ত থেকেও এরা ভেসে এসেছে।
গল্পের চতুর্থ পর্ব বয়ে চলেছে কবিতার রাস্তা ধরে- সুফিয়া কামালের কবিতা। আমরা যেই শিশুটির কথা, যেই হাসনা বানুর কথা এতক্ষণ পর্যন্ত বলছি, শুনছি। সেই হাসনা বানু বাংলাদেশের শিশু-কিশোর নারীদের অতি পরিচিত মানুষ। অতি পরিচিত কবি। অনন্য নারী মহিয়ষী। তিনি তার চেতনায় আদর্শে রেখেছিলেন স্বাধীনতা আর স্বাধীকারের স্বাদ। আর তাই শৈশবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও পিছপা হননি। বরং সেই স্বামীর হাত ধরেই নিয়েছে কবিতার নতুন সোপান। আর এভাবেই তিনি একসময় লিখেছেন, সাঁঝের মায়া। যেখানে জীবনের কথা, দেশের কথা, মানুষের কথা তিনি তুলে ধরেছেন পরম মমতায়- অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে
সুন্দর দণি হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/ দণিা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/ বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/ দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।/ সুমধুর মোহে ধীরে ধীরে ধীরে/ প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলাশেষে দিবসের তীরে/
ডুবিল যে শান্ত মহিমায়,/ তাহারি সে অস্তরাগে বসন্তের সন্ধ্যাকাশ ছায়।/ ওগো কান্ত দিবাকর! তব অস্ত-উৎসবের রাগে/ হেথা মর্তে বনানীর পল্লবে পল্লবে দোলা লাগে...
পঞ্চম পর্বে এসে স্বপ্নজ জীবনের ডানা মেলে বলা যায়, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা 'হেনা' সুফিয়া কামাল-এর মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক করে। গদ্য লেখার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে কবিতার প্রতি মোহগ্রস্থ হন জমিদার বাড়ির নাতনি হাসনা বানু আমাদের আলোকিত সময়ের সাহসমানুষ সুফিয়া কামাল। বেগম রোকেয়া, বেগম সারা তাইফুর ও বেগম মোতাহেরা বানু প্রমুখের লেখাও তাঁকে উৎসাহিত করে। আর তাই এগিয়ে যান জীবনের একটাই লক্ষ্য নিয়ে আর তা হলো মানুষের মঙ্গল। এরপর যখন তার বিয়ে হয় তখন, সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বি.এম.কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফ.এ. পাশ করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাাৎ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ তিনি লাভ করেন আমাদের সুফিয়া কামাল। যা তাঁকে সাহিত্য চর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর উত্সাহ উদ্দীপনা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন; এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত সম্পাদিত 'তরুণ' পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন সে সময়ের তরুণ মেধাবী ছাত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন। 'তরুণ' পত্রিকার জন্যে লেখা চাই। নেহাল হোসেনের মনে হলো তার নববধু সুফিয়ার কাঁচা হাতের কিছু লেখা আছে। তিনি সুফিয়ার ২/৩ টি লেখা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক একটি গল্প ও একটি কবিতা মনোনীত করে প্রথমে গল্পটি ছাপার ব্যবস্থা করলেন। 'তরুণ' পত্রিকার প্রথম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় মিসেস এস.এন. হোসেন নামে সুফিয়া কামাল-এর প্রথম লেখা 'সৈনিক বধূ' প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য ব্যাপার প্রথম লেখা প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দু মুসলমান সকলে অত্যন্ত প্রশংসা করে আরও লেখার জন্য তাঁকে উত্সাহিত করেন। এ সময় বাংলার শ্রেষ্ঠ মহিলা গীতিকবি কামিনী রায় আসেন বরিশালে। একজন মুসলমান মেয়ে গল্প ও কবিতা লিখছেন এ কথা শুনে তিনি নিজে সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে উত্সাহিত করেন। অতঃপর আমরা পেলাম প্রত্যয়ী একজন মানুষকে। যিনি জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন দেশ, মাটি, মানুষ আর শিশু-কিশোর-নারীদেরকে। তার ভালোবাসার বহমান ¯্রােতেই আমরা পেয়েছি সাহসআলো, সাহসকাব্য আর চেতনায় স্বাধীনতা...
email: mominmahadi@gmail.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন