ক্যালিগ্রাফি মূলত বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র, বিভিন্ন নিমন্ত্রণপত্র, ফন্ট ডিজাইন, মুদ্রণশৈলী, লোগো, অরিজিনাল হস্তলিখিত লোগো, ধর্মীয় আর্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, পাথর খোদাই এবং স্মরণিকাতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সৌন্দর্য, প্রশংসাপত্র, জন্ম ও মৃত্যু সনদ, ফিল্ম ও টিভিতে ছবির গতিশীলতা বা স্থিরতা, মানচিত্র এবং আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রিক শব্দ ক্যালোস (সুন্দর) ও গ্রাফ (লিখন) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং ক্যালিগ্রাফি শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সুন্দর লিখন।
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তালপাতায় ক্যালিগ্রাফি করা হতো। প্রায় ২ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে এই হস্তলিপি বিদ্যমান ছিল। এমনকি কাগজের প্রচলনের পরও প্রায় ৪০০ বছর পর্যন্ত কাগজের সঙ্গে সঙ্গে তালপাতাকে ক্যালিগ্রাফির অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাতার উভয় পার্শ্বকে হস্তলিপির জন্য ব্যবহার করা হতো। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই শিল্পের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। তালপাতা ছিল ক্যালিগ্রাফির একটি চমত্কার জমিন, যা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা ব্যবহার করতেন।
এছাড়া পোড়ামাটি এবং তামাও ছিল প্রাচীন ভারতের ক্যালিগ্রাফির জনপ্রিয় উপকরণ। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে বার্চ গাছের ছালকে ক্যালিগ্রাফির জমিন হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
নেপালি ক্যালিগ্রাফিতে বৌদ্ধধর্মের মহায়না এবং ভজরায়ানা শাখার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। রঞ্জনা হস্তলিপি ছিল এই ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক রূপ। নেপাল, তিব্বত, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, চীনের উপকূলীয় অঞ্চল, জাপান এবং কোরিয়াতে বৌদ্ধধর্মের পবিত্র বাণীকে ক্যালিগ্রাফি আকারে সংরক্ষণ করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফির ভাষা ছিল মূলত সংস্কৃত এবং পালি।
ক্যালিগ্রাফি তিব্বতীয় সংস্কৃতির একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। তিব্বতীয় হস্তলিপি ভারতীয় হস্তলিপি থেকে বিকাশ লাভ করে। তিব্বতের উচ্চপদস্থ শ্রেণীর লোক, বিশেষ করে উচ্চ লামা এবং পোটালি সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার। তিব্বত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। শব্দের লিখিত রূপ প্রচলনে এই ধর্মের অনেক অবদান রয়েছে। ধর্মের প্রায় সব ধরনের পবিত্র বাণী এবং দালাইলামা ও অন্যান্য ধর্মযাজক এবং পণ্ডিতদের বাণী হস্তশিল্প আকারে সংরক্ষিত হতো। বৌদ্ধধর্মের জপচক্রকে ক্যালিগ্রাফি অনেকটা সহজবোধ্য করে দিত। তখনকার দিনে তিব্বতের সুরম্য ভবনগুলোতে আরব এবং রোমান ক্যালিগ্রাফি শোভা পেত। আগেকার দিনে তিব্বতীয় ক্যালিগ্রাফি নলখাগড়া বা এ জাতীয় উপকরণ দিয়ে অঙ্কিত হতো, কিন্তু বর্তমানে ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে বাটালি টিপ কলম এবং মার্কার ব্যবহার করা হয়।
বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি
ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিখন শিল্পের বিকাশ এবং উন্নয়নে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের রয়েছে গৌরবময় অবদান। তখনকার সময়ে ক্যালিগ্রাফি স্মৃতিসৌধ বা জাদুঘরের দেয়াল, মসজিদ, মাদরাসা এবং সমাধিসৌধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিবর্তনে এসব ক্যালিগ্রাফি বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। বাংলায় আগেকার দিনে ক্যালিগ্রাফি আঁকা হতো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মাধুর্যপূর্ণভাবে। এক সময়ের বাংলাদেশের অংশ বিহারের বারী দরগায় প্রাচীন হস্তলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। দিল্লির কুতুব মিনার এবং কুয়াতুল ইসলাম মসজিদের ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে পশ্চিম দিনাজপুরের একটি মসজিদে ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়, যা পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত তুঘরি স্টাইল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৩০১ সালে বিহারে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে অসাধারণ শিল্পশৈলীর ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এসব ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পীরা উল্লম্ব লাইন এবং তির্যকতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেন, যেগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে অঙ্কন করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফি ছিল গতানুগতিকতার সম্পূর্ণ বাইরে। দিল্লির আলাই দরগায় পাওয়া সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফি ছিল ছোট আঁচে আঁকা, অন্যদিকে বাংলা ক্যালিগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মোটা আঁচে আঁকা।
আরও কিছু ক্যালিগ্রাফি ১৩১৩ সালে বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের সময়ে ত্রিবেণির জাফর খানের সমাধিসৌধের উত্তর দিকের দেয়ালে পাওয়া যায়, যা তুঘরা হস্তলিপির উত্কৃষ্ট রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব ক্যালিগ্রাফি কলমের বড় বড় টানে আঁকা এবং অনুভূমিক অক্ষরগুলো গুচ্ছ ভিত্তিতে আঁকা হতো। ত্রিবেণির ফিরোজ শাহী হস্তলিপির প্রক্রিয়ায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের ক্যালিগ্রাফির পূর্ণতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, যা কলকাতার পূর্ব উপকণ্ঠের একটি মসজিদে শোভা পেত। এই ক্যালিগ্রাফির অক্ষরগুলো ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরস্পর গ্রন্থিত। এগুলোকে তুঘরা ক্যালিগ্রাফির ভিন্ন রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৩৭৪-৭৫ সালে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে অঙ্কিত হস্তলিখন শিল্পকে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এগুলো ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং চিত্তাকর্ষক। এগুলো যে কারও চোখ শীতল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই মসজিদের আরেকটি ক্যালিগ্রাফি ছিল এই শিল্পের আভিজাত্যের নিদর্শন। এর ঊর্ধ্ব লাইন অত্যন্ত মনোরম ‘কুফিক’ স্টাইলে আঁকা হয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা কার্যকরীভাবে কুফিক স্টাইলেও সমান পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এটা ছিল বাংলার কুফিক ক্যালিগ্রাফির একমাত্র নিদর্শন। ১৪৪৩ সালে ইলিয়াস হোসেন শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে বালিয়াঘাটায় অত্যন্ত মনোরম একটি ক্যালিগ্রাফির পেটেম্লট পাওয়া যায়। এটি ওই সময়ের ক্যালিগ্রাফিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৪৭৪ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়। এটা ১৪৮৭ সালে সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে উত্কৃষ্ট রূপ লাভ করে।
মালদার কাছে কাটরা মসজিদে অঙ্কিত ক্যালিগ্রাফি ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাচীন বাংলায় পাঁচ ধরনের ‘তুঘরা’ ক্যালিগ্রাফি বিকাশ সাধিত হয়। এগুলো হলো—‘প্লেইন তুঘরা’, ‘কাফ এবং ইয়া’ তুঘরা, আরবি হা হরফের আদলে হা তুঘরা, ‘উলম্ব ইয়া হু’ তুঘরা, ‘সোয়ান’ তুঘরা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ‘বো অ্যান্ড অ্যারো’ তুঘরা। এসব তুঘরার স্টাইল ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু মনোরম আভিজাত্যের প্রতীক। বাংলায় তুঘরা স্টাইলের দর্শনীয় ও মনোমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফি সব মুসলিম বিশ্বের ক্যালিগ্রাফি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
তুঘরা ছাড়াও বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা সাধারণ কিন্তু নিপুণ তুলিতে ‘নাসখ’ এবং ‘তুলুথ’ ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৪৮৪ সালে গৌড়ের গানম্যান্ট মসজিদে প্রাপ্ত ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফি এই ধরনের শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৫০০ সালে সুলতান শাহের পুত্র প্রিন্স দানিয়েলের আমলে পশ্চিমবঙ্গের একটি মসজিদে কুফিক অক্ষরে তুঘরা হস্তলিপি অঙ্কন করা হয়। এগুলো ছিল ইন্দো-মুসলিম এপিগ্রাফির একটি চমত্কার নিদর্শন।
বাংলায় হোসেন শাহী আমলের পতনে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি শিল্পেরও অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যায়। তবে ১৫৫৯ সালে আফগান শাসনামলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরের আমলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প কিছুদিন স্থায়িত্ব লাভ করে। পরে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চিরায়ত ক্যালিগ্রাফির স্থলে মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানীর ক্যালিগ্রাফির আদলে বাংলায় ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু হয়, যার ফলে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্প আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়।
১৭০৭ সালে সর্বশেষ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরপরই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এর শিল্পেরও পতন শুরু হয়। এরপর ১৭৩০ সালের আভাদ, দাক্ষিণাত্য এবং বাংলা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর লক্ষ্মৌ, হায়দারাবাদ এবং মুর্শিদাবাদে আস্তে আস্তে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ লাভ শুরু হয়। ১৭১৩ সালে মোগল মুর্শিদাবাদ মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হওয়ার পর বিহার ও উড়িষ্যা আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে থাকে। এর সম্পদ এবং সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে চিত্রকররা মুর্শিদাবাদে জড়ো হতে থাকেন। ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যে আলিবর্দী খাঁর শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। কেননা তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিপাটি এবং শিল্প-সংস্কৃতিমনা। তারপর তার পৌত্র সিরাজদ্দৌলার শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প নবজীবন লাভ করে। এভাবে সময়ের বিবর্তনে বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিকাশ ও উন্নতি লাভ করে। তবে বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সের নান্দনিক শিলালিপি হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক প্রচেষ্টা। ইসলামী লিপিকলার উন্মেষ ও এর প্রসার ঘটেছিল ইসলাম ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি। আরবি ভাষায় লিখিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের অনুলুপি তৈরি ও প্রচারের প্রয়োজনেই বিকশিত হয়েছিল ইসলামী লিপিকলা। পরবর্তী সময়ে এই চর্চা ধর্মীয় প্রচারণার সঙ্গে কাঁচ ও মৃিশল্প, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, স্থাপত্য, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। অতীতে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। দেশের মূল ধারার শিল্পচর্চায় যুক্ত হতে পারেনি এই ক্যালিগ্রাফি। তবে আশার দিক হচ্ছে, ধীরে ধীরে এই ক্যালিগ্রাফি চর্চায় এগুচ্ছে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প দিন দিন বিকাশ লাভ করবে।
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তালপাতায় ক্যালিগ্রাফি করা হতো। প্রায় ২ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে এই হস্তলিপি বিদ্যমান ছিল। এমনকি কাগজের প্রচলনের পরও প্রায় ৪০০ বছর পর্যন্ত কাগজের সঙ্গে সঙ্গে তালপাতাকে ক্যালিগ্রাফির অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাতার উভয় পার্শ্বকে হস্তলিপির জন্য ব্যবহার করা হতো। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই শিল্পের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। তালপাতা ছিল ক্যালিগ্রাফির একটি চমত্কার জমিন, যা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা ব্যবহার করতেন।
এছাড়া পোড়ামাটি এবং তামাও ছিল প্রাচীন ভারতের ক্যালিগ্রাফির জনপ্রিয় উপকরণ। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে বার্চ গাছের ছালকে ক্যালিগ্রাফির জমিন হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
নেপালি ক্যালিগ্রাফিতে বৌদ্ধধর্মের মহায়না এবং ভজরায়ানা শাখার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। রঞ্জনা হস্তলিপি ছিল এই ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক রূপ। নেপাল, তিব্বত, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, চীনের উপকূলীয় অঞ্চল, জাপান এবং কোরিয়াতে বৌদ্ধধর্মের পবিত্র বাণীকে ক্যালিগ্রাফি আকারে সংরক্ষণ করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফির ভাষা ছিল মূলত সংস্কৃত এবং পালি।
ক্যালিগ্রাফি তিব্বতীয় সংস্কৃতির একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। তিব্বতীয় হস্তলিপি ভারতীয় হস্তলিপি থেকে বিকাশ লাভ করে। তিব্বতের উচ্চপদস্থ শ্রেণীর লোক, বিশেষ করে উচ্চ লামা এবং পোটালি সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার। তিব্বত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। শব্দের লিখিত রূপ প্রচলনে এই ধর্মের অনেক অবদান রয়েছে। ধর্মের প্রায় সব ধরনের পবিত্র বাণী এবং দালাইলামা ও অন্যান্য ধর্মযাজক এবং পণ্ডিতদের বাণী হস্তশিল্প আকারে সংরক্ষিত হতো। বৌদ্ধধর্মের জপচক্রকে ক্যালিগ্রাফি অনেকটা সহজবোধ্য করে দিত। তখনকার দিনে তিব্বতের সুরম্য ভবনগুলোতে আরব এবং রোমান ক্যালিগ্রাফি শোভা পেত। আগেকার দিনে তিব্বতীয় ক্যালিগ্রাফি নলখাগড়া বা এ জাতীয় উপকরণ দিয়ে অঙ্কিত হতো, কিন্তু বর্তমানে ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে বাটালি টিপ কলম এবং মার্কার ব্যবহার করা হয়।
বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি
ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিখন শিল্পের বিকাশ এবং উন্নয়নে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের রয়েছে গৌরবময় অবদান। তখনকার সময়ে ক্যালিগ্রাফি স্মৃতিসৌধ বা জাদুঘরের দেয়াল, মসজিদ, মাদরাসা এবং সমাধিসৌধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিবর্তনে এসব ক্যালিগ্রাফি বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। বাংলায় আগেকার দিনে ক্যালিগ্রাফি আঁকা হতো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মাধুর্যপূর্ণভাবে। এক সময়ের বাংলাদেশের অংশ বিহারের বারী দরগায় প্রাচীন হস্তলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। দিল্লির কুতুব মিনার এবং কুয়াতুল ইসলাম মসজিদের ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে পশ্চিম দিনাজপুরের একটি মসজিদে ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়, যা পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত তুঘরি স্টাইল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৩০১ সালে বিহারে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে অসাধারণ শিল্পশৈলীর ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এসব ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পীরা উল্লম্ব লাইন এবং তির্যকতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেন, যেগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে অঙ্কন করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফি ছিল গতানুগতিকতার সম্পূর্ণ বাইরে। দিল্লির আলাই দরগায় পাওয়া সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফি ছিল ছোট আঁচে আঁকা, অন্যদিকে বাংলা ক্যালিগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মোটা আঁচে আঁকা।
আরও কিছু ক্যালিগ্রাফি ১৩১৩ সালে বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের সময়ে ত্রিবেণির জাফর খানের সমাধিসৌধের উত্তর দিকের দেয়ালে পাওয়া যায়, যা তুঘরা হস্তলিপির উত্কৃষ্ট রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব ক্যালিগ্রাফি কলমের বড় বড় টানে আঁকা এবং অনুভূমিক অক্ষরগুলো গুচ্ছ ভিত্তিতে আঁকা হতো। ত্রিবেণির ফিরোজ শাহী হস্তলিপির প্রক্রিয়ায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের ক্যালিগ্রাফির পূর্ণতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, যা কলকাতার পূর্ব উপকণ্ঠের একটি মসজিদে শোভা পেত। এই ক্যালিগ্রাফির অক্ষরগুলো ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরস্পর গ্রন্থিত। এগুলোকে তুঘরা ক্যালিগ্রাফির ভিন্ন রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৩৭৪-৭৫ সালে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে অঙ্কিত হস্তলিখন শিল্পকে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এগুলো ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং চিত্তাকর্ষক। এগুলো যে কারও চোখ শীতল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই মসজিদের আরেকটি ক্যালিগ্রাফি ছিল এই শিল্পের আভিজাত্যের নিদর্শন। এর ঊর্ধ্ব লাইন অত্যন্ত মনোরম ‘কুফিক’ স্টাইলে আঁকা হয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা কার্যকরীভাবে কুফিক স্টাইলেও সমান পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এটা ছিল বাংলার কুফিক ক্যালিগ্রাফির একমাত্র নিদর্শন। ১৪৪৩ সালে ইলিয়াস হোসেন শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে বালিয়াঘাটায় অত্যন্ত মনোরম একটি ক্যালিগ্রাফির পেটেম্লট পাওয়া যায়। এটি ওই সময়ের ক্যালিগ্রাফিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৪৭৪ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়। এটা ১৪৮৭ সালে সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে উত্কৃষ্ট রূপ লাভ করে।
মালদার কাছে কাটরা মসজিদে অঙ্কিত ক্যালিগ্রাফি ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাচীন বাংলায় পাঁচ ধরনের ‘তুঘরা’ ক্যালিগ্রাফি বিকাশ সাধিত হয়। এগুলো হলো—‘প্লেইন তুঘরা’, ‘কাফ এবং ইয়া’ তুঘরা, আরবি হা হরফের আদলে হা তুঘরা, ‘উলম্ব ইয়া হু’ তুঘরা, ‘সোয়ান’ তুঘরা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ‘বো অ্যান্ড অ্যারো’ তুঘরা। এসব তুঘরার স্টাইল ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু মনোরম আভিজাত্যের প্রতীক। বাংলায় তুঘরা স্টাইলের দর্শনীয় ও মনোমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফি সব মুসলিম বিশ্বের ক্যালিগ্রাফি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
তুঘরা ছাড়াও বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা সাধারণ কিন্তু নিপুণ তুলিতে ‘নাসখ’ এবং ‘তুলুথ’ ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৪৮৪ সালে গৌড়ের গানম্যান্ট মসজিদে প্রাপ্ত ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফি এই ধরনের শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৫০০ সালে সুলতান শাহের পুত্র প্রিন্স দানিয়েলের আমলে পশ্চিমবঙ্গের একটি মসজিদে কুফিক অক্ষরে তুঘরা হস্তলিপি অঙ্কন করা হয়। এগুলো ছিল ইন্দো-মুসলিম এপিগ্রাফির একটি চমত্কার নিদর্শন।
বাংলায় হোসেন শাহী আমলের পতনে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি শিল্পেরও অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যায়। তবে ১৫৫৯ সালে আফগান শাসনামলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরের আমলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প কিছুদিন স্থায়িত্ব লাভ করে। পরে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চিরায়ত ক্যালিগ্রাফির স্থলে মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানীর ক্যালিগ্রাফির আদলে বাংলায় ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু হয়, যার ফলে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্প আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়।
১৭০৭ সালে সর্বশেষ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরপরই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এর শিল্পেরও পতন শুরু হয়। এরপর ১৭৩০ সালের আভাদ, দাক্ষিণাত্য এবং বাংলা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর লক্ষ্মৌ, হায়দারাবাদ এবং মুর্শিদাবাদে আস্তে আস্তে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ লাভ শুরু হয়। ১৭১৩ সালে মোগল মুর্শিদাবাদ মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হওয়ার পর বিহার ও উড়িষ্যা আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে থাকে। এর সম্পদ এবং সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে চিত্রকররা মুর্শিদাবাদে জড়ো হতে থাকেন। ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যে আলিবর্দী খাঁর শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। কেননা তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিপাটি এবং শিল্প-সংস্কৃতিমনা। তারপর তার পৌত্র সিরাজদ্দৌলার শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প নবজীবন লাভ করে। এভাবে সময়ের বিবর্তনে বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিকাশ ও উন্নতি লাভ করে। তবে বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সের নান্দনিক শিলালিপি হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক প্রচেষ্টা। ইসলামী লিপিকলার উন্মেষ ও এর প্রসার ঘটেছিল ইসলাম ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি। আরবি ভাষায় লিখিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের অনুলুপি তৈরি ও প্রচারের প্রয়োজনেই বিকশিত হয়েছিল ইসলামী লিপিকলা। পরবর্তী সময়ে এই চর্চা ধর্মীয় প্রচারণার সঙ্গে কাঁচ ও মৃিশল্প, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, স্থাপত্য, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। অতীতে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। দেশের মূল ধারার শিল্পচর্চায় যুক্ত হতে পারেনি এই ক্যালিগ্রাফি। তবে আশার দিক হচ্ছে, ধীরে ধীরে এই ক্যালিগ্রাফি চর্চায় এগুচ্ছে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প দিন দিন বিকাশ লাভ করবে।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন