সাক্ষাতকার নিয়েছেন : আহমদ বাসির
ষ ৭৬-এ পা দিতে যাচ্ছেন। লিখতে লিখতেই কাটিয়ে দিলেন ষাট বছর। জীবনের এই দীর্ঘ সফর কেমন কেটেছে বলে মনে হয় এখন।
—(হাসলেন) আমার কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়নি।
ষ বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাতে চান?
—হায়াত। এটা হলো আল্লাহর দান। কতদিন, কীভাবে লেখা আছে জানি না। যেভাবে কাটানোর রীতি রয়েছে, সেভাবেই কাটাব।
ষ আধুনিক বাংলাভাষায় কাব্যে এবং গদ্যে আপনার নিজের আবদান সম্পর্কে যদি মূল্যায়ন করতে বলি, কী বলবেন?
—আধুনিক বাংলা ভাষা তো একটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে যত্সামান্য কাজ আমারও আছে। এটাই আমার মনে হয়।
ষ আপনি বহুবার আপনার একটি প্রবল ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন। সে ইচ্ছাটি ছিল, একটি কাব্যনাটক রচনার। ইচ্ছাটি তো এখনও পূর্ণ হয়নি।
—সব তো আর হয়ে ওঠে না। চেয়েছি তো অনেক কিছু। নানারকম লেখা লিখেছি। যেগুলো লিখতে পারিনি, সেগুলো তো পারিনি। কিন্তু লেখা আমি লিখে গেছি। লেখায় ক্ষ্যান্ত দিইনি। পরিপূর্ণ না হোক, অনেক দীর্ঘ জীবন তো কাটিয়েছি লেখার সঙ্গে। নাটক ছাড়া সবকিছুই লিখেছি। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল কাব্যনাটক লেখার। এমন না যে, কাব্যনাটক লেখার টেকনিক আমি জানতাম না। জানতাম, কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠেনি।
ষ এ ব্যাপারে কি আপনার আফসোস থেকে যাচ্ছে?
—এখন আর আফসোস করে কী হবে!
ষ আপনি তো ‘কাবা শরীফ’ নিয়েও একটি দীর্ঘ কবিতা লেখার পরিকল্পনার কথা বলতেন। সে কবিতাটিও তো সম্ভবত লিখতে পারেননি।
—আমার ঠিক মনে নেই। অনেক পরিকল্পনাই তো করেছি, অনেক পরিকল্পনাই ভুলে গেছি। মনে থাকেনি।
ষ এ বছর বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের দেড়শতম জন্মবর্ষ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনার বেশ কয়েকটি কবিতা আছে। সম্ভবত ‘আমি, দূরগামী’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় আপনি জমিদার রবীন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন— ওই দাড়িঅলা সন্তের ছবি আমার ঘরে টানিয়েছে আমারই ছেলেমেয়েরা/ আহা, তারা কী করে জানবে— ওই ছবিই আমাকে অনাদায়ী খাজনার/ সর্বশেষ নোটিশের কথাই বার বার মনে পড়িয়ে দ্যায় (পঙিক্ত কটি পাঠ করার সময় আল মাহমুদ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পাঠ শেষ হলেও বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন)—কবি রবীন্দ্রনাথ ও জমিদার রবীন্দ্রনাথের এই যে পার্থক্য—এটা আপনি এখন কীভাবে অনুভব করেন?
—যেভাবেই বল না কেন, রবীন্দ্রনাথকে একটা অসাম্প্রদায়িক ভাবনা-চিন্তার আকর হিসেবে দেখা হয়েছে। বাংলার বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র রবীন্দ্রনাথে তেমন একটা নেই— এটা যেমন সত্য, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের যে একটা আন্তরিকতা ছিল, এটাও সত্য।
ষ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর উপলক্ষে দেশে নানা আয়োজন হচ্ছে। দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনও হয়ে গেল। এ কবিতাটি সম্পর্কে আমদের কিছু বলুন।
—এটা বেশ ভালো ব্যাপার। বাংলা ভাষায় তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো আর কোনো কবিতা লেখা হয়নি। এটাকে একটা আকস্মিক উদঘট্টন (আলোড়ন) বলা যায়।
ষ আপনার ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘প্রকৃতি’র কথা মনে পড়ছে। ‘কতদূর এগুলো মানুষ/ কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে/ আজও উবু হয়ে আছি...।’
—এ কবিতাটি সবাই পছন্দ করে। কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ কবিতার জন্য আমি অনেক প্রশংসা পেয়েছি। কবিতাটি আমারও প্রিয়।
ষ ‘কাক ও কোকিল’ কবিতায় আপনি কোকিলের যে হৃদয়বেদনা তুলে ধরেছেন—একবার এক শহুরে কাকের দলে/ মিশে গিয়েছিল গানের কোকিল পাখি... (কবিতাটি শুনতে শুনতে আবেগে আবারও কেঁদে উঠলেন আল মাহমুদ) এ কবিতাটি পড়ে মনে হয় আধুনিক বিশ্বের কোনো নগরীতেই প্রকৃত শিল্পী-হৃদয়ের ঠাঁই মেলে না...
—তাই তো, কোথায় মেলে। কোকিল যদি নগরেই থাকতে চায়, তাহলে তাকে নানান কম্প্রোমাইজ করতে হয়।
ষ এবার আপনার ছোটগল্প প্রসঙ্গে...। আমাদের কাছে তো এখনও বিস্ময়কর মনে হয় পানকৌড়ির রক্ত, জলবেশ্যা, কালো নৌকা এমনকি পরবর্তীকালের নিশি বিড়ালীর আর্তস্বর ধরনের আরও কোনো কোনো গল্প। এরকম সব ছোটগল্প রচনার প্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
—বয়স কম ছিল তো তখন, প্রেরণার কোনো অভাব হতো না। (কিছুক্ষণ থেমে) দুই খণ্ডে আমার সব ছোটগল্প বের হয়েছে। দেখেছো নাকি?
ষ দেখেছি, বাসায় ঢুকেই ও দুটোর ওপর চোখ পড়েছে কিন্তু গ্লাসের বাইরে থেকে। হাতে নিয়ে দেখতে পারিনি। সংগ্রহ করব।
—ওরা বেশ সুন্দর করে বের করেছে, অনন্যা।
ষ সম্ভবত ২০০০ সালে বেরিয়েছে দুই খণ্ডে আপনার উপন্যাস সমগ্র। এরপরও অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। আপনার উপন্যাসগুলোর মধ্যে কোনটি কিংবা কোনগুলো আপনার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?
—উপন্যাস তো কম লিখিনি। এ মুহূর্তে ঠিক সেভাবে বলতে পারব না। তবে কাবিলের বোন, উপমহাদেশ এগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এবং সে সময়ের বাস্তবতা যতদূর সম্ভব এ দু’টি উপন্যাসে পাওয়া যাবে। ‘আগুনের মেয়ে’ কিংবা এরকম আরও কিছু উপন্যাস আমি লিখেছি সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ষ আপনার অনবদ্য সব ছড়া নিয়ে কিছু বলুন। আপনি তো ছড়াকে কবিতা থেকে কখনও আলাদা করে দেখেননি।
—না, দেখিনি। ছড়া তো কবিতাই। আমার একটা ছড়াসমগ্রও বের হয়েছে। সব মিলিয়ে ছড়াও আমি কম লিখিনি।
ষ এবার আপনার যাপিত জীবন সম্পর্কে একটু বলুন। জীবনে কোন সময়টা বেশ সুখে কাটিয়েছেন।
—নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কোনো সময় কিছু ছিল না। সারা জীবন পরিশ্রম করতে হয়েছে।
ষ আপনার জীবনে তো বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছিল...
—বিশ্বাসের পরিবর্তন কথাটা ঠিক নয়। এটার নানা বিবর্তন ঘটেছে। এক সময় প্রগতিবাদে খুব আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
ষ সে সময় আপনার কোনো কোনো কাব্য পঙিক্ততে অবিশ্বাসের ছায়াপাতও ঘটেছিল মনে হয়। সোনালি কাবিনের একটি সনেটে লিখেছিলেন—‘মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস’।
—অবিশ্বাসের ছায়াপাত ঘটেছিল—কথাটা প্রায় তাই। কথাটা সত্যি। তখনকার বয়স কম ছিল তো। চিন্তা এতটা সুগঠিত ছিল না। (হাসলেন) তবে যাকে বলে ‘কাট নাস্তিক’—এটা আমি কোনো কালেই ছিলাম না।
ষ আপনি তো কয়েকটি ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাতসমুদ্র, কবি-শিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস।
—হ্যাঁ, পৃথিবীর অনেক দেশে আল্লাহর রহমতে আমর ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কবিতার দেশ বলে যেসব দেশ পরিচিত, সেসব দেশ আমি ভ্রমণ করেছি। সেগুলোরই কিছু কিছু লিখেছি।
ষ আপনার সমসাময়িকদের অনেকের নামই এক সময় আপনার চেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল অনেকেই হারিয়ে গেছেন। আপনিও অনেক সময় তাদের অনেকের লেখনী-ক্ষমতার কথা বলেছেন। এমনটা কেন হলো?
—মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এখানে ভাগ্যকে মানতে হয়। একটা কথা আছে না—‘জীবন থাকলে পরাজিত হতে হয়’ এটা আমরা মানিনি। মানিনি বলেই হয়তো এতদূর এসেছি।
ষ আপনি তো সঙ্গীতের শহরে বেড়ে উঠেছেন। আপনার সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতা কিছু ঘটেছিল?
—আসলে মানুষ হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা সঙ্গীতে। আমাদের শহরটা শুধু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্য না, ওই ঘরানার প্রায় সবাই ছিলেন বাদ্যযন্ত্রবিদ। এঁরা বাজাতেন, তৈরি করতেন, বিক্রি করতেন, সাপ্লাই করতেন। এ উপমহাদেশে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম। আমার আসা-যাওয়ার রাস্তায় পড়ত আলাউদ্দিন খাঁর বাড়ি। ওই পরিবারের রাজা হোসেন খান ছিল আমার ক্লাসের বন্ধু। ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। এত বড় ওস্তাদ উপমহাদেশে খুব কমই দেখা গেছে।
ষ আপনার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র কোনটি?
—সারাজীবন সেতারই আমার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল।
ষ তো, এই সঙ্গীতের পরিবেশ থেকে সাহিত্যে এলেন কীভাবে?
—অল্প বয়সে বিস্তর সাহিত্য পড়েছি তো। সাহিত্যের প্রভাবটাই আমার মধ্যে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কবি হতে চেয়েছি, কবিই হয়েছি।
ষ সারাজীবন তো কলমের সঙ্গে কাটালেন। বেশ কিছু দিন ধরে কলম হাতে আর লিখতে পারছেন না। কবিতার পঙিক্ত নিশ্চয়ই এখনও বিদ্যুত্ তরঙ্গের মতো জেগে ওঠে আপনার মধ্যে। তখন কী করেন?
—একটা বিশেষ সময় আসে সব লেখকেরই। তিনি আর লিখতে পারেন না। আমি হাতে লিখতে না পারলেও নিয়মিতভাবে আমার সংবাদপত্রের কলামগুলো ডিকটেশন দিয়ে লিখে যাচ্ছি। যতদিন পারি, এভাবেই লিখে যাব। (কথা বলতে বলতে মনে হলো কবি ক্লান্তি অনুভব করছেন। আমরা ক্ষ্যান্ত দেয়ার কথা ভাবলাম।)
ষ এই বয়সে বর্তমান নাজুক শারীরিক অবস্থায়ও আপনি যে আমাদের এত সময় দিলেন, এ জন্য আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
—ধন্যবাদ তোমাদেরও।
—(হাসলেন) আমার কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়নি।
ষ বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাতে চান?
—হায়াত। এটা হলো আল্লাহর দান। কতদিন, কীভাবে লেখা আছে জানি না। যেভাবে কাটানোর রীতি রয়েছে, সেভাবেই কাটাব।
ষ আধুনিক বাংলাভাষায় কাব্যে এবং গদ্যে আপনার নিজের আবদান সম্পর্কে যদি মূল্যায়ন করতে বলি, কী বলবেন?
—আধুনিক বাংলা ভাষা তো একটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে যত্সামান্য কাজ আমারও আছে। এটাই আমার মনে হয়।
ষ আপনি বহুবার আপনার একটি প্রবল ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন। সে ইচ্ছাটি ছিল, একটি কাব্যনাটক রচনার। ইচ্ছাটি তো এখনও পূর্ণ হয়নি।
—সব তো আর হয়ে ওঠে না। চেয়েছি তো অনেক কিছু। নানারকম লেখা লিখেছি। যেগুলো লিখতে পারিনি, সেগুলো তো পারিনি। কিন্তু লেখা আমি লিখে গেছি। লেখায় ক্ষ্যান্ত দিইনি। পরিপূর্ণ না হোক, অনেক দীর্ঘ জীবন তো কাটিয়েছি লেখার সঙ্গে। নাটক ছাড়া সবকিছুই লিখেছি। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল কাব্যনাটক লেখার। এমন না যে, কাব্যনাটক লেখার টেকনিক আমি জানতাম না। জানতাম, কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠেনি।
ষ এ ব্যাপারে কি আপনার আফসোস থেকে যাচ্ছে?
—এখন আর আফসোস করে কী হবে!
ষ আপনি তো ‘কাবা শরীফ’ নিয়েও একটি দীর্ঘ কবিতা লেখার পরিকল্পনার কথা বলতেন। সে কবিতাটিও তো সম্ভবত লিখতে পারেননি।
—আমার ঠিক মনে নেই। অনেক পরিকল্পনাই তো করেছি, অনেক পরিকল্পনাই ভুলে গেছি। মনে থাকেনি।
ষ এ বছর বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের দেড়শতম জন্মবর্ষ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনার বেশ কয়েকটি কবিতা আছে। সম্ভবত ‘আমি, দূরগামী’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় আপনি জমিদার রবীন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন— ওই দাড়িঅলা সন্তের ছবি আমার ঘরে টানিয়েছে আমারই ছেলেমেয়েরা/ আহা, তারা কী করে জানবে— ওই ছবিই আমাকে অনাদায়ী খাজনার/ সর্বশেষ নোটিশের কথাই বার বার মনে পড়িয়ে দ্যায় (পঙিক্ত কটি পাঠ করার সময় আল মাহমুদ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পাঠ শেষ হলেও বেশ কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন)—কবি রবীন্দ্রনাথ ও জমিদার রবীন্দ্রনাথের এই যে পার্থক্য—এটা আপনি এখন কীভাবে অনুভব করেন?
—যেভাবেই বল না কেন, রবীন্দ্রনাথকে একটা অসাম্প্রদায়িক ভাবনা-চিন্তার আকর হিসেবে দেখা হয়েছে। বাংলার বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র রবীন্দ্রনাথে তেমন একটা নেই— এটা যেমন সত্য, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের যে একটা আন্তরিকতা ছিল, এটাও সত্য।
ষ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর উপলক্ষে দেশে নানা আয়োজন হচ্ছে। দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনও হয়ে গেল। এ কবিতাটি সম্পর্কে আমদের কিছু বলুন।
—এটা বেশ ভালো ব্যাপার। বাংলা ভাষায় তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো আর কোনো কবিতা লেখা হয়নি। এটাকে একটা আকস্মিক উদঘট্টন (আলোড়ন) বলা যায়।
ষ আপনার ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘প্রকৃতি’র কথা মনে পড়ছে। ‘কতদূর এগুলো মানুষ/ কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে/ আজও উবু হয়ে আছি...।’
—এ কবিতাটি সবাই পছন্দ করে। কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ কবিতার জন্য আমি অনেক প্রশংসা পেয়েছি। কবিতাটি আমারও প্রিয়।
ষ ‘কাক ও কোকিল’ কবিতায় আপনি কোকিলের যে হৃদয়বেদনা তুলে ধরেছেন—একবার এক শহুরে কাকের দলে/ মিশে গিয়েছিল গানের কোকিল পাখি... (কবিতাটি শুনতে শুনতে আবেগে আবারও কেঁদে উঠলেন আল মাহমুদ) এ কবিতাটি পড়ে মনে হয় আধুনিক বিশ্বের কোনো নগরীতেই প্রকৃত শিল্পী-হৃদয়ের ঠাঁই মেলে না...
—তাই তো, কোথায় মেলে। কোকিল যদি নগরেই থাকতে চায়, তাহলে তাকে নানান কম্প্রোমাইজ করতে হয়।
ষ এবার আপনার ছোটগল্প প্রসঙ্গে...। আমাদের কাছে তো এখনও বিস্ময়কর মনে হয় পানকৌড়ির রক্ত, জলবেশ্যা, কালো নৌকা এমনকি পরবর্তীকালের নিশি বিড়ালীর আর্তস্বর ধরনের আরও কোনো কোনো গল্প। এরকম সব ছোটগল্প রচনার প্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
—বয়স কম ছিল তো তখন, প্রেরণার কোনো অভাব হতো না। (কিছুক্ষণ থেমে) দুই খণ্ডে আমার সব ছোটগল্প বের হয়েছে। দেখেছো নাকি?
ষ দেখেছি, বাসায় ঢুকেই ও দুটোর ওপর চোখ পড়েছে কিন্তু গ্লাসের বাইরে থেকে। হাতে নিয়ে দেখতে পারিনি। সংগ্রহ করব।
—ওরা বেশ সুন্দর করে বের করেছে, অনন্যা।
ষ সম্ভবত ২০০০ সালে বেরিয়েছে দুই খণ্ডে আপনার উপন্যাস সমগ্র। এরপরও অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। আপনার উপন্যাসগুলোর মধ্যে কোনটি কিংবা কোনগুলো আপনার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?
—উপন্যাস তো কম লিখিনি। এ মুহূর্তে ঠিক সেভাবে বলতে পারব না। তবে কাবিলের বোন, উপমহাদেশ এগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এবং সে সময়ের বাস্তবতা যতদূর সম্ভব এ দু’টি উপন্যাসে পাওয়া যাবে। ‘আগুনের মেয়ে’ কিংবা এরকম আরও কিছু উপন্যাস আমি লিখেছি সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ষ আপনার অনবদ্য সব ছড়া নিয়ে কিছু বলুন। আপনি তো ছড়াকে কবিতা থেকে কখনও আলাদা করে দেখেননি।
—না, দেখিনি। ছড়া তো কবিতাই। আমার একটা ছড়াসমগ্রও বের হয়েছে। সব মিলিয়ে ছড়াও আমি কম লিখিনি।
ষ এবার আপনার যাপিত জীবন সম্পর্কে একটু বলুন। জীবনে কোন সময়টা বেশ সুখে কাটিয়েছেন।
—নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কোনো সময় কিছু ছিল না। সারা জীবন পরিশ্রম করতে হয়েছে।
ষ আপনার জীবনে তো বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছিল...
—বিশ্বাসের পরিবর্তন কথাটা ঠিক নয়। এটার নানা বিবর্তন ঘটেছে। এক সময় প্রগতিবাদে খুব আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
ষ সে সময় আপনার কোনো কোনো কাব্য পঙিক্ততে অবিশ্বাসের ছায়াপাতও ঘটেছিল মনে হয়। সোনালি কাবিনের একটি সনেটে লিখেছিলেন—‘মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস’।
—অবিশ্বাসের ছায়াপাত ঘটেছিল—কথাটা প্রায় তাই। কথাটা সত্যি। তখনকার বয়স কম ছিল তো। চিন্তা এতটা সুগঠিত ছিল না। (হাসলেন) তবে যাকে বলে ‘কাট নাস্তিক’—এটা আমি কোনো কালেই ছিলাম না।
ষ আপনি তো কয়েকটি ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাতসমুদ্র, কবি-শিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস।
—হ্যাঁ, পৃথিবীর অনেক দেশে আল্লাহর রহমতে আমর ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে কবিতার দেশ বলে যেসব দেশ পরিচিত, সেসব দেশ আমি ভ্রমণ করেছি। সেগুলোরই কিছু কিছু লিখেছি।
ষ আপনার সমসাময়িকদের অনেকের নামই এক সময় আপনার চেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল অনেকেই হারিয়ে গেছেন। আপনিও অনেক সময় তাদের অনেকের লেখনী-ক্ষমতার কথা বলেছেন। এমনটা কেন হলো?
—মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এখানে ভাগ্যকে মানতে হয়। একটা কথা আছে না—‘জীবন থাকলে পরাজিত হতে হয়’ এটা আমরা মানিনি। মানিনি বলেই হয়তো এতদূর এসেছি।
ষ আপনি তো সঙ্গীতের শহরে বেড়ে উঠেছেন। আপনার সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতা কিছু ঘটেছিল?
—আসলে মানুষ হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা সঙ্গীতে। আমাদের শহরটা শুধু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্য না, ওই ঘরানার প্রায় সবাই ছিলেন বাদ্যযন্ত্রবিদ। এঁরা বাজাতেন, তৈরি করতেন, বিক্রি করতেন, সাপ্লাই করতেন। এ উপমহাদেশে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম। আমার আসা-যাওয়ার রাস্তায় পড়ত আলাউদ্দিন খাঁর বাড়ি। ওই পরিবারের রাজা হোসেন খান ছিল আমার ক্লাসের বন্ধু। ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। এত বড় ওস্তাদ উপমহাদেশে খুব কমই দেখা গেছে।
ষ আপনার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র কোনটি?
—সারাজীবন সেতারই আমার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল।
ষ তো, এই সঙ্গীতের পরিবেশ থেকে সাহিত্যে এলেন কীভাবে?
—অল্প বয়সে বিস্তর সাহিত্য পড়েছি তো। সাহিত্যের প্রভাবটাই আমার মধ্যে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কবি হতে চেয়েছি, কবিই হয়েছি।
ষ সারাজীবন তো কলমের সঙ্গে কাটালেন। বেশ কিছু দিন ধরে কলম হাতে আর লিখতে পারছেন না। কবিতার পঙিক্ত নিশ্চয়ই এখনও বিদ্যুত্ তরঙ্গের মতো জেগে ওঠে আপনার মধ্যে। তখন কী করেন?
—একটা বিশেষ সময় আসে সব লেখকেরই। তিনি আর লিখতে পারেন না। আমি হাতে লিখতে না পারলেও নিয়মিতভাবে আমার সংবাদপত্রের কলামগুলো ডিকটেশন দিয়ে লিখে যাচ্ছি। যতদিন পারি, এভাবেই লিখে যাব। (কথা বলতে বলতে মনে হলো কবি ক্লান্তি অনুভব করছেন। আমরা ক্ষ্যান্ত দেয়ার কথা ভাবলাম।)
ষ এই বয়সে বর্তমান নাজুক শারীরিক অবস্থায়ও আপনি যে আমাদের এত সময় দিলেন, এ জন্য আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
—ধন্যবাদ তোমাদেরও।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন