কাল মার্কস বলেছিলেন, ‘এতদিন দার্শনিকেরা শুধু জগেক নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হলো তাকে পরিবর্তন করা।’ মার্কসের চিন্তা-ভাবনার প্রচারক ও প্রয়োগপ্রয়াসী বদরুদ্দীন উমর তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাকে আমি ফেলে দিইনি। প্রত্যেক অভিজ্ঞতা আমার চিন্তা, চেতনা, উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করেছে। আমি জীবনে দ্রুত পরিবর্তিত হইনি। আমার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে ধীরে ধীরে। মনে হয় পরিবর্তনের এই ধীর গতিই আমার চিন্তা-চেতনার ভিত্তি মজবুত করেছে।’
যাঁর জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আর মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, বরং একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য—তিনি বদরুদ্দীন উমর।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন জীবনভর। মার্কসের শ্রেণীসংগ্রামের চিন্তা নিয়ে পার করছেন জীবনের সব দিন। এটাই তাঁর জীবনের অন্যতম দিক। তিনি জানতেন, এ গন্তব্য বন্ধুর ও বিরুদ্ধ। তবে বিশ্বাস করতেন, মেহনতি মানুষ পরিবর্তন চায়। প্রতিভার কাজ এ চাওয়াকে সুসংগঠিত করা। লেনিন যেমন করেছিলেন রাশিয়ায়, মাও করেছিলেন চীনে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো করেছিলেন কিউবায়। শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে বদরুদ্দীন উমরের ক্ষুরধার লেখা সমাজ-অধিপতিদের চিন্তাকে বিরতিহীনভাবে মোকাবিলা করে আসছে সেই ষাটের দশক থেকে। তিনি উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য উপস্থিত করার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ইংরেজিতে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেণীসংগ্রাম আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন উপমহাদেশ তথা বিশ্বের কাছে। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম সেরা কলামিস্ট।
ষাটের দশকে তাঁর অনেক লেখা বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ দেখিয়েছিল। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ, শিক্ষিতদের সক্ষম করে তোলে আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে আত্মোপলব্ধিতে। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি নতুন ও সাহসী চিন্তার পুরোধা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে অসংখ্য কিশোর-তরুণের মধ্যে নতুন দেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ক্রমে ক্রমে ভাঙছিল, যারা নতুন পথ অনুসন্ধান করছিলেন, তাঁর চিন্তা ও সক্রিয়তা সেই তারুণ্যকে দেয় নতুন পথের সন্ধান। তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন। একজন রাজনৈতিক সমালোচকও। দেশ-বিদেশের দৈনিকগুলোতে সাহসী কলাম লিখে অর্জন করেছেন ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীর বিরল সম্মান।
ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি এদেশের তরুণ সমাজকে নাড়া দেন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ বই দু’টির মাধ্যমে। তার ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি’ বইটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে শ্রেষ্ঠতম গবেষণা। আহমদ ছফা বইটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আর কিছু দরকার নেই, উমর যদি জীবনে আর কিছু নাও করতেন, তবুও এ বইয়ের জন্যই তিনি বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয় থাকবেন।’ তবে এরপর তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন। এখনও করছেন। তাঁর লেখা ‘বাঙালী মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বইটি ভাষা আন্দোলনের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। দুই খণ্ডে লেখা হয় তার ‘ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ বইটি দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। দেশের ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ বই লেখা সংকীর্ণ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, যা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, যার বেশিরভাগই লেখা হয়েছে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃতিত্বকে বড় করে দেখে। বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস সেখানে ভিন্ন। তিনি লিখেছেন সত্যনিষ্ঠ সতর্কতার সঙ্গে। এ ইতিহাসবিদের লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে শ্রেণী সম্পর্ক। মার্কস যেমনটা বলেছিলেন, ‘মানবসভ্যতার ইতিহাস হলো মূলত শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।’ বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকমের ব্যাপক মাত্রায় প্রাথমিক উত্স ব্যবহার, যা তাঁর ইতিহাসকে করেছে গ্রহণযোগ্য, সত্যনিষ্ঠ, সমৃদ্ধ। ‘ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ বইটির প্রথম খণ্ডে চল্লিশটি অধ্যায়ে অছে ১৯৪৭ থেকে ’৫৮, আর দ্বিতীয় খণ্ডের ৫৯টি অধ্যায়ে আছে ’৫৪ থেকে ’৭১ সালের ইতিহাস।
ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখে তিনি পড়েন আইয়ুব-মোনেম সরকারের রোষানলে। তখন উপলব্ধি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে বেশি দূর কাজ করা অসম্ভব। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রত্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন ’৬৮ সালে। যুক্ত হন সক্রিয় রাজনীতিতে। পরে সুযোগ, আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা বা অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিহাস অনুসন্ধান আর এর ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যত্ নির্মাণে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে আজীবন একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর তিনি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ফের সংগঠিত করা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য মাসিক ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘লেখক শিবির’-এরও নেতৃত্ব দেন। ‘সংস্কৃতি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ’৭৪ সালে। কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থা ও সব পত্রিকা নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে ‘সংস্কৃতি’ বন্ধ হয়ে যায় ’৭৪ সালের ডিসেম্বরে। ’৮১ সালে আবারও প্রকাশনা শুরু হয়। তাঁর আরও লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের রোষানলে পড়ে। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের তথাকথিত পরাজয় আর পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর গোটা বিশ্বের মতো এদেশের বামপন্থী মহলেও চরম হতাশা ও মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই সময়ে বদরুদ্দীন উমরের তীক্ষষ্ট ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা সেই হতাশাজনক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ’৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল) যোগ দেয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছিল গণআন্দোলন। ওই সময় তাঁর লেখা আন্দোলনের গতিকে আরও তীব্র করে। তত্ত্বের তীক্ষষ্ট বিশ্লেষণ আর বাস্তব অবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এ প্রয়াস থেকে তিনি বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি।
যে রাষ্ট্রে ক্ষুদ্র, তরল লোকজন সমাজের মাথা হিসেবে বিবেচিত হন, যে সমাজে খলনায়কেরা নায়কের মর্যাদা পান, সেখানে বদরুদ্দীন উমরের মতো পণ্ডিত ও বিপ্লবী তাত্ত্বিকের মূল্যায়ন হবে কতখানি? কমিশন কিংবা ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের বিনিময়ে যে রাষ্ট্রে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান পাকাপোক্ত হয় আর সুবিধাবাদীদের সহাবস্থান ঘটে, সেখানে কোনো সংবেদনশীল, মননশীল, দায়িত্বশীল মানুষ ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন? প্রগতি চিন্তা ও রাজনীতির প্রবল শক্তিকে এখনও আটকে রেখেছে সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বৃত্তি, দেউলিয়াত্বের পুরনো বৃত্ত। বদরুদ্দীন উমরের মতো ব্যক্তিদের এরকম সমাজে অস্বস্তির কারণ হওয়ারই কথা। তবে তিনি সফল। কেননা তিনি হার মানেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উক্তির বাস্তবতা আছে তার জীবনে, ‘তোমরা কমিউনিস্টরা ভুল করো না। ...সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বাসঘাতকতা করবেই।’ পরাজয়, আত্মসমর্পণ আর দাসত্বের শৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান করার শক্তিই সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার পূর্বশর্ত। গভীর তৃপ্তি আর প্রবল অহঙ্কার নিয়ে বদরুদ্দীন উমর আজ বলতে পারছেন, তিনি আজীবন বিরামহীনভাবে এ শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন। যথাসাধ্য ভূমিকা পালনে দ্বিধা, ক্লান্তি ছিল না। জাতীয় দুর্দিনে দুর্বৃত্ত সরকারি নীতি ও অবস্থার বিরুদ্ধে কখনোই কথা বলতে ছাড়েননি।
তিনি ইতিহাসের গৌরবময় দু’টি অধ্যায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী পুরুষ। ভাষা আন্দোলনের একেবারে চরম মুহূর্ত থেকে পরিণতি পর্যন্ত সব লড়াইয়ের মধ্যে তিনি কাজ করেছেন। আন্দোলনকে তিনি বেগবান করেছিলেন ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ শিরোনামে পুস্তিকা লিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। তিনি তখন ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্র। ছাত্র আন্দোলনের সব মিছিল-সভায় তিনি উপস্থিত থাকতেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি তাঁর ‘আমাদের ভাষার লড়াই’র দশ হাজার কপি ছাপিয়ে প্রচার করেছিল।
বদরুদ্দীন উমর জীবনভর প্রচারবিমুখ থেকেছেন। পুরস্কার, পদবি, সামাজিক শান-শওকত, অর্থবিত্তকে পরোয়া করেননি। এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বা সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের পুরস্কার তিনি নেননি। ’৭২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়া হলেও প্রত্যাখ্যান করেন। ’৭৪ সালে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একুশে পদক দেয়ার কথা বলা হলে ওই সময়ও তিনি তা নিতে রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘পুরস্কারের আশায় আমি লিখি না। কারো দ্বারা আমার পুরস্কৃত হওয়ার প্রয়োজন নেই।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা আবুল হাশিম ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বদরুদ্দীন উমর ’৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাস করেন। ’৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। ’৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কর্মজীবন শুরু করেন। ’৬৩ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠা তাঁর মাধ্যমে হয়। সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও সমাজকর্ম বিভাগ চালুতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ’৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলিয়ে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় পঁচাশি। এর মধ্যে ‘সংস্কৃতির সংকট’, ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি’, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : বাঙলাদেশের কৃষক’, ‘বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা’, ‘যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ’, ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘বাঙলাদেশে মার্কসবাদ’, ‘বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র’, ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, ‘মার্কসীয় দর্শন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘বাঙলাদেশের কৃষক ও কৃষক আন্দোলন’, বাঙলাদেশে ফ্যাসিবাদ’, ‘আমার জীবন’, ‘Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh’, ‘Society and Politics in Pakistan’, ‘Towards the Emergency in Bangladesh’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
যাঁর জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আর মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, বরং একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য—তিনি বদরুদ্দীন উমর।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন জীবনভর। মার্কসের শ্রেণীসংগ্রামের চিন্তা নিয়ে পার করছেন জীবনের সব দিন। এটাই তাঁর জীবনের অন্যতম দিক। তিনি জানতেন, এ গন্তব্য বন্ধুর ও বিরুদ্ধ। তবে বিশ্বাস করতেন, মেহনতি মানুষ পরিবর্তন চায়। প্রতিভার কাজ এ চাওয়াকে সুসংগঠিত করা। লেনিন যেমন করেছিলেন রাশিয়ায়, মাও করেছিলেন চীনে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো করেছিলেন কিউবায়। শোষণ-নিপীড়ন, বৈষম্য, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে বদরুদ্দীন উমরের ক্ষুরধার লেখা সমাজ-অধিপতিদের চিন্তাকে বিরতিহীনভাবে মোকাবিলা করে আসছে সেই ষাটের দশক থেকে। তিনি উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য উপস্থিত করার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ইংরেজিতে পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেণীসংগ্রাম আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন উপমহাদেশ তথা বিশ্বের কাছে। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম সেরা কলামিস্ট।
ষাটের দশকে তাঁর অনেক লেখা বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ দেখিয়েছিল। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ, শিক্ষিতদের সক্ষম করে তোলে আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে আত্মোপলব্ধিতে। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি নতুন ও সাহসী চিন্তার পুরোধা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে অসংখ্য কিশোর-তরুণের মধ্যে নতুন দেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ক্রমে ক্রমে ভাঙছিল, যারা নতুন পথ অনুসন্ধান করছিলেন, তাঁর চিন্তা ও সক্রিয়তা সেই তারুণ্যকে দেয় নতুন পথের সন্ধান। তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন। একজন রাজনৈতিক সমালোচকও। দেশ-বিদেশের দৈনিকগুলোতে সাহসী কলাম লিখে অর্জন করেছেন ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীর বিরল সম্মান।
ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি এদেশের তরুণ সমাজকে নাড়া দেন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ বই দু’টির মাধ্যমে। তার ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি’ বইটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে শ্রেষ্ঠতম গবেষণা। আহমদ ছফা বইটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আর কিছু দরকার নেই, উমর যদি জীবনে আর কিছু নাও করতেন, তবুও এ বইয়ের জন্যই তিনি বাঙালি সমাজে চিরস্মরণীয় থাকবেন।’ তবে এরপর তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন। এখনও করছেন। তাঁর লেখা ‘বাঙালী মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বইটি ভাষা আন্দোলনের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। দুই খণ্ডে লেখা হয় তার ‘ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ বইটি দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। দেশের ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ বই লেখা সংকীর্ণ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, যা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, যার বেশিরভাগই লেখা হয়েছে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃতিত্বকে বড় করে দেখে। বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস সেখানে ভিন্ন। তিনি লিখেছেন সত্যনিষ্ঠ সতর্কতার সঙ্গে। এ ইতিহাসবিদের লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে শ্রেণী সম্পর্ক। মার্কস যেমনটা বলেছিলেন, ‘মানবসভ্যতার ইতিহাস হলো মূলত শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।’ বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকমের ব্যাপক মাত্রায় প্রাথমিক উত্স ব্যবহার, যা তাঁর ইতিহাসকে করেছে গ্রহণযোগ্য, সত্যনিষ্ঠ, সমৃদ্ধ। ‘ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ’ বইটির প্রথম খণ্ডে চল্লিশটি অধ্যায়ে অছে ১৯৪৭ থেকে ’৫৮, আর দ্বিতীয় খণ্ডের ৫৯টি অধ্যায়ে আছে ’৫৪ থেকে ’৭১ সালের ইতিহাস।
ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখে তিনি পড়েন আইয়ুব-মোনেম সরকারের রোষানলে। তখন উপলব্ধি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে বেশি দূর কাজ করা অসম্ভব। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রত্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন ’৬৮ সালে। যুক্ত হন সক্রিয় রাজনীতিতে। পরে সুযোগ, আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতা বা অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিহাস অনুসন্ধান আর এর ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যত্ নির্মাণে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে আজীবন একনিষ্ঠ আত্মনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর তিনি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ফের সংগঠিত করা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য মাসিক ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘লেখক শিবির’-এরও নেতৃত্ব দেন। ‘সংস্কৃতি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ’৭৪ সালে। কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থা ও সব পত্রিকা নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে ‘সংস্কৃতি’ বন্ধ হয়ে যায় ’৭৪ সালের ডিসেম্বরে। ’৮১ সালে আবারও প্রকাশনা শুরু হয়। তাঁর আরও লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের রোষানলে পড়ে। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্রের তথাকথিত পরাজয় আর পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর গোটা বিশ্বের মতো এদেশের বামপন্থী মহলেও চরম হতাশা ও মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই সময়ে বদরুদ্দীন উমরের তীক্ষষ্ট ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা সেই হতাশাজনক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ’৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল) যোগ দেয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছিল গণআন্দোলন। ওই সময় তাঁর লেখা আন্দোলনের গতিকে আরও তীব্র করে। তত্ত্বের তীক্ষষ্ট বিশ্লেষণ আর বাস্তব অবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এ প্রয়াস থেকে তিনি বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি।
যে রাষ্ট্রে ক্ষুদ্র, তরল লোকজন সমাজের মাথা হিসেবে বিবেচিত হন, যে সমাজে খলনায়কেরা নায়কের মর্যাদা পান, সেখানে বদরুদ্দীন উমরের মতো পণ্ডিত ও বিপ্লবী তাত্ত্বিকের মূল্যায়ন হবে কতখানি? কমিশন কিংবা ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের বিনিময়ে যে রাষ্ট্রে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান পাকাপোক্ত হয় আর সুবিধাবাদীদের সহাবস্থান ঘটে, সেখানে কোনো সংবেদনশীল, মননশীল, দায়িত্বশীল মানুষ ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন? প্রগতি চিন্তা ও রাজনীতির প্রবল শক্তিকে এখনও আটকে রেখেছে সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বৃত্তি, দেউলিয়াত্বের পুরনো বৃত্ত। বদরুদ্দীন উমরের মতো ব্যক্তিদের এরকম সমাজে অস্বস্তির কারণ হওয়ারই কথা। তবে তিনি সফল। কেননা তিনি হার মানেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উক্তির বাস্তবতা আছে তার জীবনে, ‘তোমরা কমিউনিস্টরা ভুল করো না। ...সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বাসঘাতকতা করবেই।’ পরাজয়, আত্মসমর্পণ আর দাসত্বের শৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান করার শক্তিই সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার পূর্বশর্ত। গভীর তৃপ্তি আর প্রবল অহঙ্কার নিয়ে বদরুদ্দীন উমর আজ বলতে পারছেন, তিনি আজীবন বিরামহীনভাবে এ শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন। যথাসাধ্য ভূমিকা পালনে দ্বিধা, ক্লান্তি ছিল না। জাতীয় দুর্দিনে দুর্বৃত্ত সরকারি নীতি ও অবস্থার বিরুদ্ধে কখনোই কথা বলতে ছাড়েননি।
তিনি ইতিহাসের গৌরবময় দু’টি অধ্যায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী পুরুষ। ভাষা আন্দোলনের একেবারে চরম মুহূর্ত থেকে পরিণতি পর্যন্ত সব লড়াইয়ের মধ্যে তিনি কাজ করেছেন। আন্দোলনকে তিনি বেগবান করেছিলেন ‘আমাদের ভাষার লড়াই’ শিরোনামে পুস্তিকা লিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। তিনি তখন ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্র। ছাত্র আন্দোলনের সব মিছিল-সভায় তিনি উপস্থিত থাকতেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি তাঁর ‘আমাদের ভাষার লড়াই’র দশ হাজার কপি ছাপিয়ে প্রচার করেছিল।
বদরুদ্দীন উমর জীবনভর প্রচারবিমুখ থেকেছেন। পুরস্কার, পদবি, সামাজিক শান-শওকত, অর্থবিত্তকে পরোয়া করেননি। এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বা সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের পুরস্কার তিনি নেননি। ’৭২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেয়া হলেও প্রত্যাখ্যান করেন। ’৭৪ সালে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একুশে পদক দেয়ার কথা বলা হলে ওই সময়ও তিনি তা নিতে রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘পুরস্কারের আশায় আমি লিখি না। কারো দ্বারা আমার পুরস্কৃত হওয়ার প্রয়োজন নেই।’
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা আবুল হাশিম ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বদরুদ্দীন উমর ’৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাস করেন। ’৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। ’৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কর্মজীবন শুরু করেন। ’৬৩ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠা তাঁর মাধ্যমে হয়। সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও সমাজকর্ম বিভাগ চালুতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ’৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ‘সোশ্যাল ওয়ার্ক কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলিয়ে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় পঁচাশি। এর মধ্যে ‘সংস্কৃতির সংকট’, ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি’, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : বাঙলাদেশের কৃষক’, ‘বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা’, ‘যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ’, ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘বাঙলাদেশে মার্কসবাদ’, ‘বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র’, ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’, ‘মার্কসীয় দর্শন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘বাঙলাদেশের কৃষক ও কৃষক আন্দোলন’, বাঙলাদেশে ফ্যাসিবাদ’, ‘আমার জীবন’, ‘Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh’, ‘Society and Politics in Pakistan’, ‘Towards the Emergency in Bangladesh’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন