তন্দ্রার মনযোগ ভাঙে দূরের একটি ট্রাকের গর্জনে। সে মৃদু আলোর দিকে তাকায়, খানিকটা দূরে, ট্রাকের আলোয় রাস্তার মাঝখানে শুয়ে থাকা একটি বিড়াল স্পষ্ট হয়। সম্ভবত প্রচণ্ড গরমের কারণেই বিড়ালটি এমনভাবে রাস্তায় বসে আছে একটু খোলা হাওয়ায় শীতল হবে বলে। বিড়ালটিকে তন্দ্রার আদর করতে ইচ্ছে করে, ভাবতে ভাবতে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে আসা দূরের ট্রাকটি মুহূর্তেই বিড়ালটিকে চাকায় পিষ্ট করে আঁধার করে দিয়ে যায়। ল্যাম্পপোস্টের নিচে পড়ে থাকে ২৫০ ভোল্ট বাতির মৃদু আলো। বিড়ালটির মৃত্যু তন্দ্রার ভারাক্রান্ত মনে একটু বড়সড় ধাক্কা দেয়, একি তবে বড় কোন দুর্ঘটনার আভাস।সুপ্ত’র সঙ্গে তন্দ্রার প্রেম করে বিয়ে হয়নি। ওদের বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবেই তবে বিয়ের আগেই তারা একে অপরকে দেখেছিল কয়েকবার। কলেজ ক্যাম্পাসে দু’জনের প্রথম কথা হয়। লেকের ধারে বসে দীর্ঘক্ষণ নিরবতা শেষে তন্দ্রার হাতে সুপ্তর স্পর্শ যেনো একরাশ কথার সজীবতা দিয়ে যায়। তারপর এই সংসার; বিয়ের সময় অবশ্য তার দু’একজন বিবাহিত বান্ধবী পরামর্শ দিয়েছিল দেখিস, পুরুষ মানুষের মন একটু বুঝে শুনে চলিস, সবকথা পুরুষকে বলতে নেই, সবকথা পুরুষের ধাতে সয় না। কথাটি তন্দ্রার মূর্খ সংস্কৃতি মনে হয়, সবকথাই যদি বলা না যায় তবে আর দুয়ের বন্ধন কেন!
ভাবতে ভাবতে রাত্রি দ্বি-প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই, ঘুম আসছেও না। ফলে দোতলার উত্তর দিকের জানালা খুলে দিয়ে সে বড় রাস্তার মৃদু আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময়ও হঠাৎ হঠাৎ মৃদু আলোয় মানুষের আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ হয় আবার কখনও কখনও মালবাহী দু’একটি ট্রাকের গর্জন মনযোগ ভাঙে। এই তো ক্ষাণিক আগে রাস্তার একটি বিড়ালকে চাপা দিয়ে গেছে একটি ট্রাক। ট্রাকের ড্রাইভারটি নিশ্চয়ই একজন মানুষ কিন্তু কেমন মানুষ। এরকম ফাঁকা রাস্তায় কেউ এভাবে বিড়ালটিকে হত্যা করতে পারে, নিজের কাছেই প্রশ্ন করে তন্দ্রা।
সুপ্ত সকালবেলা নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে অফিসে, এখনও ফেরেনি। সবেমাত্র তিন-চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ওদের বিয়েরকাল। এখনি সুপ্তর মন বাইরে চলে গেছে, খুব সাধারণ একজন মেয়ের মতো সেও এইকথা ভাবে। অথচ জীবনটাকে খুব সহজ করে নিয়েছিল সে নিজের মতো। সারাটা জীবন কি তবে এভাবেই কাটাতে হবে, খুব আফসোস হয় তন্দ্রার। তার বিবাহিত বান্ধবীদের কথা মনে পড়ে। ওদের কারও কারও বিয়ের বয়স তিন-চার বছর পেরিয়ে গেছে তবু ওদের স্বামী সম্পর্কে মধুর কথা শোনে নিজেকে দুর্ভাগ্যবতী মনে হয়। তার কষ্টটা বাইরে প্রকাশ করার মতো নয় নিজে কাছে সওয়া ছাড়া। কাকে বলবে সে, সেই একটি ঘটনাই তাকে বারবার অবদমিত করে রাখে। কেন সে এমনটি করেছিল তার আজ কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। আজ তো জীবনের মানেই অন্যরকম বোধ হচ্ছে। নিজের কাছেই নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হয়। তার কিবা দোষ ওটা তো বয়সজনিত ঘটনা, তাছাড়া সে নিজেও বুঝতে পারেনি কিভাবে ওটা ঘটেছিল। আজ বুঝে, ওরকম আবেগ ও বিশ্বাস কখনও কখনও ভাল নয়। পুরনো স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে, কখন যে অতীতমন্থনে ডুবে যায় তার মন সে নিজেও জানে না। একটি মুখোশ তার দিকে স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। সে রাগে, দুঃখে মনে মনে ভাবে মুহূর্তেই আগুন জ্বালিয়ে দেবে মুখোশটির শরীরে, কেন ওভাবে তাকে প্ররোচিত করেছিল।
ক্রমশ মুখোশটি অস্পষ্ট হতে হতে আবার ভেসে ওঠে বান্ধবীদের মুখ। আজ তাদের কথাই সত্যি মনে হয় নইলে সেই ঘটনাটি শোনার পর থেকে সুপ্ত এত মনমরা হয়ে আছে কেন। তন্দ্রার চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল, আধোঘুমের লেশলাগা চোখেই সে রাস্তার দিকে তাকায় এবং মুহূর্তেই তন্দ্রালু চোখ ভেঙে দিব্যজগতে ফিরে আসে সে। সুপ্তর আগমন দৃশ্যটি আজ তার কাছে অন্যরকম মনে হয়। সুপ্ত কি আজ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরছে। সাধারণত এ অবস্থায় পুরুষরা মদটদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে। কলিংবেল বেজে ওঠার আগেই সে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, স্বচ্ছ হয়ে ওঠে সুপ্তর মুখ; কান্ত, তন্দ্রালু আর হাজার প্রশ্নের বাণ যেন চোখ বেয়ে নেমে আসে তন্দ্রার দিকে। তার ভীত শরীর হাল্কা গরম আর ভয়ার্ত প্রতিবেশে ঘামতে শুরু করেছে। সুপ্ত কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করে, দরজা বন্ধ করে পেছনে পেছনে দোতলায় ওঠে তন্দ্রা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কোট-টাই খুলে সুপ্ত। তন্দ্রার ইচ্ছা হয়, প্রতিদিনের মতো আজো কোট-টাই খুলে দিতে কিন্তু সাহস হয় না। কোন এক অক্টোপাস যেন শীতল করে রেখেছে তার হাত-পা-মুখ। হাল্কা ট্রাউজার পরে বাথরুমে প্রবেশ করে সুপ্ত। ক্ষাণিক পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসে কিন্তু তার চোখে-মুখে হাল্কা কান্তির ছাপ রয়ে গেছে, আয়নায় চুল আঁচড়িয়ে বিছানার দিকে যায় এমন সময় কথা ফোটে তন্দ্রার।
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খাবে চল।
খাব না, বলেই সুপ্ত বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। তন্দ্রার রাতের খাবার খাওয়া হয়নি, কথা না বাড়িয়ে সেও বিছানায় গা ছেড়ে দেয়, কিছুক্ষণ ভাবে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা? তারপর প্রশ্ন করে...
দুপুরে খেতে এলে না যে?
ইচ্ছে হয়নি, সুপ্তর সহজ উত্তর।
ক’দিন যাবত তুমি এমন করছ, কি এমন দোষ করেছি যে...। তন্দ্রার কথা শেষ হতে না হতেই সুপ্তর স্বাভাবিক ঝাঁঝালো স্বর...
দেখ, এই মাঝরাতে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাই না। যা হয়েছে তা মামুলি বিষয়, খুবই স্বাভাবিক কিন্তু চেপে রাখা আরও বেশি অস্বাভাবিক। আমাকে তাই করতে হচ্ছে, এরকম বিপাকে পড়তে হবে কোনদিন ভাবিনি আমি। এত রাতে রুমে বাতি জ্বালানো থাকলে, বাবা-মা চলে আসতে পারেন। বাতিটা নিভিয়ে দয়া করে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও। তন্দ্রা আর কথা বাড়ায় না, ধীরে ধীরে ওঠে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। তারপর শেষ রাত্রে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে দু’জন কেউ জানে না।
মন: মনুষ্য ধারাবাহিকতায় একটি জটিল বিষয়। মিরাকল। সে কখন কোথায়-যে যায় তার কোন ঠিকানা নেই। বিড়াল, বারো ঘরের পাতিলের গন্ধ শুঁকে শেষে উগাড়ের ইঁদুর নিয়ে যার রাত্রিবাস। এখানেই জীবনের সম্পর্ক জড়িত, আমাদের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবখানেই রয়েছে মনোবিত্ত কিংবা নেই। এই আছে ও নেই এর মধ্যে আমাদের আজন্ম বসবাস, এই কথা হয়েছে জানা।
সুপ্ত ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসছে না। নুসরাত আপুর কথা স্মরণ হয় তার। প্রতিবেশী। বড়বোন শুভ্রার বান্ধবী। বিয়ের কিছুদিন পর হঠাত একদিন বাড়ির বাঁশঝাড়ে গলায় দড়িবেঁধে আত্মহত্যা করলো সে। সবাই অবাক, নুসরাত এরকম করলো কেন? পরে, বাড়ির লোকজনের কানাঘুঁষায় আসল ঘটনাটি জেনেছিল তন্দ্রা। নুসরাত তখন হাইস্কুলের ছাত্রী। ওদের বাড়িতে একজন গৃহশিক্ষক থাকতো। এই শিক্ষকের সাথেই বাড়ির সকলের অজান্তে নুসরাতের প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যায়। সম্পর্ক এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একে-অপরের দেহদানে সঠিক হিসেবের অবকাশ হয়নি কারোর। একসময় অসতর্ক নুসরাত সন্তান সম্ভবা হয়ে যায়। ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে বাড়ির লোকজন জেনে গেলে কোন একরাতে নুসরাত-কে স্থানিয় এক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোরশন করিয়ে আনে। ঘটনাটি প্রতিবেশী কেউ বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির লোকজন ওই গৃহশিক্ষক-কে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেয়।
তার বছর পাঁচেকের মধ্যেই বিয়ে হয় নুসরাতের। বিয়েরাতেই বরের কাছে ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল নুসরাত। ঘটনাটি জানার পর ওর বর আর তাকে বউ হিসেবে রাখতে চায়নি। ফিরতি নাইয়রের নামে নুসরাত-কে বাড়ি রেখে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয় ওর বর। অসহায় নুসরাত ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে শেষমেষ গলায় দড়ি বেধে আত্মহত্যা করে।
শুভ্রাকে মানুষ বলে মনে হয় না তার। ওইরকম সময়েই তো অহনের সাথে তন্দ্রার অনেকটা প্রেমের মতোই ঘটনাটি ঘটেছিল। অহন শুভ্রার ভাসুরের ছেলে। সুদর্শন যুবক। ওইরাতের ঘটনাটি মনে পড়ে তন্দ্রার। শুভ্রার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে তন্দ্রা আর অহন একসাথে ছিল। ছেলেটা খুব পাগল, অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। তন্দ্রা নিজেও খুব সম্মোহিত আর চড়ম লোভী হয়ে ওঠেছিল সে রাতে। ভাবতে ভাবতে খুবই লজ্জাক্রান্ত হয় তন্দ্রা। ঘুমন্ত স্বামীকে পাশে রেখে এসব ভাবতে ভালো লাগে না তার। তাছাড়া তার চিন্তা ঘুমন্ত সুপ্ত আবার টের পেয়ে যাচ্ছে নাতো! সে রাতের নিজস্ব আলোয় সুপ্তর দিকে তাকায়। সুপ্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। ফ্যানের হালকা বাতাসেও সুপ্তর শরীর মৃদু ঘর্মাক্ত। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু জলের স্থির সন্তরণ। জনশ্রুতির কথাটি মনে হয় তার। যে পুরুষের নাক বেশি ঘামে সে পুরুষ খুব বউ-আদরের হয়। সুপ্তকে আদর করতে ইচ্ছে হয় তার কিন্তু পারে না। ঘুমন্ত স্বামীকে আদর করে দিতে কেমন যেন গর্হিত অপরাধবোধ আটকে রাখে তাকে। মনে ভাবে, সুপ্তর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে ওকে ইচ্ছেমতো আদর করে প্রমাণ করবে জনশ্রুতির কথাটি আসলেই ঠিক।
অন্ধকারের আলোতেই মুখোশটির অস্তিত্ব টের পায় তন্দ্রা। মুখোশটি তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে আর প্ররোচিত করতে থাকে। পালিয়ে যা তন্দ্রা, পালিয়ে যা, দূরে কোথাও। নইলে শান্তি পাবি না। পালাবার এখনই সময়। তন্দ্রা ভাবে সত্যি সত্যি সে পালিয়ে যাবে কিনা। গেলে কেমন হয়? একেবারে অজানায়, দূরে, অনেক দূরে। নুসরাতের কথা মনে হয় তন্দ্রার। তারমতো সেও কী দূরে কোথাও গিয়ে আত্মহত্যা করবে নাকি। আবার ভাবে আত্মহত্যা করবে কেন? সে সুপ্তকে ভালোবাসে আর সুপ্তও তাকে, তাই তার আত্মহত্যা করা ঠিক হবে না। অস্থির হয়ে ওঠে তন্দ্রা, তার শরীরও ঘামতে থাকে। মুহূর্তেই সে মুখোশটিকে ধরে ফেলতে চায় কিন্তু ধরতে পারে না। অন্ধকারেই মুখোশটি একবার তার পাশে আসে... একবার সোফায় গিয়ে বসে... একবার সুপ্তর কম্পিউটার টেবিলে গিয়ে বসে... একবার জানালার পাশে দাঁড়ায়... একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়... মুখোশটিকে সে যেন কিছুতেই ধরতে পারে না। ঘর্মাক্ত তন্দ্রা বিছানা ছেড়ে টেবিলের দিকে যায়। জগভর্তি পানি থেকে একগ্লাস পানি খায় সে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নির্জন রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের ২৫০ ভোল্ট বাতির মৃদু আলো আর ট্রাকচাপায় থেতলে যাওয়া বিড়ালটিকে দেখতে থাকে সে।
সকালে নাস্তার টেবিলে দুজনেই চুপচাপ থাকে যেন একে-অপরকে কেউ চেনে না। অন্যান্য দিন তন্দ্রা নিজ হাতে ব্রেড-এ জেলি মেখে খেতে দিয়েছে কিন্তু আজ দিচ্ছে না, নিজেও নিচ্ছে না। হঠাত সুপ্ত উত্তেজিত হয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করে ফেলে সেই ভয়। তন্দ্রা কী রাতে ঘুমিয়েছিল? বোধ হয় না, ওর চোখ দেখে বোঝা যায়। হয়তবা রাতে কেঁদেও ছিল। নাস্তা সেরে সুপ্ত রমে ফিরে অফিস যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছে, এমন সময় তন্দ্রা এসে সামনে দাঁড়ায়।
তোমার সাথে কথা আছে।
বল, সুপ্ত’র উত্তর।
আমি বাড়ি যাব।
এবার সুপ্ত মনযোগী ভঙ্গিতে আরেকটু সামনে এগিয়ে তন্দ্রার মুখোমুখি হয়।
এখানে কী খারাপ লাগছে? হেভ য়্যু ফিল বোরিং হিয়ার!
এমন একটি সিরিয়াস বিষয়ে সুপ্ত’র হেয়ালিপনার অর্থ তন্দ্রা বুঝতে পারে না, সে উত্তরহীন তাকায়।
ওকে, ওকে ইফ য়্যু ফিল বোরিং অর ডিজগাস্টিং দেন য়্যু কেন গো বাট নট উইদাউট মি। আই ওয়ান্ট টু গো উইথ য়্যু ফর রিচড্ এন্ড এ পিচফুল এরেঞ্জমেন্ট ফর য়্যু দেয়ার। হেভ য়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড ডেয়ার অনারেবল মেডাম। এই বলে তন্দ্রার মুখটা দু’হাতে একটু উঁচিয়ে ধরে নিজের খুব কাছাকাছি এনে সম্মোহনের মতো তাকায় সুপ্ত। তন্দ্রা কিছু বুঝতে পারে না, সে সুপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম দিনের মতো, মহাজাগতিক জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে। ফাঁকে, কখন যে সুপ্ত তার ওষ্ঠে একটা চুম্বন দৃশ্য এঁকে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়, ঠাহর হয় না তন্দ্রার।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে গ্রামের মেয়েরা যে রকম বৃষ্টিতে ভিজে সজীবতা উপভোগ করে, তন্দ্রাও সেই সজীবতা ফিরে পায়। বুঝতে পারে, কী ভুলটাই না সে করতে বসেছিল। মতিভ্রমে মানুষের এরকমই হয়। তার মুখে তখনও ভাষা ফুটেনি, ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে সুপ্তকেও সে একটি চুম্বন করে আসে কিন্তু পারে না, প্রথম দিনের মতো বহুকালের অচেনা বোধ কাজ করে। আজন্ম নারীজনমের লজ্জাবোধ তাকে আটকে রাখে।
অফিসে ফিরেই সুপ্ত নিশ্চিত টেলিফোন করবে, তন্দ্রা জানে। তাই রুমেই থাকে, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, বই পড়ে, টেলিভিশন অন করে কিন্তু ভালো লাগে না, সিডি প্লেয়ার অন করে লোপামুদ্রা মিত্রের গান শোনে ‘ছেলেবেলার বৃষ্টি মানেই আকাশজোড়া...’ গরম পড়েছে তবু এই গান খারাপ লাগে না; স্মৃতিমন্থন হয়। ফ্যানটা ছেড়ে সে উত্তরের জানালাটা পুনরায় খুলে দেয়। খুলতে খুলতে মনে পড়ে বড় রাস্তায় গতকাল রাতে একটি বিড়াল ট্রাকচাপা পড়েছিল। তার থেতলে যাওয়া চিহ্ন এখনও স্পস্ট হয়। বিড়ালটির কোনো দোষ ছিল না, সেই ভ্রুণটিরও... পুনরায় তার সেই ছায়াটির কথা মনে হয় কিন্তু দিনের শ্বেতশুভ্র আলোয় তাকে দেখতে পায় না সে। তন্দ্রা জানে এবার যদি তাকে সামনে পায় সে নিশ্চিত গলাটিপে হত্যা করবে।
ভাবতে ভাবতে রাত্রি দ্বি-প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই, ঘুম আসছেও না। ফলে দোতলার উত্তর দিকের জানালা খুলে দিয়ে সে বড় রাস্তার মৃদু আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময়ও হঠাৎ হঠাৎ মৃদু আলোয় মানুষের আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ হয় আবার কখনও কখনও মালবাহী দু’একটি ট্রাকের গর্জন মনযোগ ভাঙে। এই তো ক্ষাণিক আগে রাস্তার একটি বিড়ালকে চাপা দিয়ে গেছে একটি ট্রাক। ট্রাকের ড্রাইভারটি নিশ্চয়ই একজন মানুষ কিন্তু কেমন মানুষ। এরকম ফাঁকা রাস্তায় কেউ এভাবে বিড়ালটিকে হত্যা করতে পারে, নিজের কাছেই প্রশ্ন করে তন্দ্রা।
সুপ্ত সকালবেলা নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে অফিসে, এখনও ফেরেনি। সবেমাত্র তিন-চার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে ওদের বিয়েরকাল। এখনি সুপ্তর মন বাইরে চলে গেছে, খুব সাধারণ একজন মেয়ের মতো সেও এইকথা ভাবে। অথচ জীবনটাকে খুব সহজ করে নিয়েছিল সে নিজের মতো। সারাটা জীবন কি তবে এভাবেই কাটাতে হবে, খুব আফসোস হয় তন্দ্রার। তার বিবাহিত বান্ধবীদের কথা মনে পড়ে। ওদের কারও কারও বিয়ের বয়স তিন-চার বছর পেরিয়ে গেছে তবু ওদের স্বামী সম্পর্কে মধুর কথা শোনে নিজেকে দুর্ভাগ্যবতী মনে হয়। তার কষ্টটা বাইরে প্রকাশ করার মতো নয় নিজে কাছে সওয়া ছাড়া। কাকে বলবে সে, সেই একটি ঘটনাই তাকে বারবার অবদমিত করে রাখে। কেন সে এমনটি করেছিল তার আজ কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। আজ তো জীবনের মানেই অন্যরকম বোধ হচ্ছে। নিজের কাছেই নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হয়। তার কিবা দোষ ওটা তো বয়সজনিত ঘটনা, তাছাড়া সে নিজেও বুঝতে পারেনি কিভাবে ওটা ঘটেছিল। আজ বুঝে, ওরকম আবেগ ও বিশ্বাস কখনও কখনও ভাল নয়। পুরনো স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে, কখন যে অতীতমন্থনে ডুবে যায় তার মন সে নিজেও জানে না। একটি মুখোশ তার দিকে স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। সে রাগে, দুঃখে মনে মনে ভাবে মুহূর্তেই আগুন জ্বালিয়ে দেবে মুখোশটির শরীরে, কেন ওভাবে তাকে প্ররোচিত করেছিল।
ক্রমশ মুখোশটি অস্পষ্ট হতে হতে আবার ভেসে ওঠে বান্ধবীদের মুখ। আজ তাদের কথাই সত্যি মনে হয় নইলে সেই ঘটনাটি শোনার পর থেকে সুপ্ত এত মনমরা হয়ে আছে কেন। তন্দ্রার চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল, আধোঘুমের লেশলাগা চোখেই সে রাস্তার দিকে তাকায় এবং মুহূর্তেই তন্দ্রালু চোখ ভেঙে দিব্যজগতে ফিরে আসে সে। সুপ্তর আগমন দৃশ্যটি আজ তার কাছে অন্যরকম মনে হয়। সুপ্ত কি আজ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরছে। সাধারণত এ অবস্থায় পুরুষরা মদটদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে। কলিংবেল বেজে ওঠার আগেই সে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, স্বচ্ছ হয়ে ওঠে সুপ্তর মুখ; কান্ত, তন্দ্রালু আর হাজার প্রশ্নের বাণ যেন চোখ বেয়ে নেমে আসে তন্দ্রার দিকে। তার ভীত শরীর হাল্কা গরম আর ভয়ার্ত প্রতিবেশে ঘামতে শুরু করেছে। সুপ্ত কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করে, দরজা বন্ধ করে পেছনে পেছনে দোতলায় ওঠে তন্দ্রা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কোট-টাই খুলে সুপ্ত। তন্দ্রার ইচ্ছা হয়, প্রতিদিনের মতো আজো কোট-টাই খুলে দিতে কিন্তু সাহস হয় না। কোন এক অক্টোপাস যেন শীতল করে রেখেছে তার হাত-পা-মুখ। হাল্কা ট্রাউজার পরে বাথরুমে প্রবেশ করে সুপ্ত। ক্ষাণিক পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসে কিন্তু তার চোখে-মুখে হাল্কা কান্তির ছাপ রয়ে গেছে, আয়নায় চুল আঁচড়িয়ে বিছানার দিকে যায় এমন সময় কথা ফোটে তন্দ্রার।
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খাবে চল।
খাব না, বলেই সুপ্ত বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। তন্দ্রার রাতের খাবার খাওয়া হয়নি, কথা না বাড়িয়ে সেও বিছানায় গা ছেড়ে দেয়, কিছুক্ষণ ভাবে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা? তারপর প্রশ্ন করে...
দুপুরে খেতে এলে না যে?
ইচ্ছে হয়নি, সুপ্তর সহজ উত্তর।
ক’দিন যাবত তুমি এমন করছ, কি এমন দোষ করেছি যে...। তন্দ্রার কথা শেষ হতে না হতেই সুপ্তর স্বাভাবিক ঝাঁঝালো স্বর...
দেখ, এই মাঝরাতে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাই না। যা হয়েছে তা মামুলি বিষয়, খুবই স্বাভাবিক কিন্তু চেপে রাখা আরও বেশি অস্বাভাবিক। আমাকে তাই করতে হচ্ছে, এরকম বিপাকে পড়তে হবে কোনদিন ভাবিনি আমি। এত রাতে রুমে বাতি জ্বালানো থাকলে, বাবা-মা চলে আসতে পারেন। বাতিটা নিভিয়ে দয়া করে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দাও। তন্দ্রা আর কথা বাড়ায় না, ধীরে ধীরে ওঠে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। তারপর শেষ রাত্রে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে দু’জন কেউ জানে না।
মন: মনুষ্য ধারাবাহিকতায় একটি জটিল বিষয়। মিরাকল। সে কখন কোথায়-যে যায় তার কোন ঠিকানা নেই। বিড়াল, বারো ঘরের পাতিলের গন্ধ শুঁকে শেষে উগাড়ের ইঁদুর নিয়ে যার রাত্রিবাস। এখানেই জীবনের সম্পর্ক জড়িত, আমাদের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবখানেই রয়েছে মনোবিত্ত কিংবা নেই। এই আছে ও নেই এর মধ্যে আমাদের আজন্ম বসবাস, এই কথা হয়েছে জানা।
সুপ্ত ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু তন্দ্রার চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসছে না। নুসরাত আপুর কথা স্মরণ হয় তার। প্রতিবেশী। বড়বোন শুভ্রার বান্ধবী। বিয়ের কিছুদিন পর হঠাত একদিন বাড়ির বাঁশঝাড়ে গলায় দড়িবেঁধে আত্মহত্যা করলো সে। সবাই অবাক, নুসরাত এরকম করলো কেন? পরে, বাড়ির লোকজনের কানাঘুঁষায় আসল ঘটনাটি জেনেছিল তন্দ্রা। নুসরাত তখন হাইস্কুলের ছাত্রী। ওদের বাড়িতে একজন গৃহশিক্ষক থাকতো। এই শিক্ষকের সাথেই বাড়ির সকলের অজান্তে নুসরাতের প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যায়। সম্পর্ক এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একে-অপরের দেহদানে সঠিক হিসেবের অবকাশ হয়নি কারোর। একসময় অসতর্ক নুসরাত সন্তান সম্ভবা হয়ে যায়। ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে বাড়ির লোকজন জেনে গেলে কোন একরাতে নুসরাত-কে স্থানিয় এক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোরশন করিয়ে আনে। ঘটনাটি প্রতিবেশী কেউ বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির লোকজন ওই গৃহশিক্ষক-কে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেয়।
তার বছর পাঁচেকের মধ্যেই বিয়ে হয় নুসরাতের। বিয়েরাতেই বরের কাছে ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল নুসরাত। ঘটনাটি জানার পর ওর বর আর তাকে বউ হিসেবে রাখতে চায়নি। ফিরতি নাইয়রের নামে নুসরাত-কে বাড়ি রেখে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয় ওর বর। অসহায় নুসরাত ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে শেষমেষ গলায় দড়ি বেধে আত্মহত্যা করে।
শুভ্রাকে মানুষ বলে মনে হয় না তার। ওইরকম সময়েই তো অহনের সাথে তন্দ্রার অনেকটা প্রেমের মতোই ঘটনাটি ঘটেছিল। অহন শুভ্রার ভাসুরের ছেলে। সুদর্শন যুবক। ওইরাতের ঘটনাটি মনে পড়ে তন্দ্রার। শুভ্রার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে তন্দ্রা আর অহন একসাথে ছিল। ছেলেটা খুব পাগল, অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। তন্দ্রা নিজেও খুব সম্মোহিত আর চড়ম লোভী হয়ে ওঠেছিল সে রাতে। ভাবতে ভাবতে খুবই লজ্জাক্রান্ত হয় তন্দ্রা। ঘুমন্ত স্বামীকে পাশে রেখে এসব ভাবতে ভালো লাগে না তার। তাছাড়া তার চিন্তা ঘুমন্ত সুপ্ত আবার টের পেয়ে যাচ্ছে নাতো! সে রাতের নিজস্ব আলোয় সুপ্তর দিকে তাকায়। সুপ্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। ফ্যানের হালকা বাতাসেও সুপ্তর শরীর মৃদু ঘর্মাক্ত। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু জলের স্থির সন্তরণ। জনশ্রুতির কথাটি মনে হয় তার। যে পুরুষের নাক বেশি ঘামে সে পুরুষ খুব বউ-আদরের হয়। সুপ্তকে আদর করতে ইচ্ছে হয় তার কিন্তু পারে না। ঘুমন্ত স্বামীকে আদর করে দিতে কেমন যেন গর্হিত অপরাধবোধ আটকে রাখে তাকে। মনে ভাবে, সুপ্তর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে ওকে ইচ্ছেমতো আদর করে প্রমাণ করবে জনশ্রুতির কথাটি আসলেই ঠিক।
অন্ধকারের আলোতেই মুখোশটির অস্তিত্ব টের পায় তন্দ্রা। মুখোশটি তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে আর প্ররোচিত করতে থাকে। পালিয়ে যা তন্দ্রা, পালিয়ে যা, দূরে কোথাও। নইলে শান্তি পাবি না। পালাবার এখনই সময়। তন্দ্রা ভাবে সত্যি সত্যি সে পালিয়ে যাবে কিনা। গেলে কেমন হয়? একেবারে অজানায়, দূরে, অনেক দূরে। নুসরাতের কথা মনে হয় তন্দ্রার। তারমতো সেও কী দূরে কোথাও গিয়ে আত্মহত্যা করবে নাকি। আবার ভাবে আত্মহত্যা করবে কেন? সে সুপ্তকে ভালোবাসে আর সুপ্তও তাকে, তাই তার আত্মহত্যা করা ঠিক হবে না। অস্থির হয়ে ওঠে তন্দ্রা, তার শরীরও ঘামতে থাকে। মুহূর্তেই সে মুখোশটিকে ধরে ফেলতে চায় কিন্তু ধরতে পারে না। অন্ধকারেই মুখোশটি একবার তার পাশে আসে... একবার সোফায় গিয়ে বসে... একবার সুপ্তর কম্পিউটার টেবিলে গিয়ে বসে... একবার জানালার পাশে দাঁড়ায়... একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়... মুখোশটিকে সে যেন কিছুতেই ধরতে পারে না। ঘর্মাক্ত তন্দ্রা বিছানা ছেড়ে টেবিলের দিকে যায়। জগভর্তি পানি থেকে একগ্লাস পানি খায় সে। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নির্জন রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের ২৫০ ভোল্ট বাতির মৃদু আলো আর ট্রাকচাপায় থেতলে যাওয়া বিড়ালটিকে দেখতে থাকে সে।
সকালে নাস্তার টেবিলে দুজনেই চুপচাপ থাকে যেন একে-অপরকে কেউ চেনে না। অন্যান্য দিন তন্দ্রা নিজ হাতে ব্রেড-এ জেলি মেখে খেতে দিয়েছে কিন্তু আজ দিচ্ছে না, নিজেও নিচ্ছে না। হঠাত সুপ্ত উত্তেজিত হয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করে ফেলে সেই ভয়। তন্দ্রা কী রাতে ঘুমিয়েছিল? বোধ হয় না, ওর চোখ দেখে বোঝা যায়। হয়তবা রাতে কেঁদেও ছিল। নাস্তা সেরে সুপ্ত রমে ফিরে অফিস যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছে, এমন সময় তন্দ্রা এসে সামনে দাঁড়ায়।
তোমার সাথে কথা আছে।
বল, সুপ্ত’র উত্তর।
আমি বাড়ি যাব।
এবার সুপ্ত মনযোগী ভঙ্গিতে আরেকটু সামনে এগিয়ে তন্দ্রার মুখোমুখি হয়।
এখানে কী খারাপ লাগছে? হেভ য়্যু ফিল বোরিং হিয়ার!
এমন একটি সিরিয়াস বিষয়ে সুপ্ত’র হেয়ালিপনার অর্থ তন্দ্রা বুঝতে পারে না, সে উত্তরহীন তাকায়।
ওকে, ওকে ইফ য়্যু ফিল বোরিং অর ডিজগাস্টিং দেন য়্যু কেন গো বাট নট উইদাউট মি। আই ওয়ান্ট টু গো উইথ য়্যু ফর রিচড্ এন্ড এ পিচফুল এরেঞ্জমেন্ট ফর য়্যু দেয়ার। হেভ য়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড ডেয়ার অনারেবল মেডাম। এই বলে তন্দ্রার মুখটা দু’হাতে একটু উঁচিয়ে ধরে নিজের খুব কাছাকাছি এনে সম্মোহনের মতো তাকায় সুপ্ত। তন্দ্রা কিছু বুঝতে পারে না, সে সুপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম দিনের মতো, মহাজাগতিক জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে। ফাঁকে, কখন যে সুপ্ত তার ওষ্ঠে একটা চুম্বন দৃশ্য এঁকে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়, ঠাহর হয় না তন্দ্রার।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে গ্রামের মেয়েরা যে রকম বৃষ্টিতে ভিজে সজীবতা উপভোগ করে, তন্দ্রাও সেই সজীবতা ফিরে পায়। বুঝতে পারে, কী ভুলটাই না সে করতে বসেছিল। মতিভ্রমে মানুষের এরকমই হয়। তার মুখে তখনও ভাষা ফুটেনি, ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে সুপ্তকেও সে একটি চুম্বন করে আসে কিন্তু পারে না, প্রথম দিনের মতো বহুকালের অচেনা বোধ কাজ করে। আজন্ম নারীজনমের লজ্জাবোধ তাকে আটকে রাখে।
অফিসে ফিরেই সুপ্ত নিশ্চিত টেলিফোন করবে, তন্দ্রা জানে। তাই রুমেই থাকে, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, বই পড়ে, টেলিভিশন অন করে কিন্তু ভালো লাগে না, সিডি প্লেয়ার অন করে লোপামুদ্রা মিত্রের গান শোনে ‘ছেলেবেলার বৃষ্টি মানেই আকাশজোড়া...’ গরম পড়েছে তবু এই গান খারাপ লাগে না; স্মৃতিমন্থন হয়। ফ্যানটা ছেড়ে সে উত্তরের জানালাটা পুনরায় খুলে দেয়। খুলতে খুলতে মনে পড়ে বড় রাস্তায় গতকাল রাতে একটি বিড়াল ট্রাকচাপা পড়েছিল। তার থেতলে যাওয়া চিহ্ন এখনও স্পস্ট হয়। বিড়ালটির কোনো দোষ ছিল না, সেই ভ্রুণটিরও... পুনরায় তার সেই ছায়াটির কথা মনে হয় কিন্তু দিনের শ্বেতশুভ্র আলোয় তাকে দেখতে পায় না সে। তন্দ্রা জানে এবার যদি তাকে সামনে পায় সে নিশ্চিত গলাটিপে হত্যা করবে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন