আপনাদের কাছে এ বিজয় দিবসের তাত্পর্য অনেক বেশি, অনেক মূল্যবান; কিন্তু আমি যেহেতু অংশীদার, এ দিবস যারা সৃষ্টি করেছেন তাদের একজন আমি, সে কারণে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়, যা ব্যক্ত করা যায় না। অনেক ভালোবাসা, মানবিক বিনিময় এর সঙ্গে জড়িত। অনেক মানুষ এসব ভুলে যেতে পারে; কিন্তু কবিরা বিস্মরণপ্রিয় নয়, তারা ভোলে না।
আমার মনে পড়ছে, আজ তো ষোলো তারিখ; এই ষোলো কিংবা পনেরো, হয়তো ষোলোই হবে, দুপুরে খেতে বসেছি। আমার ভাগ্নি আমাকে বলছে—মামা, আমাদের বোধহয় আর দেশে যাওয়া হবে না। আমি ওকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার জন্য বলেছি যে, কী যে বলিস না তুই! খুব উচ্চহাস্য করলাম আমি। বললাম, দেখিস, আমরা খুব তাড়াতাড়ি জয়ী হয়ে ঢাকায় ফিরে যাব। আমি তো একটি কথার কথা বলেছি ভাগ্নিকে; কিন্তু দৈবক্রমে সত্যিই বিজয় দিবস এসে গেল। আমাদের যিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন, জেনারেল এমএজি ওসমানী, তিনি আমার ভগ্নিপতির হাতে একটা স্লিপ দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আমি সেটা পড়ে দেখলাম, এই মুহূর্তে আপনি ঢাকায় চলে যান। কী আশ্চর্য, আমি স্লিপ নিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি আমার ভগ্নিপতির মুখের দিকে। বললেন, কীভাবে যাবেন সেটা তো? সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি প্লেনেই যাবেন। একটা এয়ার ক্যারিয়ারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তো উঠলাম গিয়ে ব্যবস্থামত প্লেনে। একটা মিলিটারি আদান-প্রদানের এয়ার ক্যারিয়ার। সেখানে যাদের দেখলাম তারা সবাই আমার পরিচিত; কিন্তু তাদের মধ্যে দু’জনের নামই আমার মনে পড়ে। একজন হলেন সিকান্দার আবু জাফর ভাই, আরেকজন হলেন কবি আবিদুর রহমান।
ঢাকায় এসে নামলাম তেজগাঁও বিমানবন্দরে। সবাই নেমেই যার যার রাস্তায় চলে গেল। আমি একা। আর আমার স্যুটকেসটা ভারী। অনেক বই-টই নিয়ে এসেছিলাম তো! এখন কী করি? আমি কাঁধে তুলে নিয়ে অনেক কষ্টে গেটে এসে দাঁড়ালাম। এসব স্মৃতি মনে পড়ছে। অনেক স্কুটার আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমাকে দেখে ফেলে চলে যাচ্ছে। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এক বৃদ্ধ স্কুটারওয়ালা, আমাকে দেখে চলে গেলেন, অনেক দূর গিয়ে বোধহয় তার হৃদয়ে মমতা জাগায় আবার ফিরে এলেন, ‘উঠুন’। কোথায় যাব সেটা না, উঠুন। আমি স্যুটকেসটা কোনোমতে তুলে নিয়ে উঠে পড়লাম। তারপর বললাম, আমি খিলগাঁও বাগিচায় যাব। তিনি স্টার্ট করে চলে যাচ্ছেন। খিলগাঁও বাগিচায় নামলাম। আমার বাড়ির সামনে—বাড়িতে তো কেউ নেই, আমি জানি। আমি স্কুটারওয়ালাকে টাকা দিতে গেলাম। আমার পকেটে ভারতীয় টাকা। তিনি বললেন, যা খুশি দেন। আমি তাকে টাকা দিলাম। তিনি হেসে নিলেন। বললেন, যান যান ভেতরে যান, গিয়ে দেখেন কেউ আছে কি-না। আমি স্যুটকেসটা টানতে টানতে ভেতরে গিয়ে দেখি দরজা খাঁ খাঁ করছে। তালা ছিল। কোনো কিছু নেই। ঘর খালি। শূন্য খাঁ খাঁ করছে। এই-ই বিজয় দিবস আমার কাছে।
কতগুলো জিনিসের কখনও ক্ষতিপূরণ হয় না। আমারও কোনো ক্ষতিপূরণের কথা আমি বলছি না। আমরা শুধু একটা দিন পেয়েছি। সেটা হলো বিজয় দিবস। আর কোনো কিছু না, আর কিছু না। অনেক হৃদয়বিদারক স্মৃতি অতিক্রম করে এসেছি। আপনাদের কাছে এ বিজয় দিবস একরকম, আমার কাছে অন্যরকম। আমার কাছে অনেক স্মৃতি আছে, যা মেলতে গেলে ডালপালা ছড়িয়ে পড়বে। সেগুলো তো বলা যায় না, বলা যাবে না। আর কেইবা সেগুলো মনে রাখবে! কিছু তো লিখেছি। সব কথা তো লেখা যায় না। সব কথা কি লেখা যায়, সব? না, না, সব কথা লেখা যায় না। অনেক বিস্মৃতি, স্মৃতি এই দিবসের সঙ্গে জড়িত। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, এমনিই এদিনটি আসেনি। এ দিনটির জন্য অনেকের অনেক ত্যাগ আছে। আমার জন্য আমার মামার বাড়িটা কামান দেগে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ধনী লোক ছিলেন। আমার মামার বাড়িতে আমি লজ্জায় আর যেতাম না; কিন্তু আমার মামারা ব্যবসায়ী মানুষ। তারা আবার সব বিল্ডিং-টিল্ডিং করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি যাই না। আমার মামিরা খবর দিয়ে, লোক পাঠিয়ে আমাকে নিয়েছেন। কী রে, তুই আসিস না কেন? আমি বললাম, আমার জন্য এত ক্ষতি হলো! বললেন, এজন্যই তুই আসিস না? দেখ, আবার বিল্ডিং-টিল্ডিং হয়ে যাচ্ছে। তোর মামারা তো ব্যবসায়ী মানুষ, ওরা কি ওসবের তোয়াক্কা করে? খুব আদর করে মামিরা খাওয়ালেন আমাকে। কিন্তু আমি খুব শরম পেয়েছিলাম যে, আমার জন্য এসব মানুষের এত ক্ষতি হলো! এসবের জন্য কে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? কেউ দেয়নি। যা-ই হোক, আমি এজন্য বলছি যে, বিজয় দিবস আপনাদের কাছে একরকম, আমার কাছে আরেকরকম। আমার কাছে অনেক হৃদয়বিদারক স্মৃতি আছে, অনেক স্মৃতি। এমন অনেক মানুষ আমাকে টেনে টেনে ঘরে নিয়ে গেছে। নিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে রেখেছে। তাদের চেহারাগুলো মনে পড়ছে। হ্যাঁ, যে ক’জনের কথা খুবই মনে পড়ে, তারা জীবিত নেই। এই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা বড় অসহনীয়, অনেক কষ্ট আছে বিজয় দিবসের পেছনে।
আপনাদের কাছে একটা কথা বলি, এই যে বিজয় দিবস পালন করছেন, এটা বলা যায় স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে না পারলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা ঠেকানো মুশকিল হবে। আপনারা শুধু বাংলাদেশকে দেখেন একটা মানচিত্র। তা নয়, এর একটা অন্তর্বর্তী, একটা অদৃশ্য মানচিত্র আছে। সে মানচিত্র কী? এর পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আকরিক লোহা, কয়লা। লোহা আর কয়লা পাশাপাশি থাকলে সেটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশে গ্যাস আছে। স্তরের পর স্তর গ্যাস আছে। এর পরের স্তরেই আছে পেট্রল। আপনারা জানেন না; কিন্তু পৃথিবীর সব লোভী শকুন, বিদেশি—যারা এখানে আসে তারা জানে এর পেটের মধ্যে কী আছে। এই যে বাংলাদেশের পেটের ভেতরে কী আছে, আমরা জানি না—এটা একটা অপরাধ। আমাদের জানতে হবে, আমাদের দেশের মাটির নিচে কী আছে, উপরে কী আছে, সমতলভূমিতে কী আছে, টিলা-টক্করে কী আছে; সব জানতে হবে। এটা না জানলে দেশপ্রেম যাকে বলে সেটা গড়ে ওঠে না।
এ হলো বিজয় দিবসের কথা। দেশ সম্পর্কে সবসময় বেশি জানতে হবে। আমি এদেশের নদী-নালা, নারী-প্রকৃতি এর মধ্য দিয়ে এসেছি। আমি বাস করেছি। আমি ভালোবেসেছি। সেজন্য আমার কবিতায় তার চিহ্নগুলো ফুটে উঠেছে। এ কবিতাই যেহেতু আমার কর্ম, কবিতাই যেহেতু আমার ভাষা আর যেহেতু কবিতাই হলো মানবজাতির মাতৃভাষা, সেজন্য কাব্যের পেছনেই থাকি। কবি ছাড়া আর তো কিছু নই। কী আমি? কিছু নই। কবি ছাড়া কিছু নই। এই কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করতে হবে। নিজের দেশের, জাতির ভাষা ও কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই যারা করে, তারাই হলো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। এটা স্মরণ রাখবেন আপনারা।
অনুলিখন : আহমদ বাসির
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন